॥ এক ॥
অনুমিত,কবি আবেগের ঘণীভূত রূপ। কখনো বা, কবি অতিক্রান্ত হেমন্তের ভোরের ঘাসের ডগায় নক্ষত্রের বার্তাবাহী রাতজাগা শিশিরের কণা–সময়ক্রমে বয়ে চলা উত্তাপে প্রথম সন্ধ্যার রহস্যময় আগমন। বাস্তবে আধুনিক দিনের কবি মানেই আদতে ব্যতিক্রমী দুঃসাহসী মানুষ। না হলে তিনি সাহিত্য শিল্পের ছদ্মনামায় চাটুকার বিশেষ।
কবিকে বুঝতে বা খুঁজতে কবিতার ধ্যানে সেদিন পটচিত্রের সন্ধানে আমি রক্ত মৃত্তিকার দেশে, নিস্তব্ধ কোপাই নদীর পাড়ে প্রাথমিক সন্ধ্যায়। তখন নক্ষত্রেরা ঝুলে পড়েছে আমার মাথার ওপর লালমাটি বালি কাঁকড়ে চলনচিহ্ন রেখে শান্ত সরীসৃপের সান্ধ্য ভ্রমণে; নক্ষত্রও তার সচেতন চোখ রাখে। ‘৭১-এর বাংলার আকাশে যে বেদনাবিদ্ধ নক্ষত্রটি মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরল রক্তের ছবি জমিয়ে নিয়েছে বুকের মধ্যে, তাকেই আমার কথায় মুক্তিযুদ্ধের ধ্রুবতারা নামে কবিতা-কথায় রাখলাম।
ছায়াপথের কয়জন নক্ষত্র বা কবি, চেনা অথবা অচেনা,তবুও নক্ষত্রের সঙ্গে সান্নিধ্যে কমতি পড়ে না। নক্ষত্রই যে কবিদের আবাসন, কবিকূলের নিকেতন, জীবনানন্দ-উত্তরকালে বাংলার মনে তা স্বাভাবিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে।
যে কজন কবির পরিচয় একাত্তরের বাংলাদেশের বা বিশ্ববাংলার বেদনার্ত রক্তের সাক্ষী হয়ে মিশে আছে,তারই এক ধ্রুব জাতক কবি ফকির ইলিয়াস। তার বাউল মন,অভিযাত্রায় ডায়াস্পোরিক ভুবন, বাস্তবতার নিবিড় সান্নিধ্যে থেকেও মননের গভীরে জীবনের অলঙ্ঘনীয় খনন আমাকে প্লাবিত করেছে বিশেষ মাত্রায়।
কবিতায় কবির মনের তরঙ্গগুলোর সন্ধানে প্রাপ্তসত্য বা কবিতার পশ্চাৎপট আসলে কবির অন্তরের সম্পদ,যার বিক্রিয়ায় কবিতার জন্ম। কবিতার অবয়বে জেগে থাকে স্রষ্টার শেকড়ের সেইসব কাহিনি। কবি এক নিজস্ব জগৎ অবশ্যই নির্মাণ করেন। সেখানে প্রবেশের পথটাকে জেনে তবেই তার সৃষ্ট উদ্যানে প্রবেশ, বা কবিতার গল্প, মনের কথা, তথা দর্শনের সাক্ষাৎ অনুভূতি সহজ।
কবিতায় প্রকাশিত সামাজিক রাজনৈতিক বা উপলব্ধ ঐতিহাসিক ডিসকোর্সগুলোর মধ্যেই ফকির ইলিয়াসের মতো, কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রে সাময়িকীতে কলম ধরা কবির জন্য, পূর্বাপর যোগসূত্রে মন খোলা রেখে চললেই সুবিধা। যদিও চূড়ান্ত মুহূর্তে কবিতাই কবির আসল অন্তরতম সাক্ষ্য বহন করে ।
এখন কবিও সশস্ত্র প্রতিবাদী যোদ্ধা, অবশ্যই তার অস্ত্র হলো আগ্নেয় শব্দ ও ভাষার বর্ষণ। তাই, ‘ওরা পুড়ে যাক, তছনছ হয়ে যাক ওদের মসনদ। /সর্বহারা শিশুদের চোখের জলে হোক নূহের প্লাবন।’ কবির কল্পে ভূ-আন্দোলন, একটা মহাপ্লাবনের আহ্বান। ন্যায়েরযুদ্ধ জারি।
‘যে আত্মজীবনী দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় শেষ হয়ে গিয়েছিল….আমার মতের বিপক্ষে লিখিত হয়েছে যে সব প্রচ্ছদ কাহিনি, সে গুলো পড়তে ও খারাপ লাগে না আমার। গদ্যগাঁথা গুলো একদিন নবজন্ম পাবে , অন্য কোনো দুপুুরকে সাক্ষী রেখে কেউ লিখবে গল্পের ভিন্ন মাত্রা– সে নিশ্চয়তাও আমাকে বেশ আশ্বস্ত করে ।পদ্যের পদবীগুলো আমি পৃথক করে রাখি নতুন কোনো কবির জন্য। (গৃহীত গ্রাফগদ্য)
আত্মমোক্ষণের মাধ্যমে কবির এক সুনৃত ভাষণ, এক বিস্তীর্ণ প্রবাহের মধ্যে আত্মস্ফুরণের সত্য বিভাস। কবির জীবন এক বৈচিত্র্যময় পূর্বাপর যাপনচিত্র।
কবির উচ্চারণে ‘আত্মজীবনী মানেই কয়েকটি রজনী যাপনের অসম্পূর্ণ খতিয়ান।’ (ঐ)
কবি ফকির ইলিয়াসকে জেনেছি যে ধ্রুবতারার আলোয়। সে ধ্রুবের দেহ-মনজুড়ে একাত্তরের বাংলার রক্তাক্ত বেদনা ও বীভৎস যুদ্ধের স্মৃতি । তাই কবির আত্মসংলাপে কবিকেই বলতে শুনি :
কবির সাথে আমার প্রতিদিনই কথা হয়।
তাঁকে জানাই,
এ নগরে কীভাবে সর্পছানারা বাস করে মানুষের বুকের আস্তিনে .
কিংবা পোষা কুকুরগুলো কীভাবে লেজ নাড়াতে নাড়াতে কিছু শুকনো খাবারের জন্য দেখায় নিজেদের মিডিয়া প্রভুত্ব।
কীভাবে কালোকে হলদু, গোলাপকে নীল করে দেয় …কীভাবে অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যায় এনগরের মানবিক বিবেক”
(ঐ)
কবি এখানেই থামেননি , এরও পরে তাঁর যাপন চিত্রের অভিঘাতে এসে পড়ে:
১.
আমি হাডসন নদীর তীরে হেঁটেছি অনেক পথ।
সাইপ্রাস থেকে যে জাহাজটি পাড়ি দিয়েছিল নিউইয়র্ক হার্বার, শুনেছি তার
সাইরেন (ঐ)২.
সংহত তারার ভেতর আমরা
একগুচ্ছ নিমফুলের উন্মেষ দেখে জেনে যাই –
একটু আগুন থাকে বুকের ভেতর।
একটু পাথর থাকে জমে যাওয়া শীতের বরফে ।
একটু বিরহ কাছে এলেই খুব যত্ন করে
বাড়িয়ে দেয় হাত। একটু রঙের মায়া পরিয়ে
দিয়ে মায়ার হরফে ”
(নক্ষত্র বিক্রির রাতে )
কবিকে কবির আপনগত নির্জন বাংলা-ভাবের আবেশে দেখা ছাড়া কবির অন্তরের কাছে পৌঁছানোর কোনো পথ জানা নেই। অতএব, কবি তার পাঠককূল বা কবি তাকে ভালোবাসেন এমন মানষুজন জানেন–কবিতা পাঠ মানেই কবি তার সঙ্গে সহবাস-পর্যটন। কবি তখন দেখেন,
জমে থাকা হিমালয়ের মতো বিচৃর্ণ হয়ে আছে এই নিউইয়র্ক নগরী।
দেখেছি এর আগেও সহবাসের দীর্ঘশ্বাসগুলো কতো মায়ায়
মিতালী গড়ে চাঁদের সাথে ।
কত দরদ নিয়ে ইস্টরিভারের পারে জাগে সূর্য।
আমি যাযাবর সূর্যের সাথে হাঁটতে হাঁটতেই একদিন
পালন করে ছিলাম ভালবাসা দিবস।
(গৃহীত গ্রাফগদ্য)।
কবির দেশ ও কাল ছেয়ে যাপিত জীবন অনেকটা সূর্যেরই মতন ঘূর্ণয়মান। অতিক্রম, আবার কক্ষ পথে ফিরে ফিরে আসা,ফিরে দেখা। তাই কবির কথায় ‘দাগ দেখে আগে র মতোই শনাক্ত করতে পারি জন্মের আবাস।’ (ঐ)
ফকির ইলিয়াস ভুবনবিহারী আজকের বাংলার কবিদের মধ্যে জাত-বাউল মনের অধিকারী এক স্রষ্টা। কখনো কখননো বাউল-স্বভাবে প্রবল মিস্টিক। আবার
বহিরাবরণে ডায়াস্পোরিক মানতেই হয়। কবির মননে বহুত্ববাদের এক সদর্থক বিশেষ রসায়ন শব্দ ও ভাষার তরল গুণে একীভূত–একীভূত কবির সত্তায়।
সাহিত্য-ধর্মের এই মৃত্তিকায় জলে ও আকাশে কবির সহজ বিহার এবং উত্তরাধিকার। কবি বিশ্বাতীত থেকে বিশ্বাতিগ্ । সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশ বা
বিশ্ববাংলা কবির প্রাথমিক বলয়। আদি জন্মের সূতিকাগার শৈশবের ক্রীড়াভূমি। কবির দৃষ্টিতে,
প্রাচীন মমির মায়া রেখে যে চাঁদ বিগত হয়েছিল
তার জন্য পুনরায় লিখে রাখে
একতারা বিষয়ক গান
(নক্ষত্র বিক্রির রাতে )
সারা বিশ্বের রূপ মায়া ইতিহাস মন্থন করে এ কেমন ঘরে ফেরা; ফিরে ও আবার প্রকৃতির আহ্বানে, মানুষের ছড়ানো-ছিটানো ছেঁড়া মেঘের হাওয়ায় ভেসে যাওয়া।
একদিন চৈত্রের আকাশে আরও একটি চাঁদ উঠবে বলে
থেকেছি অপেক্ষায়, শুনে যেতে অন্য কোনো বৈষ্ণব সঙ্গীত। (ঐ)
খণ্ডিত রাষ্ট্র চেতনার দুর্গের বাসিন্দা হয়েও আদতে কবি বিশ্বনাগরিক। সবখানেই তার ঘর আছে, তিনি সেই ঘর ঠিক নেন খুজেঁ। কবি ফকির ইলিয়াস তেমনই এক অতি চেতনার কবি । কবিতার ভাষাটি বাংলা আর চেতনার উন্মেষ ভূমি মুক্তিযুদ্ধের বাংলা হলেও, তার কবিতা খুব সহজ ভঙ্গিতে সমগ্র পৃথিবীর। বিচার করতে গিয়ে বলা ভালো, তার কবিতা গ্রহণের ও বোঝার মনটিও সেভাবে দীক্ষিত হয়ে চলতে ভালোবাসে।
॥ দুই ॥
কখনো কখনো বলতে ইচ্ছে করে, কবি, আমি ও তোমার কথার মধ্যে বেঁচে আছি: জন্ম নিয়েছি, তোমারও জন্মের আগে। কবিতা জন্ম-মৃত্যু দু-ই জুড়ে নিয়ে হাঁটে । এক করে দিতে জানে নরক-স্বর্গ, পাতাল-আকাশ। মর্ত্যেদর পরাবাস্তবের অধিশ্বর কবি । কবির সঙ্গে মন খুলে সমস্বরে উচ্চারণ করা যায়:
আমি তো জানি ,
তুমি ও আমার সহযাত্রী ছিলে সেই তাঁবুতে
আর আমি ছি লাম ঘোর লাগা মৌন হরিদাস। (ঐ)
এর চেয়ে কতটা সহজে আউল বাউল সহজিয়া বৈষ্ণব ফকির মন– সাধারণ মনকে সমদ্ধৃ করে তুলতে পারে ! এ যেন বিশ্ববাংলার বৈভবে বিশ্বহৃদয়ের নির্মাণ।
নিরন্তর এক সুগভীর অনভূতির কথকতা ফকির ইলিয়াসের কবিতার প্রবাহের তরঙ্গজুড়ে, প্রতি বাঁকে। স্বদেশ এবং চারিপাশের পৃথিবীময় বহমান। ঘটনার ধাক্কায় ধাক্কায় কবি আহত অন্তরে । ঘটনাক্রমকে তিনি মনের গভীরে ধরেন। ইতিহাসের স্বাক্ষরিত গতি ধারার সঙ্গে তার সংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রস্ফুটিত তার কবিতা। কিন্তু চারপাশের সংবাদ মাধ্যমে মিডিয়ায় প্রভুত্ব কায়েমের যুদ্ধ ঝড়-ঝঞ্ঝার দাপট চলতেই থাকে। আর্ত কবি প্রত্যক্ষ করেন দেশজুড়ে যে অন্ধকার:
যে সংবিধান মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হবার কথা ছিল –
তার শরীরের ক্ষত দেখে আমি আঁতকে উঠি : যুথবদ্ধ
সংশোধনী হরণ করেছে আমার চেতনার স্বাধীনতা,
মৃত্তিকায় নতুন হবার প্রগাঢ় মূল্যবোধ
(গৃহীত গ্রাফগদ্য)।
‘৭১-মক্তিুক্তিযুদ্ধে চিহ্নিত ধ্রুব নক্ষত্রের আলোয়, সত্য যখন হয়ে ওঠে বর্তমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে ই অতীতের ইতি হাস। থেকে থেকে ঝড়ো হাওয়ায় জমে ওঠা পুঞ্জীভূত ধূলিকণার এক অবাঞ্ছিত মত্ততার বহুমাত্রিক আচরণ । কৌশলে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় সঞ্চিত রক্তাক্ত ন্যারেটিভগুলো পাল্টাতে এই সময় জল কর্দমাক্ত করে দেয় । সমস্ত কবি মন জানে হিংসার কৃতকর্ম দেখতে দেখতে বিস্মিত হওয়ার কোনো কালসীমা নেই। এই আগ্নেয় বিস্ময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে কবির অবিচল সুদৃঢ় কল্পচিত্র মেটাফোরের আকাশ :
এখন শীতলক্ষ্যা কিংবা বুড়িগঙ্গা নদীতে যে শবদেহগুলো
ভাসতে দেখা যায় তারা কি সেই ছন্দসন্তান। যারা একদিন গান
গাইতও, বাঁশি বাজাতও, হারমনিয়ামের ছায়ায় মিশিয়ে দিত নিজেদের ছায়া
একজন দ্রষ্টা বা কবিকে এইসব স্মৃতি ধারণ করেই তাঁর সংবেদনশীল মনে জানাতে হয় :
বৎসবৃন্দ ! নগরে এখন নারকীয় কীটদের উৎপাত। যে আঙুল পথ দেখাতো,
সে আঙুল উত্থাপিত হবে ঠিকই–কিন্তু
ডানে-বামে নড়বে না। যে ঢেউ আমাদেরকে চেনাতো উজান,
সেই ঢেউ দাঁড়িয়ে থাকবে অপরিপক্ক বর্ষায়। (ঐ)
কী গভীর স্পষ্ট ইঙ্গিতময় কবির উচ্চারণ। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী স্বার্থের সংঘাত অগ্নিবর্ষী যুদ্ধের রূপে নিয়ত। একালে ‘স্টার ওয়ার্স’–তারকাযুদ্ধ যুদ্ধের আর এক নাম। এর চাপে কবি বিবশ–বিবশ বিজ্ঞান–প্রযুক্তি বিজ্ঞান–বিবশ বিজ্ঞানী। কবি তাঁর কবিতায় আবেগে ও সম্মানে স্টিফেন হকিং এর কথা নিয়েছেন তাঁর কবি তার মুখপাতে : “We are all different – but we share the same human spirit. Perhaps it’s human nature that we adapt–and survive.
কবি লিখেছেন,
আমি কিছু অনন্ত আগুন চেয়েছিলাম –
রোদগুচ্ছ আমার প্রেমিকা হবে–
কবির স্বপ্ন–কবির জীবনবোধ। কিন্তু অভিজ্ঞতায় প্রত্যক্ষণ ও বেদনার প্রকাশে ভিন্ন ভঙ্গি:
গাজায় বর্বরতম আক্রমণের প্রতিবাদে যেভাবে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং
বয়কট করেছেন জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের
কনফারন্স, আমি ঠিক সে ভাবেই সকল আগ্রাসী মহানায়কদের বিরুদ্ধে
পাঠাতে চাইছি কিছু অগ্নিবৃষ্টি–
এখন কবিও সশস্ত্র প্রতিবাদী যোদ্ধা, অবশ্যই তার অস্ত্র হলো আগ্নেয় শব্দ ও ভাষার বর্ষণ। তাই, ‘ওরা পুড়ে যাক, তছনছ হয়ে যাক ওদের মসনদ। /সর্বহারা শিশুদের চোখের জলে হোক নূহের প্লাবন।’ কবির কল্পে ভূ-আন্দোলন, একটা মহাপ্লাবনের আহ্বান। ন্যায়েরযুদ্ধ জারি।
মানচিত্র নির্মাণ করা ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক ভাবাদর্শের সঙ্গে শুদ্ধ কবিত্বের সমন্বয় বা সমীকরণ সন্দেহাতীতভাবে এক গভীর আত্মপ্রত্যয় ও মগ্নতার দাবি করে।
‘যে কবি নক্ষত্র চেনে’ তার এই যুদ্ধের কথায় যখন নক্ষত্র-দ্রষ্টা স্টিফেন হকিং প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, তখন আর এক নক্ষত্র-বান্ধব কবিকে স্মরণ না করে পারা কি যায়! চলমান যুদ্ধ ক্ষেত্রেই প্রবল বিতৃষ্ণায় জীবনানন্দের উচ্চারণ:
মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই
অনন্ত হাঁটার পথ। সেই পথে যুদ্ধ অন্তহীন। তাই কবি ফকির ইলিয়াস প্রায় এক শতাব্দী পেরিয়ে উপলব্ধি করেন,
কোনো যুদ্ধেরই গন্তব্য নেই–বলতে বলতে
আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম
একাত্তরের দীর্ঘ এক রাতে …
ভাসছে শবদেহ,
মানুষের-মৃত্তিকার-মরমের
এর আগে এমন গণহত্যা
এ মাটিতে কখনও দেখেন’নি পিতামহ”
(নক্ষত্র বিক্রির রাতে )
আসলে বৈজ্ঞানিক, কবি বা দার্শনিক আর সভ্যতার সংকটে নিমজ্জিত হয়ে চলা সমগ্র সমাজ-সমস্ত সচেতন মানুষের মধ্যেই এক বীভৎসার অনভূতি, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’ (জীবনানন্দ)। কবিকে দেশান্তরী হতে হয়। এ তেমন নতুন কথা নয়। হয় রাষ্ট্রীয় হুলিয়া মাথায় নিয়ে , রাজশক্তির বিরাগভাজন হয়ে , রাষ্ট্র-পোষিত ধর্মের জিহাদে অথবা শাসকের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে ভিন্নমত ও দর্শনে আস্থার জ্বালায়–একথা হাজার বছরের অধিক পুরাতন। ইতালি ইংল্যান্ড জার্মান রাশিয়া এবং আমাদের বাংলাদেশ পাকিস্তান বা ভারতে ও আরব রাষ্ট্রেও এ ঘটনা বিরল নয়। ধর্মীয় উগ্রতার বা নিদেনপক্ষে চিন্তার বৈপরীত্যের কারণেই। তখন শিল্পী বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি -সাহিত্যিক দেশান্তরী,নির্বাসনে বা বিরক্তিতে স্বেচ্ছানির্বাসনে । তবে দেশ অন্তরের গভীরে ক্রন্দন করে। আমরা বারবার শরণার্থী হই যুগে যুগে। তখন মনের মধ্যে পরিচয়হীনতার এক সংকট। কবিকে সব বেদনার স্বাদ নিতে হয় নিজস্ব অথবা সংবেদনশীলতার কারণে । তখনই কবির মনে হয়:
আমার কোনো দিনোই কোনো পরিচয় পত্র ছিল না। অথবা যেটা ছিল,
তা আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ের ফেলে
দিয়েছিলাম সুরমা কিংবা ইস্ট রিভারের জলে ।
স্রোতগুলো থমকে গিয়েছিল সেদিন…আকাশ বলেছিল
আমি ও পরিচয়হীন বেঁচে আছি কবি ।
তুমি ও বাঁচো নামগত্রহীন।
এটা বাংলায় কবিতার ভাগ্যে এক নির্ধারিত সত্য, সেই হাজার বছরের পুরাতন বাংলার চর্যাপদের কবিদের কাল থেকে। রাষ্ট্র শক্তি, ক্ষমতাসীন সমাজের প্রভুদের শাসনে কবিরা তাড়া খেয়ে মরে । মায়ের, দেশমাতৃকার আহ্বান তবু জেগে চিরদিন:
তুমি ফিরে এসো।
যে মাটি আমি আঁকড়ে রেখেছি , তা গ্রহণ করো,
আর সেই চিহ্নসমুহ, জারুল গাছের ছায়ায় মিশে যাওয়া
সেই সব মার্বেল সন্ধ্যর আলো…
এখন ভাষা ও ভাবনার অতি পচনশীলতা যখন কবি তার বাস্তব পথে প্রতিবন্ধক, তখনও কবির ফলনশীল থাকা সেটাই আজকের কবির পরিচয়। কবিতা ও কবির পূর্বাপর স্মৃতি ও স্মরণের লালিত আধার দেশ-কাল। স্মৃতি তাকে টানতেই থাকে । ‘চর্যাপদ চর্যাচর্য–বিনিশ্চয়ের পরিযায়ী’ পরিক্রমায় দেশ থেকে দেশান্তরে। তেমনি যন্ত্রণার পর্যটন বারবার ইতিহাসে। যুদ্ধ বেদনাহত সচেতন পূর্ণাঙ্গ কবি ফকির ইলিয়াসের কবিতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ এমনই এক স্থান-কাল এলোমেলো করে দেওয়া জীবনের অতিক্রান্ত গোধূলি সন্ধ্যায়। কবিতা নক্ষত্রের প্রিয়তম আত্মদর্শন আবার আত্মরমণ। আমাদের অনেক স্মৃতি যন্ত্রণার, অনেক স্মৃতি আহ্লাদের, দুঃখের হেঁটমুড়ে আত্মসমর্পণের। যন্ত্রণার বাঁধ ভেঙে গেলে আকাশ ভেঙে পড়া অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধের কথা ও কাহিনি দর্শন স্মরণের মহাফেজখানার খাতায় আঁকা থাকে, লেখা থাকে। কবির দেশ ও কালের যাত্রায় কবি নিষ্ঠাবান সচেতন পরিযায়ী।
কবিকে কেমন করে হাঁটতে হয়, কবিকে কেমন করে দেখতে হয়, কবিকে কেমন করে শিখতে হয়, কবিকে কেমন করে লিখতে হয়! সে যেন ঠিক কবির বুকের মধ্যে দেখা ও অদেখা, চেনা ও অচেনা দেশকাল, আমাদের পিতামহের ব্যবহৃত চেনে বাঁধা পকেট ঘড়ির মতন। বুকের মধ্যে ধরা থাকে। এই এক রকম আমাদের উত্তরাধিকার, যেখান থেকে কবি দেখেন,
একদিন প্রতিটা মানুষ ঢুকে পড়বে তার
মন-মন্দিরের ভেতর,
এবং খুজঁবে নিজের মমি
এভাবে এক সেতু শূন্যতার অন্তরের শক্তিকে ব্যবহার করে নির্মাণ করে বহুমখুী যোগসূত্র। যার মধ্যে ছিল দূরুত্বের অনভুব, সেখানেই এসে পড়ে নৈকট্যের অনুভূতি। কবি ছায়া পথের চিরদিনের পথিক। ফকির ইলিয়াস কবিতার শূন্যতার অধিকর্তা–নদীর স্রোতের সঙ্গে হাওয়ায় হাওয়ায় এবং মধ্যাকর্ষের ঊর্ধ্বে মহাবিশ্ব পটে কবিতার ডানা মেলা তাঁর।
কবিতার পর কবিতা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয় খেয়া বেয়ে চলেছি; বড় অচেনা পৃথিবীর সব অনাদি কালের চেনা লোক। ছোট বড় ঘর। জীবনের শান্ত সমাবেশ। এখানে তো শব্দবন্ধে কবি তারা আপন রহস্য নগরী, অথবা কুমারী গ্রাম শস্য বীজ। জলের ঢেউয়ের ছায়া।
মানচিত্র নির্মাণ করা ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক ভাবাদর্শের সঙ্গে শুদ্ধ কবিত্বের সমন্বয় বা সমীকরণ সন্দেহাতীতভাবে এক গভীর আত্মপ্রত্যয় ও মগ্নতার দাবি করে । কবি ইলিয়াস সময়ের ঘূর্ণির কাছে তার স্বক্ষর: জীবনবোধর সুতীব্র আবেগের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত পরিশীলিত কণ্ঠস্বর ইলিয়াসের পরিচয় :
ময়নামতি নদীর উত্তরে আজ জেগে উঠেছে
যে চর; সে খানেই একদিন ভেসে উঠেছিল
আমার বোনের শবদেহ।… আর সেই দেহ
ঢেকে দিয়েছিল একটি বেওয়ারিশ সূর্য।
এবং তারও পরে :
নদীদের স্রোত লিখে,মানুষের প্রেমের আখ্যান
ভোজে আর উৎসবে লেগে আছে ফসলের ছবি
আরেকটি কবিতা হাতে গ্রামপথে দাঁড়িয়ে আছে কবি।
২৮ ডিসেম্বর কবি ফকির ইলিয়াসের জন্মদিন। তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।