প্রগতিতে স্থায়ী কোনো শেষ কথা নেই, প্রতিক্রিয়াতেও নয়। এককালে যা কিছু পরম প্রগতিশীল বলে গৃহীত হয়, কালের প্রবাহে তা-ই আবার চরম প্রতিক্রিয়াশীল বলে বর্জিতও হয়ে থাকে। আবার এর বিপরীত অবস্থাও ঘটে। অর্থাৎ বিশেষ কোনো কাল বা সমাজে বিশেষ কোনো আবেগ, অনুভূতি ও বিশ্বাস যা প্রগতিবিরোধী বলে চিহ্নিত হয়, তা-ই আবার অন্য কোনো কাল বা সমাজে কিংবা একই সময়ে অন্য সমাজে হয়ে উঠতে পারে প্রগতিশীল এবং তা হয়েও থাকে। একারণেই প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার স্থায়ী কোনো শাশ্বত সংজ্ঞা নেই। তবে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, সময়ের প্রয়োজনে যা কিছু অগ্রসরমান এবং যেসব আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনা মানুষকে উন্নততর জীবন ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করে তাকেই আমরা প্রগতিশীল বলে আখ্যায়িত করতে পারি। আর যা কিছু সময়ের দাবি মেটাতে পারে না এবং যে সব আবেগ, অনুভূতি ও বিশ্বাস সৃজনশীলতাবিরোধী যা পশ্চাদপদ মানসিকতার পরিচায়ক তা-ই প্রতিক্রিয়াশীল। এককথায় বলা যায়, প্রগতিশীলতা হচ্ছে চেতনার বিবর্তন বা বিকাশ, আর প্রতিক্রিয়াশীলতা হলে চেতনাহীনতা বা পশ্চাদপদ মানসিকতার অন্ধ অনুকরণ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
সাহিত্য সম্পর্কে অসংখ্য সংজ্ঞা ও মতবাদ প্রচলিত আছে। আবার মতবিরোধও রয়েছে। বিভিন্ন পণ্ডিত ও মনীষী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। প্রচলিত সংজ্ঞা ও মতবাদের বিরোধিতা করে নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকটা মেনে নিয়েই আজকের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, সমাজ বাস্তবতার শিল্পসম্মত, ভাষায়িত রূপই সাহিত্য। সাহিত্য সমাজের প্রতিচ্ছবি। সমাজ পরিবর্তণশীল। সাহিত্যও তাই পরিবর্তনশীল সমাজেরই চিত্রায়িত রূপ। তবে স্থিরচিত্র অবশ্যই নয়, গতিশীল সমাজের সাহিত্যও সমান গতিশীল। সাহিত্য যেখানে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুতে পারে না সেখানেই তার করুণ পরিণতি—নিদারুণ মৃত্যু। সাহিত্য সেখানেই হয়ে যায় ইতিহাস বা ঐতিহ্য। তখনই দেখা দেয় গ্রহণ-বর্জনের প্রশ্ন।
সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হলে অতি স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোও পরিবর্তন হয়। সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয় রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ যাবতীয় শাসন-শোষণ, সমস্ত কিছুই। সাহিত্য তখনি হয়ে ওঠে সৃজনশীল। কিন্তু বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় যারা কর্তৃত্ব করে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাদের অধিকারে থাকে তারা চায় না যে, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হোক। চায় না কেবল ক্ষমতার ভিত ধসে যাবে বলেই। পুরাতনকে আঁকড়ে ধরেই তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায়। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে, যুগ-যন্ত্রণার তাগিদে সমাজের সৃজনশীল মানুষ এই পুরাতন জীবন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারে না। পারে না বলেই বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। এই প্রতিবাদ আজকের নয়, মানব সভ্যতার গোড়াতেই এর জন্ম। আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই তা হয়ে ওঠে অত্যাবশ্যকীয়।
আদিম গুহাবাসী মানুষ যখন দেখলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া দরকার তখন থেকেই প্রতিবাদের যাত্রারম্ভ। প্রথমে তারা শরীরের শক্তি দিয়ে পশুশক্তির মোকাবিলা করতো। কিন্তু গায়ের জোরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অনেক সময় তাকে হারতে হয়েছে। তাই অনিবার্থ কারণেই নিয়োগ করতে হলো উন্নতর প্রতিরোধ ব্যবস্থা—বুদ্ধিও কৌশল। মানুষ তার চেষ্টা, যত্ন, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি নিয়োগ করলো সেদিকে। তৈরি হলো অস্ত্র। প্রথমে এবড়ো-খেবড়ো চোখা পাথরের ফলা, তারপর ক্রমান্বয়ে বর্শা, ত্রিশূল, খড়গ ও আজকের অবস্থা। বর্তামানে অনেক কিছুকেই মানুষ নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। নির্ভরশীলতায় স্থান দখল করেছে সৃজনশীলতা, অন্ধ বিশ্বাস বা অনুকরণের পরিবর্তে এসেছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি। এখানেও মানুষ থেমে নেই, গতিশীল থাকছে সময়ের প্রয়োজনেই। নতুন কিছু আবিষ্কারের পরপরই তা আর নতুন থাকছে না—পুরাতন হয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীল মানুষ আবারও নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ থাকবে, যে পর্যন্ত না মানুষের অস্তিত্ব চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে সে পর্যন্ত এ গতির শেষ নেই। এই চিন্তা প্রথম যারা করেছেন তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তার ওপর ভিত্তি করেই আজকের এই অগ্রগতি। প্রাকৃতিক বৈরিতা এবং মানুষী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের এই যে সংঘবদ্ধ সচেতন প্রয়াস, একেই আমরা প্রগতি বলি।
কিন্তু সমস্যার এখানেই শেষ নয়, নিত্য নতুন নতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে। বন-জঙ্গল আর গুহা থেকে মানুষ যখন বেরিয়ে এলো, লোকালয়ে বাঁধলো ঘর, তখন থেকেই শুরু হলো আসল সমস্যা ও আসল লড়াই। সে-লড়াই মরা-বাঁচার লড়াই, সে-লড়াই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই মানবিক মূল্যবোধ অর্জনের লড়াই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জাগতিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই মানুষ পেরিয়ে এসেছে সভ্যতার ধাপের পর ধাপ। বাড়ছে মানুষের সংখ্যা দেখা দিয়েছে খাবারের অভাব। প্রয়োজন হলো উৎপাদনমূলক শ্রমশক্তির। সৃষ্টি হলো উৎপাদন ক্ষেত্র। শুরু হলো শ্রমশক্তি নিয়োগ। জন্ম নিলো উৎপাদন সম্পৃক্ত শ্রমিক শ্রেণী। উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত এই শ্রমিক শ্রেণিকে নিজেদের করায়ত্ব বা অধীনে রাখার জন্য শাসক গোষ্ঠী প্রথম থেকেই তৎপর। এই তৎপরতার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ এসেছে এ থেকেই জন্ম নিয়েছে শাসক-শোষিতের দ্বন্দ্ব। সৃষ্টি হলো বিভিন্ন গোষ্ঠী ও মতবাদ। ছিল এক জাতি, হলো বহুধা বিভক্ত। জাতিতে জাতিতে বাধলো লড়াই, গোত্রে গোত্রে সংঘাত। এর মোকাবেলা করার প্রয়োজনেই দরকার হলো যুদ্ধ নিপুণ একটা দলের। সৃষ্টি হলো আলাদা আলাদা দল, জন্ম নিল দলপতি। দলপতি কৌশলে উৎপাদন পদ্ধতিকে করে নিলো নিজের অধীন। পক্ষান্তরে উৎপাদন সম্পৃক্ত শ্রমিক শ্রেণী রয়ে গেলো পরাধীন। আর উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্ত অংশ আত্মসাৎ করে অন্য একটি দল শুরু করলো ব্যবসা-বাণিজ্য। কালক্রমে এরাই হলো শ্রম-বিছিন্ন পুঁজিবাদী শ্রেণী।
অন্যদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে সমাজে জন্ম নিলো আরও একটি দল। তারা বুদ্ধিজীবী। তাদের সম্বল বুদ্ধির কসরত। আর ওখান থেকেই জন্ম নিলো মেহনত শূন্য পুঁজি। যত গোলমালের সৃষ্টি ওখান থেকেই। ধন ও জন দুই-ই চলে গেলো ওদের দখলে। বুদ্ধির বলেই ওরা মন দিলো অন্যের ধনে দাঁত বসাতে। পরিণামে সমাজের এক বিরাট অংশই মেহনতের অধীন হলো। কিন্তু তার ভোগ-দখল, পরিচালন ও লাভের অংশ সব গেলো শাসক-শোষক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ক্ষুদ্র কিছু মাথাওয়ালা দলের হাতে। প্রতি দেশেই। বাঁচার সমস্যা ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকলো সমাজের বিকাশ যতটা হওয়া উচিত ছিল, ততটা হতে পারলো না। পারলো না এই কারণে যে, বুদ্ধিজীবীরা তাদের মানবিক দায়িত্ব সুচারুরূপে পর্যবেক্ষণ ও পরিচালন করতে অবহেলা করেছেন, কিংবা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। প্রকারান্তরে তারা শাসক-শোষক ও পুঁজিবাদী শ্রেণীরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। কারণ তারাও এসেছেন ওই শ্রেণী থেকে। এটা তাদের শ্রেণীগত অবস্থানেরই ফল। কিন্তু তাদেরই মধ্যে যারা সমাজসচেতন, সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের প্রতি যারা আস্থাশীল, যারা ওই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বা এর বাইরে যাদের অবস্থান তারাই কথা বলছেন শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে, প্রতিবাদ করছেন বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে।
শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, অন্যায়-অনিয়ম, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ শিল্প-সাহিত্যেও সমাদৃত হলো। পুরোনো ভুয়া নৈতিকতা আর ভিত্তিহীন অবাস্তব ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সৃজনশীল বাস্তবতার প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ যেদিন থেকে সাহিত্যের আসন দখল করলো, সেদিন থেকেই সৃষ্টি হলো প্রতিবাদী সাহিত্য। সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারাটিও সেখানেই নিহিত।
একটা কথা এখানে মনে রাখতে হবে যে, উৎপাদনক্ষেত্র বা সব সম্পদের মালিক হলো রাষ্ট্র। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ঈশ্বর। তার ওপর রয়েছে জনগণের সমান অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করে সম্পদের সমবণ্টন করতে হবে। তা করতে পারলেই দেশ ও জাতি সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হবে। সাহিত্য-সংস্কৃতিও উন্নত হবে।