[পর্ব—১]
কবিতা কি বিমূর্ত শিল্প?
কবিতা কি বিমূর্ত শিল্প—এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, না। মোটেই নয়। তবে, কবিতার সৌন্দর্য তো বিমূর্ত হতেই পারে। যা ইংরেজি শব্দ ‘abstract’ এর নামান্তর। এই বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’ কবিতাটির সৌন্দর্যও বিমূর্তের উদাহরণ। কবিতা মাত্রই মূর্ত কিন্তু কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য অধরা ও বিমূর্ত। মূর্ত, বিমূর্তের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভাঁজে ভাঁজে কবিতার আত্মার যে অন্বেষণ ও অনুসন্ধান কাব্যজিজ্ঞাসার মৌলিক প্রশ্ন, হাজার বছর পেরিয়েও তা ছুটে চলছে নিরন্তর। সেই সমাধানে পৌঁছানোর আগে অবশ্যই জেনে নিতে হবে, কবিতার কি শরীর আছে?
মানুষের মতোই কবিতারও দিব্যকান্তি একটি ছিপছিপে শরীর আছে। অধিকাংশ সময় তাকে হালকা-পাতলা গড়নে দেখা যায় সাহিত্যপাতায়, কাব্যগ্রন্থের পৃষ্ঠাজুড়েই। সেখানে সে মূর্তভাবে বসত করে। গদ্যের মতো ভারী ও মোটাসোটা নয়। খুবই এক স্মার্ট গড়নের শরীরের অধিকারী সে।
আচ্ছা, সে না হয় হলো, মানলাম সেই অভিজ্ঞান। কিন্তু কবিতার দেহগঠনের প্রধান উপকরণ কী? নিঃসন্দেহে সব বোদ্ধা পাঠক একমত হবেন—শব্দই কবিতার অস্থি-মজ্জা। রঙধনুর মতো নানাবর্ণের শব্দসুতোয় গেঁথে কবিতার শরীরিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন কবি। এ জন্য কবিদের বলা হয় শব্দের সওদাগর। বলা যায় শব্দ কারবারি, এমনকি তিনি স্বপ্নদ্রষ্টাও। শব্দের কারিগর যে কবি, তিনি শব্দে শব্দে স্বপ্নের সৌধমালা নির্মাণ করে পক্ষান্তরে একটি কবিতার শরীর কাঠামো সৃষ্টি করেন। যা কেবলই দূর ও সুদূরের মধ্যখানে অধরা উজ্জয়িনীর তীরে দাঁড়ানো সুশ্রী ও সুন্দর এক দেহ-বল্লরীও বটে। ভারী গদ্যের তুলনায় দেখতে সে বেশ আকর্ষণীয়।
আমরা তা চোখের সামনে দেখতে পাই। স্পর্শ করতেও পারি আস্বাদনের মধ্যে দিয়ে। অনেক কবিতাপ্রেমীদের কাছে প্রার্থিত রসমূর্তি সে। শব্দ ও অর্থের এক অনাস্বাদনপূর্ব পারম্পর্য। তাকেই ডাকি আমরা ‘কবিতা’ নামে। কেউ কেউ আদর করে তাকে বলে, ‘কল্পনালতা’। আজও সে অন্তহীন রহস্যের শেকড়। কবিতাকে কি নারী হিসেবে কল্পনা করা হয়—যেমন, মাকে সর্বংসহা ধরিত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়? এই হিসেবে পৃথিবী স্ত্রীলিঙ্গ। কবিতা কি তবে তারই কন্যাসন্তান? সন্তান তো বটেই।
পুরাকালে দেবী সরস্বতী ব্রহ্মার কাছে সন্তান লাভের বর চাইলে সেই বরে তিনি তমসা নদীর তীরে এক দিব্যকান্ত অনিন্দ্যসুন্দর কাব্যসন্তান জন্ম দেন। বলা হয়ে থাকে, তখন থেকেই কবিতার জন্ম।
বিতার মতো শুদ্ধচারী শিল্পশাখার পাঠকপ্রিয়তা কিংবা বোদ্ধা পাঠক কোনোকালেই খুব বেশি ছিল না। সেই চর্যাপদের কাল থেকেই। তবু, যুগে যুগে কবিতা নিয়ে ভাবনা-রহস্যের অন্ত নেই। তার ভালোবাসারও শেষ নেই।
কবিতা নারী অথবা পুরুষ যাই হোক, সে বিচারে কাজ নেই। তবে খুঁজলে কবিতারও আলাদা একটি সত্তার সন্ধান পাওয়া যাবে। বস্তু জগতের কাহিনি নিয়ে কবি যে অলৌকিক মায়ার জগৎ সৃষ্টি করেন, সেই মুহূর্তেই তার কল্পনাশক্তির বলে কবিতার মধ্যে একটি মেজাজ বা সত্তাও সৃষ্টি করেন। কাজেই, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়—কবিতা কেবল শরীরসর্বস্ব নয়, আত্মা বা মন বলেও কিছু আছে তার। সে কথা আমাদের মানতেই হবে। কবিতার শরীর যেহেতু আছে, সেহেতু ধারণা করি, আত্মাও আছে। নইলে, খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে পাশ্চাত্য সাহিত্যে, এমনকি আমাদের প্রাচীন ভারতীয় মহাজনেরা কেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন আঁতিপাতি করে?
শুধু তাদের কথাই-বা এককভাবে বলি কিভাবে?
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন—একদা তমসা নদীতীরে মৈথুনরত দুটি ক্রৌঞ্চের একটিকে শরাহত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখলেন পরিভ্রমণরত বাল্মিকী। তিনি আরও দেখলেন, নিহত ক্রৌঞ্চের রক্তাক্ত দেহ ঘিরে ঘিরে তার সঙ্গী বিলাপ করছিল। সেই দৃশ্য দেখে সদ্য সঙ্গীহারা ক্রৌঞ্চের বেদনায় ব্যথিত হলেন বাল্মীকি। নিজের অজান্তেই তৎক্ষণাৎ দুটি বাক্য উচ্চারণ করলেন সংস্কৃত ভাষায়—‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/ যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।’ অর্থাৎ ‘হে নিষাদ, তুই চিরকাল প্রতিষ্ঠা লাভ করবি না, কারণ তুই কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে বধ করেছিস।’
উচ্চারণ মাত্রই বাল্মীকি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন—এই যে ক্রৌঞ্চের শোকে শোকার্ত হয়ে যা উচ্চারণ করলাম, ইহা কী? এরপর পরই দেখলেন—বাক্য দুটিতে সমাক্ষর আছে। পাঠে ছন্দস্পন্দও অনুভব করছেন। ক্রৌঞ্চবধের শোকে শোকার্ত হয়ে পঙ্ক্তি দুটি উচ্চারণ করলেন বলে তার নাম দিলেন, ‘শ্লোক’। কবিতার ইতিহাসে এই দুটি চরণ বা শ্লোককে মানবরচিত প্রথম কবিতা হিসেবে মান্য করা হয়ে থাকে। সেই দিক থেকে বলা হয়ে থাকে—বাল্মীকি ‘আদি কবি’ ও প্রথম লৌকিক ছন্দের স্রষ্টা।
বলাই বাহুল্য যে, প্রাচ্যের প্রথম সংস্কৃত ভাষার মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর রচয়িতা এই বাল্মিকী। তিনি সংস্কৃত ভাষায় অনুষ্টুপ ছন্দে রামের জীবনচরিত রচনা করেছিলেন এই রামায়ণে। তবে, বেদের মন্ত্র রচিত হয়েছে অক্ষরবৃত্তে। সংস্কৃতের মতো গণছন্দে নয়।ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বেদ যে সময়ে, যে ভাষায় রচিত হয়েছিল, পুরাকালে সেই ভাষার নাম ছিল বৈদিকভাষা। জনসাধারণের মুখের ভাষার কোনো নাম ছিল না। শুধু ‘ভাষা’ বলা হতো। এই মুখের ভাষাকে খানিক সংস্কার করে যে ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে বলা হতো সংস্কৃত ভাষা। আর এই সংস্কৃত ভাষায়-ই কাব্য জিজ্ঞাসার যাত্রা শুরু হয়েছিল বাল্মীকি পর্বের এই করুণ রসের প্রস্থান থেকেই। কাজেই প্রশ্ন ওঠে—কবিতা কী? কেন লোকে কবিতা লেখে কিংবা পড়ে?
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার আদি নিদর্শন খুঁজতে গেলে কবিতাই উঠে আসে সবার আগে। সব কালে সব দেশেই গদ্য এসেছে পদ্যের অনেক পরে। কবিতা আদি ও অকৃত্রিম বিশুদ্ধ শিল্প, সব শিল্প শাখার মাতা। তবে, কবিতার মতো শুদ্ধচারী শিল্পশাখার পাঠকপ্রিয়তা কিংবা বোদ্ধা পাঠক কোনোকালেই খুব বেশি ছিল না। সেই চর্যাপদের কাল থেকেই। তবু, যুগে যুগে কবিতা নিয়ে ভাবনা-রহস্যের অন্ত নেই। তার ভালোবাসারও শেষ নেই।
কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলছেন, ‘কবিতা হলো সবচেয়ে দার্শনিক রচনা। কবিতা হলো মানুষ ও প্রকৃতির বাক-প্রতিমা। মানুষের হৃদয়ের মতো কবিতা অমর।’ আর কোলরিজের মতে কবিতা হলো, best words in best order। যেখানে কল্পনাশক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রয়োজন। আর বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘কবিতা বোঝার বিষয় নয়, এটাকে অনুভব করতে হয়। কারণ কবি সম্ভবত বুঝে-সুঝে কবিতা লেখেন না, কেবল বিষয়কে সামনে রেখে তাকে অনুভব করেই কবিতার জন্ম হয়।’
সাহিত্য বিশ্লেষণে অন্তর্মুখী দার্শনিক প্লেটো কবিতার আত্মার দিকটায় আলো ফেলেছেন বেশি, অবলোকন করেছেন তার বিশেষত্ব। তিনি যে বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো মাইমেসিস-এর ধারণা।
সৈয়দ শামসুল হকের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। সর্বোত্তম ভাবের সঙ্গে সর্বোত্তম শব্দের সংযোগই পারে সর্বোত্তম কবিতা সৃষ্টি করতে।’ শেষোক্ত সংজ্ঞাটি অর্থবহ। এর গ্রহণযোগ্যতাও আছে। তবে, এ কথাও স্বীকার করতে হবে—কবিতার সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করে কবিতা বোঝা যায় না, কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে তার গভীরে যেতে হয়, যাকে বলে অতল অভিনিবেশ।
প্রাচীন পণ্ডিতদের সাহিত্য বিচারের ভেদবুদ্ধি এই ব্যাপারে আমাদের কিছু না কিছু সাহায্য করবে। অথবা প্রকৃত কবিতা বিচারের পথরেখা অনুসরণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে অলঙ্কার শাস্ত্রের বিভিন্ন মতবাদ। আমরা যেমন আমাদের মানবজন্মের পূর্বপুরুষদের অতীত অস্বীকার করতে পারি না, তাদের পরিচয় বহন করেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়, তেমনি কবিতার দীর্ঘ, সমৃদ্ধ ইতিহাসের সামান্য হলেও কবিকে জানতে হয়। কারণ, একটি বায়বীয় শিল্পের পেছনে একজন মানুষ তার সমগ্র আয়ু ঢেলে দেবে, কেন? আর, সেই দীর্ঘ কাব্যযাত্রা পথের শুরুতেই অধরা শিল্পের কূটাভাস কিছু জেনে নেবেন না—তা তো হয় না।
তবে, না জানলেও ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। কালোত্তীর্ণ কবিরা তাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূলে অবগাহন করেই নতুন পথ আবিষ্কারে প্রয়াসী ছিলেন। এ ক্ষেত্রে কাব্যের যাত্রাপথে যারা হাঁটতে চান দীর্ঘ দিবস ও রজনী, তাদের জন্য এ কথা বেদতুল্য। আর যারা স্বল্প সময়ের সৌখিন পৌরুষ, তাদের জন্য অন্ধ আবেগের উদগীরণ ছাড়া কোনো কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এটাও স্বীকার করা উচিত—প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মিলেই আমাদের সাহিত্য ভূমি তৈরি হয়েছে। সেসব বিষয়ে ব্যাপক আলোচনার অবকাশ নেই এখানে, সামান্যই উল্লেখ করবো। যাদের আরও গভীরে জানা প্রয়োজন, তারা বইয়ে পাবেন, গুগোল সার্চ করলেও অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।
আমি দীর্ঘদিন অধ্যাপনা-সূত্রে যা আয়ত্তে করার চেষ্টা করেছিলাম, সেই সামান্যটুকু নিয়ে সাহিত্যের আদিমতম শাখা কবিতার অসামান্য কিছু ইতিহাসে আলোকপাত করতে চাই। এক্ষেত্রে স্মৃতি মাঝেমধ্যে দিশেহারা করে তোলে। তবু মূলের প্রতি অনুগত থেকেই কাব্যবিশ্বাসের কথা আমার মতো করেই বলতে চাই। স্মৃতিশক্তি যাদের প্রখর, তারা আমৃত্যু মনে রাখতে পারেন। যেমন আমার মাকে দেখি। তাঁর নিজের বিয়ের সন-তারিখ, সন্তানের জন্মলগ্ন সব বলতে পারেন অনায়াসে এই ৮৫ বছর বয়সেও। আমি মায়ের মতো স্মৃতিধর নই, তবে স্থিতিশীল তো বটেই।
সে যাক, আসল কথায় আসি, স্মৃতি-বিস্মৃতির পর্দা সরিয়ে আমার এই সামান্য কথন। আপনাদের ভালো লাগলে বলা যথার্থ মনে হবে। আপনারা অনেকেই গ্রিক ধ্রুপদী সাহিত্যের দুই দিকপাল প্লেটো (৪২৭–৩৪৭) এবং তার শিষ্য অ্যারিস্টটল (৩৮৪—৩২২)-এর নামের সঙ্গে পরিচিত। দু’জনেই কাব্যজগতের দুই মহীরুহ। তাদের জন্ম-সময়কাল ভাবুন তো একবার? সেই কোনকালে শুরু হয়েছিল শিল্প-সাহিত্য নিয়ে মানুষের ভাবনা! সভ্যতা ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রখর জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে গ্রিস যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই তাদের আবির্ভাব, বিকাশ ও সাহিত্যে-সন্তরণ।
কাজেই, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুশীলনে সমৃদ্ধ দেশ গ্রিসের প্লেটোকে প্রথম সাহিত্যতাত্ত্বিক অভিধা দেওয়া যেতেই পারে। প্লেটো নিজেও কবিতা লিখতেন। তবে, তিনি সাহিত্য বিষয়ে একক কোনো আলোচনা করেননি। তার সাহিত্যচিন্তা বিভিন্ন গ্রন্থ যেমন—ইঅন (৩৮৭) রিপাবলিক (৩৮৭–৩৬০), লাইসিস (৩৮৭)-এ ছড়িয়ে আছে।
সাহিত্য বিশ্লেষণে অন্তর্মুখী দার্শনিক প্লেটো কবিতার আত্মার দিকটায় আলো ফেলেছেন বেশি, অবলোকন করেছেন তার বিশেষত্ব। তিনি যে বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো মাইমেসিস-এর ধারণা। মাইমেসিস শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ইমিটেশান। বাংলায় অনুকরণ বা অনুকরণবাদ। এটি তার শিল্পসৃষ্টির দার্শনিক ব্যাখ্যাও বটে। প্লেটোর মতে, সাহিত্যিকেরা যা সৃষ্টি করেন, তা মূলত অনুকরণ। অনুকরণ কখনো সত্য হয় না, অনুকৃত বিষয়গুলো ‘দৃশ্যমায়া’। তাই তিনি সাহিত্য সৃষ্টিকে সমর্থনযোগ্য মনে করেননি। আর এ কথা বলতেও ছাড়েননি—কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে বসে তার শিল্প সৃষ্টি করতে সমর্থ হন।
অ্যারিসিটটল ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই অবরোধ ভেঙে দিয়েছেন। ফলে অ্যারিস্টটলের হাতে সাহিত্য পেয়েছে নতুন মাত্রা।
এক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা হলো—মূল ক্রিয়েটর হলেন গড বা সৃষ্টিকর্তা, যিনি এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন, প্রাণী ও বৃক্ষরাজির শোভায়। সেই বৃক্ষের কাঠ চেরাই করে একজন ছুতোর মিস্ত্রী বা কার্পেনটার টেবিল চেয়ার, খাট-পালঙ্ক তৈরি করেছেন, সেই সব আসবাব থেকে লব্ধ ধারণা নিয়ে শিল্পী তার ছবি আঁকেন। কাজেই তার অবস্থান এমন:
১. ক্রিয়েটর—সৃষ্টিকর্তা
২. কার্পেন্টার—সুতোর মিস্ত্রী
৩. ইমেটেটর—শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক
এভাবে শিল্পীকে তিনি বস্তুর অনুকারক আখ্যা দিয়েছেন। এমনকি তার বিখ্যাত ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আইডিয়াল স্টেটের যে রূপরেখা দিয়েছেন, সেখানে কবিদের আপ্যায়নের কথা বলা আছে। কিন্তু নগর রাষ্ট্রে কবিকে বাস করার অনুমতি দেননি।
তবে, শেষমেশ এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন—কবিরা যখন কারও স্তুতি করে, তাদের মতো প্রশংসা অন্য কেউ করতে পারে না। অন্যদিকে কবিদের কবিতা পাঠে তরুণ ও যুব সমাজের নৈতিক চরিত্রের স্খলন ও পতন অসম্ভাবী ভেবে তিনি কবিদের তার আদর্শ রাষ্ট্রে বসবাসের অনুপযোগী মনে করেছেন।
প্লেটোর শিষ্য বহির্মুখী অ্যারিস্টটল গুরুর অনুকরণবাদ মেনে নিলেও অবলোকন করেছেন কবির সৃষ্টিকে। অনুকরণ সম্পর্কে বলেছেন, ‘অনুকরণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, সহজাত প্রবণতা। তাই অনুকরণের বিষয় সত্য হোক, মিথ্যে হোক, মানুষ অনুকরণ করবেই। মানুষ নিজে অনুকরণ করতে ভালোবাসে এবং অন্যের অনুকরণ দেখে আনন্দ পায়।’ অ্যারিস্টটলই প্রথম বলেছেন, মানুষের ভেতরে ছন্দস্পন্দন ও সুরসঙ্গতি আছে। তা কাব্যের অন্যতম উপাদান। এই উপাদান আছে বলে মানুষ কাব্যপাঠে এত আগ্রহী। প্লেটো নির্বিশেষ সব সাহিত্যিক রূপকে যেমন নীতিবিরোধী আখ্যা দিয়েছেন, অ্যারিস্টটল তা করেননি। তবে, কেবল কমেডিকে নিচু মানের নীতিবিরোধী সাহিত্যিক রূপ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আর ট্র্যাজেডিকে উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। ট্র্যাজেডির নায়ক কতটা মহান ও ধীরোদাত্ত হবেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘কাব্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে।
ট্র্যাজেডির নায়কের পতন দেখে আমাদের চোখে জল এলেও মনে কেন অপূর্ব আনন্দের সঞ্চার হয়, এর ব্যাখ্যায় অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষের আছে দ্বৈত সত্তা। একটি সত্তা যে কারণে দুঃখ পায়, সে কারণেই অন্য সত্তা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। এজন্য ট্র্যাজিক কাহিনির নাটক বা মুভি দেখে চোখে জল এলেও মন ভরে ওঠে অপূর্ব আনন্দে। যাকে বলি চিত্তের ক্যাথারসিজম। এ জন্য লোকে পয়সা খরচ করে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ট্র্যাজেডি বা দুঃখের কাহিনি দেখে কাঁদে। কিন্তু মনের মধ্যে অপূর্ব এক আনন্দের ঝলক নিয়ে ঘরে ফেরে। নিজের অজান্তেই বলে, বাহ্ বহুদিন পরে চমৎকার একটি ছবি দেখলাম।
আর Percy Bysshe Shelley মতো করেই মনের অজান্তে বলে ওঠে, ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.’
এ কথা তো আমরা মনের গভীরেই অনুভব করি যে, সব মধুর সংগীত সবচেয়ে গভীরতম বেদনার কথাই বলে। এ জন্য রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যবিশ্লেষণে একটু অন্যভাবে বলেছেন, বাস্তবের মায়ের কান্নায় বিরক্তবোধ করলেও সাহিত্যে মায়ের কান্না শুনতে আমরা ভালোইবাসি।
সাহিত্যের আলোচনা প্রথম শুরু করেন প্লেটো বটে, কিন্তু সাহিত্যের জন্যে তা ছিল মূলত অবরোধ-প্রধান। এর প্রধান কারণ হিসেবে জানা যায়, প্লেটো তৎকালীন গ্রিসের প্রশাসন, প্রশাসক ও ভাববাদী দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে। অন্যদিকে অ্যারিসিটটল ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই অবরোধ ভেঙে দিয়েছেন। ফলে অ্যারিস্টটলের হাতে সাহিত্য পেয়েছে নতুন মাত্রা। এজন্যে কবির কাছে তার সাহিত্যতত্ত্বের প্রয়োজন কখনো ফুরোবে না।
চলবে…