বাংলা কবিতার অতীত উজ্জ্বল, বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আল মাহমুদ—এমনকি বিশ শতকের শেষ মুহূর্তে আবির্ভূত কবিদের রচনায় অতীত-ঔজ্জ্বল্যের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু আমরা যে সময়ে এখন বাস করছি, এ সময়টা আশ্চর্যজনকভাবে প্রায়-কবিতাশূন্য। কারণও স্পষ্ট। মানবসভ্যতার কোনো কিছুই দীর্ঘকাল ঊর্ধ্বগামী থাকে না। প্রতিটি প্রপঞ্চ একটি নির্দিষ্ট উচ্চতাপর্যন্ত ক্রমোন্নতির দিকে যায়। এরপর থেকে আবার ক্রমাগত নিম্নমুখীও হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসু-অমিয় চক্রবর্তীদের আভির্ভাব, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা। এই পঞ্চকবি বাংলা কবিতাকে নিয়ে গেছেন বহুরৈখিকে ও চরম উৎকর্ষে। এরপর থেকে গত শতকের শেষমুহূর্ত-পর্যন্ত আরও অন্তত ৫/৬ জন বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য। বলা চলে, গত শতকের বারো আনা কালই বাংলা কবিতার ক্রমোৎকর্ষের কাল। কিন্তু সভ্যতার অন্যান্য দিকের মতো কবিতায়ও হঠাৎ ধস নেমেছে—যেভাবে ইতিহাসের একেকটি রাজবংশের পতন হয়েছে। আরও সহজ করে বলা চলে, পরিশ্রমী শিল্পীদের বিপরীতে প্রায় স্টান্টবাজদের সময়ে এসে পড়েছে বাংলা কবিতা। ফলে এখন তেমন আর কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। যারা লিখছেন, তারা অকবি-স্টান্টবাজদের দৌরাত্ম্যে প্রায় উপেক্ষিত।
এ সময়ে যারা কবিতা লেখার কসরৎ করতে চেয়েছেন, তাদের সিংহভাগেরই রচনা হয় তীব্র ভাবাবেগের স্ফূরণ মাত্র, নয় কোনো মতবাদ বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভাষিক রূপ। যা তারা প্রেমিকা বা কোনো নারীর উদ্দেশে কিংবা মনোবিকলনের বিশেষ মুহূর্তে লিখেছেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক অবস্থায় ওই রচনার শিল্পমান নিয়ে কখনো ভাবেননি। প্রয়োজনও মনে করেননি। এ কথা সত্য—ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রকাশ-প্রবণতা আধুনিকদের মজ্জাগত। কিন্তু আজকের যে তরুণরা কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদের অভিরুচিই গড়ে ওঠেনি। যা গড়ে উঠেছে, তা হলো অন্যকে বোঝার চেয়ে বোঝানোর, বহির্জগতের নানা প্রপঞ্চ জানার চেয়ে নিজেকে বিজ্ঞপিত করার মানসিকতা। অথচ জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে প্রমুখ কবির উত্থানকালে একচ্ছত্র অধিপতি রবীন্দ্রনাথ। লিখে চলেছেন মহৎ সব রোমান্টিক কবিতা—সাধনায় মগ্ন আধ্যাত্ম্যের। চরাচরের দৃশ্য-চিত্র-শব্দ-বর্ণ-গন্ধ অনুষঙ্গে কবিতাকে আধুনিক মানুষের দিনানুদিনের অভ্যাসে পরিণত করেছেন। তবে সে সত্য প্রকাশে নাগরিক জীবনের বৈকল্য-যান্ত্রিক অস্বস্তিকে যতটা গুরুত্ব দিলেন, তারও বেশি পল্লীর বিশ্বাস-পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধারণ করলেন কবিতায়। একই বৈশিষ্ট্য জসীমউদ্দীনের কবিতায়, জীবনানন্দের কবিতায়ও পরিলক্ষিত। জসীমউদ্দীনের পল্লীপ্রেম সত্ত্বেও নাগরিক বোধ থেকে তাকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আবার জীবনানন্দের কবিতায় গ্রামীণচিত্রের পাশাপাশি নগর জীবনের একাকিত্ব, নৈরাশ্য বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত হয়েছে।
________________________________________________________________________________
একদিকে বাঙালির মধ্যে একদিকে জাতীয়তাবোধ-দেশপ্রেম প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে কোনো-কোনো বাঙালি জাতীয়তার বৃত্তকে সংকীর্ণ বৃত্ত ভেবে দেশপ্রেমকে নিছক আঞ্চলিকতাপ্রীতি হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথমোক্তদের লক্ষ্য— দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি-রাজনৈতিক স্বাধিকার।
________________________________________________________________________________
ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর অভিজ্ঞতায় যোগ হয়েছে দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব বিশ্বব্যাপী রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মানুষের জীবনযাত্রায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে। স্বপ্নের ভাষা ও ব্যাবহারিক ভাষার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। কারণ—‘মানব সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন অনবরত ঘটে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ পরিবর্তন আসে না। উপস্থিতকালে জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভাবেন যে, রাজনীতির পরিবর্তন মানুষের চিন্তার রাজ্যেও বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। পরিবর্তন হয়তো আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আসে না।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা: সৈয়দ আলী আহসান)।
এ দিকে রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষ না করেও অনুভব করার চেষ্টা করেছেন দার্শনিক প্রত্যয়ে-রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। রবীন্দ্রকাব্যের শব্দ-ভাষাশৈলী সহজ সরল সত্য; কিন্তু তা কোনোভাবেই দিনানুদিনের ভাষা নয়। সে ভাষা সহজবোধ্য হলেও পোশাকি। অন্যদিকে জসীমউদ্দীনের কবিতার বিষয়বস্তু যেমন পল্লী থেকে আহরিত, তেমনি ভাষাও পল্লীবাসীর কথোপকথন থেকে সংগৃহীত। ফলে জসীমউদ্দীনের চেতনা প্রকাশভঙ্গিতে ঐকতান সুস্পষ্ট। জীবনানন্দ বিষয় নির্বাচনে যেমন জসীমউদ্দীনের সমগোত্রীয়, তেমনি রবীন্দ্রনাথেরও। কিন্তু শব্দ নির্বাচনে পল্লীর বিষয়-আশয়কেন্দ্রিক হলেও তা সম্পূর্ণরূপে পল্লীর নয়। পল্লী ও গ্রামীণ জনপদ থেকে শব্দ ও বিষয়-আশয় সংগ্রহ করেছেন সত্য; তাকেই অকৃত্রিমভাবে প্রকাশ করেননি। নিজের অনুশীলনগুণে পল্লী থেকে মন্থিত বিষয়-আশয় এবং শব্দসমবায়কে করে তুলেছেন মার্জিত। ফলে তার কাব্যভাষা না-গ্রাম্য, না-শহুরে—সংকরও নয়—হয়ে উঠেছে শিক্ষিতজনেরর মার্জিত-পোশাকি কথ্যভাষা।
বাঙালির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে প্রথম সংকট ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা, দ্বিতীয় সংকট—প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি। ইংরেজ কবি এলিয়ট যুদ্ধোত্তর বিশ্বকে দেখেছেন রুক্ষ, রুঢ় ও নিরস রূপে। যা ওয়েস্টল্যান্ডের পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে উৎকীর্ণ। একদিকে বাঙালির মধ্যে একদিকে জাতীয়তাবোধ-দেশপ্রেম প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে কোনো-কোনো বাঙালি জাতীয়তার বৃত্তকে সংকীর্ণ বৃত্ত ভেবে দেশপ্রেমকে নিছক আঞ্চলিকতাপ্রীতি হিসেবে গণ্য করেছেন। প্রথমোক্তদের লক্ষ্য— দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি-রাজনৈতিক স্বাধিকার। এ কারণে তাদের বিবেচনাবোধের কাছে সমগ্র মানবজাতির ঐক্য ও বিশ্বমানবতা গৌণ হয়ে উঠলো। পক্ষান্তরে যারা মানুষকে প্রতিদিনের আচরণ ও ব্যক্তিস্বার্থের কদর্যময় চিত্রের ভেতর আবিষ্কার করতে চাননি, তারা মানুষকে গ্রহণ করতে চাইলেন সব ধরনের দ্বেষ, প্রতিহিংসা, বৃত্ত ও সংকীর্ণতার বিপরীতে। ফলে তাদের চোখে শাসক-শাসিতের সম্পর্কের টানাপড়েন ততটা মূল্য পায়নি, যতটা মানবপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত তাদের চিন্তা। তাদের চিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা ও ব্যক্তির মনোবিকলনের রূপ। রবীন্দ্রনাথ এ শ্রেণীর বাঙালির প্রমূর্ত সত্তা। তার কবিতা যতটা ভ্রাতৃত্ব ও আত্মাধ্যবোধ ব্যঞ্জিত, ততটা শোষিত-পরাধীন জাতির মুক্তির মন্ত্র হয়ে ওঠেনি। এর কারণ—রবীন্দ্রনাথ মানুষকে তার প্রতিদিনের কর্মের মধ্যে আবিষ্কার না করে তাকে স্নেহে-প্রেম-মমতা এবং আত্মনিবেদনের চিরন্তন মানবধর্মের মধ্যে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। অথচ ইউরোপের প্রধান কবিরা তখন ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ, নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যকে প্রমূর্ত করে তুলছেন কাব্যে। তারা আধুনিক জীবনযাত্রায় দেখেছেন বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, সংশয় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদগ্র বাসনার ভেতর।
বাঙালি কবিরা ইউরোপীয় জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়টের কবিতা পঠন-পাঠনের সুবাদে আধুনিক যুগ-যন্ত্রণার স্বরূপ উপলব্ধি করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বিষ্ণু দে কাব্যক্ষেত্রে আধুনিকতার রূঢ়-রূপ চিত্রায়ণে ব্যাপক নিরীক্ষা করলেও, পশ্চিমের জীবনযাত্রার স্বরূপ বঙ্গীয়করণের চেষ্টা জোরালোভাবে করেননি। তবে বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ বেশি ঋণপরিগ্রহণ করেছেন।
পৃথিবীতে যত প্রপঞ্চ আছে, তার মধ্যে ধর্ম সবচেয়ে বেশি প্রভাবসঞ্চারী। যখন কোনো একটি বিশেষ প্রপঞ্চ প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে, তখন ওই প্রপঞ্চের প্রতি বিমুখ-আস্থাহীন-নিরপেক্ষ মানুষের শ্বাসরোধ হয়ে আসে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের বিরুদ্ধে নিকটবর্তী প্রভাবসঞ্চারী প্রপঞ্চের অনুগামীরা হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখর। এ তথ্য অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, জাদু, ধর্ম, কবিতা ও শিল্পকলার তাবৎ অঞ্চল সম্পর্কে সত্য।
১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইনের ফলে ভারতবর্ষে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো, তার প্রভাব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেভাবে পড়েছে, সেভাবে স্পর্শ করেনি এই কবিদের। তেমনি লাহোর প্রস্তাব, গান্ধী-নেহেরু-জিন্না মতবিরোধের ফলে দেশেসৃষ্ট দাঙ্গার ঘটনাও তাদের ব্যথিত করেনি। তাদের কবিতায় ব্যক্তির মনোজগত যতটা প্রতিফলিত; বহির্জগতের আচরণ ও কর্মব্যস্ততা ততটা নয়। ফলে প্রেম, হিংসা, বিদ্বেষ, ভালোবাসা, মান-অভিমান কবিতার মূল অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতার বিষয়গুলো কবিতায় অঙ্গীভূত হতে পারেনি।
সমাজে বিভিন্ন সময়ে বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের আচরণে সাধারণ ও নিম্নবিত্ত অবদমিত থাকে। এই অবদমন থেকে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। সময়ে এই অসন্তোষই ক্ষোভে পরিণত হয়। ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বিদ্রোহের। যা চিত্রিত হয়েছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ থেকে শুরু করে রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ প্রমুখের কবিতায়। উপস্থিতকালের যুগযন্ত্রণা সবাইকে সমানভাবে ব্যথিত করে না, আবার জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব বসুর সতীর্থ কবি সমর সেন তার স্বকালের কবিতা সম্পর্কে ‘সাম্প্রতিক বাংলা কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন—‘আমাদের অভিজ্ঞতা এখনও অনেকটা ধরা করা, বই পড়া; দেশের মাটির, দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় বলতে গেলে সবেমাত্র শুরু হয়েছে, আত্মীয়তায় এখনও পরিণত হয়নি। ফলে নতুন প্রভাবে বাগাড়ম্বরের দিকে বাঙ্গালীর স্বাভাবিক ঝোঁক আরও প্রখর হতে পারে, মানবিকতার নামে কীর্তনের ভাবালুতা আবার আসতে পারে এবং কবিরা ভুলে যেতে পারেন যে বুদ্ধি ও আবেগের সমন্বয়ই সার্থক কবিতার উৎস।’ আধুনিক বাংলা কবিতা পূর্ববর্তী বাংলা কবিতারই ধারাবাহিক প্রপঞ্চ, ঐতিহ্যিকও। তবে পূর্ববর্তী ধারা ও রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার বেশ কিছু পার্থক্যও সুষ্পষ্ট ছিল। যেমন জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত প্রমুখের কবিতার সঙ্গে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ; রফিক আজাদ, নির্মন্দেু গুণের সঙ্গে আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লা, ময়ুখ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, মাসুদ খান, হেনরী স্বপন, রহমান হেরনী, মজনু শাহ প্রমুখের কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ-ভাষাশৈলীর ক্রম পার্থক্য সুস্পষ্ট।
____________________________________________
একেক জনের সঙ্গে একেক জনের চিন্তার ভিন্নতা দেখা দেয়। শিথিল হতে থাকে পারিবারিক বন্ধন। শুরু হয় নিঃসঙ্গতা। এ নিঃসঙ্গতা হয়ে উঠেছে আধুনিক কবিতার বিষয়, একই সঙ্গে আঙ্গিকও।
____________________________________________
এ ধরনের পরিবর্তনে কতগুলো নিয়ামক কাজ করেছে। প্রধম কারণ পারিবারিক-সামাজিক, দ্বিতীয় কারণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক। মানুষ সামাজিক জীব, পারিবারিক বন্ধন মানুষকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও নির্ভরশীল করে তোলে। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ভাই-বোন, বাবা-মা পরস্পরের সুখে-দুঃখে সহমর্মী ও সহযোগী হন। বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান। এদেশের মানুষ মূলত কৃষিপ্রধান জীবিকানির্বাহ করে। মানুষ যতদিন গ্রামে থাকে, ততদিন তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনও সুদৃঢ় থাকে। একেক গ্রামে, একেক পরিবারের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, রুচিবোধ ও আচরণবিধি, পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ একেক রকম। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। কিন্তু মানুষ যতই শিক্ষাদীক্ষা অর্জন করে ততই কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দিতে চায় বেশি। শহরে শিল্পনির্ভর সংস্কৃতি ও পেশাদারিত্ব গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। শিক্ষিত মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়। বিয়ে থেকে শুরু করে নানা রকম সামাজিক সম্পর্কগুলো নতুনভাবে সৃষ্টি হয়। এক সময় শহরেই থিতু হতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে অভিবাসনের ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। একেক জনের সঙ্গে একেক জনের চিন্তার ভিন্নতা দেখা দেয়। শিথিল হতে থাকে পারিবারিক বন্ধন। শুরু হয় নিঃসঙ্গতা। এ নিঃসঙ্গতা হয়ে উঠেছে আধুনিক কবিতার বিষয়, একইসঙ্গে আঙ্গিকও। অর্থাৎ বিশ শতকের কবিরা কবিতায় বিষয়-শব্দ-বাক্যে যেমন একাকিত্ব-নিঃসঙ্গতাকে তুলে এনেছেন, তেমনি ছন্দ-মাত্রা-পঙ্ক্তি বিন্যাসে করেছেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। স্বরবৃত্ত-মাত্রবৃত্তে পঙ্ক্তিদৈর্ঘ্যে এনেছেন বৈচিত্র্য। পর্বের সমতা ভেঙে পঙ্ক্তিগুলো করে তুলেছেন বিসমপার্বিক। তুলে দিয়েছেন অন্ত্যমিল। এর পরিবর্তে মধ্যমিলকে দিয়েছেন গুরুত্ব। আর অক্ষরবৃত্তকে এমনভাবে গদ্যের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন, তাতে গদ্যপদ্যের স্থূল প্রভেদ প্রায় ঘুচে গেছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সাত চল্লিশের দেশবিভাগ, পাকিস্তানপ্রীতি ও পাকিস্তানবিদ্বেষ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, একত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরের মুজিব হত্যা, সামরিক শাসন, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান। এসব ঘটনার সঙ্গে জাতির অর্থনৈতিক বিষয়গুলো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রাজনৈতিক মুক্তি ব্যতীত অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে দাসত্বের কারণে ব্যক্তি হয়ে পড়ে ভীরু, মেরুদণ্ডহীন। তাই গত শতকের কবিরা রাজনৈতিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তিরও দাবি তুলেছেন। বিষয়-আঙ্গিকের পাশাপাশি তাদের চেষ্টা ছিল কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠাও।
কিন্তু আজকের কবিযশপ্রার্থীরা কবিতার কোনো শর্তই মানতে অনীহ। তাদের মনে কোনো একটি বিশেষ ভাবের উদয় হওয়া মাত্রই তা অক্ষরে-শব্দে-বাক্যে রূপ দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যের একটি দৃশ্যমান শরীরই সৃষ্টি হচ্ছে কেবল, তাতে প্রাণ-রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ থাকছে না। তারা লিখে যাচ্ছেন, স্বীকৃতিও দিচ্ছেন একে অন্যকে। তাদের প্রায় রচনা আত্মপ্রতারণায় পর্যবসিত হচ্ছে। পূর্ববর্তী কালের কবিদের সাধনা-নিরীক্ষাকে তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন, গ্রহণ করছেন না বোদ্ধাসমালোচক-অগ্রজ কবিদের কোনো পরামর্শ।
________________________________________________________________________
আর ভবিষ্যতের কবিতা নির্ভর করবে, বর্তমানের সৎ-পরিশ্রমী কবিদের নিষ্ঠা-প্রস্তুতির ওপর। আগেই বলা হয়েছে, সবকিছুরই উত্থান-পতন রয়েছে। তেমনি কাল-কালান্তরের কবিতারও। উপস্থিতকালের কবিদের প্রস্তুতি-নিষ্ঠা কবিতাবান্ধব হলেও ভবিষ্যতে যথার্থ কবিতা-ই সৃষ্টি হবে।
________________________________________________________________________
তাদের মধ্যে আত্মঅহম বড় হয়ে উঠেছে। এই আত্মম্ভরিতাকে প্ররোচনা দিচ্ছে। শিল্পে শত্রু কিছু প্রতিষ্ঠান-সংঘ। এই প্রতিষ্ঠান-সংঘ পুরস্কার-পদকের ফাঁদে ফেলে তরুণদের করে তুলছেন বিপথগামী। দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতাগুলোও বর্তমানকে কবিতাশূন্য কালে পর্যবসিত করার জন্য দায়ী।‘অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা সাহিত্য পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পেলে পুরো পাতাটিকে পারিবারিক সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের দেয়ালিকায় পরিণত করেন। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি তাকান ভীত সন্ত্রস্ত চোখে, আর আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চানাচুর মার্কা রচনা পত্রস্থ করেন যত্মসহকারে। সাহিত্যসমাজে যখন স্নবরি বা স্টান্টবাজ লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন নির্মোহ, নিরাসক্ত ও নির্লোভ প্রাজ্ঞ ও হৃদয়বান সাহিত্যিকেরা উপেক্ষিত হতে থাকেন।’ (সাহিত্যের রাজনীতি : মোহাম্মদ নূরুল হক)। এই অসাহিত্যিক সাহিত্য সম্পাদকেরা নিজের বান্ধবী, আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের অকবিতা ছাপিয়ে ছাপিয়ে সমাজে একধরনের ধারণা দিয়ে রাখেন—এই হলো কবিতা। ওই সব অবিতা পরবর্তী সময়ে বই আকারে প্রকাশিতও হয়। কিন্তু পাঠক-সমালোচক গ্রহণ না করলেও ওই সব বই ঠাঁই পায় বিভিন্ন পুরস্কার দাতা প্রতিষ্ঠান আর প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মানীপ্রাপ্ত সাহিত্যবিচারকদের ড্রয়িংরুমে। একসময় ওই বইগুলোর মলাটজুড়ে পুরস্কার জোটে। ওই পুরস্কার প্ররোচিত করে অনতি তরুণদের। তারা ভেবেই নেয়, পুরস্কারই কবি জীবনের বড় প্রাপ্তি। তারা ছোটে ওই পুরস্কারদাতাদের পেছনে। পুরস্কার দাতা-গ্রহীতাদের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন দলবাজি-গোষ্ঠীপ্রীতি- গোষ্ঠীবিদ্বেষ। তারা নিজেদের গোষ্ঠীর লেখকের রচনা ছাড়া অন্যদের রচনা পড়ে দেখেন না, স্বীকারও করেন না। এছাড়া পুরস্কার না পেলে তারা ওই কবিকেও স্বীকৃতি দেন না। অথচ এই স্বীকৃতি-অস্বীকৃতি ও পুরস্কার-পদকের সঙ্গে কবিতার কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণেই বাংলা কবিতার বতর্মান অন্ধকারে নিমজ্জিত।
আর ভবিষ্যতের কবিতা নির্ভর করবে, বর্তমানের সৎ-পরিশ্রমী কবিদের নিষ্ঠা-প্রস্তুতির ওপর। আগেই বলা হয়েছে, সবকিছুরই উত্থান-পতন রয়েছে। তেমনি কাল-কালান্তরের কবিতারও। উপস্থিতকালের কবিদের প্রস্তুতি-নিষ্ঠা কবিতাবান্ধব হলেও ভবিষ্যতে যথার্থ কবিতা-ই সৃষ্টি হবে। হয়তো দশ কি বিশ বা ত্রিশ বছর সময়ের মধ্যেই বাংলা কবিতা ফিরে আসবে, স্বরূপে, স্বমহিমায়। যেমন পদাবলির দীর্ঘকাল পর মাইকেল, এর দীর্ঘদিন পর রবীন্দ্রনাথ; তারপর রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে স্বীকার করেও সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে জীবনানন্দ-সুধীনদত্ত-বিষ্ণু দে প্রমুখের হাতে আধুনিক বাংলা কবিতার সৃষ্টি।