একজন কবি সবসময় একই প্রকরণে তৃপ্ত থাকেন না। ভাষাশৈলীতে যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, তেমনি করেন প্রকরণেও। তেমনি প্রকরণে-ছন্দে-অলঙ্কারে বৈচিত্র্য আনার লক্ষ্যে ছয় পঙ্ক্তির কবিতাগুচ্ছ ‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’। আবু হাসান শাহরিয়ারের দীর্ঘ কাব্যচর্চার ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এ কাব্য। এটি মূলত একটি দীর্ঘ কবিতা, ৫৪ সর্গে সম্পন্ন।
যান্ত্রিক-সভ্যতায় সবকিছু যেখানে উপযোগ দাবি করে, আর্থিক লাভালাভের ভিত্তিতে সেখানে প্রেমিকের দাবি কী? প্রথম সর্গেই প্রেমিকের চাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। প্রথম সর্গে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির মধ্যকার সম্পর্ক প্রকাশিত। বাদ যায়নি নেওয়া-দেওয়ার সামর্থ্যরে প্রসঙ্গও। শেষ পঙ্ক্তিতে সেই সামর্থ্য-ইচ্ছার প্রতিফলন, ‘দু-চার পঙ্ক্তি কাব্য ছাড়া আমার দেওয়ার আর কী আছে?/ নিরস কাব্য গ্রন্থে পুরে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে’। কবি নিজের সৃষ্টি সম্পর্কে বক্রোক্তি করেন, ‘নিরস কাব্যগ্রন্থ’ বলে। কারণ, মানবসভ্যতার উন্নতি যান্ত্রিক দিকে, সেখানে মানবিক বিষয়-আশয়ে ক্রমাবনতিরই ইঙ্গিত দেয়। ফলে মানুষের কাছে শিল্পকলা, চিন্তার সারাৎসার ততটা মূল্য পায় না, যতটা মূল্য পায় জাগতিক বিষয়-আশয়। কবিতাকে উপজীব্য করে রচিত শুরুর সর্গ, শেষ সর্গও কবিতাত্মক। শেষ সর্গে কবি নিজের অভ্যাস, বিশ্বাস ও কর্মের চিত্র তুলে ধরেন। সে সঙ্গে পূর্বসূরি জীবনানন্দের উদ্দেশে উচ্চারণ করেন, ‘জলে আকাশ মুদ্রিত হয়; মাটিই আমার বাঁধাই খানা/ নির্জনে সেই গ্রন্থ ওড়াই, যার রয়েছে হাজার ডানা’। মধ্যবর্তী সর্গ দেশপ্রেম, নারী, প্রকৃতি, ভূগোল, মানবপ্রেম, সর্বপ্রাণে প্রেম এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়-আশয়কে আশ্রয় করে রচিত।
‘নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী’র সর্গগুলো অন্ত্যমিলযুক্ত স্বরবৃত্তে রচিত। স্বরবৃত্তে সাধারণত হালকাচালের কবিতা, কিংবা ছড়া কিংবা ব্যঙ্গ কবিতা রচিত হয়। গুরুগম্ভীর বিষয়ের রূপান্তর স্বরবৃত্তে বেশ কঠিন। এ ছন্দের দ্রুত লয়ের সঙ্গে ভাষার গাম্ভীর্য রক্ষা করে, বক্তব্যের উদ্দেশ্য প্রকাশ করা সহজ নয়। অদীক্ষিত পদ্যকারের হাতে এ ছন্দে ছড়া কিংবা পদ্য ছাড়া আর কিছু সৃষ্টি অসম্ভব। কিন্তু দীক্ষিত কবির হাতে এই ছন্দেই কালোত্তীর্ণ কবিতা রচিত হয়। এ কথার প্রমাণ মিলবে রবীন্দ্রনাথ, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টপাধ্যায়ের অনেক কবিতায়। আবু হাসান শাহরিয়ারও এ ধারার সার্থক ও নিরীক্ষাপ্রবণ কবি।
কবিতাগুলো স্বরবৃত্তে রচিত, কিন্তু চাল অক্ষরবৃত্তের মতো। কোনো কোনো সর্গে এক পঙ্ক্তিতেই বাক্য শেষ করেননি। অক্ষরবৃত্তে যেমন এক পঙ্ক্তি থেকে আরেক পঙ্ক্তিতে বাক্যকে প্রবাহিত করে দেওয়া হয়, তেমনি কোনো কোনো সর্গে যে কথা এক পঙ্ক্তিতে শেষ হয়নি, সে কথাগুলো পরবর্তী পঙ্ক্তিতে শেষ করেছেন। পঙ্ক্তির শেষে মিলও রেখেছেন, আবার বাক্যকে রেখেছেন প্রবহমান। এই প্রবহমান স্বরবৃত্তে কবিতা রচনার একটি বিশেষ সুবিধা এই—কবির স্বতঃস্ফূর্ততা কখনো ক্ষুণ্ন হয় না। এ ক্ষেত্রে অর্থপূর্ণ বাক্য গঠনের স্বার্থে পঙ্ক্তির মাঝখানে দাঁড়ির ব্যবহার চলে। পঙ্ক্তিগুলোর মাঝখানে বাক্যের অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য কখনো কখনো পর্বসন্ধি, কখনো-কখনো পঙ্ক্তিসন্ধিও করেছেন কবি।
০১.
ধর্মসাগর ছাড়িয়ে গেলে অল্প দূরেই অশোকতলা
(কুড়ি বছর আগের কথা) প্রথম প্রেমের ছলাকলা
তুমিই আমায় শিখিয়েছিলে। এখনও তার পাঠোদ্ধারে
শেষবেঞ্চের ছাত্র আমি; পালিয়ে থাকি চোখের আড়ে।সংগ্রহে নেই অন্য কিছু, দু-চারখানা পত্র ছাড়া-
তাতেই আমি বর্ষা; তুমি বৃষ্টিতে হও মুলষধারা।
(সর্গ : ০৫)০২.
যখন পরম যত্নে আমি শিখেছি চৌষট্টিকলা
তখন গেছে শুকিয়ে তোমার সোমত্ত সেই প্রেমের জলা।
বলতে এসেছিলাম, ‘চলো হাত-পা ছুড়ে সাঁতার কাটি।’
শুখোজলার হাঁ-মুখ দেখে উৎসাহ খায় দাঁতকপাটি।সাধ ছিল আজ খুলব তোমার ভাঁড়ার ঘরের বন্ধ ঝাঁপি
দাঁত থাকতেই দাঁতের কদর বুঝলে কি হই মনস্তাপী!
(সর্গ : ০৮)
প্রথম উদাহরণের দ্বিতীয় পঙ্ক্তির বক্তব্য সম্পন্ন হয় তৃতীয় পঙ্ক্তির মাঝখানে। ‘(কুড়ি বছর আগের কথা) প্রথম প্রেমের ছলাকলা/ তুমিই আমায় শিখিয়েছিলে।’ এরপর নতুন বক্তব্য শুরু। এভাবে পঙ্ক্তির প্রবহমানতা ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় উদাহরণের ‘যখন পরম যত্নে আমি শিখেছি চৌষট্টিকলা’য় দেখি ‘শিখেছি চৌষট্টিকলা’য় দু-পর্বে পর্বসন্ধি। ‘শিখেছি’ তিন মাত্রার সঙ্গে পরবর্তী পর্বের ‘চৌষট্টিকলা’র ‘চৌ’ দিয়ে পর্বের চার মাত্রা পূরণ করেন। কিন্তু পাঠকালে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না।
সর্গগুলোয় প্রেমের প্রাধান্য থাকলেও প্রেম ছাপিয়ে মানবিক মূল্যবোধ, নৈঃসঙ্গ, অভিমান, সর্বপ্রাণে দয়া এবং দেশপ্রেমও গুরুত্ব পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কবি যুগসচেতন। কিন্তু যুগের প্রচল স্রোতে কোনোভাবে গা ভাসিয়ে দেন না। যুগযন্ত্রণা এবং ব্যক্তির আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্ম-উদ্বোধনের প্রশ্নে কবি আত্মকেন্দ্রিক। ফলে তিনি রচনা করেন আমি-কেন্দ্রিক নৈর্ব্যক্তিক পটভ‚মি। এই ‘আমি’ ব্যক্তি আমিকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে সর্বজনীন। তিনি তাঁর স্বসমাজ-স্বকালের চিত্র আঁকতে গিয়ে মূলত ব্যক্তির উপলব্ধিকে বাক্সময় করে তুলেছেন। কবি চিন্তায় ও চেতনায় মরমিয়াদের স্বগোত্রীয়। ফলে নিজের যাতনার ভেতর দিয়ে সমাজকে প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : ভ‚মিকা’য় বলেছেন, ‘কবির দায়িত্ব হচ্ছে যুগের সত্যকে এবং প্রাণধর্মকে আবিষ্কার এবং এ আবিষ্কারের চেষ্টায় তিনি যুগের ঘটনা পরম্পরাকে স্পর্শ করেন, কিন্তু তার মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না।’ আবু হাসান শাহরিয়ার যুগের সত্যকে কেবল আবিষ্কারই করেন না, সেখানে নিজের অস্তিত্বও অনুভব করেন। সঙ্গত কারণে উচ্চারণ করতে পারেন স্বকালের বিচ্যুতি আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কঠিন সত্য। স্বকালের চাতুর্য, শঠতা, প্রবঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় প্রতারণার প্রতি সংবেদনশীল মানুষের সংক্ষোভই প্রকাশ পায়। ‘মাটির যখন তৃষ্ণা তখন বুঝ দিয়ো না বন্যা-খরা’য় উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে যেমন একটি বিশেষ কালকে চেনা যায় তেমনি, ‘যখন আমার হাজার বোনের গোলাপমুখে এসিড ঝরে/ ঝলসানো মুখ নিয়ে আমার পঙ্ক্তি কাঁদে আর্তস্বরে’ উচ্চারণের পর প্রতিবাদী ও দরদি মনের পরিচয়ও মেলে। এসব তো সমাজের চিত্র। কিন্তু কবির মনের ভেতরে ঝড়ের চিত্রও তো আঁকেন নিভৃতে। এ প্রসঙ্গে আহমদ রফিকের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ‘কবিতার সংজ্ঞা, কবিতার সৃষ্টি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘অস্বীকার করা চলে না যে কবিতা মানবমনের বিশেষ বিশেষ অনুভ‚তির শাব্দিক শিল্পরূপ। গভীর কোনো ভাব বা বোধের রূপময় শৈল্পিক অভিব্যক্তি যখন কবিতা হয়ে ওঠে তখন তার পেছনে থাকে কোনো না কোনো অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি—তা একে যে নামেই চিহ্নিত করি না কেন।’ আবু হাসান শাহয়িারের কবিতার পেছনের ইতিহাস প্রচ্ছন্ন থাকে তাঁর কবিতার শরীরে ও আত্মায়। তিনি কবিতাকে কেবল স্বপ্নগ্রাহ্য করে তোলেন না, মহিমান্বিত করেন যাপিতজীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে। তাই সহজ-সরল উচ্চারণে ধরা পড়ে ‘আমার কাছে নালিশ জানায় হাজার পশু হাজার পাখি/ মানুষ তো প্রকৃতির খুনি, খুনির আবার সভ্যতা কী?’ কিংবা ‘কী করো এই প্রশ্নে আমার জবাব হলো—“জীবন লিখি”/ যদিও জানি কেউ রাজি নয় মূল্য দিতে দু-চার সিকি’, কিংবা ‘রিলকে আমার বন্ধু, মাতাল বোদলেয়ারের ছাত্র আমি’ প্রভৃতি পঙ্ক্তিতে। এ কাব্যের বিভিন্ন সর্গে সমাজের প্রতি তাঁর দায় যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি মমত্ববোধও। রফিক উলø¬াহ খান এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশের কবিতা : পরিকল্পের রূপান্তর’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘শিল্পীর দায় তো সমাজ প্রবাহের অবরুদ্ধতার মধ্যে আত্মাহুতি দেওয়া নয়, শিল্পকে জীবনের বাস্তবরূপের অনুষঙ্গী করে সামাজিক উত্তরণের গতিপথ নির্দেশ করা।’ আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতায় সমাজ বদলের পরামর্শ দেন না, কিন্তু বিবর্তনের প্রণোদনা রাখেন খুব সন্তর্পণে।
এ কাব্যের কোনো কোনো সর্গে সংকেত ও প্রতীকের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি তাকে প্রতীকী কবিদের পর্যায়ভুক্ত বলে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এ প্রতীক ও সংকেত সমাজ থেকে আহরিত বলে এর মূল্যও কম নয়। বৃক্ষ, নদী, নিসর্গ, খরা, ভ‚ত, গোলাপ প্রভৃতি মানবজীবনেরই নানা অনুষঙ্গের প্রতীক ও সংকেত। প্রতীক ও সংকেত সম্পর্কে আবু হেনা মোস্তফা কামাল ‘বাংলাদেশের কবিতা : দুই’ প্রবন্ধে স্বীকার করেছেন, ‘কবিতার শরীরে সংকেত ও প্রতীকের যে লীলা তা কখনোই দুর্বিশেষ্য নয়। এই সব আপাত-জটিলতার নেপথ্যে কবিতার মর্মে কাজ করে সমাজ, দেশ, কাল।’ এভাবে জীবনকে বিশ্লেষণ করলে, পর্যবেক্ষণ করলে জীবনের তাৎপর্য মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়। মানুষ বুঝতে পারে রিরংসা, জিঘাংসা, প্রতিশোধ-স্পৃহা, ক্রোধ কেবল মানবসমাজেই প্রচলিত। প্রকৃতিতে, নিসর্গে এসবের কোনো চিহ্ন নেই।
কবিকে শেষপর্যন্ত হতে হয় স্বতন্ত্র স্বরসম্পন্ন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুও তাঁর স্বনির্বাচিত হতে হয়। না হলে সমকালের অন্য কবিদের কণ্ঠস্বরের তলায় তাঁর কণ্ঠও সমবায়ী স্বরে অবসিত হতে পারে। হাসান হাফিজুর রহমান ‘কবিতার বিষয়বস্তু’ প্রবন্ধে যা বলেছেন, এখানে তা প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘কবিতায় স্থান-কাল-পাত্র নিজের নিজের স্বাতন্ত্র্যে একান্ত এবং কতিায় ওদের যুগের রহস্যময় সূত্রটিও আপন নির্বিকল্প অভিপ্রায় অনুযায়ীই স্বাধিকার প্রমত্ত। কাব্যরীতির এই নিগূঢ় উপায়টির ভাষায়-ফলে ওঠা সম্ভব হয় শুধুমাত্র এই জন্য যে, কবিরা স্মৃতিজীবী।’ আর এই স্মৃতিই এ কাব্যের একটি বিপুল অংশজুড়ে রয়েছে। নিজের সম্পর্কে যত কথাই কবি বলেছেন, তার অধিকাংশই স্মৃতিনির্ভর। ফলে কাব্যের শরীর ও আত্মাজুড়ে স্মৃতিময় চিত্র অঙ্কন করেছেন একের পর এক। কিন্তু সব বক্তব্যের সঙ্গে যে সমাজের প্রচলিত বস্তবের সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকবে, তা-ও নয়। বিনয় ঘোষ ‘সত্য ও বাস্তব’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘পরমসত্য বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। বাস্তবের সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের ফলে সত্যের জন্ম হয় এবং সংগ্রামের স্তরে স্তরে উন্নততর বাস্তব অবস্থার সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সত্যও জটিলতর হতে থাকে।’ কবিকে তাই সমাজের প্রচল সত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয় না, প্রচল সত্যের অন্তরালে বাস্তবতার অনুসন্ধান করতে হয়। তাই কবির উচ্চারণ, ‘নিরন্তরের যাত্রী কবি, বোধে ঢেউয়ের পরম্পরা-/ জলমহালের স্বত্ব তারই; বাদবাকিরা রুক্ষ খরা’। এভাবে কবি নিসর্গ ও মানবজীবনকে একই পঙ্ক্তিতে ধারণ করেন।
আধুনিক কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো—আত্ম-উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বীকারোক্তি। এ প্রসঙ্গে ‘আধুনিক কবিতার আধুনিকতা’ প্রবন্ধে অশ্রুকুমার সিকদার উল্লেখ করেছেন, ‘বেশির ভাগ আধুনিক কবিতা স্বীকারোক্তিমূলক।’ কথাটা যে অমূলক নয়, এর প্রমাণ আধুনিক কবিতার পরতে পরতে মেলে। আধুনিক কবি মূলত নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করেন। সমাজে-রাষ্ট্রে যাকিছু ঘটে, তার অভিঘাতে কবি ব্যথিত হন। হন আন্দোলিত এবং আনন্দিতও। ফলে কবি স্বজ্ঞানে ও নির্জ্ঞানে প্রকাশ করেন নিজের অনুভ‚তি এবং অভিজ্ঞতার সারাংশ। এরই প্রতিফলন দেখি, ‘অমাবস্যায় গিয়েছিলাম দেখতে ভূতের নাচন-কুঁদন/ একটি কালো পেত্নিকে সেই ভ‚তের সভায় ডেকেছি বোন’ কিংবা ‘আমার সঙ্গে আর কেউ নয়, যখন থাকে কেবল আমি/ আমি-ই নারী, আমি পুরুষ, একলা থাকার কী পাগলামি’ প্রভৃতি পঙ্ক্তিতে।
চিত্রকল্পে ও উপমায় তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। শব্দ নির্বাচনে লোকজ-গ্রামীণ ও নদীতীরবর্তী অঞ্চলের ভাষার প্রাধান্য রয়েছে। এ ছাড়া ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়ে মিথ-পুরাণ-রূপকথার পুনর্জীবনও ঘটিয়েছেন। তাঁর কবিতায় রয়েছে জাদুবাস্তবতা ও পরাবস্তবার মিথস্ক্রিয়াও। ছয় পঙ্ক্তির, সমিল স্বরবৃত্তে জীবন-সমাজ-শিল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে কাব্যে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের কবিতায় তো বটেই, সমগ্র বাংলা কবিতার প্রেক্ষাপটেও ‘ষষ্ঠীপদী’ একটি নতুন সংযোজন। বাংলা কবিতা মূলত লিরিক, পয়ারের কবিতা। সেখানে প্রথম নতুন রূপ আনলেন মধুসূদন সনেটের মাধ্যমে। এরপর রুবাই, লিমেরিকের প্রচলন শুরু হলো বাংলায়। কিন্তু বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রকরণের প্রচুর বিবর্তন ঘটলেও বিশেষভাবে আঙ্গিকের নতুনত্বে তেমন কেউ সচেষ্ট হননি। তবে আবু হাসান শাহরিয়ার ‘ষষ্ঠীপদী’র প্রকরণের প্রবর্তন করলেন, তারও চর্চা তেমন হয়নি। অন্য কারও কবিতায় ভিন্ন কথা, স্বয়ং প্রবর্তনকারীই পরবর্তী সময়ে এই প্রকরণে নতুন কোনো কবিতা সৃষ্টি করেননি। বিষয়টা ভাবনার।