বাংলাদেশে ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের বড় একটি অংশ রয়েছে যারা ‘গুরুপূজা’ অর্থাৎ গুরুকে ঈশ্বর জ্ঞানে ভজনা করে। এ সমাজের গুরু নারী বা পুরুষ যে কেউ-ই হতে পারেন। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্চর্যরকম সমন্বয়বাদী ধ্যান-ধারণা প্রকট। তারা হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতিকে একইসঙ্গে লালন করে। তাদের কারও নাম কালী স্বরস্বতী, কারও নাম নিজামউদ্দিন কিংবা রহিম। নাম নিয়ে তাদের বিশেষ মাতামাতি নেই। বিবাহিত নারী-রাশেদা বা মাজেদা, দেখা যায় তার কপালে লাল সিঁদুরে টিপ জ্বলজ্বল করছে।
খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের সন্ধান মেলে। ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের কোনো উপাস্য দেবতা নেই। নেই কোনো ধর্মগ্রন্থও। তারা প্রয়োজনে ভক্তি ভরে হিন্দুর মন্দিরেও যায় মুসলিমের মসজিদেও মানত করতে পারে। কিন্তু যা-ই করুক না কেন গুরুদেব কে না নিবেদন করে তারা কোনো ধর্মীয় কাজ বা সামাজিক কাজ করতে পারে না। ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিধি-নিষেধ সমস্তই রয়েছে তাদের গানের মধ্যে। প্রতি শুক্রবারে গুরুর বাড়িতে বা কোনো ভক্তের বাড়িতে গান ও ধর্মালোচনার আসর বসে। ফলে ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের ধর্ম-দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে হলে তাদের গান নিয়ে মূলত আলোচনা করতে হয়। ভগবানিয়া সম্প্রদায় বারোমাসে মূর্তিছাড়া বারো রকম পূজা অনুষ্ঠান করে, যার সব কিছু নিবেদন করা হয় গুরুর নামে, গুরুকে। এ সব অনুষ্ঠানকেই তারা ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে থাকে। যেমন-
বৈশাখ মাসে-ভগবতী পূজা
জৈষ্ঠ্য মাসে-জামাই ষষ্ঠী
আষাঢ় মাসে-রথযাত্রা
শ্রাবণ মাসে-মনসা
ভাদ্র মাসে-নবাআশ্বিন মাসে-ডাকসারান্দি
কার্তিক মাসে-কালিমাস
অগ্রাহায়ন মাসে-নবান্ন
পৌষ মাসে-পৌষসারান্দি
মাঘ মাসে-পঞ্চমী সরস্বতী
ফাগ্লুন মাসে-গোসারান্দী
চৈত্রমাসে-দোলপূর্ণিমা
এ সব অনুষ্ঠানে রান্না করা বা তৈরি করা পরমান্ন দেবতা নয় গুরুকে উৎসর্গ করা-ই ভগবানিয়াদের নিয়ম। ভগবানিয়া সম্প্রদায় ইসলামাচার পালন করলেও খৎনা প্রথা তাদের মধ্যে প্রচলিত নয়। বিবাহ সংস্কারের ক্ষেত্রে তারা হিন্দু আচার ও মৃত্যু সংস্কৃতিতে ইলামাচার পালন করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা এই সম্প্রদায়কে ভারতের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের শাখা বলে মনে করেন। কিন্তু ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা যায়, ভারতে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রর্বতক আউলে চাঁদের শিষ্য রামশরণ পাল এবং বাংলাদেশে ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলে চাঁদের অন্য শিষ্য শিশুরাম বা শিবরাম মোহন্ত বা ফকির মতান্তরে নফর বিশ্বাস। অতএব এ সিদ্ধান্ত একেবারেই টানা সমচীন নয় যে, বাংলাদেশের ভগবানিয়া সম্প্রদায় ভারতের কর্তাভজাদের শাখা। একই গুরুর অনুসারী হওয়ার ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের ধর্ম আর পাঁচটি লোকধর্মের মতোই সমন্বয়বাদী ধর্ম।
মানবতাবাদ
হিন্দু বা মুসলিম যাই হোক বাঙালির সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দেখা গেছে—প্রাগৈতিহাসিক সমাজের কৌমগত মানসিকতার মধ্যে কোনো শাস্ত্রীয় ধর্ম বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের ফলে নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্য ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলেও মনের বিশেষ স্তরে বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না।
আঠারো শতকে যতগুলো উপধর্ম সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রায় সবই সমন্বয়বাদী সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পার্থক্য কেবল বহিরাঙ্গে। মানসিকতায় তারা প্রায় এক। এদেশে যতই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসুক, রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক পীড়ন ও দাঙ্গা হোক, ধর্মীয় আন্দোলনের নৃশংসতা আসুক নিম্নস্তরের মানুষের সমাজ কাঠামোতে কোনো পরির্বতন সূচিত হয়নি। এদেশের মানুষ মনে ও মজ্জায় আশ্রয়ের সন্ধান পেয়ে গেলে সেটাকেই তার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় মনে করে স্থীর থাকতে চেয়েছে, ফলে প্রাক-আর্য-যুগ থেকে অনেক শাস্ত্রীয় ধর্ম এদেশে এসেছে কিন্তু সেই শাস্ত্রীয় ধর্ম সর্বাংশে তারা কোনোদিনও গ্রহণ করেনি বরং নিজের মতো করে তাকে লৌকিক করে নিয়ে সে স্থীর হয়েছে।
একইভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের জ্যামিতিক মাপ জোখের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলে সাধারণ মানুষেরাই সৃষ্টি করে নিয়েছে নিজের সহজ পথ। যে পথে তার মনের মুক্তি মিলবে। শ্রাস্ত্রীয় পণ্ডিতদের ছুৎমার্গের স্রষ্টাকে ছেড়ে তারা মানুষের ভজনা করতে চেয়েছে। ফকির বাউল গেয়ে ওঠেন:
মানুষের করন কারও
এবার সাধন বলে ভক্তির জোরে মানুষ ধরো
মানুষের করন করো
মানুষের করো না ভেদাভেদ
করো ধর্মযাজন মানুষজন
ছেড়ে দাওরে বেদ।
মানুষ সত্যতত্ত্ব জেনে মানুষের উদ্দেশ্যে ফেরো।
এই মানুষ ধরা অতই কি সহজ? মানুষের ভেদাভেদ জ্ঞান শূন্য না হলে কী করে সে মানুষ ধরবে। ভেদাভেদজ্ঞানকে দূর করতে হলে শাস্ত্রের নিয়ম-নীতি নয়, প্রয়োজন গুরুর চরণ, আর পান করতে হয় প্রেমের সূধা। ফকির তাই গেয়ে ওঠেন:
ঘাটে পথে দিও নারে মন
পান কর সদা প্রেমের সুধা অমূল্য রতন।
গোঁসাই চরন বলে কুবির চরন যদি নিতে পারো।
এই ঘাট পথ মূলত শাস্ত্রজ্ঞদের নিয়ম কানুন। ঈশ্বর এই নিয়ম কানুনে যাগযজ্ঞে থাকেন না থাকেন মানুষের মধ্যে। মানুষই ভগবানের আশ্রয়। তাই মানুষকে ধরতে না পারলে স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না। যে মানুষের অন্তরে ভগবান বিরাজ করে, সেই মানুষকে ধরাও তা অত সহজ নয়! তাই ভগবানিয়া গেয়ে ওঠে:
অধর মানুষ ধরা এবার ভার হয়েছে গো
মানুষ ধরি ধরি করি, ধরিতে না পারি গো,
…
এই যে মানুষরত্ন বেদের ওপর
বিরাজ করতেছে গো
কিংবা
মানুষ ধরা এত মুখের কথা নয়
…
এবার আপনি মজে তার পীরিতে তারে মজাইতে হয়।
অর্থাৎ মানুষকে ভালোবেস ঈশ্বর সাধনার পথ সুগম হয় তাইে তা সে গেয়ে ওঠে:
মানুষ হয়ে মানুষ মানো
মানুষ হয়ে মানুষ জানো
মানুষ হয়ে মানুষ চেনো
মানুষ রতন ধন
কর সেই মানুষের অন্বেষণ
ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সমন্বয়বাদের চমৎকার মেলবন্ধন। বিয়ের সংস্কৃতিতে হিন্দুয়ানা মৃত্যুর সংস্কৃতিতে ইসলামী পন্থা অবলম্বন করে এই সম্প্রদায়ের উদার মানসিকতার পরিচয় বহন করেছে বহিরাঙ্গে। আর অন্তরে সে সাধনা করে নিরন্তর মানুষ। এভাবে ভগবানিয়ারা মানবতার জয় গেয়েছে। এছাড়া ভগবানিয়া সম্প্রদায তাদের ধর্ম বা সম্প্রদায়কেন্দ্রিক কোনো নির্দিষ্ট বেশভূষা পরিধান করা, শরীরে কোনো চিহ্ন অর্থাৎ তুলসি মালা, রুদ্রাক্ষমালা, তিলক, ত্রিশূল প্রভৃতি ধারণ করাকে গর্হিত মনে করে। তারা মনে করে এগুলো মানুষের সঙ্গেমানুষের বিভেদ সৃষ্টির জন্য দায়ী। ভগবানিয়া সম্প্রদায় মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। আর তাই তাদের নির্দিষ্ট কোনো পোশাক বা চিহ্ন নেই।
গুরুবাদ
ভগবানিয়া সম্প্রদায় গুরুবাদীধর্ম। গুরুছাড়া তারা অন্য কারও উপাসনা করেন না। গুরুর গৃহই ভক্তের মন্দির। এই গুরু আবার একটি পরিবারে একাধিক হতে পারে। মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার গুরুর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করে বিয়ের পরে স্বামীর গুরুই তার গুরু হয়ে যায়। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও দেখা য়ায়। এই গুরুনির্ভর সাধন প্রক্রিয়া সূফি মতবাদে যেমন আছে তেমনি থেরবাদী বৌদ্ধদের মধ্যেও ছিল। এদেশে গুরুবাদটি গুরুবাদটা জৈন বৌদ্ধঅবদান। ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু ভক্তের যেমন মুসলিম গুরু রয়েছে, তেমনি মুসলিম ভক্তেরও আছে হিন্দু গুরু।
ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের ভক্তরা কর্তাভজাদের মতোই গুরুকে সর্বকাজের মধ্যমণি করে রাখে। কর্তভজা ভক্ত যেমন বলে:
প্রকৃত স্বভাব না নিলে হবে না গুরুভজন
আগে স্বভাবকে কর প্রকৃতি
গুরুকে পতিস্বীকৃতি।
তবে হবে আসল করণ।
অর্থাৎ গুরুকে স্বামীজ্ঞানে সমস্ত দায়-দায়িত্ব চিন্তা-ভাবনা অহঙ্কার তার চরণে সঁপে দিয়ে মুক্ত হওয়াটা সহজ হয়। একজন দেবতার পায়ে যত সহজে সব কিছু বিসর্জন দেওয়া যায়, একজন গুরুর কাছে (যখন সে মানুষ) কি অতসহজে সব সঁপে দেওয়া যায়? তবু ভগবানিয়া ভক্ত-ভক্তিতে আকুল হয়ে গুরুর বন্দনা করে।
কী দিব, কী দিব, প্রাণধন কী ধন আছে আমার
কী দিব কী দিব যে ধন তোমারে দিব
প্রাণধন সেইধন আমার তুমি।
কী দিব কী দিব প্রাণধন কী ধন আছে আমার?
তোমারই ধন তোমারে দিয়ে
প্রাণধন দাস্যগিরি করব পায়।
ভগবানিয়া ভক্তের বিশ্বাস গুরু নাম হলো একমাত্র মুক্তির পথ, যে নামে ভবযন্ত্রণা দূর হয়- মানুষ পথের দিশা পায়। তাই সে গেয়ে ওঠে:
মানব জনম পেলাম শেষে,
এবার যেন হারাইও না দিশে,
গুরু সত্য নাম ভুলো না।
ভাই বন্ধু আদি, এজগতের সাথী
এরা কেউ হবে না,
সঙ্গের সাথী কাঙাল বলে-
অন্তিম কালে গুরুনাম ছাড়া কেউ যাবে না পারে।
এজন্য ভগবানিয়া সম্প্রদায় গুরুনিন্দাকে মহাপাপ মনে করে। ভক্ত তাই বলে- গুরুনিন্দা অধঃগতি অর্থাৎ গুরুনিন্দা করা যেমন পাপ, তেমনি শোনাও পাপ। পতিনিন্দা শুনে সতীর যেমন মৃত্যু হয়, তেমনি গুরু নিন্দা শুনলে অধঃগতি প্রাপ্ত হতে হয় বলে ভগবানিয়া ভক্তরা বিশ্বাস করে।
গুরুর কাছেই ভক্তরা পথের নির্দেশ নেয়, সে গুরুর কাছে জানতে চায়-‘গুরু আমার এ পাপ দেহে কেন জ্ঞানের উদয় হলো নারে? গুরু তখন ভক্তকে মন্ত্র দেন:
সত্য মানুষের সঙ্গে থেকে
সত্য সত্য বলো মুখে,
নিরবধি থাকবা সুখে
মানুষের আশ্রয়্
একজন গুরু তার ভক্তকে মানুষের মধ্যে থেকে সত্যানুসন্ধানের মন্ত্র দেন। এমন্ত্র ফকির আউলে চাঁদ দিয়েছিলেন শিবরাম ঠাকুরকে; শিবরাম ঠাকুর দিয়েছেন ফতে মাহমুদকে। আর এখন ভগবানিয় গুরুরা সেই একই মন্ত্র ভক্তদের দেন। তারা বলেন, ‘একসত্য করো সার/ ভবনদী হবে পার।’ কী সেই সত্য? ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের গুরুমন্ত্র সত্য যাকে তারা বলে বীজমন্ত্র।
গুরু সত্য বিপদ মিথ্যা
গুরু সত্য, সত্য বলো, গুরু ধলো, সঙ্গে চলো।
এক সত্য করো সার
ভবনদী হবে পার।
এখানে সঙ্গে চলার তর্থই হলো সব মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে চলা। মানুষ ভেদজ্ঞান রহিত হয়ে চলা। গুরু ধরা যেমন ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের অবশ্যই কর্তব্য, তেমনি সত্য বলাটাও আবশ্যিক। এ জন্য এ ধর্মকে সত্য ধর্মও বলে, গুরু ধর্মও বলে।
এই গুরুবাদী মন্ত্র কর্তাভজাদের সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ নয় কেবল, সাদৃশ্যপূর্ণ সাহেব ধনী সম্প্রদায়ের সঙ্গেও। সাহেব ধনী সম্প্র্রদায় তার গুহ্যমন্ত্র বা গুরুমন্ত্রে বলে:
গুরু তুমি সত্যধন। সত্য তুমি নিরঞ্জন।
খাকি তেমার নাম সত্য। কাম্য সত্য। সেবা সত্য
ঠাকুর সত্য। বাক সত্য গুরু সত্য।
কর্তাভজা সনম্প্রদায়ের গুরুমন্ত্রও ভগবানিয়াদের অনুরূপ। তারা বলে:
জয় গুরু সত্য
কর্তা আউলে মহাপ্রভু
আমি তোমার সুখে চলি ফিরি
যা বলাও তাই বলি
যা খাওয়াও তাই খাই তোমাছাড়া তিলার্ধ নাই
গুরু সত্য বিপদ মিথ্যা
দোহাই আউলে মহাপ্রভু।
ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের মতো বাউল ও সুফি ধর্ম গুরুবাদী ধর্ম। কিন্তু সেখানে সমন্বয়বাদের আড়ালেও সুক্ষ্ম পার্থক্য বয়েছে। বাউল সাধনায় নারী সহায়ক, সেবাদাস। সেখানে নারী গুরু হয়ে উঠতে পারেনি, সুফি ধর্ম ও পীরবাদী বা গুরুবাদী ধর্ম সেখানেও নারী গুরু হতে পারে না। কিন্তু কর্তাভজা ও ভগবানিয়া সম্প্রদায় নারীকে দিয়েছে গুরুর মর্যদা। এটি তারা গ্রহণ করেছে বৌদ্ধ সহজিয়া তত্ত্ব থেকেই। বৈষ্ণব সহজিয়ারা নারীকে রাধার অংশ মনে করে থাকে। এই প্রাধান্য তান্ত্রিক ঐতিহ্যাশ্রয়ী। দেবী হচ্ছেন গুরু সকল নারীই কোনো না কোনোভাবে দেবীর গুনাবলী সম্পন্ন। বৈষ্ণব সহজিয়াও এটাই বিবৃত করে। যে গুরু দীক্ষাদেন, তিনি দীক্ষাগুরু, কৃষ্ণ। শিক্ষাগুরু, যিনি অনুভবকের উপলব্ধি করতে শেখান, হলেন রাধা। রাধার গুনাবলীতে ভাগ আছে সকল নারীর। তাই কোন না কোন ভাবে সকল নারীই গুরু।
শ্রী চৈতন্যের মা স্ত্রী হিসেবে শচীদেব ও বিষ্ণুপ্রিয়া প্রচুর সম্মান পেয়েছিলেন।রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্ত্রী সারদা দেবীও তেমনই সন্মান পান। চৈত্যদেবের প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্ন বা দেবীও হয়ে উঠেছিলেন একটি সম্প্রদায়ের নেতা। তাঁরই অনুরোধে নিত্যানন্দ দাস রচনা করেছিলেন প্রেমবিলাস। হেমলতা দেবীও ছিলেন ‘কর্নানন্দ’ গ্রন্থের রচয়িতা যধুনন্দন দাসের দীক্ষাগুরু।৩ শ্রীচৈতন্য বলেন ‘হোক স্বাক্ষন বা সন্ন্যাসী,অথবা শুদ্র, যে কৃষ্ণ জ্ঞানে বিজ্ঞ সেই হচ্ছে গুরু।’ চৈতন্যর জাত সম্পর্কিত মানুষের ধারণাটি ভেঙে দিয়েছেন জ্ঞানমার্গের আচরণীয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে। আদি বৈদিক ধর্মে নারীর দেবতারই স্থান ছিল না।সেখানে দেবীর সহজিয়া তত্ত্বের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভ করলেও সামাজিকভাবে নারীর মর্যদা ছিল যোগ্য স্ত্রী ও মা হয়ে ওঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ।সেই সীমাবদ্ধতার দেয়ালও ভেঙে ফেলেন সমন্বয় বাদী উপধর্মের ধর্মগুরুরা। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ভক্তরা এদিক থেকে অনেক প্রগতিশীলতার পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছেন।
তারা দুলাল চাঁদের মা সতী দেবীকে কর্তা মা জ্ঞানে পূজা ও সম্মান করে। শুধু তাই নয় তাঁর নামে তারা জয়ধ্বনিও দেয়।
দিলে সতী মায়ের জয় দিলে কর্তামায়ের জয়
আপদ খণ্ডে খণ্ডে কালের ভয়।
দিলে মায়ের দোহাই ঘোচে আপদ বালাই
ছুঁতে পারে না কাল শমনে।
ভক্তরা বিশ্বাস করে যে,সতী মায়ের দোহাই দিলে যেকোনো রোগবালাই দূর হয়। এভাবে সতী মায়ের অলৌকিক ক্ষমতা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারিত হলে সতী মা সাধ্বী রূপে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। ভক্তদের এই বিশ্বাস:
সতী মা ওপরে যেবা রাখিবে বিশ্বাস
সেরে যাবে কুষ্ঠ ব্যাধি হাঁপ শুল কাশ।
বাংলাদেশ ভগবানিয়া সম্প্রদায়ও সতীমাকে মান্যকরে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তাদের মধ্যেও দীক্ষাগুরু হিসেবে,শিক্ষাগুরু হিসেবে-নারী মন্ত্র দেন তার ভক্তকে।গুরুবাদী ধর্ম হিসেবে ভগবানিয়া ধর্মের যে টুকু মাহাত্ম্যা তার চেয়ে অনেক বেশি একে মহিমা দান করেছে নারীকে গুরুর মর্যদানের বিষয়টি। এই বিষয়টি সাহেব ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বেশি সরব—সেখানে রাধা হলেন সাহেব ধনী, তিনি এখানে কর্তা।
অথচ ভগবতে বা বৈষ্ণব ধর্মে রাধাকে একক ভাবে পূজা পেতে দেখা যায় না,কৃষ্ণের সঙ্গে তিনি একত্রে পূজা পান। কৃষ্ণবিহীন রাধার মূর্তির সন্ধান কোথাও মেলে না। অথচ সাহেব ধনী সম্প্রদায় রাধাকে কর্তা করে নিয়ে তার অর্চনা করছে। বারবার শ্রাস্ত্র যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানেই সমাজের নিচু তলার মানুষ ভালোবাসার আলো জ্বেলে মানবতার জয় ঘোষণা করেছে। একক পুরুষের জয় যেমন জয় নয়, নয় একক নারীর জয়ও নয় জয়। পৃথিবীতে স্রষ্টাকে লাভ করতে হলে তার সৃষ্টিকে সম্মান করতে হয়। এই সৃষ্টির রহস্যের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে পরম কর্তা, পরম মানুষ, পরম পুরুষ পরম প্রকৃতি, পরমাত্মা। তাই ভগবানিয়া ভক্ত গেয়ে ওঠে:
দিয়ে সৃষ্টির ভার
ঠাকুর করতে চাইলেন সুখ বিহার…
সৃষ্টির দায়িত্ব ভক্তকে দিয়ে-ই স্রষ্টা সুখী হতে চান—এই বিশ্বাস লালন করতে পারলে আজকের পৃথিবীকে সম্প্রদায়িক ইস্যুতে কাতর হতে হতো না। শাস্ত্রজ্ঞরা এটি বুঝতে পারেননি বলেই বারবার ধর্ম ভেঙেছে, ধর্মের লড়াই হয়েছে। ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত কৈবর্তের ঘরে মধুর হাসি হেসেছেন। এ যেন,
জলের মধ্যে ফুলবাগিচা
পাতায় পাতায় মেয়ে
জলের মধ্যে আগুন দিয়ে
বাউল রইলো চেয়ে।
গুরুবাদী এই সম্প্রদায়ের জন্য কতগুলো অলিখিত আদেশ রয়েছে। যা গুরু কেন্দ্রিক কর্তব্যকর্ম বলেই মানতে হয় ভক্তকে।ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের সব সামাজিক কাজ গুরুকে নিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। প্রতি মাসে গুরুগৃহে ভক্তকে অবশ্যই যেতে হবে। যদি একেবারেই কোনো যৌক্তিক কারণে তা সম্ভব না হয়, তা হলে বছরে দু-বার অন্তত যেতেই হবে। গুরুগৃহে যাওয়া সময় প্রয়োজনমতো খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতে হবে। বছরে অন্তত দু’বার নিজ গৃহে গুরুকে নিয়ে ধর্মীয় উৎসব করতে হবে। গুরু প্রদত্ত কোনো তত্ত্ব কোনো মন্ত্র কাগজে লেখা যাবে না। গুরু বচন সত্য বলে জানতে হবে ও মানতে হবে।আর এই বিধিনিষেধ মেনে ভক্ত তার আপন ভক্তির শতদল গুরুর পায়ে অর্পন করে গেয়ে ওঠে:
জগৎ গুরু বলিয়া দুবাহু তুলিয়া
ফকির গুন গাওরে…
ভক্তিবাদ:
আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থে বিষ্ণুর যে শাস্ত্র রয়েছে এবং তার যজ্ঞরূপে ও নামকীর্তনের মধ্যদিয়ে ভগবান বিষ্ণুর যে অনুগ্রহ লাভের উল্লেখ পাওয়া যায়, তা প্রচীনতম বৈষ্ণবাচার। এখানে লৌকিক পূজা অর্চনার বিষয় নেই। এই শ্যোতী বৈষ্ণব ধর্মের আলোচনায় ভক্তি কখনোই প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠেনি। বৈদিক পর্ব থেকে বিষ্ণু যখন পৌরাণিক যুগে আবির্ভূত হলেন তখন তিনি ভগবতের প্রধান অবতার কৃষ্ণ। ভক্তেরা তাই কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অংশাবতার বলে থাকে।পৌরাণিক বৈষ্ণব ধর্ম ব্রাহ্মণ শাস্ত্র দ্বারা অনুমোদিত হলে বৈষ্ণবচার ও পূজাপদ্ধতিসমুহ উপপুরাণসমুহে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। যারা এই লৌকিক আচার বা পূজানুষ্ঠানের বিরোধী ছিলেন, তারা যে তত্ত্বের অবতারণা করলেন, তার না, ভক্তিবাদ। ভগবত পুরাণে কৃষ্ণপ্রেমের ভক্তিমূলক ব্যাখ্যা তারা উপস্থাপন করেন।বাংলায় ধর্মচিন্তায় ভক্তিবাদের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে।
ভগবানকে পাওয়ার তিনটি পথ রয়েছে। আর সেগুলো হলো—জ্ঞানমার্গ, কর্মমার্গ ও ভক্তিমার্গ। জ্ঞান মার্গের লোকেরা ব্রহ্মাকে পান জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে কিন্তু ভক্তের হৃদয় ধরা দেন ভগবান।তাই ভক্তিতে মুক্তি মেলে—এই বিশ্বাসে ভক্ত সজল নয়নে করজোড়ে মাথা নত করে ভগবানের সামনে উপস্থিত হয়। ভগবান ও ভক্তের বোঝা বহন করতে যেন প্রস্তুত থাকেন সব সময়। শ্রী চৈতন্যদেব এই বৈষ্ণব ভক্তিকে জনগণের মনে এমনভাবে সু-প্রতিষ্ঠিত করে দেন যে, এই ভক্তির পথ ধরে সমাজে ধর্মীয় উদারনীতি ও ভক্তিবাদ প্রচার পেয়ে যায়। এই ভক্তিবাদের প্রচারে চৈতন্যের সহযোগী ছিলেনঅদ্বৈত আশ্চর্য, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস পণ্ডিত, গদাধর পণ্ডিত ও বড় গোস্বামীগণ।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবাচার্যরা মনে করেন, ভক্তিকে বাদ দিয়ে যারা কর্ম-জ্ঞানমার্গ দিয়ে ঈশ্বর লাভে বা মোক্ষলাভে চেষ্টা করে, তাদের দ্বারা মারমার্থিক সত্ত্বার সন্ধান লাভ সম্ভব নয়।এই পারমার্থিক সত্তার সন্ধান লাভের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্যের আন্দোলন বাংলার ভাবান্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।
ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের প্রবক্তা আউলে চাঁদ (লোক কাহিনি অনুযায়ী স্বয়ং শ্রীচৈতন্য) তার শিষ্যদের মধ্যে যে ভক্তিবাদ বা ভাববাদের রস প্রচার করেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বৈষ্ণব ধর্মকেন্দ্রিক সব লোকধর্মে ভক্তিবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। ভগবানিয়া সম্প্রদায় ও তাদের উপসনায় ভক্তিবাদকেই মোক্ষলাভের একমাত্র উপায় বা পথ বলে মনে করে। তাই ভক্তিতে ভগবানিয়া ভক্ত গেয়ে ওঠে:
ভক্তি বিনে হয় না ভজন,
আর এই ভক্তিভাবে বিশ্বাস হলে
মিলবে তবে মানুষ রতন।ভক্তি বিনে হয় না ভজন
আর ভক্তি বিনে মুক্তি পথ
কে কোথায় পেয়েছে, দেখ কে কোথায় পেয়েছে,
আর ভক্তি হবে মুক্তি পাবে
যার আছে একান্ত মনন।
ভগবানিয়া ভক্ত বিশ্বাস করে,ভক্ত যদি সেবার আয়োজন করে তাহলে ভগবান কিছুতেই সেই সেবা গ্রহণ না করে থাকতে পারেন না। ভক্ত যদি দরদ দিয়ে সেবা দেয়, তবে পাষাণও গলে যায়।
বৈষ্ণব মতবাদে মোক্ষলাভের যেমন একমাত্র পথ ভগবান শ্রীকৃষ্ণর প্রতি ভক্তের প্রেম, তেমনি ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের একমাত্র পথও হলো ভক্তি। কিন্তু এ ভক্তি বা প্রেম মানুষের প্রতি। এখানে এসে শাস্ত্রীয় ধর্ম ও লৌকিক ধর্ম আলাদা হয়ে যায়। বাউল তত্ত্বের শ্রেষ্ট পথও ভক্তিমার্গ বা প্রেমমার্গ ভগবানিয়াদের ভক্তি বা প্রেম সেই মানুষকেন্দ্রিক, গুরুকেন্দ্রিক। লালন যখন বলেন-
মানুষ গুরু কল্পতরু ভজমন
মানুষ হইয়া মানুষ ভজ
পাবা মানুষে মানুষে রতন।
কিংবা-
মানুষের চরণ ভজন কর মন
অথবা এই মানুষেই মানুষ আছে
মানুষ ধরা বিষম দায়।
মানুষের মধ্যেই যে অধর মানুস রয়েছেন সেই মানুষকে ধরা সহজ নয়। এজন্য মানুষের চরণই ভজন করতে হবে। বাউল ও সুফি দর্শনের ভবিক্তবাদ বা প্রেমবাদের অনুরূপ ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের দর্শন। ঈশ্বরকে পেতে তারা মানুষের আরাধনা করাকেই শ্রেয় মনে করে।
ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের কিছু মূল মন্ত্র রয়েছে, যেগুলোকে আজ্ঞা বা আদেশ হিসেবে তারা পালন করে। প্রথম ছয়টিকে বলা হয় কৈট বা কোট বা নিষেধজ্ঞা। এগুলো হলো:
১। চুরি করা যাবে না
২। ব্যাভিচার করা যাবে না
৩। মাংস ও ডিম খাওয়া যাবে না
৪। মদ গ্রহণ করা যাবে না
৫। এঁটো গ্রহণ করা যাবে না।
৬। মিথ্যা বলা যাবে না, জীবন চলে গেলেও না।
বাকি নয়টি নিষেধাজ্ঞাকে কর্ম বলে। এ কর্ম তিন রকম: বাক্য কর্ম, কায় কর্ম ও মন কর্ম।
বাক্য কর্ম তিনটি। যথা:
১। কটূ কথা না বলা।
২। অনর্থক বচন না বলা/অনাবশ্যক কথা না বলা।
৩। প্রণাম ভাষণ না দেওয়া।
কায় কর্ম তিনটি। যথা:
১।পরস্ত্রী গমন না করা।
২।পর দ্রব্য হরণ না করা।
৩।নরহত্যা না করা।
মন কর্ম তিনটি যথা:
১। পরস্ত্রী হরণের ইচ্ছা না করা
২। পরদ্রব্য হরণের ইচ্ছা না করা
৩। নর হত্যার ইচ্ছা না করা।
এছাড়া ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের গরু ছাড়া অন্য কোনো পশু পাখি পালন বা পোষ মানা নিষেধ।কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মতো বা বাউল সম্প্রদায়ের মতো ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই।গানেই তাদের মন্ত্র ও বিশ্বাসের ব্যাখ্যা।গানের মধ্যেই তারা পেয়ে যায় ধর্মের দর্শন-নীতি ও জীবনযাপন প্রণালী। এই গানকে তারা বলে ভাবের গীত বা পদের গান। প্রতি শুক্রবার তারা বাড়িতে অথবা নিজের বাড়িতে এই পদের গীতের আসর বসায়। সেখানে চলে তাদের ধর্ম-কর্ম আলোচনা। ভক্ত গেয়ে ওঠে:
মন চলো যাই গুরুর দরবারে
সংসারে সংসেজে বন্দী রইলি কেন কারাগারে।
নির্মল গুরুর কাছারী যেথায় নাইকো জুয়াচুরী
কামুকের দন্ডভারি আইন অনুমারে।
গুরু পাস করেছে পর আনা, হিংসুটের হয় যন্ত্রণা
কৃপা দণ্ডে জব্দ করে।
…
ভেঙেছে গুরুর তবিল, করগে ভক্তির আপিল
অনুরাগে রাখো উকিল প্রেমিক জুড়ি দারে।
এখন খালাস পাবি আনা হাসে (অনায়াস)
মনচলো যাই মানুষের দেশে
নিরবধি থাকবা সুখে সদাই এই শান্তিপুরে।
বেশির ভাগ পদের গানেই প্রেম ও ভক্তির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রেমই মানবতাবাদকে বেগবান করে তুলেছিল এ উপমহাদেশে।
ভগবানিয়া সম্প্রদায় ঈশ্বরকে মালিক বলে।আর ভক্তের দেহ ঈশ্বরের সম্পদ। তাই তাদের মধ্যে ‘খাজনা প্রদান’ এর রেওয়াজ আছে। কেননা তারা বিশ্বাস করে যেহেতু ভক্তের দেহে জীবাত্মা ও পরমাত্মার বাস, তাই জীবাত্মা ও পরমাত্মার বসবাসের কারণ স্বরূপ মালিককে খাজনা দেওয়াই বিধেয়। এ যেন খ্রিস্টের সেই বিখ্যাত বাণীর অনুরণন—‘ঈশ্বরের যা তা ঈশ্বরকে দাও, কৈসরের (রাষ্ট্র বা সরকার) যা তা কৈসরকে দাও।’
বাংলার ভগবানিয়া সম্প্রদায়ের প্রবক্তা শিবরাম মান্যবংশের কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন কৈবর্ত বা জেলের সন্তান। তবে গৃহধর্মের এই সম্প্রদায়ের লোকেরা একেবারে বৈরাগী বা বিবাগী না হলেও বিষয় সম্পদের লোভী নয়। ধর্মই তাদের দান করেছে সংযম। তাই অর্থলিপ্সা তাদের সহজাত নয়। তারা তাই দাস্যভাবে গুরুর সেবা করে। মানুষের সেবা করে। কর্ম করে সে গেয়ে ওঠে: ‘মানুষের সুখের কর্ম করবে মন সকলে’।মানুষই তার ঈশ্বর। মানুষের সুখের চেষ্টাতেই তার ঈশ্বরসাধনা সফল হয়।এভাবে ভগবানিয়া ধর্ম এক মহৎ মানবধর্ম হিসেবে পরিচিত পায়।