বাংলাদেশের ষাটের দ্বিতীয়-বলয়ের কবি নির্মলেন্দু গুণ। সে কারণে অনেকাংশেই তিনি দীপ্র আলোর মুখচ্ছবি নিয়ে জন্মেছেন। জন্মান্ধ-আবহ তাঁর পশ্চাতে। মননে তাঁর প্রথম-বলয়ের ছায়াপাত ঘটেছে বলেই ষাটের দ্বিতীয়-বলয়ের উন্মূল-উন্মুখর আলোর রোদে দাঁড়িয়েও তিনি কিছুটা দ্বিধান্বিত, প্রপন্ন ছিলেন এবং চেতনতর সত্তার রেসের ঘোড়ায় চেপে তিনি দ্বিধা, মোহ অতিক্রম করে ক্রমশ বিপ্লবীচেতনায় প্রত্যার্বতন করেছেন। একথা অস্বীকারের যো নেই যে, নির্মলেন্দু গুণের মধ্যেও ষাটের দ্বিধাগ্রস্ত বা স্ববিরোধী সত্তা কাজ করছে। প্রথম জীবনের তাঁর এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বিন্যস্ত আছে তাঁর ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ গ্রন্থের ‘হুলিয়া’তে। ‘হুলিয়া’র বহিরাঙ্গিকে রাজনীতির পোশাক থাকলেও বিন্যাসে, বক্তব্যে স্ববিরোধিতা আছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রাসঙ্গিক বলেছেন, ‘‘তাঁর এই পর্বের নায়ক ‘হুলিয়া’ প্রোজ্জ্বল রাজনৈতিক তৎপরতা ও ব্যক্তিগত মানসিকতা নিষ্ক্রিয়তার মাঝখানে দেলায়িত ও অন্তর্বিভক্ত।’’১
ষাটের রাজনীতি যেমন দ্বিধাবিভক্ত, অন্তত গতিবেগের দিক থেকে, তেমনি কবি-স্বধর্ম ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেশও। প্রথম-পর্বের প্রতিভূ যদি হন রফিক আজাদ, তবে নির্মলেন্দু গুণ আলোর পাখি দ্বিতীয়-বলয়ের প্রদীপ্ত সময়ের। কিন্তু তবু সেই আলোতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছ, তাঁর কোনো সচেষ্ট দর্শন ছিল না বলেই তিনি লক্ষ্যাভিসারী ছিলেন না। অবশ্য চক্রমণশীলতার মধ্য দিয়ে পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে তিনি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। কবিতাকে তিনি তাই লড়াইয়ের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, তাঁর এই আলোয় ফেরা, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ এবং সংগ্রামীচেতনা, স্বদেশনুভূমি মায়ায় জড়ানো। অনেকটা মোমের আলোর মতো সিন্ধ, দীপ্র, কিন্তু নজরুল ইসলামের মতো অভিঘাতে দীপ্ত নয়। ষাটের ক্রান্তিকালে, সংগ্রামী দিনগুলোতে নির্মলেন্দু গুণ একদিকে ব্যক্তিজীবনে রাজপথে নেমেছেন, অন্যদিকে ক্লেদাক্ত যৌনাচরে বিনতি মেনেছেন। রফিক ছিলেন স্তব্ধ মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়ে, নির্মলেন্দু মহাসমুদ্রের কল্লোলে। প্রথম-পর্ব ঘুমতাড়িত সময়ের, দ্বিতীয়-বলয় জাগরণের। নির্মলেন্দু তাই জনপ্রিয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। সময় তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর স্বভাব ও কবিকর্মের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করে দিয়েছিল। এই জনপ্রিয়তার জন্য নির্মলেন্দু গুণের চারটি অস্ত্র ছিল হাতে।
ক. প্রত্যক্ষ রাজনীতিসম্পৃক্ততা
খ. বলার ভঙ্গিতে অভিনব নাটকীয়তা বা টুইস্ট করার চমক
গ. উদ্বাস্তু-উন্মুল জীবনের সুস্থ অভিজ্ঞান
ঘ. নারী ও প্রেমকে শরীররূপে উপস্থাপনা
আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর সহজ-সরল কাব্যরীতি। তাঁর কাব্য-উপাদানে সমকালীনতা থাকে বলেই তা পাঠক-হৃদয়ে Communicating হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কবিতায় গল্পের মেজাজ দিয়ে তিনি পাঠকের মন ও মেধাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেন। কিন্তু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সরল রেখার এই ফ্রেমটাকে তিনি জনগণের কাছে ম্যাজিকের মতো নিয়ে যান। ফলে স্বদেশপ্রেম, বিক্ষোভ ও রাজনীতিই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার কেন্দ্রবিন্দু, যার লক্ষ্যবস্তু গণমানবের মুক্তির দুরায়তনিক স্বল্পময় আকাঙ্ক্ষা। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, নির্মলেন্দু গুণের মানসযাত্রা সমুদ্রগামী:
শেখ মুজিবুরহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রাক-পর্ব পর্যাপ্ত দেশের আশাহত পরিস্থিতিতে তিনিও অপরাপর কবিতার কৃষকদের মতো ত্রস্ত, হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু দায়বদ্ধ, সেকারণে সেই দায়বদ্ধতা পালনে তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর সংগ্রামের অস্ত্র। ‘নির্বাচিতা’র প্রথম সংস্কারণের ভূমিকায় তিনি তাঁর কবিসত্তার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি তাঁর সংগ্রামী হওয়ার পশ্চাৎপট, ইতিবৃত্ত নির্মাণ করেছেন এইভাবে :
‘আমাদের আপাত নির্দোষ সমাজ- ব্যবস্থার গভীরে একটা বড়- রকমের ব্যাধি আছে লুকানো। আমি আহত হয়েছি এই সমাজের দিকে তাকিয়ে। তারপর, সে সময়টাতে কবি হওয়ার উদ্দেশে ময়মনসিংহ ছেড়ে আমি ঢাকায় যাই, সেই সময়টা উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো এমনই মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল যে, ঐ সময়ের ঢেউ যাঁর রক্তে লেগেছে তার পক্ষে নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে আমাকে কলম ধরতে হয়েছে। এভাবেই আমার কবিতার সংগ্রাম রূপান্তরিত হয়েছে সংগ্রামের কবিতায়।’২
নির্মলেন্দু গুণের উত্থান, বরং বলা ভালো আত্মপ্রকাশ উত্তণসত্তরের গণআন্দোলনের সময়ে। আইউব খানের সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর সরানোর সেই দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কবির জয়যাত্রার সূচনা। এই সূচনাই শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে তাঁকে কলম ধরিয়েছে। ফলে তাঁর কবিতা সংগ্রামী কবিতায় রূপান্তরিত হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ইতিবাচক এবং তাই তাতে আশাবাদ বিম্বিত। তিনি সময়কে বাজি ধরে এগোন। তাঁর ভাষায় : ‘পরিপার্শ্ব যত বৈরীই হোক না কেন, আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি সংগ্রামই সত্য, সত্যই সুন্দর। প্রেম সেও এক সংগ্রাম।’
কবি সংগ্রাম এবং ভালোবাসাকে অভিন্ন মনে করেন। বুর্জোয়ারা প্রেমকে ‘দুর্বলতা’ বলে জহির করেছেন। কিন্তু দায়বদ্ধ কবি প্রেমকে মনে করেন সরলতা, শক্তিময় চেতনার দ্যুতি।
প্রেমের ক্ষেত্রে যে নমনীয় হৃদয়স্পর্শী মাধুর্য, তা জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ই পাওনা সম্ভব। এ কারণেই নির্মলেন্দু গুণ প্রেমের প্রতিচ্ছবি আঁকতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের কাছে বাকভঙ্গির পাঠ নিয়েছেন।
একজন সংগ্রামী ও বিপ্লবী কবির পক্ষেই এই উপলব্ধিতে পৌঁছানো সম্ভব। তাঁর চেতনতর সত্তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বোধ ও বোধি গ্রথিত। তিনি বিপ্লবী মধ্যবিত্ত বলে কিছু কিছু স্ববিরোধী চেতনায় মাঝেমধ্যে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মধ্যবিত্তসুলভ বিশ্বাস তাঁকে আবর্তন করেছে। বিশেষত ষাটের শেষপদে অর্থাৎ উত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে তাঁর রচিত ‘হুলিয়া’ কবিতার কথা উল্লেখ করা যায়। এই কবিতায় একজন মানুষের বিপ্লবী রূপান্তরের ইতিবৃত্ত ধরা আছে। কবিতাটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, স্বদেশচেতনা, ঐতিহ্য, পুরাণাশ্রিত শাস্ত্র এবং আন্তর্জাতিকতা, মার্কসবাদ একাকার হয়ে গেছে। ‘জনাকীর্ণ মাঠে জিন্দাবাদ’ কবিতায় বিম্বিত হয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতাবাদ, সংগ্রামী দ্বৈরথ। বাংলার দুঃশাসনপীড়িত ক্রান্তিলগ্নে কবি একাত্মতা অনুভব করেন ‘শ্বেতাঙ্গদের শরে বিশ্ব’ মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে। তাই তাঁর হত্যায় কবি সোচ্চার হন। এবং এই আন্তর্জাতিকতাবোধ থেকেই কবি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন রণতরীর উপস্থিতর অর্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন। ‘নিকসনের জাহাজ’ কবিতায় তিনি মার্কিন রণতরীর উপস্থিতির পেছনে জল্লাদের ছায়া লক্ষ করেন। তিনি স্বাধীনতার গভীর-অর্থদ্যোতনায় পীড়িত হন।
নির্মলেন্দু গুণের কবিতাকে চেতনাগত দিক থেকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা সম্ভব:
ক. প্রাক-পঁচাত্তর পর্ব : রাজনৈতিক সচেতনতাপ্রকীর্ণ। তরুলতা, অস্থিরতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা।
খ. পঁচাত্তর-উত্তর পর্ব : শ্রেণিগত মধ্যবিত্তের ভাবনা ও বোধ, পঁচাত্তর-পরবর্তী সমাজিক অস্থিরতা, আশাহত বেদনা বিম্বিত।
এই দুই বিপরীতার্থক ভাবনা ও চেতনা ধারণ করে আছে ‘কবিতা, অমীমাংসিত রমণী’ কাব্যের ‘নৈশ প্রকৃতি’ এবং ‘দুই চোখে জাগো’ শীর্ষক কবিতাদ্বয়। কবির এই পর্বের কবিতায় আশা, হতাশা, আশাভঙ্গের গান ছাড়াও ব্যর্থপ্রেম, হাহাকার ও যৌনতা ছড়িয়ে আছে। ষাটের প্রথম অধ্যায়ের গরল, সত্তরের যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সময়কালের হতাশাজনিত আবেগ, অবক্ষয়, সামাজিক নষ্টামী অনিবার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে পঁচাত্তরের পরবর্তী পর্বে কবিতায় চেতনায় লুপ্ত অর্গল ভেঙে জাগরণের পালা শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড তাঁর চেতনার শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে। তিনি তাই আত্মপ্রত্যয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন ঝড়ের পাখিটা কুলায় ফেরার মতো, কিংবা দিশেহারা ত্রস্ত পথিকের আলোর পথের যাত্রীর উপমায়। ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতায় কবির ঐ উচ্চারণ দৃপ্ত তেজে ফেটে পড়ে, যা তাঁর আত্মপ্রকৃতির প্রতিকৃতি : ‘আমি নষ্ট হতে হতে ফিরে এসেছি। / আমার ফেরা আমার চেতনাকে শাণিত করেছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে, আমার স্বপ্ন আর বিশ্বাসের ডাকে সেই স্বর্গের শোভাকেও আমি অস্বীকার করি।/ আমার অস্তিত্বের সদ্য জাগ্রত মাঠে/ সময় এখন শস্য বুনছে, শস্য ফলবে।’ এই শস্যের নাম ‘বিপ্লব’। ‘শান্তির ডিক্রি’ গ্রন্থের ‘অলৌকিক’ কবিতায় কবি এই বিপ্লবকে ‘নতুন জন্মমন্ত্র এই শতাব্দীর’ বলে চিহ্নত করেছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ জনগণের কবি। পঁচাত্তর-পরবর্তী বলয়ে তাঁর মোহনী আড়াল ছিন্ন হয়ে যায়, ঝলকে ওঠে মার্কসবাদ ও বিপ্লবাত্মক রোমাণ্টিকতা। নাস্তিকের মতো তিনি ঈশ্বরের আসন ঠেলে ফেলে জনগণের মুখ দেখেন। ‘নিঃস্ব মানুষ এখন আমার তীর্থ’ কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেন : ‘একটু আগে ও উপরে আকাশ ছিল, ছিল মেঘ, ছিল ভগবান।/ এখন আকাশ নেই, মেঘ নেই, ভগবান নেই, এখন মানুষ শুধু।’ মানবধর্মই তাঁর জীবনের পরমার্থ হয়ে ওঠে। তিনি ‘লেলিনবন্দনা’ করে সরাসরি রাজনীতির জগতে ঢুকে পড়েন। ‘শান্তির ডিক্রি’র নাম কবিতায় তিনি শোষণমুক্তি ও বিশ্বশান্তির কথা মন্ত্রের মতো ছড়িয়ে রাখেন। সাম্রাজ্যবাদের মুখচ্ছবি তিনি নির্মাণ করেন একজন দক্ষ সেনানীর মতো। শত্রু চিনতে তাঁর ভুল হয় না। তিনি মনে করেন : ‘শান্তি মানেই পৃথিবী থেকে পুঁজির বিনাশ/ পুঁজির উচ্ছেদ, পুঁজির শুকিয়ে মরা।’ ‘পৃথিবীজোড়া গান’ কবিতায় তিনি সাম্রাজ্যবাদের অবসানের বিশ্বাসে স্থির হন এবং বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন।
নির্মলেন্দু গুণের প্রথম পর্বের কবিতা জনগণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতো, অনুপ্রাণিত করতো। শেষ পর্বের কবিতার একটি বিশেষ স্তরে তিনি মার্কসীয় দর্শন ও তত্ত্ব কবিতার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছেন। ফলে এই পর্ব কিছুটা ভারাক্রান্ত, গম্ভীর। একারণেই তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক প্রচারধর্মীতার ছাপ পড়েছে।
বিশ্লেষণ : ১
রাজনৈতিক তথ্য : ‘আগ্নেয়াস্ত্র’
‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’ কাব্যের ‘আগ্নেয়াস্ত্র’ কবিতায় যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা, জনতা ও মস্তানদের হাতে যে অস্ত্র চলে গিয়েছিল, সেসব অস্ত্র জমা পড়েনি৷ যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল। অস্ত্রধারীরা নিজেরাই আইন তুলে নিয়েছিলেন নিজের হাতে। ফলত বিব্রত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান অর্ডিন্যান্স জারি করে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। থানায় থানায় অস্ত্র জমা পড়ছে। কবি তার দৃশ্য এঁকেছেন এভাবে : ‘পুলিশ স্টেশনে ভিড়, আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিচ্ছে শহরের সন্দিগ্ধ সৈনিক। সামরিক নির্দেশে ভীত মানুষের স্টেনগান, রাইফেল, পিস্তল, কার্তুজ যেন দারোগার স্বীকৃত মানৎ।’ কিন্তু কবি এখানে satire-এর ভঙ্গিতে ‘হৃদয়নামক’ এক অমোঘ অস্ত্র, যা কোমল বা কঠিন মনোভূমি বিদ্ধ করে, সে অস্ত্র জমা দেননি। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সশস্ত্র বিদ্রোহীর মতো। অবশ্য এই বিদ্রোহ নমনীয়; আগ্নেয়াস্ত্রের মতো ধ্বংসাত্মক নয়, এ যেন শরবিদ্ধ যন্ত্রণার পাখি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছু তথ্য ও ছবি কবির এই কবিতায় অমোঘ হয়ে উঠেছে। কবিতাটিতে ‘পুলিশ স্টেশন’, ‘আগ্নেয়াস্ত্র’, ‘সামরিক’, ‘ভীত মানুষ’, ‘স্টেনগান’, ‘রাইফেল’, ‘পিস্তল’, ‘কার্তুজ’, ‘মাস্তান’, ‘সৈনিক’ ইত্যাদি শব্দের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক থমথমে পরিবেশের চিত্র ফুটে ওঠে।
বিশ্লেষণ : ২
অবয়বগত বা মার্ফোলজিক্যাল
‘না প্রেমিক না বিপ্লবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘স্বাধীনতা, উলঙ্গ কিশোর’ কবিতায় স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত হয় সোচ্চারে। সোচ্চার সেই উচ্চারণ ব্যানারের মতো ব্যবহৃত হয় কবিতার ফ্রেমে। ছবিটি এরকম :
বলো দুঃখ কোনো স্বাধীনতা নয়,
বলো ক্ষুধা কোনো স্বাধীনতা নয়,
বলো ঘৃণা কোনো স্বাধীনতা নয়…
জননীর নাভিমূল ছিন্নকরা রক্তাক্ত কিশোর তুমি
স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও, বেঁচে থাকো,
আমার অস্তিত্বে,
স্বপ্নে,
প্রেমে
বল পেন্সিলের যথেচ্ছ অক্ষরে।
শব্দে
যৌবনে।
কবিতায়।
রেখাক্ষরে এ রকম দাঁড়ায় :
এসব visual form ষাটের কবিদের বহু কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। তৎকালীন ‘কলক্রিস্ট’ কবিতার প্রভাব তাঁরা পরবর্তীতেও এড়াতে পারেনি। কবিতায় এভাবে তাঁরা ঘর-বাড়ি, জ্যামিতিক এবং আঙ্কিক কাঠামো বানিয়ে শব্দ-বিন্যাসে কাব্য-সৌন্দর্য বহিরাঙ্গে ধরে রেখেছেন।
বিশ্লেষণ : ৩
প্রতিতুলনা : শব্দে বাক্যে এবং বাকভঙ্গিতে
নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ‘পাঠের’ সঙ্গে বহু কবিতার সমান্তরাল পাঠের সাযুজ্য সন্ধান করা যেতে পারে। তিনি জানিয়েছিলেন যেন তাঁর প্রিয় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং মায়াকোভস্কি। এঁদের উপস্থিতি তাঁর কবিতায় বিভিন্নভাবে এসেছে, কখনো শব্দে, কখনো বাক্যে বা বাকভঙ্গিতে। এছাড়াও বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা সমকালীন কবিদেরও তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। বিশেষত সংগ্রামী সত্তার আকর্ষণেই তিনি সমান্তরাল পাঠ নিয়েছেন সংগ্রামী ও সচেতন কবিদের কাছ থেকে। প্রেমের দূরন্বয়ী বাকভঙ্গি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে প্রতিতুলনীয় :
আমি মাধবীকে চাঁদ দেবো বলে / আমি মাধবীর
সম্পন্ন মুখের সাচ্ছন্দ্য দিতে গিয়ে / অনন্ত নিখুঁত
সূর্যের আমায় / যেখানেই রেখেছি চোখ সেখানেই
আলোর তিমির। (দৃশ্যে-গন্ধে-রক্তে-স্বার্থে-গানে: নির্মলেন্দু গুণ)।
সমান্তরাল পাঠ
এক দিন ম্লান হেসে আমি তোমার মতন এক
মহিলার কাছে/ যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে
গিয়ে / অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে /
শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে/ দেখেছি অমৃতসূর্য
আছে। (সুদর্শন/ বনলতা সেন : জীবনানন্দ দাশ)।
প্রেমের ক্ষেত্রে যে নমনীয় হৃদয়স্পর্শী মাধুর্য, তা জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ই পাওনা সম্ভব। এ কারণেই নির্মলেন্দু গুণ প্রেমের প্রতিচ্ছবি আঁকতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের কাছে বাকভঙ্গির পাঠ নিয়েছেন।
পদটীকা
১. এক দশকের কবিতা : আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত, প্রসঙ্গ, পৃ. চ।
২. কবিতার সংগ্রাম, সংগ্রামের কবিতা : ভূমিকা, নির্বাচিতা, নির্মলেন্দু গুণ।