সাহিত্যের প্রধান প্রবাহধারা থেকে বেরিয়ে কখন কীভাবে আপন স্বাতন্ত্র্যের অধিকারে শিশুসাহিত্য নিজের পৃথক অস্তিত্বের স্বীকৃতি লাভ করেছে সে কথা জানতে হলে বেশ খানিকটা পিছনে ফিরে দেখতে হবে। আবহমান বাংলার লোকায়ত সাহিত্যধারার মৌলিক প্রবণতাসমূহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ আজকের শিশুসাহিত্যের অনেক বৈশিষ্ট্য এবং লক্ষণই নিহিত ছিল লোকজীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত, পুরনো দিনের সেই সাহিত্যের মধ্যে। তবে হ্যাঁ, এ আলোচনার শুরুতেই একটি বিষয়ে স্পষ্ট হওয়া দরকার বলে মনে করি—বেশ কিছু স্বকীয় বৈশিষ্ট্য শিশুসাহিত্য নামের শাখাটির পৃথক অস্তিত্বের স্বীকৃতিকে এক সময় অনিবার্য করে তুলছে বটে, এ শাখার মর্যাদাপূর্ণ স্বাতন্ত্র্যের কথা মানতেও হবে, তাই বলে সাহিত্যের প্রধান প্রবাহ থেকে একেবারে বিছিন্ন করে শিশুসাহিত্যকে দেখা চলবে না কিছুতেই। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সমান গুরুত্ব দাবি করে শিশুসাহিত্যও—এই কথাটি মনে রাখতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে শিশুসাহিত্য কী? কত দূর এর পরিধি?
এক কথায় শিশুসাহিত্যের সংজ্ঞা র্নিধারণ মোটেই সহজ নয়। ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দবন্ধের পাশাপাশি কেউ কেউ কিশোর সাহিত্য ছোটদের সাহিত্য পদবাচ্যকেও দাঁড় করাতে চান। কেউবা শিশুদের জন্য রচিত সমুদয় সাহিত্যকে শিশুসাহিত্য বলছেন। কারো মতে—শিশু-চরিত্রের সন্নিবেশ এবং শৈশবজোড়া নানাবিধ কর্মকান্ডরে শৈল্পিক উপস্থাপনা ঘটে যে সাহিত্যে, তাকেই শিশুসাহিত্য বলা উচিত। শিশুর বয়স, মানসপ্রবণতা, শিক্ষা, পরিবেশ প্রভৃতি প্রপঞ্চকে বিবেচনায় রেখে শিশুসাহিত্য নিয়ে আরো অনেক রকম মতের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু সেসব বিতর্কে না গিয়ে শিশুসাহিত্য প্রসঙ্গে আমরা সবার আগে নানা রঙে বর্ণিল শিশুচিত্তের কথা বিবেচনা করি। সেখানে খেয়ালি দুরন্তপনা যেমন আছে, তেমনই আছে সম্ভবনাময় সৃজনশীলতাও; অন্তহীন কল্পনার সঙ্গে আছে মননশীলতার উম্মেষ এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশও। এই সব নিয়েই তো শিশুসাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতধারায় বহু পূর্ব থেকেই শিশুসাহিত্যের অনেক মৌলক উপাদান স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশে আছে, কিন্তু ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘মেয়েলি ছড়া’ নামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথই প্রথম ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করে এ সম্পর্কে অসাধারণ মনোগ্রাহী ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তাঁর বিচেনায় ‘অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্ম গ্রহণ করিতেছে।’ তিনি বলেছেন, ‘এই শিশু প্রকৃতির সৃজন। কিন্তু বয়স্ক মানুষ বহু পরিমাণে মানুষের নিজকৃত রচনা। তেমনি ছড়াগুলিও শিশুসাহিত্য; তাহারা মানব মনে আপনি জন্মিয়াছে।’
‘প্রকৃতির সৃজন’ বলেও স্বস্তি হয়নি রবীন্দ্রনাথের, বাক্যের শেষাংশে একটুখানি ব্যাখ্যা করে শিশুসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানিয়েছেন—‘তাহারা মানব মনে আপনি জন্মিয়াছে।’ এ প্রসঙ্গে আমরা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীরও শরণ নিতে চাই। ‘মানব মনে আপনি জন্মানো’ শিশুসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মূল্যবান অভিমত পাওয়া যায় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ সংকলনের ভূমিকায় প্রদত্ত বক্তব্যে। ‘ছড়াসাহিত্য’ এবং ‘শিশুসাহিত্য’ শব্দযুগল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি এগুলিকে ‘বাঙ্গালীর অকৃত্রিম প্রাচীন নিজস্ব সাহিত্য’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন, ‘বাঙ্গালীর গ্রাম্যসাহিত্য, বিশেষত বাঙ্গালীর শিশুসাহিত্য বা ছড়াসাহিত্য, যাহা লোকমুখে প্রচারিত হইয়া যুগ ব্যাপিয়া আপন অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছে, কখনও লিপিশিল্পের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, সেই সাহিত্য সর্ব্বতোভাবে অতুলনীয়।’
অতুলনীয় সেই শিশুসাহিত্যকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন, ‘বাঙ্গালীর অকৃত্রিম প্রাচীন নিজস্ব সাহিত্য।’ আর জন্মের স্বতঃস্ফূর্ততাকেই যেন-বা শিশুসাহিত্যের প্রধান গুণ বলে শনাক্ত করেন রবীন্দ্রনাথ। তবে হ্যাঁ, দু’জনেই ছড়াসাহিত্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে শিশুসাহিত্যের মূল প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্লাবি প্রতিভা ছড়া তো বটেই, শিশুসাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও (কিশোরকবিতা, নাটক, গান,গল্প প্রভৃতি) বিপুল পত্রপুষ্পের বিকাশ ঘটিয়েছে। সেই বিবেচনাতেই ড. হায়াৎ মামুদ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শিশুসাহিত্যের বিকাশপর্ব শুরু এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বাঙালি বিদ্বোৎসমাজকে তিনিই প্রথম বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন যে, শিশুসাহিত্য ব্যাপারটি উপেক্ষণীয় বিষয় নয়ই, বরং গুরুতর অভিনিবেশ দাবি করে।’
0২.
‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য’ প্রসঙ্গে বলতে গেলেই বাংলাদেশের জন্মের কথা এসে যায়। র্যাডক্লিফের বিভক্তির ছুরি অনেক আগেই (১৯৪৭-এ) বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫,) সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার স্থায়ী বাস্তবায়নে রক্তাক্ত ভূমিকা পালন করে, বিভক্ত দুই বাংলা দুই রাষ্ট্রের (ভারত ও পাকিস্তান) অন্তর্ভুক্ত হয়; কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। পূর্ববঙ্গ থেকে পূর্বপাকিস্তান হয় বাংলাদেশ। তবু আগের দিনের বঙ্গদেশ আর নয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিভক্ত বাংলাদেশ দেখেছে অনেক আগেই, একাত্তরে এসে পেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ, যুদ্ধজয়ী গর্বিত বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য সব কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়বে, সেটাই তো স্বাভাবিক। শিশুসাহিত্যও সেই প্রভাবের বাইরে নয়।
স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ১৯৭১ সালে, কিন্তু তার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের নানামাত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলন, ছষেট্টির ছয়-দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং বাঙালির বিজয়, অতপর অনিবার্য হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকেরা বাঙালির এই মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়েই সরব এবং সক্রিয় থেকেছেন লেখনির মাধ্যমে। পিছিয়ে থাকেনি শিশুসাহিত্যিকের স্বতঃস্ফূর্ত কলমও। শিশুরঞ্জনী ছড়া-কবিতা এবং উপদেশ ও নীতিমূলক গল্প-উপকথা দিয়ে বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্যচর্চার সূচনা হলেও গত শতকের ষাট এবং সত্তরের দশকে এ ধারায় ব্যাপক বাঁকবদল ঘটে। ফুল-পাখি-প্রজাপতির আনন্দময় রঙিন ভুবনের পাশাপাশি সমাজবাস্তবতার ছবিও মেলে ধরা হয় শিশু-কিশোর পাঠকের সামনে। ‘ঘুম পাড়ানো’ ছড়ার জায়গা দখল করে ‘ঘুম তাড়ানো’ ছড়া এসে। সমাজমনস্ক ছড়ার্”ার এই ধারা যে একেবারেই অভিনব, তা কিন্তু বলা যাবে না। আমরা তো সেই কবেই লোকছড়ায় পেয়েছি বর্গী তাড়ানোর আহ্বান—‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে…।’ ভারত-ভাগের ভুল রাজনীতিকে কটাক্ষ করে পঞ্চাশের দশকেই অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন—‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো!’ তাই বলা চলে বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্য বিশেষত ছড়াসাহিত্য বাংলাদেশ অধ্যায়ে প্রবেশের পূর্ব থেকেই যথেষ্ট সমাজমনস্ক এমন কি রাজনীতি মনস্ক হয়ে উঠেছে, তবে এই ধারা অধিকতর বেগবান হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের উত্তাল-সময়ে; ভাষা-আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের এই গৌরবময় কালপর্বে।
শুধু তাই নয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপ্রাপ্তির হতাশা-ক্ষোভ, আবারও প্রত্যাশার কথা ছড়ায় ছড়ায় ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছেন পরবর্তী সময়ের ছড়াকারেরা।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গর্ভে পাকিস্তানের জন্মলাভের পর বাঙালি মুসলিম কবি-সাহিত্যেকদের আদর্শিক দোদুল্যমানবতায় ভুগতে দেখা যায়, ভারত-প্রভাব শিশুসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও পড়ে। ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯), মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮/৬১-১৯৪১), যোগীন্দ্রনাথ সরকার (১৮৬৬-১৯৩৭) প্রমুখ লেখকের হাতে গড়ে ওঠা বাংলা শিশুসাহিত্যের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বপাকিস্তানের বেশ কিছু বাঙালি মুসলিম কবিসাহিত্যিক নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাবাদর্শের আলোকে সাহিত্যচর্চা চালু করেন। কিন্তু এ মোহ কটিয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালির ভাষাভত্তিকি জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের সূচনা হলে প্রায় অধিকাংশ কবিসাহিত্যিক মূলধারায় যুক্ত হন, তাঁদের হাতে আমাদের শিশুসাহিত্যও পত্রপুষ্পে বিকশিত হয়ে ওঠে। ‘মোদের গরব মোদের আশা/আ-মরি বাংলা ভাষা’ বলে গান গেয়ে বহুবছর আগে অতুলপ্রসাদ সেন যেভাবে মাতৃভাষার স্তুতি রচনা করেন, ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এ দেশের প্রায় সব কবি সেই ধারাতেই অসংখ্য ছড়া কবিতা রচনা করেন। তবে এঁদের কবিতা-ছড়ায় যুক্ত হয় শিমুল-পলাশ-রক্তজবার রং এবং ভাষা-শহিদের বুকের রক্ত। এইখানে এসে বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্যে অনন্য এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়, সৃষ্টি হয় নতুন জোয়ার। এই জোয়ার সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন ইব্রাহিম খাঁ, খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিন, জসীমউদদীন, বন্দে আলী মিয়া, মোহাম্মদ নাসির আলী, কাজী আবুল কাশেম, হোসনে আরা, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, হাবীবুর রহমান, রোকনুজ্জামান খান, ফয়েজ আহমদ, আতোয়ার রহমান, সাজেদুল করিম প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ।
মাতৃভাষার বন্দনা করে এবং মাতৃভূমির সৌন্দর্য বন্দনা করে কাব্যরচনা বাংলাভাষায় হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। মধুসূদন থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল হয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ পর্যন্ত কম কিছু হয়নি। কিন্তু মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের (১৬২০-১৬৯০) কবিতায় (যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি…) যে তীব্র কটাক্ষ এবং তীক্ষ্ণ ধারা উচ্চারণ ধ্বনিত হয়, এমন উচ্চকণ্ঠ বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলনের পূর্বে আর কারও কাব্যে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়নি বললেই চলে। মূলত ভাষা-আন্দোলন থেকেই বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানো, প্রতিবাদে মুঠি তোলা, রাজপথে নেমে আসা। আর এসবের প্রতিফলন ঠিকই ঘটেছে আমাদের শিশুসাহিত্যে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুক হক, আল মুজাহিদী, সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আহসান হাবীব, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, এখলাস উদ্দিন আহমদ, রফিকুল হক, সুকুমার বড়ুয়া, সিরাজুল ফরিদ, দিলওয়ার, মাহবুব তালুকদার, মাহমুদুল্লাহ, ফয়েজ আহমদ, গোলাম সারওয়ার প্রমুখ কবি এ দেশের শিশুসাহিত্যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ-বিদ্রোহের চেতনাকে যেভাবে সঞ্চারিত করেন, তাতে আবারও কবি আব্দুল হাকিমকেই মনে পড়ে যায়। সেই চড়াকণ্ঠই শোনা যায় একটু অন্যভাবে—
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়/বরকতেরই রক্ত।
কবি আল মাহমুদ কতো সহজেই এই কবিতার মধ্যে (একুশের কবিতা) অগ্নিযুগের আন্দোলনকেও একীভূত করে নিয়ে বলেন—
চিনতে নাকি সোনার ছেলে/ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণচূড়ায়/ঝাঁপ দিলো যে অগ্নি
ফেব্রুয়ারি শোকের বসন/পরলো তারই ভগ্নি।
‘জন্মেছি মাগো তোমার যে কোলে’ কবিতায় সুফিয়া কামাল বলেন—
এই বাংলার আলো বায়ু, জল, ফল ফসলের ঘস্খাণ
বাংলার ভাষা, এ বুকের আশা, এ ভাষা আমার প্রাণ।
কবি সিকান্দার আবু জাফর লেখেন—
আমাদের বাংলা ভাষা
আমাদের লক্ষ প্রাণের নিত্য দিনের
দুঃখ সুখের কান্না হাসা।
একুশের ভোরে সেদিনের ছাত্র-জনতার মিছিলের ভূমিকা কী রকম ছিল তার বিবরণ দিয়েছেন সিরাজুল ফরিদ তাঁর একুশেল গল্প’ কবিতায়—
দুঃসাহসে বুক পেতে নেয় গুলি/চর্তুদিকে রক্তঝরা আগুন,
উঠলো দুলে লালপলাশের শাখা/একুশ হলো আগুনঝরা ফাগুন।
কবি জ্যোতির্ময় মল্লিক কত সহজেই উচ্চারণ করেন—‘এই তো সেদিন’ কবিতায়—
মায়ের মত কেউ কি আছে সবার আগেই মা/মায়ের ভাষার সঙ্গে কিছুর হয় না তুলনা।
সেই ভাষাকে রুখতে বলো সাধ্য আছে কার?/জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দেব শত্রু হুঁশিয়ার।
‘পল্লীকবি’ নামে খ্যাত জসীম উদ্দীন একেবারে অনাড়ম্বরভাবে শুরু করেন তাঁর ‘বাংলা ভাষা’ কবিতাটি—
আমার এমন মধুর বাংলা ভাষা
ভায়ের বোনের আদরমাখা
মায়ের বুকের ভালোবাসা।
মাত্র দুটি চরণ পেরিয়ে এসেই কবিতাটির সুর পাল্টে যায়। কবি বলেন—
বসনে এর রঙ মেখেছি/ তাজা বুকের খুনে
বুলেটেরই ধূম্রজালে/ ওড়না বিহার বুনে।
ছড়াকার হাসান জান একেবারে সরাসরি লিখলেন ‘লালনীল ছড়া’ গ্রন্থে—
জান দিয়ে বরকত, জব্বার,
বাঁচালো মায়ের বুলি সব্বার।
এমনই সোজা কথা বলেন মাহবুব তালুকদার ‘অন্তর মন্তর’ নামের ছড়ায়—
পাকিস্তানের জিন্না
রাষ্ট্রভাষা বাংলাটারে/ কইরাছিলেন ঘিন্না,
তেনার পরে লাটবেলাটে/ দেশটা নিলেন কিন্যা।
একুশের ছড়া বা কবিতা লিখতে গিয়ে এ দেশের কবিদের রচনায় পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, রক্তগোলাপ ভিন্ন রকমের তাৎপর্য লাভ করেছে; ‘ফাগুন’ মাসও ভিন্ন ব্যঞ্জনায় চিত্রিত হয়েছে। এই প্রয়োগের দৃষ্টান্ত প্রায় সব কবির কবিতাতেই পাওয়া যাবে। কবি সৈয়দ শামসুল হক। ‘একুশে সকাল’ কবিতায় লেখেন—
পলাশ লালে শিমুল লালে/ রক্তরবির লাল
লালের চেয়ে লালে রাঙে/ একুশে সকাল।
জনপ্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন লেখেন—
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ গাছে গাছে আগুন
পলাশ শিমুল নিয়ে এলো/ আগুন লাগা ফাগুন।
কবি সুজন বড়ুয়া তো কুষ্ণচূড়ার কাছে প্রশ্নই তুলেছেন—
কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে, ভাই?
মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে,
আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বারবার
তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর?
বাঙালির ‘একুশে’ যখন ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে, তখন এই নতুন মাত্রা আবার একুশের ছড়া-কবিতায় নতুন জোয়ার আনে। কবি সুকুমার বড়ুয়া একুশ নিয়ে আগেও ছড়া লিখেছেন, আবারও লিখলেন—
বীর বাঙালির সাথে সাথে/ বিশ্ববাসী হাসো
হৃদয় দিয়ে মাতৃভাষা/ সবাই ভালোবাসো।
ভাষার লড়াই ছড়ায় ছড়াই গ্রন্থে রফিকুর রশীদ লেখেন:
এই তো সেদিন নিরানব্বই সনে/বিশ্ববাসী বাঙালিকে বেঁধেছে বন্ধনে
প্রবাসী দুই তরুণ বাঙালি ইউনেস্কোর কাছে/জানায় দাবি—আমাদেরও গর্বগাঁথা আছে।
অশ্রুভেজা রক্তমাখা সেই সে ইতিকথা/ সকল জাতির মাতৃভাষার চাইছে স্বাধীনতা।
শুধু ছড়া বা কবিতাতেই নয়, শিশুসাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও একুশের চেতনার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভাষা আন্দোলনের বেদনাবিহ্বল সংগ্রামী ঘটনার পেক্ষাপটে আমাদের গদ্যশিল্পী বা কথাশিল্পীরাও সাহসী কলম ধরেছেন, তাঁদের হাতে রচিত হয়েছে অমর একুশের নাটক, গল্প, উপন্যাস প্রভৃতি। এ ধারায় যারা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন তাদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন—জহির রায়হান, রণেশদাশ গুপ্ত, অজিতকুমার গুহ, আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, রিজিয়া রহমান, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, শাহরিয়ার কবির, বশীর আল হেলাল, হালিমা খাতুন, আবু কায়সার, সিরু বাঙালি, কাইজার চৌধুরী, ঝর্নাদাশ পুরকায়স্থ, মুস্তাফা মাসুদ, রফিকুর রশীদ, মঞ্জু সরকার, আমীরুল ইসলাম, সুজন বড়ুয়া, মনি হায়দার প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনের গল্প-উপন্যাস-নাটক শুধু নয়, ছোটদের উপযোগী ইতিহাসও রচিত হয়েছে। শিশুসাহিত্যে নতুন মাত্রা যুক্ত করার ব্রত নিয়ে যারা ভাষা-আন্দোলনের কিশোর ইতিহাস উপহার দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আব্দুল মতিন, মোহাম্মদ হান্নান, রফিকুর রশীদ প্রমুখ।
০৩.
আজ আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে একুশের রক্তেভেজা সিঁড়িতে পা রেখেই এ ভূখন্ডের বাঙালি নিজের ঠিকানা অন্বেষণে মনোযোগী হয়েছে, আপন জাতিসত্তার স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম পরিচয় প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে গড়ে তুলেছে দুঃসাহসী আন্দোলন। সামনে এসেছে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফার আন্দোলন, সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও বিজয় লাভ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় অর্জন, তথা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। জাতীয় জীবনের এইসব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সময়ের দাবিতে শিশুসাহিত্যের পরিধি বা দিগন্তরেখা সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধানত শিশুরঞ্জনী ও নির্মল সাহিত্যরস পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্য চর্চা শুরু হলেও পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে’ যুক্ত হয়েছে সমকালীন নানান বিষয়-আশয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন-সংগ্রাম, দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ, সামাজিক নানান সংকট-অবক্ষয়—এ সবই শিশুসাহিত্যের বিষয় হয়ে ঢুকে পড়েছে এবং অনায়াসে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। শিশুসাহিত্যের সব শাখায় এটা সমানভাবে ঘটেনি, ছড়া-ই সব চেয়ে প্রসারিত করে ছড়িয়ে দিয়েছে বাহু, ধারণ করেছে নানাবিধ বিষয় ও প্রসঙ্গ। অবশ্য কোনো কোনো সমালোচক এ ধরনের ছড়াকে বয়স্কজনের ছড়া বা বড়দের ছড়া বলে শিশুসাহিত্যের নির্মল- নির্দোষ শিশুবান্ধব সীমানার বাইরে ঠেলে দিতে চান। শিশুর পাঠরুচির প্রতি এই সহানুভূতি হয়তো একটা পর্যায় পর্যন্ত সমর্থনযোগ্য হতে পারে, কিন্তু বাংলা ছড়া বা কবিতার শৈল্পিক সম্প্রসারণ ক্ষমতা বা বিস্ময়কর ধারণক্ষমতাকে তো অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই।
শিশুসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা ছড়া। রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘মানব মনে আপনি যাহার জন্ম’, মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হতো যে ছড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কালক্রমে সেই ছড়া চলে এসেছে কলমের মুখে, উঠে এসেছে পোস্টারে-স্লোগানে, ছড়িয়ে পড়েছে দেয়াললিখনে। শিশুর মন ভোলানো ছাড়াও কত কাজ তার! এ প্রসঙ্গে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর মন্তব্য প্রাণধানযোগ্য। এক প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘ছড়া শুধু সমাজ-সংসার নিয়ে বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে….। ‘ভারত ভেঙে ভাগ করা বুড়ো খোকা’দের (রাজনীতিবিদদের) কটাক্ষ করে ছড়া লিখে অন্নদাশঙ্কর রায় যে ধারার সূচনা করেন, পরবর্তীতে সময়ের প্রয়োজনে সেইধারায় যুক্ত হন ফয়েজ আহমদ, আবদার রশীদ, মযহারুল ইসলাম, শামসুল ইসলাম, এখলাসউদ্দিন আহমদ, সুকুমার বড়ুয়া, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, লুৎফর রহমান সরকার, ফজল-এ-খোদা, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, আবু কায়সার, গোলাম সারওয়ার, সিরাজুল ফরিদ, মাহমুদউল্লাহ, আখতার হুসেন, প্রণব চৌধুরী, আলতাফ আলী হাসু, আবু সালেহ, আলী ইমাম, খালেক বিন জয়েনউদদীন প্রমুখ। ছড়ার প্রচলিত গন্ডি সম্প্রসারণে সত্তর দশকে এবং তারপরে আরো সম্ভাবনাময় যে সব ছড়াকার এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে আছেন— আবু জাফর সাবু, শাহাবুদ্দীন নাগরী, অজয় দাশগুপ্ত, নাসির আহমেদ, আসলাম সানী, ফারুক নওয়াজ, নাসের মাহমুদ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, সৈয়দ আল ফারুক, ফারুক নওয়াজ, রোকেয়া খাতুন রুবী, দীপংকর চক্রবর্তী, তপংকর চক্রবর্তী, সৈয়দ নাজাত হোসেন, খালেদ হোসাইন, আবু হাসান শাহরিয়ার, জোতির্ময় মল্লিক, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, রহীম শাহ, আলম তালুকদার, ফারুক হোসেন, হাসনাত আমজাদ, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, উৎপলকান্তি বড়ুয়া, আহমাদ মাযহার, রাশেদ রউফ, শফিকুর রাহী, জাকির আবু জাফর, তপন বাগচী, ওবায়দুল গনি চন্দন, আনজীর লিটন, মিজানুর রহমান শামীম, রোমেন রায়হান, সারওয়ার-উল ইসলাম, মালেক মাহমুদ, কামাল হোসাইন প্রমুখ। এইসব ছড়াকার ছড়াকে নিয়ে এসেছেন জীবনের নিত্যনৈমিত্তিকতায়, সমসাময়িক প্রসঙ্গে, রাজনৈতিক অঙ্গনে। আর সে কারণেই আমাদের ছড়াসাহিত্যের পক্ষে অনায়াসে সম্ভব হয়েছে সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে ভাষা-আন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান হয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কে নানান ধরনের ছড়ার বাঁধনে বেঁধে তোলা। শুধু তাই নয় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপ্রাপ্তির হতাশা-ক্ষোভ, আবারও প্রত্যাশার কথা ছড়ায় ছড়ায় ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছেন পরবর্তী সময়ের ছড়াকারেরা। পল্টনের ছড়া গ্রন্থে আবু সালেহ তীব্র কঁটাক্ষ হানেন এভাবে:
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা।
বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের নিজস্ব চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে ভাষা-সংগ্রামের বক্তব্যকে বাণীরূপ দেবার দায়িত্ব নেবার কারণে। আর ঠিক এইখানেই মৌলিক পার্থক্য পশ্চিমবাংলার ছড়াসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যচর্চার। অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ যথার্থই বলেছেন—‘ছড়া রচনা করেন যে কবিরা, তাঁরা আজ আর অর্থহীন কথার সুর ছড়াতে চান না। তাঁরা স্বপ্নের ফুল ফোটানোর সাথে সাথে বাস্তবের আগুনও জ্বালাতে চান।’
প্রায় সব বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক একাধিক শিশুসাহিত্য প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ছড়া এবং কিশোরকবিতার সংখ্যাধিক্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের ছড়ায় সেই ‘বাস্তবের আগুন’ যথার্থই জ্বলে উঠেছে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষিত থেকে, সেই আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। এ দেশের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম তুঙ্গে ওঠে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। কবি আল মাহমুদ তারই প্রেক্ষিতে লেখেন ঊনসত্তরের ছড়া:
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল।
প্রতিবাদের মিছিল তখন ছড়িয়ে গেছে গ্রামে-গঞ্জে, সারা দেশে। কবি শামসুল ইসলাম ‘মিছিল’ নামের ছড়ায় রমাকান্ত কামারকে সম্বোধন করে বলেছেন:
হাটে মাঠে গাঁও শহরে,
কি কারখানায়, কি বন্দরে
শোর উঠেছে জোর আওয়াজে
এ দেশ আমার আমার,
মিছিল চলে মিছিল চলে
নেই তো গরজ থামার।
বাঙালি কবি যে কত পরিহাসপ্রিয় হতে পারে তারও প্রমাণ মেলে আবু কায়সারের ছড়া ‘হাড়মাংসের ফানুস’-এ :
সেলাম হুজুর সেলাম,
গোঁ ধরতে নয়—এবার/ পোঁ ধরতে এলাম।
পরিহাস করে ওঠেন মাহমুদউল্লাহ ‘কেমন! কেমন!’ ছড়ায়:
পোটলা রাজার/ বন্দুক আছে,
বন্দুকে তার গুলি আছে,
কেমন গুলি!/ কেমন গুলি!
ভাঙতে পারে মাথার খুলি।
বাঙালির মুক্তির আন্দোলন তখন এতটাই আকাশচুম্বি যে ‘রাজার বন্দুকের গুলিকে তারা মোটেই ভয় পায় না। কারণ বাঙালি তখন নিজেকে চিনেছে, নিজেই ঘোষণা করে:
আমি বাঙালি আমার আছে/ বাংলা নামের দেশÑ
আমি বাঙালি আমার আছে/ বিশ্ব-পরিবেশ।
(আমি বাঙালি: আনোয়ারা সৈয়দ হক)
একাত্তরের উত্তাল মার্চে বাঙালির আবেগ, উৎকণ্ঠা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন-সংগ্রামের দিকনির্দেশ সবই ফুটে ওটে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে। কবি লুৎফর রহমান লিটন সেটাই ফুটিয়ে তোলেন তাঁর ছড়ায়:
সাতই মার্চে উথাল পাতাল দেশটা
চাইল সবাই দেখতে খেলার শেষটা—
(৭ই মার্চ ১৯৭১: লুৎফর রহমান রিটন)
কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখলেন—
অবশেষে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি—
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
পঁচিশে মার্চ রাতে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপরে যে পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে তার বিবরণ উঠে এসেছে অসংখ্য ছড়া এবং কবিতায়। তারই একটিতে বলা হয়েছে:
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে
পাকিস্তানি হায়েনাদের আচমকা হামলাতে
স্তব্ধ হলো ঢাকা শহর
নামলো আরো সৈন্যবহর;
ছাত্রাবাসে ছাত্র এবং গৃহকোণে মা
আবাল-বৃদ্ধ বনিতারও কান্না শোনে না।
মারলো মানুষ নির্বিচারে
ঘর পোড়ালো নির্বিকারে
এতই পশু দুধের শিশু রক্ষা পেলো না।
(যুদ্ধজয়ের গল্প: রফিকুর রশীদ)
এরপর আসে ছাব্বিশে মার্চ প্রথম প্রহর। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে বন্দি হবার আগেই ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি আদেশ দেন, শত্রুসৈন্য হটিয়ে বিজয় অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে। এই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে লেখা হয়েছে অসংখ্য ছড়া-কবিতা। কবি শফিকুর রাহী লেখেন:
একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ কী ভয়ানক রাত্রি
আমরা হলাম দস্যি কিশোর যুদ্ধজয়ের যাত্রী।
জয় বাংলার জয়ধ্বনিতে শত্রুকে দেয় রুখে।
কবি রোমেন রায়হান লেখেন:
বলছি কথা একাত্তরের/ ট্যাংক কামানের গোলায়
দুলে দুলে উঠলো এদেশ/ কী হবে কী-র দোলায়।
কী আর হবে! আত্মরক্ষার জন্য। জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা প্রস্তুত লড়তে। মা জননী তার সন্তানকে পাঠালেন যুদ্ধে:
খোকন সোনা ঘুমোসনে আর/ গ্রাম বাংলার ডাকে,
বর্গি তাড়া, কর মুক্ত/ বন্দিনী দেশ-মাকে।
(বর্গিতাড়ানো গান: রোকনুজ্জামান খান)
কবি মাহবুব তালুকদার লেখেন:
অহন ঘুমের দিন না
স্বাধীনতার বাদ্য বাজাও/ নাচো তা ধিন দিন না।
কবি আখতার হুসেনও সেই একই আহ্বান জানান:
ঢোল নাকড়া বাজা
দস্যু মেরে ছিনিয়ে নে তোর/ পাবার আচে যা যা।
এ দেশের ছাত্র-যুবক-জনতা বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেঢ়ে। হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। প্রাণপণ প্রতিজ্ঞায় ঝাঁপিয়ে পাড়ে যুদ্ধে। জনপ্রিয় বেতার কথক এম আর আক্তার মুকুল তাদের নাম দেন একাত্তরের বিচ্ছু। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘বিচ্ছু’ নামে ছড়া লেখেন:
বিচ্ছু এলো বিচ্ছু/ যায় না দেখা কিচ্ছু
খবর শুনে খান সেনাদের/ ঘাড়গুলো সব নিচ্চু।
শুধু ঘাড় নিচু নয়। নয় মাসের যুদ্ধশেষে তাদের পরাজয় মানতে হয়েছে, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। অতঃপর বাঙালির বহু প্রতীক্ষিত বিজয় এসেছে। বিজয় নিয়ে কত যে ছড়া-কবিতা রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই বিজয় আনতে গিয়ে এ দেশের মানুষের যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার বর্ণনা পাই—
ভাই গিয়েছে বোনকে ফেলে, বাপ ফেলেছে মাকে
মায়ের মানিক ধুলোয় গড়ায় কে বুকে নেয় তাকে।
(একাত্তর: সুজন বড়ুয়া)
কবি অনিন্দ্য বড়ুয়া তাঁর ‘একাত্তর’ নামের ছড়ায় জানান:
ডিসেম্বরের ষোল তারিখ/ শত্রু হলো দূর
নয়টি মাসের যুদ্ধ শেষে/ মাতৃভূমি উঠলো হেসে
সালটা একাত্তুর।
দাদুভাই ছদ্মনামে খ্যাত ছড়াকার রফিকুল হক বর্গী এলো দেশে গ্রন্থে প্রচলিত লোকছড়ার ভঙ্গিতেই আমাদের যুদ্ধজয়ের কথা বলেন এভাবে:
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা/ফুল তুলিতে যাই
সিসের বুলেট বিঁধলো বুকে/মরতে কি ভয় পাই?
বাপ মরেছে মা মরেছে/রক্ত ভরা নদী
ভেসে গেছে সেই নদীতে/রক্ষপুরের গদী।
বিজয় এসেছে ষোলই ডিসেম্বর। এই বিজয় আনতে যারা যুদ্ধে গিয়েছিল, তাদের সবাই তো ঘরে ফিরে আসেনি। পুত্রহারা মায়ের এখন কী সান্ত্বনা? কবি জানাচ্ছেন:
ভাই না ফিরুক ফিরেছে তার বসন রক্তমাখা
তাই দিয়ে মা কর না এখন প্রাণের পতাকা।
এই যে বিজয় পতাকা, স্বাধীন স্বদেশ, মাতৃভাষার জয়গাথা—এ সব পেতে কত যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, সুদীর্ঘ সেই অধ্যায় জেনে নেবার জন্য আজকের কিশোরকে আহ্বান জানান কবি ফারুক নওয়াজ—
এই সব পেতে হাজার বছর কেটেছে প্রতীক্ষায়,
হে কিশোর তুমি জেনে নিয়ো সেই সুদীর্ঘ অধ্যায়।
(এই যে তোমার বিজয় পতাকা: ফারুক নওয়াজ)
‘স্বাধীনতার গল্প’ নামের ছড়ায় কবি মসউদ-উস-শহীদ বলেন:
স্বাধীনতার গল্পে আছে/ যুদ্ধ এবং জয়
স্বাধীনতার গল্প মানে/ আত্মপরিচয়।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবের কথা বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে যে বিপুল সংখ্যক ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে, সেটাও উল্লেখের দাবি রাখে। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের অবিস্মরণীয় কবিতাটি আছে সবার ওপরে—
যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
এ এক বিস্ময়কর ঘটনাই বটে—যে মানুষটি কাঁধে বন্দুক নেননি, যুদ্ধেও ময়দানে যাননি, সেই মানুষটির নামে এবং নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে আমাদেও মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার অপর নাম হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতেই তার নামে অনেক দেশি-বিদেশি কবি সাহিত্যিক ছড়া-কবিতা লিখেছেন, গল্প-উপন্যাস-নাটকে উঠে এসেছে তাঁর উজ্জ্বল নাম: বস্তুতপক্ষে স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলা ভাষায় যে নতুন সাহিত্যধারা রচিত হয়েছে, তা দিনে দিনে বেগবান এবং সমৃদ্ধতর হতে চলেছে। মানতেই হবে যে এ সাহিত্যধারার প্রধান অংশ জুড়েই আছে শিশুসাহিত্যিকদের দর্পিত উপস্থিতি। তাদেও হাতে রচিত হয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক শিশুসাহিত্যের বহু বিচিত্র এবং নানামাত্রিক রচনাসম্ভার। এরই মাঝে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির উদ্যোগে পঞ্চাশটিরও অধিক বঙ্গবন্ধু বিষয়ক শিশুসাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় সব বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক একাধিক শিশুসাহিত্য প্রকাশ করেছে। এ ক্ষেত্রে ছড়া এবং কিশোরকবিতার সংখ্যাধিক্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিতদের পাশাপাশি এই নতুন সাহিত্যধারায় আরো যারা যুক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন:আহসান মালেক, রাশেদ রউফ, হাসনাত আমজাদ, জসীম মেহবুব, আহমেদ জসীম, অরুণ শীল, জাহাঙ্গীর আলম জাহান, ওয়াসিফ এ খোদা, সিকদার নাজমুল হক, স ম শামসুল আলম, রমজান মাহমুদ, ধ্রুব এষ, মোশতাক রায়হান, আকতার হোসাইন, বিপুল বিশ্বাস, হাসানাত লোকমান, শিবুকান্তি দাশ, সজল দাশ, চন্দনকষ্ণ পাল, চিত্তরঞ্জন সাহা চিতু, বাসুদেব খাস্তগীর, ব্রত রায়, আহমেদ সাব্বির প্রমুখ।
অসংখ্য ছড়াকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনবদ্য সব ছড়া/কিশোরকবিতা লিখেছেন। ভয়ানক বৈরী সময়ে লুৎফর রহমান রিটন সাহসী কণ্ঠে শেখ মুজিবের নামতা শুনিয়েছেন:
এক এককে এক
শেখ মুজিবের নামের আগে জাতির পিতা লেখ—
রোকেয়া খাতুন রুবী লিখেছেন:
আমার ভেতর আমি আছি/ আমার মতো করে
বঙ্গবন্ধু তোমায় চিনি /একশো বছর ধরে।
ফারুক হোসেন লিখেছেন:
এ ভাষণ, সে ভাষণ দিয়ে যাই সাক্ষ্য/শব্দের বিন্যাস, বর্ণ ও বাক্য
গব কথা সংক্ষেপে সহ এই ভাষণের/কাছে পাই প্রহসনরুপ দুঃশাসনের।
রাশেদ রউফ লিখেছেন:
উপমায় বিশেষণে নও তুলনীয়/সকলের ভালোবাসা সকলের প্রিয়
দেশের স্রষ্টা তুমি আলো-বাতিঘর/বঙ্গবন্ধু তুমি অজর অমর।
ছড়াকার হাসনাত আমজাদ তার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছড়া-কবিতাগ্রন্থ ‘এখানে এই টুঙ্গিপাড়ায়’ লেখেন—
এখানে এলেই বজ্রকন্ঠ কানে আসে বারবার
এখানে স্মৃতিরা বলছে মুজিব মানেনি কখনো হার
এখানে আছেন সেই মুজিবুর জাতির জনক যিনি
এখানেই এই টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমিয়ে আছেন তিনি।
৪.
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে ছড়া এবং কিশোরকবিতার উপস্থিতি অনেক বেশি সে কথা সত্যি, তাই বলে কথাসাহিত্যিকদের অবদানও কম কিছু নয়। ছোটদের জন্য তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন, তাও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বড়দের জন্য রচিত তাঁদের কথাসাহিত্যে তো বটোই, ছোটদের জন্য লেখা কথাসাহিত্যে ও তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্প-উপন্যাস শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা অবলম্বনে যে অল্প কিছু শিশু-নাটক বা কিশোর-নাটক রচিত হয়েছে, সেগুলিও আমাদের শিশুসাহিত্যের ভান্ডারকে সম্মৃদ্ধ করেছে। এমন কি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে শিশু-কিশোরোপযোগী যে সব জীবনীগ্রন্থ লেখা হয়েছে, এ প্রসঙ্গে সেগুলিও উল্লেখের দাবি রাখে। এইসব মিলিয়েই তো আমাদের শিশুসাহিত্য।
আমাদের এই গৌরবময় শিশুসাহিত্য কেবল বাংলা ভাষার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার প্রবল বিশ্বাস—এই বৃত্তের বাইরে বেরোতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধ প্রভাবিত বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের প্রকৃত বর্ণবিভার যথামূল্যায়ন হওয়া সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব, অহংকার। আমাদের শিশু-কিশোরেরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তাদের অন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেবার মানসে আমাদের দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিকেরা মুক্তিযুদ্ধের কিশোরগল্প এবং কিশোর উপন্যাস রচনা করেছেন। তরুণ ও নবীন কথাসাহিত্যিকের মধ্যে যারা জন্মগ্রহণ করেছে ১৯৭১ সালের পরে, তাঁরাও পিছিয়ে পড়তে রাজি নন, লিখে চলেছেন গল্প উপন্যাস—মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে। সাহিত্যিকেরা কথায় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে অনিঃশেষ সম্ভাবনাময় উৎস হয়ে উঠেছে, প্রতিদিনই এ ধারায় যুক্ত হয়ে চলেছে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্ম। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু এখানে আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু বই লেখকের নামের বিবরণ দিতে চাই।
মুক্তিযুদ্ধের আগেই সংঘটিত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে কথাসাহিত্যিক ফরিদুর রহমান রচনা করেন অনবদ্য এক কিশোর উপন্যাস দিন বদলের ডাক। কিন্তু হুমায়ূন আজাদের ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ সব বয়সের পাঠকেরই মন ছুঁয়ে যায়। আমজাদ হোসেনের ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ও মাইলফলক হয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদের সূর্যের দিন, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘কাজলের দিনরাত্রি’, শাহরিয়ার কবীরের ‘একাত্তরের যীশু’, ‘হারিয়ে যাওয়া ঠিকানা’, ‘আলোর পাখিরা’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘জাদুমানিক স্বাধীনতা’, ইশতিয়াক আহমেদের ‘মায়ের কাছে ফেরা’।
মঞ্জু সরকারের ‘একাত্তরের বোবাভূত’, আখতার হুসেনের ‘ফ্রিডম ফাইটার’, ‘নায়ের ছোট্ট মাঝি’, আনোয়ারা সৈদয় হকের, ‘তপনের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দাদাভাই’, ইমদাদুল হক মিলনের কিশোর উপন্যাস ‘সাত কিশোরের অভিযান’ ও ‘একাত্তরের মোসলেম ডাকাত’, কাইজার চৌধুরীর, ‘শোভনের একাত্তর, মুনতাসীর মামুনের ‘জয় বাংলা’, আমীরুল ইসলামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যি গল্প, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুস্তাফা মাসুদের ‘হিজলডাঙ্গার মুক্তিবাড়ি’, বেবী মওদুদের ‘জয় বাংলা’, হারুন হাবীবের ‘যুদ্ধে যাবোই’, আনিসুল হকের ‘একাত্তরের একদল দুষ্টু ছেলে’, শিহাব সরকারের ‘হাত বাড়ালেই সূর্য’, সুজন বড়ুয়ার ‘সূর্য ওঠার দিন’, ‘আলো ফুটবেই’, ঝর্না রহমানের ‘আদৃতার পতাকা’, রাশেদ রউফের ‘খোলা আকাশের দিন’, উৎপলকান্তি বড়ুয়ার ‘রাতুলের মুক্তিযুদ্ধ’, মালেক মাহমুদের ‘একুশ আমার পতাকা আমার’, লাল রঙের গল্প’, আতোয়ার রহমানের ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম’, আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘ছানা ও মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মুক্তিযোদ্ধার ছেলে’, ‘মুক্তিযোদ্ধার মা’, মোস্তফা হোসেইনের ‘একাত্তরের বীর কিশোর’, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরু বাঙালির ‘যুদ্ধশিশুর যুদ্ধজয়’, আপারেশন বিমান ঘাঁটি’, ‘আব্বুর জন্য যুদ্ধ’, ‘মাগো আমরা লড়তে জানি’, ‘অথৈ পেয়েছে পতাকা’, রহস্যময় প্লানেটে একুশ’, দীপু মাহমুদের ‘নীতুর ডায়েরী ১৯৭১’, রফিকুর রশীদের ‘বীরের মাটি, ‘অপারেশন জয় বাংলা’, ‘পিন্টুবাহিনীর যুদ্ধযাত্রা’, মনি হায়দারের ‘ঘাসফড়িং’, আমিনুর রহমান সুলতানের ‘বলধাগার্ডেনের গেরিলাকন্যা’, ফজলে আহমেদের ‘আমিও যুদ্ধে যাবো’, আশরাফুল আলম পিনটুর আনন্দবনের পাখিরা, আহমেদ রিয়াজের ‘আঙ্কল গ্রেনেড ও তার দল’, ‘একাত্তরের বীরবিচ্ছু’, ‘একাত্তরেরর রবিনহুড’, ‘মতিরাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা সবুজ’, সারওয়ার-উল-ইসলামের ‘লাল সূর্যের দেশ’, আমেনা আফতাবের গল্প—‘তিনকিশোরের যুদ্ধে যাওয়া’, নাসরীন মুস্তাফার—‘একজোড়া সবুজ চোখ’, ইফতেখার হালিমের কিশোর গল্প ‘পতাকা আমার দেশ’। ঝর্ণা রহমানের- আদৃতার পতাকা, হুমায়ূন কবীর ঢালীর- একাত্তরের মিলিটারি ভূত, শিবুকান্তি দাশের- মিলিটারি এলো গ্রামে, ইসহাক খানের বিচ্ছু গেরিলা, ইশতিয়াক আলমের মায়ের কাছে ফেরা, পান্না কায়সারের হ্র্রদয়ে একাত্তর, মোজাম্মেল হক নিয়োগীর শরণার্থী শিবির থেকে, ধ্রুব এষের রেডিও কার্তিকপুর, স্বদেশ রায়ের মাইনের খোঁজে, রবিউল হুসাইনের কুয়াশায় ঘওে ফেরা, নাসিমা আনিসের সূর্য ওঠার সময়, প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস আমাদের শিশুসাহিত্যের জগতে নতুন দিগন্তের উম্মোচন করেছে। বাংলা ভাষায় শিশুসাহিত্য চর্চার চিরায়ত যে ধারা প্রবহমান মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য সেখানে পৃথক মাত্রা যোগ করেছে এবং শিশুসাহিত্যকে সম্মানজনক স্তরে অভিষিক্ত করেছে।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে যুগে যুগে বহু আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ-বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, কখনো তা সফল হয়েছে কখনো বা ব্যর্থও হয়েছে। সাফল্য-ব্যর্থতা যাই ঘটুক, সমাজে-সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে এ ধরনের বৈপ্লবিক কর্মকান্ডরে প্রভাব না পড়ে পারে না। নিকট-অতীতের রুশ-বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। বিপ্লবের প্রভাবে রুশসাহিত্য ব্যাপক সম্মৃদ্ধ হয়েছে, রুশ ভাষার শিশুসাহিত্যে এসেছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন; বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় যেমন ছড়িয়ে দওেয়া সম্ভব হয়েছে, তেমনি তা আবার বিশ্বের সেরা মানের শিশুসাহিত্য বা কিশোরসাহিত্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনেও সক্ষম হয়েছে।
এমনটি আমরা আশা করতে পারি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রেও। বহু বছরের লড়াই-সংগ্রাম শেষে নয় মাসব্যাপী প্রত্যক্ষ জনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা পেয়েছি গণমানুষের প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের শিশুসাহিত্যে সেই যুদ্ধজয়ের প্রভাব নিশ্চয় পড়েছে এবং বিশ্বমানের অনেক সাহিত্য রচিতও হয়েছে। হয়নি কেবল বিশ্বদরবারে তার আলোকিত উপস্থাপন। কে করবে, কীভাবে হবে সেটা, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণাও হতে পারে। কিন্তু দায়িত্ব তো নিতেই হবে কাউকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, শিশু বিষয়ক এবং সংস্কৃতি বিষয়ক পৃথক পৃথক মন্ত্রণালয় আছে ঠিকই, যুদ্ধজয়ী জাতি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রভাবিত সেরা শিশু বা কিশোরসাহিত্যকে নানান ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা শিশুসাহিত্যের পাশাপাশি উপস্থাপনের উদ্যেগ নেবার কেউ নেই। ফলে আমাদের এই গৌরবময় শিশুসাহিত্য কেবল বাংলা ভাষার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার প্রবল বিশ্বাস—এই বৃত্তের বাইরে বেরোতে পারলেই মুক্তিযুদ্ধ প্রভাবিত বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের প্রকৃত বর্ণবিভার যথামূল্যায়ন হওয়া সম্ভব।