সম্প্রতি কয়েকজন তরুণের কবিতা পাঠের সুযোগ হলো। কবিতাগুলো কয়েকবার পাঠ করেছি, ভেবেছি। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মেলানোর চেষ্টা করেছি। কবিতাগুলো শিল্পের কতটুকু যন্ত্রণা ধারণ করে আছে। কবিতাগুলো সৃষ্টি, নাকি নির্মাণ; ধন্দ্বে পড়ে গেছি। শিল্প সৃষ্টির পেছনে শিল্পীর বেদনা ধারণ ও মনীষা লালনের কথাটি অস্বীকার করা যায় না। এছাড়া, যে মৌল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা কবিতা এত পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, সে অর্থে এই কবিতাগুলো কতটুকু নাড়া দেবে পাঠককে—এসব ভাবনার আলোকে আমার দ্বিধাচিত্ত পাঠ তুলে ধরতেই এ গৌরচন্দ্রিকা।
শুরুতেই বলে রাখা ভালো, কবিতা যদি হয় কবির সঙ্গে পাঠকের শিল্পিত যোগাযোগ, তাহলে কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে আমার পাঠ-উপলব্ধি কোনো অবস্থায়ই পাণ্ডিত্য প্রদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তালিকার শুরুতেই রয়েছেন ‘রাসেল রায়হান’। তার কবিতার শিরোনাম হলো—‘প্রতিবিম্ব’, ‘সিংহ’, ‘রেস’, ‘নিরাময়’ ও ‘গাথা’। রাসেল রায়হানের কবিতা প্রকৃতির উচ্ছ্বাসে, প্রকৃতিলগ্ন শব্দের মহিমায় উজ্জ্বল। কবিতার চিত্রকল্প এসেছে জটিল মনস্তাত্ত্বিক বোধ থেকে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিন্তা-নিয়ন্ত্রিত। নিসর্গকে উপলক্ষ করেই তার কবিতার বোধ বিস্তৃত। তীব্র মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও দ্বন্দ্বের আভাস রয়েছে, তার প্রয়োগকৃত শব্দসমবায়ে। আছে পাপ-পুণ্যের হিসাব-নিকাশের প্ররোচনা, রয়েছে সমকালীন যন্ত্রণার সূক্ষ্ম নির্ঘণ্ট। তবে উপমার আধিক্য কবিতার রসাস্বাদনে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটায়। তার ‘প্রতিবিম্ব’ কবিতায় ‘রুগ্ণ পাখির সম্মোহনী সঙ্গীত’, ‘শ্বাসক্লান্ত মাছের স্থৈর্য্য’, ‘সুবেহতারা নাম্নী নারী পরিত্যক্ত পানি ভেঙে আসে,’—এমন অসংখ্য পঙ্ক্তির বেড়া ভেঙে পাঠোদ্ধারে বেগ পাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। ‘শ্বাসক্লান্ত মাছের স্থৈর্য্য’ শব্দবন্ধে ‘স্থৈর্য্য’-এর মতো জটিল ও অপ্রচল শব্দ পরিহার করা গেলে আরও সুখপাঠ্য হতো। ‘প্রতিবিম্ব’ কবিতাটি তুলে ধরছি।
এত অন্তরঙ্গতা, এত হ্রদ তেপান্তর চষে
গন্তব্যে এসে দেখি ভুলে গেছি পুরনো ঠিকানা।
ডানাওলা কোনো এক বৃষের প্রশস্ত কাঁধে বসে
মৃত্যুর কাউবয় বাধ্য করবে মেলে দিতে ডানা-
মৃত্যু প্রেম ঈর্ষার, জিঘাংসার এবং বৃষের;-তখন কিছুটা মনে পড়ে যাবে। প্রাচীন লিপির
সূত্র ধরে ফিরে যাব কীটদষ্ট গমের শীষের
অভ্যন্তরে, যার কাছে জড়ো হচ্ছে পুণ্য-পৃথিবীর।বাইরে থেকে ভেসে আসে রুগ্ন পাখির সম্মোহনী
সঙ্গীত, শ্বাসক্লান্ত মাছের স্থৈর্য্য, সুবেহতারা
নাম্নী নারী পরিত্যক্ত পানি ভেঙে আসে, কোনো খনি
যেন তার অভ্যন্তর থেকে দিচ্ছে ক্রমাগত সাড়া।
প্রতিসাড়া দিয়ে বের হই, ভাবি, সুবেহতারাদের
পায়ের নিকটে এই প্রতিবিম্ব কোন ঈশ্বরের?’
[প্রতিবিম্ব : রাসেল রায়হান]
রাসেল রায়হানের কবিতার ইতিবাচক দিক হচ্ছে, আবেগকে প্রশ্রয় না দেওয়া। আবেগের অবদমন প্রক্রিয়া কবিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। তবে, ‘মৃত্যুর কাউবয়’ কী অর্থে ব্যবহৃত, তা বোঝা যায়নি।
এরপর রয়েছেন পলিয়ার ওয়াহিদ। তার কবিতার শিরোনাম, ‘ভেড়াদল’, ‘কামুক শামুক’, ‘কাজুবাদাম’, ‘চাঁদ প্রেমিক’ ও ‘বরইফুল’। তিনি হয়তো অভিজ্ঞতার শিল্পবয়ান করেছেন ভিন্নভাবে, কবিতার শিরোনাম থেকে এটা মনে হতে পারে। অনস্বীকার্য যে, কবিতায় কবির আত্মপ্রকাশ ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতার সঙ্গে নিবিড়। কবিতাগুলো যার সাক্ষ্য বহন করে। পলিয়ার ওয়াহিদের কবিতায় এক ধরনের চমক রয়েছে। যা ভাবনার খোরাক জোগায়। তার কবিতা বহুরৈখিক, গভীর। তবে, তার কবিতার বিশেষ দিক হলো যৌনতার আবহ তৈরি। তার ‘কামুক শামুক’ কবিতাটির পাঠ নেওয়া যেতে পারে—
যেকোনো নতুন প্রেমিকার কাছে
পাছে-দোঁ আশলা গন্ধ
ছন্দ নয়-যেন পাকা পেঁপের মতোন ফালি ফালি
খালি প্রাক্তন আহার!তুমি পৌঁছোবার আগে অন্য কেউ
ফেউ-ক্ষত শুকানোর আগে
দাগে দাগে পূর্বাভাস মিলে যাবে
দেখবে বয়স কমবার সাথে সাথে
রাতে রাতে শারীরিক অঙ্গগুলো
কুলোউড়া ধুলোর মতো শাসাবে বাদ্য
অবাধ্য শরীর
কামনার বনে তারা ঢেলে দেবে
নেবে কামুক শামুক
শিল্পতৃষ্ণা জীবনতৃষ্ণার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিবেচিত হলে কবিতার রসাস্বাদন সহজ হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে কবিতায় যৌনতার আবহ থাকাকে আমি নেতিবাচক অর্থে দেখি না। এছাড়া তার অন্যান্য কবিতায় কতিপয় ‘নাম’ উঠে এসেছে, যা প্রতীকের মোড়কে নিয়ে এলে কবিতাগুলো আরো রহস্যময় হতে পারতো। এটা মনে রেখে যে, প্রকৃতপ্রস্তাবে সে কবিতাই উপভোগ্য, যা পরিপূর্ণ রহস্য ধারণে সমর্থ।
অপ্রচল বা কবিতায় সাধারণত ব্যবহৃত হয় না, এমন শব্দের বুননে অরবিন্দ চক্রবর্তীর কবিতা এক ধরনের ঘোর সৃষ্টি করে। তার কবিতায় ওই শব্দ যেন হেসে ওঠে। সহজ কোনো বিষয়ও তার হাতে রসময় হয়ে ওঠে কখনো-কখনো। তার কবিতা পাঠকের চিন্তার বিভিন্ন স্তরে ধাক্কা দিতে দিতে চলে। গল্পের মতোই নান্দনিক উপস্থাপনা। ‘লিপস্টিক’ থেকে পাঠ নেওয়া যেতে পারে—
পদকর্তা হাসি চিবান, সভানেতা চুলকিয়ে চুলকিয়ে
মেঘ করেন।
অন্দরমহলে রোদ উঠলে খাঁচার মুনিয়া
খুব একা ঠোঁটে রুমাল চেপে রসময় খুলে দেন।একাদশীর শেষ দিন পিরিয়ড চলছিল বিবির
রাজার কুমার সে কথা খিড়কির দরজা খুলে জানলে
পাড়াতো প্রতিবেশির হাত ধরে
আয়না দেখাতে গেল দম্পতি
ফেরার পথে নদী ফুঁসলে উঠেছিল
পারাপারে সেতুযোগ ছিল না।রিকশায় ভেসে মেয়েটি এলো হোস্টেলে
বান্ধবীদের একজন নেত্রী সেজে বলেই ফেলল,
‘এত লিপস্টিক যায় কই?’
জব্বার আল নাঈম কবিতাকে দেখেন অত্যন্ত অন্তর্ভেদী চোখে। উপস্থাপনশৈলীতেও নতুনত্ব রয়েছে। তার কবিতার বোধ শুধু স্বদেশ ও সমকালকে উপজীব্য করে নয়, বরং আন্তর্জাতিক ও কসমিক বিশ্ব থেকে আহরিত। তীব্রব্যঙ্গও প্রকাশিত হয় তার কবিতার পঙ্ক্তিতে। কথার জাদুতে তিনি অনেক কিছুই তুলে আনতে সক্ষম। আর এটাই তার মোক্ষম অস্ত্র, যা দিয়ে তিনি প্রতিবাদের ঘোর সৃষ্টি করেন। ‘টেবিলে নীতিনির্ধারকের পক্ষপাত’ আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি দৃষ্টান্ত হবে পারে—
হে রঙ্গহীন অন্ধ পৃথিবী, কর্নিয়া খুলে তোমাকে দেখাব বর্ণিল শুকতারার মিছিল।
জল আর যৌবনের ক্যাফেটেরিয়ায় আলোর নিমন্ত্রণ;
এসো সন্ধ্যার সভায় আলিঙ্গনে শোকাহত হই নরম বিছানায়
উরুরভাঁজে মাথা রেখে চুমুতে উর্বর হোক বিশ্বদেশ।
গিরীশ গৈরিকের ‘মা সিরিজ’-এর কবিতা রয়েছে পাঠের তালিকায়। তার কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সাদামাটা বর্ণনা। তার কবিতার কৌতূহলী পাঠকই জানেন, শেষ পর্যন্ত না পাঠ করলে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। তার বর্ণনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনয় মজুমদারের কবিতা-শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি যেন গল্পের ভঙ্গিমায় কবিতা বুনে চলেন। তার কবিতা পড়তে পড়তে লস্টালজিক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এ যেন স্মৃতি রোমন্থন। আবার পুনঃপাঠে অসংখ্য ভাবনার দরোজা খুলে দেওয়ার প্রবল এক ক্ষমতা লক্ষ করা যায় তার কবিতায়। তিনি কাদামাটির গভীর থেকে তুলে আনেন কবিতার রসদ।
ছেলেবেলায় প্রেসার-কুকারের বাঁশি শুনে ক্ষুধা পেতো
হাত ধুয়েই বসে যেতাম কাঠের পিঁড়িতে।মা স্টিলের থালা ভরে নিয়ে আসতো মাংসভাত
খাওয়া শেষ না হতেই পেটের ভেতর শুরু হতো বজ্রপাত
হাত না ধুয়েই এক দৌড়ে মন্দিরে বসে-ত্যাগের প্রার্থনায় রত হতাম
মন্দির থেকে ফিরে এলে মা আমায় জল দিয়ে পবিত্র করতেন।অথচ! আজ সেই প্রেসার-কুকার আমার মস্তিষ্কের ভেতর রান্না করে
বাঁশি বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
হায় প্রেসার-কুকার তুমি আমার মস্তিষ্ক হয়ে গেলে।
[মা সিরিজ: ২৪]
শঙ্খচূড় ইমামের কবিতায় সম্মোহন আছে, আছে জীবনের গভীর অন্বেষণের এক দুর্লঙ্ঘ্য তাড়না। তার কবিতা পরিণত বোধের শিল্পযুক্তি বলে প্রতীয়মান হয়। তার বোধের মূল প্রেরণা থাকে দৃশ্যের আড়ালে। আড়ালটা কখনো এতটাই গভীরতা-নির্দেশক যে, উপলব্ধি করা যায় কিন্তু প্রকাশ করা যায় না। তার উপমা প্রয়োগের ক্ষমতাও স্বতন্ত্র।
পৃথিবীর পাঠশালায় জননী পাঠ করে ফিনকি দিয়ে ওঠা ভাতের বুদ্বুদ; আর পাখিরা পাঠ করে পালক থেকে খসে যাওয়া একেকটা অক্ষরের ব্যাকরণ। তাদের চোখ ও ঠোঁটের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ-বাতাস বোবা হয়ে যায়-
আহা! বেচারা পাখি
ওই যে দেখছো ট্যাকে বসা লোকটা; উনি আমার বাপ! অই ব্যাটা পাঠ করে জীবনের মন্ত্র- পোলাডার লাল কোর্তা, মাইয়্যাডার স্নো, কাইল কিস্তি!
পৃথিবীতে কেউ কেউ শুধু পাঠই করে, নুনের স্বাদ পায় না। তাই পাঠ চুকাতে গিয়ে হোঁচট খায় পিচ্ছিল পথে। ভেঙে যায় সংসারের ঘাড়, কেটে যায় দম্ভের ঠোঁট, পাণ্ডুর হয় বেহিসেবি হাঁড়ি। তবু ন্যাড়া কুকুরের মতন লাল জিহ্বা বের করে কিংবা ল্যাংড়া পায়ে দৌড়াতে চায় অন্তহীন বৃত্তে। পাঠ চলে নিজস্ব নিয়মে…
[পাঠ]
শরাফত হোসেনের কবিতায় শব্দের আড়ম্বর নেই, নেই জটিল প্রতীকের কলা। তার সরল স্বীকারোক্তির মধ্যে ঘুরপাক খায় নিটোল হাহাকার। ‘ছায়াসুনিবিড় আশ্রয়’-এ বোনা, প্রকৃতির চিত্রকল্পে মোড়া তার কবিতাগুলো পাঠে স্নিগ্ধ এক আবেশ ছুঁয়ে যায়; বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। তার ‘ফলন’ কবিতাটির পাঠ নেওয়া যাক—
স্মৃতিরা ছবি হয়ে ভাসে; ছবি কেবলই স্মৃতি।
পাতাদের মজ্জাগত দোষ, কথা বলে বাতাসে
এই গরমে নাড়িস না কেউ জল
ভাতের হাড়ি ভাঙিস না কেউ।উঠোন ভরতি মানুষ ছিল–হারিয়ে গেছে
সোনালি দিন মিলিয়ে গেল জলের দেশে
নাড়িস না কেউ জল।মাটির চুলা একই আছে; ধুপধোয়া মন
ধানের ডগায় বসছে শিশির; শর্ষে ফুলে মৌ।
জাহিদুর রহিমের কবিতার উপস্থাপনা সরল, স্বাভাবিক। প্রকৃতির কাছে সমর্পিত হলেও তিনি বোধের খেলায় বেশ পারদর্শী। তার কবিতার বক্তব্য গভীরতা নির্দেশক। ‘প্রতিটি গমনে অগম্যও কিছু থাকে’—জাতীয় পঙ্ক্তি কবির অভিজ্ঞতারই সাক্ষ্যবহ। প্রতিটি কবিতার সূচনাবিন্দুর সঙ্গে শেষবিন্দুর যোগসূত্র রয়েছে। এতে পাঠক তার বক্তব্যের সূত্র ধরে কবিতায় পরিভ্রমণ করতে পারছেন। বর্তমান সময়ের অনেকের কবিতা ধীরে ধীরে মূল বক্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে, কবিতা হয়ে পড়ে অর্থহীন—জাহিদুর রহিমের ক্ষেত্রে অন্তত তা লক্ষ করা যায় না।
প্রতিটি গমনে অগম্যও কিছু থাকে;
আকাশে নরম একখানা ডালে
মেঘ দেখতে দেখতে জড়িয়ে যায় পা
লতাপাতার প্রেমে- অলস দিনের পথিকের মতো,
যেন প্রেমিকার গালে না ছোঁয়া এক গোপন তিল।দূরত্বে গমন সমুদ্রের অনায়াস ছবি
ঘোলাটে আলোয় অগম্য কিছু থাকে পাশে,
যেন হোটেলের ব্যালকনিতে কাটিয়ে দেওয়া পুরো ছুটির দিন।সব গমনে অগম্যও কিছু থাকে,
থাকে প্রাপ্তি পরিতৃপ্তিহীন গ্রহণ
[হারানো বোতামের ক্ষীণ হাসি]
‘সহজ রাস্তাটা আরো দু-চার পাতা সহজ হতে পারতো’— এমন কথার ঘোর সৃষ্টি করে সানাউল্লাহ সাগর কবিতাকে পাঠকের মর্মমূলে গেঁথে দিতে চান। কিন্তু টানাগদ্যে রচিত কবিতায় তিনি এতো অর্থবহ শব্দের সমাহার ঘটান যে, কবিতার রসাস্বাদনে অনেক সময়ই তা বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কবিতায় একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য হয়তো থাকে, কিন্তু পাঠ শেষে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। তবে তার বলার ভঙ্গি স্বতন্ত্র। ‘কালোছায়া ও নিঃসঙ্গ নিমফুল’ কবিতাটি তুলে ধরা যেতে পারে—
সহজ রাস্তাটা আরো দু-চার পাতা সহজ হতে পারতো। কিছু কঠিন বানানে ভুলে যেতে পারতো কালো মানে ভয়!
কোথাও যদি একটু ছিঃ ছিঃ করার স্বাধীনতা থাকতো, তাহলে নিজেকে নিলামে তুলে নিজস্ব কঙ্কাল থেকে হাড়গোড় বিক্রি করে দিতাম। চলে যেতাম নিয়মের মধ্যমা ছেড়ে নিমফুলের ইশকুলে! কালোছায়ার সদর দরজায় অনশন চলছে; শহরের গভীরে প্রেমিকের লাল নাটক! তোমাদের কবর থেকে আমাকে কিছু ওয়াজ ইমেল করো—পবিত্রতার দোহাই ভুলে সাঁতার দেখে বাকি পথের ধুলো কুড়াবো। রঙের আলনায় গুছানো হাসি আর ভাল্লাগে না! বাকি আলোটুকু বিদায়ের রথে; নিয়মের পকেটে রিকশার সংলাপ। রাতের হাজতবাস শেষে মিথ্যে মুদ্রণে ছাপা হচ্ছে যেসব সুখ নিমফুলেরা তার কিইবা জানে! সে কেবল আষাঢ় ভেবে পুরানো নৌকায় ফিরিয়ে নেয় দগ্ধ প্রেমের ভাইরাস, নিঃসঙ্গ ছায়ার রোজগার।
নকিব মুকশি কবিতায় কী বলতে চান তা আমার বোধগম্য হয়নি। এটা আমার অনভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার কবিতায় শব্দ প্রক্ষেপণে চমক রয়েছে, রয়েছে শব্দের ঝঙ্কার। তার ‘পরিডিম’ কবিতায়—‘প্রেতলালায় অস্ত আঁকে জীনচুমু, পরিডিম খায় বেটে/যত প্রান্তিকজন, আর যুবতিহাড়ে পুরুষ নাচায়/ মুখোশের বিষথুতু/বেডশিটে রক্তচন্দন, বাতিজ্বলা নগরে বাড়ালের পলায়ন/মাজার জ্বলে লালসালুকীটে, ঈশ্বরমুখে থুতায় এক/ডানাভাঙা কইতর, নিজের গুপ্তখনি নিজেরই শত্রু/সিজারে চাঁদ নয়, পাপা ফোটে বলে গ্রাম্যজন!…’—এ জাতীয় পঙ্ক্তিগুলোর খণ্ডাংশ হয়তো বুঝতে পারি কিন্তু সর্বাত্মক পাঠোদ্ধারে ব্যর্থ হতে হয়। কবিতার আরো রসসিক্ত উপস্থাপন প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি।
এ প্রসঙ্গে কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক তার ‘কবির তপস্যা ও কবিতার সৃজনক্রিয়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আবেগের সংহতি, যুক্তিবোধ ও যুক্তির শৃঙ্খলা যখন প্রজ্ঞাশাসিত পথে অনুগমন করে, তখনই কবিতা সম্পন্ন হয়ে ওঠে। কেবল আবেগের তারল্য, চিন্তার বুদ্বুদ কবিতায় পরিণত হতে পারে না।’ এ বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যেতে পারে—চিন্তার পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শনের অন্বয় অর্থাৎ বহুমাত্রিক চেতনার সমন্বিত-অভিব্যঞ্জিত রূপই কবিতা। আলোচিত কবিতায় চমক থাকলেও শব্দের সুষম প্রয়োগেও রয়েছে বিচ্যুতি। রয়েছে ছন্দ শাসনের অদক্ষতা। যদিও নবীনের এসব বিচ্যুতি মার্জনীয়। কেননা, তারা শুরু করেছেন। তবে তাদের সবল উপস্থিতি আশান্বিত করে। আবার কবিতার বিচার যেহেতু অসম্ভব, সেহেতু কোনো মন্তব্যই চূড়ান্ত নয়। কবি গ্রহণ-বর্জন ও বিবর্তনের পথে হাঁটবেন; এটাই স্বাভাবিক। এর জন্য সাধনার বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। আলোচিত কবিতায় নন্দন ধারণা, উপমা, শৈলী, শব্দবোধ, উৎপ্রেক্ষা, ধ্বনি চেতনার প্রয়োগ কতটুকু সফল ও স্বতন্ত্র, তা কালের বিচারে রাখা যুক্তিযুক্ত। আবার এ কথা বলা যেতে পারে, সামগ্রিক বিচারে কবিতাগুলোতে যেমন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, যাপিত জীবন, উপহাস, জীবনের সঙ্গতি-অসঙ্গতি, নাগরিক জীবনের হাহাকার যেমন উপস্থিতি, তেমনি আত্মকথনও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাকচাতুর্যের আশ্রয়ে পাঠককে মোহগ্রস্ত করার প্রয়াসও লক্ষণীয়। ফলে এসব কবির শিল্পসিদ্ধিতে বিজয় কেতন যদি সত্যিই ওড়ে, তা হতে পারে বাংলা কবিতায় নতুনতর সংযোজন। আশা করতে তো দোষ দেখি না!