শিশুর বেড়ে ওঠার সেই দুরন্ত সময়টায় একদিকে হাওয়াই মিঠাই আর আইসক্রিমের দুর্নিবার আকর্ষণ, অন্যদিকে পুতুল, কানামাছি, ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট খেলার এক মোহ-মত্ততা থাকে। যেটা তার ইশকুল-বয়েস। যেখানে মন পড়ে থাকে সারাক্ষণ খেলাধুলোয়, সেখানে পাঠ্যপুস্তকের নিরস পাতায় চোখ আটকে থাকবে কেন? এখন যে রকম জ্ঞানের চেয়ে ঢংটাই বেশি চোখে লাগে! ক্ষুদে-কোমল-শিশুবীজতলায় লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে সরাসরি বটবৃক্ষের চারা! কোচিং, ভর্তিযুদ্ধ—সবকিছু মিলিয়ে শিশুর মানস-কাঠামোয় একটা জগদ্দল পাথরের মতো ভারী চাপ! কিন্তু শিশুর ‘পড়ায় আমার মন বসে না কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে’ সময়টাই ফুল, লতাপাতা, ভ্রমর, পাখি, ফড়িঙ—সব তার আপনজন!
আর শিশু-সাহিত্যের ঝুলি শিশু মনস্তত্বেরই এক অপরূপ জগৎ। পাঠ্যপুস্তকের ছড়াতেও যেন শিশু খুঁজে পায় নিজেকে। তার আপন জগতের কথাই ছড়ার আদলে যদি কেউ শোনাতে আসেন, তাহলে সে কেন শুনবে না? গল্পের প্রতি আকর্ষণটাও এই বয়সেই বেশি! ছড়া তখন নিটোল একটা মজার খেলার নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), সুফিয়া কামাল, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর শ্রুতিমাধুর্যময় ছড়া কয়েকটি প্রজন্ম এরমধ্যে পড়ে এসেছে। ‘কাজলা দিদি’ বা ‘ভোর হলো দোর খোলো’ বা ‘বাক বাকুম পায়রা, মাথায় দিয়ে টায়রা’র মতো অমূল্য রত্নরাজি কে ভুলবে? কোনো-কোনোটির হয়তো ওই রকম অর্থও নেই কিন্তু নির্মল আনন্দে বাদ সাধে না একটুও! হাজার হাজার স্মৃতির মাঝেও এই ছড়াগুলোর আসন অন্য জায়গায়।
শৈশবের সঙ্গেই এসবের সাঁকোবন্ধ। শৈশবের কথা মনে হলেই এই ছড়াগুলোর কথাও মনে পড়ে! এই ছড়াগুলো লিখেছেন সেই সময়ের আলোচিত ও খ্যাতনামা কবিরাই। পরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শিশুদের শিক্ষার পুষ্টি যোগাতে এগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সুনির্বাচিত বলে এগুলোর আবেদন সর্বকালীন।
বয়সানুসারে সাহিত্যেরও বিভাজন রয়েছে। খাদ্যের মতোই অনেকটা; যার যত ক্যালরি প্রয়োজন, সে অনুযায়ী ক্যালরি তাকে সরবরাহ করা! কৈশোরিক অবস্থায়; সাহিত্য ছড়ার গন্ধ নিয়েই মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের কাছে আসে অর্থাৎ হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তখন এই বয়স থেকে কেউ-কেউ কবিতাও লিখতে শুরু করে! (ষষ্ঠ থেকে দশম) পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তখন তার জীবন-ভাবনা এবং বয়ঃসন্ধির এই সময়টাতে এমন সাহিত্যই নির্বাচিত করে, যেগুলো তার মনস্তত্বের স্ল্যাইড! সুকান্তের কবিতার কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘আঠারো বছর বয়সে’ কবিতায় কৈশোর-উত্তীর্ণ হচ্ছে, সঙ্গে চেতনার বিকাশও ঘটছে; এ রকম একটি চেহারাই কি ভেসে ওঠে না এই লেখায়? তারপর অন্যত্র কবি-উক্তি, আঠারো বছর বয়স স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি! এটা ওই বয়সের যেকোনো কিশোরের কথা!
‘কোটা’ পূরণের সাহিত্য-রাজনীতি তো আছেই। দুই বছর কি পাঁচ বছর পর-পর আগের লেখা সরিয়ে নতুন লেখার অনুপ্রবেশ। এতে করে কি শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে? লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন শিক্ষার্থীর নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো—যাঁর লেখা পাঠ্যভুক্ত হচ্ছে, তিনি নাকি তার কিছুই জানেন না! পাঠ্যভুক্ত হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন! এমনকি লেখকদক্ষিণাও দুর্ভাগা লেখক বা কবির কপালে জোটে না! এই নীতিমালা কিসের মানদণ্ডের ওপর?
পাঠ্যপুস্তকের যেসব কবিতা বা সাহিত্য শিক্ষার্থীরা পড়ে ও লিখে পরীক্ষায় পাস করে, সেগুলোই কি ওই সাহিত্যিকের শ্রেষ্ঠ রচনা? এ রকম একটি প্রশ্নের অবতারণা হতেই পারে। না; তা নয়। খুঁজলে ওই সাহিত্যিকের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখারও হদিস মিলবে। মেধার আইকিউ অনুযায়ী অবশ্য সাহিত্যও স্থান পায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকতর পরিণত লেখাটাই অন্তর্ভুক্ত হয়। কোলরিজের ‘রিডিং ফর প্লেজার’ যে কত সুন্দর একটি লেখা—সুন্দর ও গঠনমূলক রচনায় তার পক্ষপাত থাকলেও উনিও যে একটা বয়সে গ্রোগ্রাসে সবধরনের রচনাই গিলেছেন, এই সরল স্বীকারোক্তি আছে লেখাটাতে। আমাদের সবার জন্যই তা কম-বেশি সত্য। পাঠক কি আর সবসময় সিরিয়াস বই পড়েন? তারপর যখন তার চৈতন্যোদয় হয়, তখন তিনি নিজেই আবার সলিড পুষ্টির রচনা নিয়েই মেতে ওঠেন! তখন তিনি বুঝে যান, আগে যা পড়েছেন, তা-ই তাকে পাঠ্যাভিমানী করেনি বরং পাঠানুরক্ত করেছে!
পাঠ্যাভ্যাস গড়ে ওঠাটাই বড় কথা। তারপর তিনি বর্জন করবেন না গ্রহণ করবেন—সেটা একান্তই তার ব্যাপার। বনফুলের ‘পাঠকের মৃত্যু’ আরেকটি উৎকৃষ্ট রচনা। এটা যেন এসটি কোলরিজেরই লেখার শেষ গলির ধ্বনি! বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে পাঠকের রুচি ও চিন্তার বদল হয়। দশ বছর আগের পড়ার সাথে দশ বছর পরের পড়ার সঙ্গে দশকীয় ব্যবধানের চেয়ে বড় ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায় বয়স! রচনাটি যদি অপরিণত হয়, তাহলে তা তাকে আনন্দ দিতে অপারগ। এখন পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কাদের লেখা পাঠ্যভুক্ত করে? অক্ষরেখার মতো একটি রাজনৈতিক রেখাও আছে এই লেখা নির্বাচনে! জসীমউদ্দীন যখন একাদশ শ্রেণীর ছাত্র, তখন তাঁর ‘কবর’ কবিতাটি ওই একাদশ শ্রেণীরই বাংলা বইয়ের পাঠ্য হয়! আজকাল এ রকম উদাহরণ বিরল। বরং প্রভূত্বময়তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শে লেখা বাছাই করা হয় বা লেখার চেয়ে লেখক বা কবির রাজনৈতিক মতাদর্শকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়।
নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’—একটি রাজনৈতিক-ইতিহাসভিত্তিক কবিতা। এটি একটি বিশেষ সময়ে পাঠ্যভুক্তও হলো। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কতৃপক্ষের সার্জারিতে ওই কবিতা থেকে ‘বেশ্যা’ শব্দটি সুকৌশলে ফেলে দেওয়া হয়েছে! ফলে কবিতাটি পড়তে গিয়ে একটু হোঁচট খেতে হয়। ছন্দে গিয়ে ধাক্কা লাগে! এই কবিতায় ওই ‘বেশ্যা’ শব্দটি যদি কিশোর মনস্তত্বের সঙ্গে না গিয়ে থাকে কিংবা কর্তৃপক্ষের রুচিতে বাধে, তাহলে এই কবিতাটিই পাঠ্যভুক্ত করে কবিতার অঙ্গহানি করার প্রয়োজন ছিলো কি?
‘কোটা’ পূরণের সাহিত্য-রাজনীতি তো আছেই। দুই বছর কি পাঁচ বছর পর-পর আগের লেখা সরিয়ে নতুন লেখার অনুপ্রবেশ। এতে করে কি শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে? লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন শিক্ষার্থীর নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো—যাঁর লেখা পাঠ্যভুক্ত হচ্ছে, তিনি নাকি তার কিছুই জানেন না! পাঠ্যভুক্ত হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন! এমনকি লেখকদক্ষিণাও দুর্ভাগা লেখক বা কবির কপালে জোটে না! এই নীতিমালা কিসের মানদণ্ডের ওপর?
একটি বই বেরুলে একজন লেখক তা থেকে রয়্যালিটি পান আর পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পাওয়া লেখার জন্য তাঁর সামান্য দক্ষিণাও জুটবে না! এককালীন একটা অর্থের যোগান হলেও তো লেখকের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়। ‘কোটাভিত্তিক’ লেখকদের অংশগ্রহণের কথা আলাদা। ভবিষ্যৎ সুলেখকদের পাঠ্যভুক্ত করবে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে। তখন শিশু-কিশোর মনস্তত্বের পক্ষে থাকবে—এই স্বপ্নে বিভোর হওয়া ছাড়া আর কী উপায় আছে?