শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শিবের সর্বগুণে রচিত এক বিরল চরিত্র। পুরাণমতে শিবের আরেক নাম মহাদেব। পিনাকপানি নামেও পরিচিত। পিনাক ছিল একইসঙ্গে শিবের ধনু ও বাদ্যযন্ত্র। যুদ্ধের সময় মহাদেব পিনাককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন, অন্য সময় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। শিবের আরেক নাম নটরাজ। নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে এই নাম। তাণ্ডব নৃত্যকলা। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো শিবস্বভাবী লেখক এ জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি—লেখায় যা, ব্যক্তিজীবনেও ঠিক তা-ই ছিলেন।
বাঙলা কথাসাহিত্যে দীর্ঘদিন তিন বন্দ্যোপাধ্যায় রাজত্ব করে গেছেন— তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বন্দ্যোপাধ্যায়-যুগের অবসান ঘটিয়ে গঙ্গোপাধ্যায়-যুগ রচনা করেন—শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাস দিয়ে বাঙলা কথাসাহিত্যে এ নতুন যুগের শুরু। শ্যামলের ছোটগল্পও অতুলনীয়। তার ছোটগল্পকে আমি দীর্ঘকবিতা জানি, উপন্যাসকে জানি মহাকাব্য। শব্দরা ছত্রিশ ব্যঞ্জনে বাজত তার চিঠিতেও। একসময় তার সঙ্গে আমার নিয়মিত পত্রযোগাযোগ ছিল। একটি চিঠির কয়েকটি বাক্য উদ্ধার করলেই আমার কথার যৌক্তিকতা মিলবে। চিঠিটি পাওয়ার কদিন আগে বন্ধু কমল মমিনসহ কলকাতা ঘুরে এসেছি। স্নেহমাখা চিঠির শুরুটা ছিল এমন—
তোমাদের কয়েকদিনের উল্কার মত আসা—আবার চলে যাওয়া— মনের ভেতর ঝড় তুলে দেয়। ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যেবেলার ঝড়। জ্যোৎস্নার ভেতর।
(৪/২/৯৮)
উদ্ধারকৃত বাক্যগুলো কবিতার মতো ভেঙে সাজালে কেমন লাগে, দেখা যাক সেটাও:
তোমাদের কয়েকদিনের উল্কার মত আসা—
আবার চলে যাওয়া—
মনের ভেতর ঝড় তুলে দেয়।
ফাল্গুন মাসের সন্ধ্যেবেলার ঝড়।
জ্যোৎস্নার ভেতর।
একে যদি কবিতা না-বলি, মা কাব্যলক্ষ্মী অসন্তুষ্ট হবেন। রামকৃষ্ণ বলতেন, ‘ঈশ্বরের বালক-স্বভাব।’ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন বালকস্বভাবী শিব। কবিতার প্রতি তার যে কী আগ্রহ ছিল, সে কথা আমার মতো ভালো কেউ জানে বলে মনে হয় না। একবার ‘রেপ অব ফ্লোরিডা’র কবি আলবেরি অ্যালস্টোন হুইটম্যানের কথা বলেছিলাম তাকে। ওয়াল্ট হুইটম্যানের নাম শুনলেও হার্লেম রেনেসার পথিকৃৎ এই হুইটম্যানের নাম শোনেননি শ্যামল এর আগে। প্রসঙ্গটা উঠেছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতার বাড়ির আড্ডায়। কিছুদিন পর আমার ঢাকার ঠিকানায় আসা এক চিঠিতে প্রসঙ্গটির জের টেনে শ্যামল লিখেছিলেন—‘তুমি যে হুইটম্যানের কথা বলেছো—তিনি কোন সময়কার? তাঁর কবিতার একটা Xerox পাঠাতে পারো? তাহলে তুষারকে দেখাতাম।’ (১২/১/২০০০)
তুষার মানে কবি তুষার চৌধুরী। শ্যামলদা-ইতি বউদির জামাই। আমার মুখে শুনে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার একটি পঙ্ক্তি শ্যামলের খুব মনে ধরেছিল—‘ভেতরে শরীর নেই, কার জামা কার জামা ঝুলছে বারান্দায়।’ সাহিত্যের অঙ্গনে বিচরণকারী শরীরহীন কবি-লেখকদের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি এই পঙ্ক্তির। সমাজের বুদ্ধিবাজ ভদ্দরলোকদের সঙ্গেও। লেখকদের গাড়ি-হাঁকানো জীবনাচারে প্রবল আপত্তি ছিল শ্যামলের। মুখেও বলতেন সেকথা—‘মানুষের জীবনের খুঁটি-নাটি জানতে হলে হাঁটতে হবে। গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ালে চৌদ্দ আনা জীবনই তো চোখের আড়ালে থেকে যায়। কান পেতে মানুষের কথা না-শুনলে মানুষও লেখকের কথা শোনে না।”
কবিতার নিবিড় পাঠক ছিলেন তিনি, অনুজদের লেখাও চোখ এড়াতো না। কৃতজ্ঞচিত্তে একান্ত ব্যক্তিগত একটি কথার উল্লেখ না করলেই নয়। এক চিঠিতে লিখেছিলেন:
মাস দেড়েকের ভেতর দেশ-এ তোমার (দুটি) কবিতা পড়লাম। পাঁচজনের চেয়ে ভিন্ন ও বিশিষ্ট। আমাদের ভালবাসা নিও। তোমার কবিতা তোমার আবেগমথিত চরিত্র থেকেই জন্মায়। অথচ শুধুই আবেগ নয়। কবিতা।
(২৬/৫/৯৮)
বোদ্ধা সমালোচকগণ কবিতাকে ‘প্রজ্ঞাশাসিত আবেগ’ জানেন। সেকথাই শ্যামল কত সহজ ভাষায়ই না বলেছিলেন চিঠিতে।
ইতি বউদিকে ভালবেসে বিয়ে করলেও পৌঢ় বয়সে শান্তা নামের এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শান্তাও পাগল ছিল শ্যামলের জন্য। এই শিব-পার্বতী প্রেমপের্বে ইতি বউদির সঙ্গে শ্যামলের কথা বন্ধ ছিল কয়েক মাস—সংসারে ছিল অশান্তি। বিধি বাম। স্ত্রী-কন্যা-বন্ধুদের চাপে অকালপ্রেম থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন শ্যামল। জীবনে ওই একবারই তার পিছু-হটা। হটলেও শান্তাকে তিনি ভুলতে পারেননি আমৃত্যু। তার লেখার টেবিললগ্ন র্যাকে রাখা ফটোস্ট্যান্ডে একপাশে ইতি বউদির, অন্য পাশে শান্তার ছবি সাজিয়ে রেখেছিলেন পরম যত্নে। এখানেও শ্যামল বাঙলা সাহিত্যের অন্য সব নায়কের চেয়ে আলাদা। ৭৯ দেশপ্রাণ শাসমল রোডের বাড়িতে শান্তার ও ইতি বউদির সেই জোড়াছবির বিপরীতে বসে এ যুগের শিব-পার্বতী প্রেমকাহিনীর সবটাই শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল খোদ শ্যামলের মুখে। শান্তার গল্প করার সময় খুশিতে ঝলমল করছিল সেই মুখ। সঙ্গের ছবিতে সেই ঝলমলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি । ছবির মধ্যে ছবিতে শান্তাও আছে। র্যাকের ফটোস্ট্যান্ডে বাঁয়ের স্পষ্ট ছবিটি শান্তার, ডানের অস্পষ্ট ছবিটি ইতি বউদির।