কবিতার ভেতরে একজন কবির মগ্নতা, মৌনতা বিস্তীর্ণ এক রহস্যভূমি, যেখানে কবি কেবলই একজন ধ্যানীচিন্তক এবং পরিব্রাজক হয়ে তার কাজটি করে থাকেন সাহিত্যকালব্যাপী। যদি প্রশ্ন রাখা হয়, ‘কবি কেন কবিতা লেখেন?’ কিংবা ‘কবিতাই কি সর্বশেষ মাধ্যম সত্যাশ্রয়ী দর্শন ব্যাখ্যার?’ অমূলক প্রশ্ন নয়। কবি তার সমগ্র জীবনের ভাবনা, জ্ঞান আর অন্তর্দশনকে বিকশিত, প্রকাশিত করেন তার প্রতিটি কবিতার মাধ্যমে। হতে পারে তা পরাবাস্তবতায় কিংবা বাস্তবতায় অথবা বিমূর্তবাদিতায়। বাংলা কবিতায় তো বটেই সেই সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের কালোত্তীর্ণ কবিদের কবিতায়ও বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
কবিতা ঋদ্ধ হয়ে ওঠে কবির সার্থক প্রকাশের ভেতর দিয়েই শুধু নয়, বরং রহস্যঘেরা আবহ তৈরির মাধ্যমেও। এই রহস্যময় অনিবার্য রথের যাত্রী বাংলাসাহিত্যর আদিকবি লুইপা থেকে শুরু করে অদ্যবধি লিখে যাওয়া কবিগণ । এই শব্দরথযাত্রার একজন নাহিদা আশরাফী। তার কবিতার বই ‘ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে’ (প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩) বাংলা কবিতায় নতুন সংযোজন। এই বইয়ের শিরোনাম এবং কবির কবিতাচিন্তা চোখে পড়ার মতো, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই একেবারেই।
নাহিদা আশরাফী কথাসাহিত্য রচনার পাশাপাশি নয়, বরং কবিতাকে তিনি ভিন্ন এক মেজাজ থেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা, এই শব্দব্রত যাপনই তাকে কবিতার উঠোনে স্থান করে দিয়েছে স্বতন্ত্র অবস্থানের সঙ্গে। তার কবিতার ভাষা সাবলীল কিন্তু অদ্ভুত রকমের তীক্ষ্ণ কাব্যভাষা। এই কাব্যভাষার মধ্য দিয়েই একজন কবি তার চিন্তা বিনির্মাণে ব্রতী হন। তার কবিতা গ্রন্থ ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’র অধিকাংশ কবিতায়ই মানুষের অন্তরাত্মাকে মানুষের সুপ্ত ভাবনাকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন ফুঁ দিয়ে। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ কবির কবিতায় নিজস্ব ভাবনার পাশাপাশি সাবলীলতা একটি বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেদিক থেকে নাহিদা আশরাফী তার কবিতায় ব্যক্তিক ভাবনাকে অপ্রধান রেখে সামগ্রিক চেতনার দৃঢ় অবস্থানকে সুন্দর করে প্রকাশ করার বিষয়টিতে মনযোগী হয়েছেন। তার কবিতা সাবলীল কিন্তু মানসী প্রেমের অনন্য উদাহরণ:
তোমার নাসিকা চূড়ায় ধ্যানমগ্ন ঋষি
শেরে নিল এক লক্ষ রজনীর তপস্যা
অতঃপর ধ্যান ভেঙে স্মিত হেসে
পুণ্যবতী চোখের গঙ্গায় পেল পবিত্র স্নান।
স্নান শেষে সিক্ত উদোম গায়ে উঠে এলো কপালতটে
ঠোঁটের বাগান থেকে তুলে নিলো পুজোর ফুল
ললাট মন্দিরে ঋষি সাজালো নৈবেদ্যের থালা
(বিসর্জন, প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে)
বাংলা কবিতার আদি থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত যে ধাপ পরিলক্ষিত হয় বাঁক বিবর্তনের স্থান চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ার, তা সত্যিকার অর্থেই মামুলি বিষয়। লক্ষণীয়, মধ্যযুগের পর যুগসন্ধিকালে কবি ঈশ্বরগুপ্ত তার কবিতায় মানসীপ্রেমের অনন্য ভাবধারা প্রকাশের চেষ্টা করেন। ‘মানবকেন্দ্রিক’ কারণ কেবল মানুষের জীবনাচার, ধ্যান-ধারণা। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের নিবিড়তা আর মনস্তাত্তিক বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়টি সে সময় থেকেই উঠে আসতে শুরু করে বাংলা কবিতার দেহে। পরবর্তী পর্যায়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তীসহ অন্য কবিরা আধুনিকায়নের চূড়ান্ত নির্মাণের সফল প্রয়াস ঘটান। বাংলা কবিতার এতগুলো বছর অতিক্রমের পর আবারও সেই ধরনের কাব্যিক ভাবধারা যেন ফিরে আসতে চাইছে অনেকের হাত ধরে, অনেকেরই কবিতায়।
এই প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম নন নাহিদা আশরাফী নিজেও। তিনি আপন মননের সঙ্গে কেবল ভাবনার মিশেলই শুধু নয়, সেই সঙ্গে যুক্ত করেন সময়প্রবাহের মন্ত্রণা।
নাহিদা আশরাফীর কবিতাগুলোতে মানসীপ্রেম মুখরিত হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এই প্রেমের ধারায় স্নাত হয়ে শুদ্ধ হতে পারেন যেকোনো সুন্দর হৃদয়। তার কবিতায় সাবলীলতার আড়ালে ব্যাপক গভীর চিন্তনপ্রক্রিয়া মুদ্রিত। এ চিন্তন প্রক্রিয়ার মূলেই রয়েছে মগ্নতা। কবি তার নিজস্ব ভুবনেই একা, একেশ্বর। কবিতার প্রয়োজনে কবি মুহূর্তেই হয়ে ওঠেন মনস্তাত্তিকতার মগ্নপ্রতীক। এ রহস্যের জাল ভেদ করা সম্ভবপর নয় কোনোদিন কোনো কবির পক্ষে। সাহিত্য সমালোচকরা কেবল তাদের ব্যক্তিক ভাবনাকেই ব্যক্ত করেন বক্তব্যে এবং লেখায়। কবির নিজস্ব চিন্তনের রোমন্থন প্রক্রিয়া কবি ইচ্ছা করলেও প্রকাশ করতে পারেন না কখনো বরং যেভাবেই তিনি প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন, সে কেবল কবিতাময় হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে চিন্তনের সঙ্গে পার্থিব জীবনদৃষ্টির মিশ্রণে অপরূপ এক ম্যুরাল। কেবল প্রেমই নয়, পাশাপাশি নাহিদা আশরাফীর কবিতায় যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ভিন্ন দর্শন। কবি তো গণমানুষের কথাই বলেন কখনো কখনো, কবিকে বলতেই হয় হৃত অধিকার ফেরানোর কথা। একুশ শতকের এই সময়ে সারাবিশ্বের গতিধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাহিদা আশরাফী তার রাজনৈতিক চিন্তাকে চুপচাপ সরিয়ে এনেছেন মানুষের কাতারে। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার নির্দণ্ড উচ্চারণ!-
রাষ্ট্রের গায়ে
কারা যেন গায়েবি হরফে লিখে দিয়েছে-
একশ’ হাত দূরে থাকুন।সাইনবোর্ড-
ইদানীং চোখ বেশ পরিষ্কার দেখে।
রাস্তায় নামলেই পুঁজিবাদীর উদোম গায়ে সাঁটা স্টিকার-
‘বেবি অন বোর্ড, হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার’
অথচ তার তাবৎ আমজনতার গলায়
ধারালো ব্লেডের মতো ঝুলতে দেখি, ‘ইউজ মি’।
(এ কবিতা অপাঠ্য বলে গণ্য করা হোক/ ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে)
‘মানবিক মনস্তাত্ত্বিক কবিতা’ এ শব্দগুলো বাদ দিলে একজন কবির শ্রম আর কবিতার কাছে কবির চেতনাগত কিংবা ভাবনাগত দায় কতটুকু? আরও খোলাসা করে বলতে গেলে কবি তার কবিতা নির্মাণের সময় আর বাহ্যিক দৃষ্টিকোণের সাধারণ সাহিত্য সমালোচকের ভাবনার দূরত্ব কত যোজন? এ দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাননি বলেই একজন কবি কখনোই জানতে পারেন না কোন কবিতাটি তার শ্রেষ্ঠ রচনা। কোন লেখাটি তাকে সর্বাধিক দহিত করেছে। কবিতার প্রয়োজনেই কবিরা কখনো কখনো ধ্যানী-ঋষি হয়ে ওঠেন। কখনো বা নির্লিপ্ত থাকেন অজস্র কুতর্কের ভিড়েও। এই পরিস্থিতির ব্যতিক্রম নন নাহিদা আশরাফী নিজেও। তার নিজস্ব চিন্তা আর পার্থিব বিষয়াদিকে মগজ থেকে হাতের মাধ্যমে কলমের ডগায় এবং সবশেষে সাদা কাগজে নিবন্ধিত হতে দেখা যায় ‘ফিরতে চাই বৃক্ষজন্মের কাছে’ এবং ‘প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে’র কবিতাগুলোতে।
অনস্বীকার্য সত্য হচ্ছে, একজন কবির কবিতাচিন্তা মগজ থেকে বিবর্তিত হয়ে ওঠার পর সাদা কাগজে লিখিত হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত ভাবনার বিস্তার বহু ক্রোশ। এটিই সত্য যে, কবির চেতনা, বাস্তবিক যাপিত জীবনাচার, যুগযন্ত্রণা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামাজিক বৈষম্যতা, জৈবিক বিষয়াদিসহ পারিপার্শ্বিক জগতের নানামুখী চেতনালব্ধ বিষয় কবিকে কাগজের বুকে লিখে যেতে বাধ্য করে। এই বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যেতে পারেননি স্বয়ং নাহিদা আশরাফী। তার বইয়ের কবিতা পড়লে এ ধরনের বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়বে পাঠকের চোখে। তার কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি শব্দের আড়ালে কোনো কিছুই লুকিয়ে যান না বরং অকপটে প্রকাশ করতে চান গাল্পিক ঢঙে, যে বিষয়টিকে বর্তমান সময়ের পাঠক মনোগ্রাহীরূপে গ্রহণ করে। তারপরও মহাকালের টিকে যাওয়ার একটি বিষয় রয়ে যায়। এই বিষয়টির বিচারক স্বয়ং মহাকাল। কবিতার কাছে তার কোন লুকোচুরি নেই এই সত্য তার কবিতা থেকেই প্রমাণিত।
একজন সত্যিকারের কবির ক্ষেত্রে এটি সত্য যে তার চেতনা, বাস্তবিক যাপিত জীবনাচার, যুগযন্ত্রণা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সামাজিক বৈষম্যতা, জৈবিক বিষয়াদিসহ পাশ্বর্সিক জগতের নানামুখী চেতনালব্ধ বিষয় কবিকে কাগজের বুকে লিখে যেতে বাধ্য করে। এই আঁকাবাঁকা এবং মগজের রীতিমতো ভাবনার স্ফুলিঙ্গ একটি নিপাট, নির্বিবাদ পরিকাঠামো মেনে নিয়ে লেখায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম নন নাহিদা আশরাফী নিজেও। তিনি আপন মননের সঙ্গে কেবল ভাবনার মিশেলই শুধু নয়, সেই সঙ্গে যুক্ত করেন সময়প্রবাহের মন্ত্রণা।
এই পথ নিঃসন্দেহে কুসুমাস্তীর্ণ নয় কখনো কোনো কবির জন্যই। নাহিদা আশরাফীর কবিতা হয়ে উঠুক মহাকালের পুষ্পকরথের উপঢৌকন,এই প্রত্যাশা সবসময়ের।
বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন কাব্য ‘চর্যাপদ’ থেকে শুরু করে আধুনিককাল এবং কথিত উত্তরাধুনিককালের প্রত্যেক কবির কবিতায় ছায়া ফেলেছে কবির একান্ত ব্যক্তিক অনুযোগের বিষয়টি। এই মহাসত্যই মগজের রীতিমতো ভাবনার স্ফুলিঙ্গ একটি নিপাট, নির্বিবাদ পরিকাঠামো মেনে নিয়ে লেখায় রূপান্তরিত হয়। কবিতার নির্মাণশৈলী আরও ভয়াবহ রকমের লৌকিক ক্রিয়া। আপন মননের সঙ্গে কেবল ভাবনার মিশেলই শুধু নয়, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সময়প্রবাহের মন্ত্রণা, যে বিষয়টি একজন লেখককে একদিকে যেমন ধাবিত করে পরিশীলিত রচনা সৃষ্টির দিকে, অন্যদিকে ধাবিত করে নিরুত্তাপ, অনুত্তেজক জীবনযাত্রার দিকে। সত্যিকারের ভাবনার প্রকাশ কখনোই সাহিত্য আর সৃজনশীল কর্ম ছাড়া ভিন্ন কিছু হতে পারে না। কবির চিন্তার সূচিকে ক্রমাগত পাঠ করলে এ বিষয়টি প্রতীয়মান হয়ে ওঠে এবং যার প্রমাণ কেবল বাংলা সাহিত্যেই অসংখ্য কর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এরকম বোধের ব্যতিক্রম ঘটেনি নাহিদা আশরাফীর কবিতায়।, বরং সাবলীল ছান্দসিক এক নিপাট শূন্যতা আন্দোলিত করেছে নাহিদা আশরাফীর কবিতাকে তার প্রমাণ প্রাগুক্ত দু’টি কবিতাবই। তার ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘মর্গের কবিতা’, ‘সিকোরাক্স’, ‘প্রহেলিকা’, ‘আমাদের কোনো সর্বনাশ হয়নি’সহ বেশকিছু কবিতায় তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন চিন্তাক্রিয়ার বিবর্তনের:
শিশিরের কাঁধে জমে না কোনো জন্মঋণ
বেঁচে থাকার দীনতায়;
মৃত্যুকালীন কোনো ক্লেশবোধ তাকে ছোঁয় না
রাত্রির সঙ্গমসুখে
বিধ্বস্ত পাখির পালক খসে যেতে যেতে
যেটুকু ক্লান্তি ছড়ায় শিশিরের বুকে
সেটুকু আলো ভেবে বুক পেতে নেয়
শীত-সকালের রোদ নয়া প্রেমিকের মতো
(জন্মঋণ / প্রেম নিয়ে পাখিরা যা ভাবে )
পৃথিবীর সব কবিই তার নিজস্ব মগ্নতার নিগূঢ় ধ্যানের কাছে নতজানু। কবিতার এ ধ্যান আর মগ্নতা যার জীবনযাত্রায় যত বেশি তীব্র তিনিই তত বেশি ঋদ্ধ করে সাজাতে পারেন তার শব্দের শস্যভূমি। কবির এ মগ্নতাই কবিকে নিয়ে যায় অনন্ত বিস্ময়ের দিকে। সামাজিকতা, রাষ্ট্রীয় জীবনচিন্তা, ব্যক্তিক টানাপড়েন, একজন কবিকে যতটুকু হতাশাগ্রস্ত করে তোলে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে ওঠেন কবি, যখন তার মগ্নতাকে সঠিকরূপে প্রকাশ করতে না পারেন। এ কারণেই কবি অন্যদের থেকে আলাদা তার পুরো জীবন আর চিন্তনের জায়গা থেকে।
কবি তার মনোজাগতিক চিন্তনের পথে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নিজেই পৌঁছে যান অনুন্মোচনীয় এক শিলালিপির কাছাকাছি, তা কবি নিজেও বুঝতে পারেন না। হঠাৎ করেই জেগে ওঠা সেই গভীর বোধ আর চিন্তনের পরম্পরায়, ভাবনার দোলনায় কবি চিরন্তন দোলায়িত হতে থাকেন। পার্শ্বিক প্রকৃতি, বিমুগ্ধ সমাজচিন্তা আর যাপিত জীবনাচারের তাবৎ বিষয়াদি তাকে দায়বদ্ধ করে তোলে কবিতা সৃষ্টির পথে। এ দায় থেকেই কবি ব্রতী হন ‘কবিতা’ নামের এক অপূর্ব ভাবনার নির্মাণে। যত পথেই কবি হাঁটেন কিংবা যত মতেই কবি দীক্ষিত হোন না কেন, তার চিন্তন প্রক্রিয়া, মননশীলতা আর মস্তিষ্কে উদ্বুদ্ধ যন্ত্রণার সার্থক প্রকাশ হয় কবিতার মাধ্যমে। আর এ কবিতা সৃষ্টির তাগিদ আজন্ম রহস্যঘেরা এক গভীর সরোবর। এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েই দেখা দিয়েছে নাহিদা আশরাফীর কবিতাগুলোতে।
একটি কবিতা সৃষ্টির প্রাক্কালে যাবতীয় (ইহজাগতিক কর্ম) দর্শনকে কবি আশ্রয় করেন কেবলই কি তার লেখার প্রয়োজনে? কিংবা তার নিজস্ব চিন্তন প্রক্রিয়ার সফল প্রকাশ ঘটানোর স্বার্থে? এরকম প্রশ্নের উত্তর ‘না’। কবি তার কবিতা ও দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের সবটাতেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শনকে প্রয়োগ করেন। এ কাজটি করেন বলেই কবি সমাজের অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি পরিপূর্ণ মনোজাগতিক বিষয়াদিতে। কবির অন্তরাত্মা আর বহিরাত্মার মিশেলেই সৃষ্টি হয় সার্থক কবিতা।
নাহিদা আশরাফী কবি। তিনি তার ব্যক্তিক, মনোজাগতিক তন্দ্রাচ্ছন্নতা আর নিজস্ব ভাবনার শিল্পরূপ মিলিয়েই পৌঁছে যান অলৌকিক সাম্রাজ্যে, যেখানে অযুত প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়াদি ধরা পড়ে তার দিব্যজ্ঞানে। তার মননশীলতার মাধ্যমে তিনি ওই বিশাল সাম্রাজ্যের যৎসামান্যই লিপিবদ্ধ করে প্রকাশ করতে সমর্থ হন কবিতার আদলে। সেইসঙ্গে তার কবিতায় ভাবনার সাবলীল বুনন স্পষ্ট। সমকালীন কবিতাযাত্রার একটা পথ নাহিদা আশরাফী অতিক্রম করছেন। এই পথ নিঃসন্দেহে কুসুমাস্তীর্ণ নয় কখনো কোনো কবির জন্যই। নাহিদা আশরাফীর কবিতা হয়ে উঠুক মহাকালের পুষ্পকরথের উপঢৌকন,এই প্রত্যাশা সবসময়ের।