আহমদ ছফা—বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনার কারণে যার নামটি অনন্য। আহমদ ছফা জানতেন—বাংলাদেশের উত্থানের জন্য প্রয়োজন রেনেসাঁ। আর এ রেনেসাঁর জন্য প্রয়োজন সচেতন নাগরিক সমাজ। দেশের সমাজবাস্তবতা, রাজনীতি, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থ রক্ষার্থে নতুন রেনেসাঁ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। কারণ, এক্ষেত্রে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের তুলনায় নবীন চিন্তকদের প্রয়োজন অপরিসীম। জনমুখী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখার মতো নবীন শিল্পী-সাহিত্যিক ও চিন্তকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। যারা বলে দিতে পারবে—আগামীতে এ হতে যাচ্ছে। যারা অনুধাবন করবেন—তাদের মতো বুদ্ধিজীবী মহল বা সুশীল সমাজের কালেক্টিভ অ্যাকশন সার্বিক অভিমত হচ্ছে—সুশাসন ও জাতীর উন্নয়নে সহায়ক। তাদের নিয়ে আহমদ ছফা স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি এদেশের সুশীল সেজে থাকাদের মুখোশ উন্মোচন করেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-এর প্রথমাংশে।
ছফা বলেছেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে […] যারা সারা জীবন কোনোকিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন—সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।’
মনে করি—আহমদ ছফার সমকালে এ বুদ্ধিজীবী হিসেবে যে সমাজটির পরিচিতি ছিল, আজ তারা সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী যাই বলি না কেন, তার চরিত্র বিশ্লেষণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনিবার্য। বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের আলোচনায় এ বুদ্ধিজীবী বা তাদের চরিত্রের বিশ্লেষণ করা এবং নাগরিক সমাজের করণীয় নির্ধারণ অনিবার্য বিষয়।
আন্তর্জাতিক চিন্তকদের দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবী
অ্যাডাম বি সেলিগম্যান ১৯৯৫ সালে এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে—ব্যক্তিস্বার্থ ও জনস্বার্থের সমন্বয়। যদিও আমেরিকায় সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের উত্থান হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও আমেরিকায় তারা সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।’ আবার সমাজতাত্ত্বিক অ্যান্থনি গিডেন্স ১৯৮৬ বলেন— ‘ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন সম্ভব ব্যক্তিসচেতনতা ও সামাজিক ঐক্যের মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়ে সুশীল সমাজ একটি রাষ্ট্রের মোরাল অথরিটি হিসেবে ব্যক্তিজীবনের অংশ হয়ে যায়।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়—সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে। অন্যদিকে জন আর ইহেনবার্গ ১৯৯৯ সালে বলেন, সুশীল সমাজ একটি রাজনৈতিক সমিতি হিসেবে সমাজের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাতে নাগরিক দ্বন্দ্ব নিরসন করা যায়। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা যায়, আমাদের দেশে যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের অংশ বলে জাহির করার চেষ্টা করেন, তারা তাদের ভূমিকার কারণে বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না। তারা আসলে পরজীবী অথবা পরজীবী সুশীল সমাজ, যারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় সমাজকে সমালোচনা করে কখনো পথ দেখাতে পারেনি।
আবার মার্কসীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বলা যায়, সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে সমাজের একটি প্রতিষ্ঠান। আর প্রত্যেকটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামো ক্ষমতাধর পুঁজিবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। রাষ্ট্র পুঁজিবাদ-সমর্থিত এ সুশীল সমাজের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। তাহলে আমরা বলতে পারি—একটি পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সুশীল সমাজ কখনো জনগণের স্বার্থ নিয়ে কথা বলে না। যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণী বা জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে সমাজের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের এ তত্ত্ব অনুযায়ী, পুঁজিবাদপালিত বুদ্ধিজীবী বলা যেতে পারে। নিও মার্ক্সবাদী অ্যান্থনি গ্রামসি ১৯৭১ সালে এই চরম অবস্থার ব্যাখ্যা দেন ‘হেজেমনি’ শব্দ দিয়ে। ‘হেজেমনি’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, একশ্রেণীর চতুর মানুষ নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থকে দেশ বা জাতির স্বার্থ হিসেবে উপস্থাপন করে। ‘হেজেমনি’র ব্যাখ্যায় সুন্দরভাবে এস হার্ডি ২০০৯ সালে বুঝিয়েছেন, যেভাবে সমাজের একশ্রেণী সমাজের ওপর তাদের প্রভাব এমনভাবে বিস্তার করেন, যেন জনগণ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প সহজে মেনে নেয়। আর অর্থনৈতিক শোষকদের চাহিদা ও ইচ্ছা দুই সমাজের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হয়। গ্রামসি যার একটিকে বলেছেন সিভিল সোসাইটি (বুদ্ধিজীবী) আর অন্যটি হচ্ছে পলিটিকাল সোসাইটি তথা স্টেট।
এ ব্যাখ্যা বিবেচনা করলে আমাদের বলতে হয়, আমাদের বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ সঠিক পথেই আছে। তারা তো স্বাভাবিকভাবেই জনগণের বারোটা বাজিয়ে চলছে। আদর্শগত হেজেমনি সৃষ্টি করে বুর্জোয়া শ্রেণী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তাদের ক্ষমতা সমাজে মিডিয়ায়, পারিবারিক সংস্কৃতি ও সংস্কার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সর্বত্র। এই হেজেমনিক ধারণা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক তৈরি। শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বার্থকে সমাজের সকলের স্বার্থ হিসেবে উপস্থাপন করে। তারা দাবি করে তাদের প্রচারিত মতবাদই একমাত্র যৌক্তিক। কিন্তু রবার্ট ডি পুটনাম ১৯৯৩ সালে বলেন, একটি জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুশীল সমাজের ঐতিহ্যগতভাবে অংশগ্রহণমূলক অবদান অপরিহার্য। এতে করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের প্রতিষ্ঠানের পারফরমেন্সও বৃদ্ধি হয়। Bowling Alone: America’s Declining Social Capital (1995, p. 65) তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় একটি সচেতন সিভিল সোসাইটি বা বুদ্ধিজীবী সমাজ থাকতে কীভাবে উন্নয়শীল রাষ্ট্রে সুবিধাভোগীরা জনগণকে বোকা বানায়। কেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৈষম্য হ্রাস করতে পারে না। কারণ এই বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের লোকজন সুবিধাবাদীদের স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আর তারা শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষোভ প্রশমনে ন্যূনতম মজুরি, চিকিৎসা, শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও কারখানার লভ্যাংশে কখনো শ্রমিকের অধিকার মেনে নেয় না।
একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রোধ করা যায় একটি আধুনিক ও সচেতন সুশীল সমাজের মাধ্যমে। যে সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বই হচ্ছে সুশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ন্যায়বিচার এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হওয়া। আর তাহলে সে দেশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে। যে সিদ্ধান্ত মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, তা মানুষ নিজেই নিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বাদ নেবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিস্টোফার অ্যাডাম ও স্টিফেন ডারকন (২০০৯) সালে তাদের বই, The political economy of development: an assessment-এ বলেছেন, ‘উন্নয়ন শুধুমাত্র সম্পদকেন্দ্রিক নাও হতে পারে।’ তাঁরা বলেছেন, ‘তাহলে এশিয়ান টাইগার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও কেন দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই ও বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। তাহলে বোঝা যায় সচেতন ব্যক্তি বা সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালীকরণে ভূমিকা রয়েছে। আর তখনই সে দেশে শিক্ষা, প্রযুক্তিরপ্তকরণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠানের যথাযথ কর্মক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাই জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজন একটি সচেতন সুশীল সমাজের উপস্থিতি।’ কেননা একটি সচেতন সুশীল সমাজের অনুপস্থিতির কারণে আফ্রিকার আজ এ অবস্থা। এ কারণে ওমর আজফার ২০০১ সালে বলেন, ‘কালেক্টিভ অ্যাকশনকে আমরা স্বাগত জানাই। কারণ জাতীয় ঐক্য বা কালেক্টিভ অ্যাকটিভ অ্যাকশন জাতীয় সম্পদ, অবকাঠামো পরিবেশ বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা রাখে।’
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সুশাসনকে জাতীয় স্বার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তাও বাজার অর্থনীতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর সুশাসন ও শাসককে জবাবদিহিতার পরিবেশে নিয়ে আসতে বাধ্য করতে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য বা কালেক্টিভ অ্যাকশন। আর জাতীয় ইস্যুতে জনমতের ঐক্যের জন্য প্রয়োজন একটি সচেতন সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী মহল। যারা জাতীয় স্বার্থ নিয়ে কথা বলবে। জনগণকে সচেতন করবে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করবে। তাই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা রক্ষার প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য হলেও সুশাসন একটি অপরিহার্য বিষয়। আবার মনসুর ওলসন ১৯৯৬ এই কালেক্টিভ অ্যাকশন বা জাতীয় ঐক্য ও সুশীল সমাজের সচেতন অবস্থানকেও ‘market-augmenting government force’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মনসুর ওলসন আরো বলেন, ‘কেন কোনো দেশ উন্নত হচ্ছে আর কেন অন্যসব দেশ উন্নয়নের কাতারে শামিল হতে পারছে না। এ প্রশ্নের উত্তর দিলেই সব সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারবো।’
বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের পাপ
এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনায় স্পষ্ট হলো একটি সচেতন বুদ্ধিজীবী মহল বা সুশীল সমাজের কালেক্টিভ অ্যাকশন সুশাসন ও জাতীর উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। চাই সে সমাজব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক হোক বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা হোক। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় স্বাধীনতার আগে ও পরে এমন কোনো বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি আমরা পাইনি। এ বাস্তবতা দেখেই আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘দুই যুগ, এক যুগ, ছয় যুগ, দুই বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোনো বইতে বাংলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তার ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে সুশীল সমাজের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা তা করেননি। অথচ সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদেরই সুশীল সমাজ বলতে হয়, যারা রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে না থেকেও জনগণের স্বার্থে কথা বলবেন। তারাই সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবী। এই সুশীল সমাজ এখনও জাতিবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত। তারা নিরাপদ সড়ক নিয়ে করা আন্দোলনে চুপ থাকেন। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে অযৌক্তিক প্রতিপন্ন করেন। এ কারণে আহমদ ছফা বলেন,
‘পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকে ইসলামি রাষ্ট্র নামের ব্যঞ্জনায় কেউ মোহিত হয়ে, কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ প্রতিপত্তির কারণে, কেউ লোভে পড়ে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটি পরিম-ল সৃষ্টি করেছিলো। এই রকমের একটি আবহাওয়া পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরা সৃষ্টি করেছিলো বলেই পশ্চিমারা অত সহজে কোনো রকমের আগপাছ চিন্তা না করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেবার দুঃসাহস করেছিলো। তার ফল অজানা নয় কারো। যা (ভাষা) বিনা কথাতেই পাওয়া উচিত, তার জন্য রক্ত দিতে হলো।’
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের পাপের ফল একটি জাতিকে পুরোই বহন করতে হয়। রক্ত দিয়ে তার খেসারত দিতে হয়।
এ কারণে আহমদ ছফা ফরাসি সাহিত্যের রেফারেন্স টানেন। যেখানে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে গল্পের নায়ক আশাহত। কিন্তু লেখক তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন ফরাসি সাহিত্য পড়ার। কারণ ফরাসি সাহিত্যে এমন কিছু আছে, যা পাঠ করে নায়ক হতাশা কাটাতে পারেন। অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য এমনভাবে রচিত হওয়া উচিত যাতে করে তা সমাজবাস্তবতার সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কথা বলে। হতাশের বুকে আশা জাগায়। একারণে বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টির সংকীর্ণতা ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে সংস্কৃতি ও রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক হতে পারেনি। ফলত আক্ষেপ করে আহমদ ছফাকে বলতে হয়, ‘রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদের, উড়নচণ্ডী কবিদের বিলাসের, চিত্তবিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিলো।’ এ কঠিন বাস্তবতা থেকে আমরা এখনো রেহাই পাইনি।
আইয়ুব খান তার ক্ষমতা রক্ষার্থে শিক্ষকদের মধ্যে, সাংবাদিকদের মধ্যে, সাহিত্যিকদের মধ্যে সুবিধাভোগী বাছাই করলেন। তাদের বাড়ি গাড়ি বিদেশ ভ্রমণ এবং পারিতোষিকের সুযোগ-সুবিধা করে দিলেন। অথচ তখন সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড দুরবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতেও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। স্বাধীনতার পরেও টাকা দিয়ে ধারালো কলম কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে এ বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ জনগণের শোষণে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। কারণ যে সমাজে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকটতর হয়, ব্যাংকের টাকা লুট, ঋণখেলাপি সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, সেই সমাজে সাংবাদিকেরা ও বুদ্ধিজীবীরা এবং সুশীল সমাজেরা শোষণের কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন। তা না হলে সে সমাজে এতগুলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে না কেন? তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, কবি-সাহিত্যিকদের দায়িত্ব কী? এর উত্তরও দিয়েছেন আহমদ ছফা। তিনি বলছেন, ‘কবি সাহিত্যিক লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তাঁরা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার ভ্রূণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। জাতীয় জীবনে যা ঘটে গেছে অতীতে, তাঁরা ভাবের আবেশে সামনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ফেলেন এই-ই হতে যাচ্ছে এবং এই হবে।’
স্বাধীনতা পরবর্তী কোনো সময় এমনকি এখন পর্যন্ত আমরা বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এ অবস্থান দেখা যায়নি। ১৯৭২ পরবর্তী এ সমাজব্যবস্থার উন্নয়নে ও জাতীয় ইস্যুতে আমরা উল্লেখ করার মতো এমন কোনো অবস্থান বুদ্ধিজীবীদের দেখিনি। আর যেহেতু সুশীল সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের এমন অবস্থান দেখিনি, তাই সহজে বলা যায়—বাংলাদেশে যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের অংশ বলে দাবি করে তারা আসলে সুশীল নয়। তারা শুধু বিলাপ করে পত্রিকার পাতায় আমাদের সোনালি অতীত নিয়ে। অনেক সময় গান ধরে—আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। এই জাতীয় বিলাপ প্রমাণ করে আগামি নিয়ে কী ভাববো, আমরা অতীত নিয়ে ভাবি। তাই ছফা বলেন—‘অথচ বিলাপ একটি জীবন্ত সম্ভাবনাময় জাতির সবচাইতে বড় শত্রু। কারণ যে জীবন্ত, তার অতীতের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে খেদ করার খুব একটা বেশি সময় নেই। অতীতের চাইতে তার কাছে ভবিষ্যৎ মুখ্য।’
এরই ফলে আমরা দেখিম, একটি বিশেষ শ্রেণী চটকদার স্লোগানে জাতিকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষমতাসীন দলের নামে তারা জনগণকে এখনো বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় বসে পাকিস্তানি একনায়কদের অনুকরণে চিন্তার স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, কল্পনার স্বাধীনতা, এককথায় দেশের নামে জাতির নামে সমস্ত মানবিক স্বাধীনতা হরণ করে। এসব নিয়ে এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহল চুপ। শুধু বিএনপির ক্ষমতাকালে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা সরব আবার আওয়ামী ক্ষমতাকালে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা সরব।
বিদেশ ফেরত শিক্ষিতদের বিদ্যার দৌড় ও বিদেশি সমাজবাস্তবতা
আহমদ ছফা বিদেশ ফেরত শিক্ষিতদের বিদ্যার দৌড় ও বিদেশি সমাজবাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টায় হতাশা প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজে আবিষ্কৃত থিউরি বা তত্ত্ব আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের সমাজবাস্তবতার আলোকে সত্য। সেই একই তত্ত্ব বাংলাদেশে প্রায়োগিক আকারে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন নিজস্ব থিউরি আবিষ্কার ও বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতার আলোকে সমাধান খোঁজা। এ বাস্তবতা বুদ্ধিজীবীরা বোঝেন না। বরং বিদেশি থিউরির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে নিজেকে মহাজ্ঞানী প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তাই জ্ঞান আবিষ্কারের তুলনায় বিদ্যা দেখানোর প্রতিযোগিতায় তারা ব্যস্ত থাকেন বেশি। এ কারণে আহমদ ছফা বলেন—‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলগুলোতেও বিলেত আমেরিকা ফেরতদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তার নগদ ফল এই যে, বিলেত আমেরিকা ফেরতাদের দৌরাত্ম্যে সমাজে টেকা একরকম দায় হয়ে পড়েছে। এই বিলেত আমেরিকা ফেরত পণ্ডিতেরা বিলেত, আমেরিকার কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন। […] সলিড কিছু করার বদলে বিলেতি বিদ্যের গুমর দেখাতেই তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ পেয়ে থাকেন।’
এ বাস্তবতার কারণে বিদেশের ভারিক্কি ডিগ্রি থাকার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমাদের ছাত্রদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে খুব কম সময় দেখা যায়। তারা শুধু বিদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সুন্দর অংশগুলোর গুণগান করে। কিন্তু বিদেশি সংস্কৃতির খুব কম সুন্দর অংশই তারা ধারণ ও বহন করে। নীতিগতভাবে তারা যতটা না সৎ, তার চেয়ে অতিমাত্রায় সততা পরিদর্শন করতে তারা অভ্যস্ত।
বিদেশ ফেরত শিক্ষিতদের দিয়ে বাংলাদেশে রেনেসাঁ আশা করা যায় না। কারণ বিলেতি জ্ঞান বিক্রি করে তারা নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। অন্যের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরিয়া। কালচারাল শকে তারা আক্রান্ত। এ কারণে যেই বাংলাদেশি তার প্রতি তাদের নাক সিটকানো ভাব। তাই রেনেসাঁর নেতৃত্ব দিতে হবে নিজেদের। কোনো তথাকথিত বিলেত ফেরত সুবিধাজীবীকে নয়। বরং বাংলাদেশের তরুণ চিন্তকদের। কারণ আহমদ ছফা বলেছেন—‘সামাজিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা।’
আর তাই জ্ঞানের বিকাশে আমাদের হতে হবে একাগ্রচিত্ত জ্ঞানসাধক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ দিতে হবে প্রকৃত জ্ঞানচর্চাকারীদের। শিক্ষককে হতে হবে দায়িত্বশীল দেশপ্রেমিক। শিক্ষাকে করতে হবে সার্বজনীন। যে শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত না করে তাকে করতে হবে পরিহার। সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ করে মানবিক মূর্খ হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। কারণ শিক্ষাগ্রহণ করে যেমন শিক্ষিত হওয়া যায়, ঠিক তেমনি শিক্ষা নামের অশিক্ষা গ্রহণ করে মূর্খও হওয়া যায়।
গণতান্ত্রিক সরকারের স্বৈরাচারী ভূমিকা
স্বাধীনতার পর অনেক তো গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর স্বৈরাচারী ভূমিকায় বাংলাদেশ আশাহত। জনগণ তার জীবনকে প্রভাবিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কতিপয় ক্ষমতাসীন। আর চিন্তা ও চেতনার কাঠামো ঠিক করে দিচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা। এই পোষ্য বুদ্ধিজীবীদের কারণে জনগণ বুঝতে পারছে না তার প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, অজ্ঞতা ও মূর্খতা। শুধুমাত্র ভোট দেওয়ার অধিকার কখনো গণতন্ত্র হতে পারে না। অমর্ত্য সেন ২০০১ সালে ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ এ বলেছেন—‘যে দেশে গণতন্ত্র থাকবে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হবে না।’ কেননা জনগণের চাপে অন্তত সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে। কিন্তু জনগণ যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, এ বাস্তবতা তো কখনো আমাদের রাজনীতিবিদদের আচার-আচরণে বোঝা যায় না। ফলত আহমদ ছফার মতো বলতে হয়—‘একটি জাতি তার প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, অজ্ঞতা, মূর্খতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেই যদি না পারে, তার কীসের গণতন্ত্র?’
বামরাজনীতি ও বামপন্থী শিক্ষক
বামরাজনীতি যে জনগণকেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক কাঠামো, তা বামপন্থী শিক্ষকরা ভুলে গেছেন। এ কারণে অনেক জনমুখী আন্দোলন যেমন কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও জনমুখী আন্দোলনগুলোতে তাদের তেমন সম্পৃক্ততা নেই। হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক সবসময় সরব ভূমিকা রাখেন। তাও বা যারা রাখেন, নিজের পছন্দের দল ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় তাদের জনমুখী আন্দোলন যেন স্তিমিত হয়ে পড়ে। তারা অন্যসব ছাত্র সংগঠন দ্বারা লাঞ্চিত হলে বিচার দাবি করেন। কিন্তু নিজের সংগঠন দ্বারা লাঞ্চিত হলে চুপ থাকেন। ক্ষমতাসীন দ্বারা নির্যাতিত প্রলেতারিয়েত গোষ্ঠী নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। আবার বুদ্ধিজীবী সমাজের অংশ বা ধনতান্ত্রিক সমাজের অপরিহার্য অংশ সিভিল সোসাইটি হয়ে পুঁজিবাদের শোষণের পক্ষে জয়গান করেন। তাই বাধ্য হয়ে আহমদ ছফা বলেন—‘সবল দুর্বলকে অত্যাচার করছে। আর আমাদের পণ্ডিত মহাশয়েরা পরস্পরের পিঠ চুলকে, খুনসুটি দিয়ে দিব্যি আরামে দিন কাটাচ্ছেন।’
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি
যে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা জনমুখী নয়, তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এমন শিল্প ও সাহিত্যের রচয়িতা—জনগণ কেন তার কবিতার বা গল্পের বই পড়েন না, তা নিয়ে আক্ষেপ করেন। যেখানে জনতার কোনো আবেগ ও ভালোবাসা, দুঃখ-সুখের স্থান নেই, সেই সাহিত্য সাধারণ মানুষ কেন পড়বে? যেখানে বস্তাপচা ব্যক্তি লেখকের আবেগে ভরপুর, তা লেখক নিজেই পড়–ক। নিজেই নিজেকে মহৎ সাহিত্যিক বানিয়ে বগলবাজি করুক। কারণ তারা বোঝে না জনবিরোধী শিল্প-সাহিত্যের অস্তিত্ব পৃথিবীতে টেকে না। এ কারণে ছফা বলেছেন—‘রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক মতবাদ বাদে তাঁর সাহিত্যের কতটুকু মূল্য? বিদ্যাসাগরের সৃষ্টিকর্ম থেকে তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ছেঁকে আলাদা করে যদি ফেলা হয়, তাহলে তো তিনি টোলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়ে দাঁড়ান। রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিপ্লব বাদ দিলে অমন সূর্যসঙ্কাশ প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের গর্ব বাঙালি কীভাবে করতো? ভারতের জাতীয় আন্দোলনের জান দেয়া-নেয়ার মহৎখেলা এবং রুশ বিপ্লবের অভিনব জঙ্গি মানবতার ডাকাতিয়া বাঁশির ডাকেই তো কাজি নজরুলের কণ্ঠ নিনাদিত হয়েছে।’
আর এসবই হয়েছে লেখক সাহিত্যিকদের অসচেতনতার কারণে। কারণ রাজনীতি মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের অনুঘটক, তারা তা বোঝেন না। এ কারণে নিরপেক্ষ থাকার ভান করে তারা বিরোধী ও সরকারি দল উভয় থেকে সুযোগ নেয়ার চেষ্টায় রত থাকেন। এমনকি কখনো কখনো না বোঝার ভান করেন। সরকারি দলের মতামতের পক্ষে থাকে, খোঁড়া যুক্তি দাঁড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই আহমদ ছফা বলছেন—‘রাজনীতি মানব সমাজের সর্বাঙ্গীণ পরিণতি নির্র্ধারণের নিয়তি, যারা রাজনীতি করেন তারা বিশ্বাস করলেও লেখকেরা, কবিরা, সাহিত্যিকেরা তা বিশ্বাস করেন না।’
এর ফলে তারা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির কোনো মানসিক মেলবন্ধন সাধনা করতে পারেননি বললেই চলে। আর তাই আমাদেরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলা যায়।
পাকিস্তানপ্রীতি রাজনীতি বনাম ও ভারতপ্রীতি রাজনীতি
মার্ক্সিয়ান চিন্তাবিদ গ্রামসির মতে—সিভিল সোসাইটি ক্ষমতাসীনদের স্বার্থকে জনতার স্বার্থ হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত। ঠিক তেমন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা অনেকে বোঝান অতীতের শোকাবহ স্মৃতির মাঝেই স্বাধীনতার অস্তিত্ব। তাই কখনো পাকিস্তানি রাজাকারের ভূমিকা রাখেন অতিরিক্ত ডানপন্থী সেজে। আবার কখনো ভারতীয় রাজাকারের ভূমিকা রাখেন অতিরিক্ত বামপন্থী সেজে। বোঝানোর চেষ্টা করেন পরাশক্তির অনুগত বান্দা হওয়ার মাঝে আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত রয়েছে। সমাজে একজন অতি নামাজি বুদ্ধিজীবী দেখলে যেন ভয় জাগে তিনি পাকিস্তানের ঝান্ডাবাহী। আবার অতি বামপন্থী ৮০% সাধারণ মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাতকারীকে দেখলে যেন ভয় জাগে তিনি ভারতপ্রেমী। অথচ আপনাকে যেমন ধার্মিক হতে ইসলামানুযায়ী পাকিস্তানপ্রেমী হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। অথবা আপনি ধার্মিক হলে সাম্প্রদায়িক হওয়ার প্রয়োজন নেই ইসলামে। আবার একইভাবে বামপন্থী হলে অযথা ধর্মকে গালাগাল দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। অথবা অতিরিক্ত ভারতপ্রেমী বা রবীন্দ্রপ্রেমী হয়ে ধর্মকে আপনার সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরোধী প্রমাণের প্রয়োজন নেই। আসলে এই বুদ্ধিজীবী ভারতের বা পাকিস্তানের প্রয়োজনে দাঁড়ান। তার কখনো বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে কথা বলেন না। একজন বুদ্ধিজীবীকে দেশপ্রেমিক হতে হলে পাকিস্তানের ১৯৭১ সালে আগ্রাসন ও স্বাধীনতা পর ভারতীয় আগ্রাসনের সমবিরোধী হতে হবে। এ কারণে আহমদ ছফা বলেন—‘এই মানসিক দাস সংস্কৃতিজীবীদের হাতে এতকাল আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতির ভার ন্যস্ত ছিলো বলেই আমাদের শিক্ষা, আমাদের সংস্কৃতিতে জাতীয় মানসের আশা আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয়নি।’
তিনি আরও সহজভাবে বলেন, ‘আমাদের দেশের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে বলা হয় আমেরিকার মানুষ, কাউকে রাশিয়ার, কেউ চীনের, কেউ ভারতের এবং কেউবা পাকিস্তানের। এদের অনেকের সম্বন্ধে পরিষ্কার ভাষায় বলে যায় দালাল। […] যদি বা দালালি করেন, সে সম্বন্ধে নিজেরাও বিশেষ সচেতন নন।’
আমাদের ভবিষ্যৎ
এ বুদ্ধিজীবীদের নির্ধারিত ভবিষ্যৎ আমাদের ভবিষ্যৎ নয়। বরং আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে আমাদের পরিশ্রমের ওপর। সর্বজনীন জ্ঞানের বিকাশের ওপর নির্ভর করছে আমাদের আগামী। প্রযুক্তির আত্মকরণ, দক্ষতা উন্নয় ও মানবসম্পদের বিকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আজকের বাংলাদেশকে। শুধু ৭%-এর ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় অক্ষম। শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় আধুনিকায়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষাকে মানবিকীকরণ। এ কারণেই আহমদ ছফা বলেছেন—‘আমরা জ্ঞানকে কতদূর সর্বজনীন করবো, প্রযুক্তি বিদ্যার কী পরিমাণ প্রসার ঘটাবো এবং ফলিত বিজ্ঞানের বিকাশ কতদূর নিশ্চিত করবো তার ওপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ।’
কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি—‘জ্ঞানের নামে পণ্ডিত নামধারী মানুষেরা চাকরি করে, সত্য সুন্দর এবং মঙ্গলের নামে কবি সাহিত্যিক এবং চিন্তাশীল মানুষরা চাতুরালী করে। […] কাপালিক প্রবৃত্তির গোড়ায় জল ঢেলে, সার দিয়ে রাজনীতির সেনাপতিবৃন্দ খেয়াঘাট পার হওয়ার জন্য নিত্যনতুন চকচকে কৌশল রচনা করেন। হয়ত তারা নির্বাচনের খেয়া খুব ধুমধাম করে পার হয়ে যাবেন। কিন্তু তারপর? তারপরও তো বাংলাদেশে মানুষ থাকবে। সে মানুষদের কী হবে?’
সে মানুষদের নিয়ে ভাবতে হবে নতুন কালের বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু এবং নতুন কালের নজরুল ইসলামদের। আর এ নতুন ধুমকেতুরা কখনো অনুগত শিয়াল হবে না। তারা হবে সত্য ও সুন্দরের পূজারী। তাদের স্লোগানে উদ্ভাসিত হবে সমাজ। বেজে উঠবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দামামা। অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার ভেঙে যাবে। ভেঙে যাবে গার্মেন্টস শিল্পের বড় কর্তার অহমিকা। যে একজন নারীশ্রমিকের সারাজীবনের আয় একদিনেই করেন। অথচ অশিক্ষিত শ্রমিক পায় লাভের কিয়দংশ। প্রফিট শেয়ারিং ব্যবস্থা হবে বাংলাদেশের কলকারখানাগুলোতে। যেখানে শুধু কোম্পানির লাভের অংশীদার মালিক নন, শ্রমিকেরা হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্যভিত্তিক সমাজ। আর তখনই ক্ষমতাসীনরা বাধ্য হয়ে চাটুকারের দেয়াল ভেঙে জনমুখী আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করবেন। তখন তারা ভাববেন—সমালোচনা মানে ষড়যন্ত্র না। একটি দেশের শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতে যে চিন্তাশীল শ্রেণীটি তাদের সমালোচনা করেন তারা ক্ষমতাসীনদের শত্রু না। বরং শত্রু যে চাটুকাররা, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে এ সমালোচকদের বিরোধী দল বানাতে চেষ্টা করে।
তথ্যসূত্র
১। Omor Azfar (2001). The logic of collective action. In Shughart, F. W. and Razzolini (Ed.). The Elgar Companion to Public Choice, L. pp, 59-63. Cambridge: Harvard University Press.২। John. R. Ehrenberg (1999). Civil Society: The Critical History of an Idea. New York: New York University Press.
৩। Robert. D. Putnam (1993). The prosperous community: social capital and public life’ in the American Prospect. Harvard University: Harvard University Press.
৪। Karl Marx ((1859). Preface to the Critique of Political Economy. In (ed.) Karl Marx and Friedrich Engels, Selected Works in One Volume, London: Lawrence & Wishart Publisher.
৫। Antonio Gramsci (1971). Selections from the Prison Notebooks of Antonio Gramsci. New York: International Publishers.
৬। Georg Wilhelm Fredrich Hegel (1991). Elements of the Philosophy of Right, In Allen W. W. (Ed.), Cambridge: Cambridge University Press.
৭। Christopher Adam & Stefan Dercon (2009). The Political Economy of Development: An Assessment. Oxford Review of Economic Policy, 25 ( 2), pp, 173–189.
৮। Monsur Olson (1965). The Logic of Collective Action: Public Goods and the Theory of Groups. Cambridge: Harvard University Press.
৯. আহমদ ছফা, ১৯৯৯, সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, হাওলাদার পাবলিকেশন্স।