বিচিত্র সংস্কারাচ্ছন্ন আদি কৌম গোষ্ঠীগুলোর একটি হলো বেদে জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী নিয়ে নানারকম গবেষণামূলক কাজ হলেও তাদের ভাষা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। এমনকি এ সম্পর্কে কোনো গবেষণা প্রবন্ধও নজরে আসে না। এর মুখ্য কারণ, বেদেরা আড়ালপ্রিয় ও ভ্রাম্যমাণ জাতি। এ কারণে তাদের ভাষা বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহ করা কঠিন।
বাংলাদেশের বেদেদের ভাষা পরিস্থিতি জানতে হলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নামসহ জনসংখ্যার তথ্য জানা জরুরি। বাংলাদেশে সরকারি আদমশুমারী প্রতিবেদন ১৯৯১ অনুযায়ী, সুনির্দিষ্টভাবে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা হলো বম, বুনো, চাকমা, গারো, হাজং, হরিজন, খুমি, খাসিয়া, খিয়াং, কোচ, লুসাই, মাহাতো, মণিপুরি, মারমা, ম্রো, মুরাং, মুন্ডা, ওঁরাও, পাহাড়িয়া, পাঙ্খো, রাজবংশী, রাখাইন, চাক, সান্তাল, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা ও উরুয়া। এদের সংখ্যা নয় লাখ চুয়ালিশ হাজার দুইশত পঁয়ত্রিশ জন।(অশোক বিশ্বাস, বাংলা ভাষায় ভোটবর্মী ভাষার প্রভাব, পৃ: ১০) এ ছাড়া অন্যান্য নামের আর একটি কলামে যে তালিকা আছে তাতে অন্যান্য বলতে কোনো কোনো জাতি গোষ্ঠীকে শনাক্ত করা হয়েছে তার উল্লেখ নেই। অথচ সারা বাংলাদেশে এই অন্যান্যর সংখ্যা দেখানো হয়েছে দুই লাখ একষট্টি হাজার সাতশ চৌত্রিশ জন। এদিকে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ফোরাম অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৫।( অশাক বিশ্বাস, পৃ:১০) বাংলাদেশে বসবাসরত এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রায় ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে।( সৌরভ সিকদার, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা, পৃ:১) এদের মধ্যে চাকমা ও মারমা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো লিপি নেই। সাঁওতাল, খাসি ও গারোরা রোমান লিপি ব্যবহার করে। নিচে শ্রেণী সারণির মাধ্যমে বাংলাদেশের তাদের ভাষা পরিস্থিতি ও জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দেখানো হলো :
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অবস্থান: বাংলাদেশ
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম | ভাষার নাম | ভাষা পরিবার | জনসংখ্যা | লিপি |
অহমিয়া | ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা? অহমিয়া | ইন্দো-ইউরোপীয় | খুব অল্প | অহমীয় |
বেদে | ঠার | তিব্বতি-বর্মি(সাক-লুইশ) | ৪০,০০০ | নেই |
বম | বম | তিব্বতি-বর্মি(কুকি-লুইশ) | ৬,৯৭৮ | নেই |
ভূমিজ | মুণ্ডা | অস্ট্রো-এশিয়াটিক | === | নেই |
চাক | চাক | তিব্বতি-বর্মি(সাক-লুইশ) | ২,০০০ | নেই |
চাকমা | চাকমা/চাঙমা | ইন্দো-ইউরোপীয় | ২,৫২,৯৮৬ | মনখেমের |
দালু | দালুই (গারো উপগোত্র) | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ==== | নেই |
গারো | মান্দি/আচিক | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ৬৮,২১০ | নেই (প্রচলিত রোমান) |
হাজং | হাজং | ইন্দো-ইউরোপীয় | ১,১৪,৭৭৭ | নেই |
খাসি | খাসি | অস্ট্রা-এশিয়াটিক | ১৩,৪১২ | নেই |
খারিয়া | মুণ্ডা | অস্ট্রা-এশিয়াটিক | === | নেই |
খিয়াং | খিয়াং | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | ২,৩৪৫ | নেই |
খুমি | খুমি | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | ১,২৪১ | নেই |
কোচ | কোচ | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ১২,৬৩১ | নেই |
কোল | মুণ্ডা | অস্ট্রা-এশিয়াটিক | === | নেই |
কর্মকার | সাদরী | ইন্দো-ইউরোপীয় | === | নেই |
লুসাই | লুসাই | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | ৬৬২ | নেই |
মারমা | মারমা/বর্মি | তিব্বতি-বর্মি (লোল-বার্মিজ) | ১,৫৪,২১৬ | বর্মি/মনখেম |
ম্রো/ম্রু | ম্রো | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | ২২,১৭৮ | নেই (রোমান, ম্রো) |
মনিপুরি | মৈতেয় | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | ২৪,৯০২ | অহমিয়া, রোমান |
মাহাতো | সাদরী | ইন্দো-ইউরোপীয় | ৩,৫৩৪ | নেই |
মুণ্ডা | মুণ্ডা | অস্ট্রো-এশিয়াটিক | ২,১১২ | নেই |
মালো | সাদরী | তিব্বতি-বর্মি (কুকি-চীন) | নেই | |
মাহালি | এহালি (লুপ্ত) সাদরী (ব্যবহৃত) | দ্রাবিড়/ইন্দো-ইউরোপীয় | নেই | |
ওঁরাও | কুড়ুক/সাদরী | দ্রাবিড়(উত্তর) | ৮৫,০০০ | নেই |
পাংখোয়া | পাংখোয়া | তিব্বতি-বর্মি(কুকি-চীন) | ৩,২২৭ | নেই |
পাহাড়িয়া | মালতো (লুপ্ত) সাদরী (ব্যবহৃত) | দ্রাবিড়, ইন্দো-ইউরোপী | ১,৮৫৩ | নেই |
পাত্র | পাত্র (লালং-গারো) | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ২,০৩৩ | নেই |
রাখাইন | মারমা/বর্মি | তিব্বতি-বর্মি (লোল-বার্মিজ) | ১৬,৯৩২ | বর্মি/মনখেমের |
রাজোয়ার | রাজোয়ার (লুপ্ত)সাদরী (ব্যবহৃত) | ইন্দো-ইউরোপীয় | নেই | |
রাই | সাদরী | ইন্দো-ইউরোপীয় | নেই | |
রাজবংশী | রাজবংশী | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ৫, ৪৪৪ | নেই |
সাঁওতাল | সাঁওতালী | অস্ট্রো-এশিয়াটিক | ২০২৭৪৪ | নেই (বাংলা ওরোমান প্রচলিত) |
সিং | সাদরী | ইন্দো-ইউরোপীয় | নেই | |
তনচঙ্গা/তনচংগা | তনচংগা (চাকমা) | ইন্দো-ইউরোপীয় | ২১,০৫৭ | বর্মি (চাকমার অনুরূপ) |
ত্রিপুরা | ককবোরক | তিব্বতি-বর্মি (বোড়) | ৭৯,৭৭২ | নেই (বাংলা,রোমান) |
পাহান | সাদরী | ইন্দো-ইউরোপীয় | ৬,০০০ | নেই |
উৎস : বাংলাদেশের আদিবাসীর ভাষা, সৌরভ সিকদার, বাংলা একাডেমি, প্রকাশকাল ২০১১,পৃ. ১-৩
সারণিতে উল্লিখিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষালিপি নেই। বিষয়টি ভাষা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যেমন অন্তরায় তেমনি ভাষা টিকে থাকার প্রশ্নেও ঝুঁকিপূর্ণ। জনসংখ্যার দিক থেকে শক্ত অবস্থানে থাকা সাঁওতাল, গারো, চাকমা, ত্রিপুরা, মারমা, মণিপুরিরা তাদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা ধরে রাখার চেষ্টা করলেও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা চর্চার প্রাধান্য খুব বেশি, যা তাদের ভাষার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ পরিস্থিতিতে প্রান্তিক স্তরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রসঙ্গে অশোক বিশ্বাস বলেন, ভূমিজ, ভূইয়া, বেদে, মসহর, রাজোয়ার, সিং, তুরি, রাই, মুরিয়ার ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা এমন এক প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে যে, বর্তমান অবস্থায় তাদের ভাষা (কেবল বাংলাদেশে বসবাসকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) সম্পূর্ণ অক্ষুণ্নভাবে সংরক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদের মাতৃভাষা শেখা এবং বলার প্রতি ঝোঁক প্রায় নেই বললেই চলে। (প্রাগুক্ত, পৃ:১২)
ভাষালিপি না থাকা এবং ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠী হওয়ার ফলে অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা দ্রুত প্রান্তিক স্তরে পৌঁছে গেছে। তা ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়ন, বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে দ্রুত বিপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থায় এদের ভাষা নিয়ে গবেষণা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার উদ্ভব ও ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখযোগ্য গবেষণা খুব বেশি হয়নি। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউশনের কল্যাণে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কতিপয় গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ রচিত হলেও বেদে জনগোষ্ঠীর ঠার ভাষা নিয়ে এখনো পর্যন্ত ভাষাবিজ্ঞানের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো গবেষণা হয়নি। আর সে লক্ষ্যে বর্তমান গ্রন্থে বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষার উদ্ভব আলোচনা, ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে, যেন বিপন্নপ্রায় এই জাতির ভাষা সম্পর্কে স্বচ্ছ ও যৌক্তিক ধারণা লাভ করা যায়।
বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়:
বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মতোই তাদের ভাষা নিয়েও রয়েছে বিশেষ জটিলতা। নৃতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের বেদেরা অস্ট্রাল গোত্রভুক্ত হলেও গবেষকগণ বলেন যে, তাদের ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সাক-লুইশ শাখা থেক বা ঠেট বা ঠার ভাষা। ( সৌরভ সিকদার, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩)
বেদে ভাষা ‘ঠার’ প্রসঙ্গে বিজ্ঞজনেরা বলেন যে বেদেরা যে ভাষায় কথা বলে তা বাংলাদেশের চাক জাতির চাক ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের চাকরা বান্দরবান জেলায় বাস করে। বার্মার রাখাইন রাজ্যেও তাদের বড় অংশের বসতি। সেখানে তারা সাক বা থেক নামে পরিচিত। এদের গায়ের রঙ ফর্সা, চুল কালো ও সোজা, শরীরে পশম কম, ঠোঁট পুরু যা বেদে দেহ বৈশিষ্ট্যের বিপরীত।
বেদেরা নৃতাত্ত্বিকভাবে প্রটো অস্ট্রালয়ড বা আদি অস্ট্রাল হলেও এদের ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের অন্তর্গত বলে জানান গবেষকেরা। পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫,৩১,০০০ জন। এবং এরা মোট ১৫টি ভাষায় কথা বলে, যা এই ভাষা পরিবারভুক্ত। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অবস্থানগত পরিস্থিতি বিশেষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৯১ সালের পরিসংখ্যান মতে ঠারভাষী বাংলাদেশি বেদের সংখ্যা ৪০,০০০। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যানের অর্থ হলো ঠারভাষীর অবস্থান এই পরিবারের ভাষা সদস্যদের মধ্যে চতুর্থ। এর আগে রয়েছে যথাক্রমে মারমা ভাষী, গারো আচিক/মান্দী ভাষী এবং ত্রিপুরা—কক বোরকভাষী জনগোষ্ঠী।
বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রসঙ্গে ড. সৌরভ সিকদার বলেন, ‘১৬৩৮ সালে শরণার্থী আরাকানরাজ বলালরাজের সাথে মনতং জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা।’৫ ( সৌরভ সিকদার, প্রাগুক্ত,পৃ. ২৩)
অথচ ঐতিহাসিক নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে বলালরাজের সাথে যে জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আসে তারা মনতং নামের কোনো স্বতন্ত্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নয়, বরং মংতং নামধারী মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এবং তাদের ভাষা ঠার নয় বর্মি। এটি তিব্বতি-বর্মিজ (লোল বর্মিজ) পরিবারের ভাষা।
‘মান্তা সম্প্রদায়ের জীবিকার সংকট ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পন্থা উদ্ভাবন’ গ্রন্থে শংকরলাল দাশ মান্তাদের ভাষা সম্পর্কে বলেন, ‘মানতা সম্প্রদায়ের বহু মানুষ জানিয়েছে যে তাদের ভাষার সাথে বেদেদের ভাষার হুবহু মিল রয়েছে। তারা যখন বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে তখন নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে। একই ভাষার ব্যবহার ছাড়াও উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের পরস্পরের আকার-ইঙ্গিত একই রকম। ভাষার সাদৃশ্য উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছে।’ (পৃ. ৩৪) শংকরলাল দাশ তার গবেষণায় মানতাদের নিজস্ব ভাষার নাম কী তা উলেখ করেননি। গবেষণায় তিনি বেদেদের ভাষা প্রসঙ্গে পূর্বসূরিদের মতামতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনিও বলেন যে বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। তবে মাঠ সমীায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের বেদেরা নিজেদের মানতা বলে এবং মান্তাদের মতো তাদের নিজেদের ভাষাকে ঠার ভাষা বলে পরিচয় দেয়। ড. সিকদার বেদের এই ভাষাকে বার্মা, চীন ও লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে জানান। একই সাথে বাংলাদেশের চাক ভাষার সাথে এ ভাষার মিল বা ঘনিষ্ঠতা খতিয়ে দেখার পে মত দেন।৭ (প্রাগুক্ত,পৃ. ২৩) কেননা উভয় ভাষা একই ভাষা পরিবারের সদস্য। এ অবস্থায় এ দুটি ভাষার সাংগঠনিক কাঠামো ও শব্দভান্ডারের তুলনামূলক বিচার-বিশেষণ জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা একই উৎস থেকে আসা ভাষাগুলোতে শব্দ ও ভাষার সাংগঠনিক কাঠামোতে সাদৃশ্য থেকে যায়।
চাক ও ঠার ভাষার বৈচিত্র্য :
চাকরা পার্বত্য চট্টগ্রমের বান্দরবান জেলার বাইশারি, নাই্যংছড়ি, আলিখ্যং, কোয়াংঝিরি, কামিছড়া, ক্র্যোং প্রভৃতি মৌজায় বাস করে। মিয়ানমারে তাদের বড় অংশের বাস রয়েছে। সেখানে তাদের সংখ্যা প্রায় ২০,০০০ এবং সেখানে তাদের আরেক নাম সাক বা থাক। এদের ভাষা চীনা-তিব্বতি পরিবারের সাক-লুইশ শাখার অন্তর্গত। বেদেদের ঠার ভাষার মতো চাক ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। নৃতত্ত্বের বিচারে বেদেরা অস্ট্রাল আর চাকরা মঙ্গোলীয়। এ ছাড়া ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে চাকদের সাথে বেদেদের তেমন কোনো সাদৃশ্য নজরে আসে না। কোনো জাতির ভাষায় তার ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অনিবার্য। সে বিচারে বেদেদের সাথে চাকদের ভাষার কোনো সাদৃশ্যও নজরে আসে না। ঠার ভাষার মতো চাক ভাষার কোনো বর্ণমালা নেই। নিচে বেদেদের ঠার ভাষা ও চাক ভাষার তুলনামূলক চিত্র দেওয়া হলো।
বাংলা | ঠার | চাক |
বাবা | খাইপতা | আবা |
মেয়ে | ডেমি | আসিক |
আগুন | পেগুন | ডভয়া |
চোখ | কোখি | আমিক |
মানুষ | চেনুষ | ওই |
বাতাস | চেতাস | মুঙ |
স্তন | লোপ | আসুক |
দাদা | ডুককি | আপা |
চাক ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সাক-লুইশ গোত্রের একটি ভাষা। এর স্বরধ্বনিগুলো হলো ই, এ, এ্যা, আ, অ, উ। অন্যদিকে ঠার ভাষায় স্বরধ্বনি পাওয়া যায় সাতটি। ই, এ, এ্যা, আ, অ, ও, উ। চাক ভাষায় যে স্বর টোনাল বৈচিত্র্য এর উচ্চারণকে কঠিন করে। (সৌরভ সিকদার,প্রাগুক্ত,পৃ. ২২) ঠার ভাষায় তার দেখা মেলে না। আবার চাক ও ঠার ভাষার বাক্য গঠনরীতি বাংলার মতোই কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া ক্রমধারা অনুসরণ করে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে চাক ভাষার শব্দের সাথে ঠার ভাষার ন্যূনতম ঋণ শব্দের দেখা পাওয়া যায় না। সারণিতে দেখা যায় চৌদ্দটি শব্দের মধ্যে একটি (আমি-আং-ঙা) মাত্র শব্দের সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত বেদেদের সাথে বান্দরবানের চাক জাতির তেমন কোনো সম্পর্ক গড়ে না ওঠার কারণে ঠার ভাষায় চাক ভাষার প্রভাব প্রকটভাবে ল করা যায় না। তা ছাড়া বাংলাদেশের বেদেদের বসবাসের বা বিচরণের ত্রেও সম্পূর্ণভাবে আলাদা। তারা বাংলাদেশের নদীবিধৌত সমভূমি অঞ্চলকেই বসবাসের জন্য নির্ধারণ করে থাকে এবং এই বাসস্থান স্থায়ী হয় না। নির্দিষ্ট সময় পর তারা আবার পাট চুকিয়ে চলে যায় অন্যত্র, যেখানে জীবিকার সম্ভাবনা আছে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের বেদেদের জন্য চাক ভাষা আধিপত্যবাদী ভাষা নয়, বরং বাংলা ভাষাই তাদের কাছে আধিপত্যবাদী ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বেদেদের সবচেয়ে বড় বাসস্থল ঢাকা, সাভার; চাঁদপুর, মতলব; মানিকগঞ্জ, সাটুরিয়া; সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল। এসব অঞ্চলে ঠার ভাষায় চাক ভাষার শব্দ বা ধ্বনিঋণের সুযোগ কম।
ড. সিকদার সাক-লুইশ শাখার যে গোত্রটিকে বেদেদের ঠার ভাষা বলে উলেখ করেছেন তা আসলে ঠার নয় তা উত্তর বার্মার থেক বা ঠেক ভাষা। এটি সাক বা আসাক ভাষার সমগোত্রীয়।
রমানি ও ঠার ভাষার বৈচিত্র্য :
অপর একদল গবেষক বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষায় এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার প্রভাব লক্ষ করেছেন। গবেষকেরা বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষাকে ইন্দো-ইরানীয় ‘রমানি’ ভাষা বলে উল্লেখ করেন। ভাষাবিজ্ঞানীরা বেদেদের ভাষাকে ভারতীয় আর্য ভাষা বলেই চিহ্নিত করেছেন। (মিথুশিলাক মুরমু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অন্বেষণ, পৃ. ১৯০) এদের মধ্যে আছেন ড. উলিখ, আর এল টার্নার, ড. কোচানোউস্কি, ড. ডাবিউ. আর. রিশি প্রমুখ পণ্ডিত। (শ্রীপান্থ,জিপসির পায়ে পায়ে,পৃষ্ঠা ৫৬) কিন্তু এই মন্তব্য বাংলাদেশের বেদেদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কিছুতেই। রমানি বাংলাদেশের বেদেদের ভাষা নয় বরং ভারতের বাদিয়াদের ভাষা যারা বাঞ্ছার, নাটরা, বাওরিস, বিলক ভাঙ্গি, বান্টু বা চুরাদের মতোই স্থলচারী যাযাবর। ভারতের এই বাদিয়াদের সাথে বাংলাদেশের বেদেদের বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে যেসব বাদিয়া আছে তাদের সংস্কৃতির সাথে বেদেদের সংস্কৃতিরও মিল নেই। বাংলাদেশে এরা সাদরী ভাষায় কথা বলে। এটি ইন্দো-আর্য পরিবারের ভাষা। ভারতে বাদিয়ারা আবার রমানি ভাষায় কথা বলে বলে একমত পোষণ করেন জিপসি গবেষকগণ। নিচে রমানি ও বাংলাদেশের ঠার ভাষার নমুনা দেওয়া হলো, যা থেকে বোঝা সম্ভব হবে যে ঠার ও রমানি একই ভাষা গোত্রের ভাষা নয় এবং বেদেদের ভাষাকে রমানি বলেও মেনে নেওয়া যায় না। এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যা বাংলাদেশের বেদেদের নিজস্ব ঐতিহ্য।
বাংলা | ঠার | রমানি |
পাখি | ফইকলা, পোক্কর | চিরিকলো |
বড় | ডাডো | বোড়ি |
মরা | নিরগা | মুলের |
জিনিস | কুনিশ | চিজ |
কুকুর | ভুতকাল | জুকল |
ঋষি ঠার ও বেদে ঠার ভাষার বৈচিত্র্য :
এদিকে ঠার ভাষা নিয়ে আলোচনা আরও জটিল হয়েছে তখন, যখন জানা গেল ঠার কেবল বেদেদের ভাষার নাম নয়, ঋষিদের ভাষার নামও ঠার। গবেষণায় দেখা গেছে বেদেদের মতো ঋষি বা মুচি নামক অন্ত্যজ শ্রেণির জনগোষ্ঠীও ঠার ভাষায় কথা বলে। আর উভয় গোত্রের ভাষার মধ্যেও বিস্তর পার্থক্যও রয়েছে। ফাদার যোসেফ রানা
মন্ডল তাঁর ‘রাঢ় সমতটে খ্রিষ্টধর্ম’ গ্রন্থে ঋষিদের ঠার ভাষা সম্পর্কে বলেন, ‘ঋষিদের এই ঠার ভাষা আজ বিলীনের পথে। এদের মধ্য থেকে যারা আজ শিতি হয়েছেন তাদের অনেকেই এই ভাষা আজ ভুলে গেছেন অথবা নিজেদের ভাষা বলতে আজ অস্বীকার করেন।’ ফলে ঋষি ঠার ভাষার খুব বেশি নমুনা পাওয়া যায় না। নিচে যোসেফ রানা মন্ডল কর্তৃক গৃহীত ঋষি ঠার ভাষার নমুনার সাথে বেদে ঠার ভাষার নমুনা তুলে দেওয়া হল।
বাংলা | ঋষি ঠার | বেদে ঠার | বাংলা | ঋষি ঠার | বেদে ঠার |
হিন্দু | ঝুটকো | বিঁধু/গিরু | গরিব/খারাপ চেহারা | ডভনে | নুডলে খেনুষ |
গ্রাম | গামাল | গাওলি | ধনী/ভালো চেহারা | সায়গা | খলু খেনুষ |
ছুরি | আরকো | নেতর | পুলিশ | বয়কা | নাটকোল |
ভাত | কুড়োন | বতন/ধুতি/লিপ্তি | মুসলমান | গাটা | চেঙ্গি/খুসলা |
চাল | দাতি | গেউল/গেল | হাঁস | ফ্যাসফ্যাসে | ভেরাক/বক্কর |
ডাল | হলেতো | ডাইরবাড়ি/বতুলেরলিরিনি | মাছ | দামারকা | ছাইমলা/খেমাছর |
খাওয়া | খোটা | টাগা | শূকর | গদগদে | গোধর |
সারণিতে দেখা যাচ্ছে যে, ঋষি ঠারের সাথে বেদে ঠারের পার্থক্য বিদ্যমান। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে ঠার যদি চীনা-লুইশ গোত্রের ভাষা হয় বা রমানি গোত্রের ভাষাও হয় তবে সেটি কোন ঠার, বেদে-ঠার নাকি ঋষি-ঠার? ভাষাবিজ্ঞানীরা সাক-লুইশ গোত্রের যে ভাষাটিকে থেক বলেছেন ড. সিকদার সেটিকে ঠার বলে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু যেহেতু বেদেদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ নেই তাই ড. সিকদার এ ভাষার কোনো নমুনা দিতে পারেননি। তবে আমরা নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে এ কথা বলতে চাই যে বেদেদের ভাষা বা ঋষিদের ভাষা কোনো টাই সাক-লুইশ গোত্রের ভাষা নয়। তাহলে এদের ভাষাকে কী বলা যায়? এটা কি আদৌ কোনো ভাষা নাকি উপভাষা, নাকি নিভাষা নাকি তা অপার্থ বা সাংকেতিক ভাষা?
বেদে জনগোষ্ঠীর ঠার ভাষা কোনো উপভাষা নয়। উপভাষা হলো ছোট ছোট দলের বা কোনো অঞ্চলের বিশেষভাবে প্রচলিত ভাষাছাঁদ। এ বিচারে চট্টগ্রাম বা সিলেট অঞ্চলের বাংলাভাষীদের ভাষাছাঁদ আলাদা আলাদা উপভাষা কিন্তু বেদেদের ঠার ভাষা কোনো উপভাষা নয়। কেননা এদের এই ভাষার মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য যেমন আছে তেমনি গোত্রে গোত্রে ঠার ভাষার শব্দবৈচিত্র্যও ল করা যায়। বেদেদের প্রধান দুটি গোত্রে ও একটি উপ-উপগোত্রের ব্যাপক শব্দবৈচিত্র্য এ ভাষাকে জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। একটি গোত্রের সাথে অন্য একটি গোত্রের বাগ্ব্যবহারের ধ্বনি, শব্দ ও শব্দ প্রয়োগের যে স্বতন্ত্রতা ল করা যায় তাতে এক একটি গোত্রের এ ভাষাকে Idiolect বলা যেতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ঠার ভাষাকে তো Idiolect বলা চলে না।
তাহলে এটা কি সাংকেতিক ভাষা? বেদেদের ঠার ভাষা প্রসঙ্গে নাজমুন নাহার লাইজু বলেন, ‘বেদে সমাজে নিজস্ব সাংকেতিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে। বেদেরা এই ভাষাকে ঠার ভাষা বলে অভিহিত করে। ঠারের অর্থ হলো উল্টো ভাষা। বেদেরা নিজ সমাজে এই ভাষায় কথা বলে।’ এদিকে ড. অসীত বরণ পালও তার গবেষণায় বেদেদের ভাষাকে সাংকেতিক ভাষা বলেই শনাক্ত করেছেন। সুকুমার সেন বলেন, ‘গোপনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য অথবা অসৎ উদ্দেশ্যে দলের লোকের কাছে প্রকাশ্যে অন্যের অবোধ্য অথচ প্রয়োজনীয় সংলাপ স্বাভাবিকভাবে চালাইবার জন্য বিশেষ বিশেষ (এক বা একাধিক ভাষা হতে গৃহীত) শব্দ বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এ রকম বাগ্ব্যবহারকে অপার্থ-ভাষা অর্থাৎ সংকেত-ভাষা বলা হয়।’ (ভাষার ইতিবৃত্ত,পৃ: ২৩) এ রকম ভাষার মধ্যে ঠগীদের রামসিয়ানা ভাষার উলেখ করেন ড. সেন। রামসিয়ানা শব্দের অর্থ হলো রাম-চালাকি অর্থাৎ বড় রকম ফাঁকি। অপরাধ জগতের বা দুর্বৃত্তদের গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ভাষাই যে কেবল সাংকেতিক ভাষা হিসেবে সব সময় ব্যবহৃত হবে তা নয়।
বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা কি অপরাধজগতের ভাষা?
গবেষকগণ প্রায়ই সাংকেতিক ভাষাকে অপরাধজগতের ভাষা বলে শনাক্ত করতে চান। অপরাধজগতের সব ভাষাই সাংকেতিক ভাষা হতে পারে কিন্তু সব সাংকেতিক ভাষাই যে অপরাধজগতের ভাষা এমনটা নয়। অপরাধজগতের বা নিষিদ্ধ জগতের ভাষার মধ্যে কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অন্য সাংকেতিক ভাষার সাথে নাও মিলতে পারে। নিষিদ্ধ জগতের ভাষার অধিকাংশ শব্দই দেশি ভাষার শব্দ বা শব্দার্থ ও রূপালংকারের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয় বা হয়ে থাকে। যেমন স্বর্ণালংকারকে পাশ্চাত্যের অপরাধজগতের ভাষায় ‘বরফ’ বলা হয়, আবার হেরোইন কোকেনও ‘বরফ’। বারবণিতার কাজ বোঝাতে অপরাধজগতের ভাষায় ‘লি-বিঝনেস’ বলা হয়। আবুল কালাম মনজুর মোর্শেদ তার আধুনিক ভাষাতত্ত্ব বইয়ে জানান, ‘অপরাধজগতের ভাষার বৈশিষ্ট্য ল করলে দেখা যায় তাদের শব্দভান্ডারে একটি আন্তর্জাতীয় প্রভাব বিদ্যমান।’ (পৃ. ১৬৬) যেমন আমেরিকার অপভাষা (উচ্চারণ বিকৃত বা শব্দ প্রয়োগ বিকৃত ত্র“টিপূর্ণ শব্দ বা ভাষা) অন্যান্য দেশের অপরাধজগতের ভাষায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
নিচে অপরাধজগতে ব্যবহৃত কতগুলো শব্দের নমুনা দেওয়া হলো।
অপরাধজগতের ভাষা | অর্থ |
জুঁই | মেয়েবন্ধু |
উনডা | সুন্দরী |
বারুয়া | পুলিশের ইনফরমার |
এ্যাকরা | বোঝা |
আলগা | বিদেশি, আগন্তুক |
ককরো | পুলিশ |
ফুঙ | কোকেন |
কলম | দরজা-জানালা ভাঙার যন্ত্র |
মাস | জেলখানা |
চাম | গুন্দর (১৫-২০ বছরের মেয়ে) |
বেদে জনগোষ্ঠীকে কি অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করা যায়? ব্রিটিশ শাসন আমলে কতিপয় ক্ষুদ্র যাযাবর গোষ্ঠীকে অপরাধপ্রবণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়, যাদের মধ্যে বেদেরাও ছিল। অথচ বেদেরা উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক কালপর্ব থেকে যে এ দেশের ভূমিজ তার প্রমাণ রয়েছে প্রাচীন সব সাহিত্যে। প্রাচীনকালে তারা রাজপুরুষের মর্যাদা পেত বলে জানা যায়। তাদের মৌখিক সংস্কৃতিও বেশ ঋদ্ধ ছিল। বেদেদের রয়েছে নিজস্ব বস্তুগত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নিজস্ব বিবাহ সংস্কার, গান, লোকসাহিত্য, চিকিৎসা পদ্ধতি আর ভাষা। বেদেদের গানের সুর থেকে সৃষ্টি হয়েছে সংগীতের বিশেষ রাগ, যার নাম মালকোষ। যাদের সংস্কৃতি এতটা ঋদ্ধ তারা কোনো ‘গোপন তথ্য সরবরাহ’ বা ‘অসৎ উদ্দেশ্যে’ ঠার ভাষা ব্যবহার করবে তা মেনে নেওয়া যায় না। তবে কেন তাদের ভাষাকে গোপন সাংকেতিক ভাষা বলা হয়? অপরাধপ্রবণ জাতির তালিকায় ভাগ্যলিপি বাঁধা পড়ার পর থেকে তাদের ভাষার ওপর আরোপ করা হয় এই অপবাদ। অথচ গোপন সাংকেতিক ভাষা কেবল যে অপরাধজগতের ভাষা তা নয় এটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মী, সাংবাদিক এবং স্পাইরাও ব্যবহার করে। ড. সেন জানান, চর্যাগীতিতেও এই রকম অপার্থ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যাকে প্রচীন টিকাকারগণ সান্ধ্য ভাষা বলেছেন। বেদেদের ভাষায় কি সেই রকম অপার্থ শব্দ আছে যে রকমটা অপরাধজগতের মানুষেরা ব্যবহার করে?