জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ ইতোমধ্যেই পাঠকমহলে বিশেষ একটি স্থান দখল করে নিয়েছে। তিনি সাহিত্যে স্থান করে নেওয়ার জন্য লেখেননি। নিজের তাগিদে, সময়ের প্রয়োজনে লিখেছেন। আর সেই লেখাই এখন সাহিত্যের আকাঙ্ক্ষা ও জিজ্ঞাসাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন লেখক সত্তা নিয়ে। এত কিছুর মাঝেও তার এই সত্তা আমাদের বিস্মায়াভিভূত করে। আমরা খুঁজে পাই সাহিত্যিক বঙ্গবন্ধুকেও। অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে তার হস্তলিপি প্রকাশের মাধ্যমে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যদিয়ে তার লেখক সত্তা প্রস্ফুটিত হয়। আঠারো মিনিটের সেই দীর্ঘ ভাষণ স্বাধীনতাকামী বিক্ষুব্ধ মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছে। জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। তার কণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল। সাহিত্য যেমন আবিষ্ট করে মানুষকে; তেমনি ভাষণের যদি সাহিত্যমূল্য থাকে, তবে ৭ মার্চের ভাষণেরও বিশেষ সাহিত্যমূল্য রয়েছে। কাব্যিক সেই ভাষণকে তবে ‘দীর্ঘ কবিতা’ বলা যায়। যা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বের হওয়ার মূলমন্ত্র। সেই ভাষণে বাঙালির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তান সরকারের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ রয়েছে। বাঙালিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে শুধু ভাষণই উচ্চারিত হয়নি, বজ্রমুষ্ঠিতে উঠেছিল কলমও। তিনি কারাবন্দি জীবনের ফাঁকে ফাঁকে সময়ের সদ্ব্যবহারও করেছেন। তিনি লিখে গেছেন তার আত্মজীবনী। যদিও তা সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তিনি কারাগারে বসে রোজনামচা লিখেছেন। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পর তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অবশ্য পাঠ্যরূপে পরিগণিত হয়েছে।
২০০৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি এক্সারসাইজ খাতা আকস্মিকভাবে তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুঁজে পান। খাতাগুলো অনেক পুরনো, পাতাগুলো জীর্ণপ্রায় এবং লেখা প্রায় অস্পষ্ট। মূল্যবান ওই খাতাগুলোই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। যা তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। তবে ২০১২ সালে তার আত্মজীবনী প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয় বইটি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি অবস্থায় এই অমূল্য দলিল রচনা করেন। তার লিখিত এই স্মৃতিকথা ২০১২ সালের ১৮ জুন বাংলায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটির প্রথম প্রকাশনার সার্বিক দায়িত্বপালন, তত্ত্বাবধান ও কার্যক্রম পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বইটি প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি, হিন্দি, স্প্যানিশ, উর্দু ও চীনা ভাষায় অনূদিত হয়।
জেল-জুলুম, নিগ্রহ-নিপীড়ন যাকে সবসময় তাড়া করে ফিরেছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসর্গীত-প্রাণ, সবসময় ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু যে আত্মজীবনী লেখায় হাত দিয়েছিলেন এবং কিছুটা লিখেছেনও, বইটি তারই সাক্ষ্য বহন করে। বইটিতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। লেখকের কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি; সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তার রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সব দুঃসময়ে তার পাশে অবিচল ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তার রচিত নতুন গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি এ বইটিতে স্থান পেয়েছে। তবে বইটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র দ্বিতীয় খণ্ড বলে ধারণা হতে পারে। তবে এটি বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ নতুন বই। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে তার লেখা দুটি এক্সারসাইজ খাতা জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ও পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধারকৃত একটি খাতার গ্রন্থরূপ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত এই ‘কারাগারের রোজনামচা’।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পর ‘কারাগারের রোজনামচা’ রাজনৈতিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বইটি পড়লে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, ব্যথা-বেদনা, রক্তক্ষরণ, ক্রান্তিকাল সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়। আমাদের ভাগ্যোন্নয়ন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের জন্য নিজের জীবন-যৌবন উজাড় করে দিয়ে যে মহান আত্মত্যাগের পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তা এই বইয়ের পাতায়-পাতায় পরম মমতায় শব্দে-বাক্যে উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর ওই বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার ও জামিন পান। এরপর মে মাসে আবার গ্রেফতার হন। ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি উঠে এসেছে বইটিতে। বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকাকালীন প্রতিদিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবন, জেল-যন্ত্রণা, কয়েদীদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল—সেসব বিষয় যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে; ঠিক তেমনি তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ৬ দফার আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রকৃতিপ্রেম, পিতৃ-মাতৃভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
বইটির পাণ্ডুলিপি দু’বার উদ্ধার করা হয়। প্রথমবার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পরপরই, দ্বিতীয়বার জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালীন। বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বইটির পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের লোমহর্ষক দু’টি ঘটনা বইয়ের ভূমিকায় সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। বইটির নামকরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা।
বইটিতে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন স্মৃতিচারণে তার মনের অব্যক্ত কথা বলতে চেয়েছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে যে রাজনীতি; সেই রাজনীতিতে দ্বিচারিতা চলে না, কপটতা চলে না। ব্যক্তি স্বার্থের চেয়েও সেখানে দেশ ও জনগণের স্বার্থই বড়। বঙ্গবন্ধু দেশ ও জনগণের স্বার্থেই রাজনীতি করেছেন। বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কখনো ‘বীরের জাত’ আবার কখনো ‘পরশ্রীকাতর’ও বলেছেন। বাঙালি অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়, আবার অন্যের ভালো দেখতে পারে না। আবার সবসময়ই কিছু বাঙালি ছিল বিশ্বাসঘাতক। সবসময়ই বাঙালিরা নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে নিজেদের ক্ষতি করেছে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভিনদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
একদিকে ৬৬ সালের ভয়াবহ বন্যা। চালের দাম ৪০-৫০ টাকা মণ। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। জনগণের মনে শান্তি নেই। অন্যদিকে ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আওয়ামী লীগসহ সারাদেশের মানুষ সোচ্চার, তখন চলছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে। ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। জাতির সেই সংকটকালে কিছু মানুষকে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন বাঙালি জাতির সঙ্গে বেঈমানি করতে। যাদের বঙ্গবন্ধু ‘আগাছা-পরগাছা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা বাঙালি হয়েও তারা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তাঁবেদারি করেছে।
জনগণের নেতাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে অন্ধকার কারাগারে। একদিকে উঁচু প্রাচীর। পাশের সেলে সত্তর জন পাগল। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর মানসিক নির্যাতন, অন্যদিকে পরিবার-পরিজন ছাড়া একাকী জীবন। সেই দুঃসহ জীবনে তার সঙ্গী হয়েছিল ‘প্রকৃতি’ আর ‘বই’। কারাগারে বসে শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ পাঠের খবরও আমরা পাই। কারাগারের চার দেয়ালে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিঃসর্গের যে অপরূপ বিবরণ দিয়েছেন, তা অসাধারণ বলাই যায়। আত্মজীবনীতে তিনি দিল্লির ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলীর মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছেন। রোজনামচায় পাচ্ছি প্রকৃতির নানা রূপের বিবরণ। ঘুরেফিরে একজোড়া হলুদ পাখির জন্য তার ব্যাকুলতার কথা লিখেছেন।
কারাগারের রোজনামচা বইটি ১৯৬৬-১৯৬৯ সালের দিনলিপি হলেও; তিনি কখনো ফিরে গেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে, কখনো বা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মহৎ সংগ্রামে। বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা। একজন মহান, মানবিক নেতার সংস্পর্শে এসে একজন কুখ্যাত ‘চোর’ কিভাবে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে, সে সত্যও বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক যেন কোনো রকম শব্দ-বিভ্রান্তিতে না পড়ে, তার জন্য তিনি দিনলিপি লেখার আগেই কারাগারের প্রচলিত শব্দগুলোর অর্থ ঘটনার বিবরণীর মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন। যেমন—আইন দফা, ডালচাকি দফা, হাজতি দফা, ছোকরা দফা, রাইটার দফা, চৌকি দফা, জলভরি দফা, ঝাড়ু দফা, বন্দুক দফা, পাগল দফা, দরজি খাতা, মুচি খাতা, শয়তানের কলসহ জেলখানায় ব্যবহৃত নানাবিধ শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচনেরও ব্যবহার করেছেন দিনলিপিতে।
বইটির দিনলিপিতে বাংলা বা বাঙালিত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমষ্টির জন্য তার ক্রন্দন প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রতিটি চরণে। কঠিন সত্যকে ভালোবেসে নির্মোহভাবেই নিজেকে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি দিনলিপির শেষে লেখকের একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতার নিদারুণ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। কোমল পাঠকও যেন তার জীবনের বন্দিশালায় এসে কান্নাসিক্ত হয়ে পড়েন।
‘কারাগারের রোজনামচা’ জেলজীবনের খুঁটিনাটি নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। স্মৃতিচারণের ধারাবাহিকতার স্বার্থে প্রতিটি লেখার একটি আলোচ্য বিষয় উঠে আসে। যেমন—‘থালা বাটি কম্বল জেলখানার সম্বল’, ‘মানবিক বৃত্তি’, ‘৬ দফার জন্য জেলে এসেছি’, ‘সেলের চৌহদ্দি’, ‘ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই’, ‘পাকিস্তানের আপন মার পেটের ভাই’, ‘আমাকে দেখতে আয়, আমি আর বেশি দিন বাঁচব না’, ‘আব্বা বালি চল’, ‘আর্থিক সংকট’, ‘তার নিষেধ না শুনে পারলাম না’, ‘একুশ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি’, ‘বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব’, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখেছে, এখানে নামাজ পড়তেই হবে’, ‘পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু’, ‘কলম ফেলে দিন। লাঠি, ছোরা চালান শিখুন’- প্রভৃতি কথার মধ্যদিয়ে তার স্মৃতিকথা সবিস্তারে লিখে গেছেন। প্রতিটি রোজনামচায় তারিখ এবং বার উল্লেখ করেছেন।
রোজনামচা পড়তে গিয়ে পাঠক বঙ্গবন্ধুর মার্জিত রসবোধের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত না হয়ে পারবেন না। সুযোগ পেলেই তিনি ব্যঙ্গ, বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের মধ্যে যোগসাজশ লক্ষ করে বঙ্গবন্ধু ‘ইন্দোনেশিয়াকে পাকিস্তানের আপন মায়ের পেটের ভাই’ বলে অভিহিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—‘পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার লোকের অভাব হলো না, যারা সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থরক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই।’ (পৃষ্ঠা: ১১২, ২০ শে জুন ১৯৬৬, সোমবার)। এছাড়া পরগাছা রাজনীতিবিদ, জেলখানার কয়েদিদের সমান অধিকার, ছাত্রলীগের প্রতি উপদেশ জানিয়ে অনেক কথা বলেছেন।
রাজনীতির বাইরেও বঙ্গবন্ধু যে সংবাদপত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তা তার লেখাতেই বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন, ‘মানিক ভাইকে যেখানে রেখেছে, সেখান থেকে খবর আনা খুবই কষ্টকর। এত বড় আঘাত পেলাম তা কল্পনা করতে বোধ হয় অনেকেই পারবে না। প্রথম থেকেই এই কাগজের (ইত্তেফাক) সাথে আমি জড়িত ছিলাম।’ জেলখানায় কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাকে। তবু তার লেখায় কৌতুকবোধের অভাব হয়নি। তাই রোজনামচায় বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের কষ্টের পাশাপাশি রসবোধের পরিচয়ও পাবেন পাঠক। কেননা তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার অবস্থা হয়েছে, ‘পর্দানসিন জানানা’র মতো কেউ আমাকে দেখতেও পারবে না, আমিও কাউকে দেখতে পারব না। কেউ কথা বলতে পারবে না, আমিও পারব না।’’ প্রায় তিন বছর এক দুঃসহ কারা নির্যাতন ভোগের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তিনি। প্রবল মানসিক শক্তির জোরে এই অসম্ভবকে তিনি সম্ভব করেছেন।
কারাজীবনে সীমাহীন শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, কষ্টের শিকার হয়েছেন তিনি। অপমান, অবহেলাও কম সহ্য করেননি। কিন্তু বন্দি থাকাকালীন তার সংসার, সন্তান, সহধর্মিনীর জীবন কতটা কষ্ট, দুর্বিষহ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে পার করেছেন, তা এই আত্মজীবনী ও রোজনামচা পড়ে কিছুটা অনুধাবন করা যায়।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নানা সময়ে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে। আন্দোলন, সংগ্রাম, জনগণ, দেশ ছাড়া তার ভাবনার জগতে আর কিছু ছিল না। ফলে তিনি যোগ্য সহধর্মিনী পেয়েছিলেন বলেই অখণ্ড মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন দেশ ও জাতির জন্য। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে অগণিত স্থানে তার সহধর্মিনীর প্রতি গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতার উল্লেখ রয়েছে। বেগম মুজিবের রাজনেতিক পরামর্শ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করেছেন এমন দৃষ্টান্তও কম নয়।
আত্মজীবনীতে তিনি সন্তানদের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনাকে, অন্যদিকে রোজনামচায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেছেন রাসেলকে। শিশু রাসেলের আদর-আবদার বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রকাশিত রচনায় জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার প্রতি একটু বেশি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সেটাও হয়তো স্বাভাবিক।
পৃথিবীতে যত আত্মজীবনী বা দিনলিপি প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে নিঃসন্দেহে বই দুটি ব্যতিক্রম। এখানে কল্পনার আশ্রয় নেই। পাঠককে আপ্লুত করার কৌশল নেই। নিরেট একজন মানুষের কষ্টে যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে—একজন নিয়মিত লেখক না হয়েও বঙ্গবন্ধু এক অমূল্য সম্পদ আমাদের জন্য রেখে গেছেন। কারণ বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্বের দিনলিপি এই বই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমূল্য উৎস। বাঙালির জাগরণের দলিল। বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন।