কে কবি, কে নয়, কোনটি কবিতা, কোনটি নয়—এমন বিতর্ক-কূটতর্কের পাশাপাশি ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’—জীবনানন্দ দাশের এই উক্তিও কবিপাড়ায় বহুল প্রচারিত। ‘কবি’ ও ‘কবিতা’ নিয়ে যত আলোচনাই থাক, একজন কবি-শিল্পীকে সমাজের প্রতি সৎ ও দায়বদ্ধ থেকেই কবিতা রচনা করতে হয়। কবির উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতার উৎসারণ তখনই কবিতা হয়ে ওঠে, যখন প্রকৃতির নির্মল উপাদান, ইতিহাসের সঞ্চয়, প্রেমের সঞ্জীবনী সুধাসহ সমাজ-রাষ্ট্র ও যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ কবির হাতে প্রাণতা পায়। এসব প্রপঞ্চ সমন্বয়ে রচিত কবিতা যেমন কবিকে স্বস্তি দেয়, তেমনিভাবে পাঠককেও ভাবরসে আপ্লুত করে। পাঠক নতুন চিন্তার জোগান পায়। তবে সব কবিতা পাঠকের ভালো লাগবে কিংবা লাগাতেই হবে এমন দায়বদ্ধতা কবির থাকে না। এরপরও প্রতিদিন রচিত হয় অজস্র কবিতা। আর তার ভেতর থেকেই খুঁজে নিতে হয় পাঠযোগ্য কবিতা। কবি মামুন রশীদের কবিতাও শিল্পের নানা শর্ত পূরণ করে রচিত, যা অনায়াসেই পাঠযোগ্য বিবেচিত হতে পারে।
সমুদ্র রাখে না কোন স্মৃতি
হাজারো ফটোগ্রাফ গেঁথে দেয় মানুষের বুকে।
খোলা শঙ্খের হাওয়ায় কান পেতে
আসমানী নীলের সাথে যারা
মেলে দেয় পাখা, তাদেরও থাকে মনে
নোনাজলে ভেসে যাবার বাসনা।
ইতিহাসের পাতা খুলে কবে কোন মোহমুগ্ধ সন্ত
সফেন ফেনার মাঝে খুঁজেছিল প্রিয়মুখ
ভয়ার্ত প্রেয়সী তার- নির্বাক, বিস্ময়ে লুটিয়ে
পড়তে দেখেছিল নিজেরই জমানো ছায়া।
অন্ধকারে প্রতিদিন মানুষ আজও
ফেরি করে সমুদ্র স্মৃতি ।
সমুদ্র রাখে না কিছুই-
গেঁথে দেয় হাজার ফটোগ্রাফ।
(সমুদ্র রাখে না কিছুই)
মানুষ রশীদ বয়সে তরুণ কিন্তু অনতিতরুণ নন। তিনি দীর্ঘদিন কবিতাযাপন করছেন। জীবনের বিভিন্ন স্তর পর্যবেক্ষণ করেছেন, যে কারণে তার কবিতা জীবনাভিজ্ঞানে ঋদ্ধ। সহজ অথচ গভীর অর্থবোধক শব্দ ও চিত্রকল্পে তিনি পাঠক মনে অভিঘাত সৃষ্টিতে সক্ষম। তার কবিতায় যুগপৎ প্রেম ও বিরহের যে মেলবন্ধন, তা রোমান্টিকতার সাক্ষ্যবাহী। প্রাকৃতিক অধরা সৌন্দর্যালোক ও ব্যক্তিচেতনালোক দুই-ই রোমান্টিসিজমের মূল আলেখ্য। ব্যক্তিক আবেগরাশি, প্রধান-অপ্রধান বেদনারাশি, কামনাবাসনা, বিশ্বাস-ধারণা প্রভৃতি দৈনন্দিন মানবিক অভিলাষ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রোমান্টিকতার জগতকে শাসন করত। কিন্তু কালের বিবর্তন সেই কাঠোমোতে পরিবর্তন এনেছে। কবিতার নান্দনিক লক্ষ্যও এখন যেন বিপরীতমুখি। অস্বীকার করা যায় না, এই বিবর্তনের মূলে রয়েছে নাগরিক বিধ্বস্ত জীবনের চরম আগ্রাসন। যা জন্ম দিয়েছে এক ধরনের হাহাকারবোধের। এতে পাল্টে গেছে আধুনিক কবিতার রোমান্টিকতার আবহ, চিত্রকল্প। মামুন রশীদের কবিতায়ও চিত্রকল্প এসেছে হাহাকারের জারন-বিজারণে। নিচের কবিতাটি পাঠ করি:
আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই, আমি নই।
বুঝি না, কি অফুরন্ত সম্ভাবনার মুখে বার বার
দুপুরের রোদের ভেতরে সামান্য
বিশ্রামের খোঁজে- ভাঁটফুল, জংলি কাঁটা আর
গুল্মলতার বাগান মাড়িয়ে- খ্যাতিতে নগণ্য—
চোখের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ঠাঁয়- ভীষণ
অচেনা গাছকেই বেছে নেয় মানুষ।
নিরুদ্দেশে, দূরের কার্নিশে নিজেকে অমর, অক্ষয় করার
অপ্রাকৃত আনন্দে গা খুঁড়ে খুঁড়ে লেখা নাম, বেদনার
নীল ক্ষতে ধরে রাখি। প্রিয় অনুরাগে ভ্রমণ পিপাসু
মানুষ চলে যায়। ভোরের হাওয়ায় বর্ষাভেজা
আকাশের নিচে যে লেখে নাম- সেও ভুলে যায়।
শুধু আমি, জীবনে ফেরার পথে সবচেয়ে বেদনার
গানগুলো মনে করে ডুকরে উঠি। খুলে দেই
আড়াল থেকে ধরে রাখা চোখের নেকাব। নিভৃতে,
ক্ষতবিক্ষত মুদ্রিত ইতিহাসের ভেতর দাঁড়িয়ে দেখি
বসন্তের চেয়ে ঝরাপাতার স্পর্শ অনেক বেশি সঙ্গীতমুখর।
(আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই, আমি নই)
‘দুঃখবোধ’ এ কবিতায় তীব্রভাবে উদ্ভাসিত। প্রকৃতিশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক চিত্রকল্প কবিতাটিকে অনন্য করে তুলেছে। কবিতাটি পাঠে পাঠককে থমকে দাঁড়াতে হয়; কেননা, ‘আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই’ এই দুঃখবোধ কবির একার নয়, সমস্ত মানব হৃদয়েই এই ক্ষত লুক্কায়িত। কবির জীবন রসায়ন থেকে উত্থিত এই বোধ যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, সর্বজনীনতা লাভ করে, বলা যেতে পারে কবি তখনই সার্থক। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, রোমান্টিকতার উদ্ভব-বিকাশের সময় ইউরোপে চলছিল শিল্পবিপ্লব আর জন্ম নিচ্ছিল পুঁজিবাদী বুর্জোয়াশ্রেণি। এই শ্রেণির ইহজগতের প্রত্যেকটি বস্তু, কলা, অনুষজ্ঞকে যাচাইয়ের মাপকাঠি ছিল মুদ্রা। অর্থাৎ তাদের আরাধ্য ঈশ্বর-মুদ্রা। আর এই অস্বস্তিকে কাটাতে রোমান্টিক কবিরা নিজের ভেতর ডুব দিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনিন্দ্য রাজ্য, কল্পলোকে। কিন্তু নৈঃসঙ্গ্যচেতনা মানুষের পিছু ছাড়েনি। নৈঃসঙ্গ্যচেতনা সৃষ্টির পশ্চাতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক সভ্য সমাজের তীক্ষè ও দ্রুত সংক্রমণে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব, বৈপরীত্য, সংঘর্ষ সবকিছু একই কক্ষপথে আবর্তনরত মানুষগুলোকে সমচুম্বকীয় টানের মতো পরস্পর থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে দিয়েছে। ফলে বেদনা, হতাশা, একাকীত্ব, নৈঃসঙ্গ্য মর্মমূলে গেঁথে গেছে মানুষের। রোমান্টিক চেতনার অন্যতম প্রতিভাস এই নিঃসঙ্গতা মামুন রশীদের কবিতাকে ভিত্তি দিয়েছে।
মামুন রশীদের কবিতায় বেদনাবোধের তীব্র অভিমান ধ্বনিত হয়, বিচ্ছিন্নসত্তারও সন্ধান মেলে। বস্তুবিশ্বের সবকিছু খুলে ফেলে কবি একা হওয়ার বাসনা করেন। কবির ‘অন্ধকার’ কবিতা থেকে কবির একাকিত্বের স্বরূপ তুলে ধরা যেতে পারে:
ঘরের ভেতরে মানুষ ধীরে, আরও ধীরে,
খুব ধীরে, ক্রমাগত খুলে ফেলে নিজস্ব পোশাক;
একা খয়েরি পাখার ভেতরে ডুবে- উড়ে
ক্রমশ একা হয়ে ওঠে- নিজের ভেতরে।
এখানে মানুষের মজ্জাগত পরিবর্তনের আভাস লুক্কায়িত, না কি হতাশা মিশ্রিত কণ্ঠে আত্মজিজ্ঞাসা? কেন মানুষ একা হয়ে ওঠে নিজের ভেতরে, কোন বেদনাবোধে? আবার ‘মানুষের ভিড়ে’ যখন তিনি বলেন:
মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে যখন
একা-একা হয়ে যাই, তখন গাছেদের
মত চোখ কার বন্ধ করে দেই।
আমার ভেতরে কোন হাওয়া আসে না,
বরং আমি একা হাওয়া হয়ে যাই।
এ কবিতাটিও বিচ্চিন্নতাবোধের ইঙ্গিতবাহী। বোধকরি, নির্জনতা কবির খুব প্রিয় এবং বিচ্ছিন্নতাবোধই কবির প্রধান শক্তি। বিচ্ছিন্নবাদী মানসিকতা জীবনের এক রহস্যাময় অংশ। এ অভিব্যক্তি হয়তো কোনো শব্দবন্ধেই প্রকাশ করা যায় না, তবে নিঃসন্দেহে নাড়িয়ে যায় অনুভূতির অর্গল। এভাবেই একটি কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে ওঠে।
বিশ্বের প্রতিটি মানুষই হয়তো চায় তাকে কেউ না কেউ মনে রাখুক। ‘একটু একটু করে’ কবিতায় কবিও বাসনা করেছেন, মানুষ তাকে মনে রাখুক।
একটু একটু করে মানুষ আমাকে মনে রাখুক।
খোলা মাঠে, আড্ডায়- তৃষ্ণার চেয়ে
চায়ের উষ্ণতা বেশি মগ্ন করে।
একটু একটু করে উষ্ণতা শেকড় মেলে।
একটু একটু করে মানুষ আমাকে মনে রাখুক।
প্রতিটি সৃজনশীল এবং কল্পনাপ্রবণ মানুষ আত্মজিজ্ঞাসা পীড়িত ও মর্মাহত হন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি দেখে, নিজেকে দুঃখী মানুষের কাতারে শামিল করে। সমাজ সংসার থেকে কবির বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়াস লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে কবিতাগুলোতে। কবি নিজেকে খুঁজে পান ‘অস্তিত্বহীন এক মাঠের ভেতরে ঘন অন্ধকার’-এ। স্বভাবতই প্রশ্ন করা যেতে পারে মাঠ যেখানে অস্তিত্বহীন, সেখানে কবি ঘন অন্ধকার কীভাবে দেখেন। কবি কল্পনায় হয়তো অনেক কিছুই সম্ভব কিন্তু মনে রাখা দরকার অন্ধকার বস্তুগত না হলেও এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
কবি মাত্রই দার্শনিক, মানুষ রশীদের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। তিনি কবিতার কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করে মানুষের সুখ-দুঃখের ইতিহাস তুলে ধরেন। কবিতা সৃষ্টিতে তিনি শুধু বিষয়বস্তুর সন্ধানে ব্রতী না হয়ে নিজের মতো করে দৃশ্য সৃষ্টিতে নিমগ্ন থাকেন। তিনি যাপিত জীবনের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও চিত্রায়ন করেন কখনো কখনো। সমাজের অবক্ষয় ও অসাম্যের জায়গাটিও তিনি চিহ্নিত করেন। প্রশ্ন তোলেন, ‘মূর্খরা কি হ্রস্ব-উকার ও দীর্ঘ-উকারের ব্যবহার জানে?’ (ছেড়ে যাবার পর)। পাশাপাশি আত্মোন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন- নিজেকে নির্মাণের ব্যস্ততায় আপনার উত্তরাধিকার/পুনরায় স্বপ্নমুগ্ধ, সফল উড্ডয়নের লাটাই ধরে/আমিও দাঁড়াব পুবের বারান্দায়’ (বাবা)। একজন কবি রূপহীনতা ও রূপাতীতের মধ্যেই এমন কিছুর সন্ধান করেন যা আসলে অনুভূতি, অনুভব ইত্যাদি অলৌকিকত্ব ও কল্পনার অন্তর্গত। বিমূর্ত শিল্পীর কাছে আবেগ ও রিয়েলিস্টিক রিপ্রেজেন্টেশন বা শারীরিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নান্দনিকতা অর্থহীন। মামুন রশীদ জানেন, শব্দের ঝঙ্কারে সীমাবদ্ধ যে কবিতা, তাতে শুধু চমকই বাড়ে। কিন্তু কবিতার ভেতর যদি থাকে কবির একান্ত অনুভব ও সাধনা তাহলে সে কবিতাকে অকবিতা বলতে গেলে ভাবতে হয়। কবিতার বিষয়বস্তু শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা আগে থেকে ভাবা না গেলেও; কবিতা রচনায় সচেতন থাকা চাই শব্দ, ছন্দ কিংবা বাক্যবুননের দিকটা। কবিতাবোদ্ধারা এমনটিই বলে এসেছেন বার বার। কবির চারিত বোধের নির্যাস ঢেলে রচিত কবিতা পাঠকের অনুভব-অনুভূতিতে দাগ কাটে নিঃসন্দেহে, পাঠক যদি সে কবিতার সঙ্গে মনসংযোগ ঘটাতে সক্ষম হন। কবিতার মৌলদায়ও পাঠক মনে রস উদ্রেক করা। আর জানেন বলেই, কবির জীবনাভিজ্ঞান যথাযথ শব্দের বিন্যাসে, উপমা-উৎপ্রেক্ষা আর গভীর চিত্রকল্পের বুননে হয়ে ওঠে শিল্পরসের জারক। বলা অসংগত নয়, মানুষ মৌনস্বরের কবি কিন্তু তার কবিতাগুরো কিছুতেই নিম্নমুখী নয়। মৌনস্বরেই তিনি যাবতীয় মান-অভিমান, চাওয়া-পাওয়া, হৃদয়ের আকুলতা কিংবা সমাজ-সংসারের জটিল সব কথামালা তুলে ধরেন কবিতার অবয়বে, শব্দচাতুরতার আশ্রয় না নিয়েই।
পরিশেষে বলা যায়, সব কবিতা যেমন কবিতা হয় না, তেমনি সবাই প্রকৃত কবির মর্যাদাও পান না। জীবনানন্দের ভাষায় কবি সেই, যার রয়েছে কল্পনার প্রাচুর্য। মামুন রশীদও ব্যাপক কল্পনাশক্তির অধিকারী। তার চিন্তাবিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির নৃ-ঐতিহ্য, প্রকৃতি, সমাজ-রাষ্ট্র, বিশ্বায়ন থেকে শুরু করে মহাজাগতিক বিষয়াদি। রয়েছে ধ্যানের জগত। যে কারণে তার হাতে প্রতিচিন্তা উদ্রেককারী এবং হৃদয়গ্রাহী কবিতার জন্ম হয়।