[পর্ব-৩]
বাংলা কবিতা বিশ্লেষণ: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যরীতি-সম্বন্বয়
বাংলা কবিতার হাজার বছরের ইতিহাসে ‘চর্যাপদ’ আবিষ্কার একটি মাইলফলক। বাংলা ভাষার কাল-চেতনার অবস্থানকে যেমন তা সুদৃঢ় করেছে, তেমনি বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন হিসেবে বাংলা ভাষার পতাকাটি উড্ডীন করেছে সগৌরবে। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের উপর্যুক্ত ধারার বাতাবরণেই বাংলা ভাষায় কাব্যবিচার শুরু হয়। তবে এই ইতিহাস খুব যে পুরনো, তা নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন যথাক্রমে চর্যাপদ (১০ম শতক) ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (১৪শ শতক) ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু ওই সময়ে বাংলা ভাষায় কাব্যতত্ত্ববিষয়ক কোনো গ্রন্থেরই সন্ধান মেলে না। যদিও দু’টি কাব্যেই শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের প্রচুর প্রয়োগ রয়েছে।
মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য কিংবা মধ্যযুগের অন্যান্য ধারার খ্যাতিমান বাঙালি কবিদের রচনায় কাব্য সম্পর্কিত ভাবনার কিছুটা পরিচয় মেলে। তারা যে অলঙ্কারশাস্ত্রে অভিজ্ঞ ছিলেন, তা তাদের রচনায় শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের ব্যবহার দেখে সহজেই বোঝা যায়। এসব রচনায় তারা সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের রীতি ও বৈচিত্র্যের বাইরে স্বতন্ত্র কোনো আলঙ্কারিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করেননি; হয়তো তার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। কারণ সংস্কৃতের সঙ্গে তাদের ছিল প্রাত্যহিক সম্পর্ক এবং বিদ্যাশিক্ষার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল সংস্কৃতের বাধ্যতামূলক চর্চা। ফলে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রকেই তারা বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন।
তবে স্বাধীনভাবেও তারা কাব্যচিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এক্ষেত্রে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, আলাওল ওভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। দেবী চণ্ডীর মহিমাগীত বর্ণনার পাশাপাশি সেকালের সমাজ চিত্রও অঙ্কন করেছেন তিনি। ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ ফুল্লারার গৃহে কিছুদিন বাস করার অনুমতি চাইলে দেবী চণ্ডী, সতীন সন্দেহে ফুল্লরার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া, তাই ব্যক্ত হয়েছে এখানে।
তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি
এই স্থানে কত দিন করিব বসতি।
হেন বাক্য হৈল যদি অভয়ার তুণ্ডে
পর্বত ভাঙিয়া পড়ে ফুল্লরার মুণ্ডে
হৃদে বিষ মুখে মধু জিজ্ঞাসে ফুল্লরা
ক্ষুধা তৃষ্ণা দূরে গেল রন্ধনের ত্বরা।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের বিখ্যাত অন্নদামঙ্গলকাব্য তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। দেবী অন্নদার গুণকীর্তনের জন্যে রচিত হলেও এই প্রথম মর্ত্যের মানুষের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে এই কাব্যে। কাব্যটির প্রধান চরিত্র ‘ঈশ্বরী পাটনী’। ঈশ্বরী পাটনীর মুখে উচ্চারিত সেই প্রার্থনাটি তো প্রতিটি বাঙালি পিতা-মাতার চিরন্তন প্রার্থনা—‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। অন্নদামঙ্গল কাব্যটি ১৮ শতকের শ্রেষ্ঠতম কাব্য হিসেবে স্বীকৃত। ভাষা-ছন্দ ব্যবহারে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বৈষ্ণবকবিরা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের অনুসারী হলেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা কোথাও কোথাও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন বিদ্যাপতির বিরহের একটি পদে ভাদ্র মাসের ভরা বর্ষাকালের চিত্র ফুটেছে এভাবে—‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর’।
রাধা-বিরহের পদে চণ্ডীদাস ফুটিয়ে তুলেছেন কৃষ্ণের প্রতি রাধার আর্তি, কৃষ্ণ কালো, মেঘ কালো, সেই মেঘের পানে তাকিয়ে আছে রাধা আহারে বিরতি দিয়ে।
সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে/ না চলে নয়নতারা
বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে, যেমতি পরাণপারা।
অথবা/
সই, কেমনে ধরিবো হিয়া,
আমারই বধূয়া আনবাড়ি যায়
আমারই আঙ্গিনা দিয়া
উনিশ শতকের প্রথমদিকে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও লালমোহন বিদ্যানিধি কাব্যবিচারে সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তাদের পরবর্তী সময় থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ফলে প্রাচ্য অলঙ্কারশাস্ত্রের আধিপত্য অনেক ক্ষেত্রেই শিথিল ও ক্রমশ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শই বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সমধিক জনপ্রিয় ও অনুসরণীয়।
বিশেষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শিল্পসাহিত্যে বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক প্রকরণে যে পরিবর্তন এসেছে, সেই ধারায় বাংলা কবিতাও তার প্রাচ্য কাব্যার্দশকে সমুন্নত রেখে পাশ্চাত্য সাহিত্যের আধুনিক কাব্যার্দর্শের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলিত একটি নতুন কাব্য জিজ্ঞাসার সমন্বয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, দীনেশ চন্দ্র সেন, প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ আধুনিক বাঙালি সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চার যে আদর্শ অনুসরণ করেছেন, তা ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ধারার সংমিশ্রণ। বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের পাশ্চাত্যমুখী করেছে তুমুলভাবে। বিশেষভাবে এই ধারায় স্নাত হয়েছে বাংলা কবিতার পঞ্চপাণ্ডব।
বর্তমান বাংলা সাহিত্যের আদর্শও পূর্ব-পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্বের সংশ্লেষের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক নতুন উদ্যান।
চলবে…
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জিজ্ঞাসায় কবিতা কী এবং কেন-২ ॥ দিলারা হাফিজ