নিজেকে চিনতে সময় লাগে, জানতে অনেক মেহনত করতে হয়— তবেই মানুষ আপনার ভেতরদেশে ঢুকে আবিষ্কার করে আত্মতাকে। সমাজ রূপান্তরের হাত ধরেই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময় ও পরিবেশে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে; সৃষ্টি করে সৃজনীকর্ম। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মানুষেরা, মানে অপশ্চিমী বা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের লোকেরা সৃষ্টিশীলতায় ও দর্শনে বারবার আত্মতা প্রতিষ্ঠার জায়গায় মার খেয়েছে। ইতিহাসের ধারা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী আঘাতে ও সংঘাতে। এইসব অঞ্চলের লোকেরা শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকেছে অন্যের গোলামীর মধ্যে। নিজেদের আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং স্বাধীন জীবনচিন্তাধারায় পশ্চিমের প্রবল তরঙ্গ আছড়ে পড়েছে। অপশ্চিমের যাবতীয় অর্জনকে পশ্চিমের পণ্ডিত সমাজ অসভ্য, অমার্জিত, দুর্বল, অপুষ্ট, বাজে, অনাধুনিক, পশ্চাদপদ, নিকৃষ্টরূপে চিহ্নিত করে— বিশেষভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনদর্শনকে। রাজনৈতিক আধিপত্যের জোয়ারে সুকুমার বৃত্তির কেন্দ্রগুলোও হয়ে পড়ে হীন ও অপাঙতেয়। ফলে তৃতীয় বিশ্বের একজন লেখক নিজেকে হারিয়ে ফেলে: আপন উত্তরাধিকার, মাটি-পানি-হাওয়া, শেকড় ও পতিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। রচনা করে ধারকরা সাহিত্য, পশ্চিমের সাহিত্যাদর্শের আলোকে নির্মাণ করে সমস্ত লেখালেখি। উপনিবেশিক গোলা ভরে ওঠে কৃত্রিম ও বানানো সাহিত্যের ফসলে। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে উপনিবেশিত দেশগুলো স্বাধীন হতে থাকে— অবশ্য দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের রণরক্তের নদীতে সাতাঁর দিতে হয়েছে সবাইকে।
ইউরোকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও অর্থনৈতিক লাভের লক্ষ্যে নৌ-অভিযানের মাধ্যমে পশ্চিম সতের, আঠের ও উনিশ শতকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বাণিজ্যিক ও বসতি উপনিবেশ গড়ে তোলে। প্রায় চার শতাব্দীব্যাপী উপনিবেশিত রাষ্ট্রগুলোতে বাণিজ্য পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে তারা চালান করেছে ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন এবং মানবিক চিন্তনপ্রক্রিয়া। ফলে সেখানে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক শোষণ ও আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং যাবতীয় সম্ভাবনা ও বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে; পাশাপাশি রাজনীতিক মেরুকরণ, অর্থনৈতিক ও জাতিগত বিভাজন তৈরি করেছে। এসবের কারণেই উন্নত-অনুন্নত, সভ্য-অসভ্য, সাদা-কালো, কেন্দ্র-প্রান্ত, শাসক-শাসিত, আলো-অন্ধকার ইত্যাদি বিপরীতধর্মী ধারণার জন্ম। শিক্ষা ও ভাষা-সাহিত্যের মাধ্যমে পশ্চিম গড়ে তুলেছে অনুগত ও সহযোগী একটি শ্রেণী— যারা মানসিক দিক থেকে উপনিবেশিত; নিজ দেশের সমস্ত কিছুর ব্যাপারে হীনমন্য এবং উপনিবেশিক দেশের সব কিছুকে মনে করে শ্রষ্ঠ । তারা স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তা ও কর্ম পরিচালনায় অপারগ। তাই নিজ দেশে ও ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও তা হয়ে ওঠে শাসক দেশের আদর্শানুসারি ও প্রতিনিত্বকারি। আবার স্বাধীনতা লাভের পরও দেখা যায় সেই ধারা অব্যহত থেকে যায় অনেক সময়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো রণরক্তের মাধ্যমে স্বাধীন হতে থাকে। কিন্তু শৈক্ষিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের প্রভাব সেখান থেকে মুছে যায় না। শিক্ষা ও আর্থনীতির ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী ও অনুকারী বিরাট একটি শ্রেণী সাবেক উপনিবেশিক দেশের পূর্বতন ব্যবস্থা জিইয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে কলোনিয়াল শিক্ষায় উজ্জীবিত শ্রেণী ঘৃণা ও বর্জন করতে দ্বিধা করে না। এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় ও স্বাধীন চিন্তনধারা প্রতিষ্ঠার সূচনা হয় সত্তর দশক থেকে। মূলত আফ্রিকা ও লাতিন আমিরিকায় উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যচর্চার ধারা সচেতনভাবে এগিয়ে যায়। আফ্রিকায় চিনুয়া আচেবে, লাতিন আমেরিকার কোনো কোনো প্রমুখের সাহিত্যকর্ম বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা জোগায়। তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনায় এডওয়ার্ড সাঈদের ‘অরিয়েন্টালিজম’, হোমি ভাবা ও গায়র্ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখের চিন্তনকর্ম ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষভাবে ভারত ও বাঙলাদেশে বাঙলা ভাষার সাহিত্যে এই ধারার চর্চা অত্যন্ত সীমিত। কবিতার ক্ষেত্রে তা আরো বেশি নেতিবাচক ভূমিকায় অব্যহত।
ভারত স্বাধীন হয় বিশ শতকের মাঝামাঝি। আঠের শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয় পশ্চিমের উপনিবেশ। এই দীর্ঘ সময়ে আমূল পালটে যায় জীবনের যাবতীয় ধারা-উপধারা ও সাহিত্যাদর্শ। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পশ্চিমীকরণ হতে থাকে মেধাবী ও শক্তিশালী মানুষদের হাতে। মধুসূদন সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত— উপনিবেশিত লেখকদের মধ্যে যার সমস্ত সৃজনীশক্তি ব্যয় হয়েছে পশ্চাত্য প্রেরণায়। যদিও সৃষ্টিশীলতায় তাঁর কৃতিত্ব অসামান্য— ছন্দের-ভাবের মুক্তি, সার্থক মহাকাব্য, নাটক ও সনেটের প্রবর্তন তাকে বাঙলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছে। শেষ জীবনে তাঁর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে বাঙলার প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের জগতে। তবে প্রত্যাবর্তন বর্তমানে ততটা নয়, যতটা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলায়। উনিশ শতকে বিরাজমান বঙ্গীয় জীবন ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যে প্রায় অনুপস্থিত। মহাভারত, রামায়ণ আর পৌরাণিক অনুষঙ্গ মিশ্রিত এক ধরনের রোম্যান্টিক জগৎ কবি নির্মাণ করেন। যে বর্তমানতা ‘নীল দর্পণে’ বাক্সময়, যে জমিন কৃষকের বাঁচা-মরার প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত— সেখানেই নীলের আগ্রাসন— সেই কর্কশ বাস্তবতা তাকে উদ্বিগ্ন করেনি বা ভাবায়নি বা তাঁর শ্রেণীচরিত্র ভাবতে দেয়নি। উপনিবেশিত মানসিকতার ফলে জমিন ও কৃষক লগ্ন হতে পারেননি কবি। তবে এইটুকু সাত্ত্বনা যে, বঙ্গীয় ঐতিহ্যে ফেরার বাসনা তাঁর মাঝে পরবর্তীকালে প্রকাশ পায় ‘চতুদর্শপদী কবিতাবলী’তে। সেই বাসনা অবশ্য তাকে প্রকৃতির নিকটবর্তী করেনি, দুরত্ব বা ফাঁক বরাবরই রয়ে গেছে।
কালান্তরের সাহিত্যসমুদ্রের সবচেয়ে বড় ঢেউ সৃষ্টি করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙলা কবিতার সৈকত প্লাবিত করে তা উছলিয়ে পড়ে বিশ্বজমিনেও। লালনের মতো তাঁর জীবনসাধনা, জীবনদর্শন ও কর্মপথের অর্জন ও পরিবর্তনের ইতিবৃত্ত আর তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির ইতিহাস একই মানুষের কায়া ও ছায়া। বাঙলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ও সর্বাত্মক কৃতিত্ব তাঁর মাধ্যমে অর্জিত। তবে তাঁর আত্মবিকাশের পরম্পরা, উত্তরাধিকারের সীমানা প্রাচীর এবং পশ্চিমের রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ভূমি ও নদীতীরবর্তী সাধারণ মানুষ এবং স্থানিক আবহমান প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে দেয়নি, শুধু ফটোগ্রাফারের মতো চিত্রণ করতে দিয়েছে । রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ও গানে প্রকৃতি বিপুল ঐশ্বর্যে প্রকাশিত; তার বিস্তৃতি রীতিমত বিস্ময় জাগানিয়া ব্যাপার। তাঁর চিন্তাধারা ও অলঙ্কারের বাহন হিসেবে প্রকৃতি সবচেয়ে বড় জায়গা জুড়ে আছে এবং জীবনানুভব, চেতনাস্রোত ও জীবনদেবতা নির্মাণে প্রকৃতি প্রধান নিয়ামকরূপে কাজ করেছে। সে কারণে ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো তাকেও ‘প্রকৃতির কবি’ বলা হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর এই অভিধার পেছনে এই দুই কবির রোম্যান্টিকতার প্রতি সমর্পিত প্রাণের বৈভব দায়ী। রবীন্দ্রনাথ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ দুজনই প্রকৃতিকে দেখেছেন মূলত দুটি উপায়ে : এক. দার্শনিক দৃষ্টিতে, দুই. নান্দনিক চোখে। রবীন্দ্রনাথ এই দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমের সাহিত্য ও দর্শনের জগৎ থেকে অর্জন করেন। তাই তাঁর কবিতায় জীবন ও জগতের সত্য অনুসন্ধান ও উপলব্ধি এবং সৌন্দর্যসৃষ্টির মূলে প্রকৃতির প্রবল উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিনি ভেবেছেন ও দেখেছেন: প্রকৃতি দর্শনচর্চার উপযুক্ত স্থান, উপমা-রূপক-প্রতীক নির্মাণে শ্রেষ্ঠ জায়গা, সৌন্দর্যের লীলাভূমি, এমন এক কল্পরাজ্য বা ইউটোপিয়া যেখানে আছে শুধু সুখ-শান্তি-স্বস্তি, নাগরিক গ্লানি থেকে মুক্তির ক্ষেত্র, যাকে শিল্পীর আঁকা ‘ল্যান্ডস্কেপ’ বলা যায় সহজে। এই দৃষ্টি তাঁর কাব্যে আজীবন সুন্দর তুলিতে সুন্দরভাবে অঙ্কিত। কবির দূরবর্তী দৃষ্টিতে তাই জমিন ও কৃষকের জীবনযুদ্ধের বাস্তবতা ধরা পড়েনি। জমিদার জীবন যাপনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে লালিত কবির পক্ষে দূরত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিকটবর্তী হওয়া সম্ভবও ছিলো না। কবিতার পটভূমিকা তৈরি করেন প্রকৃতিক নান্দনিকতায়, সত্য ও সুন্দরের সাধনায়। ফলে মাটিলগ্ন মানুষের প্রেম জসীমউদ্দীনের ‘বালুচর’-এ প্রকাশ পেলে রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়নি: তোমার বালুচর পড়তে গিয়ে বড় টকেছি হে। বালুচর বলতে আমি তোমাদের দেশের সুদূর পদ্মাতীরের চরগুলির সুন্দর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা আশা করেছিলাম। কেমন চখাচখি উড়ে বেড়ায়, কাশফুলের গুচ্ছগুলি বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কতকগুলি প্রেমের কবিতা দিয়ে তুমি বইখানাকে ভরে তুলেছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বাঙলার প্রকৃতিপাঠে দূরবর্তী নান্দনিকতায় আপ্লুত। ষড়ঋতুরঙ্গ ও বৈচিত্র্যের ঐশ্বির্যময় রূপাবলী অঙ্কনে তাঁর খ্যাতি প্রবাদতুল্য, সেখানেও তিনি বঙ্গীয় ধারার পরিবর্তে পশ্চিমের পদ্ধতি গ্রহণ করেন। জসীমউদ্দীনের উপলব্ধি: এমন কি এদেশের শীত, শরৎ প্রভৃতি ঋতুকে তিনি বর্ণনা করিলেন ইউরোপবাসীর মত করিয়া। বাঙলার শীত, এ দেশের বসন্ত, ইউরোপের শীত-বুড়ী নয়। শরতের রঙ্গও পরিপূর্ণতার রূপ লইয়া এদেশে দেখা দেয় না। এদেশের লোক যা ভালবাসে বা পছন্দ করে তা পাশ্চাত্যে পড়িয়া রহিল। এ দেশের যা কিছু ইংরেজের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারে, তাহা লইয়া তিনি পসরা সাজাইলেন। এমন কঠিন সত্য উচ্চারণে জসীমউদ্দীন দ্বিধা করেননি, কারণ তিনি যে ধারার সাহিত্যচর্চা করেন তা বঙ্গীয় মাটি-জল-মানুষের শেকড়ে বিস্তৃত। জসীম আসলে উপনিবেশিত কাব্যধারার মৌল সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছেন। ফলে কল্লোলের কালে প্রবল প্রতাপে কবিরা যখন পশ্চিমের সাহিত্যাদর্শ ও জীবনদর্শনে প্লাবিত হয়ে কাব্যচর্চা করছেন, তখনও জসীম বিভ্রান্ত হয়ে হীরা ফেলে কাচ তুলে নেননি। নিজের সঙ্গে, নিজের জাতির মানুষের সঙ্গে, নিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেননি। আধুনিকতার ডামাডোলে দমে যাননি একদম। বরং এই ধারাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে আপন নদীতে সাঁতার কেটেছেন সানন্দে। আত্মগ্লানি থেকে মুক্ত হয়ে আত্মতাকে গ্রহণ করেছেন। জসীমউদ্দীন এমন এক কবি, যিনি রবীন্দ্রনাথের সূর্যাবর্তের মাঝে জন্ম নিয়েও প্রভাবিত হননি, আবার কোনো বিদ্রোহও করেননি এবং সেই প্রবল আলোক রশ্মিতে ঝলসে যাননি। বরং আপন আলোয় ও মহিমায় গৌরবান্বিত হয়েছেন বিচিত্রতা ও মৌলিকতার শক্তিতে। ফলে তাঁর কবিতায় প্রাণবন্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে বাঙলাদেশের আবহমান জীবন ও প্রকৃতি— যে প্রকৃতি আবাদ-মেহনত-কর্ষণের জমিন, বীজবোনা-মই দেওয়া-ফসলের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্র, কিষাণের রোদবৃষ্টির মাঝে লাঙল-জোয়াল গরুর মিলিত কর্মযাত্রার জায়গা, ঋতুচক্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের প্রাকৃতিক রূপবদল, ফসলকাটা ও ফসলতোলা, শস্যের ঘ্রাণ, মাড়ায়ের বিষয়াবলি, নদী-নদীভাঙন-নদীচরাঞ্চল-চরদখল, রাখালের কর্মযজ্ঞ ও বিনোদনের কেন্দ্র। অন্যদিকে জমিন তাঁর কাব্যে হয়ে উঠেছে মানুষের জীবিকা ও লড়াই বা কাজিয়ার স্থান; দখল, স্বত্ব, রক্তপাত, খাজনার জায়গা। কল্পরাজ্য, সৌন্দর্য-তীর্য বা দৃষ্টিনন্দনের কোনো ক্ষেত্র হিসেবে প্রকৃতিকে তিনি দেখেননি। বাঙলা প্রকৃতপক্ষে সে-রকমও নয়। নগর জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির গন্তব্য নয় প্রকৃতি; বরং এই প্রকৃতি ও প্রকৃতিলগ্ন মানুষের মিলিত রূপ ও ক্ষেত্র পূর্ণাঙ্গ বঙ্গদেশ গড়েছে— যেখানে নগরের স্থান নেই। বঙ্গদেশের ইতিহাসে বারবার যে লড়াই ও সংঘাত হয়েছে তার মূলে রয়েছে প্রকৃতির দখলদারিত্ব। ভূমিই বঙ্গবাসী কৃষকের জীবন ও জীবিকার প্রধান অবলম্বন; তাঁর জীবন বাস্তবতা ও স্বপ্ন, সামাজিক সম্পর্ক ও লেনদেন, রাজনৈতিক কর্ম ও কৌশল, সাংস্কৃতিক বন্ধন ও বিরোধ, ঐতিহ্যিক উৎসব ও অনুষঙ্গের প্রাণ। জসীমউদ্দীনের গ্রাম-বাঙলা তাই কখনো সবুজ, কখনো ধূসর, কখনো বিচিত্র রঙের বিন্যাসে ঐশ্বর্যময়, কখনো দুর্যোগে বিষাদময়; তবে কোনো পশ্চিমা শিল্পীর চোখে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ নয়; বাঙালি শিল্পীর বাঙালি দৃষ্টি দিয়ে আঁকা সত্যিকার বাঙলাদেশ। কল্পনার রঙ-রূপ-গন্ধের অভাব কখনোই অনুভব করা যায়নি যেখানে। ফলে জসীমের কবিতার উপমা-প্রকীক-রূপ আর চিত্রকল্প নির্মিত হয়েছে বাঙলার স্থানিক ও আবহমান পটভূমিকায়। বিস্তৃত জমিন, আবাদ লাঙল, মই, পশুপাখি, ফসল, নদী-নদী নাওমাঝি-মাছজাল, ভাঙন, চর-চরদখল-চরাঞ্চলের রূপাবলী, ভূমিবর্তী মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সুখ-দুঃখ-আনন্দ বেদনার ধারাভাষ্য তাঁর কবিতার উপাদানরূপে কাজ করেছে। তাঁর কাব্যভাষাও তাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। গাঁথাকাব্য ও গীতিকাব্য উভয় ধারার শিল্পসৌকর্য এককথায় অসাধারণ। ছন্দের বৈচিত্র্যে ও অলঙ্কারের সৌন্দর্যে তাঁর কাব্য বাঙালি পাঠকের কাছে যেমন আনন্দের তেমনি আত্মপরিচয় ও আত্মআবিষ্কারের ঠিকানা। উপনিবেশিত মনের শহুরে সমালোচকতাই তাকে আধুনিক বলতে দ্বিধাগ্রস্ত এবং ‘পল্লীকবি’ উপাধি দিয়ে আত্মতৃপ্ত। পশ্চিমের আধুনিকতার মাপকাঠিতে জসীমউদ্দীন অবশ্যই আধুনিক কবি নন; তাতে কোনোভাবেই খাটো হয়ে যান না তিনি; বরং তথাকথিত পোশাকি আধুনিকতার বাইরে নিজস্ব, একক ও স্বতন্ত্র একটি পৃথিবী গড়েছেন কবি— একে স্থানিক আবহমান ও লোকজ আধুনিক বলছি— আমাদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র আধুনিকতা, বৈশ্বিক আধুনিকতা থেকে আলাদা এই ধারণা। তাঁর সৃষ্ট প্রকৃতি ও মাটি-নদীবর্তী মানুষেরা তাই আমাদের একান্ত আত্মীয়।
প্রথম স্বাধীনতাকামী, প্রথম উপনিবেশবিরোধী, প্রথম রবীন্দ্র-দ্রোহী, প্রথম চিরউন্নত শির কবি নজরুল— বহু বিচিত্রতা, বহু আপাতবিরোধী প্রবণতার সমাবেশ তাঁর মাঝে বিাজমান। সর্বভারতীয়, সর্বমানবিক ও বিপ্লবীরূপে তাঁর খ্যাতি আকাশছোঁয়া এবং বিশ্বপ্রেমিক ও নারীপ্রেমিক হিসেবে তাঁর কৃতি চূড়াস্পর্শী। এসবের মাঝে বাঙলার মানুষ ও প্রকৃতি তাকে বারবার কাছে টেনেছে। তাঁর কবিতা ও গানের প্রাকৃতিক পটভূমিকা মূলত বাঙলাকেন্দ্রিক। এখন কথা হলো- এ প্রসঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কি গতানুগতিক না স্বাতন্ত্রিক, রাবীন্ত্রিক না দ্রোহী? অবশ্যই নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে তা চিত্রিত এবং অধিকাংশ স্থানে প্রকৃতিকে মুগ্ধ চোখে দেখেছেন ও রোম্যান্টিকের তুলিতে এঁকেছেন। তবে কবি প্রকৃতি ও মানষের অঙ্গাঙ্গির সম্পর্কের রূপটি উপলব্ধি করেছেন। গণমানুষের উৎপাদন ও জীবন অবলম্বন যে প্রকৃতির বুক থেকে শ্রম ও ঘামের মাধ্যমেই আসে এবং তার প্রতি অধিকার খেটে খাওয়া মানুষেরই প্রধান, তাকে রক্ষার দায়িত্বও তারই; সে সম্পর্কে কবি ছিলেন সোচ্চার। ফলে গণমানুষের যেমন আত্মীয় তিনি, তেমনি প্রকৃতির বন্ধুও।
এ আত্মীয়তা নজরুলোত্তর বা জসীমউদ্দীনের সমসাময়িক কবিদের মাঝে অনুভব করা যায় না। তিরিশোত্তর কবিরা জনগণের সাথে বন্ধন চায়ওনি। মূলত পশ্চিমের দোকান থেকে ধার করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কবিতার পসরা সাজিয়েছেন বাহারি রঙে; তার অবস্থা মাকাল ফলের মতো। জীবনানন্দ দাশ বাদে আর সকলের কবিতা উপনিবেশিত মনের সৃষ্টি।
সুধীন দত্তের মৌলিকতা, শিল্প সফলতা, সৃজনী স্বাতন্ত্র্য ও মাননিক সৌকর্য রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা কবির মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু নিখিল নাস্তি, সংশয়গ্রস্ত মন, বস্তুবাদী ও ক্ষণবাদী দৃষ্টির সঙ্গে বিশ শতকে বিরাজমান বঙ্গীয় জীবনদর্শন ও সংস্কৃতির সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। সমগ্র ভারতবর্ষ স্বাধীনতার জন্যে যখন আন্দোলন-সংগ্রামরত, বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত, তখনও তিনি মালার্মের ভক্ত হয়ে পশ্চিমের ফেলা দেওয়া/ পরিত্যক্ত সম্পদ এবং মৃত ভাষা সংস্কৃতির শব্দভাণ্ডার নিয়ে অতি উৎসাহে কাব্যচর্চা করেছেন। আবার তাঁর কবিতায় প্রকৃতির যে ছবি আঁকা বা অলঙ্কারের যে উপাদান নির্মিত হয়েছে, সেই ছবিতে বা উপাদানে যে রঙ-রেখা-রূপ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে মনে হয় ভিন কোন দেশের, বিশেষভাবে ইউরোপের তৃতীয় শ্রেণীর কবিতা, অন্তত বঙ্গীয় নয়। কবি যে দেশে, যে সমাজে বসবাস করেছেন, যেখানে উত্তরাধিকার বিস্তৃত এবং আজন্ম জলহাওয়ামাটির উৎষঙ্গে বেড়ে উঠেছেন; তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাই একজন মানবিক কবির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এই কবিধর্মের ব্যতিক্রম হলে তাকে আর স্বতঃস্ফূর্ত বা মৌলিক কবি বলা যায় কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। যে ‘উটপাখি’ লিখে সুধীন দত্ত কবি হিসেবে প্রতিনিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য, কালের পরিহাসে সেই পাখির বৈশিষ্ট্যই তাঁর মাঝে বিরাজমান— যে পাখি উড়তেও পারে না, আবার সাধারণ পাখির সঙ্গে মিশতেও পারে না। তাঁর ‘উত্তর ফালগুনী’, ‘সংবত’, ‘অকেস্ট্রা’ কাব্যগুলোয় বাঙলার প্রকৃতি নেই— যে প্রকৃতির কোলে বাঙালি সন্তান জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে। তাই দেখা যায় বাঙলার ঋতুভিত্তিক ও নদীমাতৃক প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর কবিতার কোনো সম্বন্ধই নেই।
তিরিশোত্তর অন্যসব কবিও একই পথে হেঁটেছেন। যেমন বুদ্ধদেব বসু; তাঁর সার্বত্রিক সৃষ্টিশীলতা বাঙলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং রবীন্দ্রোত্তর স্বতন্ত্র একটি কাব্যধারা নিমার্ণে তাঁর ভূমিকা অসামান্য; কিন্তু তাঁর চিন্তা-চেতনা-কর্মদ্যোতনা সব কিছুর উৎস ও উপাদান পশ্চিমের জমিন থেকে আহরিত। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ডিএইচ লরেন্স, র্যাবো ও বদলেয়ারের পৃথিবীতে। পশ্চিমের অবাধ যৌনতা আমদানি করেন রবীন্দ্রনাথ থেকে পৃথক হতে। এই ভিন্নতার জন্যে রাবীন্দ্রিক রোম্যান্টিকতার বঙ্গীয় সংস্করণ থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে তিনি সম্পূর্ণ ইউরোপীয় হতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। ফলে বাঙলাদেশের বা বঙ্গীয় কবি না হয়ে বরং বাঙলা ভাষার পশ্চিমা কবি হয়েছেন বা পশ্চিমের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কাব্যচর্চার শেষপর্বে ভারতীয় পুরাণের জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রসংশার দাবিদার। তাঁর কাব্যনাট্য ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বাংলা সাহিত্যে একটি অসামান্য সৃষ্টি। ‘যে-আঁধার আলোর অধিক’, ‘মরচে-পড়া পেরেকের গান’, ‘শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর’ কাব্যগুলোকে কলাকৈবল্যবাদী কাব্য হিসেবে সফল বলা যায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমরা বঙ্গীয় প্রকৃতির যে অনুসন্ধান করছি, সেই প্রশ্নে এই কবি প্রশ্নবিদ্ধ। বাঙলার মাটি বাঙলার জল আর কৃষকজীবনলগ্ন প্রকৃতির বাস্তব আখ্যান ও রঙ-রূপের কোনো হদিশ তাঁর কাব্যে নেই; না থাকাই স্বাভাবিক— কেননা উপনিবেশিত কবি আপন দেশ নয়, প্রভু দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাতেই গর্ব ও স্বস্তি বোধ করেন। তাঁর কবিতায় সৃজিত প্রাকৃতিক ভূগোল বাঙলার নয়; পশ্চিমের— বাঙলা প্রকৃতির পটভূমি তাঁর কবিতায় কোনো ভাবেই ছায়া ফেলেনি; চিত্রকল্প-উপমা-রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক উপাদান পশ্চিমের দৃষ্টিতে সৃষ্ট; দার্শনিকতা ও নান্দনিকতায় আপ্লুত— যার অবস্থান বাঙলার অপর প্রান্তে।
অপর প্রান্তে নগরবাউল কবি অমিয় চক্রবর্তী সারাজীবন ঝড়ো হাওয়া পোড়ো বাড়ির মধ্যে সংগতি সাধনের চেষ্টায় ব্যাপৃত। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছে থেকেও তিনি আলাদা হতে পেরেছেন আপন সৃজনশৈলী অর্জনের মাধ্যমে। আজীবন ভ্রাম্যমান এই কবি খুঁজে ফিরেছেন জীবনের পরশপাথর। ‘খসড়া’, ‘একমুঠো’, ‘মাটির দেয়াল’, ‘দূরবাণী’, ‘পারাপার’, ‘পালাবদল’ প্রভৃতি কাব্য তাকে নাগরিক বাউল মনের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে; অনেক উৎকৃষ্ট সৃষ্টিও রয়েছে তাঁর। তিনি কাক্সিক্ষত কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং শিল্পসাফল্যও অর্জন করেন সৃজনশীলতার মৌলিকত্বে। তবে তাঁর চিন্তাচেতনা ও অনুভবের প্রাকৃতিক পটভূমিকা বঙ্গের সঙ্গে অধিকাংশ স্থানে সংগতিপূর্ণ নয়। বাঙলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে পৃথক হবার কারণে একটা দূরত্ব, ফাঁক বা ভিন্নতা থেকে গেছে বাঙলার সঙ্গে । শেষে জীবনে প্রবাস থেকে ফেরার তৃষ্ণায় কাতর হলেও তাকে প্রকৃত প্রত্যাবর্তন বলা যায় না— একে রোম্যান্টিক বিলাসিতা বলাই শ্রেয়। তাঁর প্রতীক-রূপক-চিত্রকল্প মূলত নাগরিক দৃষ্টির আহরণ। বঙ্গীয় জীবন ও প্রকৃতির পটভূমি তাঁর কাব্যে— প্রেরণা ও উপাদান— কোনোভাবেই কাজ করেনি। ফলে বাঙলার কবিরূপে প্রতিষ্ঠা বা ‘বাঙলার কবি’ পরিচয় তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, জুটেছে আধুনিক বা নাগরিক কবি হিসেবে, যে আধুনিকতা ধারণার উদ্ভব পশ্চিম থেকে। ‘ঘরে ফেরার দিন’, বা ‘হারানো অর্কিড’-এ কবি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন, তবে তা নাগরিক ও রাম্যান্টিক কবির এক ধরনের কাতরতা ও শখ। বাঙলার গ্রামজনপদ কবির কাছে এক ধরনের ইউটোপিয়া— এখানেই কবি শেকড়ের টানে ফেরার পিপাসায় অস্থির— এ ধরনের উপলব্ধি বা সান্ত্বনা শেষপর্বে কবিমনে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। ‘বৃষ্টি’ বা ‘বড়োবাবুর কাছে নিবেদনে’র মতো আরো কিছু কবিতা লিখলে হয়তো তিনি বাঙালির কবি হতে পারতেন; কিন্তু সে তো অসম্ভবের কথা।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশকে বুদ্ধদেব বসু ‘প্রকৃতির কবি’ বলেছেন— যার সমস্ত উপলব্ধি ও চেতনাস্রোত প্রকৃতির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’ ও ‘রূপসী বাংলা’র পর কবি চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক নৈরাজ্য-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধের প্রেক্ষিতে প্রকৃতির কাজ থেকে অনেকটা সরে আসেন। বিশ্বের চলমান ঘটনাবলী ও বিভিন্ন সত্যতার ইতিহাস তাকে আলোড়িত করে দারুণভাবে; ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘মহাপৃথিবী’, বা ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ নাগরিক সমাজ ও সভ্যতার অন্তর্দেশে বিক্ষুব্ধ ঢেউয়ের আঘাতচিহ্ন্। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, দার্শনিক ভাষ্য, সামগ্রিক বিচার ও মানবিকতার পক্ষবলম্বন কবিকে অনেক দূর নিয়ে গেছে। এই কবি তিরিশোত্তর অন্যান্য কবিদের মতো বাঙলার প্রকৃতি অনুভবে ও অঙ্কনে পাঠককে হতাশ করেননি। তাঁর প্রথম আত্মমুদ্রিত কাব্য ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘রূপসী বাংলা’য় কবি বাঙলাকে ভালোবেসে বাঙলার রূপ-রঙ-গন্ধের পরিপূর্ণ এক জগৎ নির্মাণ করেন। জসীমউদ্দীনের মতো গভীরভাবে মৃত্তিকালগ্ন ও শেকড়প্রোথিত না হলেও বাঙলার হেমন্ত ও শীতঋতুর চিত্ররূপময় গল্পকল্প কবি সৃষ্টি করেন। যদিও এলিয়টের পড়ো জমিনের প্রভাব তাঁর মাঝে বিরাজমান। তবু স্থানিক কৃষি বাস্তবতার আবহমানতা তিনি ধারণ করেছেন সযতেœ। ফলে হেমন্তের নদী, কুয়াশা, ফসল, ফসলকাটা পরবর্তী মাঠ, পাখি, লাঙল-কৃষক-চাষাবাদ, শিশিরের জল, খড়-নাড়া-পড়োজমি-খুদ, ধানক্ষেত, ইঁদুর-পেঁচা-জ্যোৎস্না, বাঙলার নিজস্ব রূপকথা, বিচিত্র ধান-ভাঁড়ার শস্য ইত্যাদি ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’তে বাক্সময়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তিরিশোত্তরকালে জীবনানন্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেছেন— উপনিবেশিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে স্বাদেশিক বোধ ও আপন প্রকৃতিলালিত ও ইতিহাসাশ্রিত ঐতিহ্য মুখ বের করে হাসির আলো ছড়াতে পারেনি। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত সেই কাব্যের জন্যে আমরা সেই সময়ের অনুজ্জ্বল, সমালোচিত ও অপাঙতেয় কবিকে সবার উপরে সশ্রদ্ধ স্থান করে দিয়েছি— বাঙলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে কি নির্মম কূটাভাস! সেই কালের লজ্জা এইকালে এসে গৌরব হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে— কবি বিচারের কি দুর্ভাগ্যজনক ব্যবস্থা। সান্ত্বনা এইটুকু যে, অনেক পরে হলেও এইকাব্যের মূল্যায়ন হয়েছে ও মূল্যমান সম্পর্কে উপলিব্ধি এসেছে অনেকের মাঝে। স্থানিক বা লোকজ আধুনিকতা ও স্থানিক আবহমানতাই যে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের মানুষের সৃজনকর্মের জন্য মানানসই, উন্নতির সোপন ও মুক্তির মূলসূত্র সে চেতনাবোধ ধীরে ধীরে সঞ্চরণশীল।
সেই বোধ থেকেই আমরা ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ ও ‘রূপসী বাংলা’কে বাঙলা কবিতার উজ্জ্বল দুটি আলোকস্তম্ভ রূপে বিবেচনা করি। কেননা ‘রূপসী বাংলা’য় কবি বাংলার পরিচিত-অপরিচিত গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, বনজ ও ফলজ বৃক্ষ-পাখি, রূপময় নদী-নৌকা মাছ, জলজ উদ্ভিদ-প্রাণি, মাঠ-মাঠের ফসল কিষাণ-কিষাণী, লোককাহিনী-রূপকথা-কিংবদন্তি, লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, সন্ধ্যাসকালের প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঋতুবৈচিত্র্য ও জ্যোৎস্নার রূপাবলী, বর্তমান ও অতীতের নারী সংশ্লিষ্টতা ও আকাক্সক্ষা-স্বপ্ন-দুর্ভাগ্য-বাস্তবতা, অসংখ্য কীট-পতঙ্গ, স্থানীয় ফুল-ফলের রূপরসগন্ধবর্ণময় এক পরিপূর্ণ বাঙলার পৃথিবী সৃষ্টি করেন পরম মমতা ও ভালোবাসায়। এই পরিবেশেই কবি সুখ-শান্তি-স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছেন, তাই অন্য কোথাও যেতে চাননি। বাঙলাকে, বাঙলার রূপময় প্রকৃতি-মানুষ-ঐতিহ্য ভালোবেসে কবি সকলের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করেছেন, এই কাব্যের একমাত্র যে সীমাবদ্ধতা তা হলো বাঙলায় বিরাজমান কৃষিভিত্তিক প্রাকৃতিক ও লৌকিক বর্তমানতার অনুপস্থিতি। নিরাসক্ত পাঠক সেই ঘাটতিটুকু মেনে নিয়েই প্রাকৃতিক ও লোকঐতিহ্যিক চলচ্চিত্র মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করে সেই প্রসাদের স্বাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেন না।
পশ্চিম সাগরের নোনা হাওয়া আর পানির স্বাদ যারা যৌবনে গ্রহণ করেছেন, জীবনের পরিণত বা পড়ন্ত বয়সে তাদের অধিকাংশই আর সেই স্বাদ ভুলতে পারেননি। যেমন বুদ্ধদেবের মতো বিষ্ণু দে। পুরোপুরি নাগরিক কবি। এলিয়ট, লুই আঁরাগ ও পল এলুয়ারের উত্তরাধিকার নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি দুরূহ ও দুর্বোধ্য এক কাব্যভুবনের স্রষ্টা; অতঃপর তীব্রভাবে রবীন্দ্রজগতের মুগ্ধ প্রচারক। ‘উর্বশী ও আর্টেসিস’ কাব্যে কবি ‘বিদেশী পথিক’, তাই কবি স্বদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত। ‘চোরাবালি’র পশ্চিমা আবহাওয়ায় মনে হয় যেন বিদেশি কবিতার বাঙলা অনুবাদ; যদিও যথেষ্ট প্রাকরণিক সাফল্য ও উদ্দীপনাময় মনোভাবের প্রকাশ সেখানে ঘটেছে। তিনি কবিতায় বিদেশি পুরাণ, পশ্চিমের সহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রকলা, সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ ইত্যাদির রসায়নে এমন এক দুর্গম শিল্পশৈলী নির্মাণ করেন যা উদ্ধার করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন অসম্ভব হয়ে ওঠে। তীব্র মননচর্চা আর নাগরিক মনোদৃষ্টির এই কবি বাঙলার প্রাকৃতিক ভূগোলের সীমানা ছোঁয়া তো দূরের কথা, চোখ তুলে তাকানওনি। ‘পূর্বলেখ’-এ বাঙলার বাতাবরণে আসার চেষ্টা করেছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন। ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘সন্দীপের চর’-এ বাঙলার সাংস্কৃতিক ও লৌকিক ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে তিনি কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু বাঙলার কৃষিভিত্তিক প্রকৃতির রূপরসগন্ধ তাঁর কাব্যে প্রায় অনুপস্থিত। বন-বনানি ও সাঁওতাল-ওরাঁও সম্প্রদায়ের চিত্রায়ন আর বাঙলার প্রকৃতি ও বাঙালি কৃষকের জীবন সংগ্রাম অনেক ফারাকে স্পন্দমান। তাঁর কবিতার প্রাকৃতিক ভূগোল নান্দনিকতায় ও দার্শনিকতায় চিত্রিত। এই প্রকৃতি জীবন-জীবিকার জায়গা নয়, শুধু শ্রমহীন শান্তির আশ্রয়। তবে ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘সন্দ্বীপের চরে’ বিষ্ণু দে-র নাগরিক মন শান্তি পেতে চায় বাঙলার অরণ্যে-গ্রামে, চাষা-চাষীর আঙ্গিনায়— তাঁর কবিতার মূল স্রোতধারার সঙ্গে যা কিছুতেই মেলে না, মনে হয় ‘দ্বীপ’ যেন দূরে উঁকি দিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, আবহমান ও স্থানিক বাঙলার প্রাকৃতিক ভূগোলের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা গড়ে ওঠেনি কখনো; নাগরিক কবি নগর, নগর বাস্তবতা, দৈশিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক সংকট, বিশেষভাবে পশ্চিমের দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ তাকে প্রধানত ও বারবার উদ্বেলিত করেছে। ফলে বাঙলার কবি ‘হয়ে ওঠা’ হয়নি তাঁর, হয়েছেন বুদ্ধিবাদী, বিদগ্ধ, পণ্ডিত, আঁরাগ-এলিয়ট ভক্ত, পশ্চিমমুখী কবি।
তিরিশোত্তর কালের নেতিবাচক প্রভাব পরবর্তী কালেও পড়েছে, ফলে তাদেরকেও আপন পরিচয়ের প্রশ্নে দ্বিধাহীন হতে দেখা যায় না। আহসান হাবীরের ‘দুহাতে দুই আদিম পাথর’, ফররুখ আহমদের ‘মুহূর্তের কবিতা’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘একক সন্ধ্যায় বসন্তে’র আমার পূর্ব বাংলা, সানাউল হকের ‘নদী ও মানুষের কবিতা’ বা হাসান হাফিজুর রহমানের ‘বিমুখ প্রান্তর’কে বাঙলা কাব্যে অবশ্যই উজ্জ্বল ও মৃত্তিকাস্পর্শী বলতে হবে। এইসব কাব্য তাদের সমগ্র কাব্যের মাঝে দ্যুতি ছড়ায়, কিন্তু তাদের সমগ্র কবিসত্তার প্রতিনিধিত্ব করে না। আবার এসব কাব্যে বাঙলার প্রকৃতিদর্শনে কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি রোম্যান্টিক; কিন্তু বাঙলার প্রকৃতি মোটেই রোমান্টিক নয়, কঠোর বাস্তব। সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। বাস্তবভিত্তির উপরে কল্পনার সবুজ বিনির্মাণ যদি তারা করতেন, তবেই তারা বাঙলার সঙ্গে সহজ, স্বাভাবিক ও প্রকৃত আত্মীয়তা রচনা করতে পারতেন। সান্ত্বনা এইটুকু যে, কাছের না হলেও দূরের কুটুম হতে পেরেছেন।
যেটুকু ফাঁক চল্লিশের কবিদের মাঝে দেখা গেছে, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনোত্তর বাঙলা কবিতায় তার পূর্ণতা দিয়েছেন কয়েকজন কবি: আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ ও ওমর আলী। ওবায়দুল্লাহর ‘সাত নরী হার’, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ ও ‘বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ বাংলাদেশের আবহমান প্রাকৃতিক পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকজীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও উদ্দীপনাসহ এক সুগভীর ব্যঞ্জনা অর্জন করে। বঙ্গীয় ভূমি ও ভূমিব্যবস্থা যে সখের জায়গা নয়; লড়াই, কর্ষণ এবং শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্র তা তিনি উচ্চস্বরে ব্যক্ত করেন। জমিন ও উৎপাদনকেন্দ্রিক হাজার বছরের বঞ্চনা ও সংগ্রাম বংশ-পরম্পরায় বাঙালির রক্তে ও জীবনেতিহাসে প্রবহমান, সেই উত্তরাধিকার সমকালীন জীবনেও তাৎপর্যপূর্ণ— এই উপলব্ধি অসামান্য কাব্যভাষায় বাণী লাভ করে তাঁর হাতে। তিরিশের অনিশ্চয়তা ও নেতিবাচক দৃষ্টি ও দর্শনের অপর প্রান্তে জীবনকেন্দ্রিক এক জাগর-আশান্বিত-দ্বন্দ্বমুখর-সংগ্রামরত চেতনাস্রোতের সৃষ্টি করেন। সেজন্যে তাঁর নায়ক একজন কৃষক, সাহসী ও সংগ্রামী পুরুষ, যে জমিনে বীজ বপন করে সন্তানের জন্যে, লড়াই করে বাঁচে, মরে আবার লড়াই ও সংগ্রাম করে উত্তর প্রজন্মের জন্যে।
এই কাজটি সামগ্রিকভাবে সুসম্পন্ন করেন আল মাহমুদ। বাঙলার প্রাকৃতির ভূগোল অঙ্কনে এই কবি অনন্যতা উপার্জন করেন। আল মাহমুদের কাব্যযাত্রা আজীবন বাঙলার প্রকৃতির মধ্য দিয়ে। একদিকে বাঙলার প্রকৃতির প্রাণচাঞ্চল্য, সৌন্দর্য, বিশালতা, বর্ণবৈভব অর্থাৎ নান্দনিক ও দার্শনিক রূপ ; অন্যদিকে প্রকৃতি জীবন-জীবিকার অবলম্বন, ধ্বংসাত্মক হিংস্রতা বা বাস্তবরূপে বিরাজমান। এই দুই রূপ তাঁর কাব্যে বিশেষ ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। কারণ কবির প্রধান বিষয় নারী; তারপরেই প্রকৃতি। তবে এই প্রকৃতি পশ্চিম বাংলার নয়, পূর্ববাংলার। হুমায়ুন কবির নির্দেশিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অবিরাম স্রোতধারায় নতুন জগতের সৃষ্টি ও পুরাতনের ধ্বংসময় পূর্ববাংলার প্রকৃতি তাঁর আরাধ্য। আবার জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের কবিতায় অঙ্কিত প্রকৃতি আর আল মাহমুদের প্রকৃতি একরূপ নয়। কারণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, দুর্ভিক্ষের সময় কবির কৈশোর কেটেছে। জীবনানন্দের ও জসীমউদ্দীনের বাঙলাদেশ তিনি দেখেননি; সেজন্যে এ-দেশকে কবি ‘সোনার বাংলাদেশ’ বলতে পারেননি। কেননা তিনি ‘নদীর পাড়ভাঙা বাংলাদেশ’ দেখেছেন। অন্যদিকে কবি নিজেকে একজন চাষীর সমগোত্রীয় মনে করেন; যার অন্যতম প্রধান বিবেচ্য হলো প্রকৃতি: বৃষ্টি, বৃষ্টিসিক্ত প্রাণময় ফলবান মাটি; যে মাটি সবুজ সীমাহীন ফসলের মাঠ ও জীবন-জীবিকার ভিত্তি গড়েছে। সেজন্যে কবি ‘একটি চাষীর মত’ ‘সমস্ত প্রাকৃতিক আয়াত’ শিখেছেন। এখানেই প্রকৃতিকেন্দ্রিক কবির স্বতন্ত্র মনোভাব প্রকাশিত। বাংলা কবিতায় বহুদিন থেকে মুগ্ধ ও আবিষ্ট চোখে প্রকৃতি বর্ণনার যে ধারা চলে আসছিলো, তার সঙ্গে কবি প্রকৃতির বাস্তব ও স্বাধীন রূপের চিত্র আঁকেন।
প্রথম জীবনে কবি প্রকৃতির নান্দনিক ও দার্শনিক দিকটির প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। প্রকৃতি সৌন্দর্য, মুগ্ধতা, অবসর, সূক্ষè অনুভূতি, বোধ ইত্যাদির আধার; রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ দাশের কাব্যসৃষ্টি ও ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রথম জীবনে কবির মাঝে এ ধরনের মনোভাবের সৃষ্টি হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তরে’ মূলত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। প্রকৃতির মাঝে প্রকাশিত ও উৎসারিত সৌন্দর্য ও ধ্বনির প্রতি কবি মুগ্ধ হয়ে নিজেকে ‘ধ্বনির যাদুকর’ ও ‘জলপানশব্দের শিকারি’রূপে চিহ্নিত করেন। ‘কালের কলস’ থেকে তাঁর চিন্তাধারা পালটাতে শুরু করে।
আবহমানকাল ধরে অনার্য বাঙালি কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মূলে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন-ব্যবস্থা বর্তমান। এ-দেশের কৃষক প্রকৃতি বলতে কৃষিক্ষেত্রকেই বোঝে। তাঁর জীবন ও জগৎ ভাবনার কেন্দ্রে প্রকৃতি কার্যকর। কৃষিভিত্তিক প্রকৃতির রহস্য ও শৃঙ্খলা জ্যোতিষী খনা নিখুঁতভাবে গণনা করতে পারতেন। বিশেষভাবে ঋতু ও আবহাওয়ার সঙ্গে ফসল উৎপাদনের নির্ভুল সূত্র তাঁর বচনে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে কবি প্রকৃতি-অভিজ্ঞ খনাকে সামনে আনেন। কবির মতে, প্রকৃতির ছদ্মবেশ বা রহস্য ব্যাখ্যা করেন বিদূষী নারী খনা। প্রথম পর্বে ‘প্রকৃতি’, দ্বিতীয় পর্বে ‘কবির বিষয়’ এবং তৃতীয় পর্বে ‘খনার বর্ণনা’য় খনাকে প্রকৃতি ভাবনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিরূপে উপস্থাপন করেন। কবি খনাকে ‘প্রকৃতির ছায়া’রূপে অভিহিত করে তাঁর গুরুত্ব তুলে ধরেন। আল মাহমুদের কবিতায় বারবার একই সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। প্রকৃতির নান্দনিক-দার্শনিক রূপের অপর পিঠে আছে প্রকৃতির বাস্তব চিত্র। কৃষকদের চাষাবাস করার এবং চাষবাসের মধ্যে জীবনযাপনের করার অধিকার আছে। সেজন্য প্রতিটি কৃষকের সঙ্গে প্রতিটি কৃষক, প্রতিটি কৃষকের ঘরনীর সঙ্গে প্রতিটি কৃষক পুরুষ, তার হালবলদের সঙ্গে তার জমিজমা যুক্ত। এই যুক্ততা একই সঙ্গে ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক। বাঙলা ও বাঙালির ইতিহাস পরিপূর্ণ হয়ে আছে কৃষকের জমি ও জমির ফসল দখলের কাহিনীতে। বৌদ্ধযুগের অবসানে বাংলায় ব্রাহ্মণ্য শাসন, শোষণ, বর্ণপ্রথা, বিভেদ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের কারণে সমাজজীবনে শান্তি, সাম্য ও নিরাপত্তা ছিলো না। কৃষকের উৎপাদিত শস্য লুণ্ঠিত হয়ে যেতো। নারীর চেয়ে শস্যের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন সেই সময়ের বাঙালি কৃষকের আর্তি শোনা যায় ‘সোনালি কাবিনে’। প্রকৃতি ও নারীভাবনা ইতিহাসের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে।
আল মাহমুদ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়। শেষ পর্যন্ত কবি তাই প্রকৃতি বলতে দেশজননী বুঝেছেন। প্রথম পর্বে প্রকৃতি কবির কিষাণী নারী আর তৃতীয় পর্বে দেশ হলো কবির মা; মায়ের অঙ্গ-প্রতঙ্গ হলো প্রকৃতি। তাই তাঁর দেশ আর দেশের প্রকৃতি অভিন্ন। বঙ্গজননী আর প্রকৃতি অঙ্গাঙ্গিরূপে বিরাজমান। বস্তুত আল মাহমুদের নারী ভাবনা, স্বদেশচেতনা ও প্রত্যাবর্তন, সমাজচেতনা, ঐতিহ্যমুখিতা অর্থাৎ মৌলিক সকল কিছুর পটভূমি হলো প্রকৃতি। গ্রামের চাষা-হালবলদ, লাউয়ের মাচায় সিক্ত নীল শাড়ির নিশান, দূরের নদী-হাটের নাও-মাঠ, জোনাক পোকা, ধানক্ষেত, ফুল-বসন্তের পাখি, নারীর ধানঝাড়া, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি ইত্যাদির মাঝে কবির বসবাস। তাই কবি মানুষের বাসস্থান, লাউমাচা, নীলাম্বরী নিয়ে থাকতে চান। নদীর নাচের ভঙ্গি, পিতলের ঘড়া, হুঁকোর আগুন, চুড়ুইয়ের বাসা, নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখি, পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ, মাছের আঁশটে গন্ধ, কুরুলিয়ার পুরনো কই ভাজা, সোনালি খড়ের স্তুপ, কলাপাতায় মোড়া পিঠার মতো হলুদমাখা চাঁদের জোছনাময় প্রকৃতির মাঝে কবি বসতি গড়ে তোলেন।
আল মাহমুদ প্রকৃতি বলতে প্রধানত জমিনকে ভেবেছেন। তাঁর কবিতায় একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে এই জমিন। জমিন বা মাটিই পৃথিবীর প্রধান উপাদান। জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন এই মাটি। নিসর্গ, ফসল, প্রাণবৈচিত্র্য, খনিজ সম্পদ সব কিছুই মাটিকেন্দ্রিক। কবি মৃত্তিকা বলতে ফসলের মাঠ বোঝেন। মৃত্তিকার ছবি আঁকতে তাই দৃষ্টিনন্দন কোনো দৃশ্যের কথা তাঁর মনে আসে না; মনে আসে ফসল উৎপাদন বা ফসলভরা জমিনকে। এই কারণেই কবি ফলবতী নারীর সঙ্গে মাটির তুলনা করেছেন বারবার। ‘‘প্রকৃতি’’ কবিতায় কৃষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কবি মৃত্তিকাকে ভেবেছেন প্রিয়তমা নারী। আসলে কবি নিজেকে ভাবেন একজন বাঙালি কিষাণ, যে কিষাণ জমিনে কর্ষণ করে নারী ও সন্তানের জন্যে ফসল ফলায়; যেমন নারীদেহের জমিনে আবাদ করে সন্তান উৎপাদন করেন। শস্য ও সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র যথাক্রমে জমিন ও নারী। প্রাচীন কৃষিব্যবস্থা ও বিশ্বাসে নারী ও জমিনের উর্বরতাকে সমান্তরাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই নারীর দেহজমিনে কবি রহস্যের বীজ বা জন্মকণা বুনতে চান, চাষাবাদ করে ফসল ফলাতে ইচ্ছুক। কবি তাই গর্ভধারিণী হিসেবেও মাটিকে চিহ্নিত করেন।
তবে জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদদীনের গ্রামীণ নিসর্গ, জনপদ ও জীবন চিত্রণের ভঙ্গি আল মাহমুদ অনুসরণ করেননি এবং গ্রামীণ বাঙলায় তাদের পথে ফিরে আসেননি। বরং তিনি জয়নুল, কামরুল ও সুলতানের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি অনুসরণ করেন। এই তিন জনের ক্ষেত্রে কৃষকের ফিরে আসার অর্থ চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত করা: তাঁরা তিন জনই দৃশ্যমান বাস্তবের মধ্যে লুকানো অদৃশ্যমান বাস্তবতাকে চোখে মেলে ধরেছেন। আল মাহমুদ এঁদের মতো কৃষকের উপস্থিতিকে বাস্তবতা দিয়েছেন। কৃষকেরা মৃত নয়, অতীতের একটা অংশ নয়, তারা বিদ্যমানতা এবং বর্তমানতার মধ্যে জীবন্ত। তাই তাঁর কৃষক আধুনিক ঐতিহ্যের অংশ, ঐতিহ্যের অবদমিত অংশ এবং অবদমিত অংশের উপস্থিতি। এই উপস্থিতি শ্রেণীবিক্ষুব্ধতার পরিচয় নয়, কিংবা ধনদৌলত এবং ক্ষমতার বঞ্চিতকরণ নয়। এই উপস্থিতি জীবনের উপস্থিতি। কবির ফিরে আসা সেই কৃষকসন্তান তাই আবারো মিশে যেতে চায় নিজে সমাজে ও ঐতিহ্যে।
কবি যেমন ফিরে এসেছেন আপন জগতে, তেমনি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈশ্বিক আধুনিকতা। সে জন্য তাঁর কবিতায় কৃষক, পশুপাখি, হালবলদ, নৌকা ইত্যাদির প্রতীক ফিরে যাওয়ার, প্রত্যাখ্যান করার এবং নির্মাণ করার। এসব থেকে তৈরি হয়েছে নিজস্ব স্থানিক আধুনিকতার দুই পরিপ্রেক্ষিত এবং দুই পরিপ্রেক্ষিত উদ্ভূত স্থানিক বাঙালি সংস্কৃতি। বৈশ্বিক আধুনিকতার বিপরীত হচ্ছে স্থানিক আবহমানতা, এই আবহমানতা রুখে দাঁড়িয়েছে মেকি ও ফাঁপা আধুনিকতার বিপক্ষে। সে জন্য স্থানিকতা একই সঙ্গে আবহমানতা এবং প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ থেকে তৈরি হয় জীবনদর্পিতা: জমি-ধান-সন্তান-হালবলদ ও প্রেয়সীর জন্য রুখে দাঁড়ানোর ভঙ্গি। আল মাহমুদের মৌলিকতা এবং ঐতিহ্যবাদিতা সেই আবহমান বাঙলায় ফেরার পিপাসায় এবং প্রত্যাবর্তনের লজ্জায়। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সকল সংকোচ, গ্লানি ও লজ্জার উর্ধ্বে। তাই তিনি গাঁয়েই ফিরে এসেছেন; গাঁয়ের জমিনে, নদীতে ও নিসর্গে। অর্থাৎ বাংলার প্রকৃতিলগ্ন জীবনে কবির বিচরণ ও আহরণ স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক।
একুশোত্তর বাংলাদেশের কবিতার এই ধারায় কবি ওমর আলীর কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। যমুনার তীরবর্তী মানষের কথকতা, চরাঞ্চলের মাটিলগ্ন মানুষ ও প্রকৃতি, আবাদ-বিবাদ-মেহনত, আদিগন্ত ফসলের মাঠ, কর্ষণ, ভাঙনের দুদর্শা, প্রকৃতিলালিত কিষাণ-কিষাণীর গার্হস্থ্য ও আটপৌরে জীবনস্পন্দন-অনুষঙ্গ অর্থাৎ গ্রামীণ সংস্কৃতি তাঁর কবিতাকে বাঙলার কাব্যরূপে চিহ্নিত করেছে। নাগরিক জীবন ও পরিপার্শ্বের পরিবর্তে কবি স্থানিক আবহাওয়ায় বাঙলার প্রকৃতি চিত্রায়ণে তৃপ্তি ও গৌরব বোধ করেছেন— ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ সেই বোধকে বাক্সময় করে তোলে। বাঙলা কবিতার মূল ধারায় কবি নিজেকে নিয়োজিত করে বাঙলার কবি হতে পেরেছেন— এখানেই তাঁর বড় পাওয়া।
পরবর্তী কালে বাংলাদেশের কবিতায় এই ধারা প্রধানরূপে বিবেচিত হয়নি। তিরিশের কবিতার ভূত ও ভার এখনো বহন করছেন অনেক কবি। বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু কবি অবশ্য সেই চেষ্টা করেছেন, কিন্ত সামগ্রিকভাবে তা সুসম্পন্ন করতে পারেননি তারা। কারণ উপনিবেশিক চিন্তামুক্ত হয়ে তারা সাহসের সঙ্গে বলতে পারেননি আত্মতার কথা এবং চলতে পারেননি আত্মপথে, আপন গন্তব্যে। নব্বই দশকের অনেকেই এই ধারা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছেন এবং একুশ শতকের সূচনায় কোন কোন কবি স্বাধীন চিন্তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছেন— এখানেই আমাদের ভরসা ও ভবিষ্যৎ। প্রত্যাশা: স্বাধীন দেশের স্বাধীন কাব্যধারা আত্মপ্রতিষ্ঠা পাবে আপন পরিচয়ে ও মহিমায়।