মোহাম্মদ নূরুল হক—মূলত কবি। একজন কবির জন্য সবচেয়ে বড় বাধা, তার গদ্য। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাবনার জগৎ রয়েছে, রয়েছে নিজের চিন্তাকে প্রকাশের আকাঙ্ক্ষাও। কখনো কখনো নিজের পাঠ অভিজ্ঞতাকেও অন্যের সঙ্গে বিনিময়ের তাগিদ অনুভব করেন অনেক কবি। মোহাম্মদ নূরুল হকও নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। সেই প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে শুধু কবিতাকেই তিনি বেছে নেননি; কবিতার যেখানে সীমানা, সেই সীমানাকে ছাড়িয়ে উদার আকাশের দিকে নিজের চিন্তার জট ছাড়াতে আশ্রয় নিয়েছেন গদ্যের। ভাবনার যেখানে বিস্তৃতি প্রয়োজন, সেই প্রয়োজনে গদ্যকে আশ্রয় করেছেন। তাকে গদ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে কখনো অন্তর্তাগিদে, কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে। আমাদের ছোটকাগজসহ সাহিত্যপাতায় গদ্যের সংকটই বেশি। ফলে মোহাম্মদ নূরুল হকের গদ্য লেখার সুযোগের সদ্ব্যবহার সাহিত্য সম্পাদকরা করলেও, প্রকারান্তরে কবি মোহাম্মদ নূরুল হক আড়ালে চলে গেছেন। প্রথমত এবং প্রধানত কবি হলেও, তার প্রকাশিত গদ্যের সংখ্যাই সর্বাধিক। ফলে তার গদ্য যতটা আলোচিত, ততটাই অনালোচিত থেকে গেছে কবিতা। আশঙ্কা রয়েছে, যা কবি হিসেবে তাকে অস্তিত্বের সংকটের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
কাল বিচারে মোহাম্মদ নূরুল হক একুশ শতকের প্রথমার্ধে (২০০০-২০১০ সময়ে) বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় তিনি নিজেকে প্রকাশ শুরু করেন। ইতোমধ্যে তার তিনটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর প্রকাশিত হয় ‘স্বরচিত চাঁদ’ ও ‘উপ-বিকল্প উপসম্পাদকীয়’। মোহাম্মদ নূরুল হক যে সময়পর্বে লেখা শুরু করেছেন, তার সময়ের অধিকাংশ কবিকেই মূলত এখনো শনাক্ত করা হয়নি। সমালোচিত হয়ে, কাব্যালোচনার মধ্য দিয়ে তাকে আবিষ্কার করা, পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি হয়নি। শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, অধিকাংশ কবির ক্ষেত্রেই এই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি করা হয় না। সমালোচকদের সঠিক নজর সবার প্রতি পড়ে না। ফলে তারা থেকে যান অনালোচিত। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে, তার সময়ের কবিরা তাকে উপলব্ধি করেননি। বরং সচেতনভাবে আমাদের মাঝে যে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, অন্যের প্রতি নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক মানসিকতা রয়েছে—বিষয়টি তারই প্রভাব।
সমসাময়িক তো বটেই, পূর্ববর্তী কবিদের সম্পর্কেও মোহাম্মদ নূরুল হক তার উপলব্ধির দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছেন পাঠকের কাছে, নিজের কবিতার ক্ষেত্রে তিনি সমালোচকদের সেই মনোযোগ আকর্ষণ করাতে পারেননি। এর মানে এই নয় যে, কবি কীর্তিতে তিনি পিছিয়ে। হয়তো সচেতনভাবেই তাকে দলভুক্ত করা হয়নি। তবে এই দলভুক্ত হতে না পারাই বরং মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার জন্য ইতিবাচক হয়ে তাকে আপন শক্তিতে সংহত করেছে। ফলে কবিতা তাকে করে তুলেছে আÍসচেতন।
গেলাশ ভর্তি বিকেল নিয়ে বসে আছি স্থির হাওয়ার টেবিলে
বিকেলের নোনা স্বাদ ঘুড়ি হয়ে উড়ে গেলে কাচ ভেঙে ভেঙে
ভাঙা কাচের টুকরো ঈষদুষ্ণ মেঘফ্রাই উড়ে উড়ে খাচ্ছি
লাফিয়ে উঠছে সন্ধ্যা পৌরাণিক সমুদ্রের বিনম্র হাঙর
আমি হাঙরের মুখে চুমো খাই, সন্ধ্যা খাই বিয়ারের আগে
মানুষের মন লিখি—দিগন্তের স্লে¬টে আঁকি বাতাসের ছবি।
(পৌরাণিক সমুদ্রে বসে আঁকা ছবি: মাতাল নদীর প্রত্নবিহার)
কবিতায় আবেগের ব্যবহার প্রয়োজন, আবেগের যথার্থ প্রকাশ ছাড়া অনুভূতির তীব্রতা স্পষ্ট করা সম্ভব নয়, তবে সেই আবেগের ব্যবহার যেখানে সংযত, সেখানেই কবিতার পূর্ণতা। সেই কবিই সময়কে, নিজের দশককে উতরে যান, যিনি আবেগের সঙ্গে নিজের মেধা ও মননের সেতু তৈরি করে তাকে প্রকাশ করতে পারেন। ভাবাবেগই শুধু নয় বরং বুদ্ধির দীপ্তিও কবিতাকে আচ্ছন্ন করে রাখলেই শুধু অনবদ্য কবিতার জন্ম হতে পারে। অপ্রাপ্তিজনিত হতাশা আর দুঃখজড়ানো অনুভূতিকে মোহাম্মদ নূরুল হক শুধু আবেগ নয়, মেধা ও মননের সেতুবন্ধন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে তার সময়ের ভিন্নস্বর।
ঘুমবিলাসী সাপেরা উড়াল দিচ্ছেন আজ হাওয়ার সমুদ্রে
রোদের শাড়ির রঙে ঝলসে উঠলো লাল রামধনু-স্তন
কামরাঙা পাখিগুলো শিস দিচ্ছে অবিকল দোয়েলের ঢঙে
. আর আমাদের ঘুম
পালিয়ে বেড়াচ্ছে দেখো নিখিল নাস্তির মৃদু নিশ্বাসের আঁচে
আসে জল, জলসত্রে তৃষ্ণার আগুন: ছাই হই পুড়ে পুড়ে
তবু মেয়ে অভিমানে উড়ে যায় ডুব দেয় জলের গভীরে
শ্রাবণের মেঘ যদি ঢাকতে না পারে দিগন্ত। পর্বতচূড়া।
বুকের ওড়নায় কি ঢাকা যায় কামরাঙা মেয়ের বয়স?
(আমাদের ঘুম অথবা মেয়েদের বয়স : মাতাল নদীর প্রত্নবিহার)
কবি মাত্রেই আবেগী। কবিতায় নিজের আবেগকে প্রকাশে উন্মুখ। সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়েই কবি নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলেন। কারণ তিনি জানেন আবেগকে কী করে ভাষা দিতে হয়, কী করে তার পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে হয়। মোহাম্মদ নূরুল হক, তার কবিতায় আবেগের ব্যবহারে সংযমী। তিনি শুরু করেন যে আবেগে, যে আবেগকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি ভাষাকে আশ্রয় করেন, পরমুহূর্তেই তিনি সেই আবেগকে যুক্তির জালে ফেলে, ভাষাকে সংযমের বাঁধনে বেঁধে প্রকাশ করেন। ফলে তার কবিতায় একদিকে আবেগের প্রকাশ যেমন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমনি সেই একই আবেগকে কী করে যুক্তির বন্ধনে দৃঢ় করতে হয়, তারও বহিঃপ্রকাশ। ‘বুক পকেটে কবিতা: বুক পকেটে বিকেল’ কবিতাটি এক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে পারি:
বুক পকেটে বিকেল বরফকুচির মতোন ধ্রুপদীসঙ্গীত
স্বাপ্নিক পূর্ণিমা গলে প্রিয় মৃত্তিকার নামে বিনম্রজোনাকে
প্রেমহীন রাত আঁকি রতিক্লান্ত সূর্যের গহনে
শিল্পের পাড়ায় অন্ধ তারাগুলো চোখ খোলে হঠাৎ বিদ্যুতে
এসো বিদ্যুতের রাত—আমাদের সূর্য গেছে স্বেচ্ছা নির্বাসনে
মগজে বিকেল হাসে—সন্ধ্যার বাতাসে কাঁপে রজঃস্বলা মেঘসেই মেঘ রেঁধে খায় মঙ্গার দুপুর
মেঘ তাই ভুলে গেছে জলসিক্ত একান্ত আকাশ
বুকপকেটে কবিতা ভয়ানক চিত্রকল্পে বিবর্ণ মাতাল।
(বুক পকেটে কবিতা: বুক পকেটে বিকেল)
মনোযোগী পাঠকমাত্রই এখানে আবেগের সঙ্গে যুক্তি এবং মেধার সমন্বয় খুঁজে পাবেন। কবিতার ক্ষেত্রে কিছু নির্ধারিত শব্দ রয়েছে, যা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি তার আবেগকে স্পষ্ট করে তোলেন। কবিতার জন্য পেলব, গীতল শব্দসমষ্টির প্রতি কবির পক্ষপাত থাকে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত, নির্দিষ্ট শব্দমালাকে ঘুরেফিরে কবি নিজেকে প্রকাশের জন্য বেছে নেন। তবে সবাই যে প্রচলের প্রতি আস্থা রাখতে রাজি নয়, তারও উদাহরণ মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা। অন্যদের চেয়ে এক্ষেত্রে সহজ উদাহরণ এবং আমাদের হাতের কাছের বহুল ব্যবহৃত কবি জীবনানন্দ দাশকেই উপস্থাপন করে দেখাতে পারি। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেই সমালোচকরা উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, তিনি কিভাবে গদ্যগন্ধী শব্দকে অকপটে ব্যবহার করেছেন। কিভাবে তার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ঠ্যাং-এর মতো কর্কশ শব্দও কবিতার গীতলতায়, পেলবতায় মধুর হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশের অনেক পরের প্রজন্ম মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতাতেও আমরা গদ্যগন্ধী শব্দমালার বহুল ব্যবহার দেখি। দেখি গদ্যের কাঠিন্যের ভেতরে থেকেও কবিতার মিষ্টতা।
তোমার পুরুষ যদি ক্ষুধার্ত হাঙর, তুমি তবে
বাঘিনীর বোন?
হয় না এমন দৃশ্য? বাঘিনী হাঙরে—
নিখিল বিরোধ? কাঙ্ক্ষিত সন্ধ্যায় অন্ধকার?
অসম্ভব সম্ভাব্য দৃশ্যের—
ক্লান্তি দেখে তুমি নারী, আমিও পুরুষ?তোমার দীর্ঘশ্বাসের আঁচে আমি পুড়ি ঠাণ্ডা রাতে
ওপারে একা, বিনিদ্র কাটাও সময়কেন এই কষ্টচাপা আমাদের দিনরাতগুলো?
(আমাদের চাপা কষ্টগুলো: স্বরচিত চাঁদ)
মোহাম্মদ নূরুল হক ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী। তার কবিতা চিত্রকল্পময়। সেইসঙ্গে সবসময়ই তার কবিতায় থাকে একটি বার্তা। তার কবিতার পঙ্ক্তিগুলোর সমন্বিত বাঁধনের ভেতর দিয়ে রচিত হয় একটি সম্পূর্ণ দৃশ্য। যা বাংলা কবিতার সম্পূর্ণ নিজস্ব রূপ-
ডালিম দানার মতো লাল লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দি রাধিকার স্তন। আর
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।
জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।আর রজকিনী ঘাটে- রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনে আয় তৃষ্ণা মেটাবি দিঘির।জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফনা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালাসন্ধ্যায়
বয়স্ক রাতের দিঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
(স্রোতের নামতা)
আমাদের সময়ের এবং বাংলা কবিতার যে আমিত্বময় বৈশিষ্ট্য, নিজেকে প্রকাশের যে আকুলতা, সেই আকুলতা মোহাম্মদ নূরুল হকের থাকলেও, তার কবিতাকে ঠিক আমিত্বময় বলে অভিহিত করা যায় না। বরং ব্যক্তি ‘আমি’র বাইরে এসে তিনি নিজেকে প্রকাশের অন্তর্তাগিদ অনুভব করেছেন। ফলে অন্তর্গত বেদনার চেয়ে বহিস্থ বিষয়ের প্রতিই তিনি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। যে অভিজ্ঞতার ভেতরে দিয়ে তিনি পাঠককে নিয়ে চলেন, তাকে তার কবিতা শুধু শব্দের আগ্রাসন হয়েই পাঠককে তাড়িত করে না, সুখপাঠ্য পঙ্ক্তিমালার সঙ্গে-সঙ্গে পাঠকের ভাবনার দুয়ারেও কড়া নাড়ে।