‘সুখে দুঃখে ছিল একে অন্যের সাথি/ হিন্দু এবং মুসলমানে ছিল সম্প্রীতি’—বাউলকবি শাহ আবদুল করিম, এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির উদাহরণ দিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, তার গানে। কিন্তু সেই সম্প্রীতি সেই সৌহার্দ্য বেশিদিন আমরা টিকিয়ে রাখতে পারিনি। আমাদের মাঝে ভাঙন এসেছিল। যে ভাঙনের স্রোতে ভেঙে গেছে দেশ, ভেঙে গেছে সম্প্রীতি। বাউলকবি শাহ আব্দুল করিম তার গানে বলেছিলেন, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম/হিন্দু বাড়িতে যাত্রাগান হইত/নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম/কে হবে মেম্বার কে হবে গ্রামসরকার/আমরা কি তার খবর লইতাম?’ কে মেম্বার আর কে গ্রামসরকার হবে, তার খবর সাধারণ মানুষ না নিলেও, যারা সেই খবরের সন্ধান করতো, সেই খবরের জন্য লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল তাদের লোভের বলি হয়েই দেশভাগ হয়। দেশভাগের পেছনের পুরো কারণটাই রাজনৈতিক, যার সঙ্গে সাধারণের কোনো যোগ ছিল না। অথচ যে সম্প্রীতি ছিল এ অঞ্চলের মানুষের ঐক্যের ভিত্তি। তাকেই বিভাজনের রেখায় ফেলে ছড়িয়ে দেওয়া হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গার রূপে। আবার রাজনীতির ভেতরে থেকেও যারা বুঝেছিলেন, ভাঙনের সুরের মধ্য দিয়ে প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে না, বরং রোপিত হবে একটি বিষবৃক্ষ, তাদের ধারণা যে ভুল হয়নি, দেশভাগের প্রায় সত্তর বছরের মাথায় এসে তাও এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ১৯৪৬ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘মুসলিম লীগের পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সম্ভাব্য সব দিক আমি ভেবে-চিন্তে দেখেছি। এই পরিকল্পনাটি গৃহীত হলে ভবিষ্যতে গোটা ভারতের ওপর এর প্রতিক্রিয়া কী হবে, একজন ভারতীয় হিসেবে সেটাও আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় মুসলমানদের জীবনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও আমি একজন মুসলমান হিসেবে পরীক্ষা করে দেখেছি। পাকিস্তান পরিকল্পনাটির সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করে আমি এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এই পরিকল্পনাটি গোটা ভারতবর্ষের জন্য অমঙ্গল ডেকে আনবে।’ সেই অমঙ্গলের ধ্বনি হয়তো আর কোথাও খুঁজে পাওয়া না গেলেও, যে হাহাকারের বীজ বপিত হয়েছিল, তার কুফল কিছু মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। আমৃত্যু তাদের সেই হাহাকারের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মানচিত্রের ভেতরে থাকার পরও দেশহীন কিছু মানুষের কথা। যা বোঝাতে তুলে আনছি কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি মন্তব্য। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘বইয়ের দেশ’ পত্রিকার একটি (সংখ্যাটি প্রকাশের দিনক্ষণ মনে করতে পারছি না) সংখ্যায় হর্ষ দত্তের নেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে দেশভাগ প্রসঙ্গে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এত বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে। অথচ তার ঠিক যুক্তি নেই।’ সত্যিকার অর্থেই হয়তো এর কোনো যুক্তি নেই, তবু বুকের ভেতরে টনটনে একটা ব্যথা মানুষ উপলব্ধি করে। সেই উপলব্ধিকে সবাই ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না। তাদের সেই টনটনে ব্যথা থেকে যায় বুকের নিভৃতে একান্ত আপন হয়ে। কিন্তু যারা ভাষার কারিগর, তারা নিজের ভেতেরর সেই ব্যথাকেই তুলে ধরেন, যা অন্যের ব্যথাকেও প্রকাশ করে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো। ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন দেশ। মানচিত্র বদলের সঙ্গে সঙ্গে এপারের কিছু মানুষ চলে গেলেন ওপারে। আর ওপারের কিছু মানুষ চলে এলেন এপারে। মোটাদাগে সম্পর্ক এবং কাহিনি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। এপার-ওপারের মধ্যেই যারা চলে গেলেন, আর যারা এলেন তারা সত্যিকার অর্থেই হারিয়ে ফেললেন ঠিকানা। তাদের আর নিজের দেশ রইলো না। রাজনৈতিক প্রসঙ্গে না গেলেও, এ সত্যি আজও স্পষ্ট বিনিময়ের মধ্য দিয়েই যারা যাওয়া-আসা করলেন, ঠিকানা বদল করলেন, তারা কেউই রাজনৈতিক পরিচয়ের সেই দেশকে নিজের একান্ত আপন করে নিতে পারেননি। মাতৃভূমি ভাবতে পারেননি। তাই ছেড়ে যাওয়া এবং ছেড়ে আসার মধ্যে দিয়েও তারা সত্যিকার অর্থেই দেশও হারিয়ে ফেললেন। মানচিত্রের ভেতরে থেকেও এই দেশহীন মানুষগুলোর হাহাকার বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে সাহিত্যে। তবে দেশভাগের হাহাকার আমাদের সাহিত্যে এলেও তা সত্যিকার অর্থে স্বতন্ত্র কোনো ধারা তৈরি করতে পারেনি। দেশভাগের বেদনা যে আমাদের খুব কম লেখককেই স্পর্শ করেছে, তার পেছনে রয়েছে এই লেখকদের প্রায় কাউকেই বাস্তবে নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে উদ্বাস্তু হতে হয়নি। ছিন্নমূল হওয়ার বেদনা তাদের উপলব্ধি করতে হয়নি। ফলে সাদত হোসেন মান্টো, খুশবন্ত সিং, কৃষণ চন্দর, কর্তার সিং দুগগাল, মুন্সী প্রেম চন্দ, ইসমত চুগতাই, খাজা আহমদ আব্বাস, সৈয়দ আবদুল মালিক, মুলক রাজ আনন্দ, কালিন্দিচরণ পাণিগ্রাহী, গুলজার সিং সন্দু, অমৃতা প্রিতম, কুররাতুল আইন হায়দারের মতো দেশভাগ বিষয়ে একঝাঁক লেখকের রচনাসম্ভার আমরা পাইনি। আমাদের সাহিত্যে তাই দেশভাগের সাহিত্য নিয়ে বড় কোনো অধ্যায় তৈরি হয়নি।
বাংলা সাহিত্যে খুব অল্প সাহিত্যিকের লেখাতেই দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে, তার বেদনা অনুভূত হয়েছে। কিন্তু দেশভাগকেই সাহিত্যের উপজীব্য করে তোলেননি কেউই। ঘুরেফিরে অনেকের লেখাতেই এসেছে দেশভাগ, ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে যেমন, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতাতেও তেমন এসেছে। তবে খুব বড় প্রসঙ্গ হয়ে নয়। সাধারণের জীবনে দেশভাগের যে বেদনা, যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, তাদের লেখনীশক্তির অভাবে, তা আমাদের সাহিত্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের কথাসাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, নাটক রচিত হয়েছে। রচিত হয়েছে বেশ কিছু কবিতাও। দেশভাগের দৃশ্যপটকে কবিতায় তুলে এনেছেন রণজিৎ দাশ। তিনি ‘ইতিহাস’ কবিতায় বলেছেন,—
বিরামহীন, গত দু’রাত ধরেই চলেছে এই মেঘের দল। যেন ৪৭ সালের সীমান্ত-পেরিয়ে-আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুর্দা, ঐ দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে-পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা।
অনেক রাতে ভেসে গেল সুঠাম, অভিজাত দুটি মেঘ পাশাপাশি-মনে হল নেহরু আর এডুইনা মাউন্টব্যাটেন।’
দেশভাগের পুরো অভিঘাত ও দৃশ্য মাত্র কয়েকটি কথায় তুলে আনার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে পড়া ক্লান্ত মেঘের সঙ্গে মায়ের উপমায় তিনি ইতিহাসের পুরো অনুষঙ্গটিই স্পষ্ট করে তুলেছেন। মাত্র কয়েকটি পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে এখানে উঠে এসেছে দেশভাগের পুরো চিত্র। দেশভাগের বেদনা পুরো জীবনই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। তার লেখায় বারেবারে, ঘুরেফিরে এসেছে দেশভাগের নানা অনুষঙ্গ। কখনো সেই স্মৃতি দেশছেড়ে আসার বেদনাক্রান্ত, কখনো উদ্বাস্তু জীবনের হাহাকার আবার কখনোবা সেই স্মৃতিতে ভর করেছে দেশহীন-পরিচয়হীন মানুষের অসহায়ত্ব। দেশভাগের মর্মপীড়া কবি শঙ্খ ঘোষকেও পুড়িয়েছে। ভিটেমাটি ছাড়ার বেদনাকে তিনি উপলব্ধি করে বলেছেন—
তুমি মাটি? কিংবা তুমি আমারই স্মৃতির ধূপে ধূপে
কেবল ছড়াও মৃদুগন্ধ আর কিছু নও?
রেখায় রেখায় লুপ্ত মানচিত্র-খণ্ডে চুপিচুপি-
তোমার সত্তাই শুধু অতীতের উদ্দাম উধাও
বাল্য সহচর। তুমি মাটি নও দেশ নও তুমি।
দেশভাগের আনুপূর্বিক পরিবেশের বর্ণনা পাওয়া যায় বাউলকবি শাহ আবদুল করিমের লেখায়। তিনি বলেছেন—
ব্রিটিশ আমলে মেলার পূর্ণরূপ ছিল
দেশ বিভক্ত হয়ে যখন পাকিস্তান এল।
ধনী-মানী-জ্ঞানী-গুণী হিন্দু ছিল যারা
ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে গেল তারা।
শহর বন্দরে কেহ দেশের বাহিরে।
চলে গেল যে-যাহা ভালো মনে করে।
এই চলে যাওয়ার পেছনে সাধারণের যতটা ইচ্ছে তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক কারণ। রাজনীতির শিকার সাধারণ মানুষের এই অসহায়ত্বকেই স্পষ্ট করে তুলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার একটি কবিতায়। সেখানে তিনি বলছেন—
শিয়ালদার ফুটপাতে বসে আছেন আমার ধাইমা
দুটো হাত সামনে পেতে রাখা,
ঠোট নড়ে উঠছে মাঝে মাঝে।
যে কেউ ভাববে দিনকানা এক হেঁজিপেঁজি বাহাত্তুরে রিফিউজি বুড়ি।
আঁতুড় ঘরে আমার মুমূর্ষু মায়ের কোল থেকে উনি
একদিন আমাকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন…
দাইমা, এ কোন্ পৃথিবী আমাকে দেখালে?
বুড়ি, সর্বনাশিনী, আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলি
এই অকল্পনীয় পৃথিবীতে
আমি আর কত কিছু হারাবো?
সব হারানো এই মানুষের ঢল আজও থামেনি। আজও নানা কারণে দেশভাগের যন্ত্রণাকে বুকের নিভৃতে লালন করছে মানুষ। যারা কোনোভাবেই এই যন্ত্রণার সঙ্গে নিজেদের জড়াতে চায়নি। কিন্তু ছেড়ে যাওয়ার বেদনাকে তারা কখনোই ভুলতে পারে না। মাটির সঙ্গে যে সম্পর্ক তাকে শেকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে গেলেও থেকে যায়। যাকে স্পষ্ট করে তুলেছেন কবি মনীন্দ্র রায় তার ‘চিঠি’কবিতায়।
সুশান্ত, তোমার মনে পড়ে
সরলার মাকে, যে এখানে
কাজ করত? হঠাৎ সেদিন
শুনলো যেই বন্যা পাকিস্তানে,
বুড়ি গিয়ে বসল বারান্দায়,
দেখি তার চোখে জল ঝরে।
সময় ও পরিবেশ যাদের তাড়িয়ে নিয়েছে অস্থির এবং যন্ত্রণাকাতর এক সংকটের দিকে। যেখানে কখনোই তারা স্থির হতে পারেননি। কিন্তু বুকের ভেতরে থাকা স্বদেশ, স্বদেশের খবরের জন্য উত্কণ্ঠা সবসময়ই বুকের ভেতরে। দেশহারানো মানুষদের সবসময়ই তাড়া করে ফিরছে আরও কিছু হারানোর বেদনা। আর তাই হয়তো মাওলানা আবুল কালাম আজাদের India Wins Freedom-বইয়ের ‘ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না’ কথাগুলো আজও অভিশাপের আঙুল তুলে রয়েছে। আর তাই হয়তো আজও দেশভাগের বেদনা মানুষ মর্মে অনুভব করেছে, তার রেশ বয়ে বেড়াচ্ছে।