বিপ্রদাশ বড়ুয়া (জন্ম.২০ আগস্ট ১৯৪০) বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কথাশিল্পী। তাঁর কথাসাহিত্য পাঠকের মনে গভীর দ্যোতনা সৃষ্টি করে। তিনি বাংলাদেশের সমাজ ও মানবজীবন থেকে সাহিত্যের উপাদান গ্রহণ করেছেন। যে সমাজে মানুষ এক অদ্ভুত আচরণ ও জীবনযাপনে বিশ্বাসী। যেখানে মানুষ নামের মানুষগুলোই আজ অচেনা হয়ে উঠেছে। একে অপরের প্রতি সহযোগিতার হাত না বাড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। সেই যান্ত্রিক জীবনের জান্তব কিছু বিষয় চিত্রিত করেছেন নানা গল্পে। মূলত এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজকেই তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। তাঁর ‘সুন্দর মানুষ’ সেই অনবদ্য গল্পগুলোর একটি। এই গল্প মানুষকে ভাবতে শেখায়। জীবনের যাপনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মানুষের যাপিত জীবনপ্রণালী কী হওয়া উচিত, মানুষের প্রতি মানুষের দায় কতটা, মানুষ নিজেরই স্বজাতিকে কতটা ভালোবেসে আগলে রাখে তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এই গল্পের মাধ্যমে।
‘নদীর নাম গণতন্ত্র’ ( ১৯৮৭) গল্পগ্রন্থের অন্যতম একটি গল্প ‘সুন্দর মানুষ’। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুন্দর। তাকে ঘিরেই স্বল্প পরিসরের এই গল্পে জীবনের নিষ্ঠুর চিত্র অঙ্কন করেছেন লেখক। জীবনে মানুষের মূল্যায়ন মানুষের কাছে কতটা ঠুনকো তার ভয়াবহ রূপায়ণ এটি। সুন্দরও যে মানুষ সে কথা সমাজের সবাই ভুলে গেলেও তার প্রিয় সহচর, অন্যতম বন্ধু একটি কুকুর তা ভুলে যায়নি। কারণ সুন্দরের জীবনও ওই কুকুরের মতোই মানুষের কাছে অপ্রত্যাশিত। যখন সুন্দরকে প্রয়োজন তখনই কেবল তাকে মানুষ রূপে গণ্য করা হলেও অন্য সময় সুন্দর থেকেছে মানবজাতির ধরাছোঁয়ার বাইরে। একসময় সুন্দরের করুণতম মৃত্যু! এবং তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে তারই ঘনিষ্ঠ সহচর একটি কুকুর। যাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছিল সুন্দর। নিজে একবেলা খেলে কুকুরটকেও সে খাইয়েছে যত্ন করে।
এ পৃথিবীতে মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে পারে সহজেই। কিন্তু একটি কুকুর তার প্রভুকে ছেড়ে যায় না। প্রভুর সঙ্গী হয়ে তাকে যতটুকু পারে সাহায্য করেছে। সুন্দরের পাশে লেজ গুটিয়ে শুয়ে থেকে তাকে সঙ্গ দিয়েছে। এই গল্পটি পাঠে বিবেক জাগ্রত হয়। লেখক এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যা হৃদয়ে কড়াঘাত করেছে বারবার। মনে প্রশ্ন জেগেছে প্রকৃতপক্ষে কি সুন্দররা মানুষ? তাহলে কেনো মানুষের কাছে তার আশ্রয় হলো না।বিহারে তাকে মরাণাপন্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কোনো মানুষের হৃদয় বিগলিত হলো না? এ তো তাদেরই মতো মানুষ। যারা একসময় তাকে সমীহ করতো, শ্রদ্ধাভারে সুন্দরের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতো সেই সুন্দরকে সবাই অবহেলা করলো! সুন্দর কেনো মানুষ হতে পারলো না মানুষেরই কাছে? কী নির্মম পরিহাস এঁকেছেন লেখক বিপ্রদাশ বড়ুয়া। এই গল্পে সুন্দরের কাহিনিকে ঘিরে উঠে এসেছে সমাজের ধর্মীয় আবরণ, শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন, জৈবিক চিত্র। এই চিত্র দেখে আক্ষেপ করে বলতেই হয়, একই মানুষ ভিন্ন এই পৃথিবীর ছায়াতলে! আসলেই সুন্দর, হরসুন্দরী, রমিজ কেউই তো তাদের মানুষের কাতারে আনতে পারেনি! তাইতো তারা প্রতিনিয়ত করুণ- বর্বরোচিত জীবনযাপন করেছে। এই গল্পে স্থান পেয়েছে শ্রেণিচেতনা, মনুষ্যত্ব- বিবেক, মানব জাতির প্রতি মানবের দায় প্রভৃতি বিষয়।
গল্পের সূচনা হয়েছে সুন্দরের ভিক্ষু জীবনকে কেন্দ্র করে। মানুষের এক জীবনেও জন্মান্তর হয়। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুন্দরের জীবনটাই তার প্রামণ। সে প্রতিটি পদক্ষেপে জীবনের নতুনতম স্বাদ অনুভব করেছে। তবে সে স্বাদ দুঃখের-যাতনা ও বঞ্চনার। দীর্ঘ দশ বছর ভিক্ষু জীবনযাপনের পর সুন্দর একদিন গেরুয়া পোশাক পরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তার দীর্ঘ ভিক্ষু জীবনে এমন কোনোই অসঙ্গতি চোখে পড়েনি যে সুন্দর এভাবে নিজের জীবনে পরিবর্তন ঘটাবে! ধর্মসাধনায় সে প্রতিটি নিয়ম-কানুন-ব্রত মেনে চলেছে। অবিরাম ধর্ম- সাধনা, কঠোর নিয়ম, সংযম ও ভিক্ষুদের আচরণীয় পথ অনুসরণ করে সাধারণের কাছে সুন্দর বেশ শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তার মতিভ্রমকে অনেকেই পাগলের কাণ্ড বলেই ধরে নেয়। তবে সুন্দর বেশ স্বাভাবিক। একদিন হঠাৎ সে গেরুয়াও ছেড়ে দেয়। মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পেলেও সে নির্বিকার। নির্জন মাঠে, নদীর তীরে, বড়জোর পথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতো। ক্ষুধা-তৃষ্ণায়ও সে কাউকে কিছু বলতো না। গ্রামের লোকজন করুণাবশত কখনো কিছু খেতে দিলে তখন সে দুটো খাবার মুখে তুলতো। এভাবেই সুন্দরের জীবন পার হতে থাকে। তিন- চারদিন অনাহারে থাকার পর একটু খাবার জুটতো। হয়তো কেউ অতি করুণাবশত তাকে দিতো। যেটুকু খেতে পেতো তাই খেয়েই রাতে বিহারের বারান্দায় পড়ে থাকতো। কিন্তু এই সুন্দরও তো মানুষ! তার প্রতি মানুষের স্বাভাবিক ভালোবাসা কোথাওই পরিলক্ষিত হয় না। গল্পে লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে:
গ্রামের লোকজন করুণাবশত ডেকে ভাত খেতে দিত প্রথম প্রথম । কিন্তু ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে চুরি করে খাওয়া কিংবা কারণে-অকারণে কাউকে আক্রমণ করার স্বভাবও দেখা যায় না। মানুষের সমাজে সবসময় বাস করেও সে অসহায় একা রয়ে গেল। বিহারের গোল- বারান্দা, নদীর ধার, বরোজের পাশটা তার কাছে অভয়কেন্দ্র। মানুষের জীবনপ্রবাহ দেখে সে নিজের হতভাগ্য জীবনের কথাও ভাবে। মাঝে মাঝে ব্যাকুল হয়ে ওঠে পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি…কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।১
প্রকৃতার্থেই সুন্দর বুঝে উঠতে পারে না সে মানুষ কিনা। সত্যিই যদি সুন্দরও অন্যদের মতো মানুষই হবে কেনোই বা এ সমাজ সুন্দরদের প্রতি দৃষ্টি দেয় না। এ সমাজে কেনো প্রতিনয়ত দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে সুন্দরেরা ক্ষত-বিক্ষত। কেউই এদের খোঁজ রাখে না ! কারণ সুন্দরেরা হয়তো এ সমাজের রাঘব বোয়াল তথা উচ্চবিত্ত শ্রেণির কাছে মানুষের পর্যায়ে পড়ে না! বছরের পর বছর ছন্নছাড়ার মতো সুন্দরের জীবন কাটলেও হঠাৎ সে ভোল পাল্টায়। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। ধর্মীয় নানা ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণ নিজের মতো করে দিতে শুরু করে। তার সেই মতামত এত একান্ত এবং যুক্তিযুক্ত যে সাধারণ তা কিছুতেই খণ্ডানোর সাহস পেতো না। সুন্দর ভিক্ষু জীবনে বার্মা, শ্রীলঙ্কা বহু জায়গায় ঘুরে নানা জ্ঞান আহরণ করেছিল। তাই কেউ যুক্তি খণ্ডাতেও আসতো না। মাঝে মাঝে তরুণদের কাছে নিজের মত প্রকাশ করে তাদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেছে। এরই মধ্যে আবার তার আচরণে পরিবর্তন আসে। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে। একসময় অনেকদিনের জন্য এলাকা থেকে গায়েব হয়ে যায়। তাকে নিয়ে কারো কোনোই চিন্তা নেই। কারণ সবাই জানে তার যাওয়ার জায়গা নেই। গল্পকার ব্যক্ত করেছেন এভাবে:
একদিন ভোর থেকে তাকে আর দেখা গেল না। কোথায় উধাও হল, কী হল কেউ জানে না। খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন কেউ অনুভব করল না। তবে সবাই জানে সে আসবে, দু-চারদিন পর ঠিক ফিরে আসবে। এতে কারু কোনো কাজ আটকে থাকবে না ।
তৃতীয় দিন সুন্দর ফিরে এল একটি বাচ্চা কুকুর সঙ্গে নিয়ে। বাচ্চাটি সারাক্ষণ তার পিছু লেগেই আছে। কখনো কোলে নিয়ে বাচ্চা ছেলেদের পিছু নেওয়া হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে সে মাথা উঁচু করে গ্রামের পথে হেঁটে চলে। মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়াতেই ছেলের দলও দাঁড়িয়ে যায়। মুখে কিছু না বলে, গালাগাল না করে নীরবে প্রতিবাদ করে দাঁড়ায়, অথবা কুকুরছানার মতো তাদের প্রতিও মমত্ব-বোধে অন্ধ হয়ে যায়।২
সুন্দর প্রকৃতির টানে মানবতার টানে ছুটেছে উদভ্রান্তের মতো। তার কোনো পিছুটান নেই। মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই। তাইতো যখন যেভাবে চেয়েছে সেইভাবেই থাকতে পেরেছে। কিন্তু তার মধ্যে মনুষ্যত্বের অভাব ঘটেনি। তাইতো ধর্মের বাণী ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ করে তাকে পুঁজি করতে চায়নি। সাধারণ মানুষকে যুক্তি- বুদ্ধি দিয়ে পথ দেখাতে চেয়েছে। যখন তা ব্যর্থ হয়েছে তখন সে আবরণ ভেদ করে সে অসীমের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু তাকে মায়ায় জড়ায় একটি কুকুর ছানা। যেকিনা অন্য কুকুরের সঙ্গে সঙ্গী হতে পারতো কিন্তু সে থেকেছে সুন্দরের ভালোবাসা- ভরসায়। সুন্দর তাকে আগলে রেখেছে প্রতিনিয়তই।
ক্ষুধার তাড়নায় যখন এই দুই প্রাণী কাতর তখন সুন্দর কাজ পায় এক বাগানে। যেখানে তাকে পাহারা দিতে হবে। যাতে রাতের আঁধারে শেয়াল বা কোনো মানুষ তরমুজ, ফুটি নষ্ট করতে না পারে। কাজের বিনিময়ে সুন্দর পেয়েছে দুমুঠো খাবার। যেই খাবারে নিজে এবং তার সন্তানসম ছোট্ট কুকুরটির ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। সুন্দর নিজের মতো দিনে একবেলা থেকে সপ্তাহান্তে একবার খাওয়ার অভ্যেস করে তোলে বাচ্চাটিকেও। মাত্র অল্পদিনে কুকুরটিও এ-ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কাউকে দোষ দেয় না। এবং একজন আরেকজনকে ছেড়েও যায়নি। কুকুর এবং সুন্দরের ভেতর যে ভালোবাসা তা অবলা পশুটিকেও দায়িত্ববোধে পূর্ণ করে তুলেছে। সুন্দর আশ্রয় নিয়েছে একটি কুকুরের কাছে। মানুষের কাছে নয়। কারণ মানুষ বেঈমানী করেছে বারবার কিন্তু অবলা পশুটির আশ্রয় তাকে ভালাবাসার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে। কাউকে আঁকড়ে একজায়গায় থিতু হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। কারণ সুন্দরের ইহজগতে কেউ নেই। না পরিবার- পরিজন না আপন কোনো মানুষ। এ জগতে সুন্দরের মতো অসহায়, দরিদ্র শ্রেণির মানুষের আত্মীয়-পরিজন কেউ হতেও চায় না। তাইতো সুন্দর এক স্বার্থহীন মায়ায় জড়িয়েছে। যেই মায়া তাকে করেছে মহান, আত্মত্যাগী, মানবপ্রেমী, পশুপ্রেমী।
এই সমাজের মাঝে চলে এক আজব লীলা খেলা। যে খেলায় কেউবা বাঁচে কেউবা মরে। তবে এই সুন্দরদের কী পাওয়ার আছে এ সমাজে তা পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন লেখক।
এক বসন্তে মাদার ফুল ফোটা শেষ হলে বাচ্চাটি জোয়ান কুকুর হয়ে ওঠে। তখন সেও তার সঙ্গীকে কামনা করে। ছটফট করতে থাকে কিন্তু প্রভুর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারে না। ফলে সে সুন্দরের সঙ্গী হয় আজীবন। রাতে সুন্দরের পাশাপাশি শোয়। শীতের রাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে সুন্দরের পাশে। বর্ষার দাপট কমে আসতে না আসতেই দেহটা চনমন করে ওঠে সঙ্গীর আশায়। কিন্তু সেও সুন্দরের মতোই নারী সংসর্গ বর্জিত। তারা এ সমাজে এক অপরিসীম মমত্ব গড়ে তুলেছে নিজেদের মধ্যে। যার ফলে সুন্দরকে ছেড়ে যেতে পারে না কুকুরটি। বসন্তের ফুরফুরে হাওয়ায় এরা আবারও চঞ্চল হয়ে ওঠে। সুন্দরকে খাওয়া-দাওয়ার বিনিময়ে কাজে ডাকে অনেকেই। তরমুজ-ফুটির বাগান পাহারা দিতে। সুন্দর যখন তরমুজ ফুটির বাগান পাহারা দেয় তখন একদিন রাতে জেলের মেয়ে হরসুন্দরী সুন্দরের সাহায্যপ্রার্থী হয়। বাঁচার আশায় হাত পাতে হর।
নদীর পানি শুকোতেই তাদের পেটে ভাত নেই। দুঃখ- দারিদ্র্যপীড়িত হরসুন্দরী সুন্দরের মতো দীনহীনের কাছে হাত পাতে। কিন্তু সুন্দর দীনহীন হলেও হৃদয়হীন নয়। ফলে হরসুন্দরীর দুঃখ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। যদিও কোনোদিন সুন্দরের দ্বারা কোন অন্যায় হয়নি। কিন্তু আজ সে আর অন্যায়ের কথা ভাবতে পারে না। হরসুন্দরীকে বাঁচাতে শেয়ালে খাওয়া তরমুজ-ফুটি দিয়েই তাকে বাঁচাতে চেয়েছে৷ কিন্তু হর পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে শরীরকেও নিলামে তুলতে চেয়েছে। সুন্দরের কাছে তার আবদার সে যদি তার পেট ভরায় তাহলে হরসুন্দরী তার দেহ ভরাবে। কিন্তু সুন্দরের মনও সুন্দরের বার্তা দিয়েছে। নিজের দুর্বল চিত্তকে আড়ালেই রেখেছে। মানুষের প্রতি মানুষের মানবিকতা রক্ষিত হয়েছে। সুন্দর চায়নি হরসুন্দরীর সম্ভ্রম লুটে তাকে খাবার দিক। একে তো সুন্দর এই শেয়ালে খাওয়া তরমুজ- ফুটি দিয়েই মালিকের অনাস্থাভাজন হলো কিনা তা ভাবতে থাকে! তারওপর হরসুন্দরীর দুর্বলতার সুযোগ সে নিতে চায়নি। যৌন জীবনে অভুক্ত থাকলেও সুন্দর প্রকৃত মানুষ। তাইতো সে দেখিয়েছে মানবিকতা। কিন্তু সুন্দর যখন তার মানবিকতা দিয়ে সমাজের বিভেদ-দুঃখ মুছিয়ে দিতে সচেষ্ট ঠিক তখনই সে অভুক্ত। তার অভুক্ত পেটের দায় তাকে ক্ষুধার যাতনা বুঝতে সাহায্য করেছে। তাইতো সে হরসুন্দরীর প্রতি অমানবিক হতে পারেনি। যতটুকু সাধ্য তার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি সে করেনি। সুন্দরের এই সুন্দরতম বোধ মানুষকে ভাবতে শেখায়। সুন্দরের দিকে মানবিক বোধ নিয়ে তাকাতে সাহায্য করে। গল্পাকার বিষয়টির অবতারণা করেছেন এভাবে:
… রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। ঠিক তখনই জেলেপাড়া থেকে নেমে আসে চোর। চারদিক তখন শান্ত। টিন পিটিয়ে পাহারা দেওয়ার কাজ থেমে গেছে, সব পাহারাদার চোখ বুজে স্বপ্নে ও ঘুমে আচ্ছন্ন। একটি মেয়ে জেলেপাড়া থেকে নেমে এল। সুন্দরের ঘাসের বিছানার পাশে নুয়ে পড়েছে মেয়েটি। কুকুরটাও ঘুমিয়েছে কি কোথায় গেছে কে জানে ? মেয়েটি তার কাছে মিনতি করে চাইল ফুটি ও তরমুজ।
দু দিন ধরে কিছু খেতে পায় নি। সুন্দর এই উপকারটুকু না করলে সে আর প্রাণে বাঁচবে না। সুন্দরের মায়া হল। কিন্তু পরের জিনিস সে দেবে কি করে? গৃহস্থকে না বলে কিছু দেওয়াতো অন্যায়। মেয়েটি আবার অনুনয় করল, শেয়ালে খাওয়া হলেও চলবে। দাও গো!৩
নদীর জল শুকিয়ে গেলে মাঝিদের ভাগ্য ফেরে। কিন্তু মাঝি এবং তার পরিবারের যে দুঃখ-কষ্ট হরসুন্দীরর মধ্যে দিয়ে লেখক একদৃষ্টে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। হরসুন্দরীরা এ সমাজে ভেসে যায় কোনো এক স্রোতে। পেটের তাড়নায় রাস্তায় নামে। কিন্তু সেই রাস্তা হরসুন্দরীদের জন্য মসৃণ নয়। এ সমাজের কিছু মানুষ নামের নরপিশাচ সুযোগ বুঝে সুন্দরীদের সম্ভ্রম লুটে নেয়। কিন্তু সুন্দর নিজেও হরসুন্দরীর গোত্রের। সবচেয়ে বড় কথা সুন্দর এতটাই মানুষের কাছে অবহেলিত হয়েছে যে হরসুন্দরীকে আর নতুন করে কাছে টানার বাসনা তার মধ্যে জন্ম নেয়নি। এমনকি তার চিরন্তন সঙ্গী কুকুরটিই তাকে আগলে রেখেছে ভালোবাসায়, প্রভুর প্রতি অস্থায়। যা মানুষ পারেনি। না পেরেছে হরসুন্দরী নিজেও। সুন্দর অসুস্থ থেকেছে তখন হরসুন্দরী পাশে এসে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ হরসুন্দরী এ সমাজের। সমাজ নারীর সে অধিকার দেয়নি। মনের আবেগ এখানে খাটে না। কিন্তু সুন্দর মনের অজান্তেই তার আপনজনকে খুঁজতে চেয়েছে।যখন সে রোগে পড়েছে তখন মালিকের লোক এলেও তাকে সাহায্য-সহযোগিতা না করে বরং বাগানটা যাতে ঠিকঠাক দেখভাল করে সেই আদেশই দিয়ে যায়। সুন্দরের জন্য তাদের দায় নেই। কারণ এ সমাজে সুন্দরকে নিয়ে ভাবার কেউ নেই! লেখক সুন্দরের জীবনের সেই করুণতম দৃশ্য তুলে ধরেছেন এভাবে:
রাত বাড়তে থাকে। শেয়াল এসে খেতের ফসল খেয়ে যায় । কুকুরটার ডাকও শোনা যায় না। সুন্দর খড়ের বিছানায় পড়ে থাকে। তবুও তার একরকম ভালো লাগে। শরীরে চটচটে উষ্ণতা অনুভব করে, জ্বর আসে। শেয়াল এসে তার গা চেটেপুটে দেয়? অথবা তার কুকুর বন্ধু, অথবা হরসুন্দরী কিনা কে জানে। হয়তো জ্বরের ঘোরে হরসুন্দরী এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, ডেকে নিয়ে যেতে চেয়েছে নিজের ঘরে। হয়তো কুকুরটা খেঁকিয়ে উঠেছে হরসুন্দরীর প্রতি, অথবা কী কী ঘটেছে মনে করতে পারে না কিছুই। তেষ্টায় জল দিয়েছে যেন কে? আর কিছুই মনে পড়ে না। বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম।৪
হরসুন্দরী এবং সুন্দরের মতোই হতভাগ্য রমিজ। তার ছেলের দু-চারটি হাড়গোড় ছাড়া কিছুই ছিল না। শেয়ালে সব খেয়ে নিয়েছে। কখনো কখনো শেয়ালগুলোও মানুষের মতো কথা বলে কিন্তু সুন্দর তার ভাষা বোঝে না। অন্যদিকে মঝুও তারই মতো নিম্নবর্গের হলেও সেও সুন্দরকে উটকো ঝামেলা মনে করেছে। একসময় মঝুর সঙ্গে যে দোকান পাহারা দিত এখন সেই মঝুই দোকানের গুদামে একজন রুগ্নকে রাখতে চায় না। আপদ বিদায় হলেই যেন মঝু বাঁচে! শরীরে বল নেই সুন্দরের। এখন কেউ তাকে দেখার নেই। মঝু বিরক্ত হয়। হরসুন্দরী করুণা করে।আস্তে আস্তে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রবলভাবে নেতিয়ে পড়তে থাকে সুন্দর। কিন্তু সুন্দর সবার কাছে উটকো ঝামেলা। তাই তো সবাই চায় আপদ যত দ্রুত বিদায় হয় ততই ভালো। সুন্দরের প্রবল ইচ্ছে হয় পিঁড়ি পেতে শাক-সবজী ও ডাল-মাছ দিয়ে থালা ভর্তি ভাত খেতে। কিন্তু তার কপালে তা নেই। সুন্দরেরা এ সমাজের উচ্ছিষ্ট! তাইতো তার প্রতি মানবের মায়া নেই।যখন সে শ্রমণ(ভিক্ষু জীবনের পূর্ব ধাপ) ছিল তখন সবাই তাকে খেতে দিত। এখন কেউ নেই তার।
এর মধ্যে দিয়েও লেখক এক আবছায়া ঈঙ্গিত দিয়েছেন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের। যে সমাজে মানুষের কদর করা হয় পুণ্যের আশায়। যখন সে পুণ্যের পথে বিঘ্ন তখন মানুষের মানবিকতা মিইয়ে যায়। এই অধরা পৃথিবীতে সবাই লাভ খোঁজে।সেই লাভ হোক বাহ্যিক বা সুদূর কোন কল্পলোকের কাহিনীর। নতুবা এই সুন্দরই কেনো শ্রমণ জীবন ত্যাগ করাতে তাকে বিহারের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখেও সাধারণের চৈতন্য হলো না। কেনো তাকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হলো না? সুন্দরের মতো মানুষেরা কী কোনোভাবেই এ সমাজের চৌকাঠ পেরুতে পেরেছে আজও! আজও এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে মানবতার চর্চা নেই। আছে হিংসা-বিদ্বেষ, লুটতরাজ। অন্যকে মেরে-কেটে কে নিজের পকেট ভরবে সেই আশায়। কিন্তু সুন্দরেরা থেকে যায় কালের গর্ভে। হয়তো সেখানে মানবতা-মনুষ্যত্বের চর্চা আছে কিন্তু পেটে ভাত নেই! একসময় হরসুন্দরীদের কপাল ফিরলেও তারা সমাজের প্রতিবন্ধকতাকে রুখে দিতে সক্ষম হয় না।
সুন্দরের মৃত্যু এ সমাজে মনুষ্যত্ব, বিবেকের মৃত্যু। তার মৃত্যুর সঙ্গে মিলিয়ে গেলো তারই একমাত্র সুহৃদ, আপনজন, বন্ধুসম কুকুরটিও। কারণ সুন্দরের জীবনও ওই কুকুরের জীবনের মতোই। যে জীবনের জন্য এ সমাজের কোনোই দায় নেই। আজও আমাদের সমাজে সুন্দরেরা না খেতে পেয়ে মরছে। হারিয়ে যাচ্ছে কালের স্রোতে। কেউবা অন্যকে মেরে- কেটে, রাহাজানি করে খেয়ে পরে বাঁচতে চাইছে, কেউবা হরসুন্দরীর মতো অন্যের কাছে বিকোতে চাচ্ছে, আবার কেউবা সুন্দরের মতো মহৎ হৃদয় নিয়ে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে পাশে থাকার মহত্তম চেষ্টা করছে। এই সমাজের মাঝে চলে এক আজব লীলা খেলা। যে খেলায় কেউবা বাঁচে কেউবা মরে। তবে এই সুন্দরদের কী পাওয়ার আছে এ সমাজে তা পাঠকের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন লেখক। তাইতো সুন্দরদের মৃত্যুই এ সমাজে অনিবার্য হয়ে ওঠে:
রাত কেটে যায়। সকাল হতেই ঘুম আসে চোখে। সারাদিন আর হুঁশ নেই। লোকজন বিহারে এসে তাকে দেখে যায় । সে বেঁহুশ পড়ে থাকে। দিনের পর দিন কেটে যায়, আবার রাত নামে। সে স্বপ্নে দেখে কে যেন তাকে গণ্ডুস ভরে জলদান করছে। তার সমস্ত শরীর শীতল স্পর্শে জুড়িয়ে যায়। কে যেন আদর করে ডাল-ভাত তুলে ধরে মুখের কাছে। তৃপ্তি ভরে সে খায়। দু মুঠো গরম ভাত, ডাল শাক মাছ-জীবনে এত তৃপ্তি ভরে সে কোনোদিন খায়নি। ঘোমটা মাথায় হরসুন্দরী তাকে খেতে দিয়েছে। এত মমতা কেউ তাকে কখনো দেখায়নি, এত ক্ষুধা কোনোদিন অনুভব করেনি, তৃপ্তিও পায়নি কোনোদিন। হরসুন্দরী ডাকল, আর কি খেতে ইচ্ছা করে বলো। পেট ভরেছে তো!
এই অবস্থায় এক রাতে ওষুধ-পথ্য কিছু না পেয়ে পাঁচ দিন থাকার পর সুন্দরের মৃত্যু হল। একই সময়ে কুকুরটিও গেল। ভোরে বিহারে আগত সবাই সে-দৃশ্য দেখল-কুকুরকে জড়িয়ে ধরে সুন্দরের মৃতদেহ পড়ে আছে।৫
গল্পাকার বিপ্রদাশ বড়ুয়া সমাজকে এত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, একটি ছোট্ট গল্পের শরীরে তুলে ধরেছেন আবহমান চেতনা। মানুষ নামের মানুষগুলো আজ এ সমাজে অসহায়।সুন্দরেরা সেই অসহায় মানুষের কাতারে।যাদের মৃত্যই যেন এ সমাজের কাম্য।
তথ্যসূত্র
১.বিপ্রদাশ বড়ুয়া , নির্বাচিত প্রেমের গল্প, মুক্তধারা, ঢাকা, ১৯৯০,পৃ. ১১১
২.তদেব,পৃ.১১২
৩.তদেব,পৃ.১১৫
৪.তদেব,পৃ.১১৭
৫.তদেব,পৃ.১২০