বহির্বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিরক্ষায় রাষ্ট্র চালিত হয় খ্রিস্টাব্দের হিসেবে। আমাদের শিক্ষা, অফিস-আদালত, আন্তর্জাতিক ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা চলে একই হিসেবে। তাই নাগরিক সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে খ্রিস্টীয় সন বা খ্রিস্টাব্দ। একে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আমাদের জাতিসত্তায় আছে বঙ্গাব্দ। বাংলা সন কিংবা বঙ্গাব্দ বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে যে, এ নিয়ে নতুন কোনো কথা বলার সুযোগ নেই।
পঞ্জিকা খুলে বৈশাখের দিনক্ষণ দেখতে হয় না। সে এলে জানান দিয়েই আসে। আকাশে-বাতাসে ঘোষিত হয় বৈশাখের আগমন-বার্তা। পয়লা বৈশাখ এলেই আমরা গেয়ে উঠি ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক’। আমাদের কানে আসে ‘ঐ নতুনের কেতন ওড়ে…’।
নগরসংস্কৃতিতে পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ কেবল একদিনের উৎসব-আনন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জাতীয় সংস্কৃতিতে এর প্রভাব এখনো অনস্বীকার্য। বিশ্বের সব জাতিই নিজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বর্ষবরণ পালন করে।
আমরা জানি যে, মেসোপটেমিয়ায় অর্থাৎ আজকের ইরাকে, যিশুখ্রিস্টের জন্মের ২ হাজার বছর আগে প্রথম বর্ষবরণ উৎসব উদযাপিত হয়। তখন অবশ্য খিস্টাব্দে শুরু কখনো মার্চ, সেপ্টেম্বর বা ডিসেম্বর থেকে ধরা হতো। খ্রিস্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে থেকে শীতপ্রধান দেশে শীতকে গুরুত্ব দিয়ে জানুয়ারি মাসকে বছরের প্রথম ধরে ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন জুলিয়াস সিজার। সেই থেকে পয়লা জানুয়ারিকে ধরা হয় ইংরেজি নববর্ষের সূচনা। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের নিরিখে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ এই ভারত উপমহাদেশে বৈশাখ মাসকে বছরের শুরু ধরা হয়। এখন যদিও আমরা আর গ্রীষ্মপ্রধান নয়, নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবেই পরিচিত, তবু বৈশাখই রয়ে গেছে আমার নববর্ষের সূচনামাস। তবে এর আগে এই দেশে চালু ছিল তিন ধরনের বর্ষগণনা পদ্ধতি।
১. চান্দ্রসন: চন্দ্রের বর্ষপরিক্রম হিসেবে সাড়ে ২৯ দিনে মাস হিসেবে ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায় চান্দ্রবর্ষ ধরা হতো।
২. সৌরসন: সূর্যের বার্ষিক গতি অনুয়ায়ী ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায় সৌরবর্ষ ধরা হতো।
৩. নক্ষত্র-সন: রাশিচক্রের হিসেবে ২৭টি নক্ষত্র পরিক্রমায় প্রতিটি তিথি হিসেবে নিয়ে ৩৬০ দিনে নক্ষত্র-সন ধরা হতো। এই ভিত্তিতে সন শুরু হতো চৈত্র মাসে।
এই তিনধরনের বর্ষগণনাকে সমন্বয় করে সম্রাট আকবরের সময়ে (১৫৫৬-১৬০৯) চৈত্রের ফসল তোলার পর খাজনা দেওয়ার সময় বৈশাখ মাস ধরে নতুন বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। আকবরের সিংহাসনের সময় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরিকে স্মরণে রেখে ৯৬৩ হিজরি=৯৬৩ বঙ্গাব্দ ধরা হয়। এভাবে বর্ষগণনা শুরু হয়।
সব সংস্কৃতির মূলে রয়েছে কৃষি
আমরা দেখেছি যে, বর্ষগণনার ভিত্তিই ছিল ফসল তোলা বা খাজনা দেওয়া। অর্থাৎ কৃষিসংস্কৃতির প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে নববর্ষের সঙ্গে। আর কৃষিই মানুষের আদি সংস্কৃতি। সংস্কৃতি বলতে এখানে কেবল গান-বজনা, যাত্রা-নাটক নয়। কৃষি নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ধর্মকর্ম, শিক্ষা, বাণিজ্য প্রভৃতি। এর সবই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। আমাদের কথাবলা বা ভাষা, সামাজিক রীতিনিতি, শিষ্টাচার সবকিছু মিলেই সংস্কৃতি। সব সংস্কৃতির মূলে রয়েছে কৃষি। একথা মনে রাখলেই পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে।
চৈত্রের ফসল ঘরে তুলে বৈশাখে খাজনা দিতে সাধারণ কৃষক হাজির হতেন জমিদারবাড়ির আঙিনায়। সেখানে বছরে একবার করে দেখা হতো তাঁদের। কৃষকদের খাজনা বুঝে নিতে ২-৩ দিন লেগে যেত। তাই সমবেত কৃষকদের মনোরঞ্জনের জন্যে আয়োজন করা হতো যাত্রা-কীর্তন-কবিগানের। বসতো হরেক দ্রব্যর পসরা। সকলের হাতে কাঁচা পয়সা থাকত, তাই পছন্দের জিনিস কিনতে পারত। এভাবেই শুরু হয়ে যায় মেলা। এই বৈশাখী মেলা এখন মাসজুড়ে বসে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। খাজনা দেওয়ার উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় গ্রাম্যমেলার সংস্কৃতি। বৈশাখের মেলা কোনো কোনো অঞ্চলে ‘গলুইয়া’ নামেও পরিচিত।
বৈশাখের সঙ্গে হালখাতা তো রয়েছে। হালখাতা মানে পুরনো খাতা বদল করে নতুন খাতা খোলা। খাতা এখানে প্রতীকী অর্থে। খাতা মানে হিসেব। পুরনো পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নতুন হিসাব খোলার অনুষ্ঠান। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের একটা বিরাট তাৎপর্য আছে। চলমান সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। কিন্তু বছর শেষে বিক্রেতার বাড়িতে বা দোকানে গিয়ে পাওনা পরিশোধ করা এবং আপ্যায়িত হওয়ার ঘটনার মধ্যে ‘বাণিজ্য’ তথা ‘অর্থনীতি’ লুকিয়ে থাকলেও এর মধ্যে দিয়ে মানুষের যে মিলন ঘটে, পারস্পরিক সম্পর্কের যে বিকাশ ঘটে, তা মানুষের সামাজিক জীবনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
বর্ষবরণ উৎসবই একমাত্র পর্ব, যেখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই
বছর জুড়েই মেলা বসে। ব্রিটিশ-বাংলার জনস্বাস্থ্য পরিচালক সিএ বেন্টলি তাঁর ‘ফেয়ার অ্যান্ড ফেস্টিভ্যাল ইন বেঙ্গল’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, যে ১৯২১ সালে পুরো বাংলায় সাড়ে সাত হাজার মেলা ছিল। আশির দশকে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা জরিপ করে দেখেছে যে ৪ হাজার ৫ টি মেলা আছে আমাদের দেশে। এর সবই বৈশাখী মেলা নয়। বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের মেলা বসে দেশজুড়ে। এখন তো বিষয়ভিত্তিক মেলার প্রচলন রয়েছে। বইমেলা, হস্তশিল্প মেলা, পুষ্পমেলা, বসতি মেলা, চশমা মেলা এমনকি চাকরি মেলার আয়োজনও হয় বিভিন্ন শহরে। কিন্তু মেলার ধারণা এসেছে বৈশাখ থেকেই।
মেলা যে শুধু উৎসবের-আনন্দের নয়, বাণিজ্যের সঙ্গেও এর গভীর যোগ রয়েছে, একথা যে কোনো সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। মেলা তথা উৎসব হয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষেও। আদিবাসীরা তাঁদের ধর্মীয় প্রতিটি পর্বে মেলা-উৎসবের আয়োজন করেন। খ্রিস্টানরা বড়দিনে মেলার আয়োজন করে। কঠিন চীবর দান কিংবা বৈশাখী পূর্ণিমা উৎসবকে নিয়েও মেলা বসে বৌদ্ধদের। মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ঈদ কিংবা মর্হরম উপলক্ষেও অনেক স্থানে মেলা বসে। হিন্দুদের প্রতিটি পূজাই মেলায় রূপ নেয়। কিন্তু বর্ষবরণ উৎসবই একমাত্র পর্ব, যেখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই। বাঙালি একসঙ্গে সমান গুরুত্বে পালন করতে পারে একমাত্র পয়লা বৈশাখকেই। তাই সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ অনুষ্ঠান হিসেবে এর প্রয়োজন চলমান সমাজে বড় বেশি প্রয়োজন।
পয়লা বৈশাখ মনে করিয়ে দেয় যে, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। আমি জাতিসত্তায় আমি বাঙালি, নাগরিকতার বিচারে আমি বাংলাদেশী— এই প্রশ্নের মীমাংসাও পাওয়া যায় পয়লা বৈশাখেরদদ কাছে। আমরা তাই পয়লা বৈশাখকে আত্ম অনুন্ধানের বড় উৎসব বিবেচনা করতে পারি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন, একাকী। কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ’। একাকী থাকলে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়, দীন মনে হয়। উৎসবে গেলে কোনো ক্ষুদ্রতা থাকে না, দীনতা থাকে না, একাকিত্ব থাকে না। উৎসবে মানুষের সঙ্গে একত্র হতে পেরে, মনুষ্যত্বের উত্তাপ অনুভব করে নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়। উৎসব তাই বাঙালির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে নববর্ষ উৎসবের মতো উৎসব, যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি নেই, আঞ্চলিকতার সীমাবদ্ধতা নেই, ভাষার অনৈক্য নেই। নববর্ষের মতো ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান বাঙালির জীবনের এক বড় অবলম্বন। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় উৎসবও এখন রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় আটকা পড়ে যাচ্ছে। তাই বর্ষবরণ, নবান্ন, বোশেখী মেলা, পৌষ মেলা, বইমেলা প্রভৃতি উৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রতিবছর নতুন করে উজ্জীবিত হতে পারে।