দুই.
বলরাম হাড়ি ছিলেন খানিকটা উদার-উদাসীন-আবেগপ্রবণ মানুষ। কোনো বিশেষ সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত না করেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন হরিজন সম্প্রদায়ের হরি। সত্যবাদিতাকে চরিত্রের মহৎগুণ হিসেবে তিনি বিবেচনা করতেন। তাই ভক্তদের নির্দেশ দিতেন ‘সদা সত্য বলবে।’
আঠারো শতকের শেষদিকে মেহেরপুর অঞ্চলের অসহায় নিম্নবর্ণের মানুষ ওপরতলার বিদ্বেষ ও জমিদারদের নিষ্পেষণে কোণঠাসা হয়ে পড়লে বলরাম তাদের জন্য একটি স্থান প্রস্তুত করতে চেষ্টা করেছিলেন। কোনোরকম সংঘাত ও বিদ্বেষের পথে না হেঁটে তিনি নীরবে নিভৃতে সঙ্কীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যাকে পরিত্যাগ করে উদার মানবতার জয় ঘোষণা করলেন। বয়কট করলেন মূর্তিপূজা, তীর্থভ্রমণ, শাস্ত্রনির্ভরতা ও আচারসর্বস্ব ধর্মচর্চা। এ প্রসঙ্গে সুধীর চক্রবর্তী বলেন—‘মেহেরপুরের রামহাড়ি…ব্রাত্যজনের বাঁচবার জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। নিছক প্রতিবাদ নয়, টিকে থাকাও। সঙ্কীর্ণশাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা। তাই মূর্তিপূজা, অপদেবতা পূজা অকারণ তীর্থভ্রমণ, দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্রনির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে এঁদের অস্ত্র ছিল জাতি ভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মাচরণ’।১৩
বাংলায় যত লোকধর্মের আবির্ভাব হয়, সব ধর্মের অবতারই মানবতায় বিশ্বাসী। ‘ঠাকুর দেবতা নয়, মানুষ ভজো’—এই বিশ্বাসের জন্য লোকধর্ম জনপ্রিয়তা পেয়েছে। হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিনাশ, যাগযজ্ঞ ও আড়ম্বরতা পরিহার করে যে সব লোকায়ত ধর্মের আবির্ভাব, তার মধ্যে বলাহাড়ি বা বলরামী সম্প্রদায় আরও একধাপ এগিয়ে। কোনো কোনো লোকধর্ম যেমন—কর্তাভজা-ভগবানিয়া, সাহেব-ধনী সম্প্রদায় অবতার তত্ত্ব মানে কিন্তু বলারামের শিষ্যরা অবতারতত্ত্ব ও বৈষ্ণবতার ঘোরবিরোধী। হাড়িরাম নিজেকে কারও অবতার হিসেবে ঘোষণা দেননি। তিনি বলেছে, ‘আমি আপন শরীর হইতে এ পৃথিবীর সৃষ্টি করিয়াছি। লোকে আমাকে নিচে হাড়ি বলিয়া জানে, কিন্তু আমি সাধারণত হাড়ি নহি আমি হাড়ের সৃষ্টি করিয়াছি তাই আমি হাড়ি’।১৪ তিনি আরও বলেন, ‘আদিকালে কিছুই ছিল না, আমি আপন শরীরের ‘ক্ষয় করিয়া অর্থৎ আপনার শরীর হইতে লইয়া এই পৃথিবী সৃষ্টি করি। এই নিমিত্ত ইহার নাম ক্ষিতি হইয়াছে।১৫ শুনতে পাওয়া যায়, যে স্বয়ং সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় বলে আভাসে আপনাকে পরিচয় দিতো।১৬ তিনি নিজেকে ‘রামদীন’ বলতেন। ‘রা’ মানে পৃথিবী, ‘ম’ শব্দে জীবের আশ্রয়, ‘দীন’ শব্দে ‘দীপ্তাকার হয়’—এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বলরাম হাড়ি নিজে অবতার হিসেবে নয় স্রষ্টা হিসেবেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সুধীর চক্রবর্তী বলেন—‘লক্ষ করলাম, বলাহাড়ি ত্রেতা যুগের রামচন্দ্র বা দ্বাপরের বলরামের অবতার বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি। নিজেকে বসিয়েছে এ সবের ঊর্দ্ধে, নিজের নাম দিয়েও ‘রামদীন’।১৭ বলরাম হাড়ির ভক্ত বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘তিনি বলে গেছেন, সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি এই চার যুগের আগে ছিল দিব্যযুগ। সেই সময় তেনার জন্ম। তার মানে সব অবতারের আগে তার জন্ম।১৮ অবতারবাদী শাস্ত্রীয় ধর্মগুলোর বিরুদ্ধে—এ এক চরম প্রতিবাদ। তার অনুসারী ভক্তরা কারও পূজা করে না, কোনো ঠাকুর দেবতার নাম উচ্চারণ করে না, কোনো মূর্তি বা ছবি বা গাছকে পূজা করে না এমনকি কাউকে প্রণামও করে না। শুধু রামদীনকেই ডাকে। তাই ভক্তরা ভক্তি ভরে গায়:
ওগো রামদীন নিয়ে চলো আমায়
তোমার আলোক পথে
আমি চেয়ে আছি, তোমার আশার আলো
জীবনে মরণে হাসিতে খেলিতে রও সাথে ॥
ভক্তরা যতই ‘রামদীকে’ ডাকুক তারা মূলত মানুষ ভজনে বিশ্বাসী আর তাই বলরাম হাড়ি শাস্ত্রকে অগ্রাহ্য করেছেন; অগ্রাহ্য করেছেন বর্ণবাদী প্রথাকে। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের অন্তরে যেখানে ভেদ সেখানে তাদের শাস্ত্রের শাসনে ভেদজ্ঞান থাকবেই। আর তাই তারা গায়:
হাড়িরাম তত্ত্ব নিগূঢ় অর্থ বেদ বেদান্ত ছাড়া।
করে সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্য সেই পেয়েছে ধরা।
মানুষ , তাদের মতে কারিকর হাড়িরামের সৃষ্টি ঈশ্বরের নয়।’১৯ অতএব জাতপাতের বাড়াবাড়ি তাদের নেই। মানুষ হয়ে হাড়িরাম নিজেকে ঈশরের অধিক বলে ঘোষণা করে প্রমাণ করলেন—‘মানুষই ঈশ্বর’। ঈশ্বর কোনো ঘটে-পটে মূর্তিতে নেই, ঈশ্বর কোনো শাস্ত্রে নেই, তীর্থে নেই। ঈশ্বর আছেন মানুষের মধ্যে, নিজের মধ্যে। কিন্তু নিজের ভেতরের ঈশ্বরকে জাগ্রত করতে বাউলরা যে যুগলভজন করে অর্থাৎ নারী সঙ্গিনী নিয়ে কায়া সাধন করে, তার ঘোরবিরোধী বলরামীরা।
তিন.
ভারতীয় আধ্যাত্মসাধনার সঙ্গে অদ্বৈত চেতনা ও যোগপ্রীতি জনমানসে প্রবল ভাবে প্রভাব ফেলে ফলে, লোকায়ত ধর্ম সাধনার ধারায় যোগমার্গ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বৈদিক ও সুফিবাদের প্রভাব এড়াতে না পেরে ‘যোগমার্গ ও অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধনমার্গের সঙ্গে আপস করে নিতে হয়েছিল। এ কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল সহজিয়া ও বাউল সম্প্রদায়ের।
যোগমার্গের সাধকরা দেহকে একটি যন্ত্র মনে করেন। তারা মনে করেন—‘…এই যন্ত্রস্থ সব গুপ্ত ও সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে অন্য কোন স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে মনবাসনা পূর্ণ হতে পারে।’২০ ‘সুধীর চক্রবর্তী বলেন, ‘আসলে বাঙালির লৌকিক সাধনার দুই রূপ , অনুমান আর বর্তমান। লৌকিক সাধক বলেন, রাধা কৃষ্ণ-বৃন্দাবন-মথুরা-কুব্জা-কংস-চন্দ্রাবলী—এসব কল্পনা-অনুমান করে সাধনা তাকে বলে অনুমানের সাধনা। আর বর্তমানের সাধনা হলো মানব দেহ নিয়ে। সেই দেহেই আছে বৃন্দাবন, সেখানেই মান-বিরহ-বিপ্রলম্ভ-শৃঙ্গার। মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে গুরুর নির্দেশিত পথে দেহতত্ত্বের মধ্যে দিয়ে যুগলভজনে যে ঐশী উপলব্ধি সেটাই সঠিকপথ। বলরামীদের সাধনা আবার ওই অনুমান—বর্তমানেরও বাইরে আরেক রকমের।২১
বলরামীরাও দেহকে যন্ত্র মনে করে। এরা মনে করে হাড়িরাম যেমন আঠারো তত্ত্ব দিয়ে মানবদেহ গঠন করেছেন, তেমনই সেই দেহ চালাচ্ছেনও তিনি।২২
তাই তারা গায়:
হাড়িরাম মানবদেহ বানিয়েছে এক আজব কল
বলের সৃষ্টি বলে করায় মন আমার
বল বিনে চলবে না এ কল।২৩
কিন্তু তাতে কী? ‘হাড়িরাম বলে গেছেন, সবচেয়ে দামি সাধনা সেইটা যাতে ‘সখার সখী নেই, সখীর সখা নেই।২৪ বলরামীদের গুরু নেই, সাধনসঙ্গী নেই, একে তারা বলে খাসতনের সাধনা। হাড়িরাম ছিলেন সেই খাসতনের সাধক। হাড়িরামের ধর্ম বৈরাগ্যের নয়, গৃহীর সাধনা।একে ভক্তরা বলে ত্রয়োতনের সাধনা। ত্রয়োতনের সাধনা সম্পর্কে বলরামী ভক্ত বিপ্রদাসের বরাত দিয়ে সুধীর চক্রবর্তী জানান—’…হাড়িরামের মনের মানুষ জন্মদ্বারে যাবে অর্থাৎ স্ত্রীসঙ্গম করার শুধু সৃষ্টির জন্য। তাই বৃথা কামে নয় আর রোজসঙ্গম নয়। আমাদের মতে, বৃথা বীর্যক্ষয় নরহত্যার সমান পাপ। তাই স্ত্রীলোকের রক্ত স্রাবের সাড়ে তিনদিন পরে অর্থাৎ চতুর্থ দিনে সহবাস করতে হবে সুসন্তান কামনা করে। এই সহবাসই ত্রয়োতনের ধর্ম।২৫ ভক্ত বিপ্রদাসের মতে, ‘ত্রয়োতনের ধর্ম…শুধু সন্তানের জন্য জন্মদ্বারে যাওয়া, …কাম ত্রয়োতনের ধর্ম নয়।’
আর নিত্যন হলো দুই/একটা সন্তান জন্মের পর স্ত্রী আসক্তি পরিত্যাগ করতে হবে। এটা ত্রয়োতনের পরের ধাপ। জন্মদ্বারকে পচা গর্তরূপে জ্ঞান করে সংসারে অনাসক্তি আনাই হলো নিত্যন। এ সময় হাড়িরামের ধ্যান করতে হবে। বোধিতন হলো সেই দশা, যেখান থেকে মানুষের সহজে মুক্তি মেলে না। কামনা-বাসনায় আটকে পড়া মানুষই হলো বোধিতনের শিকার। ভক্ত বিপ্রদাস বলেন, ‘বোধিতন হলো জ্ঞানপাপীর দশা।…হাড়িরাম বলে গেছেন, যে প্রতিদিন সঙ্গম করে আর অকারণ বীর্ষময় করে সে পড়ে বোধিতনের ফাঁদে। তাই মুক্তি পেতে বলরামী ভক্ত গেয়ে ওঠে:
বোধিতনে বদ্ধ হয়ে থেকো নারে মন আমার
হাড়িরামের চরণ বিনে গতি নাহি আর।
আর অন্য উপায় দেখিনে থাক একিনে
আবার মানব হবি যদি হাড়িরামের করণ করোযার॥
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ধর্মসমাজে আধ্যাত্মিক কর্মের নির্দশক হিসেবে গুরুস্থান সর্বাগ্রে। গুরুর নির্দেশিত পথে চলাই শিষ্যের একমাত্র কর্তব্য। গুরুর উপদেশ ছাড়া ভক্তে-শিষ্যের তত্ত্বজ্ঞান বোধিগম্য হয় না। এ কারণেই ভারতবর্ষে তিন রকম গুরুর দেখা মেলে। তারা হলেন—দীক্ষা গুরু, শিক্ষাগুরু ও কুলগুরু। বলরাম হাড়ি তার ভক্তদের সামনে কখনো নিজেকে গুরু বলে উপস্থাপন করেননি। কেননা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরাই গুরুপ্রথার মাধ্যমে গুরুপদগুলোর ওপর একক কর্তৃত্ব বিস্তার করে রেখেছিলেন। ইহলোক পরলোকতত্ত্ব ও মোক্ষলাভ ইত্যাদির ক্ষেত্রে গুরুরাই সর্বেসর্বা। এ কারণে শিষ্যের কাছে তারা ভগবানের মর্যাদা পেতে চাইতেন। এদিকে চৈতন্য পূর্বকালে তো নিম্নবর্গের মানুষের কোনো ধর্মের অধিকারই ছিল না। গুরু হওয়ার অধিকার তো সুদূর পরাহত ব্যাপার। চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রথম গুরুবাদ জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করলেও চৈতন্য পরবর্তীকালে গুরুবাদ, ভক্তিবাদী সাম্যধারাকে ধরে রাখতে পারেনি। ফলে লোকায়ত বলরামী ধর্মে গুরু ধরার বালাই নেই। বলরাম ভক্ত বিপ্রদাস বলেন, ‘আমাদের মতে গুরু নেই, সাধন সঙ্গী নেই।’ আছে সাধুসঙ্গ। ভক্তরা তাই গায়:
আমরা হাড়িরামের চরণকৃপায় মিলে সব জাতে
ও তার শুদ্ধ আচার সত্যবিচার দেখলাম সাধু সঙ্গেতে ॥
তা জলে পাক অন্ন, ভেদ নাই ছত্তিশ বন্ন
এ সংসারে আর কে পারে হাড়িরাম ভিন্ন?
মূলত সাধুসঙ্গে থেকেই ভক্তকে সাধনা করার পথ বাতলে দিয়েছেন হাড়িরাম। বলরামীরা কেবল রামদীনকে ডাকে আর সংসারে থেকে সংসারের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টায় নিজেকে রত রাখে। এজন্য তাকে গুরুর কাছে যেতে হয় না, সাধনসঙ্গীর সঙ্গ দরকার পড়ে না। কেবল রামদীনের নাম নিলেই চলে। বলরামীদের বিশেষ কোনো আচার-বিচার নেই। আলখাল্লা তসবি বা প্রতীক নেই। খুব সাদামাটা সরল তাদের জীবন। সুধীর চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আর পাঁচটা উপাসক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বলারামীদের খুব একটা মিল নেই। গুরুবাদে এরা বিশ্বাসী নয়, কাজেই মন্ত্রদীক্ষা বা শিক্ষা নেই। সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো প্রবর্তক-সাধক-সিদ্ধ এসব স্তর পরম্পরার সাধন মাগ এদের নেই। বেশির ভাগ লৌকিক সাধনার যা সামান্য লক্ষণ, অর্থাৎ নারী সঙ্গী নিয়ে কায়াসাধন তা তারা করে না। তাই এই ধর্মে বিকৃতি নেই বলে ভক্তের ওপর শোষণ কম। তাদের ধর্মের আচরণ বিভিন্ন খুব সহজ সরল। সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের কেউ নেই। একেবারে নিম্নবর্ণের হিন্দু অন্ত্যজ ব্রাত্যসব মানুষ আর কিছু দলছুট মুসলমান তাদের দলের অংশীদার। মুসলমান থেকে বলরামী হয়েছে যারা, তারা হাড়িরামকে বেল হাড়িআল্লা। তাদের মুরব্বিদের অত্যাচার নেই, উচ্চবর্ণ-গুরু নেই। তাই গদি নেই, খাজনা নেই, মন্ত্রতন্ত্রের অবিচার নেই, আখড়া নেই, আসন নেই। আসন মোটে দু’জায়গায়। এ বাংলার নিশ্চিন্তপুর, ও বাংলায় মেহেরপুর। আলখাল্লা জপমালা, তসবি বা খেলকা এদের নেই।’ এই হলো সংক্ষেপে বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের ধর্মদর্শন।
‘এরা জাতিভেদ প্রথা মানে না। সকলের খাবার সকলে খায়। অসুস্থ হলে ওষুধ খায় না। তারা বিশ্বাস করে বলরামের নামেই অসুখ ভালো হবে। এদের মধ্যে যারা ভিক্ষা করে তারা ভিক্ষা না পেলে বিরক্ত হয় না। কি ভিক্ষায়, কি দুঃখে, কি সুখে তাদের একমাত্র ধ্বনি—‘জয় বলরাম’ কেউ বা আবার ‘হাড় হাড্ডি বলরামও’ বলে।
কোনোরকম আন্দোলন-সংস্কারে না গিয়েও বলরাম হাড়ির তার ধর্মমতকে অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যেভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। একজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে মানুষ ভজার সহজ সাধনা ক্রমেই আর পাঁচটি লোকায়ত ধর্মের আদর্শ ও দর্শনকে ছাপিয়ে আরো অভিনবরূপ লাভ করেছিল বলে আজও কিছু মানুষ তার আশ্রমে গিয়ে তার নামে ফুল জল ছিটায় আর ভক্তি ভরে ডাকে:
পারের কর্তা তাড়ান কর্তা, কর্তা গো আছেন রামদীন নারায়ণ,
রাম নামেতে মারো ডঙ্কা, শঙ্কা কিরে অবুঝ মন।
বলরাম হাড়ি যদিও অবতারবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবু তার ভক্তরা বৈষ্ণবদের মনে তার গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেন গানে। ফলে বৈষ্ণবসহ অন্যান্য হিন্দুর মনে হাড়িরামের প্রতি বিশেষ প্রীতির ভাব জেগে ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। ভক্তদের বিশ্বাস—বলরামহাড়ির আসলে রামেরই অবতার। এ কারণে ভক্ত গায়:
হাড়িরাম হাড়িরাম বলে
হাড়ের মালা দেই গলেতে॥
লঙ্কার ছিল রাজারাবণ
সীতা হরে হলো নিধন,
ঐ দেখ বধিল রাবণ লঙ্কাতে॥
রামায়ণে লিখা আছে
এ কথা মোর নাইকো মিছে,
সাগর বাঁধে হনুমানে
রাম নামেরই কৃপা গুনেতে॥
পূর্ণ বলে ও হাড়িররাম
তোমার হইল অনন্ত নাম
ভক্তিভার ডাকতেল পরে
চরণ দেও রাম তাহারে॥
রামনাম বলে প্রহ্লাদ যেমন অগ্নিকুণ্ডে বেঁচে ছিলেন, রাম নাম বলে প্রহ্লাদ যেভাবে জলে ডুবে না গিয়ে পাথরসহ ভেসে উঠেছিলেন, ঠিক একইভাবে হাড়িরাম তথা রামদীনকে ডাকলে, ভক্তের বিশ্বাস, কোনো বিপদ থাকবে না। কেননা রাম চরণে আশ্রয় নিয়ে বিভীষণ পার হয়েছিলেন মহাবিপদসংকুল পথ।
তাই প্রায় প্রতিটি গানেই হাড়িরাম স্তুতি বর্ণনা করা হয়েছে রামায়ণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যেমন:
হনুমান তো বনের পশু/মনে তার নেই কো ময়লা
ও যে অপার নদী পার হয়ে যায়/গলে দিয়ে রাম নামের মালা
নিলু বলে, ভাবরে মন, হাড়িরাম নামেতে করোনা হেলা
এনাম ডাকলে পরে থাকবে ভালো/থাকবে না তোর শামন জ্বালা ॥
বলাহাড়ি ভক্ত হাড়িরামকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে একাকার করে দেন তার গানে। উদ্দেশ্য কি কেবল বৈষ্ণবদের মনে প্রতীতি জন্মানোর প্রত্যাশা? না কি, হাড়িরামকে তাদের মর্যাদা দেওয়া?
একটা গান:
হাড়িরামের নিত্য লীলা বুঝা ভার
ভাসে পাথর ‘ডোবে শোলা, পাষাণ ডোবে দেখনা
বেদ পুরাণে শুনি খবর, হাড়িরামের জিৎ জবর
রামতত্ত্ব সকলের ওপর জানেন কেবল মহেশ্বর।
আবার:
রাম নারায়ণ বলে ডাকি
রামের চরণ ধুলি গায়ে মাখি
বেদের বাইরে উদার তিনি
নাম রাখে তার হাড্ডি হাড়ি।
কিন্তু বেদের বাইরে উদার হয়েও ভক্তদের কৃপায় সেই হাড়িরাম চার যুগের অবতার হয়ে ওঠেন।
সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি
চার যুগে সৃষ্টি করলেন তিনি,
ও যে সত্যযুগে হয় নারায়ণ
ত্রেতা এসে ধনুকধারী।
আবার দ্বাপরেতে বংশীধারী
কলিতে গৌরাঙ্গ তিনি
দিনু বলে কলি শেষে
নিত্য ধাম তার মেহেরপুরে
লীলা তাহার প্রকাশিতে
উদয় হলেন বলরাম হাড়ি ॥’
একইভাবে ভক্তরা, তাকে ডাকে এভাকে:
তুমি বিষ্ণু তুমি কৃষ্ণ
তুমি প্রভু নিত্যনন্দ
আনন্দ দেও এ হৃদয়…
আবার একইভাবে মুসলমানদের বিশ্বাসকে স্থির রাখতে সে গায়:
অসম্ভব কথা শুনে লাগল জীবের দিশে,
আল্লাতালা মেহেরাজে মানুষরূপে আসে ॥
নিম্নবর্গের প্রান্তিক মুসলিমদের কাছে হাড়িরাম তাই হাড়িআল্লা।২৬ আজও মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার হাড়িরামের অনুসারীরা একনিষ্ঠ বলরামের অনুসারী নন। তারা বৈষ্ণববাদের সঙ্গে আছেন, হরিভজনদের সঙ্গেও আছেন। আছেন সখি-ভাবুকদের কীর্ত্তন দলেও। তাদের বিশ্বাসের জায়গাজুড়ে একমাত্র রামদীনকে পাওয়া আজ দুষ্কর। কেননা, প্রথাগত ধর্মের চাপে এই রকম ক্ষুদ্র লোকায়ত ধর্মবিশ্বাসীর বিশ্বাসে যতটা না চাপ লাগে, তার চেয়ে ঢের বেশি চাপ তার বহিরাঙ্গে। তাই তারা কুষ্টিয়ার যুগীয়া দাস পাড়ায় কালীমন্দিরে পূজো না দিলেও কীর্তনে অংশ নেন। অংশ নেন মনসা পূজার মণ্ডপেও। আর এভাবেই বর্তমানে বলরাম ভক্ত চারুবালা দেবী, অনন্তদাস, সন্তোষ হালদার, হগা রায়, পুষ্প রাণী, অজিৎ রায়, টগা ও হগা রায়দের বলরামী ধর্ম ও বিশ্বাস মেলাতে-মেলাতে একদিন মিলিয়ে যাবেন। বলরামের আশ্রমেও হয়তো আর ডঙ্কা মেরে বলরাম হাড়ির নাম নেওয়ার কেউ থাকবে না। এর কারণ বলরামীদের উদার ধর্মবিশ্বাস ও নীতির মধ্যেই নিহিত।
তথ্যসূত্র
১৩। প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯
১৪। কুমুদনাথ মল্লিক, প্রাগুক্ত,পৃ. ২৪১
১৫। অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ.২০৮
১৬। অক্ষয়কুমার দত্ত, পৃ. ২০৮
১৭। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০
১৮। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০
১৯। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
২০। বাংলার সুফি সাধনা, আহমদ শরীফ, সম্পাদনা রায়হান রাইন, সংবেদ, পৃ: ২২৩
২১। সুধীর চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২
২২। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
২৩। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১
২৪। প্রাগুক্ত, পৃ. ১২
২৫। প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯
২৬। সুধীর চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত,পৃ. ৪১
শেষ
বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের ধর্ম-দর্শন ॥ রঞ্জনা বিশ্বাস