[ ১৭ সেপ্টেম্বর, কবি বিনয় মজুমদারের জন্মদিন। এই উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের বিশেষ নিবেদন]
একজন কবিকে চিন্তার গভীরে নিয়ে যায় যে অন্তর্দাহ,তা টি এস এলিয়ট পাঠে যেমন পাওয়া যায়,তেমনি ফুটে ওঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। আবার একই প্রণোদনা স্পষ্ট হয় বিনয় মজুমদারের কবিতায়ও। ১৯৬২ সালে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হলে সমসাময়িক কবিরা তাকে পাগল আখ্যা দেন। টি এস এলিয়টের ক্ষেত্রেও এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। অথচ,এলিয়ট-ই কাল পরিক্রমণে আধুনিক কাব্যের স্বর্ণশিখরে সমাসীন।
কবিতা হৃদয়াবেগের সংরাগ থেকে সৃষ্টি না হলে কবিতার রসাস্বাদনে সৎ পাঠক মাত্রই বিভ্রান্ত হয়। অথচ ভাবালুতাসর্বস্ব কথামালা আর যা-ই হোক কবিতা পদবাচ্যে গৃহিত হয় না। প্রযত্ন-পরিশীলিত বোধের উপস্থিতি ও প্রকরণ স্বকীয়তা কবিতাকে সসীম থেকে অসীমের পথে ধাবিত করে।কবিতার গুণমুগ্ধ আলোচকদের কবিতাকেন্দ্রিক এসব প্রপঞ্চ বিবেচনায় ‘ফিরে এসো, চাকা’র পুনঃপাঠ অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, বিনয়ের কবিতা নৃ-ঐতিহ্যে ব্যাপ্ত হৃদয়ের গভীরে জন্ম নেয়া প্রেম-অভিজ্ঞান বিষয়ক এক আলোকপর্বমূখী বোধ। যা সমকালিন প্রেক্ষাপটে প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, প্রেম-বিরহের ডিসকোর্স হিসেবে অত্যুজ্জ্বল।
বিনয় বিশ্বাস করতেন—যেহেতু এই বিশ্বে কোনোকিছুই গণিতের বাইরে নয়, সে কারণে কবিতাও অবশ্যই গণিতহীন নয়।
বিনয়ের ‘ভালবাসা দিতে পারি, তোমরা কী গ্রহণে সক্ষম’ পঙ্ক্তিটি বিফলতা নির্দেশক। বলা যায়, মানবজীবন ঘনিষ্ট হতাশা, বিষণ্নতা, প্রত্যাখ্যান, বিরহ-দাহ এক ধরনের মনোবিকারের জন্ম দেয়। এই মনোবিকারই প্রকৃত কবির সৃজনযন্ত্রণার সময়কাল। কবি দেশ-কাল, সময়, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সভ্যতা ধারণ করে পথ পরিক্রমণে অগ্রবর্তী। মানুষ জন্ম থেকে পর্যায়ক্রমের দিকে চলিষ্ণু তেমনি, কবিতাকেও হতে হয় ‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ অভিমুখী। কবিমানসের প্রেম-বিরহের স্থুলতা অতিক্রম করে এ কাব্যের প্রতিটি পঙ্ক্তি পৌঁছে যায় ভাবনার তুরীয়লোকে। তখন প্রেমের ঐ অভিজ্ঞান অতিক্রম করে সকল মর্মচেতনা। স্বপ্নকল্পের প্রেম, বাস্তবতার ছেদন প্রক্রিয়ায় পাঠককে বিমোহিত করে। বিরহের সঙ্গে মানব হৃদয়ের যোগসূত্র কেবল প্রকাশ্য ব্যঞ্জনার স্মারক না হয়ে পৌঁছে যায় রক্তের প্রতিটি কণায়।
অত্যন্ত নিপূণভাবে আমাকে আহত ক’রে রেখে
একটি মোটরকার পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেলো।
থেমে ফিরে তাকালেই দেখে যেতো, অবাক আঘাতে
কী আশ্চর্য সূর্যদয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে কুয়াশা,
কী বিস্মিত বেদনায় একা-একা কেঁদে ফেরে শিশু।
নারীকে কোন ফাঁদে ফেলে কিংবা তার চলার পথ রুদ্ধ করে প্রেমময় আখ্যান গড়া বিনয়ের মোটেও কাম্য নয় বলে ধরা যায়। এখানে তার কাব্যবোধ প্রেমিকসত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত করে। এটাও বিনয়-অভিজ্ঞানে এক ধরনের ডিসকোর্স।
আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত
কিছু ছন্দে, ভীরু মিলে আলোড়িত কাব্যের কণিকা
এখন বিক্ষিপ্ত নানা বায়ুপথে, ঝড়ের সম্মুখে।
আমাকে ডাকে না কেউ নিরলস প্রেমের বিস্তারে।
বিরহের জীবনকে বিনয় মজুমদার গাণিতিক সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য বারবারই বাস্তব আর বিরহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্যদর্শন বোঝার চেষ্টা করেছেন, গণিতের সূত্রে জীবনের মর্মার্থ অন্বেষণে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে কবিতায় ব্যক্তিক অভিনবত্ব, প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। তার কবিতার গভীর পাঠে এক ধরণের মনোবৈকল্য ধরা পড়ে। গ্রন্থটির শেষের কবিতাগুলোতে তাকে কামোন্মাদ হতে দেখি। নারীবাদী চিন্তায় তার জাগতিক সংকল্প প্রকাশিত হয় বিচ্ছেদের প্রজ্ঞারূপে। জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় মজুমদার না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্থাপন করেন।
রক্তের ভিতরে জ্যোৎস্না; তবু বুঝি, আজ পরিশেষে
মাংসভোজনের উষ্ণ প্রয়োজন; তা না-হলে নেই
মদিরার পূর্ণ তৃপ্তি; তোমার দেহের কথা ভাবি—
নির্বিকার কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার, সুখ
এমন আশ্চর্যভাবে মিশে আছে;
কিংবা,
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে-ক্রমাগত
ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন ঘুম পাড়াবার সাধ ক’রে।’
প্রেমপর্বে তিনি নির্ণিমেষ জ্যোৎস্নার সন্ধানে ব্যস্ত থেকেছেন, শোকের ছায়াকে দেখেছেন প্রজ্ঞার অভাবিত শান্তি মূল্যায়নের সপক্ষে। প্রেম ও অ-প্রেমের মত তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণায় কবিমানস নির্বিবাদে ঘুরপাক খায় কবিতার বেলাভূমে। কাঙ্ক্ষিত নারী হৃদয়ের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন বিনয় মজুমদার। তাই কাক্সক্ষার মনোজাগতিক জটিল ঘূর্ণন তার কবিতায় যে আলো-আঁধারের চিত্রকল্পে, নৈঃশব্দ পরিক্রমণ করে তাকে কী আত্মবৈপরীত্য বলা যায়? এ প্রশ্ন এড়িয়েও সুলুক সন্ধানী পাঠক বোঝেন তাঁর কবিতা ছুঁয়ে যায় গোপন কাঙ্ক্ষার সব দরজা। তখন কবিতা হয়ে ওঠে হতাশ্বাস জীবনের পরিপূরক—‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় বলেন:
আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল—আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
তখন বিনয়ের কবিতায় প্রেমের পারস্পরিক প্রজ্ঞা নিয়ে আর কথা থাকে না। কবিতা পাঠে মননের যে দরজা খুলে যায় তাতে শুধু প্রেমহীন হতাশা আর আকুতি তীব্রতর হয়।
কবিতার রস আস্বাদন করতে হবে সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে, দর্শন দিয়ে নয়। ফলে বিনয়ের কবিতায় দর্শন অন্বেষার তেমনি কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। বিনয়ের কবিতা কবিতার মধ্যেই, অন্য কিছুর মধ্যে নয়। তার কবিতায় সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান শুধু ফুলকে ঘিরেই নয়, কাঁটা নিয়েও। এই দার্শনিক তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে ‘আত্মপরিচ’-এ লিখেছেন: ‘এইসব দার্শনিক বিষয় ভাবতে ভাবতে আমার সময় চলে যেতো মাসের পর মাস। এখনো আমি ভেবেই চলেছি। এই দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষ না হলেও চলে, হয়তো তার আভাস মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাসই হোক আর যা-ই হোক উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন।’ তবু এ কথা স্বীকার্য যে দর্শনের জন্য কবিতা পাঠ নয়, কবিতার জন্যই কবিতা পাঠ।
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো- এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনায় গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।
বিনয় বলতেন: ‘আমি গণিতবিদ। আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিত চিন্তায়। আর কবিতা, মানুষ যেরকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান করে তেমনি।’ বিনয়ের চিন্তার ভেতর দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তিনি বস্তুত যাপনের নানাবিধ বিষয় দেখতে ও দেখাতে চেষ্টা করেছেন গণিত সমীকরণ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। বিনয় বিশ্বাস করতেন—যেহেতু এই বিশ্বে কোনোকিছুই গণিতের বাইরে নয়, সে কারণে কবিতাও অবশ্যই গণিতহীন নয়। কিন্তু তিনি গাণিতিক বিশ্বাস ও সূত্রে প্রেমের সমীকরণ মেলাতে পেরেছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না তার কবিতায়।
বিনয় মজুমদারের কবিতার প্রসঙ্গ এলে ‘গায়ত্রী চক্রবর্তী’ নামটি স্বাভাবিক ভাবেই সানে চলে আসে। যাকে তিনি ‘ঈশ্বরী’, ‘চাকা’, ‘মানুষী’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। কল্পনার রঙে তাকে নিয়েই গড়ে তুলেছেন প্রেমের বিশ্ব। ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে’ কবিতায় তিনি বলেন:
কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।
বিনয় মজুমদার ‘দিকচক্রবাল’-এর ‘চক্র’ অর্থাৎ ‘চাকা’কে জীবনের সহায় ভেবেছেন। আর এই ‘চাকা যে চালায়, সে চক্রবর্তী, আমি সেই চক্রবর্তীকে ফিরে আসতে বলেছি- গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই একটা আস্ত চাকা বানিয়েছি।’ এই চক্রবর্তীই একাধারে বিনয়ের ‘প্রেম ও বিরহের’ মাঝে সমাসীন। তার কবিতার পাঠ নেওয়া যায়:
ঝরে পুঁজ, ঝরে স্মৃতি, রহস্যনিলীনা অপসৃতা
কুমারীত্ব থেকে দূরে, আরো দূরে, অবরুদ্ধ নীড়ে।
আর আমি অর্ধমৃত; বৃক্ষদের ব্যাপক অসুখে
শুশ্রূষা করার মতো অনাবিল প্রিয়জনও নেই।
সামাজিকতার বন্ধুবৎসল অভিজ্ঞানে বিনয় মজুমদারও ব্যতিক্রমী নন। এরপরও তার নির্জন স্বেচ্ছাবাস, যাপিত অভিজ্ঞতার নানামাত্রিকতা উঠে আসে বিরহ-কাতরতার আদলে। সমসাময়িকদের কাছে অপমানিত এবং প্রেমে ব্যর্থতা বিনয়ের মানবীয় উপলব্ধিতে সজোরে আঘাত করে। তার নিজস্ব-দর্শন শ্রেণিসংগ্রামের দ্যোতকতা নিয়ে মানসলোক বিলড়িত করে। যার সুস্পষ্ট শৈলী কবিতায় উপস্থাপিত হতে দেখি বিচ্ছেদের নিরিখে।
ফলে আলোচিত প্রেম-বিরহের ডিসকোর্সটি বিনয় অভিসন্দর্ভের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, অভিজ্ঞান শেষে এমনটি প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
বস্তুত প্রেম-বিরহ বিষয়ক ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন রাখে। সঙ্গত দৃষ্টিতে কাব্য-সাহিত্যের বিশ্ববীক্ষায় বিনয় প্রেমের মধু-বিস্বাদ প্রতিতুলনার দাবি করে। প্লাটোনিক প্রেমকে সংজ্ঞায় এনে কবির অভিজ্ঞান বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষিত হতে পারে। কবিতায় অস্তিত্ববাদ, রিয়ালিজম, স্যুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম কিংবা প্রাচ্যবাদের ধারণায় বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বিনয়ের কবিতা বিশ্লেষণ বা বিস্তারিত পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে। কিংবা, পাশ্চাত্য সাহিত্যের যেকোনো প্রেম বিষয়ক দ্বান্দ্বিকতা ডিসকোর্সের উপজীব্য হতে পারে।
শুধু গান ভালোবাসো; বিপদার্ত মিলনচিৎকারে
এমন আগ্রহীনা, চ’লে গেছো পার্কের আশ্রয়ে।
কিংবা,
অপূর্ণের ক্লেশ এই, যে-শাখাগ্রে ফাল্গুনে আমের
বোল মুকুলিত হয়, সে শাখায় নতুন পাতার
উদ্গমের পথ নেই; কোথায় মুকুলিত প্রেম?
বিনয়ের কবিতাকে ‘আধুনিক কামসূত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস তার সমকালে যেমন দেখা গেছে তেমনি তার মৃত্যুর পরও এ অপচেষ্টা থেমে নেই। কিন্তু আমার এ ডিসকোর্সের উদ্দেশ্য নিন্দাভাষ্য রচনা নয়, বরং তার কবিতার অন্তর্নিহিত প্রেম বিষয়ক মূল্যবোধকে তুলে ধরার চেষ্টা। ‘সন্তপ্ত কুসুম ফুটে’ কবিতায় তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন, বলতে চেয়েছেন তার অন্তস্থিত বিরহের বিবরণ:
সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়।
দেখে কবিকুল এত ক্লেশ পায়, অথচ হে তরু,
তুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না।কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙ্ক্তি আর
মনে নেই গোধূলিতে; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুল বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।
বলাবাহুল্য, বিনয়ের কিছু কবিতা রয়েছে যেগুলোতে ‘কাম’ বিষয়ক চিন্তাভাষ্য চিত্রিত হয়েছে। তার ‘সন্তপ্ত কুসুম ফুটে’ কবিতাতেও কেউ কেউ কিছুতেই সেগুলোকে ‘অকবিতা’ বলার সুযোগ নেই। বিনয়কে মূল্যায়ন করতে হলে তার সে কবিতাগুলোরও গভীর পাঠ জরুরি। বিনয় (হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা) নিজের ঠিকানা হারিয়ে গেছে বলে মনে করেছেন, মনে করেছেন ‘ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই’; এটা তার জীবনসত্য কিন্তু কবিতার সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীতে। তিনি কবিতায় প্রেম ও বিরহের যে ভিন্ন দ্যোতনা ছুড়ে দিয়েছেন, তা কবিতার প্রকৃত পাঠক ঠিকই বুঝে নিতে সক্ষম হবেন।
কবি বিনয় মজুমদার অন্ধকারে বসে আলোর তপস্যায় মগ্ন থেকেছেন। সরল গ্রাম্যজীবনের লোকবিশ্বাস বুকে লালন করে নিরন্তর হেঁটেছেন সত্যানুসন্ধানে। আশার জটিলতায় সামিল না হয়ে বুকের ভেতর গড়ে তুলেছেন মসৃণ শিল্পঘর। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তিনি শিল্প সুষমার নিখুঁত তুলিতে এঁকেছেন কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি। মার্কিন কবি জিন গ্যারেজ বলেছেন, ‘একটি কবিতার প্রতিটি পঙক্তিই হলো এক আত্মজীবনী।’ এ মহান উক্তির সঙ্গেই জীবনের গাঁটছড়া বেঁধেছেন কবি বিনয় মজুমদার। তার শাব্দিক কথামালা ও হার্দিক বর্ণমালা জুড়ে রয়েছে ধ্রুপদী সদগুণের সমন্বয়।
বিনয়ের কবিবন্ধু উৎপল কুমার বসুর বলেন: ‘বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমরা বুঝি তেমন এক অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি যেন এরপর আর কোন কবিতা হয় না।’ আর এর সূত্র ধরে বিনয়ের বহুল আলোচিত ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতা নিয়ে আমার এ ক্ষুদ্র ডিসকোর্স। বিনয়ের কবিতায় প্রেম-বিরহ বিষয়ক এ ডিসকোর্সটি তার ব্যক্তির সৃষ্টিকুশলতা থেকে সামষ্টিক গভীরতার দিকে বেগবান কি-না সেটি বিবেচনা করা দরকার। যেহেতু তার কবিতার তাত্ত্বিক গুরুত্বের; পাশাপাশি দর্শনের গুরুত্বও অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে নৃ-ঐতিহ্যে কবিতার বিস্তার শৈলী, কতটুকু গ্রহণীয় তার ব্যাখা দাঁড় করানো এ ডিসকোর্সের উদ্দেশ্য নয়। ফলে আলোচিত প্রেম-বিরহের ডিসকোর্সটি বিনয় অভিসন্দর্ভের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, অভিজ্ঞান শেষে এমনটি প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।
আরও পড়ুন: মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতা: প্রজ্ঞার শিল্পরূপ ॥ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ