পার্থিব জগতে মানুষই সৃষ্টি করে অজস্র শিল্প। মানুষ ও শিল্প একটি আরেকটির পরিপূরক অবস্থায় বিরাজমান। এছাড়া শিল্প মানুষেরই উৎপাদন। এই উৎপাদনের পথ ধরে মানুষ তার নতুন এক জগতে হেঁটে চলে অবিরাম। যেখানে মানুষ তার চিন্তার উপস্থাপন ঘটাতে পারে। কিন্তু এই উপস্থাপন কার জন্য? সে তো মানুষের জন্যই। এ জন্য চাই, মানুষের মাঝে মানুষের অধিকার।
বিশ্বব্যাপী বিশ শতকীয় মার্কসবাদের উত্থান বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিবিধ ব্যঞ্জনা। মার্কসবাদে প্রভাবিত বাঙালি কবি-লেখকদের রচনায় চেতনে-অবচেতনে প্রকাশিত হয়েছে মার্কসীয় সাম্যবাদ। পৃথিবীজুড়ে লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক শিল্প-আন্দোলন ও সমকালীন নানা তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ। যুগধর্ম ও সমকালের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো লেখকের চিরকালীন বৈশিষ্ট্য। অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার কারণেই সাম্যবাদী ধারণার উন্মেষ ঘটেছে। এছাড়া আদিম সাম্যবাদী ধারণায় দেখা যায় যে, মার্কসবাদীদের মতে, মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগঠনের রূপ ছিল যৌথ এবং সাম্যবাদী। জীবন রক্ষার জন্যে উৎপাদনের উপায়গুলো তখনো খুবই অনুন্নত। উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক ছিল অপরিহার্যরূপে সামাজিক ও সমষ্টিগত। উৎপাদিত বা সংগৃহীত খাদ্য সম্পদের ভোগও ছিল সমষ্টিগত। কালক্রমে এই সাম্যবাদী ধারণা বজায় রাখা যদিও কঠিন হয়ে পড়ে। তখনই আদিম সাম্যবাদী সমাজের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসে দাসসমাজের ভ্রূণ। এ প্রসঙ্গে দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ভাষ্য হচ্ছে, ‘সত্যযুগে সর্বাধিক বিকাশপ্রাপ্ত দাসপ্রথার প্রথম উন্মেষ থেকেই শোষক ও শোষিতে সমাজে শ্রেণীভেদ ঘটে। পরিণামে আদি সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে সেখানে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উদ্ভব ঘটেছিলে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে আবার রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সৃষ্টি হয়েছিলে’। এঙ্গেলস অবশ্য ইতিহাসের যুক্তি বিচার করে বলেছেন যে, প্রাচীন যুগে রাষ্ট্র ছিল ক্রীতদাস দমনের জন্য দাসমালিকদের রাষ্ট্র, যেমন সামন্ততন্ত্রী রাষ্ট্র ছিল ভূমিদাস ও পরাশ্রিত কৃষকদের বশে রাখার জন্যে অভিজাতদের সংস্থা এবং আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্র পুঁজিকর্তৃক মজুরিশ্রম শোষণের হাতিয়ার। কিন্তু সাম্য, সাম্য শব্দটি এখন একটি সামাজিক ও আইনগত ধারণা। আইনানুগভাবে সমাজে সবার সমান অধিকার ও সমান সুযোগ থাকবে—এটাই সাম্যের প্রকৃত অর্থ। অর্থাৎ সাম্যের সাধারণ অর্থ হলো সমতা। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণা মতে, সাম্য অর্থ সব বিষয়ে সমতা বা অভিন্নতা বোঝায় না। সাম্য বলতে বোঝায় সবার ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার সমতা। লাস্কির মতে, সাম্যের অর্থ সবার সমান ব্যবহার বা একই কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিকই শুধু নয়, এর সঙ্গে ন্যায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এ ধরনের সমতা বা সমাবস্থা কখনো সঠিকভাবে প্রদর্শিত হতে দেখা যায়নি। মানব সভ্যতার প্রারাম্ভকাল থেকেই একদল আরেক দলকে শোষণ করে এসেছে। যা বর্তমান অবস্থায় এসেও অনেকটাই বিরাজমান। এভাবে একে অন্যের দ্বারা শোষিত ও বঞ্চিত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কখনো প্রতিবাদ বা কখনো প্রতিরোধ ও হানাহানির পর্যায়ে আমূলিত হয়েছে। এজনই মানুষের মাঝে সদ্ভাব, সম্প্রীতি ও মৈত্রিবন্ধন রচনার জন্যে যুগে যুগে নানা মনীষী সাম্যের কথা বলেছেন। একটি বৈষম্যহীন ও শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্রেকাঠামোর পরিকল্পনা করে মনীষীগণ মানুষের মুক্তি কামনা করেছেন। ইতিহাসে তাঁকে ‘ইউটোপিয়ান’ সমাজতন্ত্রী নামে অভিহিত করেছে। কারণ ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে এমন কিছু গ্রন্থ রচিত হয়েছিল সেগুলোতে সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার নানাচিত্র ফুটে উঠেছিলে। এরপর ১৮৪৮ সালে কাল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ প্রকাশিত হওয়ার পর সাম্যবাদী চেতনার জগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে।
বহু সময় অতিক্রমণের পর ১৯১৭ সালে মার্কসীয় তত্ত্বের আলোকে ভ্লাদিমির ইনিচ লেনিনের নেতৃত্বে অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নে দুনিয়ার প্রথম বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। কার্ল মার্কস নির্দেশিত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র যখন ধীরে ধীরে বিকশিত হবে, তখন তা রূপ নেবে সাম্যবাদী সমাজে। যেহেতু মার্কস সমাজতন্ত্রের ভেতর দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিজ্ঞানভিত্তিক সাম্যবাদে উত্তরণের প্রক্রিয়া নির্দেশ করেছেন, সেহেতু তাঁর মতবাদকে আমরা বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ বলে অভিহিত করতে পারি। এছাড়া কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস শুরু থেকেই অভিমত জ্ঞাপন করেছিলেন যে, সাম্যবাদী বিপ্লব হবে বিশ্ববিপ্লব এবং তার রঙ্গভূমি হবে সারাপৃথিবী। মূলত তারই ফলে, বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী চেতনাকে ইঙ্গিত করেই বিশ্বসাহিত্যে সাম্যবাদী ধারনার উন্মেষ ঘটে। আবার এরই ধারাবাহিকতায় আধুনিক বাংলা কবিতায় সাম্যবাদী ধারণার সূত্রপাত হতে দেখা যায়। বাংলায় সাম্যবাদী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনাপর্ব থেকেই এর সঙ্গে লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সংযোগ সাধিত হয়েছিল। একদিকে গণমানুষের জন্য পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, অন্যদিকে সেই মুক্তির মন্ত্রকে গ্রহণীয় ও সাধারণবোধ্য করার জন্যে সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রচারণা শুরু হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের চেতনা বিশ্বে যে নতুন সমাজপ্রবাহের সৃজন ঘটিয়েছিলে, সেই চিন্তাস্রোতের মানবিক আকুতি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ফ্যাসিবাদীদের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। সেই সময় ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক দলিল এ স্বাক্ষর দেন। বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদী চেতনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অনেকটা স্মরণীয়। এরপর তেজদীপ্ত উচ্ছ্বাস আর বিপ্লবী মন্ত্র নিয়ে কবিতায় বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেই সময় অর্থাৎ বিশের দশকে লেখক বুদ্ধিজীবীরা প্রকাশ করতে থাকেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—সংহতি, বিজলী, আত্মশক্তি, কল্লোল, কালিকলম, ধূমকেতু, নবযুগ, লাঙল, গণবাণী, নবশক্তি ও বঙ্গবাণী ইত্যাদি। এই সব পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সমাজের নীচতলার মানুষের জীবন যন্ত্রণার উদ্ভাসন উঠে এসেছিল। এরপর তিরিশ ও চল্লিশের দশক সময় ধরে সাম্যবাদী চেতনার উৎসারণ-এর ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে দেখা যায়। সেই সময় বিষ্ণু দে, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র, কামাক্ষী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দিনেশ দাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কবি বাংলা কবিতার ভুবনে মার্কসীয় চেতনার দ্বারা সাম্যবাদের জয়গান গাইলেন। এই সময় আবার বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা যেমন: অগ্রণী, অরণী, পরিচয়, প্রতিরোধ ও আকাল ইত্যাদি পত্র-পত্রিকা সাম্যবাদের চেতনায় কবিতা প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলে বলা যেতে পারে। এই সাম্যবাদী চেতনা বাংলা সাহিত্যের এমন অনেক কবিদের মধ্যে দেখা গেছে।
বাংলা কবিতায় সাম্যবাদী চেতনার সৃষ্টিশীলতা কেবল নিজ বাসভূমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীটাকেই করেছে সে তার উত্তরাধিকার—যেখানেই দেখা গিয়েছে মানুষের অধিকারের লুণ্ঠন সেখানেই উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। সৃষ্টিশীলতার বাঁধ ভেঙে উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদী বিদ্রোহের জয়ঢাক। একজন কবি সাম্যবাদী চেতনা ধারা উজ্জীবিত হবেন, এটা তার সামাজিক অবস্থানগত কারণেই অনেকটা হতে দেখা যায় এবং অনেক কবিরা হয়েছেনও তাই। বাংলা কবিতায় সে সব কবি সাম্যবাদী চেতনা ধারণ করে উদ্ভূত বাস্তবতাবোধ, মানবপ্রীতি ও নিগৃহীত মেহনতী মানুষের কথা তুলে ধরেছেন এবং কবিতায় সাম্যবাদী চেতনায় ঐক্যের সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছেন তাদের কবিতা নিয়ে এখানে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবে। যেমন—‘সকলের তরে সকলে আমরা/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ কবিতার উপর্যুক্ত এই লাইন দুটি আমাদের অবলীলায় সাম্যবাদের সহজ অভিব্যক্তি প্রকাশ হওয়ার কথা বলে দেয়। এভাবে রবীন্দ্রনাথকে আমরা সাম্যবাদী ধারণা নিয়ে কবিতা লিখতে দেখতে পাই। যদিও রবীন্দ্রনাথ সাম্যবাদী কবি নন। তবু বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ সাম্য চিন্তার উপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন এবং সাম্যের আলোয় নতুন যুগ ও জীবনের আবির্ভাব হবে এই চিন্তা তাঁর শেষ জীবনের সৃষ্টিগুলোর মাঝে বারবার প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। তাই তো তাঁর বেশ কিছু কবিতায় এর প্রমাণ মিলে। যেমন: পুরাতন ভৃত্য, দুই বিঘা জমি, এবার ফিরাও মোরে, ঐক্যতান, বাঁশি ও ওরা কাজ করে ইত্যাদি কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের সাম্যবাদী চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। তাঁর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার দুটি লাইন—‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উপেক্ষিত ও বঞ্চিত মানুষের যে উদ্ভাসন ঘটেছে সেটা রবীন্দ্রনাথের মানবিকতাবাদেরই ফসল। যা সাম্য চেতনার ধারা ভাবিত হয়ে আছে। তাই রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—’মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’। রবীন্দ্রনাথের পর কবিতায় যিনি সাম্যবাদের জয় ঘোষণা করলেন তিনি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সকল মানুষই মানুষ, কেউ কারও চেয়ে ছোট নয়। মনুষ্যত্বের মহিমাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। পৃথিবীতে বর্ণবাদ, ধনী-নির্ধন, উঁচু-নিচু, জাতিত্ব সংস্কার, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতির চেয়ে মানবতা ও মানব সত্যের স্থান অনেক ওপরে। এই মহাসাম্যের বাণী তাঁর কবিতায় প্রতিধ্বনিত হতে দেখা গেছে। তাই তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
সমান হউক মানুষের মন, সমান অভিপ্রায়,
মানুষের মতো, মানুষের পথ এক হক পুনরায়;
সমান হউক আশা অভিলাষ সাধনা সমান হোক,
সাম্যের গানে শান্ত ব্যথিত মর্তলোক।
এছাড়া তিনি তাঁর অনেক কবিতায় সাম্যবাদের জয়গান গেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম কবিতাগুলো হলো—সর্বংসহা, সাগি্নকের গান, সাম্যসাম, নষ্টোদ্ধার, মেথর, শূদ্র ও জাতির পাতি ইত্যাদি কবিতাগুলো তাঁর সাম্যবাদী চিন্তারই প্রতিফলন।
১৯২০ -এর দশকে বাংলা কবিতায় সাম্যবাদের চেতনা যেভাবে রেখায়িত হয় তা অহিংস বুর্জোয়া মানবতাবাদী দর্শনের মূলে আঘাত আনে। কার্ল মার্কসের বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী দর্শনের বাস্তব প্রয়োগের দৃষ্টান্ত সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে শ্রেণীসংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী কার্যকরণ সাহিত্যেও দানা বেঁধে ওঠে। মার্কসীয় সাম্যবাদের এই চেতনা তরুণদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই সাম্যবাদী চেতনায় উদ্ভুদ হয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী কবি হিসেবে যাকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে তিনি হলেন বিদ্রোহী ও আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মূলত তিনিই বাংলা কবিতায় বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী চিন্তার প্রয়োগ ঘটান তাঁর কবিতায়। নজরুলই একমাত্র কবি, যিনি প্রথম সাম্রাজ্যবাদী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। নিম্নোক্ত বর্ণনায় বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সাম্যবাদী কবিদের আলোকপাত করা হয়েছে তাঁদের সৃষ্ট শিল্পকর্মের ভিত্তিতে।
কাজী নজরুল ইসলাম
উনিশ শতকের রোমান্টিসিজমের রূপান্তরমূলক যে কাঠামো বিশ শতকের মর্ডানিজমের শরীরে, তারই মেঘ-ছায়াতলে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিভার বহিঃপ্রকাশে তৈরি হয়েছিল হর্ষঘেরা প্রবণতায়। একুশ শতকের প্রথম প্রহরে এখন যখন মর্ডানিজমের নামে শমিত ও দমিত, উত্তর আধুনিকতাবাদ যা-যা এড়িয়ে-মাড়িয়ে গেছে, ধুলো ঝেড়ে তুলে নিতে প্রস্তুত পুনর্বার, তখন নজরুলের চিন্তাজগতের দরজায় কড়া নড়ে ওঠে যেন অনিবার্যভাবে। হয়তো নজরুলের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাংলা কবিতায় বড় বেশি প্রয়োজন। জীবনানন্দ বলেছেন—‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।’ তাঁর সংশয়হীনতা, জাগ্রত মানুষের প্রতি প্রবল আস্থা আর অস্তিত্ব-ব্যক্তিত্বের মজবুত ভিত বাঙালি সমাজ ও সভ্যতায় সমূহ নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চারণ।
নজরুলের শুভবোধ আমাদের চিন্তাভুবনে তাই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করে চলে এক অনাবিল বিলোড়ন। আর আমরা যেন উদ্ভ্রান্তের মতো আশ্রয় খুঁজতে থাকি নজরুলের সাহিত্য দর্শনের, শিল্প দর্শনের ইতিবাচক প্রহরের বিস্তৃত পরিসরে। বিশেষ এক কালপর্বে নজরুল বিস্ময়কর প্রতিভা। দেশ-কালের সাথে তাঁর অন্তরাত্মার যে যোগাযোগ, সেই শক্তি তাঁকে কালান্তরে মহানায়কের ভূমিকায় আসীন করেছে। সমূহ অন্যায়-অবিচার আর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিপে তাঁর স্বভাবজ আবেগের স্পন্দন-বিলোড়নের অন্তরালে আন্তরসত্যে অঙ্গীকার ছিল সুদৃঢ়। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থার জন্য তাঁর আকাক্সা, বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে প্রহরে প্রহরে। ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’ আজ যেন আমাদের প্রাত্যহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে। এর আগে ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়’-এর মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকার বিশেষ (প্রথম) সংখ্যায় ‘সর্বপ্রধান সম্পদ-রূপে’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সাম্যবাদী গ্রন্থের কবিতাবলিতে ধর্ম-জাতি-সম্প্রদায়গত ভেদাভেদকে অতিক্রম করে মানবতাবাদী চেতনায় সাম্যবাদী প্রবণতাকে জায়গা করে দিয়েছেন নজরুল। কবির মতে, সব ধর্মের মূল বাণী হলো—মানুষ ও মানবতা। তাঁর ধারণা বিভেদ আর শ্রেণীবিভাজন করেছে মানুষ নিজেদের লাভের জন্য। তাই সমাজের কোলাহল থেকে সরে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের আকুলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি দারুণ আগ্রহ ও সাহসের সাথে। মানুষের জয়গান গেয়েছেন কবি দেশ-কাল-পাত্রের ভেদাভেদকে ছাড়িয়ে। লিখেছেন সে কথা—
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
…হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি…
মূর্খরা সব শোনো
মানুষ এনেছে গ্রন্থ; ন্থ আনেনি মানুষ কোনো!
(মানুষ:সাম্যবাদী)।
সাম্যবাদী জীবনের চেতনায় ঔপনিবেশবিরোধিতা এবং জাতীয়তাবাদ নজরুলের মধ্যে মহত্ত্বর বোধে চালিত হতে পেরেছে। নজরুল তাঁর কাব্যজীবনের প্রারম্ভ থেকেই হিন্দু-মুসলমানের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অভিন্ন বলয়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন। অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলন যখন কতকটা স্তিমিত, তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাতাস তীব্র হয়ে উঠল। নজরুল তখন বাঙালি জাতির সামনে নিয়ে এলেন মানবতাবাদের শাশ্বত বারতা। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’ তার ভাবনায় সমুন্নত ছিল মানবজাতির ঐতিহ্য। সাম্প্রদায়িক বিবাদ প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ। দাঙ্গায় যে উভয় সম্প্রদায়েরই দায় রয়েছে তা তিনি পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে অবলোকন ও উপলব্ধি করেছেন। মানবিকতা আর সহমর্মিতায় তাঁর চিন্তা আচ্ছন্ন ছিল সর্বদা। সমূহ বাধা-বিপত্তি-ব্যবধানকে দূরে সরাতে চেয়েছেন নজরুল-‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।…মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।’
নজরুল বাঙালি জাতিসত্তার রূপকার। সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে ছিল তার অবস্থান। ব্যক্তির আত্ম-উপলব্ধি আর আত্ম-উদ্বোধনকে বিবেচ্য রেখেছেন তিনি সব সময়। কেননা নজরুল মানতেন- ব্যক্তিকে নির্ভর করেই নির্মিত হয় সমষ্টির অস্তিত্ব ও অবস্থিতি। সব ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ড জীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ছিল। সর্বোপরি কবি ‘সাম্য’ কবিতায় স্বপ্নের দেশ- আদর্শ দেশের কথা বলেছেন। এমন দেশ যেখানে রাজা-প্রজা নেই, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। ‘সাম্যবাদী’ এ স্থানে বর্ণবৈষম্য নেই, এখানে সাদা ও কালোদের জন্য আলাদা গোরস্তান বা গির্জা নেই। এখানে কোনো ধর্মের বা শাস্ত্রের ভেদ নেই, নেই কোলাহল। সেখানে পাদ্রী পুরুত মোল্লা এক পাত্রে জল খেলেও জাত যাবে না, স্রষ্টা বাতিল হবে না। সাম্যবাদ বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম যে মমতায় মানবতা মিশ্রিত সাম্যের প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন তা একান্তই অভিনব। এখানেই নজরুলের সাম্যবাদী চেতনার নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।
বিষ্ণু দে
নজরুল পরবর্তী ত্রিশের দশকে এসে সাম্যবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত অন্যতম কবি হচ্ছেন বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দে সে তাঁর কবিতার উপজীব্যে তাত্ত্বিকাতায় ও প্রকরণে মার্কসীয় সাম্যবাদী দৃষ্টির আলোকপাত করেছিলেন। সেখানে সে মমনধর্মী ও বুদ্ধিদীপ্ত শিল্পনৈপুণ্যের উচ্চমার্গে কবিতাকে উপস্থাপন করলেন। যদিও বিষ্ণু দে মার্কসীয় সমাজ ও রাষ্ট্রদর্শনকে তাঁর সৃষ্টিমূলে অন্বিষ্টরূপে বিবেচনা করলেও সেটা তিনি তাঁর নিজের মতো করেই গ্রহণ করেছিলেন। দেশবিভাগ পূর্বকালে রচিত তাঁর কয়েকটি কবিতাগ্রন্থে সাম্যবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। সে কবিতাগ্রন্থগুলো হলো—পূর্বলেখ, সাত ভাই চম্পা, সন্দীপের চর ইত্যাদি। এ সব কবিতাগ্রন্থের কবিতাগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য, ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা, যুদ্ধ-বিরোধি ও শোষণ-বঞ্চনার প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলেন। এই শোষণ-বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ আনতে আপোসহীন সংগ্রামের প্রয়োজন, তা বিষ্ণু দে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। মার্কসবাদী সাম্যের গভীরে আস্থা ও বিপ্লবের মাধ্যমেই এই সমাজের বাস্তবায়নে তিনি ঐকান্তিক প্রত্যয় দৃঢ়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। শ্রেণীবিভিক্ত পুঁজিবাদী সমাজে স্বার্থের শেকল ছাড়া মানুষের কোন মূল্যায়ন করা যায়নি। বিপ্লবের মাধ্যমেই এই অমানবিক সমাজের ধ্বংস তরান্বিত হতে দেখা গেছে। পুঁজিবাদীর বিরুদ্ধে বিষ্ণু দে’র একটি কবিতা এমন—
অর্থের উৎপাতে
পুরুষার্থ নির্ণীত যে সমাজের উঁচু-নিচু স্তরে
যুগে যুগে ইতিহাস এই বাহ্য ভ্রান্তির নিষ্ঠুর
অপচয়ে অন্ধকার, মনুষ্যত্ব-তুচ্ছ সে বৈভবে।
সেই তিক্ত বঞ্চনার, বাণিজ্য-লক্ষ্মীর রক্তাতুর
সাম্রাজ্যের অভিসার ধূলিসাৎ প্রাণের বিপ্লবে।
এছাড়া তিনি মনুষ্যত্বহীন ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজের উৎপাটন ঘটিয়ে যে সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটে সেজন্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
স্বাধিকারের মুক্তি আজ, ন্যায়যুক্তি-প্রতিষ্ঠ জীবন।
এবারে আরম্ভ হল মনুষ্যত্বে প্রাণের মনের
ক্ষুরধার দ্বন্দ্ব আর সমাধা-সাধনা ভেদহীন
সমাজের বিশ্বব্যাপী ভূমিকায়।
মূলত বিষ্ণু দে-এর কবিতায় সাম্যবাদী চেতনার অন্তর্মূলে ছিল মানুষ ও জীবনের চিত্র অঙ্কন। যেখানে সে মানবমুক্তির কামনা করেছেন।
সমর সেন
ত্রিশের দশকের শেষ সময়ের আরেক কবি সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে কবিতাচর্চায় যিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, আমি রোমান্টিক কবি নই, মার্কসিস্ট তিনি হলেন কবি সমর সেন। নজরুল, বিষ্ণু দে’র মতো তিনিও আর্দশ ও মননে সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। বিশেষত কবিতাচর্চায় মার্কসীয় জীবনদৃষ্টির প্রত্যয়কে তিনি নিষ্ঠা সহকারে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ফলে সাম্যবাদী চেতনার কবিতায় দেখা যায় যে, সমর সেন এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করলেন। সমর সেন-এর কবিতায় প্রথম থেকেই ধনতান্ত্রিক যুগ-যন্ত্রণা হতে উৎকৃষ্ট ডিকাডেন্ট জীবন ও সমাজের চালচিত্র ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সমর সেনের কবিতায় পুঁজিবাদী সভ্যতার নাগপাশে আবদ্ধ যে মুমূর্ষ জীবন রেখায়িত তা তাঁর কবিতায় অঙ্কিত হয়েছে। সেই সময়ের তাঁর কয়েকটি কবিতাগ্রন্থ যেমন—গ্রহণ, নানা কথা, খোলা চিঠি, তিন পুরুষ ইত্যাদি। এইসব কবিতাগ্রন্থে সমর সেন সাম্যবাদী চেতনার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বলা যেতে পারে। সমর সেনের সাম্যবাদী চেতনায় সৃষ্ট কয়েকটি কবিতার পঙ্ক্তি এরকম: ক. সমাজে মধ্যপদ ধীরে ধীরে লোপ পায়/ বণিকেরা প্রাকার বানায়/ দিনে দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে/ নিরন্ন বেকারের মজুরের ভিখিরির সংখ্যা বাড়ে। খ. সাম্রাজ্যবাদের এ নাভিশ্বাস মুহূর্তে/ প্রতিবিপ্লবের ঝঞ্চাবাহিনী/ দেশে-দেশান্তরে নতুন সাম্রাজ্য প্রয়াসী। গ. আমি সাধারণ মধ্যবিত্ত, কূপের মণ্ডুক/ ছাপোষা মানুষ,/ দিনের বিষাদ মুখে রাত্রে বাড়ি ফিরি।
মূলত সমর সেনের কবিতায় দেখা যায় যে, শোষণ-বঞ্চনার ইতিরেখায় শ্রমজীবী ও সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কথা উঠে এসেছে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়
সুভাষের পূর্বেও সাম্যবাদ বাংলা কবিতায় আশ্রয় পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, সমর সেন প্রমূখের হাত ধরে। কিন্তু সুভাষপূর্ব সাম্যবাদী কবিগণ নিঃসংশয় সাম্যবাদী ছিলেন না। সুভাষ প্রথম নিঃসংশয় সাম্যবাদী কবি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুভাষও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। রাজনীতিবিদ ও কবির বিরল এক সমন্বয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
মঞ্চে, এমনকি একপর্যায়ে কবিতা থেকে ছুটি নিয়ে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করেছিলেন রাজনীতিতে। বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের প্রয়োজনে যিনি কবিতা লিখেন এবং রাজনীতির প্রয়োজনে চির বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন কবিতার সাথে, তাঁর কবি পরিচয়ের তুলনায় নিশ্চয়ই রাজনৈতিক পরিচয় প্রধান। তা ছাড়া তাঁর কবিতাও যেহেতু প্রায় সর্বাংশে রাজনীতি-আশ্রয়ী, ফলে সঙ্গত কারণেই রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রধান করে না দেখার উপায় নেই। সুভাষকে একজন কবির বদলে রাজনীতিবিদ হিসেবে চিহ্নিত করার সুবিধা এই যে, একজন রাজনীতিবিদ রচিত বক্তৃতা ও স্লোগানপ্রধান কবিতায় পাঠকের শিল্পপ্রত্যাশাও সীমিত। কবি বুদ্ধদেব বসু সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে সাবধান করেছেন এভাবে, ‘দু-দিক বজায় রাখা চলবে না, এক দিক ছাড়তে হবে। যদি তিনি বিশ্বাস করেন যে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করাই তাঁর কর্তব্য, তিনি তা করবেন মানুষ ও কর্মী হিসেবেই, কবি হিসেবে নয়। কিন্তু যখন ও যতক্ষণ তিনি কবি, কবিতার উৎকর্ষই হবে তাঁর সাধনা। হয় তাকে কর্মী হতে হবে, নয়তো কবি।’
বাংলা সাহিত্যের অন্য সাম্যবাদী লেখকদের চেয়ে সুভাষ বেশ স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য যেমন বক্তব্যের তীব্রতা ও স্পষ্টবাদিতায়, তেমনই বক্তব্যের পুনরুক্তি ও একঘেয়েমিতায়।
পূর্বসূরী সাম্যবাদী লেখকদের সাম্যবাদ তত্ত্বভারাক্রান্ত এবং অনেকাংশে ভাববিলাসী। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদ মার্কসীয় ভাবনার বিচ্ছিন্ন ও দ্বিধান্বিত প্রকাশ। ‘দ্বিধান্বিত প্রকাশ’ এই অর্থে যে, নজরুল নিজে মার্কসবাদী ছিলেন না। প্রগতি, ধর্ম, সাম্যবাদ প্রসঙ্গে নজরুলের জীবনদর্শন ছিল স্ববিরোধিতাপূর্ণ। সাম্যবাদের বিবেচনায় যেমন নজরুল প্রগতিশীল, তেমনই হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মকেন্দ্রিক রচনার প্রেক্ষিতে তাঁকে প্রগতিবিরোধী বলে শনাক্ত করা যেতে পারে।
সমর সেনের রচনাও মার্কসবাদ বহুল, কিন্তু সুভাষের আগে বাংলা কবিতায় মার্কসবাদ ততটা স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। সুভাষই প্রথম স্পষ্ট, নিঃশংসয় মার্কসবাদী কবি। বাংলা সাহিত্যে সুভাষ ছাড়াও মার্কসবাদে দীক্ষিত সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্য। সুভাষ-সুকান্ত-মানিকের মধ্যে আদর্শগত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিষয়গত সাদৃশ্য থাকলেও সবারই রয়েছে অনুপম স্বকীয়তা।
‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘সকলের গান’। কবিতার প্রথম শব্দ ‘কমরেড’ পদাতিক সৈন্যের জন্য মার্কসবাদের প্রেরণার পাশাপাশি কাব্যটির বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিতবাহী। প্রথম শব্দটিতেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, এই কাব্যটি পদাতিক কমরেডের কাছে প্রত্যাশায় ঠাসা। পাঠককেও তিনি একজন কমরেড ভাবেন বলেই ‘পদাতিক’ কাব্যের প্রথম উচ্চারণ ‘কমরেড’।
কমরেড, আজ নতুন নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা-
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
‘পদাতিক’ কবিতায় মার্কসবাদের ‘প্রারম্ভিকতা’ ছাড়াও রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ। মার্কসবাদী কবি হিসেবে মধ্যবিত্তকে তুলোধুনা করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। বুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছাড়াও তিনি প্রকাশ করেছেন রোমান্টিক কবিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ। রোমান্টিক কবিদের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা অতিশয় মার্কসপ্রভাবজাত। রাজনৈতিক কর্মী বলেই রোমান্টিক কবিদের উচ্চতর শিল্পমানসকে মেনে নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। ‘রোমান্টিক’ কবিতায় সুভাষের উচ্চারণ—
ছেঁড়া জুতোঁয় ফিতেটা বাঁধতে বাঁধতে
বেঁধে নেই মন কাব্যের প্রতিপক্ষে;
সেই কথাঁই বাধে না নিজেকে বলতে-
শুনবে যে কথা হাজার জনকে বলতে।
পদাতিক কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা হচ্ছে মে দিনের কবিতা। এ কবিতায় তিনি নতুন প্রজন্মকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নতুন প্রজন্মকে রোমান্টিকতা পরিহার করে সমাজের বাস্তবতা দেখে যাওয়া আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কবিতাটির শুরুতেই উল্লেখ করেছেন–
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
‘ছাড়পত্র’ খ্যাত সুকান্ত ভট্টাচার্য রবীন্দ্র-নজরুলোত্তর যুগের তরুণ কবি। যিনি বিপ্লবী কবি এবং গণজাগরণের কবি। যিনি সমাজতন্ত্রের আদর্শের কবি। যিনি চে গুয়েভারার মতো বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। সাম্যবাদে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। যিনি নজরুলের মতোই তার কাব্যে উচ্চারণ করে গেছেন অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সংগ্রামের শব্দমালা। যিনি বিপ্লব ও গণমানুষের মুক্তির পক্ষের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন বারবার। লড়াকু সৈনিকের মতো কাজ করেছেন প্রলেতারিয়েত জনগোষ্ঠীর ও কৃষক-শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়ার প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা কবি। বন্দিত্ব মোচনের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অগ্নিরথের সারথি, উদ্দীপ্ত যৌবনের অগ্রপথিক। মার্কস ও লেনিন ছিলেন তার স্বপ্নপুরুষ। কৈশোরেই বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংস ও তাণ্ডবলীলা, দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে মানুষের মৃত্যু ও হাহাকার দেখে তিনি আলোড়িত হয়ে ওঠেন। সামাজিক অনাচার-অত্যাচার এবং শ্রেণিবৈষম্য দেখে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। নির্যাতিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। ভুখানাঙ্গা মানুষের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসেন। ফলে গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা তার কবিতায় বাণীরূপ পায়। অল্প বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে তাকে কিশোর কবিও বলা হয়।
বাংলা কবিতায় তিনি সমাজতান্ত্রিক ধারার পথিকৃৎ। শিল্পের জন্য শিল্প-কাব্যধারায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সাম্যবাদের কবি। কবিতার মধ্যদিয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে এবং সমাজ বদলে ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলেন। প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন সমাজ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়াই ছিল তার অন্বিষ্ট। নজরুলের মতো তিনিও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তিনি কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। রাত জেগে জেগে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতেন এবং গণমানুষের জন্য কবিতা লিখতেন।
অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণীবৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।
বেজে উঠলো কি সময়ের ঘড়ি
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি
আমরা সবাই যে প্রহরী
উঠুক ডাক উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে;
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
ভীরুরা থাক কোটি করাঘাতে পৌঁছাক দ্বারে
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি।
সুকান্ত তার কবিতার মাধ্যমে মেহনতি মানুষের কাছে যুদ্ধের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সুকান্তের কবিতা শক্তি জুগিয়েছে। সুকান্ত শ্রেণী বিভক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। মানুষের সমঅধিকার বাস্তবায়নের জন্য তিনি নিরলস কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ কবি। অসহায় মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা ছিল বিশাল। দোর্দণ্ড প্রতাপে তিনি অসহায়দের স্বার্থে সংগ্রাম করেছেন। সুকান্তের কবিতা অধিকার অর্জনের আন্দোলনকে গতিময় করতে সহায়ক হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রকে তিনি কবিতার উচ্চারণ দিয়ে রুখতে চেয়েছেন। সুকান্ত তার কবিতার মধ্যদিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সুকান্ত তার কবি চেতনার গুরু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় সুকান্ত ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন। এবং ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের মুখপত্র ‘অকাল’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এ সময় সুকান্তের ‘বোধন’ কবিতাটি সে সময়ের লেখক ও পাঠকদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
আদিম হিংস্র মানবিকতার
যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোমাদের
চিতা আমি তুলবোই।
সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়।
সাতচল্লিশোত্তর কালে বাংলা কবিতা বিকশিত হয়েছে দুই বিপ্রতীপ স্রোতে। বাংলাদেশের কবিতায় মুখ্যত যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের জীবনসংগ্রাম-দেশপ্রেমের ছবি, পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় সেখানে দেখি আবার চেপে বসেছে অনন্বয় আর অসঙ্গতির কর্কট-ছোঁয়া। উত্তরকালে, ষাট-সত্তর-আশির সময়খণ্ডে, উভয় বাংলার কবিতাকেই এলো নতুন এক আন্তর্জাতিক চারিত্র্য। ল্যাটিন আমেরিকা আর আফ্রিকার মুক্তিকামী কবিতাবিশ্ব প্রবলভাবে প্রভাবিত করল বাংলা কবিতাকে। নিম্নবর্গের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে লেগে উঠল ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার শিল্প প্রেরণায়। নব আবির্ভূত এই আন্তর্জাতিক চরিত্রই বর্তমান সময়ের বাংলা কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। কবিতায় সংগ্রামের আবছায়ায় অবতীর্ণ হয়েছে বাংলা কবিতায় সৃষ্টিশীলতার সাম্যবাদী চেতনা। গণমানুষকে অসাম্প্রদায়িক সাম্যবাদী চেতনার বলয়ে অনুপ্রাণিত করতে কবিতা মূখ্যম অস্ত্র। সেসব সৃষ্টিশীল কবিতাগুলোই পেড়েছিল মানুষকে অনুরণিত করতে, নাড়া দিতে। কবিতার সেই শক্তি আছে যে শক্তি মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে পারে মানুষ হয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করার অমোঘ বাণী। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে যুগে-যুগে কালে-কালে দামামার সুরে প্রাণের মাঝে ধ্বনিত হয়েছে বাংলা কবিতার অসাম্প্রদায়িক সাম্যবাদী চেতনা।
আর সব বিভেদ মুছে বিপ্লবী রক্তের কালিতে লেখা কবিতাই মানুষের মাঝে স্থাপন করতে পারে অমূল্য সেই বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।