স্বাধীনতা, এই শব্দটির সঙ্গে মানুষ তার নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষমাত্রই আকাঙ্ক্ষা থাকে স্বাধীনতার। সীমাহীন নীলিমায় ওড়ার। আর এই স্বাধীনতা যদি হয় রক্তের বিনিময়ে, অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে তাহলে তার স্বাদটাও পাল্টে যায়। তখন এই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে আরও বেশি অর্থবহ। অনেক বেশি আনন্দের উপলক্ষ। পলাশীর প্রান্তরের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে আমাদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও সেই স্বাধীনতা ফিরে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অনেক সংগ্রাম, লক্ষ মানুষের রক্ত, নানা বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস পেছনে ফেলে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখা পাই স্বাধীনতার। এর মাঝে আমাদের পার করতে হয় দুইটি দেশের শাসন এবং শোষণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইংরেজের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানী শাসনের ভূত। তাদের তাড়াতে, কাঁধ থেকে নামাতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ২৫ বছর। এর মাঝের ইতিহাস শুধুই অপ্রাপ্তি, হতাশা, আর শোষণের। এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ শুরু হয় ১৯৭১-এ। মুক্তিপাগল বাঙালী পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষ প্রাণ আর হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। আমাদের সব মানুষের প্রিয় শব্দ এটি।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ গৌরব ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। একটি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই জড়িয়ে থাকে দেশের শিল্প ও সাহিত্য। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও জড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে মর্যাদার সঙ্গেই শিল্প-সাহিত্যে তুলে ধরায় অংশ নিয়েছেন আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের রচনার মাধ্যমে। সাহিত্য ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। সময়ের ধারাবাহিকতায় সাহিত্যে বিভিন্ন উপাদান, অনুষঙ্গ জারিত হয়ে উপস্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির পরবর্তী অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকেই আমাদের সাহিত্য স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য মণ্ডিত হয়ে উঠতে থাকে। এই পটভূমিকায় ১৯৭১-এ সদ্য স্বাধীন দেশের সাহিত্যে প্রভাব ফেলতে থাকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের সাহিত্যের উৎকর্ষে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখে মুক্তিযুদ্ধ। তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী নিয়ে নানা ধরনের সাহিত্যসৃষ্টির প্রবণতা। আর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন পর্যন্ত সাহিত্যসৃষ্টিতে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামশীলতা, দেশপ্রেম, আÍত্যাগ, বীর্যবত্তা ইত্যাদি গুণের পরিচয় বিধৃত হয়ে সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা ক্রমেই স্বমহিমায় অবয়ব লাভ করেছে। তাই বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
দুই.
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে রচিত হয় বেশকিছু প্রবন্ধ-স্মৃতিকথা জাতীয় বই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- এমআর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’, শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’, সেলিনা হোসেনের ‘একাত্তরের ঢাকা’, এমএসএ ভূঁইয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’, মেজর রফিকুল ইসলামের ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, রফিকুল ইসলামের (বীরউত্তম) ‘লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে’, কাজী জাকির হাসানের ‘মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, হেদায়েত হোসেন মোরশেদের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম,’ ‘ঢাকায় গেরিলা অপরাশেন’, রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’। পান্না কায়সার সম্পাদিত ‘হৃদয়ে একাত্তর’।
তিন.
সাহিত্যে সবচেয়ে বড় ক্যানভাসে কাজের মাধ্যম উপন্যাস। ভারত ভাগের পর থেকেই আমাদের উপন্যাস সাহিত্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জনের পথে অগ্রসর হয়। এ ধারায় আমাদের ঔপন্যাসিকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত, বিপুল বিষয় নিয়ে উপন্যাস রচনায় হাত দেন। সম্ভাবনাময় এই শাখায় প্রথমেই রয়েছে আনোয়ার পাশার ’রাইফেল রোটি আওরাত’। উপন্যাসটির রচনাকাল মুক্তিযুদ্ধের সময়। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানীদের বর্বরতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। নায়ক সুদীপ্ত শাহিন। তার জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ¡ কাটিয়ে এক সময় অংশ নেয় মুক্তিযুদ্ধে। তাকে সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অনেকসময় সম্পর্কহীন বলেই মনে হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বসে লেখা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রথম উপন্যাস হিসেবে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস চারটি। এগুলো হচ্ছে- ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘দুই সৈনিক,’ ’জলাঙ্গী’। শওকত ওসমানের চারটি উপন্যাসের কোনটিতেই মুক্তিযুদ্ধের আনুপূর্বিক ইতিহাস উঠে আসেনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের খণ্ডচিত্র এঁকেছেন তার উপন্যাসে। তার ‘জলাঙ্গী’ উপন্যাসে উঠে এসেছে এক ভীরু মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করার চেয়ে তার কাছে প্রেমই বড়। অন্যদিকে ‘নেকড়ে অরণ্য’ উপন্যাসে তিনি তুলে এনেছেন হাজী মখদুম মৃধা নামের এক রাজকারের দালালি এবং তার বিপর্যয়ের কাহিনী। এখানে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে কাহিনী এগিয়ে যায়নি। আবার তার ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অত্যাচারের চিত্র। সেই সঙ্গে পাকিস্তানীদের বর্বরতা, মানুষের অসহায়তা এবং আমাদের প্রতিরোধের চিত্র এঁকেছেন। তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, শওকত ওসমানের কোন উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধের অখণ্ড চিত্র উঠে আসেনি। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা লেখা তার এই চারটি উপন্যাসেই যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে তাতে আমাদের যুদ্ধদিনের সম্পর্ণ চিত্র নেই।
শওকত আলীর উপন্যাস ‘যাত্রা’, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। সেলিনা হোসেন তার ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস- এ তুলে ধরেছেন একাত্তরের গ্রামীণ জীবনের চিত্র। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ি তার একমাত্র সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গ করে। শহর থেকে দূরের এক গ্রাম হলদী গাঁয়ের মেয়ে বুড়ি এই উপন্যাসে হয়ে উঠেছে একাত্তরে সন্তানহারা হাজার মায়ের প্রতীক। রশীদ হায়দারের উপন্যাস ‘অন্ধ কথামালা’, আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’, আল মাহমুদের ’উপমহাদেশ’, শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, মাহমুদুল হকের উপন্যাস ‘খেলাঘর’, আবুবকর সিদ্দিকের উপন্যাস ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’। এই উপন্যাসে আবুবকর সিদ্দিক মূলত তুলে এনেছেন পারিবারিক অশান্তি। ঘটনাচক্রে উপন্যাসের সময়কাল উনিশ শ’ একাত্তর। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস ‘ফেরার সূর্য’, আবু জাফর শামসুদ্দিনের উপন্যাস ‘দেয়াল’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, ‘সৌরভ’, রফিকুর রশীদের উপন্যাস ‘দাঁড়াবার সময়’, ‘ছায়ার পুতুল’। রফিকুর রশীদের ‘দাঁড়াবার সময়’ উপন্যাসের কাহিনীতে উঠে এসেছে যুদ্ধ-উত্তর সময়। স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা, মালেক যে রাজনীতির কূটকৌশল আয়ত্ত করতে না পারার কারণে নানা রকম ষড়যন্ত্রের শিকার। যুদ্ধ-উত্তরকালে একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন সংগ্রামের কাহিনী দাঁড়াবার সময়। আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ঘেরাও’, হারুন হাবীবের ‘প্রিয়যোদ্ধা’, বরেন চক্রবর্তীর ‘ক্রান্তিকাল’, ‘মুক্তি উপাখ্যান’, ‘তামস’। ‘বরেন চক্রবর্তীর ‘তামস’ বাংলাদেশের বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতার আলোকে ফিরে দেখা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। এই উপন্যাসের নায়িকার মধ্যে আমরা দেবী চৌধুরানীর মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখতে পাই। এখানে রোমান্টিকতার পাশাপাশি সামজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম ও চেতনা ও মূল্যবোধের বিষয়টি উঠে এসেছে। সোনালী ইসলামের ‘চৈত্র থেকে পৌষ’, মুহম্মদ আনোয়ার আলির ‘একাত্তরের দুঃখগাঁথা’ উল্লেখযোগ্য। মুুহম্মদ আনোয়ার আলির একাত্তরের দুঃখগাঁথা উপন্যাসে দেখা যায়থ বাঙালী মাত্রই ভেতো আর ভীতু। এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে একাত্তরে গোটা জাতি পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপন্যাসের নায়ক নবীরদ্দিও যুদ্ধে যোগ দেয়। সামান্য দিনমজুর যুবক হলেও পাকিস্তানী দালাল, রাজাকার, আর অসহ্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে চায়নি। তাই সেও লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়। অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে নবীরদ্দিরা দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও সে পায় না তার মনের মানুষ ছলিমনকে আর পায় না স্বাধীন দেশের নিজের গ্রামে বসবাসের সুযোগ। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র জমা দিলেও রাজাকার আলবদরদের হাত থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে স্বাধীনতার পর এসব রাজাকারের দ্বারা গুপ্তহত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভিটেমাটি ছাড়তে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। রাজাকার-আলবদরা হয়ে ওঠে অঢেল সম্পদের মালিক, আর মুক্তিযোদ্ধারা হতদরিদ্রই থেকে যায়। এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে একাত্তরের দুঃখগাঁথা উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্য অনেক উপন্যাসের চেয়ে এখানেই এ উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্য।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় জীবনে এত বড় ঘটনা আর নেই। একটি জাতির স্বাধীনতা তার সব থেকে বড় পাওয়া। আমাদের সেই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। আমাদের লেখকদের অনেকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় জীবনে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন লালন করে সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সেই চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন সর্বার্থে কোন উপন্যাসেই উঠে আসেনি। খুব বড় কোন ক্যানভাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলো রচিত হয়নি। আবার অনেক বড় ক্যানভাসের মক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে ইতিহাসের বিকৃত রূপ কোথাও বা খণ্ডিত অংশ উপস্থাপিত হয়েছে। যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এসব উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়নি। আবার কোন কোন উপন্যাসে ঘটনাচক্রে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের ভেতর দিয়ে উঠে আসা জীবন এগুলোর অনেক উপন্যাসের বিষয় নয়। তাই সত্যিকার অর্থেই আমাদের স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় আমরা কোন মহৎ উপন্যাসের দেখা পাইনি।
চার.
মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় লেখা আমাদের ছোটগল্পের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, আর তা হলো আমাদের ছোটগল্পের লেখকরা বেশিরভাগই উপন্যাসিক। বেশ কয়েকজন কবিও লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে গল্প। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্যথ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইনকোট, অপঘাত, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর দিন ফুরানোর খেলা, আমৃত্যু আজীবন, মুক্তিযোদ্ধারা, আবু রুশদের খালাস, আলাউদ্দিন আজ আজাদের ‘স্মৃতি তোকে ভুলবো না’, আবু ইসহাকের ‘ময়না কেন কয় না কথা’, আবদুশ শাকুরের ‘ইশু’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কালিমদ্দি দফাদার’, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের ‘অল্পরী’, আমজাদ হোসেনের ‘কারবালার পানি’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ব্ল্যাক আউট’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, ইমাদাদুল হক মিলনের ’লোকটি রাজাকার ছিল’, ইমতিয়ার শামীমের ‘মৃত্তিকা প্রাক-পুরাতান’, জাহানার ইমামের ’রায়বাগিনী’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘আমৃত্যু’, ‘আজীবন’, জুলফিকার মতিনের ‘খোঁজা’, নাসরীন জাহানের ‘বিশ্বাস খুনি’, পূরবী বসুর দুঃসময়ের ‘অ্যালবাম’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘মাধবপুরে’, ‘পৌষের আকাশে’, বশীল আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, বুলবুল চৌধুরীর ‘নদী জানে’, মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’, মোহাম্মদ রফিকের ‘গল্প, কিন্তু সত্য নয়’ ইত্যাদি।
আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেথ বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’, শওকত ওসমানের ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, সৈয়দ ইকবালের ’একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’, রাহাত খানের ’মধ্যিখানের চর’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’, ‘উনিশ শ’ একাত্তর’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া’, ‘আমি এবং জারমান মেজর’, মইনুল আহসান সাবেরের কবেজ লেঠেল, ভুলবিকাশ, রশীদ হায়দারের কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা। কায়েস আহমেদের আসন্ন, মাহমুদুল হকের কালো মাফলার, জহির রায়হানের সময়ের প্রয়োজনে, মামুন হুসাইনের মৃত খড় ও বাঙাল একজন, শামসুদ্দীন আবুল কালামের পুঁই ডালিমের কাব্য, আমজাদ হোসেনের উজানে ফেরা, সত্যেন সেনের পরিবানুর কাহিনী, মঞ্জু সরকারের শান্তি বর্ষিত হোক, শওকত আলীর সোজা রাস্তা, আকাল দর্শন, কায়েস আহমেদের আসন্ন, হুমায়ুন আজাদের যাদুকরের মৃত্যু, সুচরিত চৌধুরীর নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত, রিজিয়া রহমানের ইজ্জত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পাঁচ.
নাটক সাহিত্যের অন্যতম একটি মাধ্যম। দৃশ্যকাব্য নামে পরিচিত এই মাধ্যমটিতেও উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এ পর্যায়ে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় মমতাজউদদীন আহমদের নাম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তার রচিত নাটকগুলো হচ্ছে- স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণচোর, বকুলপুরের স্বাধীনতা, বিবাহ, কি চাহ শঙ্খচিল, জিয়া হায়দারের সাদা গোলাপে আগুন, নীলিমা ইব্রাহিমের যে অরণ্যে আলো নেই, আলাউদ্দিন আল আজাদের নিঃশব্দ যাত্রা, নরকে লাল গোলাপ, সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, রণেশ দাশগুপ্তের ফেরী আসছে উল্লেখযোগ্য। এই নাটকগুলো মঞ্চনির্ভর এবং এর অনেকগুলোই মঞ্চ সফল নাটক। এই নাটকগুলোর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা, এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের ঘৃণিত ইতিহাস এবং বাঙালীর ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ধারায় হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন টেলিভিশন নাটক।
ছয়.
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী আমাদের শিশুসাহিত্যের বিকাশ লাভ করে তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে। এখানেও ঘটে রূপান্তর। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা হয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, উপন্যাস, গল্প, ছড়া। ছড়া আমাদের শিশুসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ছড়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সাহিত্যে জীবনের সূত্রপাত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে ছড়া সাহিত্যেও। এক্ষেত্রে অগ্রণী ছড়াকারদের মধ্যে রয়েছেন সুকুমার বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, লুৎফুর রহমান রিটন প্রমুখ। সুকুমার বড়ুয়ার ছড়ায় যেমন ধরা পড়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তেমনি উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়-
সাগর তীরে পথের ধারে
ঝুপড়ি দালান হাট বাজারে
থানায় থানায় জেলায় জেলায়
নদীর জলে- বনের কাছে
মুক্তি সেনার রক্ত রেখা
সাক্ষী আছে সাক্ষী আছে।
গর্ত ছেড়ে সাপের ছানা
কোন সুযোগ দিচ্ছে হানা
মীরজাফরের প্রেতাÍারা
কিসের জোরে কোথায় নাচে?
সাক্ষী আছে সাক্ষী আছে।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিতে
রক্ত দলিল পুড়িয়ে দিতে
ফন্দি করে আবার কারা
নকশা বানায় নতুন ধাঁচে?
তন্দ্রাহারা বীর বাঙালীর
বুদ্ধি বিবেক সাক্ষী আছে।
(সাক্ষী আছে : সুকুমার বড়ুয়া)
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন- শাহরিয়ার কবির, হুমায়ূন আহমেদ, মাহমুদুল হক, আবু কায়সার প্রমুখ।
সাত.
সাহিত্যের প্রধান শাখা চারটি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। সাহিত্যের অন্য তিনটি শাখার চেয়ে কবিতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন সবচেয়ে বেশি। কবিরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতটা আলোড়িত, ততটা অন্যরা নন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায়, প্রেক্ষাপটে যত কবিতা লেখা হয়েছে অন্য শাখায় সে তুলনায় আমাদের প্রাপ্তি সামান্যই বলতে হয়। এর কারণ হয়তো এই যে, আমাদের অনেক কবিই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে। যার প্রভাব পড়েছে তাদের রচনায়। আবার যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি না গিয়েও শক্র পরিবেষ্টিত দেশে ভয়ার্ত সময়ের মাঝে পার করা কবিরাও তাদের আশা-আকা´খা তুলে এনেছেন কবিতায়। স্বাধীনতার জন্য মানুষের আর্তি ধরা পড়ে শামসুর রাহমানের কবিতায়-
তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
. . . রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
(তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা : শামসুর রাহমান)
স্বাধীনতার জন্য বাঙালী জীবনের যে আকুল আকাঙ্ক্ষা, আর্তি তা যেমন ধরা রয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। তেমনি যুদ্ধসময়ের বাংলাদেশে, সেই ভয়াল একাত্তরে যারা এই বন্দি শিবিরে ছিলেন, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় যাদের বুক কেঁপে উঠেছে সেই চিত্র ধরা রয়েছে-
কখনও নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা;
মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।
বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;
মনে হয়, স্বাধীনতা-লখিন্দর যেন,
বেহুলা-বিহীন
জলেরই ভেলায় ভাসমান।
(সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিন-রাত্রি : শামসুর রাহমান)
একাত্তরে স্বাধীনতা এই শব্দটি ছিল বাঙালীর প্রথম চাওয়া। পরাধীতার শৃ´খল ছিঁড়ে পৃথিবীর বুকে নতুন মানচিত্র তৈরির জন্য সেদিন বাংলার কামার, কুমার, জেলে, তাতী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা সবাই হাতে হাত বেঁধেছিল। সবার বুকে-মুখে ছিল এক আশা। এক স্বপ্ন- স্বাধীনতা। সেই শব্দটিই আমাদের কবিদের অনুপ্রেরণা হয়েছে-
শুনেছি তোমার নামে, ঘাটের মগার করোটিতে
তরঙ্গ সঙ্গীত রচে, ঝিনুকে মুক্তোর ভাঙে ঘুম,
বিষুবরেখার স্বপ্নে শর্বরী হারায় বেমালুম,
নিস্তব্ধ কবরে সূর্য সোচ্চার আলোক থাকে দিতে,
(স্বাধীনতা : দিলওয়ার)
এছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীনতার মহান নেতা, মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা, পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা, ধর্ষিত রমণীর আহাজারি, সন্তানহারা মায়ের আকুতি, যুদ্ধে যাওয়া সন্তানের জন্য শুভকামনা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, স্বাধীনতার শপথ সবই উঠে এসেছে আমাদের কবিতায়।
হঠাৎ চব্বিশটি রক্তাক্ত দেহ-রমণী, শিশু, যুবক, প্রৌঢ়-
আমরা দেখতে পাই এক মুহূর্তের জন্যে,
রক্তাক্ত এবং লুণ্ঠিত,
দ্বিতীয়বার আর নয়,
রক্তাক্ত, লুণ্ঠিত এবং প্রাণহীন-
দেয়ালের পায়ের কাছে চত্বরে তারা শুয়ে আছে।
(অন্তর্গত : সৈয়দ শামসুল হক)ট্রিগারে আঙুল রেখে, পুনর্বার, বুঝে নিতে চাই
অধিনায়কের কণ্ঠে উচ্চারিত গাঢ় শব্দাবলি,
শপথ-প্যারেডে : ’তোমাদের মনে রাখা প্রয়োজন
এই যুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ; বিশ্বাসঘাতক নয়, আজ
সৌন্দর্যের প্রকৃত প্রেমিক চাই; তোমাদের কাজ
নয় মোটে সাহজিক। আনন্দের রক্ষণাবেক্ষণ
অত্যন্ত দুরূহ নয়, আজীবন সপক্ষে লড়াই।’
জলপাই-রঙ ইউনিফর্মে, সবুজাভ হেলমেটে,
স্বয়ংক্রিয় আস্ত্রে সজ্জিত সৈনিক আমি, কর্মরত।
সৌন্দর্যের রাজধানী ঘিরে অসংখ্য বিরোধী বীর
অবস্থান নেয়, সুবিধাজনকভাবে একচোটে
আছে যার শিল্পরুচি, তাকে প্রয়োজন- ব্যক্তিগত
কিংবা সার্বজন্য হরিষে বিষাদেথ যে জন সুস্থির।
(সৌন্দর্য- সৈনিকের শপথ প্যারেড : রফিক আজাদ)স্টেনগানের প্রতিটি ঝলকে বাজাল উজ্জ্বল সুর
শৈশবের বল ছুঁড়লো গ্রেনেডে, অকম্পিত সঙ্গিন
বিঁধলো শক্রর দেহ। আমার নিজের ভাই
বড় বেশি ভালো সে বাসতো স্বাধীনতা
জননীর নিষেধ মানেনি, পিতার অবাধ্য হয়েছিল
পতাকার রক্তিম সাহস তাকে ডাক দিল
স্বদেশের ছবি রক্তে, ঝাঁপ দিল স্বদেশের নামে।
আমার কিশোর ভাই, প্রিয় ছিল স্বাধীনতা
স্লোগানে উত্তাল হত খুব। দর্পিত বাতাস
তাকে ডাক দিল, স্টেনগানে বাজাল সংগীত।
(আমার ভাই : হুমায়ুন কবির)স্বাধীনতা আর তুমি থেকো না এমন শব্দহীন
সাধ্যাতীত দূরত্বে আমার
সহসা গভীর রাতে বৃষ্টিপতনের মতো বেজে ওঠো,
ছুঁয়ে যাও আমার শরীর
তুমি হও ভূমিলগ্ন খুলে দিয়ে সমস্ত নিষেধ!
দণ্ডিত বালক যেন অনায়াসে ছুঁতে পারে তোমাকে এখন
নেড়ে-চেড়ে সহজে দেখতে পারে নিষিদ্ধ খেলনা তার
তোমাকে রেখেছে সেই কবে থেকে অন্তরালে, অদৃশ্যে আমার
হে আমার স্বাধীনতা তোমার স্পর্ধিত হাতে
খুলে ফেলো যেখানে রয়েছে লেখা অনন্ত নিষেধ।
(স্বাধীনতার প্রতি : মহাদেব সাহা)শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালো তার অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
(স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো : নির্মলেন্দু গুণ)
আট.
যে কোন জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জনের পেছনে থাকে আবেগ-উচ্ছ্বাস। সাহিত্যেও এর ব্যতিক্রম নয়। আবেগ-উচ্ছ্বাস কমে এলেই তখন মহৎ রচনা সম্ভব হয়। আমাদের সাহিত্যে কবিতা, নাটক, উপন্যাস সবখানেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখ করার মতো অনেক কাজ হয়েছে। বিশেষত কবিতায় এ ধারার প্রকাশ লক্ষ্য করার মতো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, আমাদের গৌরবময় এই অধ্যায় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বিশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তর দশকের কবি-সাহিত্যিকরা। পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের অনেক কবি-সাহিত্যিক সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশও নিয়েছিলেন। তাদের সেই অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাদের কলমে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দশক আমাদের সত্তর দশকের কবি-সাহিত্যিকরাও তাদের লেখায় তুলে এনেছেন বিজয়ের গৌরবগাঁথা। আবার একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের দ্বিধা- পরাজিত শক্তির ফিরে আসা- জাতির পতাকায় তাদের হিংস্র ছোবল কোনকিছুই এই দশকের কবি-সাহিত্যিকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তারা নানাভাবে আমাদের সাহিত্যে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। তবে এই ধারা থিতিয়ে আসে আশির দশক থেকেই। এরপরের আরও দুটি দশকথ নব্বই এবং শূন্য। এ সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন বড় মাপের কাজ তো দূরের কথা, আমাদের সাহিত্যে এ সময়ের লেখকদের লেখায়, চিন্তায়-চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এর কারণ হয়তোবা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের- আমাদের জাতীয় জীবনের সবেচেয়ে গৌরবের বিষয়টিকে কালিমালিপ্ত করে ফেলা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করে তোলা হয়েছে বিতর্কিত। ব্যক্তিস্বার্থে এবং পরাজিত শক্তির অপ্রচারের জোয়ারে একদা কোণঠাসা হয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারেনি স্বাধীনতার বার্তা। আর পক্ষ-বিপক্ষের মাঝে পড়ে নতুন প্রজন্ম, এই গ্লোবালাইজেশনের সময়ে এক ছাতার নিচে পৌঁছার ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের যোগ্য করে তোলার লড়াই ভুলে ছিল জাতির ইতিহাস, পেছনের গৌরবগাঁথা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যা রচিত হয়েছে তাতে মহৎ কোন রচনার দেখা আমরা পাইনি। পাইনি কোন বড় ক্যানভাসের সর্বজন গ্রাহ্য সাহিত্যকর্ম। গড়ে ওঠেনি কোন মহৎ উপন্যাস, যা হয়েছে তাতেও অনেক সময়ে সত্যিকার ইতিহাসের চেয়ে কোন দলের মতবাদ প্রচারের দিকেই নজর দিয়েছেন অনেক ঔপন্যাসিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলনও এসব অনেক রচনাতেই নেই, যা আছে তা খণ্ডিত, অনেকক্ষেত্রে বিকৃত, একদেশদর্শী।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে এখনও অনেক কাছের একটি বিষয়। আবেগের স্থিতি এখনও কমেনি অনেকক্ষেত্রেই। তাই সাহিত্যিকরাও এর বাইরে আসতে পারছেন না। হয়তো আরও, আরও কয়েক দশক পারথ যখন থিতিয়ে আসবে সব আবেগ, যখন সকল বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। গবেষণায় উঠে আসবে সকল মিথ্যা এবং ভ্রান্তির জাল। তখন হয়তো নতুন কোন সাহিত্যিকের হাতে রচিত হবে মহৎ কোন সাহিত্যকর্ম। যাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের, আমাদের গৌরবের, আমাদের প্রিয় স্বাধীনতার প্রতিফলন হবে।