বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার, যে বাংলাদেশ হবে আত্মনির্ভরশীল। আর একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রত্যয়ী হতে হলে তাকে হতে হয় স্বনির্ভর। আবার অন্যভাবে বলা যায়—জাতি হিসেবে দাঁড়াতে হলে আত্মপ্রত্যয়ী হতে হয় সেই জাতির প্রত্যেক মানুষকে। আর আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার জন্য সততা, সাহস, মানবিকতা ও নীতি নৈতিকতার প্রয়োজন। অথচ বর্তমান বাংলাদেশে আমরা কে কখন কিভাবে কোথায় সুযোগ পেলে একটু বেশি আয়ের জন্য নিজের নীতিকে বিসর্জন করছি, তা কখনো ভাবি না। নীতিহীনতার এই পর্যায়ে জাতি হিসেবে আমরা কতটুকু মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো?
আমাদের প্রতিবছর রেমিটেন্স আয় ১৫-১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ এ দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রতিবছর দক্ষ শ্রমিকের পেছনে ব্যয় হয় ৬-৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আমাদের এ শিক্ষাব্যবস্থা কর্মমুখী নয় এবং একই সাথে তা কাক্সিক্ষত মানবিক গুণাবলি গঠন ও দক্ষতা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ কারণে ভারতে গিয়ে—প্রতিবছর আমাদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে—মেডিক্যাল কলেজগুলোতে কীভাবে তাহলে গত এক দশক আগেও শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও নেপাল থেকে পড়তে আসতো? তাহলে এখন এমন অবস্থা কীভাবে হয়েছে? শুধু শিক্ষাব্যবস্থা নয়, আমাদের অর্থনীতিতে এবার যুক্ত হয়েছে অর্থপাচার এর মতো বিষয়।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিলো ৩৮৫১৫.১ কোটি টাকা। অন্যদিকে আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে ৩১৩৮৭৯.০ কোটি টাকা। এ বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি আমরা এতদিন পূরণ করে আসছিলাম মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে রেমিটেন্স আয়ের মাধ্যমে। কিন্তু গত কয়েক বছর বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠানোর আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। সেই সাথে শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে আরো প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ২০১৩ সালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। অর্থপাচারের দিক থেকে ভঙ্গুর রাজনীতির দেশ পাকিস্তানকেও বহু ধাপ পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ৭ থেকে ১২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানির আড়ালে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে জিএফআই। ব্যবসায়ীরা আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে বাড়তি অর্থ পাচার করছেন। আবার রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়েও পাচার করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই অর্থপাচার হচ্ছে। অনেকে অযথা ক্ষমতাসীনদের দুষছেন। কিন্তু আমরা জানি, যে-ই ক্ষমতাসীনরাই আসুক না কেন, কোনোভাবে এ চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না, যদি না আমাদের রাজস্বনীতি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, গ্যাস বিদ্যুৎসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা সরবরাহকরণ নিশ্চিত না করা যায়। আর তা না পারার কারণেই—গত ৮-৯ বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ আগের মতোই জিডিপির ২২-২৩ শতাংশ পর্যন্তই রয়ে গেছে।
এ কারণে আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত, বিশেষত ইমপোর্ট সাবস্টিটিউট ইন্ডাস্ট্রিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রদান, নতুন সম্পূরক শুল্ক ও মূসক আইন ২০১২ বাস্তবায়ন, ১৩৩৯টি আমদানি পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক তুলে নেওয়া, নতুন কোম্পানি নিবন্ধন ফি বৃদ্ধি, ব্যবসায়ী মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগে আর্থিক ও নীতিগত প্রণোদনার অভাব গত কয়েক দশক ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে যে সম্ভাব্য ১৩৩৯টি পণ্যের উপর সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে নেওয়া হবে—তার অধিকাংশ বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাতের পণ্য। রাজস্ব বোর্ড থেকে বলা হচ্ছে—সকল ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাট আরোপের ফলে ভোক্তা দেশি ও বিদেশি পণ্য হ্রাসকৃত মূল্যে কিনতে পারবে। কিন্তু এতে করে দেশীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এতদিন যাবত যে কররেয়াত সুবিধা পেতো তা পাবে না, বিদেশি কোম্পানি দেশীয় ব্যবসায়ীদের মতো কোনোরকম আমদানি শুল্ক ছাড়াই বাংলাদেশে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করতে পারবেন। আমাদের ভোগ বৃদ্ধি, সরকারি অবকাঠামো ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদির কারণে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান ছাড়া যে কোনো প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না—এটা সবার জানা।
আরও পড়ুন: প্রকাশিত হলো ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ এবং সমকালীন রাজনৈতিক অর্থনীতি’
আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কাক্সিক্ষত উন্নত অর্থনীতির দেশ হওয়ার জন্য মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮% উন্নীত করা, মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩৪% বৃদ্ধি, ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত ১৫.৯% বৃদ্ধির আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ১৭.৭% থেকে ২১% এ উন্নীতকরণ, রপ্তানি-জিডিপি অনুপাত ৩০% বৃদ্ধি করে ৫৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বিদেশি বিনিয়োগ ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ অপরিহার্য বলে জানানো হয়েছে।
এক্ষেত্রে প্রয়োজন রাজস্ব কাঠামোতে পরিবর্তন আনা। বিশেষত আমাদের করনীতি প্রোগ্রেসিভ না হয়ে রিগ্রেসিভ। অর্থাৎ যিনি বেশি আয় করছেন, আনুপাতিক হারে তার উপর বেশি হারে করারোপ না করে যিনি কম আয় করছেন তার উপর বেশি কর আরোপ করা হচ্ছে। এতে করে একজন মধ্যবিত্ত বছরে ২.৫০ লাখ টাকা আয় করে বছরে পাঁচ হাজার টাকা কর প্রদানে বাধ্য হচ্ছেন।
অন্যদিকে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করে সেই মধ্যবিত্তই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করার সময় ভ্যাট দেবেন। তাই আয় হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে খরচ বেশি করেন মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের তুলনায়। কিন্তু আয়ের তুলনায় খুব স্বল্প খরচ করেন উচ্চবিত্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় ও খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ে। ফলত দেখা যাবে মধ্যবিত্তের টাকায় সরকার তার আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করছে, কারণ মধ্যবিত্ত আয় অনুপাতে উচ্চবিত্তের তুলনায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে বেশি ব্যয় করে বেশি ভ্যাট দিচ্ছে। অথচ মধ্যবিত্তের সুযোগ সুবিধা বাড়ছে না। আর এই রাজস্ব কাঠামোর চাপে একজন মধ্যবিত্ত কৃপণতা করে টাকা জমিয়ে চাইলেও উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ফলত কর্মসংস্থানের অভাবে শোষিত হচ্ছে বেসরকারি খাতের শ্রমিক।
প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি পূর্বেই ধারণা করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। তিনি অবশ্যই আন্তরিকভাবে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে চাইছেন। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষ মানবসম্পদ ও সততা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনিক কর্মচারীদের মাঝে অভাব দেখা যায়। এসবের কারণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত অর্থনীতির রাষ্ট্র হওয়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখী হতে পারে। আর তখন শিল্পখাতে কর্মসংস্থান ১৮% থেকে ২৫% এ উন্নীতকরণ, নতুন ১২.৯ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র দূরীকরণ ও এসএমই খাতের উন্নয়ন, রপ্তানিমুখী বাজার সম্প্রসারণে রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো আমাদের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
তাই প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারি বেসরকারি সবধরনের মানুষকে আন্তরিক হতে হবে। হতে হবে আত্মপ্রত্যয়ী দেশপ্রেমিক। বিশেষত প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা করতে হবে নিশ্চিত। আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা কাক্সিক্ষত ফলাফল পাচ্ছি না। সরকারি কর্মচারীদের জনগণের প্রতি আচরণ এখনো অনেকটা বন্ধুসুলভ নয়। এ কারণে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর এক বক্তব্যে সরকারি কর্মচারীদের জনগণের ব্যাপারে নমনীয় হতে বলেছিলেন। খবরটি সেই সময়ে একটি বিখ্যাত দৈনিকে বড় করে প্রকাশ পেয়েছিলো। আজো যখন দেখি বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এতটা অদক্ষতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়, তখন যেন বঙ্গবন্ধুকেই মনে পড়ে।
আমাদের আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় প্রতীক বঙ্গবন্ধু দেশীয় শিল্প বিকাশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বাণিজ্য ঘাটতি রোধ এবং রাজনৈতিক অর্থনীতিকে কতটা সুন্দরভাবেই না নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক মুক্তি দেননি, বরং অর্থনৈতিক মুক্তিও দিয়েছিলেন। তারই পথে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাঁটতে শুরু করেছেন। আসুন মাননীয় গণপ্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, প্রধানমন্ত্রীর সহায়ক হয়ে উঠি। এ নীতিগত অস্পষ্টতা দূরে সরিয়ে সুশিক্ষা, জনগণবান্ধব করনীতি বাস্তবায়ন, দেশীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে অর্থপাচার রোধ করতে এগিয়ে আসি। নীতিহীনতার এ স্রোতে না ভেসে আসুন নিজেকে ও যুবসমাজকে গড়ে তুলি দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে। সুযোগ দিই তাদের উঠে আসার। যাতে করে ব্রেইন ড্রেইন বা মানি ড্রেইন না হয়ে সুখি সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলি।