সাহিত্য হচ্ছে সমকালীন সমাজের দর্পণ। আমরা আজ যে নিজের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে পারছি, তা সম্ভব হচ্ছে সাহিত্যের জন্য। ভারতবর্ষে এ সাহিত্য চর্চার শুরু বৈদিক যুগেই। প্রথম দিকে এ চর্চা ছিল ধর্মাশ্রয়ী। মধ্যযুগে সে সাহিত্য চর্চার ধারা অব্যাহত থাকলেও তার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে তৎকালীন বাঙালির সমাজচিত্র। মূলত মধ্যযুগে মানুষের জীবনই ছিল ধর্মকেন্দ্রিক। তাই সে সব কিছুর সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করে ফেলত। এর কারণ ছিল-ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও হতাশা।
আদিম কাল থেকেই মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে নিয়ামকটি কাজ করে আসছে তাহল বেঁচে থাকার ইচ্ছা। মানুষ আদিম কাল থেকেই অমর হওয়ার ইচ্ছে লালন করতো। দৈহিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য তার প্রধান উপাদান হলো খাদ্য। আর মৃত্যুকে যেহেতু অগ্রাহ্য করতে সে কখনোই পারেনি, তাই সে ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। আর এই দুই নিয়ামকের সমন্বয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি আবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই আবর্তনের মধ্যেই বঙ্গজনপদবাসী তাদের সামাজিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার বিশেষ পরিচয় বিধৃত করেছিল এই যুগের রচনাবলিতে।
নানা রকমের চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের সামাজিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধর্মকে আশ্রয় করলেও তাদের নিজস্ব জীবনধারা যেমন গার্হ্যস্থজীবন, সামাজিকজীবন, ক্ষুধা ও খাদ্য—প্রভৃতির বিশ্বস্ত চিত্র তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি।
এ যুগে মূলত সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে দুটি ধারা লক্ষ করা যায়—একটি বিশুদ্ধ সংস্কৃত, অন্যটি মিশ্র-সংস্কৃত বা অসংস্কৃত (প্রাকৃত বা অবহট্ট) ভাষার রচনা। এ যুগে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্যচর্চা বেশি হতো রাজাদের পৃষ্ঠাপোষকতায়। ধর্মীয় অনুসঙ্গ ছাড়া এতে ঠাঁই পেতো রাজ-রাজাদের প্রশংসা বা স্তুতি, আদিরসাত্মক বিষয়। এর বেশিরভাগই হতো ধর্মীয় অনুসঙ্গের মোড়কে। সংস্কৃত সাহিত্যের সর্বশেষ বিখ্যাত কবি জয়দেব। তিনি ‘গীতগোবিন্দ’-এর রচয়িতা। সংস্কৃত সাত্যিকরা যেসব ক্ষেত্রে সংস্কৃত প্রথা অনুসরণ করেননি তার প্রমাণ এই কাব্য। এছাড়া এ যুগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘কবীন্দ্র সমুচ্চয়’ ও ‘সদুক্তিকর্নমৃত’ও বাঙালি সমাজের প্রামাণ্য দলিল। ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য চর্চার বাইরে গিয়ে অবহট্ট ভাষার কবিরা রচনা করেছেন ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’। মধ্যযুগে বাংলা ভাষায় যেসব কাব্য রচিত হয়েছে, তার বেশিরভাগটাই ধর্মাশ্রয়ী। সেইসব সাহিত্যে তৎকালীন বঙ্গজনপদবাসী তথা বাঙালির সমাজ জীবনের সজীব চিত্রও আবিষ্কৃত হয়ে গেছে।
অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের বাংলাভাষার একমাত্র আদি নিদর্শন চর্যাপদ। এতে তৎকালীন বাঙালির গার্হ্যস্থ জীবনের বাস্তব চিত্র উঠে এসেছে। এতে বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে বাঙালির গার্হ্যস্থ জীবনের অন্তরালে। বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সাহিস্য বা কবিতা চর্যাপদ। এর রচয়িতারা ছিলেন মহাযানী বৌদ্ধদের অন্তর্ভুক্ত সহজিয়া গোষ্ঠীর সাধক। ‘তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মঠ ও বিহারে তারা সন্যাসির জীবন যাপন করতেন। হঠ যৌগিক তান্ত্রিক সাধনা এবং শাস্ত্রচর্চা নিয়ে তারা জীবন কাটাতেন।’১
মহাযানের প্রধান বিষয় হলো মন্ত্র। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় জানান, ‘তাহাদের কাছে যাদুশক্তি মূলমন্ত্র ও মণ্ডল’।২ অর্থাৎ বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যরা মন্ত্রের জাদুশক্তিতে বিশ্বাস করতেন, যা মূলত আদিম সমাজের লোকাচার বা লোক বিশ্বাস। সেই আদিম সমাজের সদস্য হলো—শবর, ডোম, চণ্ডাল, পুলিন্দ, নিষাদ, তন্তুবায় (তাঁতী) প্রভৃতিজাতির লোক। বঙ্গজনপদবাসী এই লোকেরা যে বিশেষ বৃত্তিধারী তন্ত্রসাধক ছিল, তার প্রমাণ আমরা সাহিত্যের নানা স্থানেই পাই।
চর্যাপদে সরাসরি বেদে প্রসঙ্গ না এলেও আদিম বঙ্গজনপদবাসী এই বিচিত্র পেশার লোকের পরিচয় পরোক্ষভাবে এসেছে। বেদেজনগোষ্ঠীর শান্দার সম্প্রদায়ের প্রধান কাজ হলো শানা ও গৈবী তৈরি করা। শানা ও গেবী হল তাঁতীদের তাঁত বোনার যন্ত্র। ‘শাহানা অর্থ চিরুনি, বাঙালিরা বিকৃত করে বলে হানা। এই হানা আসলে খাগড়ার নরম কাঠ দিয়ে তৈরি চিরুনি আকৃতির একটি যন্ত্র, যার মধ্য দিয়ে তাঁতের লম্বালম্বিভাবে টানা সূতাগুলো চলে যায়। তাঁতী ও জোলাদের কাছে এই যন্ত্রের খুব চাহিদা। একমাত্র শানদার বেদেরাই এই যন্ত্রটি সূক্ষ্ণভাবে বানাতে পারে। আর বেদেরা এই যন্ত্র বিক্রি করে বেশ সস্তায়। ৩
অন্যত্র শম্ভু নাথ জানান, ‘কাপড় বোনার তাঁত তৈরি করত ডোমেরা।’৪ এর প্রমাণ মেলে ১০ নং চর্যায় ‘তান্তি বিকনঅ ডোম্বী অবর ন চঙ্গতা।’ এখানে তন্ত্রী বলতে তাঁত যন্ত্রকেও বোঝানো হয়ে থাকতে পারে কেননা তন্ত্রী মানে তার। তাহলে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, বংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়টি প্রাচীন ডোমদের একটি শাখা, যারা তাঁতীদের জন্য তাঁত যন্ত্র তৈরি করত। চর্যা পদে তন্তুবায় ও ডোমদের প্রচুর উল্লেখ আছে। চর্যাপদে তন্তুবায় সম্পর্কে ২৬ নং পদে দেখি কবি বলছেন:
তুলা ধুনি ধুনি অসুরে আঁসু
আঁসু ধুনি ধুনি নিরবর সেসু।
অর্থাৎ তুলা ধুনে ধুনে আঁশে আশে লীন করা হয়। আঁশকেও ধুনে ধুনে নিরবয়ব করা হয়। এছাড়া চর্যাপদে শান্তিপাদ নামে যে সিদ্ধাচার্য ছিলেন তিনি বলেন, পাঁচটি কাল, তন্তুতে শুদ্ধ বা পবিত্র বস্ত্র বোনা হয়, আমি সেই তন্তুবায়, সুতো আমার নিজের, (আমি আমার সূতোর লক্ষণ নিজেই জানিনা।’৫ অন্যত্র কবি বলেন তন্তুবায় বৃত্তি ছেড়ে আমি বজ্রধর হয়েছি।’ অর্থাৎ বৌদ্ধ সাধক হয়েছেন। এ তথ্য থেকে প্রমাণ হয় যে, আদি মধ্যযুগে বাঙালি সমাজে তন্তুবায় পেশাজীবী ও তাঁত যন্ত্র নির্মাতা শ্রেণী হিসেবে শান্দার বেদে জনগোষ্ঠীরও অস্তিত্ব ছিল। এর প্রমাণ মেলে বাহ্নপাদের ১০ নং চর্যায়। সেখানে ডোম্বীর নড়া এড়া/নটপেড়া নামক উপকরণের উল্লেখ থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে ডোম সমাজে বহুরূপীর সাজপোশাক রাখার জন্য নটপেটিকার প্রচলন ছিল। অর্থাৎ তারা বহুরূপী সাজতো।
নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা যায় শান্দার বেদেদের একটি গোত্র ভারতে বহুরূপীর জীবন বেছে নিয়েছে। তারা নাম পদবিতে ‘ব্যাধ’ ব্যবহার করে।’৬ ব্যাধ অর্থ শিকারি। এই শিকারি ব্যাধের প্রসঙ্গও এসেছে চর্যাপদের ৬ নং পদে।
কাহারে যিনি মেলি আচ্ছহু কীস
বেঢ়িল হাক পড়অ চৌদীস
আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী।
খনহ ন ছাড়অ ভুসুক অহেরি।
অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ, শবর, পুলিন্দ, চণ্ডাল, ব্যাধ—প্রভৃতি অরণ্যচারী কোমদের শিকার ছিল প্রধান উপজীব্য।’৭ চর্যাপদে শবর নামে আর একটি বঙ্গজনপদবাসী জনগোষ্ঠীর সন্ধান পাওয়া যায়। নীহার রঞ্জন রায় এদের বৃত্তি সম্পর্কে বলেন ‘এদের অন্যতম বৃত্তিছিল সাপ খেলা দেখানো, জাদু বিদ্যার নানা খেলা দেখানো।’৮ তাদের সর্পদেবী জাঙ্গুলী নামে পরিচিত। শবরদের নৈরাত্মা দেবীর প্রতীক হলো ডোম্বী। নৈরাত্মাদেবী কখনো কখনো শবরী বলেও কল্পিত হন।’৯ চর্যার ২৮ নং পদে এই শবরদেবীর স্তুতি করা হয়েছে, যে কিনা সর্ববিষ মোচয়িত্রী হিসেবে মনসার সমকক্ষ।
এ প্রসঙ্গে নীহার রঞ্জন রায় বলেন ‘মনসার সঙ্গেই নাম করিতে হয় জঙ্গলবাসী, শবরকুমারীরুপিনী বৌদ্ধ জাঙ্গুলী দেবীর। এই দেবী বীনাবাদয়িত্রী এবং মনসার মতো তিনিও সর্ববিষমোচয়িত্রী। স্মরনরাখা প্রয়োজন যে বৈদিক স্বরস্বতী ও অন্যতম রূপে সর্ববিষমোচয়িত্রী এবং সেক্ষেত্রে তিনি শবর কন্যা।’১০ অর্থাৎ মধ্যযুগের বহু আগে থেকেই সর্পদেবী হিসেবে জাঙ্গুলী দেবী বা শবর কন্যার উপস্থিতি ছিল বাঙালি সমাজে। সর্পকেন্দ্রিক এক শ্রেণীর পেশাজীবীও যে তৎকালীন সমাজে ছিল, তার প্রমাণ মধ্যযুগের সংস্কৃত সাহিত্য তথা উমাপতি ধরের শ্লোক এবং গোবর্ধন আচার্যের শ্লোকে ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি।
চর্যাপদেও (২০ নং) ডোম বা ডোম্বীকে নাড়ি বিচার করতে দেখি এই বলে, ‘নাড়ি বিআরন্ডে সেবা বায়ুড়া।’
৪৩ নং চর্যায় পদকর্তা তন্ত্রমন্ত্রে স্থীর থাকতে পারছেন না। বলছেন, কী হবে তোর মন্ত্রে, কী হবে তোর তন্ত্রে, তোর ধ্যান ব্যাখ্যানে? অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রাচীন শবর ও ডোম সম্প্রদায়টি মন্ত্রগুনিন সম্প্রদায়ই ছিল। তাদের সমাজে সৃজন-উদ্দীপক ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল সেই যুগে।’১১ ড. সুর বলেন, এই প্রকার অনুষ্ঠান থেকেই উদ্ভব হয়েছিল শিব দেবতার। এরা আবার ধর্মান্তরিক হয়ে বৌদ্ধ হলে তারা নিজেদের আদিদেবতাকে আর ত্যাগ করতে পারেনি। ফলে, এদের সাধনায় বুদ্ধ হয়ে গেল ধর্মরাজ আর ধর্মরাজ হিন্দু সমাজের হলেন ধর্ম ঠাকুর। ড. সুর জানান ‘এই পূজার পৌরিহত্য করার একমাত্র অধিকার ডোম জাতিরই আছে।’১২
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে একসময় সমাজে ডোম জাতির মধ্যে থেকে নানা রকম পেশা ভিত্তিক জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, এই জাতিটি নানা রকম কাজেই দক্ষ ছিল। তারা পাটনীও ছিল। ডোম্বী পাদ ১৪ নং চর্যায় উল্লেখ করেন,
গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বহই নাঈ
তাই বুড়িলী মাতঙ্গী ঘোইআ লীলে, পার করেই।
বাহ তু ডোম্বী বাহলো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
এই সব নিম্ন স্তরের সমাজের লৌকিক পূজা হিসেবে মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল মনসামঙ্গল কাব্য। মনসা পূজা গৃহিত হয়েছিল আদিবাসী সমাজ থেকেই।’১৩
মধ্যযুগের মন্ত্রগুনিন সম্প্রদায়ের চিত্রটি ধরা পড়েছে মধ্যযুগের প্রায় সব সাহিত্যে। নিম্নস্তরের ডোম-শবরদসহ এ শ্রেণীর নারীদের মধ্যে তন্ত্রমন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কোরেশী মাগনের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যে দেখা যায়, ওঝা বা সাপুড়ে সাপের মাথা চিবিয়ে খেতো। সে বিশ্বাস করতো, এতে তার জাদুশক্তি বাড়বে।
সর্পে মারি মুণ্ডে সেবা করত্র ভোজন।
মুকুতা ঝরত্র মুখে হাসিতে দশক
অলক্ষিতে মুণ্ডু লই করিল ভোজন।
দুগুণ বাড়িল বল রূপ শত গুণ।’১৪
বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মা পুরান’ কাব্যে গাড়রী ওঝার বর্ণনা রয়েছে। বেদে সমাজে মাল বেদে গোত্রের ওঝা হলো গাড়লী। পদ্মাপুরানের এই ওঝা মৃত মানুষকে জীবন দেওয়ার কথা বলেন এভাবে:
বিষবর্ণ ঔষধ আছে উচলি পর্বতে,
সেই ঔষধে মরা মানুষ পারি জিয়াইতে।’১৫
বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল বা পদ্মা পুরানে মনসার পূজা প্রচলনের বিষয়টি তীব্র ঘাতসংঘাতের মধ্য দিয়ে সফল হয়েছে। অনার্য দেবী মনসার বৃত্তান্ত কোনো ব্রাহ্মণ্য পুরানের কাহিনী নয়, কবি সৃষ্ট লোক বিশ্বাসের ফসল। মনসার জন্ম বেড়ে ওঠা, বিয়ে বিয়ে পরবর্তী জীবন সংঘাত সবটার মধ্যেই সমকালীন অনার্য সমাজের নারী জীবনের ঘটনাই উঁকি মেরেছে। এ অবস্থায় নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে এবং সর্বস্তরের দেবী হয়ে ওঠার আকুলতার জন্য নিজের যোগ্যতা ও ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হয়েছে মনসাকে।
বিজয় গুপ্তের কাহিনীতে মনসার উচ্চ সমাজে গৃহীত হওয়ার পেছনে সামাজিক সংঘাতের দীর্ঘসময়ের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কাজ করেছে। এতে ফুটে উঠছে মধ্যযুগের সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থার নানা খণ্ডচিত্র। নিম্নস্তরে ঝালু-মালুর মতো জেলেরা যেখানে মনসার ভক্ত, এমনকি বণিক সম্প্রদায়ের মতো অভিজাত নারী সমাজ অর্থাৎ চাঁদ সওদাগরে স্ত্রীও যেখানে মনসাভক্ত, সেখানে সর্পদেবীর পূজা প্রচারের পেছনে বড় বাধা হয়ে দাড়ায় চাঁদ সওদাগর নিজে। একইসঙ্গে অনার্য সাপের ওঝা সম্প্রদায়ও।
মনসার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে ওঝা সম্প্রদায় উচ্চারণ করে মন্ত্র। একে বলা হয়, মহাজ্ঞান বা বীজমন্ত্র। এরা নানা ওষুধ গন্ধদ্রব্য এবং তন্ত্রমন্ত্রের সাহায্যে বিষকে প্রতিরোধ করতে পারে। বিষহরি দেবতার আশীর্বাদ তাদের প্রয়োজন নেই। বিজয়গুপ্তের কাব্যে ধন্বন্তরি ওঝার দম্ভোক্তি:
তক্ষকবাসকী আদি যত নাগ আছে
সকল চিবাইতে পারি যদি পাই কাছে।’১৬
কিংবা
তক্ষক বাসুকী আদি যত যত নাগ
দন্তে চিবাইতে পারি যদি পাই লগি।’১৭
সাপুড়ে ওঝারা যে সেই সময় জীবন্ত সাপের মাথা চিবিয়ে খেতো বা খেতে পারতো, তার প্রমাণ পাই কোরেশী মাগনের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যে:
সর্পে সারি মুণ্ডে সেবা করত্র ভোজন
মুকুতা ঝরত্র মুখে হাসিতে দশন।
অলক্ষিতে মুণ্ডু লই করিল ভোজন।
দুগুণ বাড়িল বল রূপ শতগুণ।’১৮
মঙ্গল কাব্যের ধনন্তর জানায়, ভাদ্রমাসের মঙ্গলবার যে অমাবস্যা হয়, তখন সাপের মাথা খেলে মনসার সাধ্য নেই যে, ওঝাকে যমের ঘরে পাঠাতে পারে। সেই অহঙ্কার ধন্বন্তরির:
সাপ খাম, বিষ পেম,
চারি যুগে মই জীম
যমের ভয় নাহিক আমার।’১৯
অর্থাৎ সাপ খেয়ে, বিষ পান করে অমর হওয়ার কথাই বলেছে ধনান্তরি। ধনান্তরি ওঝার মন্ত্র ও ক্ষমতা অবিনাশী। কাব্যে তাই:
কানে মন্ত্র কহে ওঝা পৃষ্ঠে ঘা মারে
নির্বিষ হইয়া শিষ্য উঠে একে বারে।’২০
শ্রী রায় বিনোদের পদ্মাপুরানে-শঙ্খ গাড়ুরীকে দেখি মৃত শিষ্যদের জীবন দিতে:
সাধন গামছা লৈয়া মহামন্ত্র পড়ি
জীয়াইল শিষ্যগন দিয়া গামছার বাড়ি।’২১
মৃতকে জীবন দেওয়া, শরীর বিষমুক্ত করা, পরনারী অপহরণ বা বশিভূত করার মতো কাজ করতে পারে গাড়ুরী ওঝা। গাড়ুরী শব্দটি এসেছে গড়ুর শব্দ থেকে। গড়ুর হলো সাপের শত্রু। যিনি গড়–র মন্ত্র জানেন, তিনি গাড়রী। দ্বিজবংশী দাসের পদ্ম পুরানে ধনান্তরিকে দেখি:
ঝুলি ভরি নিল চারি ঔষধের মূল।
গারুড়ি মন্ত্রের পুথি লইল বহুল।
হড়পি ভরিয়া সর্প নিল ভারে ভারে।
সত্ত্বরে চলিয়া যায় রাজা রাখি বারে।’২২ধনান্তরি ওঝা তার নিজের পরিচয় দেন:
ছয়কুড়ি শিষ্য মোর অনুচর সঙ্গে।
সর্পমারি বিষ খাই ঢাক বাজাই রেঙ্গ।’২৩
ধন্বন্তরি ওঝা যে বেদে তার প্রমাণ পাই ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণের প্রশ্নে, ‘কোথাকার বেদে তুমি গাড়ুরী বিদ্যার।’
মধ্যযুগের অন্যতম রচনা বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও উল্লেখ আছে—’তোমার যৌবন কাল ভুজঙ্গম/ আক্ষেহো ভাল গরুড়ী।’২৪ মনসার সঙ্গে গাড়রী ওঝা বা বেদেদের যে বিরোধ আমরা মঙ্গলকাব্যে লক্ষ করি, তা পরবর্তীকালে একেবারেই দূর হয়ে গেছে।
মনসার বিরোধী ধন্বান্তরির দম্ভোক্তি:
সেও আর আমি যদি থাকি একঘরে
তবু সে প্রাণে মোরে কি করিতে পারে।’ ২৫
অবশেষে এ বিরোধ ধূর হয়ে যায়। সমাজে মনসা পূজা প্রচলিত হবার পর সাপুড়েরা একেবারে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘যারা ছিল মনসাবিরোধী তারাই হয়ে উঠলো মনসামন্ত্রের সাধক। আগে ছিল এই বোধ আমরা ওষুধ ও মন্ত্র দিয়ে সাপকে ঠেকাব মনসার সাপকে। পরে বিশ্বাস হলো আমরা মনসার কৃপায় ওষুধ ও মন্ত্র প্রয়োগে সাপের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাব।’২৬
বাংলাসাহিত্যে ময়মনসিংহ গীতিকা অত্যন্ত সমাদৃত এর বিখ্যাত পালাগুলোর জন্য। ময়মনসিংহ গীতিকার একটি পালা মহুয়া’। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য এই পালাগুলোর প্রথম রচনা কাল ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী বলে উল্লেখ করেন।’২৭
এই সময়কে আদর্শ ধরে নাজমুন নাহার লাইজু সিদ্ধান্ত টানেন, ‘আমাদের দেশে বেদে জনগোষ্ঠী প্রায় দুইশত বছর থেকে চারশত বছরের প্রাচীন।’২৮ যদিও এই মন্তব্যটি সাম্পর্কে কোনো বিরোধিতার প্রয়োজন নেই, তবু ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়ার পালা যে একটি কালকে নির্ণয় করে, সে সম্পর্কে বলাই বাহল্য। মহুয়ার পালায় বেদেরা এসেছে স্বাভাবিকভাবেই। তাদের বিচিত্র পেশা, জীবন, সংস্কৃতির স্বভাব সম্পর্কে মহুয়ার পালায় যে বর্ণনা আছে তা অতিবাস্তব।
তিনশত বছর আগে দ্বিজ কানাই রচিত এই গ্রাম্য পালায় বেদেরা তাদের নেতিবাচক স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আবিভূত হলেও তা যে খুব স্বাভাবিক তাই প্রমাণিত হয়েছে। গবেষকগণ বেদেকে নিষ্ঠুর ও খল চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করলেও পালাকার মহুয়া বেদে সম্পর্কে কোথাও কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি, এ দায়িত্ব তার নয়। ফলে এ পালায় হুমরা বেদে যথার্থভাবেই প্রতিনিধিত্ব করেছে বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়টির।
মহুয়া পালার হুমরা বেদে ও তার দল বাজিকর সম্প্রদায়ের বেদে। এরা তামসা বা মজমায় নানা রকম খেলা দেখায় এবং পয়সা উপার্জন করে।
হুমরা বাইদ্যা ডাক দিয়া বলে মাইন কিয়া ওরে ভাই।
ধনু বাডি লইয়া চল তামসা করতে যাই।।
যখন নাকি হুমরা বাইদ্যা ডুলে মাইলো বাড়ী
নদ্যা পুরের যত মানুষ লাগলো দৌড়া দৌড়ি।।
একজনে ডাক দিয়া কয়রে আর এক জনের ঠাই।
ঠাকুর বাড়ী বাইদ্যার তামসা চল দেইখ্যা আই।।
যখন নাকি বাইদ্যার ছেরি বাশে মাইলো লাড়া
বইস্যা আছিল নদ্যার ঠাকুর উঠ্যা ঐল খাড়া।
দড়ি বাইয়া যখন বাঁশে বাজি করে।
নইদ্যার ঠাকুর উঠ্যা কয় পাইরা নাকি মরে।।
বাজী করলাম তামসা করলাম ইনাম বকসিস চাই
মনে বল নদ্যার ঠাকুর মন যেন তার পাই।’২৯
মধ্যযুগের এই পালায় বেদের উপস্থিতি আমরা আধুনিক যুগের সাহিত্যেও ছড়িয়ে যেতে দেখব। তাদের ব্যবহৃত চিরকালীন রাই চণ্ডলের হার, বিষল্যাকরণী আর যত ভেষজ ওষুধ; সবই সাহিত্যের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে বিশ্বস্তভাবে।
তোতা লইল ময়না লইল আরো লইল টিয়া
সোনামুখী দইয়ল লইল পিঞ্জরায় ভরিয়া।
ঘোড়া লইল গাধা লইল কত কইব আর
সঙ্গেতে করিয়া লইল রাও চণ্ডালের হার।৩০
পদ্মপুরানে ধন্বন্তরি কে দেখি
এত শুনি ধন্বন্তরি বিষৌষধি তুলি
কমণ্ডলুনিল আর ঔষধের ঝুলি।।
বিচিত্র সাপের ছাল বান্ধিয়া মাথায়।
ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠেতে চড়ি জয় ঢাক বাজায়
ছয়কুড়ি শিষ্য ওঝার চলিলেক সঙ্গে।
মন্দ্র মহৌষধি যত লইলেক সঙ্গে
অস্তি সঞ্চারিনী আর জীবসঞ্চারিন।।
জ্যোতিরূপা তেজময় বিমাল্য করনী।’৩১
মহুয়ার পালায় বেদেদের ঘর গৃহস্থালীর বর্ণনাও এসেছে চমৎকারভাবে। বেদেরা হাসের মাংস খেতে পছন্দ করে। তারা শিকার করে পাখির মাংস খায়। এই প্রসঙ্গটিও এসেছে মহুয়া পালায়:
হাস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া
ভালা কইরা রইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।৩২
মহুয়াপালায় দুই মাসের মেয়েকে চুরি করে হুমরা বেদে। বেদে মেয়ে হিসেবে সে হুমরা বেদের দলে বেড়ে ওঠে। নদের চাঁদের সঙ্গে মহুয়ার প্রণয় ও পরিণয়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায় হুমরা বেদে ও তার দল। ট্রাজেডিধর্মী এই পালায় নিষ্ঠুর ও খলচরিত্র হুমরা বেদের স্নেহ ও ঝরে পড়তে দেখি:
ছয় মাসের শিশু কন্যা পাইল্যা করলাম বর
কি লইয়া ফিরবাম দেশে আর না যাইবাম ঘর।
শুন শুন কন্যা আরে একবার আখি মেইলা চাও
একটি বার কহিয়া কথা পরান জুড়াও।৩৩
পালায় বার বার হুমরা বেদের উন্মক্ত আচরণ-বেদে স্বভাবের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে। মহুয়াকে দলে স্থায়ী ভাবে রাখার পেছনে বেদে দলের অর্থনৈতিক বিষয়টি ক্রিয়াশীল ছিল। হুমরা বেদের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে মহুয়ার রূপসৌন্দর্যই ছিল মূল চালিকাশক্তি। যার কারনে হুমরা বেদে মহুয়া ও নদের চাঁদকে মাঝখানে বার বার প্রতিরোধের দেয়াল তুলতে করছে। শেষপর্যন্ত মহুয়া ও নদের চাঁদের মৃত্যুতে যখন সে বেদনার্ত হয়ে ওঠে এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হয় তখন পাঠক তার দিক থেকে সুখ ফিরিয়ে নেয় কিন্তু এটাই যে বেদে জীবনের বাস্তবতা। তাদের স্নেহ ভালোবাসা জীবনের প্রয়োজনের কাছে জিম্মি হয়ে যায় গৃহহীন এই যাযাবর স্বভাবের মানুষের এই তো পরিণতি।
তথ্যসূচি
১ শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে সমাজতত্ত্ব, কলকাতা, ২০১২, পৃ: ৩৯
২. নীহার রঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, (আদিপর্ব), দে’জ সং, ১৪১৬ খ্রি:, পৃ: ৫২৬
৩. জেমস ওয়াইজ, পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ, তৃতীয় ভাগ,
৪. মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ: ৫৬
৫. শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৩
৬. অতীন্দ্র মজুমদার, চর্যাপদ, কলকাতা, ২০১১, পৃ: ১২৫
৭. ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়, বাংলার বহুরূপী, কলকাতা, ২০০৮ পৃ: ৩৬
৮. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ:৪৪৯
৯. প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৭১
১০. অতীন্দ্র মজুমদার, প্রাগুক্ত পৃ:১০৮
১১. নীহার রঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৮৯
১২. ড. অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, কলকাতা, পৃ: ১৩৬
১৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ১৩৬
১৪. প্রাগুক্ত পৃ:১৩৭
১৫. ড. মুহাম্মদ আবদুল জলিল, লোক চিকিৎসায় তন্ত্র-মন্ত্র,
১৬. বিজয়গুপ্ত, পদ্মপুরাণ, জয়কুমার দাশ গুপ্ত সম্পাদিত, কোলকাতা, পৃ: ১৭৭৫
১৭. বিজয়গুপ্ত, মনসামঙ্গল (পদ্মপুরাণ) পৃ: ৭৬
১৮. প্রাগুক্ত, পৃ: ৮৩
১৯. কোরেশী মাগন. চন্দ্রাবতী, পৃ: ৩৬
২০. বিজয়গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ: ৭৬
২১. বিজয়গুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃ: ৭৬
২২. রায়বিনোদ, পদ্মপুরাণ, (ড. মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া সম্পাদিত) পৃ: ১৪২
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ৮৩
২৪. প্রাগুক্ত, পৃ: ৮৪
২৫. বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্য (মুহম্মদ আবদুল) পৃ: ৩৭
২৬ বিজয় গুপ্ত, প্রাগুক্ত,পৃ: ৮৩
২৭. শম্ভুনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে সমাজ তত্ত্ব পৃ: ৫১
২৮. আশুতোশ ভট্টাচার্য, বাংলার লোক সাহিত্য-প্রথম খণ্ড, পৃ: ৩৭১
২৯. নাজমুন নাহার লাইজু, বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়, পৃ: ২৮
৩০. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ গীতিকা পৃ:১৪-১৫
৩১. প্রাগুক্ত, পৃ: ১৩
৩২. দ্বিজবংশী দাস, পদ্মপুরাণ, পৃ: ৮৩।
৩৩. শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন, মৈমনসিংহ গীতিকা, পৃ: ১৫১