[পর্ব-৪: শেষপর্ব]
বাংলা কবিতার চিরায়ত অলঙ্কারগুলো
অলঙ্কার শব্দের মূলে আছে সংস্কৃত ভাষার ‘অলম’। যার অর্থ ভূষণ। অলঙ্কার শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ধরে আলঙ্কারিকেরা বলেন, যার দ্বারা ভূষিত করা হয়, তাই অলঙ্কার। আচার্য দণ্ডীর মতে, কাব্যের যে-সব ধর্ম তার শোভা সম্পাদন করে, তাই অলঙ্কার। আর আচার্য বামন বলেন, কাব্য অলঙ্কারের কারণেই গ্রাহ্য হয়। অর্থাৎ অলঙ্কার আছে বলেই কাব্য পাঠকের কাছে আস্বাদনযোগ্য হয়ে ওঠে।
কেন? —বলছি সে কথাও। যেকোনো বাক্য পাঠ করার সময় তার দুটি দিক পাঠককে আকৃষ্ট করে। এগুলো হলো—শব্দের ধ্বনি (Sound) ও অর্থ (Sense)। তাই শব্দের ধ্বনিরূপ ও অর্থরূপের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে প্রধানত দুই ধরনের অলঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ধ্বনিরূপকে অবলম্বন করে যে অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালঙ্কার, আর শব্দের অর্থকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অলঙ্কারকে বলা হয় অর্থালঙ্কার। শব্দালঙ্কার এক্ষেত্রে শব্দ বা ধ্বনি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। শব্দের ধ্বনিরূপের বিপর্যয় ঘটলে শব্দালঙ্কারের কোনো তাৎপর্য থাকে না। দেখুন, জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির বিশেষ একটি পঙ্ক্তি—‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’। এই পঙ্ক্তিটিতে ‘র’ ধ্বনির বারবার উচ্চারণের ফলে এক ধরনের তাড়নজাত ধ্বনি সৃষ্টি হয়েছে। একই ধ্বনির এমন পুনরাবৃত্তির মাধ্যমেই শব্দালঙ্কারের সৃষ্টি হয়।এই শব্দালঙ্কারের নাম ‘অনুপ্রাস’।
শব্দালঙ্কারের নানা শ্রেণিবিভাগ রয়েছে; তার মধ্যে প্রধান বিভাগগুলো হলো: অনুপ্রাস, যমক, বক্রোক্তি, কাকু বক্রোক্তি, শ্লেষ ও পুনরুক্তবদাভাস।কাকু বক্রোক্তির একটি উদাহরণ, ‘রাবন শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী, আমি কি ডরাই সখি, ভিখারী রাঘবে?’ অর্থাৎ ‘আমি ডরাই না’। মেঘনাদ পত্নী প্রমীলা এই বক্তব্যটিতে সরাসরি ‘না’বাচক শব্দ ব্যবহার না করেও কাকু অর্থাৎ তার কণ্ঠস্বরের ওপর জোর দিয়ে তা বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন।
অর্থালঙ্কার শব্দের অর্থরূপের সাহায্যে যে-সব অলঙ্কার সৃষ্টি হয় তাকে বলে অর্থালঙ্কার। অর্থালঙ্কারে শব্দধ্বনি গৌণ, তার অর্থই প্রধান। এজন্য অর্থ ঠিক রেখে শব্দ বদলে দিলেও অর্থালঙ্কারের কোনো পরিবর্তন হয় না। সাধারণ লক্ষণ অনুযায়ী অর্থালঙ্কারকে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলো—সাদৃশ্যমূলক, বিরোধমূলক, শৃঙ্খলামূলক, ন্যায়মূলক ও গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক।
সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার সাধারণত দুটি ভিন্ন ধরনের বিষয় বা বস্তুর মধ্যেকার কোনো সাদৃশ্যের ওপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়। যেমন—‘মেয়েটি দিন দিন লতার মতো বেড়ে উঠছে।’ এখানে ‘মেয়েটি’ এবং ‘লতা’ দুটি ভিন্নধর্মী পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্যের কারণে তুলনা করায় সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। আলঙ্কারিক পরিভাষায় এর নাম উপমা।
উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, অপহ্নুতি, সন্দেহ, নিশ্চয়, প্রতিবস্তুপমা, দৃষ্টান্ত, নিদর্শনা, ব্যতিরেক, ভ্রান্তিমান, সমাসোক্তি, প্রতীপ প্রভৃতি সাদৃশ্যমূলক অলঙ্কারের অন্তর্ভুক্ত।
প্রত্যেক কবিকেই জীবনের কোনো না কোনো প্রান্তে এসে এরকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কেউ জবাব দেন, কেউ বা দেন না। নীরব থাকেন অথবা বলেন, ভালো লাগে তাই লিখি। লিখে আনন্দ পাই—তাই লিখি। সহজ সরল উত্তর।
বিরোধমূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয় দুটি পদার্থের আপাত বিরোধকে অবলম্বন করে। যেমন: ‘বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে’। এখানে আপাত বিবেচনায় ‘বড় হওয়া’ এবং ‘ছোট হওয়া’—দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও প্রকৃত কোনো বিরোধ নেই। তাই এটি বিরোধমূলক অলঙ্কারের উদাহরণ। বিরোধমূলক অলঙ্কারের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য হচ্ছে বিরোধাভাস, বিভাবনা, বিশেষোক্তি, অসঙ্গতি ও বিষম অলঙ্কার।
শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কার হয় বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে বাক্যাংশের শৃঙ্খলাকে অবলম্বন করে। যেমন—‘পরশে চাহনি তার, দৃষ্টিতে চুম্বন/ আর চুম্বনে মরণ’। এখানে ‘পরশ’রূপ কারণের কাজ ‘চাহনি’, ‘চাহনি’ বা দৃষ্টিরূপকারণের কাজ চুম্বন, আর ‘চুম্বন’রূপ কারণের কাজ মৃত্যু। এ তিন বাক্যাংশের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়েছে বলে এটি শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কারের দৃষ্টান্ত। শৃঙ্খলামূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে কারণমালা, একাবলি ও সার।
ন্যায়মূলক অলঙ্কার গড়ে ওঠে যখন কোনো বক্তব্য ন্যায়সঙ্গত সমর্থনসহ উপস্থাপিত হয়। যেমন—‘এ জগতে হায় সে বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি/রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।’ এখানে প্রথম চরণের বিষয়টি দ্বিতীয় চরণ দিয়ে সমর্থিত হওয়ায় ন্যায়মূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ন্যায়মূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে অর্থান্তরন্যাস ও কাব্যলিঙ্গ।
গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কার সৃষ্টি হয় সাধারণ বক্তব্যের আড়ালে আরেকটি গভীর অর্থ থাকলে। যেমন—‘অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ/ কোনো গুণ নাই তার কপালে আগুন।’ এখানে আপাত দৃষ্টিতে নিন্দা বোঝালেও প্রকৃতপক্ষে শিবের প্রশংসা করা হয়েছে। তাই এখানে গূঢ়ার্থপ্রতীতিমূলক অলঙ্কারহয়েছে। গূঢ়ার্থমূলক অলঙ্কারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাজস্তুতি ও অপ্রস্তুতপ্রশংসা।
আধুনিককালে অসংখ্য পাশ্চাত্য অলঙ্কার বাংলা কাব্যে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। সেগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে মহোপমা (Epic Simile), ধ্বনিবৃত্ত (Onomatopoeia), পরাবৃত্তি (Chiasmus) প্রভৃতি। কাব্য জিজ্ঞাসার বিপুল সমুদ্রে আমার এসব কথা নিতান্তই তরঙ্গজল।
কবিতা কী—প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিলেই নানা মুনির নানা উক্তি উল্লেখ করে বলতে চেষ্টা করেছি, কবিতা আসলে কী? শেষ পর্যন্ত কবিতা পাঠ করে ‘সহৃদয়হৃদয়সংবাদী’ পাঠকের চিত্ত যা বলবে, তাই শেষকথা।
কিন্তু কবিতা কেন লিখি?
বাংলা কবিতার প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিতার সবটাই দেবতাদের গুণকীর্তনের জন্যে একদা রচিত হয়েছে। এজন্যে সে যুগের কবিদের একটাই উত্তর— দেবতা সন্তুষ্টির জন্যে কবিতা লিখি। কিন্তু যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় প্রথম আমরা হোচট খেলাম। যেকোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে যে কবিতা লেখা যায়, তিনি তাই দেখালেন ‘তপসে মাছ’, ‘আনারস’, ‘পাঁঠা’, ‘রসের ছাগ ‘ নামক কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। এমনকী নারী শিক্ষার বিরোদ্ধচারণ করেও তিনি কবিতা লিখেছেন। এজন্য তার সম্পর্কে বলা হতো ‘এত বড় প্রতিভা ইয়ার্কিতেই ফুরাইলো।’ তারও কবিতা রচনার কারণ সহজেই আমরা বুঝতে পারি।
বিহারীলাল চক্রবর্তী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—দু’জনেই জীবনদেবতাকে তুষ্ট করতেই লিখেছেন। চাঁদের সৌন্দর্য পিপাসার চেয়ে ক্ষুধার রুটি যে অনেক বেশি প্রার্থনীয়, সুকান্ত ভট্টাচার্য সেই অকাট সত্যটি তুলে ধরতেই যেন কলম ধরেছিলেন জীবনের সামান্য সময়ে।
প্রত্যেক কবিকেই জীবনের কোনো না কোনো প্রান্তে এসে এরকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কেউ জবাব দেন, কেউ বা দেন না। নীরব থাকেন অথবা বলেন, ভালো লাগে তাই লিখি। লিখে আনন্দ পাই—তাই লিখি। সহজ সরল উত্তর। এতে কবিতার ছন্দ-অলঙ্কার কিছুরই প্রয়োগ করতে হয় না।
আধুনিক কালের কবিরাও এই সমাজেরই স্পর্শকাতর, সূক্ষ্ম অনুভূতির সৃজনশীল মানুষ।
সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরাসরি অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন না। অনেকে কবিতার ভাষার আড়ালে তাকে ব্যক্ত করতে চান। এজন্যও অনেকে কবিতা লেখেন। ‘কেন লিখি’—এই নামে রফিক আজাদের একটি কবিতা খুঁজে পেয়েছি, তার সমসাময়িক অনেকের কাব্যগ্রন্থ খুঁজে এই জাতীয় লেখার তল্লাসি করে ব্যর্থ হলাম। তাহলে সেই উদ্ধৃতিগুলো লেখাটিকে সমৃদ্ধ করতো। তবে, রফিক আজাদের কবিতাটি উল্লেখপূর্বক এই নিবন্ধের ইতি টানছি আপাতত।
কেন লিখি ॥ রফিক আজাদ
এ-রকম প্রশ্ন শুনে শূন্য শস্যক্ষেতে একদৃষ্টে
তাকিয়ে থাকতে হয়, বড়ো নিরুপায়।
এ-রকম প্রশ্ন শুনে কোনো-কোনো ক্ষণে
আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে।
সামান্য যেটুকু আয়ু পার হয়ে এখানে এসেছি—
তাকিয়ে থাকতে হয়—শূন্য পথে—নির্বাক, নিশ্চল!
বুক্র ভেতর বড় ভয়—তেতো হয়ে যায় মুখ—
শরীরে কম্পন জাগে, নিষ্প্রদীপ ঘরে
দীর্ঘস্থায়ী দীর্ঘশ্বাস ঘোরাফেরা করে!
কেন লিখি?—স্তর-পরম্পরাক্রমে আমার পদ্যের মধ্যে
সে কথাটি, বারবার নানাভাবে বলতে চেয়েছি…কেন লিখি?—নির্বিবেক মধ্যবিত্ত পাঠকের পরম্পরাময়
মাংসল পাছায় খুব কষে লাথি-মারা সম্ভব হয় না বলে
লাথির বিকল্পে লেখা, বারবার, মুদ্রিত পৃষ্ঠার
মাধ্যমেই পাঠাই…শেষ
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জিজ্ঞাসায় কবিতা কী এবং কেন-৩॥ দিলারা হাফিজ