বিপ্রদাশ বড়ুয়া (জন্ম.২০ আগস্ট ১৯৪০) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সফল পুরুষ। তাঁর কথাসাহিত্য সমকালীন জীবনচিত্র পরিগ্রহ করেছে। একারণেই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ তাঁর গল্পে ঘুরে-ফিরে স্থান পেয়েছে। প্রকৃতার্থে তিনি জাতির প্রতিটি সমস্যা-সংকটে, সংগ্রামে, আর্তনাদে কলম ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির প্রবলতা অনুভব করে জাতির দুর্দিনকে ইতিহাসের স্বাক্ষী করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কালখণ্ডে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। যার প্রতাপে বাঙালি তার অস্তিত্বের সংকটে পড়ে। তাই অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে বাঙালি তখন দ্রোহে-ক্ষোভে- প্রতিবাদে-প্রতিরোধে-সংগ্রামে-আন্দোলনে ফেটে পড়ে। দেশমাতৃকাকে শত্রমুক্ত করতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর এর মধ্যে দিয়ে দেশে যে অরাজক পরিস্থিতি-সংকট সৃষ্টি হয় তা লেখকের শিল্প-সাহিত্যের উপাদানে রূপ নেয়।
কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া তৎকালীন রাজনৈতিক ডামাডোলকে এভাবেই সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অভিজ্ঞতা তাঁকে নির্লিপ্ত থাকতে দেয়নি। তাইতো সামাজিক-রাজনৈতিক পথ ধরেই তিনি এগিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উচ্চারণে গল্পের উঠোন পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তীক্ষ্ণ ও শিকড় সন্ধানী অন্তর্মুখীনতাকে বহির্মুখী করে তুলেছেন। ফলে তাঁর গল্প সমকালীন হয়েও চিরকালীনতা নিয়ে স্পার্ধায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। পাঠককে গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় তৎকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া জীবনবাদী গল্পকার। তাঁর ‘সাদা কফিন ও মুক্তিযোদ্ধা’ ( ২০১৭) গল্পগ্রন্থের অন্যতম নামগল্প ‘সাদা কফিন’। এই গল্পের প্রেক্ষাপট মুক্তিযুদ্ধ। পরাধীনতার নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে লিপ্ত হয় বাঙালি জাতি। সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর বিট্রিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালি জাতি আবার আরেক শোষণে লিপ্ত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের করাল গ্রাসে ক্রমাগত বাঙালি জাতিসত্তা নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিট্রিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশে বিভক্ত হয়। কৃষ্টি-সংস্কৃতির ব্যাপক পার্থক্য হওয়া সত্ত্বেও কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে ভারতবর্ষ ভাগ হয়। কিন্তু বিভাজনের পরে শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানীদের আরেক দফা নাটক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একসময় বাঙালি জাতি শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের বিপক্ষে সোচ্চার হয়ে ওঠে। নিজেদের অধিকার আদায়ে মাঠে নামে। ঠিক তখন পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে থাকে। একসময় তা যুদ্ধে রূপ নেয়। যা ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ নামে অভিহিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের নাটক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে প্রবল অসন্তোষের সৃষ্টি করে। যা একসময় তীব্র ক্ষোভে পরিণত হয়। এবং বাঙালি জাতি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য এবং অস্ত্র জড়ো করতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান তার সৈন্যদের কুকুরের মতো লেলিয়ে দেয় বাঙালির ওপর। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে। ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়, সেই রাতে প্রায় ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু হয়েছিল। তবে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। জ্বালাতে শুরু করে ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুটপাট আর ধ্বংসে পরিণত হয় গোটা পূর্ব পাকিস্তান। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হয়। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে ওঠে শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি। যার ভয়াবহতা ধারণ করে লেখা হয়েছে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস-কবিতা। তবে কথাসাহিত্যে সবসময়ই সময়কে খুব বেশি ধারণ করা হয়েছে। কারণ কথাসাহিত্যের পরিসর এবং বর্ণনাভঙ্গি কবিতার চেয়ে দীর্ঘ এবং ধরণ-ধারণে ভিন্ন। তাই বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে এর প্রেক্ষাপট হিসেবে-
বাংলাদেশের ছোটগল্পের নিজস্ব ক্যানভাসে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় ও প্রবর্তনা। অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন ছিল বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম প্রেরণা ও উদ্দেশ্য। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে-স্বাধীনতা অর্জিত হলো তা’ সমাজের এবং মানুষের ভাগ্যের কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হলো। ফলে শুরু হলো স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা। এ কারণে সত্তর দশকের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বীরত্বগাথা এবং স্বাধীনতাকে ঘিরে বাঙালির অনিঃশেষ স্বপ্নের যেমন রূপায়ণ ঘটেছে তেমনি স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাও এই দশকের গল্পে অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।১
আর ইতিহাসের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরতে বিপ্রদাশ বড়ুয়া কলম ধরেছেন। তাঁর কলমের তুখোড় শক্তিতে ইতিহাস পুনর্জীবিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সারা ঢাকা শহরের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখনকার একটি রাতের ঘটনা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। যা ‘সাদা কফিন’ গল্পে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই গল্পে কথাসাহিত্যিক তৎকালীন সময়ের একটি রাতের যে দৃশ্যের অবতারণা করেছেন তার মধ্যে দিয়েই মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) ভঙ্গুর চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আঁতকে ওঠে প্রাণ। কী বিভৎস নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল এই দেশমাতৃকায়! শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহিদের প্রতি। হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জেগে ওঠে সেই লাখ লাখ মা-বোনের প্রতি যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র।
আর তাইতো এ দেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এবং বিপ্রদাশ বড়ুয়ার মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতাকে স্মরণ করে সাহিত্য নির্মাণ বাঙালি জাতির গৌরবগাঁথাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে সমকালীনতাই তাঁকে চিরকালীনতায় ভাস্বর করে রাখবে।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁর ‘সাদা কফিন’ গল্পে দেখাতে চেয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের নখরাঘাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের পর বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র পেতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই রাষ্ট্র পেতে বীর সন্তানেরা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়েছে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’ গল্পের সূচনা হয়েছে এক থমথমে রাতে। চারিদিকে স্তব্ধ। কোথাও যেন কেউ নেই। জনমানবহীন রাতে গল্পের কথক ঢাকার রাস্তায় উদভ্রান্ত হয়ে একটি বাহনের অপেক্ষা করছে। যেই বাহনে করে সহজেই তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু নীরব নিস্তব্ধ শহরে কোথাও কোনো লোক চলাচল নেই। এমনকি কোনো গাড়িরও দেখা মিলছে না। ক্রমাগত থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে কথক তার হিমশীতল রক্ত নিয়ে অপেক্ষারত। হঠাৎ পাশ দিয়ে একটি রিকশাঅলা যেতেই ভয়ের স্বরে বলে, দ্রুত সরে পড়েন। পরিস্থিতি খুব খারাপ। পাকিস্তানী মিলিটারী শহরে হানা দিয়েছে। কিন্তু কথক কিভাবে যাবে, কোথায় যাবে! তার তো মতিঝিল পেরিয়ে বাসাবো যেতে হবে। কিন্তু রাস্তার যে পরিস্থিতি সেখানে কিভাবে সম্ভব। আর্তস্বরে তাই রিকশাঅলাকেই তার মিনতি জানাই। সে যেদিকে যাবে সেদিকেই যেন নিয়ে যায়। তাও তো একজন কেউ তার সঙ্গে থাকবে। যতটা যাওয়া যায় ঠিক ততটা পথ তো এগুবে তার। যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল এক অন্ধকার গহীন তলদেশে। সেই সময় মানুষ যাপন করেছিল দুঃসহ জীবন। সবাই প্রাণের তাগিদে যে যার মতো ছুটছে। অধিকাংশ মানুষ প্রাণের ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে যতটা সম্ভব নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করেছে। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিকে কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া তুলে ধরেছেন এভাবে-
…শহরে সৈন্য নেমেছে সাব, সরে পড়ুন, এক্ষুণি এদিকে এসে পড়বে। তাদের আছে কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, আরো কত কী…
বলো কী? সৈন্য নেমেছে? কোথায়? কত দূরে? – আমার মাথা ঘুরে-গেল । তুমি কোন দিকে যাবে ভাই, জলদি আমাকে নিয়ে চলো!
না, পারব না সাব। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে, পথে পথে বাধা, আপনাকে নিয়ে যাব কী করে! না, আমি নিতে পারব না– হাঁপাতে হাঁপাতে রিকশাঅলা কথাগুলো বলে ফেলল ।
বললাম, তুমি যেখানে যাও ভাই আমাকে নিয়ে চলো, তোমার সঙ্গেই থাকব আমি । বাধা ডিঙিয়ে দু’জনে রিকশা টেনে নেব। তোপখানা, পল্টন সড়ক, মতিঝিল, কমলাপুর ছাড়িয়ে বাসাবো …।২
বিপ্রদাশ বড়ুয়ার গল্পের এমন অনুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, পাঠকও সেই সময়ে হারিয়ে যায়। গল্পকথকের ভয়াল দৃশ্য বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পরিভ্রমণ করতে হয় পুরো সময়টাকে। গল্পকথক রিকশাঅলাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় পাড়ি দিতে গিয়ে জনমানবহীন, ভয়াল এবং গভীরতম ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে থাকে। যেই গন্ধে আছে দেশমাতৃকার ওপর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলা। চারিদিক ছারখার করার দৃশ্য। দানবের নখরাঘাতে প্রতিটি প্রাণ শঙ্কিত-দ্বিধান্বিত। একদিকে জীবনের মায়া অন্যদিকে দেশের স্বাধীনতা সবই তাদের ভাবিত করে। হন্যে হয়ে যে রিকশার জন্য অপেক্ষা সে রিকশাতে উঠেও যেন বাড়ির দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে গল্পকথকের। তার মাথা এলোমেলো হয় নানা চিন্তাভাবনায়। জীবন- মৃত্যুর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আর কীইবা ভাবনা আসবে তার!
গত দুদিন কাজের চাপে কথক বাড়িমুখো হতে পারেনি৷ তাইতো আজ যাওয়ার তাড়া থাকলেও সেখানে বাধ সাধে দেশের পরিস্থিতি। বেতার অনুষ্ঠানে কিছুটা ঈঙ্গিত পেলেও বাড়ির পথে হাঁটা তার জন্য বাঞ্ছনীয় হয়ে উঠতেই তিনি পথে নামেন। সেই পথে নামাই যেন তার জীবনের জন্য চরমতম দুর্দিনের মুখোমুখি করে। সেইসঙ্গে রাতের নিস্তব্ধতা তাকে হিমশীতল করে তোলে। কিছুদূর গিয়েই বাধার মুখে পড়ে। পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাড়ির ঘর ঘর শব্দে রাতের নিস্তব্ধতাও ম্লান হয়ে যায়। তখুনি রিকশা ফেলে রিকশাঅলা ভোঁ দৌড় দেয়। কিন্তু কথক রিকশায় থেকে যায়। সে যেন এক অপরিসীম বেদনায় মুষড়ে পড়তে থাকে। কোথায় যাবে, আদৌ বাঁচবে কী!
অপসৃত রিকশাঅলা, ভৌতিক শহর এবং রাস্তার ধারের সারি সারি অট্টালিকা প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভেতরে মরে আছে। দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রেসক্লাবের চত্বরে আশ্রয় নেয় কথক। কিন্তু সেখানেও নীরবতা৷ তবে অনেক খোঁজাখুঁজির পর খানিকক্ষণের মধ্যে বুকে একটু সাহস পায় পরিচিত দারোয়ানকে দেখে। সেও ভয়ে ভয়ে বলে, কোথায় যাবেন? কেউতো নেই। আপনি পালিয়ে যান। কিন্তু কোথায় আশ্রয়। নিজের শহর, নিজের দেশে সে নিরাপদ নয়। কোথায় যাবে? গল্পকথকের আমি উচ্চরণের মধ্যে বার বার যেন তাই পাঠক আমিকেই খুঁজে ফেরে। মনে হয় যুদ্ধপীড়িত ভূখণ্ডে পাঠকও দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় এর মুক্তি। বুঝে ওঠে না। জীবনের জন্য, দেশের জন্য তার কী করা প্রয়োজন! প্রতিটি মুহূর্তে কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া মুক্তিযুদ্ধপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র উপস্থাপন করেছেন। এত সহজ-সরলভাবে ঠাণ্ডা-নিশ্চল অনুভূতি সৃষ্টিকারী ‘সাদা কফিন’ গল্পটি তাই পাঠককেও যেন কফিনে প্রবেশ করায়। দেশের প্রত্যেকেই যেন কফিন বন্দি। গল্পে লেখক প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন এভাবে,
কেউই নেই! কিন্তু যাব কোথায়? গাড়ি, সামরিক ট্রাক ও কনভয়ের শব্দ একদম এগিয়ে আসছে, ওই বুঝি দেখা যায়, আর যদি আসেই- এখানে আশ্রয় নিলাম, পরে যা হবার হবে, আপাতত এখান থেকে নড়ছি না— বুকের ভেতর দুরু দুরু কম্পমান একটি বল যেন অবিশ্রাম লাফাচ্ছে, অবিরাম একটি নৌকো ঢেউয়ের আঘাতে কাঁপছে। আমার কী যেন হয়ে গেল, দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে কী যেন বলে গেল কিছুই শুনিনি । আমার সামনে পেছনে একটি মাত্র শব্দ শুনছি- আশ্রয়!৩
লেখকের এমন উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের যে বিভৎস চিত্র উঠে এসেছে তা ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশের জনগণ স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ করেনি। বুকে তাজা রক্ত ঢেলে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করেছে। কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া কালকে ধারণ করতে চেয়েছেন। আর একারণেই তাঁর গল্প পাঠকের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। কিন্তু সেই ভয়াবহতাও একসময় আশার আলো জাগায় প্রাণে।
এ প্রসঙ্গে সমসাময়িক কালের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের ভয়বহতা বর্ণিত হয়েছে এভাবে,
পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদগোষ্ঠী আজ এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির শাশ্বত অধিকার স্তব্ধ করতে গিয়ে আজ তারা চোখে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করেছে। ঘরে ভাত নেই, সঙ্গে হাতিয়ার নেই আর থলেতে নেই পয়সা। ব্যক্ত ঘুঘুরা এভাবে যে ফাঁদে পড়বে তা তারা আগে ভাবতেই পারেনি। বার বার এইসব ঘুঘুরা বাংলাদেশের ফসল খেয়ে গেছে। কিন্তু ফাঁদ কখনও দেখেনি। শুধুমাত্র প্রতিবাদ ও প্রস্তাবের মধ্যেই ছিল বাঙালীর প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাঙালি আজ জেগেছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ব্যক্তঘুঘুদের সর্বংশে নিধন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।৪
পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলা এবং শোষিত-নিপীড়িত বাঙালি জাতির অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ প্রাপ্তি। কিন্তু প্রাপ্তির পূর্ব বাঙালি জাতিকে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয় সেই পরীক্ষার একটি ক্ষণের চিত্র সাদা কফিন গল্পের মাধ্যমে উঠে এসেছে। দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি জাতিকে এই দুর্বিষহ সময়কে যাপন করতে হয়। গল্পকথক প্রেসক্লাবের ভেতরে আশ্রয় নিলেও সেখানে অনিরাপদ। সৈন্যদের গতিবিধি এদিকেই। দুটো বড় কনভয়, ট্রাঙ্ক নিয়ে তারা ছুটে চলেছে। কোথাও নিরাপত্তা নেই। এই জনমানবহীন মরুভূমিতে যেন সে একা দাঁড়িয়ে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মৃত্যুর পানে উন্নুখ। কখন হয়তো একটি গুলি এসে বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়ে চলে যাবে। হয়তো এতটাই এফোঁড়ওফোঁড় হবে যে তার চেতনা সঙ্গে সঙ্গে নাশ পাবে। গল্পকার বিপ্রদাশ বড়ুয়া সেই চিত্রই এঁকেছেন এভাবে,
আমি জানালা ছেড়ে ঘরের ভেতর চললাম, বিপদ ঘনিয়ে এলো বলে। চারদিকে বিদঘুটে অন্ধকার, অন্ধকার হাতড়ে চেনা দেয়াল-দরজা ইত্যাদি অনুমান করে বাথরুমের দিকে পৌঁছার আগেই দুনিয়া কাঁপানো শব্দ হলো গুড়ম-গুড়ম বুম বুম বুম বুম পলকে একরাশ বাতাস তাড়িয়ে বালি-ইট-প্লাস্টারের গুঁড়োর ঝড় বয়ে গেল, সমস্ত ঘরটি কেঁপে রাতের নিস্তব্ধতাকে আরেক বার ভেঙে চুরমার করে আবার শব্দহীনতায় উধাও হয়ে গেল। ভয় জড়ানো চোখের ফাঁকে দেখলাম উত্তরের দেয়াল ভেদ করে কামানের গোলা পূর্ব দেয়ালে বাধা খেয়ে ছাদ ফুটো করে চলে গেছে। বিরাট গহ্বর আমার পাশে মূর্তিমান হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল, আমিও চোখ খুলে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে।দুই কান রইল নতুন শব্দের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশায়। পায়ের কাছে মেঝেতে স্তূপ, জঞ্জাল। অন্ধকারে অনুমান করলাম সারা ঘরের দৃশ্য, বুকের ভেতর করোটির খাঁজে খাঁজে শিরশির বোধ। তাড়াতাড়ি আবার গোলাবর্ষণের আগে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচের তলায় নেমে যাওয়া ঠিক করলাম। নেমে যাচ্ছি। সিঁড়ির হাতল মাঝে মাঝে গেছে উড়ে; অন্ধকারে, ভয়ে ভয়ে, আন্দাজে, নামতে নামতে যেন পাতালে নেমে যাচ্ছি আমি একা মৃত্যুর রাজ্যে চুপিসারে ঢুকে-পড়া একটি প্রাণী নিঃশব্দে ঘোরাঘুরি করছি আর অন্ধকারপুরীর দেয়াল, আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, লোহার শিক আমার শরীরে মৃত্যুর নিশ্বাস ফেলছে; কাঁপা কাঁপা পায়ে যেন সাপের ঠান্ডা স্পর্শ-অন্ধকারে মৃত্যুর মহড়া শুরু হয়ে গেছে।৫
গল্পকথকের এই ভয়াল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া এবং সবিশেষ তার আমিত্বের অবসান ।সমস্ত ঢাকা শহর মহাস্থান গড় ও ময়নামতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্লেগে আক্রান্ত ইঁদুরের মতো নিজের শরীরকে টেনে নিয়েও রক্ষা করতে পারনি কথক। একসময় প্রচণ্ড শব্দের মাঝে অনুভব করতে থাকে তার গায়ে রক্ত। কনভয় ও ট্রাঙ্ক ঘর্ঘর শব্দে দূরে যেতেই পরিচিত দারোয়ান কুতুব কথকের ডাক শুনে ছায়ান্ধকারের মধ্যে দৌঁড়ে আসে। রক্ত দেখে সে আবার ছুটে পালায়। মিনিট সাতেক কুতুব নিশ্চিহ্ন। তার কোনো খোঁজ নেই। এদিকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে গল্পের কথক। জ্ঞান হারানোর পূর্বে আবার কুতুব এসে উপস্থিত হয়। চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে সংজ্ঞা ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু একসময় সে তলিয়ে যায় গভীরতায়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যেন সাদা কফিন বন্দি শরীর ঘুরেফিরে রাস্তার প্রধান প্রধান সড়কে। সেই দৃশ্যের অবতারণা করেছেন এভাবে-
সাদা কফিনের মিছিল চলছে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ধরে। রাস্তার দু’পাশের সারিবদ্ধ অট্টালিকা ইমারত আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যায় নবরূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে, কখনো তিন দেয়ালে, আবার সমস্ত দেয়ালে জুড়ে যেন বায়ু প্রবাহের সুবিধানুযায়ী অসংখ্য ছোটো বড় ছিদ্র, কখনো ইমারতের চূড়াগুলো মসৃণ না হয়ে থ্যাবড়া কোথাও শুধু কয়েকটি স্তম্ভ দণ্ডায়মান, ছাদহীন অট্টালিকা জ্যোৎস্না-রৌদ্রের অপরূপ স্বপ্ন খেলায় বিভোর আর কিছুক্ষণ আগের মারমুখো মেশিনগান এবং কামানের মুখগুলো সাদা কফিনের সম্মানার্থে অবনত, সৈন্যরা অভিবাদন জানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দুপাশের অসংখ্য গাছ লাল লাল থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া ছড়াচ্ছে। একটি রাত্রির নিস্তব্ধতা বেয়ে ভেসে চলছে একটি সাদা কফিন।৬
গল্পকথক রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে একটু বেঁচে থাকার আশায় ছটফট করলেও সেখানে হানা দিয়েছে পাকিস্তানী সৈন্য। শরীরের রক্তে যখন প্রায় অবচেতন তখন তার দৃষ্টি বেশ ঝাপসা। সাদা কফিনের মিছিল চলছে শহর জুড়ে। মূলত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এমন বেহাল দশা সৃষ্টি হয়েছিল যেখানে সাদা কফিনের সারি ছাড়া কিছু দেখার উপায় ছিল না। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিল প্রত্যেকটি মানুষ।পুরো দেশ যেন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল। মানুষগুলো ভয়ে কুঁকড়ে থাকলেও শেষপর্যন্ত দেশকে শত্রমুক্ত করেছে এই জাতি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে বাংলাদেশের বহু লেখক গল্প-কবিতা রচনা করেছেন। এসব ছোটগল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বহুমাত্রিক চিত্র উঠে এসেছে। একাত্তরের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতন, অত্যাচার, ধর্ষণ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, দেশত্যাগ, নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। বিপ্রদাশ বড়ুয়াও এদের ব্যতিক্রম নন। ফলে তাঁর ‘সাদা কফিন’ গল্পটিতেও সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্রের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে।
মূলত বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কফিন’ গল্পটি বাঙালি জাতির শেকড়ের কথা বলে। যে জাতি আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শুধু অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করার মনোবল নিয়ে। শত্রুর বুকে পদাঘাত করে নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করেছে। পেটে ভাত নেই, পরনে বস্ত্র নেই, হাতে অস্ত্র ছিল না, থলিতে পয়সা ছিল না তবু শুধু প্রবল আবেগ ও দেশপ্রেম তাদের সঞ্চারিত করেছে। আর তাইতো এ দেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এবং বিপ্রদাশ বড়ুয়ার মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতাকে স্মরণ করে সাহিত্য নির্মাণ বাঙালি জাতির গৌরবগাঁথাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ফলে সমকালীনতাই তাঁকে চিরকালীনতায় ভাস্বর করে রাখবে।
তথ্যসূত্র
১.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ; শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি; বাংলা গবেষণা সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, জাহান কম্পিউটার এন্ড প্রিন্টিং, রাজশাহী, ডিসেম্বর ২০২১, (বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ, চঞ্চল কুমার বোস),পৃ. ১১৬
২. বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সাদা কফিন ও মুক্তিযোদ্ধারা, একুশে বাংলা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ১৩-১৪
৩. তদেব,পৃ. ১৫
৪. জয় বাংলা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র, ১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, বুধবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮ (২ রা জুন, ১৯৭১)
৫. বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সাদা কফিন ও মুক্তিযোদ্ধারা, একুশে বাংলা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ১৬-১৭
৬. তদেব, পৃ.২২