বাংলা শিল্প-সাহিত্যের এক উর্বর ভূগোল হচ্ছে বৃহত্তর যশোর অঞ্চল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, এসএম সুলতান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, হোসেনউদ্দিন হোসেন, সুচন্দা, ববিতা, মৌসুমীর জন্ম বৃহত্তর যশোরে। নতুন প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা হচ্ছেন সুহিতা সুলতানা, খসরু পারভেজ, ম্যারিনা নাসরীন প্রমুখ। এটা গবেষকদের অনুসন্ধান করে দেখার বিষয় হতে পারে, কেন যশোর অঞ্চলে এত বেশি সংখ্যককবি-কথাসাহিত্যিক-চিত্রশিল্পী-অভিনয় শিল্পীর জন্ম হয়েছে। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক প্রকৃতি অথবা জলবায়ুর কোনো প্রভাব আছে কি না।
ম্যারিনা নাসরীন একজন সুপরিচিত হয়ে ওঠা কথাসাহিত্যিক। পেশা বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনা। তিনি মূলত ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। এযাবত তার প্রকাশিত উপন্যাস হচ্ছে: (১) জল ঘুঙুর , (২) ফিনিক্সের ডানা (৩) প্রেতাত্মার শহর। তার গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে (১) একটি প্রশ্নবিদ্ধ জন্ম (২) একজন হন্তারকের জবানবন্দী (৩) দ (৪) মৃত্যুঞ্জয় ঘাট (৫) জন্মভিটে (৬) শ্রাবণদিনের ভোর ও আমার সন্তানেরা। ম্যারিনা নাসরীনের সৃষ্টির সঙ্গে তার যাপিত জীবনাভিজ্ঞতার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। ম্যারিনা নাসরীনের জন্ম মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাগরদাঁড়ি গ্রামে। সেদিক থেকে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভৌগোলিক উত্তরসূরি। একই গ্রামে জন্ম দুজনের। তবে লেখালেখির ক্ষেত্র কিছুটা আলাদা।
মধুসূদন মহাকবি এবং মূলত কবি-নাট্যকার। ম্যারিনা নাসরীন মূলত কথাসাহিত্যক। যদিও মাঝে মাঝে দুচারটি কবিতাও লিখে থাকেন। ম্যারিনা নাসরীনের শৈশব থেকে শিক্ষাজীবন সবটাই কেটেছে যশোরে। অতপর চাকরির-সূত্রে বসবাস করে এসেছেন ময়মনসিংহ শহরে। পারিবারিক অবস্থান ঢাকায়। তবে স্বামীর বদলির কর্মস্থল হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মাঝে মাঝে থেকেছেন। ঘুরে এসেছেন বিদেশও। তার এমনতর জীবনাভিজ্ঞতা তাকে নানাবিধ মানুষের সঙ্গে এবং নানা অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেলামেশার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে করে তার জীবনাভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে, জীবন ও জগৎকে দেখার দৃষ্টি একইসঙ্গে শানিত, দূরগামী, সূক্ষ্ণ ও প্রসারিত হয়েছে। একজন কথাসাহিত্যেকের সৃষ্টিশীল কাজের জন্য এ ধরনের অভিজ্ঞতা খুবই উপকারী হয়ে থাকে।
অবশ্য এখন ছোটগল্পে গল্প না থাকলেও চলে বলে নবীন লিখিয়েরা ফতোয়া দিয়ে থাকেন মাঝে মাঝে। তাদের ফতোয়া সঠিক হলে বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতার কোনো মূল্য থাকবে না কথা কথাসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে। কিন্তু বাংলা ছোটগল্প এখনও ততোটা গল্পহীন হয়ে যায়নি। যাদের ছোটগল্পে এখনো গল্প রয়ে যায়, তাদের একজন হচ্ছেন ম্যারিনা নাসরীন। তিনি ছোটগল্পের বিবর্তন মনে রেখেই গল্প লেখেন কিন্তু পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যান না সবখানি। তিনি ছোটগল্পের মধ্যে এক বা একাধিক গল্প রেখে সেটাকে উপস্থাপন করেন, কখনো পরাবাস্তবতার আড়াল দিয়ে, কখনো প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে, কখনো বা পরীক্ষামূলক ভিত্তিতে নতুন ধরনের আখ্যানধর্মিতা নির্মাণ করে।
ম্যারিনা নাসরীনের মধ্যে দুটো পরস্পর বিরোধী গুণের সমাবেশ ও সংশ্লেষ ঘটেছে। তিনি পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদ প্রযোজিত বিশ্বায়িত দুনিয়া সম্পর্কে খুঁটিনাটি ওয়াকিফহাল ও বাস্তবতাঘেঁষে সংবেদনশীল এবং তার মধ্যে সতত ক্রিয়াশীল একটি কবিমন। তার রচনায় দুটি বিপরীতমুখী প্রবণতার সমাবেশ ঘটেছে, সংঘর্ষ হয়েছে এবং কখনোবা অবিচ্ছেদ্য সংশ্লেষ ঘটেছে। তিনি গল্পের আঙ্গিক নির্মাণ এবং তার বিবর্তিত অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থেকেই গল্প নির্মাণ করেছেন। কোনো কোনো গল্পে নিরীক্ষাধর্মিতার ছোঁয়া লেগেছে। তবে তিনি কোনো অবস্থাতেই বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্করহিত নিরীক্ষাবিলাসী গল্প রচনা করেননি। বিষয় হিসেবে তার গল্পে প্রাধান্য লাভ করেছে মা ও মাতৃত্ব, উচ্চশিক্ষিত উঁচু শ্রেণীর মানুষের দাম্পত্যজীবনের অবিশ্বস্ততা, ভাঙন, রাজনীতি-রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বত্র মূল্যবোধের ধস, লেখকের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন, নারী স্বাধীনতা, নর-নারীর জটিল মনস্তত্ব, মানবজীবনে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া প্রযুক্তি বিপ্লবের প্রভাব, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি।
ম্যারিনা নাসরীনের একটি অনিন্দ্যসুন্দর গল্পের নাম ‘ছাতিমফুলের ঘ্রাণ’। দারুণ মিষ্টি একটি গল্প। কিন্তু সেই মিষ্টতার আড়ালে গভীর বেদনার কঠিন স্বাদ। মফস্বল শহরের দুজন যুবক যুবতীর প্রেম এবং একজন মেধাবী গরিব যুবতীর এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে এলাকার মানুষকে উদারভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া স্বপ্ন গল্পের বিষয়বস্তু। ছাতিমগাছ একটি কিংবদন্তী সমৃদ্ধ গাছ, যার ইংরেজি নাম ডেভিলস ট্রি বা শয়তানের বৃক্ষ। দারিদ্র্য ও পুরুষশাসিত সমাজ মেধাবী বালিকা-কিশোরীর ন্যায্য স্বপ্ন কিভাবে ধ্বংস করে তাকে অসফল জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তা শৈল্পিক দক্ষতায় তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। ছোটগল্পটিতে আছে রোমান্টিক দৃশ্য, ধর্মীয় ভেদাভেদে সহাবস্থানকারী সমাজব্যবস্থা, যাত্রাপালা অনুষ্ঠান, গার্মেন্টস থেকে যাত্রাপালার প্রিন্সে হওয়ার ছবি। ম্যারিনা এত নিখুঁতভাবে দৃশ্যগুলো ধারণ করেছেন যে, পড়ার সময় কখনো কোনো দৃশ্য বা ঘটনাকে অসম্ভব কিংবা অবাস্তব অথবা বেখাপ্পা মনে হয় না। তিনি যাত্রাপালার একটি আসরের বর্ণনা দিয়েছেন এতটাই বাস্তব-নিবিড়তায় যে, আমার যাত্রা দেখায় অভিজ্ঞ মন তা পড়তে পড়তে ফিরে গেছে ফেলে আসা যাত্রা দেখা দিনগুলোতে।
গল্পটি বলার এবং ঘটনা সন্নিবেশনের ধরন এতটাই বাস্তব ঘেঁষা যে তার কোনো অংশকেই আরোপিত অথবা অতিরঞ্জিত মনে হয় না। গল্পটি সময়কে অতিক্রম করে চিরকালের শিল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়ার যাবতীয় গুণ ধারণ করেছে গঠনে ও প্রাণে, মেধায় ও মেজাজে।
গল্পটির নামকরণ অসাধারণ ব্যঞ্জনাময়। নানাদিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মফস্বল এলাকার একজন কিশোরীর প্রেম করা কিংবা কোনো দরিদ্র মেধাবী কিশোরীর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া একদিকে ছাতিমফুলের ঘ্রাণের মতই মোহময়, অন্যদিকে তা শয়তানের পরিচালনায় ভ্রান্তি ও অসাফল্যের গহ্বরে পতিত হওয়ার নিয়তিতে বাঁধা। কিন্তু তারপরও ছাতিমফুলের ঘ্রাণ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না কোনো কোনো জীবনে। গল্পটির নাম ছাতিমফুলের ঘ্রাণ ছাড়া অন্যকিছু হতে পারে কি না তা এখন কল্পনা করতে গেলে নেতিবাচক উত্তর আসে মাথায়।
ম্যারিনা নাসরীন ঠিক নারীবাদী সাহিত্যিক নন কিন্তু গভীরভাবে জেন্ডার সচেতন শিল্পী। তিনি চলনে বলনে কথাবার্তায় পোশাক পরিচ্ছদে একজন সাহসী আধুনিক মানুষ। তিনি তসলিমা নাসরীনদের মতো নারীর অধিকার নিয়ে খোলামেলাভাবে নিরন্তর হৈচৈ করেন না কিন্তু যখনই বিশ্বের কোথাও নারীর ওপর নতুন করে বড় ধরনের আঘাত আসে , তিনি তার কঠিন প্রতিবাদ করেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বদলে নারীতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চান না। তিনি চান নারী পুরষের সাম্যবাদী জীবন ব্যবস্থা যেখানে উভয়েই মানুষ হিসেবে সমান স্বীকৃতি, সম্মান, অধিকার ও সুযোগ নিয়ে বসবাস করবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে নারীপুরুষ উভয়ের যৌথ বসবাসের প্রেমশাসিত উঠোন। পুরুষের বৈষম্যমূলক অন্যায় আধিপত্য আর মেনে নেয়া নয়। কিন্তু প্রযুক্তির প্রচলন ও প্রসার, কর্ম উপলক্ষে নারীর বাইরে আসা প্রভৃতি ইতিবাচক ঘটনার পার্শ্বফল হিসেবে নারী-পুরুষের দাম্পত্যজীবনে ভাঙন ধরছে আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং তা সামগ্রিকভাবে পারিবারিক জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে। এটা কাম্য নয় অথচ অনিবার্য গতিতে ঘটে চলেছে।
ম্যারিনা নাসরীন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এবং শৈল্পিক সুচারুতায় বিষয়টিকে গল্প করে তুলেছেন। তার সেই গল্পের নাম ‘চিত্রটি মুছে যাক্’। কিন্তু ঘটনার সরল বর্ণনা নয়, ম্যারিনা নানাবিধ শৈল্পিক মোড় রচনা করে মোড়ে মোড়ে তুলে ধরেছেন এসময়ের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর মনস্তত্ত্ব, অপ্রকাশিত অসহায়ত্ব, স্বাধীনতা ও সংসারের মধ্যে টানপোড়েন, পুরুষের ধূর্ত ও শীতল অবিশ্বস্ততা এবং সর্বোপরি এসব ভাঙনকবলিত পরিবারের সন্তানদের সমস্যা ও মনোবেদনার ছবি। ম্যারিনা নির্মোহ ভাষার তুলিতে এঁকেছেন এসব ছবি কিন্তু তারপরও অবিশ্বস্ততা বিরোধী একটা শুভকামনার ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে তার গল্পের প্রাণে।
ম্যারিনা নাসরীন একজন জীবনধর্মী সুদক্ষ কথাশিল্পী। তিনি অর্থহীন কোনো গল্প রচনা করেন না। জীবন ও জগত তার সৃষ্টির ভূমি ও মাঠ। কিন্তু তিনি জীবনের জন্য শিল্প এমন তত্ত্বেও আটকে থাকেন না সবসময় অথবা সবখানি। তিনি জীবনের জন্যই লেখেন কিন্তু তার লেখনীকে চালিত করে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্ব। বিষয়টি শুনতে খটকা লাগার মতো কিন্তু সত্য। তার গল্পগুলো সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সিনেমার মতো। প্রতিটি দৃশ্য মাপা কিন্তু সাবলীল ও স্বাভাবিক। তিনি যখন পরাবাস্তবতার অথবা নিবিড় কল্পনার ছোঁয়া ও ছায়া দিয়ে গল্প রচনা করেন, তখনো সেখানে বাস্তব ও কল্পনার হরগৌরী মিলন ঘটে। তার গল্পের কল্পনা থেকে বাস্তবকে আলাদা করা যায় না; বাস্তব থেকে কল্পনাটুকু মুছে ফেলতে গেলে অনুমোদন মেলে না। তিনি কল্পনা ও বাস্তবের দাঁড়িপাল্লা অথবা গজফিতা হাতে নিয়ে এ কাজ করেন বলেও মনে হয় না। এটা মূলত তার সহজাত সৃজনক্ষমতার ফল অথবা ফসল। হয়তো বা লিখতে লিখতে সেই সহজাত ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্জিত শৈল্পিক ভাবনাজাত কৌশল।
তার একটি গল্প পড়া শেষ হলে আরেকটি গল্প পড়ার পিপাসা জাগে তাৎক্ষণিকভাবেই। এমন আকর্ষণক্ষমতা তার ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান শক্তি যা এসময়ের অনেকের ছোটগল্পে অনুপস্থিত। তার গল্পের ভাষা আধুনিক কবিতার মতো নিয়ন্ত্রিত অথচ সাবলীল; ছোট ছোট গদ্যের শরীরে তিনি সঞ্চারিত করেন কবিতার অনিঃশেষ প্রাণরস। তার গল্পে আবেগ আছে, সংবেদনশীলতার নিবিড় ছোঁয়া আছে কিন্তু সেসবের তারল্য নেই। তিনি ছোট ছোট বাক্যে রচনা করেন গভীর ব্যঞ্জনাগর্ভ উদ্ভাসন। আপন সৃষ্টিকে সর্বোতভাবে এবং সর্বত্র প্রাণবন্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিহার করে চলেন সবধরনের স্থূলতা ও আতিশয্য। প্রকৃতির নিবিড় পাঠ তার করায়ত্ব। এই পাঠ তিনি তার গল্পে রচনায় কাজে লাগান। তার গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে প্রকৃতির সবুজতা, সরসতা, শ্যামলিমা ও সচ্ছলতা। ম্যারিনা নাসরীনের মনটি চির আধুনিক। প্রথার কিংবা ইজমের কোনো খাঁচা তার নয়। ম্যারিনা শিল্প সাহিত্য ভাষা রাজনীতি অর্থনীতি প্রভৃতি অঙ্গনে নিয়ত ঘটমান পরিবর্তন সম্পর্কে ষোল আনা ওয়াকিফহাল। তার চেয়েও বড় কথা নিজস্বতা অটুট রেখে প্রয়োজন মাফিক পরিবর্তনটুকু গ্রহণেও দ্বিধাহীন তিনি। তার গল্পের শহুরে চরিত্র নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারে: ‘শালা এই সিসি ক্যমেরার যন্ত্রণায় মানুষ আজকাল স্বাধীনভাবে সঙ্গমও করতে পারে না।’(এই শহরে/ শ্রাবণদিনের ভোর ও আমার সন্তানেরা)। এমত উচ্চারণ কোনো সস্তা স্টানবাজি নয়, এটা এই সময়ের বাস্তবতার সময়োচিত রূপায়ন।
‘এই শহরে’ গল্পটি পাঠ করতে করতে মনে হয়েছে এসকসময় শামসুর রাহমানের দেখা ঢাকা শহর অথবা মুনতাসির মামুনের লেখায় উঠে আসা ঢাকা শহর নানা দিক থেকে বদলে গিয়ে আজ নষ্টামির রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যার অধিক্য, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধার অভাবের প্রকটতা আর দূষিত রাজনীতির সহায়তাপুষ্ট কতিপয় নীতিহীন পেশাজীবী শ্রেণির যা ইচ্ছে তাই করার অলিখিত সুযোগ ও অধিকার সাধারণ মানুষের জীবনকে উপহার দিয়েছে এক জীবন্ত নরক যেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায় গুণতিতে সংখ্যালঘু সৃজনশীল ও সংবেদনশীল আত্মাগুলো। কোনো ডায়ালগ নেই, লেখকই বলেছেন সবকথা। গল্পটি আকারে ছোটো, আটসাট ও স্মার্ট। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়, এক নিঃশ্বাসেই পড়তে হয়। কিন্তু পড়া শেষ হওয়ার পর মাথা ঘুরতে বসে।
টনটন করে বিবেকী সংবেদনশীলতা। হুমায়ূন আজাদের কথা ধার করে বলতে ইচ্ছে করে ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?’ অথচ গল্পটি কোনো বিবৃতি নয়, রঙমেশানো কোনো ক্রাইম রিপোর্ট নয়। সবটুকু শৈল্পিক সুচারুতায় ও সৌন্দর্যে নির্মিত একটি ক্ষুদ্রাবয়ব ছোটগল্প। সেই ক্ষুদ্র শরীরেই বিন্যস্ত ঘটনার আড়ালে অজস্র ঘটনার পাহাড়, উচ্চারিত কথার শেষে অনেক অনুচ্চারিত বাক্য, খানিক প্রকাশের পোশাকে অনেকখানি অপ্রকাশের শরীর। গল্পের উপসংহারটি ঠিক ‘শেষ হয়ে হইলো না শেষ’-এর মতো নয় বরং হৃদয়মনকে আলোড়িত ও মথিত করে তোলার ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। ‘এমনিতে রাজ্যের জ্যাম। তার ওপর বাসটি দুমিনিট পরপর থামছে, যাত্রী তুলছে। পনেরো ষোলো বছরের হেলপার ছেলেটি রাস্তা থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে মানুষের ভেতর মানুষ গুঁজে দিচ্ছে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগিয়ে বাসটি যাত্রাবাড়ী পৌঁছুল। স্টপেজে নামতে যাচ্ছিল মুরাদ। পেছন থেকে কোন এক যাত্রীর ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রাস্তায়। মুরাদ দেখতে পায় ব্যাগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে মস্তকটি। আর চারপাশ থেকে ছুটে আসছে দু-কোটির শহর।
মুরাদ কোনো দিকে না তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়। দৌড়াতেই থাকে। যেকোনো মূল্যে এই শহরের বাইরে তাকে পালাতে হবে। যদিও সে নীলার খুনি নয়। অনেক দুপুরের নির্জনতা নীলা আসিফকে দিয়েছে জানার পরেও সে নীলাকে খুন করেন। হ্যালুসিনেশনটা বেড়েছে কেবল। মুরাদের মনে হয় এই শহরটিই নীলার খুনি। অথচ মুরাদের জীবনের সব কবিতা ছিল এই শহর আর প্রিয় নীলাকে ঘিরে।’
আজকাল শহর মানেই পুলিশের দাপট। বলা চলে শহর সংস্কৃতি মানে পুলিশ শাসিত সংস্কৃতি। বাংলাদেশে দিনদিন বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতার মাত্রা ও হার ; পুলিশ বিভাগ এই অপরাধ দমনের কাজে নিয়োজিত। কিন্তু তাদের একটা অংশ জড়িয়ে যাচ্ছে অপরাধ সংঘটনে। তাদের সঙ্গে জড়িত থাকে ক্ষমতা আর অর্থ হাতে গডফাদারগণ। ম্যারিনা এই গল্পে সেই চিত্র তুলে ধরেছেন নিখুঁঁতভাবে যা বাস্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করে। ম্যারিনার ‘এই শহরে’ গল্পটি পড়ার পর আমার বারবার মনে পড়ছিল আল মাহমুদের বিষ্ময়কর সৃষ্টি ‘ মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতাটির কথা যেখানে রয়েছে এক কবির অন্যায়, অবিচার, লোভ , হিংসায় আকীর্ণ হয়ে ওঠা রাজধানীর ধ্বংসকামনায় শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত পুরাতন কামানের নাভিতে আগুন দিয়ে ন্যায়বিচারের নির্দেশনামা আসমানী কিতাব বুকে নিয়ে শহর ছেড়ে পালাতে মনস্থিরকরণের শিহরণ জাগানিয়া ছবি। কাকতালীয়ভাবে হলেও ম্যারিনার এই গল্পের নায়কও একজন সংবেদনশীল ন্যায়পরায়ণ কবি।
ম্যারিনা নাসরীন তার বেশ কিছু গল্পে বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেতে চেয়েছেন। ‘সেই অপরাজিতা’, ‘ নীতি অথবা বনলতা সেন’, ‘একটি আপাত অসমাপ্ত গল্প’, ‘কাগজের বউ’, ‘সফেদ আলীর মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা’ প্রভৃতি গল্পে তার সেই নিরীক্ষাপ্রবণ মনের পরিচয় ফুটে উঠেছে। ‘সেই অপরাজিত’ গল্পটি একজন ঔপন্যাসিকের লেখকজীবন এবং পারিবারিক জীবন নিয়ে। একজন ঔপন্যাসিক অথবা বৃহত্তর ব্যঞ্জনায় বললে লেখকের কি কোনো নৈতিকতা থাকতে পারে? লেখক কি উদ্দেশ্যে লিখে থাকেন? বিখ্যাত হওয়ার জন্য? অর্থ উপার্জন করে বড়লোক হওয়ার জন্য? সেলিব্রেটি হওয়ার জন্য? সমাজের প্রতি, সমাজের বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর প্রতি লেখকের কি কোনো দায়দায়িত্ব থাকা সমীচীন? লেখক কি পাঠকের রুচির কথা মনে রেখে লেখে? নাকি সুরুচিসম্পন্ন বিদগ্ধ পাঠকশ্রেণি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লেখকের কোনো দায় আছে? এসব প্রশ্ন উসকে দিতে ম্যারিনা রচনা করেছেন ‘ সেই অপরাজিতা’ শিরোনামের নতুন স্বাদের গল্পটি। লেখক গালিব, তার বউ সায়মা এবং উপন্যাসের নায়িকা অপরাজিতা মূলত এই তিনটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছে গল্পটি।
অপরাজিতা চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে কল্পনা আর পরাবাস্তবতার আলো-আঁধারি মিশিয়ে। গালিব এবং অপরাজিতার মুখ দিয়ে লেখক বহু কথা বলিয়েছেন কিন্তু নিজে কোনো পক্ষ নেননি। একজন লেখকের অন্তর্লোক জানার কৌতূহল যাদের তারা এই গল্প পড়ে বেশি আনন্দ পাবেন। গল্পের ঘটনাসমূহ বাস্তবে হুবহু সেভাবে ঘটে কি না সেই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক কিন্তু ম্যারিনা কল্পনা ও বাস্তবকে এমনভাবে একাকার করে পরিবেশন করেছেন যে তাকে অস্বীকার অথবা উপেক্ষা করা পাঠকের সম্ভব নয়। একটি শক্তিশালী ছোটগল্প হিসেবে ‘সেই অপরাজিতা’ টিকে রইবে দীর্ঘকাল। ‘নীতি অথবা বনলতা সেন’ গল্পটির রচনার আড়ালে ও ভেতরে লুকিয়ে আছে ম্যারিনা নাসরীনের কবিমন। নিবিড়ভাবে সংবেদনশীল মানুষরা খুব বেশি সুখী হতে পারে না; কারণ তাদের যা আছে এবং নিজেরা যা তা নিয়ে আত্মতৃপ্ত থাকতে চায় না তারা, পারে না। তাদের মনের পাখা রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ কবিতার বলাকার ডানার মতো। আর তাদের মনে নিত্য দ্বন্দ্ব রচনা করে রাখে বাস্তব আর কল্পনা। জীবনানন্দ দাশের অমর সৃষ্টি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিও কল্পনা ও বাস্তবের মাঝখানে পড়ে আছে অমীমাংসিত অবস্থায়। সমালোচক গবেষকগণ একমত হতে পারেননি বনলতা সেন আসলে কি কোনো বাস্তবের নারী ছিল নাকি তা শুধু অতৃপ্ত জীবনে অতিষ্ঠ জীবনানন্দের অনুকূল কল্পনার চিন্ময় অস্তিত্ব মাত্র।
ম্যারিনার গল্পের নায়িকা নীতি নিজে একসময় কবিতা লিখতো এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভীষণ ভক্ত ছিল সে। কিন্তু বিয়ের পর তার স্বামী রাইসুল বাধ সঙ্গে সবকিছুতে। নীতি একসময় হ্যালুসিনেশনের শিকারে পরিণত হয়। ঈশ্বরদী জংশনে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে কথা হয় তার কুয়াশার ভেতরে মুখোমুখী। একদিকে পরিবারের লোকজনের আহ্বান অন্যদিকে জীবনানন্দ দাশের। এই অবস্থায় শেষ হয়ে যায় গল্প। নীতি আর বনলতা সেন হয়ে যায় একাকার। নীতি আর সংসারে ফিরে এসেছিল নাকি ট্রেনের নিচে পড়ে মারা গিয়েছিল সে পর্যন্ত যাননি ঔপন্যাসিক।
কুয়াশামাখা আলো-আঁধারিতে পাঠককে রেখে গল্পের শেষ টেনে দিয়েছেন। নীতি কোনো সাধারণ চরিত্র নয়, এমনকি তাকে পুরোপুরি স্বাভাবিক চরিত্র বলাটাও কঠিন। কবি এবং নীরস সংসারের মধ্যকার মীমাংসাহীন দ্বন্দ্বই এই গল্পের মূল থিম। নানা নাটকীয়তা, সাসপেন্স আর রহস্যময়তায় ঠাসা গল্পটি ম্যারিনা নাসরীনের কল্পনা শক্তি, প্রকাশ ক্ষমতা ও কবিতাপ্রেমের এক ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল উদাহরণ। সক্রিয়ভাবে একজন সচেতন ও সোচ্চার নারী হিসেবে ম্যারিনা তার গল্পে উপন্যাসে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কামুকতা ও লাম্পট্য, শোষণ, নিপীড়ন এবং এসময়ের নারীর প্রতিবাদী হয়ে ওঠার ছবি এঁকেছেন তার ‘কাগজের বউ’ নামক ছোটগল্পে। একজন খেটে খাওয়া নারীর শরীরমনের চাহিদা এবং শোষণকারী পুরুষের বিরুদ্ধে শেষাবধি গর্জে ওঠার চমৎকার কাহিনী রয়েছে গল্পটিতে। গল্পটি একারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে গল্পের নায়িকা মজিলা কোনো শিক্ষিত নারী নয়, সমাজের উঁচু তলার নারীও নয়। সে একজন খেটে খাওয়া শ্রমিক। এই শ্রেণির নারীরাই বেশি শোষিত ও নিপীড়িত । তার প্রতিবাদ ও প্রতিশোধ গ্রহণ তাই ব্যতিক্রমী ও অনন্যসাধারণ।
জাদুমাখা ব্যঞ্জনায় ও ভাষায় রচিত ম্যারিনার আরেকটি গল্পের নাম ‘চিরকুট’। গালিব, তার বাবা সরকার আজমত , গালিবের ফুফাতো বোন মঞ্জুরী, গালিবের মা এবং রহস্যময়তায় মোড়ানো একটি বাড়ি। খানদানী অথচ অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা টানাপোড়েন কবলিত প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের পারিবারিক দাপট, কঠোর নীতিপরায়ণতা, অন্যদিকে একজন উড়নচ-ী কিশোর গালিবের লেখাপড়ায় ব্যর্থ হয়ে বাড়ি থেকে মালেশিয়া পালানো , টাকা উপার্জন, অনেকবছর পর বাড়ি ফেরা। ততদিনে বাবা-মা সবাই মৃত, বাড়িটি মঞ্জুরীর বাবার কাছে বিক্রয় হয়ে যাওয়া এবং তিরিশোত্তর পর্বে উত্তীর্ণ মঞ্জুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, মিলন এবং বাবার রেখে যাওয়া ট্রাংকের তালা ভেঙে তার রহস্য উদ্ধার এইসব নিয়ে গল্পটি। পুরো গল্পটি শিহরণ আর সাসপেন্সে ভরা। গালিব যখন ফেরে বাড়িটিতে তখন ঘন সন্ধ্যা, গা ছমছম ভূতুড়ে পরিবেশ, সেখানে সহসায় মঞ্জুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ।
তার সঙ্গে আবেগে জড়িয়ে পড়া। শরীর জড়িয়ে শরীর। সিনেমাটিক দৃশ্যাবলি। গল্পটির উপসংহার নিবিড়ভাবে আকর্ষণীয় ও কাব্যময়। ‘গালিব নোটবুকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় । নোটবুকের প্রতিটা পাতার ফাঁকে একটা করে দশ টাকার নোট। উদ্ভ্রান্তের মতো পাতা উল্টায় গালিব। সারা জীবন বাবার কাছে হেরেছে গালিব। আজও হেরে গেল। মঞ্জুরী থেমে গিয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে প্রবল বেগে বাতাস ঢুকতে থাকে। বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে টাকার নোটগুলো ঘরময় উড়ছে। টাকা নয়, যেন প্রত্যেকটা নোট একেকটা চিরকুট। যেখানে বাবা ওর শৈশব লিখে রেখে গিয়েছেন। গালিব পাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে টাকাগুলো ধরতে চায় কিন্তু একটা টাকাও ধরতে পারে না।’ গল্পটির মাঝে অনেক পাঠকই তার ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরকে দেখতে পাবেন। জীবননিবিড় আখ্যান। কিন্তু তারচেয়েও গুরুতপূর্ণ হচ্ছে গল্পটি বলার আকর্ষণীয় ভঙ্গি এবং উপভোগ্য নাটকীয়তা নির্মাণ।
বাস্তব আর পরাবাস্তব মিলিয়ে নির্মিত একটি গল্পের নাম ‘সফেদ আলীর মৃত্যুসংক্রান্ত জটিলতা’। সাপের দংশনে মারা যায় সফেদ আালী। তার মৃত্যু অথবা বেঁচে থাকা, ওঝা, ইমাম এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের তৎপরতা আর মৃত চোখে সফেদ আলীর এসব অবলোকন গল্পটির নানাদিক। তবে মানুষের চরিত্র ও মনস্তত্ত্ব এই গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয়। গল্পকার খুবই আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে সম্মোহক ভাষায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন গল্পটি। গল্পটির ফিনিসিং দুর্দান্ত সুন্দর। ম্যারিনা নাসরীন গল্পের মূল ব্যক্তি সফেদ আলীর মন ও চরিত্র দুটোই উন্মোচন করেছেন কৌশলী হাতে। একটি অনুচ্ছেদে তা চূড়ান্ত ব্যঞ্জনা ধারণ করেছে। মৃত সফেদ আলীকে নিয়ে অনুচ্ছেদটি এরকম: ‘বারান্দায় লোহার টেবিলে সফেদ আলীকে শোয়ানো হয়েছে। পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়ে তার শরীরের ওপর ঝুঁকে কিসব যন্ত্র লাগিয়ে পরীক্ষা করছে। মেয়েটির শরীর থেকে অদ্ভুত সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। আলতা বানুর শরীরের থেকেও অনেক বেশি নেশা এই ঘ্রাণে। সফেদ আলীর মনে হলো, মরার পর এই একটা লাভ হলো, জানতে পারলো সব মেয়ের শরীরেই আলাদা ঘ্রাণ থাকে। সে সিদ্ধান্ত নিল বারেক ওঝা যদি তাকে বাঁচাতে পারে তবে সে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করবে। মুসলমান পুরুষ, চারটে বিয়ে করতে পারে। আর তার টাকা-পয়সারও অভাব নেই। কিছুসময় পরীক্ষার পর মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলল, স্যরি, অনেক অগেই মারা গিয়েছেন। আপনারা আগে নিয়ে এলেন না কেন?’
পুরুষদের একটা বড় অংশ এতটাই কামুক স্বভাবের হয়, এতটাই বহুগামী যে মৃত্যুর পর তার লাশ সেসব করার স্বপ্নে বিভোর হয়। ম্যারিনা এই গল্পে ধোলাই করে ছেড়েছেন পুরুষদের কিন্ত সবচেয়ে বড় কথা শিল্পের ধর্ম কোথাও ব্যাহত হয়নি। লেখক হিসেবে এটা তার প্রবল শক্তিমত্তার স্বাক্ষর বহন করে।
ম্যারিনার আরেকটি শিল্পসম্মত চমৎকার গল্প ‘আগন্তুক’। মন জাগানো সাসপেন্স, চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা বিন্যাস, মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি গুঁজে দেওয়া বর্ণনার ভাঁজে ভাঁজে ইত্যাদি গল্পটিকে মোহনীয় মহিমা দান করেছে। সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে গল্পে কমরেড শাফায়াত চরিত্রটিকে হাজির করা হয়েছে পরাবাস্তবতার আলো-আঁধারি মাখিয়ে। গল্পটির কেন্দ্রীয় থিম হচ্ছে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির ক্রম অধঃপতনের ছবি । ম্যারিনা নিজে বাম রাজনীতির বিপক্ষে থাকেননি; তিনি শুধু বাম রাজনীতির পতন এবং তার পেছনের কারণের দিকগুলো তুলে ধরেছেন নির্মোহ মন ও ভঙ্গি নিয়ে। এই গল্পটির ভেতরে বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের হাজার হাজার মানুষ তাদের রাজনীতিলগ্ন যৌবনের দিনগুলোর চিত্র দেখতে পাবেন।
গল্পটির নাম ‘আগন্তুক’ হওয়ার পেছনে কারণ হয়তোবা এই যে কমরেড শাফায়াত অনেক বছর আগেই নিহত হওয়ায় তাকে পরাবাস্তবতার জামা পরিয়ে আনা হয়েছে যাকে চেনে না এই প্রজন্মের মানুষজন। অথবা এমনটা হতে পারে যে, অতীতে ভ্রান্ত নেতৃত্বে পরিচালিত বাম রাজনীতির অংশীদার মানুষদের একটা বড় অংশ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে , তাদের আত্মাগুলো আগন্তুক হয়ে এসে কড়া নাড়ছে এসময়ের মানুষের বিবেকের দ্বারে। বিবিধ ব্যঞ্জনার সম্ভাবনায় ঋদ্ধ নামকরণটি নিঃসন্দেহে অনিন্দ্যসুন্দর। ম্যারিনা কত নিবিড়ভাবে রাজনীতি সচেতন, এই গল্পটি তারই সোনালি স্বাক্ষর বহন করে। ‘আগন্তুক’ গল্পটির মতো না হলেও অনুরূপ রাজনীতি সচেতনতাধর্মী আরেকটি উৎকৃষ্ট গল্প ‘করোটি’। এই গল্পে বাম রাজনীতির কথা আছে, রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়া আত্মকেন্দ্রিক মানুষের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার কথা আছে। চরমভাবে আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ফয়সাল কৌশল করে বাম রাজনীতিতে প্রবেশ করে ত্যাগী ও খাঁটি যুবনেতা বিভাসকে হত্যা করায় পুলিশের এনকাউন্টারে; অতঃপর দখল করে করে নেয় নিহত বিভাসের প্রেয়সী কর্মী সুজাতাকে। বিয়ে করে। সংসারী হয়। কিন্তু সুজাতার ভাবনায় ও ভালোবাসায়, তার স্বপ্নে ও অনুভবে রাজত্ব করে যায় বিভাসের প্রেম।
ঈর্ষায় ও ব্যর্থতা বোধে জ্বলতে থাকা ফয়সাল শেষতক সুজাতাকে অসাধু ডাক্তরদের সহায়তা নিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ত্যাগ, লোভ, ঈর্ষা, নিষ্ঠুরতা, প্রেম, অপ্রেম সবকিছু মিলিয়ে এক সমৃদ্ধ ভাবনার গল্প ‘করোটি’। পৃথিবীতে অধিকাংশ সমস্যার মূল যে মানুষের মগজ বা করোটি, এই গল্পে সেই ছবি ফুটে উঠেছে নিপুণভাবে। কিন্তু গল্পটি ভালো লাগার প্রধান কারণ ম্যারিনার গল্প বলার মুগ্ধতা সঞ্চারী ধরন ও কাব্যময় ভাষা। মানুষের হৃদয়িক দুর্বলতা, অন্তরঙ্গ টানাপোড়েন, যৌনতার আকর্ষণ এবং দুর্ভাগ্যের জয়ধ্বনি এসব নিয়ে একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন ম্যারিনা। জীবনসঙ্গিনীকে হারিয়ে একা ও অসহায় হয়ে পড়া একজন মাঝবয়েসী চিকিৎসক মানুষ ঘটনাচক্রে মুখোমুখি হয় তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে লুবনার রুমমেটের; নাম তার অনুপমা। অনুপমা তার প্রথম যৌবনের দুর্বার জোয়ারের ধাক্কায় প্রেমে পড়ে যায় বাবার বয়েসী সেই চিকিৎসকের। জানাজানি। অতঃপর চিকিৎসকের হার্টফেল করে করুণ মৃত্যু।
অনুপমার একাকী জীবন বেছে নেয়া এবং প্রবল ঘৃণাবশত লুবনার চিরকুমারী থেকে যাওয়া। লুবনার বাবা ডাঃ ফয়েজ চৌধুরী ব্যবহার করতেন একটি বিশেষ পারফিউম যা অনুপমাকে মাতোয়ারা করে দিতো। অথবা তা ছিল ফয়েজ চৌধুরীর পুরুষালী ঘ্রাণ। লুবনা বিয়ে করেনি কিন্তু বাবার সেই পারফিউম জড়িয়ে রাখে নিজ অস্তিত্বে। বহু বছর পর জীবনের পড়ন্ত বয়সে দেখা হয় লুবনা-অনুপমার। লুবনার কাছ থেকে বিচ্ছুরিত সেই পরিচিত ঘ্রাণ মাতোয়ারা করে দিতে চায় স্মৃতিতে জেগে ওঠা অনুপমাকে। অতঃপর ফ্ল্যাশব্যাক। চমৎকার এই গল্পটির নাম ‘পারফিউম’।
গল্পকার ম্যারিনা নাসরীন একজন নারী । এই গল্পে তিনি চিরাচরিত নারীসুলভ মনোভাবের ওপরে ওঠে অসম বয়েসী অসম সম্পর্কের দুজন নারীপুরুষের শারীরিক মানসিক চাহিদাকে উপস্থাপন করেছেন স্বাভাবিকত্বের রঙ ও মহিমা দিয়ে। সাহিত্যিক হিসেবে এটি তার অনন্যসাধারণত্বের পরিচয়জ্ঞাপক। গল্পটি বলার এবং ঘটনা সন্নিবেশনের ধরন এতটাই বাস্তব ঘেঁষা যে তার কোনো অংশকেই আরোপিত অথবা অতিরঞ্জিত মনে হয় না। গল্পটি সময়কে অতিক্রম করে চিরকালের শিল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়ার যাবতীয় গুণ ধারণ করেছে গঠনে ও প্রাণে, মেধায় ও মেজাজে।
বেপরোয়াভাবে সাহসী হওয়ায় তার ভাষা ছুঁয়ে ফেলে অফিস আদালতের মন, যৌনতার উল্লাস, আন্তর্জাতিক মারপ্যাচের ভেতর বাহির। আঞ্চলিক এবং প্রমিত উভয় ধরনের ভাষার ওপরই তার দখল ঈর্ষণীয়। বিশ্বায়ন প্রযোজিত প্রযুক্তিগত পরিভাষাসমূহ তার কলমের ডগায়। তিনি স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে উপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করেন। কোনো কৃত্রিমতা নেই তার ভাষায়।
ম্যারিনা যথেষ্ট রোমান্টিকতা লালন করেন ভাবনায় ও ভালোবাসায়। মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের প্রাঙ্গণে বসেও তিনি প্রেমের জয় দেখতে চান, দেখেন। তার ‘ সংযোগ’ নামক গল্পটি ভালোবাসার পরিশীলিত আবেগে ও টানাপোড়েনে নিবিড়ভাবে সমৃদ্ধ সৃষ্টি। গল্পটিতে তিনি ভালোবাসার তিনটি রূপ দেখিয়েছেন। বাংলাদেশী জনৈক শিক্ষিত যুবক কর্তৃক প্যারিসের একটি মেয়েকে ভালোবেসে তার দাবি মোতাবেক বাপ-মা-দেশ সবার সঙ্গে সম্পর্ক ও সংযোগ ছিন্নকরণ। তারই ছোট ভাই ইমরান কর্তৃক মা-বাবা-দেশের জন্য নিজের প্রেমের মুখে লাগাম পরিয়ে রাখা এবং ভালোবাসার পাত্র ইমরানের জন্য রেবতী নামক যুবতীর আশাহীন আশার বাতায়নে বসে পথ চেয়ে থাকা। প্রেমের বাতাবরণে রচিত গল্পটি মাল্টি ডাইমেনশনাল। গল্পটিকে ব্যঞ্জনার তুঙ্গে তুলেছে নামকরণ ‘সংযোগ’। ভালোবাসার মানুষ দূরে চলে গেলেও ভালোবাসার সঙ্গে সংযোগ রয়ে যায় সবার অলক্ষে, অঘোষিত সিদ্ধান্তে। এই গল্পটির উপসংহারও হৃদয়-মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো, দুলিয়ে দেওয়ার মতো। অনেক মিষ্টি একটি গল্প। গল্পের শেষে পাঠকের জন্য বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি। গল্পটি যারা পড়বেন, তাদের অধিকাংশেরই দারুণভাবে ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
‘জন্মভিটে’ ম্যারিনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প। জননী মানেই জন্মভূমি, জননীর শরীরই সন্তানের জন্মভিটে এমন দার্শনিক থিম নিয়ে গল্পটি। গল্পটিতে মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য এবং মা-সন্তানের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ এমন ভাবনা থেকে গল্পটি রচিত বলে মনে হয়। সেই ভাবনার জয় হয়েছে প্রথম থেকে শেষাবধি। তবে অপেক্ষাকৃত বৃহদায়নের এই গল্পটিতে পুরুষের অবিশ্বস্ততা ও কামুকতাময় বহুচারী স্বভাবের ছবি উঠে এসেছে পাশাপাশি। গল্পটিতে কিছুটা নারীবাদী ভাবনার ছায়া ও ছোঁয়া আছে। ‘বলিরেখা’ নামক গল্পটি চলমান সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্র প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, মাদক ব্যবসা, এনকাউন্টারে মানুষ হত্যা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রভৃতি উপকরণ ও উপাদান নিয়ে একটি শক্তিশালী সৃষ্টি। এই সময়ে আমাদের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রপ্রশাসন কেমন ছিল, তা একশ বছর পর জানতে হলে ম্যারিনার এই গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে ম্যারিনার উপস্থাপনা ভঙ্গির জাদুতে গল্পের প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি দৃশ্য বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নিবিড়ভাবে সমাজসচেতন ও মানবদরদী কথাসাহিত্যিক তার দুঃসাহসী কলমে লিখেছেন এই গল্প। একটা অংশ পাঠ করা যায়:
‘‘কাল রাতেও শাহজাদা মায়ের হাতটা মাথার নিচে দিয়ে পরম নির্ভরতায় ঘুমিয়েছিল। বজ্রপাতের মতো ডোর বেল বাজল। এত রাতে কে এলো ! ধড়ফড় করছিল শামিমার বুক। সাজু দরজা খুলেছিল। কালো পোশাকের মোচওয়ালা লোকটি গমগম কণ্ঠে বললো, ‘আমরা থানা থেকে এসেছি শাহজাদাকে অমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’
শাহজাদা যেতে চায়নি। বলেছিল সকালে যাবে। ওরা শুনলো না। সাজু দৌড়ে ওদের পিছু পিছু গিয়েছিল কিন্তু ততক্ষণে কালো রঙের গাড়িটি গো গো শব্দ করে এগিয়ে গেছে। রাতভর সাজু আর রবি এ থানা ও থানা দৌড়ে কোনো খোঁজ পায়নি। তাদের এক কথা, শাহজাদা নামের কাউকে থানায় আনা হয়নি। রাতের শেষ প্রহরে সাজুর কাছে ফোন এলো। নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে শাহজাদা মারা গেছে। লাশ শনাক্ত করতে যেতে হবে।
নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ? কার সঙ্গে, কোথায়? পলাশী বাজারের পেছনে অসমাপ্ত বিল্ডিংটির মেঝেতে শাহজাদা উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। পিঠ দিয়ে গুলি ঢুকে বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। দুহাতের কব্জিতে গভীর কালশিটে দাগ।
ভ্যানটি খুব আস্তে চলছে। লাশ টানতে টানতে লোকটি হয়ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই হাসপাতালেরর মর্গে কাটাছেঁড়ার জন্য আজ কত লাশ এলো কে জানে!
মর্গের সামনে শামিমা বসে থাকে। শামিমার কাছ থেকে দু’শো টাকা নিয়ে সাজু কাকে দিয়ে এলো। হয়ত ডোমকে। তাতে কি সুবিধে শামিমা জানে না। কখন যেন রবি এসে পাশে বসেছে। বিড়বিড় করছে,‘এনকাউন্টার হইছে বড়াপা, এনকাউন্টার। হিরণ কাউন্সিলর টাকা দিয়া করাইছে।’’
ম্যারিনা নাসরীনের ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ঘাট’ নির্মাণশৈলীর দিক থেকে একটি চমৎকার ছোটগল্প। শিহরন আর কল্পনার অদ্ভুত সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে গল্পটিতে। থিম হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র । তবে বিষয় হিসেবে এসব এখন অতিব্যবহারে অনেকটা ক্লিশে হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আরেকটি গল্পের নাম ‘মুখ’। গল্পটি অতিকল্পনার ফসল বলে মনে হয়েছে আমার। মুক্তিযুদ্ধে সবকিছু একরৈখিকভাবে ঘটেনি, সব দৃশ্য, সব চরিত্র একই রকমের ছিল না, এসব কথা আমরা কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচনার সময় প্রায়শ ভুলে যায়। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তাদের এসব নিয়ে সাহিত্য রচনার সময় আরও বেশি পড়াশোনা করা দরকার এবং প্রয়োজনে প্রত্যক্ষদর্শীদের সহায়তা গ্রহণ সমীচীন। মানোত্তীর্ণ বা কালজয়ী শিল্পসাহিত্যের জন্য কেবল ভাবনার অনুকূল আবেগনির্ভর উত্তেজনাকর প্লট আর পঙক্তি নির্মাণ যথেষ্ট নয়। আমরা হয়তো সেকারণেই আজ অবধি মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো কালজয়ী গল্প-উপন্যাস পাইনি।
ম্যারিনা নাসরীনের ছোটগল্পগুলো সমকালকে ধারণ করে রচিত। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের জীবনে ও জীবনযাপন প্রণালীতে, জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপে শহরগুলো হয়ে উঠেছে ঘিঞ্জি, বেড়েছে নানামুখী অপরাধপ্রবণতা, রাজনীতি, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা অঙ্গ, মানুষের রুচি ও চাহিদা, দাম্পত্য জীবনের ধরন, পারিবারিক মূল্যবোধ সবখানেই ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে এবং পরিবর্তনের ধারা বহমান। ম্যারিনা পরিবর্তিত ও পরিবর্তনশীল সময়ের ছবি এঁকেছেন তার কথাসাহিত্যের ক্যানভাসে। তিনি সমাজের বহিরাঙ্গের ছবি এঁকেছেন, একইসঙ্গে এঁকেছেন তার ভেতরের অন্তরঙ্গ ছবি। সেসব ছবির মাঝে একটা গতিশীলতা বিরাজমান । তিনি গল্পগুলোর পটভূমি হিসেবে চলমান সময়ের উঠোনকে বেছে নিয়েছেন , দুএকটি ক্ষেত্রে অতীতের ঘটনা হয়েছে পটভূমি কিন্তু গল্পের থিমগুলো চিরকালীন আবেদনে সমৃদ্ধ। মূলত মানুষের মন , মানসিকতা, মননশীলতা, আকর্ষণ, অনুরাগ, বিরাগ, প্রেম, ঘৃণা, সংশয়, উদারতা, স্বার্থপরতা, অর্থলিপ্সা, দোলাচল, কামুকতা, ল্যাম্পট্য প্রভৃতি তার গল্পে উদ্ভাসিত হয়েছে সেসব ছবির রঙে, রসে, ঘ্রাণে। এগুলো চিরকালীন বিষয়। ম্যারিনা তার গল্পগুলো লিখেছেন ভাষার কুহক মিশিয়ে এবং গল্পের পরতে পরতে ভাঁজে ভাঁজে শিল্পসৌন্দর্যের মুগ্ধতার রস সঞ্চার করে । ফলে গল্পগুলো ধারণ করেছে না-ফুরিয়ে যাওয়ার ঐশ্বর্য।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে ম্যারিনার বড় শক্তিটি হচ্ছে তার মোহময় ও মুগ্ধতা সঞ্চারী ভাষা। খটখটে নীরস নয়, তার ভাষা সপ্রাণ কাব্যরসঘন। বেপরোয়াভাবে সাহসী হওয়ায় তার ভাষা ছুঁয়ে ফেলে অফিস আদালতের মন, যৌনতার উল্লাস, আন্তর্জাতিক মারপ্যাচের ভেতর বাহির। আঞ্চলিক এবং প্রমিত উভয় ধরনের ভাষার ওপরই তার দখল ঈর্ষণীয়। বিশ্বায়ন প্রযোজিত প্রযুক্তিগত পরিভাষাসমূহ তার কলমের ডগায়। তিনি স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে উপযুক্ত ভাষা ব্যবহার করেন। কোনো কৃত্রিমতা নেই তার ভাষায়। বেখাপ্পা উচ্চারণ নেই কোথাও। বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাষার ব্যবহার তার গল্পগুলোকে সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠতে সফল সহায়তা দিয়েছে। তার গল্পের মাঝে গাঁজাখুরি কোনো কিছু আবিস্কারের অবকাশ নেই। ভারতে ট্রেনিং নিতে গিয়ে পালিয়ে আসা একজন বামপন্থী যুবকের মনের ভয় ও সংশয় তুলে ধরতে গিয়ে ম্যারিনা ব্যবহার করেন বাস্তবনিষ্ঠ সাহসী ভাষা যা পড়ামাত্র পাঠকের মনে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া স্থান করে নেয়: “ মাসুক দেশে ফিরে এলো। ফিরে আসার সময় সমাজ বদলে দেবার ভূতটাকে কুচবিহারেই নামিয়ে রেখে এলো। কিন্তু এসব কথা বাংলাদেশের কেউ জানে না। এমনকি মা পর্যন্ত নয়। তাহলে ইনি কে? কিভাবে জানলেন এত কথা! ‘র’ এর হাত অনেক লম্বা। অরুণ ধরা পড়ে ফাঁস করে দেয়নি তো সব?” (আগন্তুক, জন্মভিটে)।
ম্যারিনা নাসরীন কথাশিল্পী হিসেবে যতটা দক্ষ, তিনি তার সমান অথবা তারও বেশি মহৎপ্রাণ ও আলোকিত সত্তার অধিকারী একজন মানুষ। তার গল্প পাঠে যেমন তৃপ্তি পায় সাহিত্যপ্রেমী প্রাণ, তেমনি গল্পকারকে ঘিরে বেড়ে উঠতে চায় একটা সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
ম্যারিনার গল্পের ভাষা স্মার্ট। ছোট ছোট বাক্য। কথোপকথনে মুখের ভাষার জুতসই ব্যবহার। শহুরে মানুষের মুখের ভাষা শহরের লোকের মতো; বস্তির পাত্রপাত্রীর মুখের ভাষা বস্তির ভাষার অনুরূপ। খিস্তি খেউড়, যৌনতা বিষয়ক শব্দাবলি , অফিসের পরিভাষা, বন্ধুদের আড্ডার পরিভাষা, প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শব্দাবলি ও পরিভাষা সব ধরনের ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু কোথাও তা কৃত্রিমতায় আরোপিত ভাষা হয়ে ওঠেনি। ম্যারিনা কবিতাপ্রেমী মানুষ। সে কারণে তার বেশ কিছু ছোটগল্পে কবিতার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। অধিকন্তু তার গল্পের ভাষায় কবিতার রস ও গতিময়তা বিরাজমান। গদ্যের মাঝেও তিনি চমৎকার উপমা এবং চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু হাতে লাগাম রেখে। তিনি তার গদ্যকে কবিতা করে তোলেননি তবে কবিতার প্রাণময়তা গুণটি সঞ্চারিত করেছেন। তার ভাষা আধুনিক, স্মার্ট, কাব্যগুণে সমৃদ্ধ অথচ সাবলীল।
(ক)‘লে বাবা! মেয়েদের কণ্ঠ এত হার্স হয় নাকি?’(আগন্তুক, জন্মভিটে)।
(খ).‘তোমার বাপে লিজা আপারে বিয়া করছে। হ্যার বাবু হইব।’ (জন্মভিটে, জন্মভিটে)।
(গ) ‘আগের মতোই বিভাসের সঙ্গে আমার তুমুল তর্ক চলে। প্রেম, রাজনীতি, বর্তমানের কমিউনিজম। আমি বলি কোমরভাঙা কমিউনিজম। বিভাস ক্ষেপে ওঠে। ওর চব্বিশ বছরের বুদ্ধি আর আমার আটত্রিশ বছরের পরিণত অভিজ্ঞতায় কখনো কখনো ম্যাচ করে না। ও রাগী যুবকের মতো রেগে যায়। অভিমান করে বাচ্চাদের মতো। আমি কখনো প্রেমিকার শাসনে, কখনো মায়ের মমতায় মান ভাঙাই। আবার কখনো এমন হয়, অলস মোহময় মধ্যাহ্নে এক নিঃসঙ্গ নারী নির্মমভাবে চব্বিশ বছরের পুরুষটিকে পেতে চায়। ও আসুক আমাকে ভেঙে পুনঃনির্মাণ করুক। বিভাস আসে। ওর জাদুর ছেনির স্পর্শে বারবার পুনঃনির্মিত হয় আমার শ্যাওলা ধরা প্রাচীন ভাস্কর্য।’(করোটি, মৃত্যুঞ্জয় ঘাট)।
(ঘ) ‘আসিফের অফিস খুঁজে বের করতেই হবে। স্কুলে তেলবাজ হিসেবে পরিচিত ছিল আসিফ। নম্বরের জন্য সেই বয়সেই স্যারদেরকে নানাভাবে ম্যানেজ করে ফেলত। কাস্টমসের চাকুরিতে পাঁচ বছরে দেদার কামাই করেছে। চাকুরি ছেড়ে এখন এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা করে। নামকরা বিজনেস ম্যাগনেট, সিআইপি। বড়লোক বন্ধুরা গরিব বন্ধুদের পাত্তা না দিলেও সাগরেদ হিসেবে বেশ পছন্দ করে। মুরাদ আসিফের সাগরেদ টাইপের বন্ধু। সন্ধ্যাকালীন মদ্যপানের সাথি। মাঝেমধ্যে হাতে টান পড়লে দুই পাঁচ হাজার ছুড়ে দেয় মুরাদের দিকে। হাত ঘুরিয়ে ছত্রিশ-তেইশ-ছত্রিশ শেপ দেখিয়ে বলে চলবে? মুরাদের চলে না।’(এই শহরে, শ্রাবণদিনের ভোর ও আমার সন্তানেরা)।
(ঙ) ‘দেয়ালের গায়ে সহস্র মুহূর্ত হুহু করে গড়িয়ে যাচ্ছে। টেবিলের ওপাশে রিভলভিং চেয়ারটি ডিপ অলিভ ফোমে মোড়ানো। দারুণ অভিজাত! অথচ রাজার মতো একা।’ (করোটি, মৃত্যুঞ্জয় ঘাট)।
(চ) ‘মেয়েটি অবিরাম চলছিল। উল্লাস করতে থাকা অসংখ্য মাংসল শরীরের মধ্য দিয়ে সে ক্রমাগত ধূসর ভবিষ্যতের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল। পাড়ার পর পাড়া , শহরের পর শহর তার পায়ের স্পর্শে আসতে থাকে। তার উপস্থিতিতে বয়সের মধ্য ভাগের গুটিকয় নারীর পান খাওয়া বেড়ে যায়। ঠোঁটে রঙ চড়ে পরতের পর পরত। মেয়েটি হিমিকা, অলকা, বিশাখা বা আমিনা। বাংলাদেশ থেকে নৈনিতাল, সেখান থেকে কলকাতা। গুজরাট, পাঞ্জাব, নাসিক, লক্ষ্ণৌ।’(মৃন্ময়ী অথবা অন্য নামের মেয়েরা, মৃত্যুঞ্জয় ঘাট)।
(ছ) ‘ট্রেনের সিডিউল ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। এখন বাজে রাত নটা। দেওয়ানগঞ্জ জংশনে কি একটা ঝামেলায় আটকে পড়েছে ট্রেন। কিসের ঝামেলা, কখন ঝামেলা মিটবে সে সম্পর্কে ময়মনসিংহ জংশনের কেউ কিছু জানে না। আজ বৃহস্পতিবার বলেই বোধ হয় এত ভিড়। স্টেশনের ছোট প্লাটফর্মে মানুষ গিজগিজ করছে। গুমোট গরমে একের নিশ্বাস অন্যের কাছে ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠছে। মাথা থেকে হাত আটেক উঁচুতে টার্মিনালের ছাদে কটা ফ্যান ঝুলছে বটে কিন্তু সেগুলো ঘুরছে না। বিদ্যুৎ নেই। ভাদ্রের দোষে বাতাসও অনুপস্থিত। টার্মিনালের বিশেষ ব্যবস্থায় টিম টিম করে গোটা কয়েক ঝুলন্ত বাল্ব এখানে ওখানে জ্বলছে। তার আলো-আঁধারিতে মানুষের দীর্ঘ প্রতিবিম্ব দেয়ালে দেয়ালে কোলাজ হয়ে হেলছে দুলছে খেলছে।’ (যে জীবনের সঙ্গে হয় নাকো দেখা, জন্মভিটে)।
ম্যারিনা নাসরীন সহজাত প্রতিভার অধিকারী একজন কথাসাহিত্যিক। জন্মগত সৃজনশীল মেধা আর অর্জিত শিল্পজ্ঞানের সুসমন্বিত সৃষ্টি তার ছোটগল্প। তিনি অনেকটা অনায়াস ভঙ্গিতে গল্প লেখেন। কোষ্ঠকাঠিন্যময় অতিকল্পনা , আরোপিত ঘটনার উদ্ভট আড়ম্বর এসব তার নয়। তিনি গল্পকে এগিয়ে যেতে দেন স্বাভাবিকতায়। অতি মাতব্বরীজানিত কচকচানি নেই তার গল্পে। আবার চিন্তক হিসেবে তিনি গভীরচারী, দর্শক হিসেবে সূক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী।
বাংলা ভাষার ওপর তার দখল যে কোনো বিবেচনায় যথেষ্ট। এসব কারণে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তার গল্পগুলোতে নির্মাণের কংক্রিটময়তার চেয়ে সৃজনের প্রাণময়তা বেশ। পড়তে ভালো লাগে, এটাই তার গল্পের সবচেয়ে বড় গুণ। তিনি তার সময় সম্পর্কে সচেতন। তিনি চলমান বিশ্ব বিষয়ে সক্রিয়ভাবে ওয়াকিফহাল। আধুনিক সভ্যতা শাসিত মানুষের জীবন জুড়ে অর্থনীতি, পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ, ক্ষমতা, ভোগবাদিতা ইতাদির দাপট ; সেসবের দিকে ম্যারিনার চোখ খোলা, মন সংবেদনশীলতায় সংশ্লিষ্ট। কথাসাহিত্যের ইতিহাস ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সজাগ তিনি কিন্তু কোনো ইজম অথবা হুজুগের স্রোতে ভেসে যাওয়া তার নয়। তার সাহিত্যের ভাষা আকর্ষণে ও উপভোগ্যতায় সমৃদ্ধ এবং প্রাণময়তায় সচ্ছল। পরিহাস তার একটি প্রিয় অস্ত্র। তার গল্প বলার ধরনটি নিজস্বতায় প্রতিষ্ঠিত।
ঘটনার ভূগোল, সময়, চরিত্র ও প্রেক্ষাপট অনুসারে গড়ে উঠেছে তার গল্পের ভাষা। প্রতিটি গল্পেরই ভাষা জুতসই এবং বিশ্বসযোগত্যায় উত্তীর্ণ। তার প্রায় প্রতিটি গল্পের উপসংহার গভীর আবেদন সৃষ্টিকারী। তিনি সমাজসচেতন এবং একইসঙ্গে শিল্প ও জীবনের কাছে দায়বদ্ধ শিল্পী। দায়বদ্ধতার কথা তিনি কোথাও বলেননি; সেসব নিয়ে কোনো গলাবাজি তার স্বভাবে নেই। গল্প রচনার সময়ও তিনি তার জীবনদর্শনকে, সাহিত্যদর্শনকে অপ্রত্যক্ষ রাখেন, অসোচ্চার কণ্ট দান করেন। সেজন্য তার গল্পে বিবৃতিধর্মিতা, স্লোগানধর্মিতা, সরাসরি পক্ষাবলম্বন, সিদ্ধান্তসূচক নগ্ন অভিমত ইত্যাদি নেই। তিনি ঘটনা অথবা গল্পগুলো উপস্থাপন করে তার কাজ শেষ করেন। গল্পপাঠ শেষে মনে হয়, তিনি শুধু লেখার জন্য রেখেন, শুধু পাঠকের পাঠের জন্য লেখেন। কিন্তু নিবিড়ভাবে দৃষ্টিপাত করলে পাঠকের কাছে তার সুন্দর মনটির ছায়া ও ঘ্রাণ শেষপর্যন্ত সবখানি অধরা রয়ে যায় না।
ম্যারিনা আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর লেখক নন। তিনি একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন। সেই দেখাটা রাজনীতিবিদের দেখার মতো নয়, সমাজবিজ্ঞানীর মতো করে নয়, এমনকি বিপ্লবী-বিদ্রোহী সাহিত্যিকদের আদলেও নয়; কিন্তু তার একটা নীরব অন্তরঙ্গ চাওয়া আছে। একটা অঘোষিত অন্তরঙ্গ জীবনদর্শন আছে। গল্পের প্লট, উপস্থাপনা ভঙ্গি এবং কখনো কখনো গল্পের যবনিকা তার সেই উজ্জ্বল মানবিক চাওয়াকে ব্যঞ্জিত করে দূর থেকে—সংকেত রচে না-বলা উচ্চারণে। ম্যারিনা নাসরীন কথাশিল্পী হিসেবে যতটা দক্ষ, তিনি তার সমান অথবা তারও বেশি মহৎপ্রাণ ও আলোকিত সত্তার অধিকারী একজন মানুষ। তার গল্প পাঠে যেমন তৃপ্তি পায় সাহিত্যপ্রেমী প্রাণ, তেমনি গল্পকারকে ঘিরে বেড়ে উঠতে চায় একটা সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।