(পূর্ব প্রকাশের পর)
না-চার.
আগের আলোচনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে, এমন অজস্র প্রশ্ন জাগে, এসব প্রশ্নে না-গুলোর উৎস বা ভিত্তি, এর ধরন, এর প্রভাব ইত্যাদি জিজ্ঞাসাগুলো থেকেই যাচ্ছে। না-গুলোকে নেতিবাচকভাবে, পাপ-অন্যায়-অপরাধ এবং সামাজিক বিচ্যুতিহিসাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্য জায়গায়:
না-চার.
আগের আলোচনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে, এমন অজস্র প্রশ্ন জাগে, এসব প্রশ্নে না-গুলোর উৎস বা ভিত্তি, এর ধরন, এর প্রভাব ইত্যাদি জিজ্ঞাসাগুলো থেকেই যাচ্ছে। না-গুলোকে নেতিবাচকভাবে, পাপ-অন্যায়-অপরাধ এবং সামাজিক বিচ্যুতিহিসাবে দেখার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্য জায়গায়:
১। দেশ ও জাতির স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আইনলঙ্ঘন করা আইনি না-গুলোকে অমান্য করা এবং পাল্টা না বলা কি অপরাধ?
২। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং উনিশশ মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বকালের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেগুলো কি অপরাধ?
৩। কাজী নজরুল ইসলাম যে লিখেছেন, “আমি মানি নাকো কোনো আইন”১৮— এটা কি অপরাধ?
৪। সত্যজিৎ রায়ের পিকুর ডায়েরি গল্পে পিকুকে দেখা যায় তার মায়ের সাথে হিতেশ কাকুর গোপন ঝগড়ার সময় বন্ধ দরোজার দিকে তাকিয়ে তারস্বরে ‘চুপ’ বলে চিৎকার করে, প্রশ্ন হলো পিকু ধমকটা কাকে দেয়? সে কি বুঝতে পারছে তার মা পরকীয়ার মতো গোপন অন্যায় কাজে জড়িত, নাকি সে ঝগড়ারত কুকুরগুলোকে ধমকটা দিয়েছে? এখানে পিকুর মনে কোন ধরনের না ছিল?১৯
৫। ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো (১৭১৯) উপন্যাস নিয়ে আহমদ শরীফ কোন এক লেখায় যেন প্রশ্ন রেখেছিলেন, আদিবাসী অধ্যুষিত দ্বীপে গিয়ে রবিনক্রস ক্রুসো স্থানীয় মানুষদের ‘অসভ্য’ আখ্যা দিয়ে যে নরহত্যা করে তা কি সুসভ্য ইংরেজ জাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য, নাকি অপরাধ? রবিনসন ক্রুসো তারুণ্যের ঝোঁকে না-এর দিকে ধাবিত হয়ে ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকলেও ব্রিটিশদের উপনিবেশে কি তার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহী অনেক না-এর জন্ম দেয় না?২০
৬। দ্য ক্লিনার নামের একটি চীনা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে দেখা যায় চীনের এক তরুণ বিল্ডিং পরিষ্কার করার কাজ করতে গিয়ে কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে কোনও এক তলার ফ্ল্যাটে এক দম্পতির মিলনদৃশ্য দেখে ফেলে, এই দেখা কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? নাকি ক্লিনার তরুণের মনের ভেতরকার না, অন্যের ঘরের গোপন দৃশ্য দেখার বাসনা চরিতার্থ করার এই প্রয়াস একটি না-এর শক্তি?
২। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং উনিশশ মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বকালের প্রচলিত আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেগুলো কি অপরাধ?
৩। কাজী নজরুল ইসলাম যে লিখেছেন, “আমি মানি নাকো কোনো আইন”১৮— এটা কি অপরাধ?
৪। সত্যজিৎ রায়ের পিকুর ডায়েরি গল্পে পিকুকে দেখা যায় তার মায়ের সাথে হিতেশ কাকুর গোপন ঝগড়ার সময় বন্ধ দরোজার দিকে তাকিয়ে তারস্বরে ‘চুপ’ বলে চিৎকার করে, প্রশ্ন হলো পিকু ধমকটা কাকে দেয়? সে কি বুঝতে পারছে তার মা পরকীয়ার মতো গোপন অন্যায় কাজে জড়িত, নাকি সে ঝগড়ারত কুকুরগুলোকে ধমকটা দিয়েছে? এখানে পিকুর মনে কোন ধরনের না ছিল?১৯
৫। ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসো (১৭১৯) উপন্যাস নিয়ে আহমদ শরীফ কোন এক লেখায় যেন প্রশ্ন রেখেছিলেন, আদিবাসী অধ্যুষিত দ্বীপে গিয়ে রবিনক্রস ক্রুসো স্থানীয় মানুষদের ‘অসভ্য’ আখ্যা দিয়ে যে নরহত্যা করে তা কি সুসভ্য ইংরেজ জাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য, নাকি অপরাধ? রবিনসন ক্রুসো তারুণ্যের ঝোঁকে না-এর দিকে ধাবিত হয়ে ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকলেও ব্রিটিশদের উপনিবেশে কি তার কারণে রাষ্ট্রদ্রোহী অনেক না-এর জন্ম দেয় না?২০
৬। দ্য ক্লিনার নামের একটি চীনা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে দেখা যায় চীনের এক তরুণ বিল্ডিং পরিষ্কার করার কাজ করতে গিয়ে কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে কোনও এক তলার ফ্ল্যাটে এক দম্পতির মিলনদৃশ্য দেখে ফেলে, এই দেখা কি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? নাকি ক্লিনার তরুণের মনের ভেতরকার না, অন্যের ঘরের গোপন দৃশ্য দেখার বাসনা চরিতার্থ করার এই প্রয়াস একটি না-এর শক্তি?
৭। সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখে গেছেন:
বিদ্রোহ আজি বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ;২১
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ;২১
এ কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর মতো লুতুপুতু স্বভাবের মধ্যবিত্তের ভদ্রসন্তান আপত্তি করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কথা,
সে তো জানতো না যে দেশের ও বিদেশের বীভৎস নৈরাজ্য থেকে যে-মতবাদে নিশ্চিন্ত আশ্রয় সে খুঁজেছিলো তারও ক্রিয়াকর্ম নৈরাজ্যমুখী; সে তো জানতো না যে ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারদিকে’ বলে ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত শুধু যে রেললাইন ওপড়ানো আর পোস্টাপিস পোড়ানো হবে তা নয়, শুধু কলকাতার রাস্তা হত্যার প্রকাশ্য রঙ্গালয় হ’য়ে উঠবে, তাও নয়; —আরো অনেক কিছু হবে: পরীক্ষা দিতে এসে ছেলেরা চেয়ার-টেবিল ভেঙে বেরিয়ে যাবে, পড়া না পারলেই ধর্মঘট করবে স্কুলের ছাত্র—তারপর একদিন নম্বর বিতরণে ঘোরতর অসাম্যের অন্যায় আর যদি সহ্য না হয়, যদি বিদ্যার্থী-বঞ্চিতেরা পাস-করা পুঁজিওয়ালাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে তাহ’লেই বা কী বলবার আছে?২২
বুদ্ধদেব বসু সেদিন ভুল বলেন নাই, তাঁর কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে। বিদ্রোহ যদি সত্যিই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাতে হয়তো সুকান্ত তাঁর মতাদর্শের জয় দেখতে পান, কিন্তু তাঁর পছন্দের আদর্শবাদীরা ক্ষমতায় থাকলে তখন কি কোনও কারণ ধরে কোনও পক্ষ এমন পাল্টা বিদ্রোহ করবে না? সেদিনও কি এমন বিদ্রোহ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে না? সেদিন কি প্রতিবিপ্লবের রক্তস্রোতে আবার কলকাতার রাজপথ রঞ্জিত হয়ে উঠবে না?
বুদ্ধদেব বসু কি জানতেন সুকান্ত এত অল্প বয়সে মারা যাবেন? তিনি তো আশা করেছিলেন সুকান্ত একদিন বড় কবি হবেন, বিয়ে করবেন, সংসারী হবেন; তখন যদি সংসারে স্ত্রী বিদ্রোহ করেন? যদি সন্তানেরা বিদ্রোহ করে? ল্যাদাগ্যাদা শিশুহিসাবে বুদ্ধদেব বসু ঘুষখোর দাদুর হাতেঠেলা প্যারামবুলেটরে চড়তে চড়তে বড় হলেও সুকান্তসহ পরবতী প্রজন্মের এবং অনাগত ভবিষ্যৎ কাল স্পষ্ট অবলোকন করেছিলেন।
৮। আগেই বলা হয়েছে না-এর আতিশয্যে তা একদিন অত্যাচার হয়ে ওঠে। তাই না-গুলোকে অস্বীকার করে পাল্টা-না গড়ে তোলার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সমাজে দেখা দেয় বেয়াদবি, বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহের। বেয়াদব মানে “আদব নাই যার”—এই ‘নাই’ শব্দটি না থেকেই উদ্ভূত।
ড. আহমদ শরীফের একটি প্রবন্ধের নাম বে-আদবি, প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথের বেয়াদব নিবন্ধটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বেয়াদব নামের নিবন্ধটি লিখেছিলেন ফিরোজ শাহ মেহতার২৩ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণকে ইংরেজরা বেয়াদবি হিসাবে আখ্যায়িত করেছিল বলে, সে ঘটনার প্রতিবাদে। রবীন্দ্রনাথ দেশপ্রেমকে, আবেগকেই বেয়াদব বলে মনোভাব ব্যক্ত করেন, “হৃদয় জিনিসটাই বেয়াদব—তাঁহাদের নিজেদের পার্লামেন্টে, সাহিত্যে, সমাজে তাহার অনেক পরিচয় পাওয়া যায়।”২৪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তিটি নানা দিক থেকেই প্রণিধানযোগ্য এখানে চিন্তার নানা রকম সুযোগ আছে।
আহমদ শরীফ তাঁর রচনায় বেআদবিকে সামন্তবাদ, রাজতন্ত্র, বুর্জোয়াবাদ, অতীতমুখিতা ও সব রকমের পশ্চাৎপদতার বিপক্ষে এবং প্রগতিশীলতার পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে দেখেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন। বইয়ের নয় পৃষ্ঠাজুড়ে তিনি বেয়াদবির প্রেক্ষাপট এবং এর নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, সমাজের বিদ্যমান না-গুলোর সমালোচনা করেছেন, সেসব না-এর বিরুদ্ধে পাল্টা-না গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কথা বলেছেন। উপসংহার থেকে একটু উদ্ধৃতি দিলেই ব্যাপারটি স্পষ্ট বোঝা যাবে, তিনি লেখেন,
এ বেআদবির অপর নাম নতুন। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে গোড়ায় নতুনের ধারক থাকে নগণ্য কয়জন, মধ্যে তার বাহক হয় অসংখ্য, পরিণামে সর্বজনীন হয়ে স্বীকৃতি পায় নতুন। স্বাধিকারে স্বপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার গরজেই গণমানবকে বেআদব হতে হবে।
অতএব বেআদবি প্রগতির লক্ষণ, আত্মচেতনার অভিব্যক্তি, বিদ্রোহের বীজ, বিপ্লবের সংকেত, নতুন সমাজসংস্কৃতির পূর্বাভাস। তবে প্রসার হোক বেআদবির, জয় হোক বেআদবের।২৫
আহমদ শরীফ বেআদবিকে প্রশ্রয় দিলে প্রতিপক্ষ থেকে, সমাজের না-বাদী রক্ষণশীল অংশ থেকে প্রশ্ন না উঠে পারে না, তিনি যে বেআদবির কথা বলেছেন সেটির মাত্রা কতটুকু, ধরনটাই বা কেমন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন রাগীশিক্ষক হিসাবেই তাঁর পরিচিতি ছিল, ছাত্রদের কথায় কথায় ধমকাতেন, এই ধমকদাতা, ক্রুদ্ধ শিক্ষকই কি বেআদবিকে প্রগতি বলেছেন? কোনও ছাত্র যদি তাঁর টেবিলে পা-তুলে বসত, তা কি তিনি মেনে নিতে পারতেন? তাঁর সামনে ধূমপান করলে মেনে নিতে পারতেন? সমাজে প্রচলিত আদব-কায়দাকে তিনি মধ্যযুগীয় সামন্তবাদের নিদর্শন বলে জানতেন, তিনি কি ছাত্রের ঠ্যাঙ উঁচানোর বেআদবি মানতে পারতেন? কে জানে! হয়তো তাঁর ছাত্ররাই তা ভালো বলতে পারবেন। নাকি সক্রেটিসের মতো তরুণ প্রজন্মের নবীন ছাত্রদের নতুন কথা শুনিয়ে শিক্ষকহিসাবে কিংবদন্তী হয়ে ওঠার প্রয়াস!
৯। সর্বদাই কি সমাজের না, আইনের না শুনতে হবে, মানতে হবে? তিরিশ/একত্রিশ বছর আগে একদিন রাতে বাঁশঝাড়ের বাঁশগাছে ফাঁসিতে ঝুলে থাকা এক মহিলাকে দড়ি কেটে নামিয়ে এনেছিলাম, সেদিন কত মানুষ যে আমাদেরকে হাইকোর্ট দেখিয়েছে! ফাঁসিতে ঝুলন্ত কাউকে নামানোর অধিকার কারও নাই, কেউ নামাতে পারবে না, পুলিশকে খবর দিতে হবে, তাদের হুকুম ছাড়া নামানো যাবে না ইত্যাদি। তরুণ বয়সে সেদিন পুলিশী না-গুলোর প্রতি ভয় ছিল, আবার ভেতরে ভেতরে পাল্টা-না-এর শক্তিও ছিল। সেই পাল্টা-না-এর শক্তির কারণেই সেই মহিলা আজ পর্যন্ত সুস্থভাবে বেঁচে আছেন। সেদিন কোন না-এর শক্তিতে কোন না-এর বিজয় হয়েছে?
১০। বিপরীত ঘটনাও ঘটে। অনেক সময় অনেকে সাহস দেখাতে গিয়ে অপঘাতে মারা যান। সমাজে প্রচলিত না-এর বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক পাল্টা-না দেখাতে গিয়ে গত বছর (৩১ জুলাই, ২০২৩) একজন ফরাসি স্পাইডারম্যান মারা গেলেন। শিশুদের জন্য নির্মিত ব্যঙ্গচিত্র সিরিজ স্পাইডারম্যানের অনুসরণ ও অনুকরণ করে তিরিশ বছর বয়স্ক ফরাসি তরুণ রেমি লুসিডির উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ে দেয়াল বেয়ে ওঠার এক অভিনব শখ সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন। তিনি জীবনে হাজার হাজার না-কে উপেক্ষা করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হংকংয়ের একটি সুউচ্চ ভবনের ৬৮ তলা থেকে পড়ে মারা গেলেন। সকল না-এর পরিসমাপ্তি ঘটল এভাবে!২৬
না-পাঁচ
সমাজে প্রচলিত আরও কয়েক প্রকার না-এর উদাহরণ এখানে আলোচনার দাবি রাখে। ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা না-গুলোকে কয়েক রকম দেখা যায়।
ক) অনুজ্ঞাবাচক বা নির্দেশমূলক না: ওখানে যেও না।
খ) ইচ্ছাসূচক বা প্রার্থনাবাচক না: তুমি এটা নাও না।
খ) ইচ্ছাসূচক বা প্রার্থনাবাচক না: তুমি এটা নাও না।
ক) স্থায়ী না-: কখনো মিথ্যা কথা বলবে না।
মনে কোনোদিন লোভকে স্থান দেবে না।
মানুষের বিপদ দেখে হাসবে না।
মনে কোনোদিন লোভকে স্থান দেবে না।
মানুষের বিপদ দেখে হাসবে না।
খ) অস্থায়ী বা সাময়িক না:
আজ আর বাইরে কোথাও যাবে না।
এ মাসে ইলিশ মাছ ধরা যাবে না, খাওয়া যাবে না।
আজ আর বাইরে কোথাও যাবে না।
এ মাসে ইলিশ মাছ ধরা যাবে না, খাওয়া যাবে না।
গ) চিকিৎসাবৈজ্ঞিানিক না-:
অ্যালার্জি থাকলে ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে না।
খালিপেটে এই ওষুধ খাওয়া যাবে না।
মাস্ক না পরে বাইরে যাবে না।
অ্যালার্জি থাকলে ইলিশ মাছ খাওয়া যাবে না।
খালিপেটে এই ওষুধ খাওয়া যাবে না।
মাস্ক না পরে বাইরে যাবে না।
ঘ) ছদ্মবেশী না: বাংলা ভাষায় অনেক সময় না কিন্তু হ্যাঁ হয়ে যায়। বাক্যের ভেতরে হ্যাঁ এবং না লুকানো থাকে। এগুলোকে ছদ্মবেশী না বলা যেতে পারে। যেমন, ‘এই আজ না তোমার ঘুরতে যাওয়ার কথা! (এর মানে হলো, হ্যাঁ আজ তোমার ঘুরতে যাওয়ার কথা।) তুই না অনেক দুষ্টু হয়েছিস! (এর মানে, হ্যাঁ, তুই অনেক দুষ্টু হয়েছিস।)
আবার অনেক সময় অস্তিবাচক অনুজ্ঞা বা হ্যাঁ-বোধক বাক্য দিয়ে লুকানো নেতিবাচক বাক্যের না-প্রকাশ করা হয়। যেমন, নে, সব খা, খেয়ে ফেল! (এর অর্থ, কিছু খাবি না।) যাবি, যা, এই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যা! (এর অর্থ, বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যাবি না।)
সন্ধ্যার পর সুঁইকে সুঁই বলবে না, চুনকে চুন বলবে না। এমন ধরনের ছোটখাটো না থেকে শুরু করে কোনো দেশে হানাদার বাহিনীর অবিরাম বিমান হামলার মুখে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে, হামলা বন্ধের প্রস্তাবে, নির্বিচারে নরহত্যার আয়োজনে বিরতি দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে পরাশক্তিগুলোর ভেটো, অর্থাৎ না-এর প্রস্তাবের মতো বিভিন্ন রকম প্রভাব সৃষ্টি করে না-গুলো।
আগেই দেখানো হয়েছে না-গুলো মানবসমাজের বিভিন্ন কোণ থেকে উদ্ভূত হয়ে সমাজে স্থান করে নেয়। এই না-গুলোর মধ্যে আছে পরস্পর সমন্বয় এবং প্রতিরোধ। ধর্মীয় না-গুলো অনেকের কাছে বৈজ্ঞানিক না-এর বিরোধী, তাই সেগুলো অগ্রাহ্য করার কথা বিজ্ঞানবাদীরা বলে থাকেন; আবার বৈজ্ঞানিক না-গুলোকে ধর্মীয় ব্যাখ্যাকারগণ ধার্মিক জীবন ও বিশ্বাসের পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করে সেগুলো অগ্রাহ্য করাকে দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে স্থির করেন। পুঁজিপতিরা এসব না-কে পুঁজি করে বিনিয়োগের পথ খোঁজেন, বিনিয়োগ করে না-বিরোধী পণ্য বাজারজাত করে মুনাফা উপার্জন করেন।
যেমন, ধর্মীয় না যদি হয়, বেপর্দায় মুসলমান নারীরা ঘর থেকে বের হবেন না, তাহলে সেখানে বস্ত্রব্যবসায়ীরা নানা রকম বোরখা, স্কার্ফ, হিজাব, নেকাব ইত্যাদি পণ্য উৎপাদন করেন, বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন, বাজারজাত করেন; এটাই তাদের সুযোগ।
ধর্ম নামক শাস্ত্রটি মানুষ জন্মগতভাবে লাভ করে, পারিবারিকভাবে চর্চা করে, সামাজিকভাবে পালন করে এবং রাজনৈতিকভাবে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসও নিয়ে থাকেন। ধর্মের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর বলে ধর্মীয় উৎস থেকে আসা না-গুলো অগ্রাহ্য করা, অস্বীকার করা কঠিন হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যে পরিবারে যুক্তি, বুদ্ধি ও স্বাধীনভাবে জ্ঞান চর্চা করার সুযোগ নাই, সেখানে ধর্মীয় না উপেক্ষা করা কঠিন। ধর্মবাদীরা তাদের শাস্ত্রীয় না-গুলো ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে না দিয়ে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে কিছু মানুষ তা সহজেই মেনে নেন, কিছু মানুষ গোপনে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং পাল্টা-না সৃষ্টি করে নেন, অনেকে পরিস্থিতি বুঝে সুবিধাজনক আচরণ করেন।
ধর্মীয় না অনেক সময় এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, সেখানে বৈজ্ঞানিক না-এর সঙ্গে প্রবল সাংঘর্ষিক রূপ নেয়। যেমন, ভারতের পুনা শহরে প্লেগ ও দুর্ভিক্ষ প্রবল হয়ে উঠেছিল, তখন ইংল্যান্ড থেকে আসা প্লেগ রোগের চিকিসার জন্য বিলাত থেকে আনা দু’জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে উগ্রপন্থী হিন্দু রাজনৈতিক কর্মীরা হত্যা করেছিল। লেখক সমুদ্র গুপ্তের ভাষায় সে ঘটনা,
এরই কিছুদন পরে পথিমধ্যে বন্দুকের গুলিতে নিহত হলেন দুই ইংরেজ রাজকর্মচারী। একজন লেফটেনান্ট আয়ার্স্ট। আরেকজন মি. র্যান্ড। তিনি ছিলেন প্লে-অফিসার। হত্যাকারীরা হলেন দামোদর আর চাপেকার নামক দুই মারাঠী যুবক।২৭
অন্যদিকে ভারতের ঐ ঘটনার শতাব্দীকাল পরে এই যুগেও পাকিস্তানে শিশুদের জন্য টিকাদান নিয়ে স্থানীয় ধর্মপন্থীদের সাথে প্রবল বিরোধ চলছে। অনেক দিন ধরে চলমান সেই বিরোধের সূত্রেই গত ৮ জানুয়ারি (২০২৪) খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বাজাউর জেলায় পোলিও টিকাদানকারীদের ওপর বোমা বিস্ফোরণে পাঁচজন পুলিশ নিহত হন এবং সাতাশজন আহত হন। ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ নামক একটি উগ্র ইসলামপন্থী সংগঠন হামলার দায় স্বীকার করেছিল। এ ঘটনার পরে সেখানে পোলিও টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।২৮
আফগানিস্তানের বর্তমানে ক্ষমতাসীন তালেবানি ধর্মীয় না-গুলোর কথা বিশ্ববাসী অবগত, ভারতের এ যুগের উগ্রবাদী হিন্দুদের না-গুলোও সর্বজন বিদিত। প্যালেস্টাইনের গাজা উপত্যকাসহ সর্বত্র ইসরায়েলি ইহুদিদের না-গুলোই বর্তমানে সর্বশক্তিমান না। মায়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বগুলোর ভেতরে নানা রকম না-এর ব্যাপার আছে, সেগুলোও মনে রাখতে হবে। মহাপারাক্রমশালী রাশিয়ার সাথে যুদ্ধরত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের যে এলাকাগুলো একবার রাশিয়ার দখলে যাচ্ছে, আবার ইউক্রেনের পুনর্দখলে যাচ্ছে, এভাবে বারবার দখল-পুনরুদ্ধারের পালা চলছে, সেখানকার নাগরিকদের কথা ভাবুন, তাদেরকে কত প্রকার রাজনৈতিক ও জাতিগত না-এর ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে!
এভাবেই নানারকম না-এর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রবল হয়ে ওঠে।
ধর্মীয় না-গুলোকে আলোচনার সুবিধার জন্য শ্রেণীবিভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এগুলো কয়েক ধরনের: ১। পৌরাণিক না, ২। সাংগঠনিক না, ৩। নীতিবাদী না, ৪। বস্তুগত না, এবং ৫। আধ্যাত্মিক না।
পৌরাণিক না-গুলো প্রতিটি ধর্মেই দেখা যায়। অতীতের পুরনো ব্যক্তি, ঘটনা, প্রাণী বা বস্তু এবং স্থান নতুন প্রজন্মের কাছে নির্বিশেষে সম্মানিত, ক্ষেত্রবিশেষে পূজনীয় হয়ে ওঠে; সর্বজনীনতার কারণেই এখানে না গড়ে ওঠে। এ বিষয়টি ভালো জানার জন্য জোসেফ ক্যাম্ববেলের মিথের শক্তি বইটি পড়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি ধর্মই সাংগঠিক রূপ লাভ করে বলে যে কোনও সংগঠনের মতো এখানেও ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনে না গড়ে ওঠে। মানুষের জীবনকে সুস্থ, সুন্দর ও সুনিয়ন্ত্রিভাবে যাপন করার সুবিধায় বিধি-বিধানগুলোর পক্ষে না-সৃষ্টি হয়। কিছু কিছু বস্তু বাস্তব কারণেই ক্ষতিকর ও অপরিচ্ছন্নতার কারণে নিষিদ্ধ করা হলে সেখানে না-এর সৃষ্টি হয়। আর মানবমনের কুপ্রবৃত্তি বা হৃদয়ের স্খালন ঠেকানোর জন্য এবং নানাবিধ কারণে আধ্যাত্মিক না-গুলোর জন্ম হয়।
অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক না-গুলোর সৃষ্টি হয় দুটি উৎস থেকে।
১। অপ্রমাণিত বিশ্বাস রোধ করার প্রয়োজন থেকে,
এবং
২। ক্ষতিরোধ করার জন্য
এবং
২। ক্ষতিরোধ করার জন্য
এই ক্ষতিগুলো বিজ্ঞান করায়ত্তকারী শক্তির স্বার্থে কাজ করে। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতিসাধন করতে পারে বৈজ্ঞানিক যুক্তি হাতে থাকা সত্বেও, স্রেফ স্বার্থে। ক্ষতিকর ও ক্ষতিগ্রস্তের পার্থক্যের কারণে বিজ্ঞানের না-গুলো আপেক্ষিক। বিশ্বাসজনিত না-গুলোও বিজ্ঞান করায়ত্তকারী গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন,
নদী বা পুকুরের পানি পান করবেন না। (আমাদের তৈরি করা নলকূপ আছে, কিনে নিন।)
আর্সেনিক ঝুঁকির কারণে নলকূপের পানি পান করবেন না। (আমাদের তৈরি আধুনিক ফিল্টার আছে, কিনে নিন।)
ফিল্টারের পানি পান করবেন না, কারণ সেটি নিরাপদ না। (আরও অত্যাধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি পিউরিফাইয়ার আছে, ব্যবহার করুন।)
সয়াবিন তেল খাবেন না, ফ্যাট হতে পারে। (আমাদের কোম্পানির খাঁটি সরিষার তেল আছে।)
সরিষার তেল খাবেন না, ইউরিক অ্যাসিডের ঝুঁকি বাড়ে। (আমাদের কোম্পানির বিশুদ্ধ সয়াবিন তেল আছে।)
আর্সেনিক ঝুঁকির কারণে নলকূপের পানি পান করবেন না। (আমাদের তৈরি আধুনিক ফিল্টার আছে, কিনে নিন।)
ফিল্টারের পানি পান করবেন না, কারণ সেটি নিরাপদ না। (আরও অত্যাধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তিতে তৈরি পিউরিফাইয়ার আছে, ব্যবহার করুন।)
সয়াবিন তেল খাবেন না, ফ্যাট হতে পারে। (আমাদের কোম্পানির খাঁটি সরিষার তেল আছে।)
সরিষার তেল খাবেন না, ইউরিক অ্যাসিডের ঝুঁকি বাড়ে। (আমাদের কোম্পানির বিশুদ্ধ সয়াবিন তেল আছে।)
এখানে আলোচনা এবং সংজ্ঞায়নের চেয়ে উদাহরণগুলো বেশি কার্যকর, আপনারা আরও ভালো ভালো উদাহরণের সঙ্গে পরিচিত আছেন, মিলিয়ে দেখুন।
ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির যেমন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজের সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষের তেমন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নাই। এই না থাকার কারণেই বিজ্ঞানবিরোধী না-গুলো এখানে ইটের ফাঁকে ঘাসের মতো গজিয়ে ওঠে। প্রতি বছর পদার্থ, রসায়ন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে কতজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, কেন পাচ্ছেন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে কী কী নতুন সূত্র আবিষ্কৃত হলো, তা এদেশের বিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন না, অনেক শিক্ষকও খবর রাখেন না, আর তা দেশের সাধারণ মানুষের তো জানার কথাই না। এ কারণে বিজ্ঞানের নব আবিষ্কার যখন মানুষের আরাম-আয়েস বৃদ্ধি এবং কষ্ট বা অসুবিধা দূর করার জন্য পণ্য হয়ে অথবা জীবন রক্ষাকারী ওষুধহিসাবে বস্তুগত আকারে উৎপাদিত হয়ে বণিক শ্রেণীর হাত ধরে বাজারে প্রবেশ করে, তখন সেটি সাধারণ মানুষ তার প্রয়োজন, রুচি এবং ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে কাছে গ্রহণ করে— এই হলো বিজ্ঞানের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক।
বিজ্ঞান এবং মানবসমাজের মাঝখানে আছে বিশাল এক পুঁজিপতির দল, যাঁরা ধর্মে বিনিয়োগ করে, আবার বিজ্ঞানেও বিনিয়োগ করে। এরা মুনাফা করার জন্যই এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, কাউকে মরণোত্তর স্বর্গীয় জীবন সুনিশ্চিত করার জন্য করে না, আবার জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার জন্যও করে না। বিজ্ঞান যখন পুঁজিপতিদের বিনিয়োগের বিষয় হয়ে যায়, আর যদি তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, মানুষ সেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে দূরের জিনিস মনে করে, সন্দেহ করে এবং দূরত্বজনিত কারণে বিরোধও সৃষ্টি হয়। তখন সেখানে বিজ্ঞানবাদী না-গুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সাধারণ মানুষ, পাল্টা-না প্রতিরোধক হিসাবে খাড়াও করে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক না-গুলো সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনিস্টিক সেন্টার এসব জায়গায় বিজ্ঞান করায়ত্তকারীদের না-গুলো ধারালো বল্লমের মতো সক্রিয় থাকে, মানুষ সেখানে নিতান্ত অসহায়। ওখানে গেলে শোনা যায়:
(যা লিখে দিলাম এর বাইরে) অন্য কোম্পানির ওষুধ খাওয়াবেন না।
অন্য কোথাও টেস্ট করাতে যাবেন না।
এখানে ওষুধ পাবেন না। (বাইরে থেকে আনতে হবে।)
রোগীকে বাড়িতে নেবেন না। (আইসিইউতে রাখতে হবে।)
ভয় পাবেন না, কিচ্ছু হবে না।
অপাশেন করাতে হবে দ্রুত, দেরি করা যাবে না।
আশা ছাড়বেন না (অপারেশন করালেই চলবে।)
অন্য কোথাও টেস্ট করাতে যাবেন না।
এখানে ওষুধ পাবেন না। (বাইরে থেকে আনতে হবে।)
রোগীকে বাড়িতে নেবেন না। (আইসিইউতে রাখতে হবে।)
ভয় পাবেন না, কিচ্ছু হবে না।
অপাশেন করাতে হবে দ্রুত, দেরি করা যাবে না।
আশা ছাড়বেন না (অপারেশন করালেই চলবে।)
না-ছয়
এ রচনার প্রথম দিকে, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যে প্রশ্নটি রেখেছিলাম, মানুষ কেন বিপরীতযাত্রা করে! তরুণ বয়সে যারা আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক না-গুলো উপেক্ষা করে, পাল্টা-না সৃষ্টি করে তারা কেন পরিণত বয়সে আবার সেই পুরনো না-এর সমষ্টিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচেন, অন্যদেরকে, বিশেষ করে তরুণদেরকে, অন্তপক্ষে নিজেদের সন্তানদেরকে সেই না-এর দড়ি দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করেন? ওই যে বলা হয় “রাগ গাঙে চর পড়ে আগে”— সে কথাটিই ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে।
এ রচনার প্রথম দিকে, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে যে প্রশ্নটি রেখেছিলাম, মানুষ কেন বিপরীতযাত্রা করে! তরুণ বয়সে যারা আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক না-গুলো উপেক্ষা করে, পাল্টা-না সৃষ্টি করে তারা কেন পরিণত বয়সে আবার সেই পুরনো না-এর সমষ্টিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচেন, অন্যদেরকে, বিশেষ করে তরুণদেরকে, অন্তপক্ষে নিজেদের সন্তানদেরকে সেই না-এর দড়ি দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করেন? ওই যে বলা হয় “রাগ গাঙে চর পড়ে আগে”— সে কথাটিই ব্যাখ্যা করার অবকাশ আছে।
যাঁরা তরুণ বয়সে প্রচলিত না-গুলোকে উপেক্ষা করেন, অস্বীকার করেন এবং পাল্টা না সৃষ্টি করেন, তাঁদের মনের পরিচয় জানা প্রয়োজন। মোটা দাগে তাঁদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
ক) এক পক্ষ আবেগপ্রবণ হয়ে না-বিরোধী হন,
খ) আরেক পক্ষ যৌক্তিকভাবে না-বিরোধী বা বিদ্রোহী হন।
খ) আরেক পক্ষ যৌক্তিকভাবে না-বিরোধী বা বিদ্রোহী হন।
কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ, সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিদ্রোহ প্রথম ধরনের, আবেগপ্রবণতার ভাব-উচ্ছ্বাস। রবীন্দ্রনাথের “বাঁধ ভেঙে দাও” যৌক্তিক আহ্বান। এমন উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়।
কিশোর বয়সে এবং উঠতি তরুণ বয়সে মানবমনে আবেগের আতিশয্য থাকে, একারণে এই বয়সের ক্ষোভ, প্রক্ষোভ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ এবং বিরুদ্ধতাও আবেগনির্ভর। ব্যক্তিজীবনের বয়সবৃদ্ধিতে, যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার পূর্তিতে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তাভাবনার পরিপক্কতায় কালক্রমে আবেগ হ্রাস পেলে ব্যক্তি তখন একটু একটু করে আবেগহীন বা যৌক্তিক হতে থাকেন। এভাবে তাঁর প্রথম জীবনের পণগুলো, প্রত্যয়গুলো এবং সিদ্ধান্তগুলোতে পরিবর্তন আসে, ভিন্নযাত্রা শুরু হয়।
আবেগ মূলত স্বল্পায়ু, যুক্তি দীর্ঘায়ু। তবে যৌক্তিক সিদ্ধান্তেও পরিবর্তন আসে। এক কালের কঠিন যুক্তিবাদী মানুষও জীবনের কোনও এক বয়সে অতি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে পারেন। মানসিক সমস্যা ও মানসিক পরিবর্তনের পেছনে দুটি দিক বিশেষ ভূমিকা রাখে দৈহিক ও মানসিক। দৈহিক কারণগুলোর মধ্যেও আছে দুটি বিভাগ:
১। স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভসিস্টেমের ভূমিকা: এ ধরনের পরিবর্তনের পেছনে মানবমস্তিষ্কের স্নায়ুমণ্ডলীর ভূমিকা থাকে। মস্তিষ্কের বাম পাশের যেখানে মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি ও শৃঙ্খলার অবস্থান সেখানে, নির্দিষ্ট স্নায়ুমণ্ডলীকে সুস্থ ও সতেজ না থাকলে, কোনও প্রকার শুষ্কতা, অতিরিক্ত আর্দ্রতা, টিউমার জন্ম, রক্তাধিক্য, রক্ত জমাটবাঁধাসহ নানা প্রকার সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর প্রভাবে মানুষের যুক্তি এবং আবেগের শৃঙ্খলা ভেঙে যায়।
২। শারীরিক জৈব রসায়ন অর্থাৎ অন্তঃস্রাবী গ্রন্থিরস বা হরমোন, ও অন্যান্য রাসায়নিকের ভূমিকা: এছাড়া হরমোনে কোনও প্রকার তারতম্য ঘটলে তার যৌক্তিক এবং বৌদ্ধিক অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটতে পারে। নানা প্রকার ভিটামিন, প্রোটিন, অক্সিজেন, গ্লুকোজ, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনের উপাদানের স্বল্পতায় কিংবা আধিক্যে এক বয়সের অতি যুক্তিবাদী, নিরাবেগ, নিরেট এবং নিষ্ঠুর ধরনের মানুষও আরেক বয়সে আবেগপ্রবণ হয়ে ঘন ঘন কাঁদেন, কথায় কথায় হাসেন—এমনও দেখা যায়।
আবার বিপরীত ব্যাপারও ঘটে, এক কালে যিনি ছিলেন অতি আবেগ ঘরপুর একজন স্নেহপরায়ণ মানুষ, যিনি গল্প-কথায় সামান্য আবেগ কেঁদে ওঠেন, তিনিও আরেক বয়সে অতি কঠোর, নিরাবেগ ও নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন, অতি আপনজনের বিয়োগবেদনাও তখন তাঁকে কাবু করতে পারে না। এভাবে না-গুলোরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এটা হলো ভেতরের কারণ, এছাড়া বাইরের কারণও অনেক আছে। যথাযথ জ্ঞান ও বিদ্যাবুদ্ধির অভাব, নিরন্তর চর্চার অনুপস্থিতি, স্বার্থবুদ্ধির প্রভাব, লোভজনিত নতুন আশা, ভীতিজনিত আত্মরক্ষার সিদ্ধান্ত এবং বিনিময় ইত্যাদি।
জীবনের হ্যাঁ এবং না-গুলোর কাটাকাটির হিসাব মিলাতে না পেরে প্রায় দুই দশক আগে এক ছাত্রী জিজ্ঞাসা করেছিল, “মাদরাসায় পড়া শিক্ষিতেরা যখন নাস্তিক হয়, তখন কেন এত কট্টর ধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠে?”
এরপর পাল্টা প্রশ্নও এসেছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই, এক ছাত্র জানতে চেয়েছে, “ইংরেজি, হিসাববিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, সমাজকর্ম এমন অনৈসলামিক সাবজেক্ট নিয়ে পড়া কিছু শিক্ষিত মানুষ, যারা কোনওদিন কোরআন শরিফটা রিডিংও পড়ে নাই, এক কালে উগ্র প্রগতিবাদী ছিল, এমন মানুষেরা যখন হঠাৎ ধার্মিক হয়, তখন কেন কট্টর মৌলবাদী হয়ে ওঠে?” জটিল ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় ছিল না, তাই মুচকি হাসি দিয়ে বলতাম, “রাগ গাঙে চর পড়ে আগে।” তরুণরা সাধারণত কয়েকটি কারণে সমাজে প্রচলিত না-গুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বা নিতে আগ্রহী হয়ে থাকে, এগুলো এমন:
১। কৌতূহল: অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার কৌতূহল বুদ্ধিমান কিশোর-তরুণদের এক স্বাভাবিক প্রবণতা। তাই প্রচলিত না-গুলোকে লঙ্ঘন করে তারা নতুনত্বের সন্ধানে এগিয়ে যেতে চায়। যেমন,
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়, সন্ধানীরা কিসের আশায়।
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে।
২। উপকার: নিজের বা কাছের মানুষের জন্য উপকার করতে গিয়ে কল্যাণবাদী নৈতিকতাবোধ এবং মানসিকতা থেকে তরুণরা বিভিন্ন প্রকার না-এর দেয়াল ডিঙানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করে এবং সেখান থেকেই সাহস পায়।
৩। বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ: আগেই বলা হয়েছে না-গুলো যখন বেশি শক্তিশালী, অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করে সেখানে তরুণের মনে বিদ্রোহ দেখা দেয়। যেমন,
আমি আপনাকে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।
আমি মানি নাকো কোনো আইন
আমি মানি নাকো কোনো আইন
রুশ লেখক ইভান তুর্গেনেভের (১৮১৮—৮৩) ফাদার অ্যান্ড সন (১৮৬২) উপন্যাসটি যিনি পড়েছেন তিনি জানেন সেখানে ইভজেনি ভাসিলিয়েভিচ বাজারভ নামের রুক্ষ স্বভাবের, তীক্ষ্ম মেধার, যুক্তিনিষ্ঠ, বস্তুবাদী এবং নাস্তিক্যস্বভাবী তরুণটি তার আচরণের জন্যই পাঠকের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, যার জন্য লেখক নিজে পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছেন। বাজারভ ছিলেন তাঁর স্বকালে অনভিপ্রেত এবং ভাবীকালের নায়ক। তবে লেখক এই নায়কটিকে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে, হয়তো পাঠকের চাপে পড়েই মৃত্যু ঘটিয়েছেন।২৯
আবার জেমস জয়েস (১৮৮২—১৯৪১)-এর আ পোর্ট্রটে অব দ্য ইয়াংম্যান এজ এ আর্টিস্ট (১৯১৬) উপন্যাসের নায়ক স্টিফের ডেডেলাসকে পরবর্তী শতাব্দীর আইরিশ তরুণহিসাবে একটা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছেন। তুর্গেনেভের বাজারভ সর্বদা একই রকম, একটি স্থির চরিত্র ছিল, কিন্তু জয়েসের স্টিফেন রূপান্তরিত চরিত্র। প্রথম জীবনে তাকে দেখা যায় অত্যন্ত ধর্মভীরুহিসাবে। কোনও এক নারীকে একটি চুমু খাওয়ার ঘটনায়, প্রবলভাবে অনুতপ্ত হয়ে চার্চে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। কিন্তু কলেজজীবন পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পরেই যুক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষকদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলে নানা রকম তর্কে ও বিতর্কে অংশ নিয়ে সে হয়ে ওঠে মোটামওুটি একজন ধর্মবিরোধী, হয়তো বিদ্বেষীও। ধর্ম নিয়ে তখন সে নানা রকম ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা শুরু করে, তার এই পরিবর্তন উপন্যাসটিকে সজীবতা দিয়েছে।
স্টিফেন ডেডেলাসের এই মানসিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী সমকালীন সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত, স্বকালের সমাজ ও আয়ারল্যান্ডের রাজনীতি। চার্চের পুরোহিতদের নেতিবাচক ভূমিকা ছাড়াও ছিল সেকালের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং রাজনৈতিক নানা জটিলতার কুটিল খেলা—যা এতদূর বসে আমার পক্ষে বোধকরা অসম্ভব। তবে এ উপন্যাসে শুধু ধর্ম বনাম প্রগতির দ্বন্দ্বটাই মুখ্য নয়, নানা রকম জটিলতার প্যাঁচ আছে। সেই আন্দোলন ও সংগ্রামের ফসল ৬ ডিসেম্বর ১৯২১ আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতালাভ। ডেডেলাসকে প্রথম জীবনে যাঁরা না-দিয়ে বেঁধে রাখতে চেয়েছেন, তাঁরাই পরে ডেডেলাসের পাল্টা-না এর আঘাতে জর্জরিত হয়ে নেতিবাচক মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন।৩০
এখানে মানবমনের পরিচয় একটু দিয়ে নিলে আলোচনাটা ইচ্ছাপূরণের দেশে সহজে যেতে পারবে। যাঁরা আমার চেয়ে বয়সে বড় কিংবা জানাশোনায় বিজ্ঞ তাঁরা তো জানেনই, যাঁরা নতুন পাঠক তাঁদের জন্য এটুকু প্রয়োজনীয়। মানব মনের দুটি স্তর আছে, ক) সচেতন মন (Consous Mind) এবং খ) অবচেতন মন (Sub-consous Mind)।
এ-টুকু হাতে রইল, এবার ফ্রয়েডের মতে মানুষের ব্যক্তিসত্তার সাংগঠনিক দিকটা একটু দেখে নেওয়া যাক। তাঁর মতে মানুষের ব্যক্তিসত্তার ভেতর তিনটি বিশিষ্ট অংশের কথা বলেন, ১। অদস (Id), ২। অহং (Ego) এবং ৩। অধিশাস্তা (Super Ego)। মনোবিজ্ঞানের পরিভাষা হিসাবে বাংলা শব্দতিনটি অপরিচিত বলে একটু কঠিন মনে হতে পারে, তাই সহজ ভাষায় বলতে গেলে প্রথমটিকে আমরা জীবাত্মা বলতে পারে। যে কোনও জীবের বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্বভাব নিয়ে মানবসন্তান বাঘ-ভালুক-সিংহ কিংবা হায়েনার মতোই জন্মগ্রহণ করে, কাম, ক্রোধ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিয়ে বেঁচে থাকে এবং একদিন মৃত্যুবরণ করে। তার জৈবসত্তা কিন্তু জৈবস্বভাব নিয়েই টিকে থাকে। দ্বিতীয় বিষয়টিকে বলা হয়ে থাকে অহং বা ইগো, এটিকে আমরা মানবাত্মা বলতে পারি। মানুষহিসাবে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা লাভ করি, বৃদ্ধি, কৌশল, চিন্তা, কল্পনা, সীমাহীন আকাক্সক্ষা এগুলো ইগো বা অহং-এর বিশিষ্টতা। আর সুপার ইগো বা অধিশাস্তাকে আমরা মহাত্মা বলতে পারি। এটিকে বিবেকও বলা হয়।
জৈবসত্তা থেকে মানবসত্তায় উত্তীর্ণ হলে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা, লোভ, হিংসা এমন কতগুলো বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়, সেসব বৈশিষ্ট্যকে বিবেকের শাসনে রাখতে পারলে মানুষ মহাত্মায় উত্তীর্ণ হতে পারে। মনোবিদগণের মতে এ বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা দেখে নেওয়া যাক,
তিনটি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত অধিশাস্তা। প্রথমত, পিতামাতার বা তৎস্থলবর্তী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যা কিছু আজ্ঞা, অনুজ্ঞা, অনুশাসন, আদেশ, উপদেশ, শিক্ষা, পরিচালনা ও পথনির্দেশ—এসবই শিশু অকপটে মেনে নেয়, ভয়েতে অথবা ভালোবাসা ও প্রশংসা পাবার জন্য। তাছাড়া শিশুবয়সে যুক্তিবুদ্ধি বা বিচারশক্তিও কম থাকে, অপরদিকে পিতামাতা ও অন্যান্য গুরুজনদের উপর থাকে পরম নির্ভরশীলতা ও অগাধ বিশ্বাস। প্রত্যেক শিশুর মনের ভিতর চিরদিনের জন্য এগুলি গেঁথে যায় এবং পিতামাতার অবর্তমানে, তাঁদের প্রতিচ্ছবি বা প্রতিমূর্তি (চধৎবহঃধষ ওসধমব) তাঁদের স্থলবর্তী হয়ে সন্তানের মনের মধ্যে পাকাপাকিভাবে বাসা বাঁধে। রক্তমাংসের মা-বাবা হয়ত নাও থাকতে পারেন বা দূররে থাকতে পারেন, কিন্তু মনের মধ্যবর্তী এই চধৎবহঃধষ ওসধমব বা মা-বাবার প্রতিচ্ছবি চিরন্তন হয়ে, সজাগভাবে তাদের মনের মধ্যে থেকে তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে।
দ্বিতীয়ত, Social Inharitance, বা সামাজিক উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ জীবনের ন্যায়, নীতিবোধ, ধর্ম, সমাজের বিধান, সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ, এমনকি দীর্ঘজীবনের জাতীয় কুসংস্কার, সবই বর্তায় এক পুরুষ থেকে পর পুরুষে।
তৃতীয়ত, নিজের ব্যক্তিজীবনের আদর্শ বা Ego Ideal। অধিশাস্তা বিবেকের চেয়েও বড়। সে হিসেবে অধিশাস্তার কাজ হচ্ছে অহংকে পথভ্রষ্ট হতে না দেওয়া। ব্যক্তি, যে সমাজে ও যে কালে জন্মগ্রহণ করেছে, তার ধর্ম, ন্যায়নীতি, রীতি, মূল্যবোধ ও বিভিন্ন সংস্কারের সঙ্গ ছন্দ মিলিয়ে, সামঞ্জস্য রেখে তাকে চলতে বাধ্য করা হয়। অধিশাস্তা ব্যক্তির অন্তরে অন্তর্যামী হিসাবে থেকে, অহং-এর সবকিছু কাজকর্মের উপর খর দৃষ্টি রাখে।৩১
অধিশাস্তাকে উপেক্ষা করলে ব্যক্তিসতার অহংবোধের মধ্যে দেখা দেয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাপবোধ, আত্মধিক্কার, অনুতাপ, অনুশোচনা, প্রবল উৎকণ্ঠা এবং সবশেষে দেখা দেয় মানসিক ভারসাম্যের বিলুপ্তি এবং অস্বাভাবিক মানসিকতা। অধিশাস্তা চালিত হয় সময় এবং পরিবেশ থেকে অর্জিত আদর্শবোধ দ্বারা। এটি জন্মগত নয়, সে কারণে মানুষের বিবেকও জন্মগত নয়। অধিশাস্তা সমাজ থেকে অর্জিত বলে বিবেকও অর্জিত গুণের প্রকাশমাত্র।
মনস্তত্ত্ববিদ ডা. অরুণকুমার রায়চৌধুরীর মতে, “অধিশাস্তা তথা বিবেক মানুষের জীবনের অর্জিত অভ্যাসগত ব্যবহারমাত্র। বিবেক যদি জন্মগত হত তবে সমস্ত নরনারীর ক্ষেত্রে বিবেকের প্রকাশ হত অভিন্ন।”৩২
মানুষের চেতন মনের সাথে অবচেতন মনের আশা-আকাক্সক্ষার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দেখা দিলে যে অস্বাভাকিতা দেখা দেয় তা ব্যক্তিত্বকে পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, ব্যক্তিমন যখন সেটি টের পায় তখন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেতে গিয়ে লাগামহীন ইচ্ছাকে স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এভাবে তরুণ বয়সের অহংবোধ, ইচ্ছার অবাধ স্বাধীনতা যখন তাকে বিভিন্ন প্রকার না-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা দেয়, পরিণত বয়সে অধিশাস্তার সঠিক শাসনে বা নিয়ন্ত্রণে মানুষ পরিণত জীবনে একটা নীতি ও আদর্শের বৃত্তে স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব গ্রহণ করে।
পত্রিকাটি হাতের কাছে খুঁজে পাচ্ছি না বলে রেফারেন্স দিতে অক্ষম। তবে না বলে পারছি না, বত্রিশ/তেত্রিশ বছর আগে পাক্ষিক সানন্দা পত্রিকা সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল, সেখানে তাঁকে এমন একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি বিশ্বাসী নাকি অবিশ্বাসী। তিনি উত্তরে জানিয়েছিলেন, “আগে ঘোরতর নাস্তিক ছিলাম, এখন মনে হয় এতটা অবিশ্বাসী হওয়া বোধহয় উচিত না।”
সে লেখা পড়ে আমরা খুব হাসাহাসি করতাম, মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসও কি উচিত-অনুচিতের ওপর নির্ভর করে! পরে ড. হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পরে তাঁর লাশ দাফন করার ঘটনা পেপারে পড়ে এবং শুনে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, যে হুমায়ুন আজাদ কোনওদিন মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন নাই, সারাজীবন যিনি ধর্মের বিরুদ্ধেই লিখে গেছেন। তাঁর লাশ জার্মানি থেকে দেশে এনে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁদের সমাজের মসজিদের ইমাম জানাজা না পড়ানোর ইচ্ছা থেকে নাকি পালিয়ে গিয়েছিলেন; পরে অন্য কোনও মসজিদ থেকে ভিন্ন ইমাম এনে জানাজা পড়াতে বাধ্য করা হয়।
সেদিনও আমরা হেসেছিলাম, যিনি জীবনে ধর্মে আস্থাশীল ছিলেন না, মৃত্যুর পরে কেন ধর্মের ছত্রচ্ছায়ায় নেওয়া হলো? তাঁর লাশ যদি আরজ আলী মাতুব্বর বা ড. আহমদ শরীফের লাশের মতো মেডিক্যাল কলেজে দান করা হতো, কিংবা যদি মিনা ফারাহ-এর পুত্রের লাশের মতো হিন্দুনিয়মে দাহ করা হতো, তাতে কি কোনও প্রকার ক্ষতিবৃদ্ধি হতো? হুমায়ুন আজাদের স্বজন-পরিজনেরা কেন ইসলামি রীতিকে এত প্রয়োজন করে করলেন! তবে কি সত্যজিৎ রায়ের সেই উক্তির মধ্যে এ রহস্য রয়ে গেছে?
টীকা ও তথ্যনির্দেশ:
১৮। কাজী নজরুল ইসলাম, বিদ্রোহী, ‘অগ্নিবীণা’, নজরুল-রচনাবলী-১, বাংলা একাডেমী, প্রথম পুনর্মুদ্রণ (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ) জুন, ২০১২, পৃষ্ঠা- ৮।
১৯। সত্যজিৎ রায়, পিকুর ডায়েরি ও অন্যান্য, নওরোজ কিতাবিস্তান ঢাকা, প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা-৩৩।
২০। | https://www.enotes.com/topics/robinson-crusoe/questions/who-did-robinson-crusoe-kill-2659641
“I perceived presently he had a bow and arrow, and was fitting it to shoot at me: so I was then obliged to shoot at him first, which I did, and killed him at the first shot.”
The person Crusoe kills is a “savage” who is trying to retake the fleeing captive whom Crusoe will later name Friday. After beheading another pursuer, Friday comes over Crusoe and makes the following gestures:
“[he] kissed the ground, and laid his head upon the ground, and taking me by the foot, set my foot upon his head; this, it seems, was in token of swearing to be my slave for ever.”
Crusoe is pleased with this turn of events: ever since he saw the first natives on the island, it has been his “dream” to capture and enslave at least one of them. He now has his slave, and a very willing and intelligent one at that.
১৮। কাজী নজরুল ইসলাম, বিদ্রোহী, ‘অগ্নিবীণা’, নজরুল-রচনাবলী-১, বাংলা একাডেমী, প্রথম পুনর্মুদ্রণ (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ) জুন, ২০১২, পৃষ্ঠা- ৮।
১৯। সত্যজিৎ রায়, পিকুর ডায়েরি ও অন্যান্য, নওরোজ কিতাবিস্তান ঢাকা, প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা-৩৩।
২০। | https://www.enotes.com/topics/robinson-crusoe/questions/who-did-robinson-crusoe-kill-2659641
“I perceived presently he had a bow and arrow, and was fitting it to shoot at me: so I was then obliged to shoot at him first, which I did, and killed him at the first shot.”
The person Crusoe kills is a “savage” who is trying to retake the fleeing captive whom Crusoe will later name Friday. After beheading another pursuer, Friday comes over Crusoe and makes the following gestures:
“[he] kissed the ground, and laid his head upon the ground, and taking me by the foot, set my foot upon his head; this, it seems, was in token of swearing to be my slave for ever.”
Crusoe is pleased with this turn of events: ever since he saw the first natives on the island, it has been his “dream” to capture and enslave at least one of them. He now has his slave, and a very willing and intelligent one at that.
ড্যানিয়েল ডিফোর (১৬৬০—১৭৩১) সতেরো শতক থেকে এখন বিশ্বসভ্যতা অনেক দূরে এগিয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে নানা দেশে নানা কমিশন কাজ করছে। রবিনসন ক্রুসোর ঘটনা এভাবে এখন বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
২১। সুকান্ত ভট্টাচার্য, ‘অনুভব’ ॥১৯৪৬॥, ছাড়পত্র, সুকান্ত-সমগ্র, সারস্বত লাইব্রেরি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ৩১ শ্রাবণ, ১৩৬৪, পৃষ্ঠা-৫০।
২২। বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত, সুকান্ত বিচিত্রা (বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত), সাহিত্যম, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ ২৫ জানুয়ারী, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-৩৭।
২৩। ফিরোজ শাহ মেহতা (১৮৪৫—১৯১৫) ভারতীয় রাজনীতিবিদ, মুম্বাই মহানগরীর কমিশনার, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি।
২৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেয়াদব, সমায়িক সার সংগ্রহ, রবীন্দ্র-রচনাবলী-১৭, ঐতিহ্য প্রকাশনী ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ মার্চ, ২০০৬, পৃষ্ঠা-৭৭০।
২৫। আহমদ শরীফ (ড.), বেআদবি, কালের দর্পণে স্বদেশ, মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা-৯০।
২৬।| https://ekattor.tv/international/48814/ 01.08.2023..
২৭। সমুদ্র গুপ্ত, বঙ্গভঙ্গ, আনন্দধারা প্রকাশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৭৫, পৃষ্ঠা-৪-৫।
২৮।https://www.jugantor.com/international/760825/, 08.01.2024|
২৯। | Ivan S. Turgenev, Father and Sons, Translated from russian by C.J. Hogarth, London an Torento Published J.M. Dent and Sons Ltd and New York, by E.P. Dutton and Co.Inc. 286-302, Forth Avenue, New York, Reprinted 1929.
৩০। James Joyce, A Portrait of the Artist as a Young Man, Published by Alice and Books, aliceandbooks.com
৩১। অরুণকুমার রায়চৌধুরী (ডা.) অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয় মুদ্রণ এপ্রিল ১৯৯১, পৃষ্ঠা-১২৭-১৩০।
৩২। অরুণকুমার রায়চৌধুরী (ডা.) প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা- ১৩০।
২২। বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত, সুকান্ত বিচিত্রা (বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত), সাহিত্যম, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ ২৫ জানুয়ারী, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-৩৭।
২৩। ফিরোজ শাহ মেহতা (১৮৪৫—১৯১৫) ভারতীয় রাজনীতিবিদ, মুম্বাই মহানগরীর কমিশনার, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি।
২৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেয়াদব, সমায়িক সার সংগ্রহ, রবীন্দ্র-রচনাবলী-১৭, ঐতিহ্য প্রকাশনী ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ মার্চ, ২০০৬, পৃষ্ঠা-৭৭০।
২৫। আহমদ শরীফ (ড.), বেআদবি, কালের দর্পণে স্বদেশ, মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা-৯০।
২৬।| https://ekattor.tv/international/48814/ 01.08.2023..
২৭। সমুদ্র গুপ্ত, বঙ্গভঙ্গ, আনন্দধারা প্রকাশন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ ১৩৭৫, পৃষ্ঠা-৪-৫।
২৮।https://www.jugantor.com/international/760825/, 08.01.2024|
২৯। | Ivan S. Turgenev, Father and Sons, Translated from russian by C.J. Hogarth, London an Torento Published J.M. Dent and Sons Ltd and New York, by E.P. Dutton and Co.Inc. 286-302, Forth Avenue, New York, Reprinted 1929.
৩০। James Joyce, A Portrait of the Artist as a Young Man, Published by Alice and Books, aliceandbooks.com
৩১। অরুণকুমার রায়চৌধুরী (ডা.) অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয় মুদ্রণ এপ্রিল ১৯৯১, পৃষ্ঠা-১২৭-১৩০।
৩২। অরুণকুমার রায়চৌধুরী (ডা.) প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা- ১৩০।
মন্তব্য