প্রত্যহ ভেসে যাওয়া ‘‘সহস্র বিস্মৃত রাশি’র দু’চারটি অশ্রুজল’’-ই ছোটগল্পের উৎসভূমি। অন্তত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলেছেন। মানুষের জীবন ও মনের গল্পই তো আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রভূমি। কিন্তু গল্প যখন শুধু মানুষের মস্তিষ্ক থেকে পল্লবিত হয়, তখন তাতে আর মন মজে না। বিজ্ঞান যাই বলুক না কেন, মনের আধার মগজে, না বুকে—এই নিয়ে যতই বিতর্ক করুক না কেন, সাহিত্যের বাজারে মন একটা বড় ভূমিকা রাখে। আর সেই মনের মন্দির আমরা বুককেই ভাবতে ভালোবাসি। কারণ সাহিত্যে দুইয়ে দুইয়ে শুধু চারই হয় না, তিন, পাঁচ, সাত—যা খুশি হতে পারে!
এসব কথা বলার কারণ একটিই—বলা হয়, বর্তমানে সাহিত্যের বাজার মন্দা, গল্পের মাঝে গল্প নেই। কবিতার নামে যা ছাপা হয়, তা শব্দের জড়ভরত। কথাগুলো মিথ্যে নয়। আবার এও সত্য—চিরকালই এমন একটা কথা ছিল—কিছুই হচ্ছে না।
এ কথা সত্য যে, অপবাদ ছিল, আছে এবং থাকবে। আবার সঙ্গে সঙ্গে কালজয়ী সাহিত্যও রচিত হবে। তবে, বর্তমানের কথাসাহিত্যের বিরুদ্ধে অভিযোগটি জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এর বাস্তব ভিত্তিও আছে। কারণ এখন সাহিত্যে মস্তিষ্কের সঙ্গে মনের যোগ নেই। সাহিত্যিকের সঙ্গে বিচিত্র জীবনের পরিচয় নেই। তবে দুনিয়াদারি সব সত্যের মতোই এ কথাও পুরোপুরি সত্য নয়। প্রতিনিয়ত যে পালাবদল পৃথিবীতে ঘটে চলছে তার ‘দু’চারটি অশ্রুজল’ ঠিকই প্রকৃত সাহিত্যিকের হাতে পড়ে অক্ষয় হয়ে থাকছে।
উপর্যুক্ত কথাগুলো ‘চিন্তাসূত্রে’র আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত বারোটি গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়ার ভূমিকা বলা যেতে পারে। সঙ্গে এও যোগ করা যেতে পারে—এই বারোটি গল্প বিচিত্র জীবনের গল্প। যে গল্পগুলো জীবন থেকে নেওয়া। আমাদের আশেপাশেই যারা ঘুরে বেড়ায়, হয়তো যাদের আমরা দেখেও দেখি না, তাদের কথাই বলেছেন বারোজন গল্পকার। রসনিষ্পত্তিতে গল্পগুলো মানোত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ হলো কি না, তার বিচার বাদ দিয়ে গল্পের মাঝে গল্প উপহার দেওয়ার জন্য প্রথমেই এই গল্পকারদের ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ ‘চিন্তাসূত্রে’র সম্পাদককেও। যিনি এই মানসম্মত সংখ্যাটি প্রকাশ করেছেন।
আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত প্রথম গল্পটি ছিল রুমা মোদকের। গল্পের শিরোনাম ‘শর-জীবন’। বিপন্ন হয়ে আসা বেদে সম্প্রদায়কে নিয়ে গড়ে তুলেছেন তার গল্পের জমিজিরাত। শুরুতেই দেখা যায়—যক্ষ্মাক্রান্ত আফাজউদ্দীনকে। যিনি একটি বেদে বহরের সর্দার। রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী আফাজউদ্দীনের মতোই মুমূর্ষু তার বেদে বহর। তাদের আগের জৌলুস আর নেই। আয়-রোজগারে ভাটা পড়েছে অনেক আগেই। আফাজউদ্দীনের বর্তমান কাজই হলো অতীতকীর্তির স্মৃতিচারণ করা। কোনো এনজিও কিংবা অন্য কোনো সংগঠন তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে এলে আফাজ সগৌবে প্রচার করে অতীতের কীর্তিগাথা।
মরিয়ম কিভাবে মারিয়াম হলো, সেই ঘটনাই এই গল্পের মূল উপজীব্য। একইসঙ্গে উঠে এসেছে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের অন্ধকার জীবনের চালচিত্রও
গল্পটির প্রধান চরিত্র আফাজের স্ত্রী আছিয়া। স্বামী আর একমাত্র সন্তান সাবিত্রীকে নিয়ে তার সংসার। সংসারের আয়ের প্রধান উৎস নানা রকমের ওষুধ বিক্রি, দাঁতের পোকা ফেলানো—এসব। সঙ্গে আছে দেহ-ব্যবসা—গণিকাবৃত্তি। সাবিত্রীর নতুন যৌবন। নিয়মিত এক খদ্দের আসে তার কাছে। বিয়ে হয়েছিল। টেকেনি। সন্তান নিয়ে চলে এসেছে বাপের কাছে। এখন তার গর্ভে আরেক সন্তান। যার জন্মের পর বাবার স্বীকৃতি থাকবে না। সাবিত্রীও আফাজের ঔরসের নয়। আছিয়ার এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় সাবিত্রীর প্রকৃত বাবার কথা। গল্পকার দক্ষ হাতে বর্ণনা দিয়েছেন। যার ফলে গল্পপাঠের সময় প্রতিটি দৃশ্য পাঠকের চোখে ভেসে ওঠে। একটি বাক্যে তিনি যেভাবে দেশের সমকালীন রাজনীতির চিত্র এঁকেছেন, তা সত্যিই অভাবনীয়। অনেকে অনেক লাইনেও যা বর্ণনা করতে পারেন না, তিনি তা এক লাইনে বর্ণনা করে দেখিয়েছেন। তবে এ গল্পের সমাপ্তি সবচেয়ে টার্নিং পয়েন্ট। আছিয়া যখন সাবিত্রীর গর্ভের সন্তানের বাবাকে দেখতে পায়, তখন সে চমকে ওঠে, কারণ এই সে ব্যক্তি, যে কিনা সাবিত্রীরও জন্মদাতা!
‘শ্রেণীশত্রু’ গল্পে ফারহানা রহমান এঁকেছেন মারিয়াম চৌধুরী ওরফে মরিয়ম খাতুনের আখ্যান। মরিয়ম কিভাবে মারিয়াম হলো, সেই ঘটনাই এই গল্পের মূল উপজীব্য। একইসঙ্গে উঠে এসেছে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষের অন্ধকার জীবনের চালচিত্রও। সরলরৈখিক গল্পটি বয়নে বেশ আকর্ষণীয়। রিংকম্পজিশনে গাঁথা সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষের তৈরি দুর্ভেদ্য নিয়মনীতির কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গলটি।
শারমিন রহমানের গল্পের সাধারণত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনভাষ্যই থাকে। তার ‘ফুলবানু’ গল্পটিও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্রামের এক অসহায়, অবলা ফুলবানু এই গল্পের মূল চরিত্র। সে মূলত প্রতিটি নারীরই প্রতীক। ঘরে-বাইরে নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু পুরুষ। ফুলবানু বিভিন্ন সময়ে ঘরে-বাইরের পুরুষের হাতে যৌননির্যাতনের শিকার। তাই গল্পের শেষে ফুলবানুর উপলব্ধি হয়, এইসব বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন পুরুষ-পশুর চেয়ে তার আলাভোলা স্বামী, যে স্ত্রীর সেঙ্গ নিবিড় মুহূর্তের কথাও অন্যের কাছে খুব সহজেই বলে দেয়, যার জন্য ফুলবানু বা ফুলবানুর কন্যা পদে পদে মানুষের তিরস্কার শোনে, সে অনেক ভালো। কারণ অন্য নারীর প্রতি তার কোনো লোভ নেই। ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো নারীর ওপর সে ঝাঁপিয়ে পড়ে না।
‘শূন্যে উড়াল’ গল্পে মুস্তাইন সুজাত জীবনের এক চিরায়ত সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সবাইকে একদিন সময়ের কাছে সাক্ষী রেখে চলে যেতে হয়। গল্পে কাছুনি বুড়ি সেই ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী। হারুর বন্দি পাখির ছটফটানি দেখে পাখির মাঝেই নিজেকেই দেখতে পায় বুড়ি। এই সংসারটাকেও তার কাছে খাঁচা মনে হয়। তাই, গল্পের শেষে বুড়ির অনুরোধে হারু যখন পাখিকে মুক্ত করে দেয়, বুড়ির প্রাণপাখিটাও সে সঙ্গে মুক্ত হয়ে যায় দেহপিঞ্জিরা থেকে। বুড়ি ছাড়াও গল্পে উঠে এসেছে বেশ কিছু চরিত্র। সঙ্গে গ্রামবাংলার প্রকৃতিকে লেখক একজন চিত্রকরের মতোই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তবে গল্পের বর্ণনায় লেখক আঞ্চলিক ভাষারও ব্যবহার করেছেন। ফলে কোথাও কোথাও পাঠকের জন্য অস্পষ্টতা তৈরি হতে পারে।
আসলে এই নাগরিক জীবন আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছে কিন্তু সেইসঙ্গে কেড়েও নিচ্ছে অতীতকে। হত্যা করছে অনুভূতিপ্রবণ মনকে
কর্পোরেট দুনিয়ায় আমরা ছুটতে ছুটতে, তালমিলিয়ে চলতে চলতে হারিয়ে ফেলছি আমাদের শৈশব-কৈশোরকে। আমাদের অমল-কোমল অতীতকে। মাহরীন ফেরদৌসের ‘রুবি তোমাকে চিনি’ তেমনি সমাজের উঁচুতলার এক মানুষকে নিয়ে গল্প গড়ে উঠেছে। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের মূল চরিত্র একজন মেয়ে। অফিসে সোসাইটিতে যিনি সবকিছু মেনটেইন করে চলেন। অফিসের দুঁদে এমপ্লয়ি। সোসাইটিতেও নাম ডাক। বান্ধবী সানজিদার আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে রুবি নামের স্কুলের এক সহপাঠিনীকে সাহায্য করতে গল্প কথিকা রুবিদের বাসায় যায়। কিন্তু যে স্কুলের বান্ধবী, কৈশোরের এক আনন্দময় মুহূর্তে এই রুবিও তার পাশে ছিল, সেই রুবির কথা সে স্মরণ করতে পারে না। এই কর্পোরেট দুনিয়ায় চলার জন্য কত কিছু তার মুখস্থ। কত কিছু তাকে মনে রাখতে হয়। এইসব মনে রাখতে গিয়ে সে ভুলে গেছে কৈশোরের বান্ধবীর কথা। অর্থাৎ নিজের অতীতের কথাও। আসলে এই নাগরিক জীবন আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছে কিন্তু সেইসঙ্গে কেড়েও নিচ্ছে অতীতকে। হত্যা করছে অনুভূতিপ্রবণ মনকে। মুছে দিচ্ছে আনন্দঘন স্মৃতিকে। অতীত হারানোর অন্তর্লীন বেদনা এই গল্পে উঠে এসেছে। মাহরীন ফেরদৌসের গদ্য বেশ স্মার্ট। তিনি গল্পকে দক্ষ হাতে নিয়ে যেতে পারেন সমাপ্তি পর্যন্ত। খুব সহজেই আঁকতে পারেন সমাজের পারিপাশ্বের চিত্র। তবে গল্পের শেষে রুবিকে ভুলে যাওয়ায় যে হাহাকার জেগেছে গল্পকথিকার মনে, সেই হাহাকার পাঠকের মনে ঠিক একই সুরে বাজে না। কিছুটা ম্লান হয়ে যায়।
কবীর আলমগীরের গল্প ‘বৃক্ষের নাম কাঠবাদাম’। গল্পটিতে উঠে এসেছে মধ্যবিত্ত সমাজের এক করুণ চিত্র। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার যে দুস্তর ব্যবধান, কষ্টের যে পাঁচালি বয়ে চলতে হয় মধ্যবিত্তকে, তারই গল্পরূপ আফাজ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে রচিত এই আখ্যান। আফাজ পঙ্গু। আগে নসিমন চালাতো। অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন ক্রাচ নিয়ে ঘরে বসে থাকে আর কারণে-অকারণে গালি দেয় স্ত্রী-পুত্রকে। ছেলে নিয়ামত কলেজে পড়ে। অবসরে নসিমন চালায়। তবে সবদিন চালাতে যায় না। সেদিনই তাকে বাবার গালি শুনতে হয়। কাঠবাদাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে গালি শোনে। কান্না পায় তার। মনে পড়ে ময়না বুবুর কথা। তার বড় বোন। আগে সে কাঁদলে ময়না তাকে সান্ত্বনা দিতো। অথচ সেও মাস কয়েক আগে চলে গেছে এই গাছের ডালের সঙ্গে ফাঁসি দিয়ে। ফাঁসির ঠিক কারণ জানা যায় না। জানার উপায় নেই। তবে শোনা যায়, ভালোবেসে কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে গর্ভে বাচ্চা চলে আসে। সেই ‘কলঙ্ক ঘোচানো’র জন্য এই মৃত্যুর পথ বেছে নেওয়া। আসলে মধ্যবিত্তের বিষে নাশ হয়ে যায় অনেক পরিবার। পরিবেশ, প্রকৃতিই যার নীরব সাক্ষী। সমব্যথী। তাই বাবার কাছে যখন নিয়ামত গালি শোনে, তখন জীবনটা অসহ্য মনে হয়, তখন কাঠবাদাম গাছের ডাল দেখে মুক্তির উপায় চোখে পড়ে। মনে হয়, বোন ডাকছে—এই দুঃখ-কষ্টের জীবন ছেড়ে চলে যেতে।
এক ডজন গল্পের মধ্যে বিষয় নির্বাচনে ফারাহ সাঈদের ‘এক পোয়া আমি’ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। উত্তম পুরুষে বর্ণিত গল্পটির কথক কোনো ব্যক্তি বা প্রাণী নয়। একটি তরমুজ। বলা যায়, এটি একটি তরমুজের আত্মকাহিনী। জন্মের পর থেকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত একটি তরমুজের জীবনাখ্যান। তবে, গল্পটি পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত মনে হয়, অসহায়, নিশ্চল তরমুজ আসলে নিয়তির নিগড়ে বন্দি, পরাজিত কোনো ব্যক্তিরই গল্প।
রাইসার মনে হয়তো ক্ষণিক সময় প্রজাপতি তার রঙিন পাখাও ঝাপটায়। তবে তাদের আহ্বানে সে সাড়া দেয় না। কারণ জীবন তাকে শিখিয়েছে, প্রেম পুরুষের নিছক এক মোহ
নাসরিন সিমির ‘সাহিত্য পুরস্কার’ গল্প উৎসভূমি এই সময়ের সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে নোংরামি, রাজনীতি। অধিকাংশ সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে যে নীলনকশা প্রণীত হয়, নাসরিন সিমির গল্প তারই গল্পরূপ। নাসরিন সিমি শুধু বর্তমানের পুরস্কারের রাজনীতিকেই তুলে ধরেননি, একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের চেতনা নিয়ে সুবিধাবাদীদের মুখোশও টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন। গল্পে প্রতীকী ব্যঞ্জনা তৈরিতে লেখক পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সামান্য একটি শব্দের ব্যবহারও যে কত লক্ষ্যভেদী হতে পারে, নাসরিন সিমি ‘খামোশ’ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে তা দেখিয়েছেন। তবে লেখক গল্পের সমাপ্তি নিয়ে আরেকটু ভাবলে ভালো করতেন বলে আমাদের অভিমত। শুরু থেকে টান টান বর্ণনার মাধ্যমে এগিয়ে আসা গল্প শেষ দিকে কিছুটা ঝুলে পড়েছে।
ইলিয়াস বাবর ‘পুরুষ ও প্রেম বিষয়ক’ গল্পে রাইসা নামের এক নার্সের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। নিষ্ঠুর বাস্তবতাই তাকে বুঝিয়েছে, বাঁচতে হলে পয়সা উপার্জন করতে হবে। কিন্তু এরপরও প্রথম প্রথম রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছেড়ে যাওয়ার সময় বখশিস দিতে চাইলে, নিতে দ্বিধা হতো রাইসার। তবে ওই যে জীবন থেকে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়। রাইসাও আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে বেতনের বাইরে এইসব উপরি গ্রহণ করতে। অনেক সময় রোগীর আত্মীয়-স্বজন আচরণে, ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে রাইসার প্রণয়কাঙ্ক্ষী, পাণিপ্রার্থী হয়। রাইসার মনে হয়তো ক্ষণিক সময় প্রজাপতি তার রঙিন পাখাও ঝাপটায়। তবে তাদের আহ্বানে সে সাড়া দেয় না। কারণ জীবন তাকে শিখিয়েছে, প্রেম পুরুষের নিছক এক মোহ। পুরুষ প্রেমের নামে অন্য কিছু চায়। আর তার ঘোর যেদিন কেটে যাবে, সে রাইসাকে নষ্ট পুতুলের মতো পথে ফেলে দেবে। ইলিয়াস বাবরের গদ্য বেশ সাবলীল। তাই কোনও বিরতি ছাড়াই গল্প পড়ে শেষ করা যায়।
আর্থিক সচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও শিল্পী নাজনীনের ‘ঘোর’ গল্পের মইনুলের মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া খুব সহজ হয়নি। তার শিক্ষক হারান মাস্টার অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজীব করিয়েছিল মইনুলের মূর্খ, ধনী বাপকে। মইনুলও পড়া শোনায় বেশি মনোযোগী ছিল ছোটবেলা থেকে। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর তার সর্বক্ষণই কাটতে থাকে ডাক্তারি বিদ্যার বড় বড় বই পড়ে। তার ইচ্ছে ছিল পাশ করার পর তার অসুস্থ বাপকে প্রথম অপারেশন করবে। করেও। কিন্তু অপারেশন সার্থক হয় না। মইনুলের বাবা মারা যায়। মইনুল তাই নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারেনি। অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ে। কাহিনী এতটুকু হলেও শিল্পী নাজনীন তার ‘ঘোর’ ঘটনাকে এত সরলীকরণ করে উপস্থাপন করেনি। পুরো গল্পটি বুঝতে হলে পড়তে হবে শেষ পর্যন্ত। এবং শেষ পর্যন্ত পড়লেই এক অনুচ্ছেদ থেকে অন্য অনুচ্ছেদের আপত ভিন্নতা প্রতীয়মান হবে। অর্থাৎ শিল্পী নাজনীন তার গল্পে শুধু বিষয়কেই উপস্থাপন করেননি, সেইসঙ্গে কাঠামো নির্মাণেও সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
গল্প না পেয়ে গল্পহীনতাকে যারা গল্পের উপদান করে, এ গল্পগুলোর অবস্থান তাদের বিপরীত বিন্দুতে। সবশেষে পুরোনো কথাটি আবার নতুন করে বলা যায়, জীবনের গল্প বলা এখনো ঢের বাকি
মুরিকুলির মাধ্যমে ‘মুরিকুলির মৃত্যু ও মুক্তি’ গল্পে রঞ্জনা বিশ্বাস ভাগ্যবঞ্চিত, নিপীড়িত আদিবাসীদের অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। মুরিকুলি ১৯৭১সালে যুদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করতে পারলেও, নিজের ভিটা রক্ষা করতে পারেনি খলিল মোল্লার হাত থেকে। দেশ স্বাধীন করার পর বাবা-মা-বোনকে দেশে নিয়ে আসার জন্য ভারতে মামার বাড়ি যায়। মামা কাউকে দেশে ফিরতে দেয় না। মুরিকুলিকেও বলে থেকে যেতে। কিন্তু জীবনবাজিক রেখে যে দেশ স্বাধীন করেছে, সে দেশে না ফিরে কি সে পারে? তাই সে ফিরে আসে। ফিরে এসে দেখে দখল হয়ে গেছে তার বাড়ি। মুরিকুলি প্রথমে প্রতিবাদ করে। যখন বুঝতে পারে, হাজার প্রতিবাদ করেও ফিরে পাবে না তার বাড়ি, তখন নিজের বাড়িতেই সে আশ্রিত হয়ে থাকার সুযোগ দিতে মোল্লার কাছে অনুরোধ করে সে। মোল্লা তার অনুরোধ রাখলে সে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই বাড়িতে থাকে। মৃত্যুতে মুরিকুলির মুক্তি ঘটে অভিশপ্ত জীবন থেকে। কিন্তু তার মৃত্যু জন্ম দেয় অজস্র প্রশ্নের। সে প্রশ্নের আদৌ কোনো উত্তর আছে কি না, কে জানে?
সানাউল্লাহ সাগর ‘গল্পের ঠিকানা’য় উন্মোচন করেছেন একজন লেখকের মনোলোকের রহস্য। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দহন, যৌন অবদমনের চেয়ে একজন লেখকের কাছে আরাধ্য তার গল্প। তার সৃষ্টিকর্ম। স্ত্রী বা সুন্দরী প্রেমিকার সান্নিধ্য তাকে টলাতে পারে না তার গন্তব্য থেকে। শেষপর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা, উদ্দীপনা তাকে নিয়ে যায় গল্পের কাছে।
‘চিন্তাসূত্রে’র বারোটি গল্প পাঠককে মুখোমুখি করে বিচিত্র অভিজ্ঞতার। গল্প না পেয়ে গল্পহীনতাকে যারা গল্পের উপদান করে, এ গল্পগুলোর অবস্থান তাদের বিপরীত বিন্দুতে। সবশেষে পুরোনো কথাটি আবার নতুন করে বলা যায়, জীবনের গল্প বলা এখনো ঢের বাকি। নতুন করে বুকে আশা বেঁধে দাঁড়ানো যায়, আমাদের কথাসাহিত্য সামনের দিকেই এগিয়ে চলছে।