[পর্ব-২]
প্রাচ্য অলঙ্কারশাস্ত্র: কবিতার আত্মা ও শরীর
ভারতবর্ষে সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছিল বহু আগে। সংস্কৃত ভাষায় একে সাহিত্যশাস্ত্র বা সাহিত্যতত্ত্ব নামে অভিহিত করা হয়। বাংলার অলঙ্কারশাস্ত্র মূলত সংস্কৃত ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্রের অনুবর্তন। ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন আকরগ্রন্থ আচার্য ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র’। গ্রন্থটি খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আচার্য ভরত ছিলেন মূলত নাট্যশাস্ত্রকার, তাই তার আলোচনার মূল বিষয় ছিল নাটক ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়। সঙ্গত কারণেই তিনি বাক্য, বাক্যবিন্যাস, বাক্যের দোষ, গুণ, অলঙ্কার, লক্ষণ ও আট প্রকার শৃঙ্গার রসের আলোচনাও করেছেন।
আচার্য ভরতের পরে শ্রেষ্ঠ দু’জন আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডী ও আচার্য ভামহ। দণ্ডী রচনা করেন ‘কাব্যাদর্শ’ নামের একটি বিখ্যাত অলঙ্কার শাস্ত্রের গ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি কাব্যের গুণ, ধর্ম ও প্রকারভেদ আলোচনা প্রসঙ্গে ছত্রিশটি অর্থালঙ্কার উদাহরণসহ আলোচনা করেছেন। আচার্য দণ্ডীর মতে, ‘অলঙ্কার হচ্ছে কাব্যের সৌন্দর্য বিধায়ক। কাব্যের যে সব ধর্ম তার শোভা সম্পাদন করে, তাই অলঙ্কার। এই শোভা সম্পাদনের বিষয়টি বাইরে থেকে আরোপিত নয়, তা কাব্যের অঙ্গীভূত সৌন্দর্য।
সপ্তম—অষ্টম শতকের দিকে ভামহ ‘কাব্যালঙ্কার’ নামে অন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার মতে, ‘শব্দ ও অর্থের সমন্বয়ই কাব্য’। অলঙ্কার শাস্ত্রবিদ ভামহের পরে আচার্য বামন (৮০০-এর কাছাকাছি) তার ‘কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তি’ গ্রন্থে সূত্রাকারে প্রথম অলঙ্কারশাস্ত্র ব্যাখ্যা করেন। বামনের বিচারে উপমাই প্রধান অলঙ্কার। তিনি আরও বলেছেন, ‘কাব্যং গ্রাহ্যম অলঙ্কারাৎ’। অর্থাৎ কাব্য অলঙ্কারের কারণেই গ্রাহ্য হয়। অলঙ্কার আছে বলেই পাঠকের কাছে তা আস্বাদন যোগ্য হয়ে ওঠে। তিনি এর সঙ্গে এক নতুন তত্ত্ব যুক্ত করে বলেছেন, ‘রীতিত্মা কাব্যস্য’। অর্থাৎ রীতিই হচ্ছে কাব্যের আত্মা। রীতি বলতে তিনি পদ রচনার বিশিষ্ট পদ্ধতিকেই বুঝিয়েছেন। বামন কথিত কাব্যের আত্মা বা মতবাদ পরবর্তীকালে অলঙ্কার শাস্ত্রের মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
কাব্যের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে আলঙ্কারিকদের মধ্যে এই যে মতভেদ ও বিতর্ক, তার ওপর ভিত্তি করে অলঙ্কারশাস্ত্রের ছয়টি প্রস্থান গড়ে ওঠে। এগুলো হলো—১) রস প্রস্থান, ২) অলঙ্কার প্রস্থান ৩) গুণ প্রস্থান ৪) রীতি প্রস্থান ৫) ধ্বনি প্রস্থান ও ৬) বক্রোক্তি জীবিত প্রস্থান।
বামনের মতে, পদরচনার চমৎকারিত্বের ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়। বক্রোক্তিপ্রস্থানের প্রবক্তা হচ্ছেন আচার্য কুন্তকের মতে, বক্রোক্তি হলো কাব্যের আত্মা। বক্তার কথা বক্রোক্তিতে সঠিক অর্থে গ্রহণ না করে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করা হয়। তার মতে, শব্দার্থের এ বক্রতার ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়।
এই ছয়টি প্রস্থানের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে বেশ ক’জন আলঙ্কারিকের তাত্ত্বিক আলোচনায় উঠে আসে মূলত কাব্যের আত্মাপ্রসঙ্গ। কাব্যের শরীরের অস্তিত্ব সব মহাজনই মেনে নিয়েছেন, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ভিন্ন ভিন্ন যত মতবাদ গড়ে উঠেছে, সবই কাব্যের আত্মার অনুসন্ধানে বা অন্বেষণে।
আত্মা কী? কিংবা কাব্যের কোন গুণকে আত্মা হিসেবে মান্য করা হবে, সেই সুরাহা এসেছে আলঙ্কারিকগণের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। অলঙ্কার প্রস্থানের প্রধান প্রবক্তা আচার্য ভামহ, উদ্ভট ও রুদ্রটের মতে, অলঙ্করই কাব্যের মূল, অলংকার না থাকলে কাব্যের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয় না, অলঙ্কারের যথাযথ ব্যবহারে বাক্য কাব্যময় হয়ে ওঠে। কাজেই অলঙ্কারই কাব্যের আত্মা।
ধ্বনি প্রস্থানের প্রবক্তা হচ্ছেন আনন্দবর্ধনের মতে, ধ্বনি হচ্ছে কাব্যের আত্মা। ধ্বনিবাদীরা অবশ্য অলঙ্কারকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন না; তবে তারা অলঙ্কারবাদীদের মতো অলঙ্কারকে কাব্যের বহিরাঙ্গিক বিষয় মনে না করে বরং কাব্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করেন। তারা বলেন, অলঙ্কার কাব্যের আস্বাদনযোগ্যতা বাড়ায় সত্য, কিন্তু তা কাব্যের আত্মা নয়। মূলত রস ও রূপ—এই দুই সত্তা নিয়েই কাব্য হয়ে ওঠে। এই দুটির মধ্যে রয়েছে আজন্ম অচ্ছেদ্য (Organic) সম্পর্ক। যথোচিত অলঙ্কার যেমন নারীর সৌন্দর্যবৃদ্ধি করে, তেমনি কাব্যেরও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তবে ধ্বনিবাদীদের মতে, কেবল অলঙ্কারের ওপরই কাব্যত্ব নির্ভর করে না; অলঙ্কৃত বাক্য যেমন কাব্য, তেমনি অনলঙ্কৃত বাক্যও সার্থক কাব্য হতে পারে।
নারীর লাবণ্য যেমন তার অঙ্গসংস্থান বা অলঙ্কারের অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়, তেমনি কাব্যের কাব্যত্ব শব্দ, অর্থ, অলঙ্কার বা রচনারীতির অতিরিক্ত অন্য কোনো বিষয়। আর সে অতিরিক্ত বিষয়ই হচ্ছে ধ্বনি। অর্থাৎ ‘ধ্বনি’ হচ্ছে ব্যঞ্জনা বা প্রতীয়মান অর্থ। যা বাক্যের বাচ্যার্থের চেয়ে ব্যঙ্গ্যার্থকে প্রধান করে তোলে তা-ই ধ্বনি। এ ধ্বনি তিন প্রকার বস্তুধ্বনি, অলঙ্কারধ্বনি ও রসধ্বনি। এগুলোর মধ্যে রসধ্বনি প্রধান। অভিনবগুপ্ত ধ্বনিবাদেরই একজন সমর্থক ছিলেন। আনন্দবর্ধনের মতে, রসের ধ্বনিই হলো শ্রেষ্ঠ, কাব্যের আত্মা।
গুণপ্রস্থানের প্রধান প্রবক্তা আচার্য দণ্ডী অলঙ্কারকে বলেছেন, কাব্যের শোভাবর্ধক, কিন্তু গুণকে বলেছেন কাব্যের আত্মা। দণ্ডী তার গ্রন্থে শ্লেষ, প্রসাদ, সমতা, মাধুর্য, অর্থব্যক্তি, ওজঃ—এমন দশটি গুণের কথা বলেছেন। তার মতে, এক বা একাধিক গুণের সমাবেশেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়। রীতিপ্রস্থানের প্রবক্তা আচার্য বামন বলেছেন, রীতিরাত্মা কাব্যস্য। অর্থাৎ রীতিই হচ্ছে কাব্যের আত্মা। রীতি বলতে তিনি পদরচনার পদ্ধতিকে বা বিশিষ্ট শৈলীকে বুঝিয়েছেন। প্রধান পদরীতি হচ্ছে তিনটি গৌড়ী, বৈদর্ভী ও পাঞ্চালী। বামনের মতে, পদরচনার চমৎকারিত্বের ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়। বক্রোক্তিপ্রস্থানের প্রবক্তা হচ্ছেন আচার্য কুন্তকের মতে, বক্রোক্তি হলো কাব্যের আত্মা। বক্তার কথা বক্রোক্তিতে সঠিক অর্থে গ্রহণ না করে ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করা হয়। তার মতে, শব্দার্থের এ বক্রতার ফলেই কাব্যত্বের সৃষ্টি হয়। তা পাঠককে আনন্দও দেয়। তবে, শুরুতেই বলেছি নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থের প্রণেতা আচার্য ভরতের কথা। যিনি কাব্যে প্রযোজ্য আটটি রসের কথাও বলেছিলেন। প্রাচীনতম এই প্রবক্তা আচার্য ভরত রস প্রস্থানকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন। তার মতে, রসই কাব্যের আত্মা বা মূল। রস ছাড়া কাব্য হতে পারে না।
মানবমনের এই নয়টি ভাব বিভিন্ন স্তর পার হয়ে রসে রূপান্তরতি হয়। রস ছাড়া কোনো কাব্যই রচিত হতে পারে না। তাই অলঙ্কারশাস্ত্রে রস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে।
আচার্য ভরত তার গ্রন্থে কাব্যের গুণ, অলঙ্কার ও বৃত্তির বিচার করে বলেছেন, এগুলো কাব্যের বাহ্যবস্তু, আন্তর বিষয় হলো রস। তিনি যে আটটি রসের পরিচয় দিয়েছেন, সেগুলো হলো—১) শৃঙ্গার রস ২) হাস্যরস ৩) করুণ রস ৪) রৌদ্ররস ৫) বীররস ৬) ভয়ানক রস ৭) বীভৎসরস ও ৮) অদ্ভুত রস। ভরতের মতে, বাক্য বিন্যাসের মাধ্যমে যখন এর যেকোনো একটি রসের উদ্ভব ঘটে, তখনই তাকে বলে কাব্য। পরবর্তী সময়ে আচার্য অভিনবগুপ্ত ‘শান্ত’ রসকে সংযুক্ত করে রসের সংখ্যা নয়-এ উন্নীত করেন। নয়টি স্থায়ী ভাব থেকেই নয়টি রসের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
কাব্যতত্ত্বের প্রধান পুরুষ আচার্যভরত বলেছেন, ‘রস ছাড়া কোনো বিষয়েরই সূত্রপাত হয় না।’ আর বিশ্বরাজ বলেছেন, ‘যা রসিত বা আস্বাদিত হয়, তাই রস।স্থায়ী নয় প্রকার ভাব থেকে নয় প্রকার রস সৃষ্টি হয়েছে বলে আলঙ্কারিকেরা ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। এগুলো হলো—১) বিস্ময় ভাব থেকে অদ্ভুত রস, ২) রতি ভাব থেকে শৃঙ্গার রস, ৩) হাস ভাব থেকে হাস্য রস, ৪) শোক ভাব থেকে করুণ রস, ৫) ক্রোধ ভাব থেকে রৌদ্র রস, ৬) উৎসাহ ভাব থেকে বীর রস, ৭) ভয় ভাব থেকে ভয়ানক রস, ৮) জুগুন্সা ভাব থেকে বীভৎস রস ও ৯) শম ভাব থেকে শান্ত রস।
একটি জাতির আদর্শ ও মাহাত্ম্য নিয়ে যেসব মহাকাব্য বা কাব্য রচিত হয়, তা অধিকাংশ সময়ে বীর রসের হয়ে থাকে। উৎসাহ ভাব থেকে বীর রসের সৃষ্টি হয়। সে বিচারে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনাকালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম সর্গেই যদিও ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘গাইবো মা বীর রসেভাসি মহাগীত’; তবু কাব্যের পরিশেষে মৃত্যু ও শোকের ঘটনা বর্ণনায় তা করুণ রসের কাব্যে পরিণত হয়েছে। তবে, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি সার্থক বীররসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বল বীর,
বল উন্নত মমশির
শির নেহারি আমারি নত-শির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
মানবমনের এই নয়টি ভাব বিভিন্ন স্তর পার হয়ে রসে রূপান্তরতি হয়। রস ছাড়া কোনো কাব্যই রচিত হতে পারে না। তাই অলঙ্কারশাস্ত্রে রস একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে।
চলবে…
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য জিজ্ঞাসায় কবিতা কী এবং কেন-১॥ দিলারা হাফিজ