আধুনিক বাংলা কবিতায় আবেগের বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার সম্মিলন ঘটিয়েছেন—এমন কবির সংখ্যা অত্যল্প। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, উপস্থিত কালের প্রধান প্রবণতা শনাক্তির ভেতর দিয়ে শিল্পচর্চার দায় মৌলিক শিল্পীর। এ দায়পালনে সফল হলেই সমকালের সীমানা পার হয়ে মহাকালেও তার কবিতা নিত্যপাঠ্য হয়ে ওঠে। আধুনিকবাংলা কবিতা মূলত দুটি ধারায় প্রবাহিত। প্রথম ধারাটি আবেগের, দ্বিতীয়টিপ্রজ্ঞার। প্রজ্ঞারঅনুশাসন মানতে গিয়ে কখনো-কখনো মৌলিকত্বের প্রতি অবিচার করা হয়। বৃহত্তরজনগোষ্ঠীর অনুভূতির সঙ্গে প্রথম ধারার সম্পর্ক সুনিবিড়। বাংলা কবিতার যে ধারাটি আবেগকে মহিমান্বিত করে তুলেছে, সে ধারার সার্থক কবি মহাদেব সাহা। তীব্র ভাবাবেগের প্রাচুর্যে ভেতর মহাদেব সাহা নিজেকে করেতুলেছেন বৃহত্তর রসপিপাসুর আরাধ্য। ফলে আবেগের বিশেষ-বিশেষ মুহূর্তে পাঠক তার কবিতায় নিজেকেসমর্পণ করেন, খোঁজেন চিৎপ্রকর্ষের ব্যঞ্জন। তাঁর কবিতার মূল বিষয় প্রেম। আবেগব্যতিত প্রেম অকল্পনীয়। ফলে তার কবিতায় স্বাভাবিকভাবেই আবেগ এসেছে। শিল্পেরআবেগ আত্ম-উৎসর্গের প্রয়োজনে, সমর্পণেরও।
আধুনিকবাংলা কবিতার একেক কালখণ্ডে একের ধরনের গতি বাঁক এসেছে। আধুনিক মানুষ যাপন করে জীবন এবং জটিল সময়। সময়েরঅভিঘাতে তার মনোজগত আলোড়িত হয়। ‘আজীবন একই চিঠি’ কবিতায় নিজের সময়ের অভিঘাত ও মনোবিকারকে করে তোলেন কবিতার অবিকল্প অনুষঙ্গ। কবিতায় ক্রমাগত উঠে আসে মানবিক সম্পর্ক, সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যক্তি-সম্পর্কের টানাপড়েন। তারপ্রকাশভঙ্গি নৈর্ব্যক্তিক হওয়া ব্যক্তিবিশেষের অনুভূতি হয়েও তা সর্বজনীন। কবিরকাজ নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে স্বমাজের চিত্র তুলে ধরা। স্বসমাজের আবেগ-অনুভূতি-সংক্ষোভের চিত্র অঙ্কনইতার লক্ষ্য। বাংলাদেশেরচিনায়ত রূপ তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে। ‘তিনি এক স্বপ্নচারী লোক’ কবিতায় বাবা একটি প্রতীকী সত্তা।
জীবনেরসব কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বহীনও নয়। তবে মাঝে-মধ্যে তুচ্ছ কোনো কিছুর অভাবেও জীবনকে অসার মনেহয়, মানুষ হতাশায় ভোগে, সিদ্ধান্তনেয় আত্মহননেরও। কাঙ্ক্ষিতবিষয় লাভের জন্য দৃঢ়চেতা চরম অহঙ্কারীও হয়েপড়েন আত্মসমর্পণে কাতর। ‘চিঠি দিও’ কবিতায় সে রকম অভিব্যক্তি-ই প্রকাশ পেয়েছে। দেশপ্রেম প্রত্যেক কবির রয়েছে। তবেদেশপ্রেমের প্রকাশকৌশল কখনো-কখনো বিতর্কিতও হতে পারে। কারও-কারও দেশপ্রেম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ‘দেশপ্রেম’ কবিতায় এ সবই বর্ণিত। কলাকৈবল্যবাদীরা যখন মানুষকে বাদ দিয়ে শিল্প নিয়েআলোচনা করছেন। তীক্ষ্মভাবে প্রতিবন্ধকগুলোকে কটাক্ষ করে। এর কারণ__মহৎশিল্পী মূলত আত্মজিজ্ঞাসা তাড়িত। সমাজ ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি দেখা দিলে ব্যথিত হতে পারেন, কিন্তু নিজেকে অশুভ ও অসুন্দরের কাছে কখনো সমর্পণ করেন না। মানুষস্বভাবতই স্বপ্নচারী, ভাবতে অবাক লাগে নিরেট স্বপ্নবাজও বাস্তববাদীর স্বভাবেখোঁজেন স্বপ্নচারিতা। আপন উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজস্থ মানুষকে অবলোকনেরপ্রয়াস পায় ওই মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে কবি স্বপ্নচারী ততক্ষণ, যতক্ষণ মানবকল্যাণের প্রশ্নে নতুন কোনো দিক উন্মোচন করা সম্ভব। এর বাইরেতিনি সমাজলগ্ন, রাজনীতি সচেতন এবং মানবপ্রেমিক। ফলে তাঁর কবিতায় আপাতত পরস্পর বিরোধী বক্তব্য লকরা যায়। এই বিরোধাভাসআসলে কবির সামগ্রিক চিন্তার যোগসূত্র মাত্র। এখানে তাঁর সাফল্য, এখানেবিশুদ্ধ শিল্পের আখ্যান।
শিল্পকলা-দর্শন-বিজ্ঞান-ধর্মেরস্ব-স্ব অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে স্ব-স্ব অঞ্চল অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে শ্রেয়। ফলেনানা প্রসঙ্গে ঘুরে-ফিরে স্ব-স্ব অঞ্চলের মাহাত্ম্য গুরুত্ব পায় বেশি। এর মধ্যে কবিরা বেশি আত্মপ্রেমীএবং আপন কর্মবিশ্বের প্রশংসামুখর। ফলে কবি মাত্রই কবিতা বিষয়ক কবিতা রচনা করেন। তাঁরমতে জীবন ও কবিতা একই জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ__জীবনেরজন্য আলো-হাওয়া আর অন্নের পাশাপাশি কবিতারও প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্মান্ধদের রোষের শিকার কোনো মানুষস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। যাবতীয় সৌন্দর্য যেখানে নানা রকম বিধি-নিষেধের যাঁতাকলেপিষ্ট হতে থাকে। প্রতিশোধপরায়ণ-ক্রোধোন্মত্তরা কেবল নিজের স্বার্থ রার জন্য প্রয়োজনে সৌন্দর্য, নান্দকিতা ও মাঙ্গলিক বিষয়-আশয়কেও সমাজে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। জীবনও জগৎ সম্পর্কে তাঁর ঔদাসীন্য রয়েছে। একজন মানুষের সবই আছে, কিন্তুসব কিছু থেকে তিনি স্বেচ্ছা-বিচ্ছিন্ন। ফলে বুকের ভেতর এক ধরনের কষ্ট বাড়তে থাকে। এই কষ্টজমাট বাড়তে বাড়তে কারও ভেতর আত্মহননেরবাসনা জাগে, কেউ দেখেন নিজেকে প্রকাশ করার ভিন্না মাত্রার পথ। কবিরাএই শেষ ধারা মানুষ। ‘মানুষেরবুকে এতো দীর্ঘশ্বাস’ কবিতায় মানুষের কষ্টের সেসব বিষয় উপলব্ধির চেষ্টা আছে। সে সঙ্গেআত্মকথনও। প্রত্যেক মানুষের কষ্ট-ই তার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। তাঁরদীর্ঘশ্বাস হয়ে উঠেছে ’অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক’। অধিকাংশ কবিতায় তাঁর সন্ন্যাস-মানসের প্রমাণ বহনকরলেও শেষ পর্যন্ত কবি জীবনবাদী শিল্পী।
মানুষ, প্রকৃতি, দেশ—এ তিনের প্রতি কবির মমত্ব অকৃত্রিম। মানুষেরপ্রতি প্রেম, ক্রোধ ও ক্ষোভে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে দেশের প্রতিও। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি তাঁর প্রেম তুলনারহিত। মহাদেবসাহা দুঃখ নিয়ে লিখেছেন ‘দুঃখ আছে কতো রকম’। ভাবতে অবাক লাগে কবি এই কবিতাটি লিখেছেন অসমপঙ্ক্তির স্বরবৃত্তে। অথচঅক্ষরবৃত্তের মতোই এ কবিতায় গাম্ভীর্য বজায় রয়েছে। কোনোভাবেই স্বরবৃত্তের চালটি চটুল হয়ে পড়েনি। বাঙালিমাত্রই নিজের মাকে চির দুঃখিনী হিসেবে দেখেন। মায়ের সামান্য ম্লান মুখই বাঙালির কাছে পৃথিবীরসেরা অন্ধকার। তাঁর কবিতা আবেগের প্রাচুর্য আছে, সে আবেগ অনিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু বুদ্ধির প্রাবল্য না থাকলেও যুক্তিবোদ ও সমাজ-বাস্তবতারনিরিখে তাঁর কবিতাকে সমাজবিচ্ছিন্ন বলা যায় না। এই অর্থে মহাদেব সাহা সমাজসচেতনও। আবারসমাজকালীন রাজনীতি তাঁর কবিতায় প্রচ্ছন্ন; এ অর্থেরাজনীতি সচেতনও। মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের আবেগ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত, তবে সে সব মানুষেরই বেশির ভাগ-ই ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, ঠিকাদার কিংবা প্রশাসক শ্রেণীর। কিন্তু শিল্পী ও রাজনৈতিক ঘরানার মানুষের কাছে বুদ্ধিরচেয়ে আবেগের গুরুত্ব বেশি। ফলে এই শ্রেণীর মানুষ সাধারণ মানুষকে সম্মোহিত করেন আবেগেরজোরেই। রাজনীতিবিদএবং কবির বক্তব্যের যৌক্তিকতার চেয়ে ভাষার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন শ্রোতারা। কবিতারএকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য—এর রহস্যময়তা। একধরনেরঘোর সৃষ্টিও কবির কাজ। পাঠককে ঘোরের ভেতর ধরে রেখে ভিন্নতর রস গ্রহণে প্রণোদিতকরেন কবি। কিন্তুসে রহস্যময়তার সঙ্গে ধাঁধার সম্পর্ক পরিপূরক নয়। বরং ধাঁধার রহস্য উন্মোচিত হয় বলে বিষয়টি বোঝারসঙ্গে সঙ্গে ধাঁধার প্রতি পাঠকের আকাঙ্ক্ষা নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু কবিতার ঘোর কখনো কাটে না। ফলে রহস্যময় কবিতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ ক্রমাগতবাড়তে থাকে।
মহাদেবসাহা প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, দ্রোহের কবি—শেষপর্যন্ত মানবতার কবি। ‘এই গৃহএই সন্ন্যাস, ‘মানব এসেছি কাছে’, ‘চাই বিষ অমরতা’, ‘কী সুন্দর অন্ধ’, ‘তোমার পায়ের শব্দ’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা-ই মানবতার পক্ষে এবং তীব্র আবেগের ফসল। এসবকাব্যে কবি সমাজে নিজের উপস্থিতিতে অস্বীকার করেন না, কিন্তু গৌণ করে তোলেন। ফলে গৃহী হয়েও সন্নাসী, বেঁচেথেকে অমরত্বের বিষ পান করতে চান। অন্ধের চোখ দিয়ে দেখেন পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য। প্রকৃতপক্ষে কবি স্বপ্নচারী ততক্ষণ, যতক্ষণ মানবকল্যাণের প্রশ্নে নতুন কোনো দিক উন্মোচন করা সম্ভব। এর বাইরেতিনি সমাজলগ্ন, রাজনীতি সচেতন এবং মানবপ্রেমিক। ফলে তাঁর কবিতায় আপাতত পরস্পর বিরোধী বক্তব্য লকরা যায়। এই বিরোধাভাসআসলে কবির সামগ্রিক চিন্তার যোগসূত্র মাত্র। এখানে তাঁর সাফল্য, এখানেবিশুদ্ধ শিল্পের আখ্যান।