কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বিশাল এক ট্রাজেডি-চরিত্র। বিশ্বসাহিত্যে যেসব ট্রাজেডি আছে, নজরুল-জীবন সেসব ট্রাজেডি থেকেও কম বিস্ময়কর নয়। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের জন্য এ এক বিশাল দুঃখ। নজরুলের জীবনের পথ কখনোই সহজ ও মসৃণ ছিল না। গ্রিক ট্রাজেডির মতো জন্ম থেকেই যেন তা নির্ধারিত ছিল। বিশাল প্রতিভার অধিকারী হয়েও তার পুরো বিকাশ ঘটাতে পারেননি। নজরুল নিজেও তা উপলব্ধি করেছিলেন। যে কারণে তাঁর যে বিরাট প্রতিভা ছিল, বিরাট সম্ভাবনা ছিল- দারিদ্রের রাহুগ্রাস, অসুস্থতা এবং অমসৃণ জীবনপ্রবাহের কারণে তা সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারেনি। নজরুলের মেধার যদি পুর্ণ বিকাশ ঘটতে পারত বাংলা সাহিত্যের সম্মান ও মর্যাদা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। রবীন্দ্রনাথ ও মধুসূদন ছাড়া আর কারো সঙ্গেই নজরুল প্রতিভার তুলনা চলে না। এই তিন প্রধান কবি নিজেদের প্রায় একক চেষ্টায় বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ব্যতিত অন্য দুজনেরই সাহিত্যজীবন ছিল স্বল্পায়ু।
কাজী নজরুল ইসলামের জন্মই দরিদ্র পরিবারে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় তাঁর জন্ম হয়েছিল ঝড়ো রাতে। যে ঝড় সারাজীবনই যেন তাকে তাড়িত করেছে। মাত্র ৯ বছর বয়সে অর্থাৎ বাল্যকালেই তাঁর বাবার মৃত্যু স্বাভাবিক জীবনকে কঠিনের পথে ধাবিত করে দেয়। দারিদ্রের নির্মম কাষাঘাত, অভিভাবকহীনতা, ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন নজরুল যেন ভয়ঙ্কর এক ঝড়ে দিকহারা পাখি হয়ে পড়ে; চতুর্দিকে নেমে আসে অনিশ্চিত অন্ধকার। ভয়ঙ্কর এই অন্ধকার ঠেলেই আলোর ফোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এ জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে ক্ষুধার সঙ্গে, দারিদ্রের সঙ্গে, ব্রিটিশদের সঙ্গে, এমনকি ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনার সঙ্গে। যার শুরু যেন জন্ম থেকেই।
নজরুল লেটো দলে গান করেছেন, গান লিখেছেন। গ্রাম ত্যাগ করেছেন। ট্রেনের মদ্যপ গার্ডের বাড়িতে থেকেছেন। রুটির দোকানে কাজ করেছেন। এ সবের ভেতর দিয়েই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, এক স্কুল থেকে আর এক স্কুলে— এইভাবে বোহেমিয়ান জীবনের সাম্পানে ভেসেছিলেন। এ কারণে একাডেমিক উচ্চশিক্ষা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই হয়নি। মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন, প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এর মূলে দারিদ্র যতখানি, তার চেয়ে বেশি কোথাও বাধাধরা নিয়ম পছন্দ করেননি তিনি। ফলে জীবনের বারবার পথের পরিবর্তন ঘটেছে। এ ভাবেই যখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারের ভেতর দিয়ে নজরুল জীবন এগুচ্ছিল, তখনি মানসিকভাবে সবচেয়ে বড় আঘাতটি পান তিনি। ‘পিতৃব্য বজলে করিমের সঙ্গে নজরুল-জননীয়া দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্ক স্থাপন’ তার জীবনে বিরাট এক ক্ষত তৈরি করে, যে ক্ষত কোনদিনই আর দূর হয়নি। মায়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ-স্বাভাবিক সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে। এখানে এ কথা উল্লেখযোগ্য, অধিকাংশ গবেষক মায়ের উপর নজরুলের দুর্জয় অভিমানের কারণ অজ্ঞাত বলেই উল্লেখ করেছেন। নজরুলের হৃদয়ে বিরাট এক শূন্যতা ছিল। তা নজরুলের কথাতেই ধরা পড়ে— ‘ছেলেবেলা থেকে পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে, যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কানায় কানায় তা কখন কোথাও পাইনি।’ এক ঝড়োজীবনের অধিকারী হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, গীতালেখ্য-ও-গীতানাট্য রচয়িতা, সুরকার, স্বরলিপিকার, গায়ক, বাদক, সংগীতগজ্ঞ, সংগীত-পরিচালক, সাংবাদিক, সম্পাদক, পত্রিকা পরিচালক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র-কাহিনীকার, চলচ্চিত্র-পরিচালক। অথচ বিস্ময়ের বিষয় এতসব সৃষ্টি মাত্র তেইশ বছরে (১৯১৯-৪২)।
নজরুলের জীবন নানাভাবে প্রতিকূলতার শিকার হয়েছে। ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে সেনাজীবন বেছে নিয়েছিলেন। সৈনিক জীবন শেষে দেশে ফিরে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য শুরু করেন অগ্নিবারুদের মতো গান কবিতা লেখা। সাধারণ মানুষের মধ্যে চেতনার অগ্নিশিখা জ্বালাতে থাকেন তিনি। ব্রিটিশ শাসক তা সহ্য করতে পারেনি। ফলে নজরুলকে কারাবরণ মেনে নিতে হয়। ব্রিটিশ শাসক তাঁকে কারাগারে রেখে তাঁর লেখনির শক্তি থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। নজরুলের কলম আরো বেশি অগ্নিময় হয়ে ওঠে। ফলে রাজরোষ নজরুলের জীবনে এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করে। জেল-জুলুম-অত্যাচার তার জন্য অবধারিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তিনি কখনো আপসের পথে হাঁটেননি। জীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তিনি ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’কে অতিক্রম করেছেন।
কঠিন পাহাড় অন্ধকারের জীবনে এ ছিল মধুসূদন ও নজরুলের সবচেয়ে বড় আলো। কিন্তু অভাবের যে অন্ধকার, সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি ঘটেনি এই দুই মহান কবির।
প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক-কষ্ট, অসুস্থতা- সব দিক থেকেই তার জীবন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে। নার্গিসের সঙ্গে তাঁর যে বিবাহ হয়েছিল, সেখানেও রচিত হয়েছে ট্রাজেডি। বাসর রাতেই স্ত্রীকে ছেড়ে চিরকালের মতো তিনি চলে এসেছেন, আর কোনোদিন সেখানে ফেরেননি। কিন্তু তার অন্তরে যে আঘাত যে যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করলো, তার থেকে মুক্তিও তিনি কোনদিন পাননি। এ ছিল তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আপোসহীনতা। নার্গিসের মামা আলী আকবর খানের প্রস্তাব ছিল তাকে ঘরজামাই হিসেবে থাকতে হবে। নজরুলের ব্যক্তিত্বের জন্য এ ছিল চরম আঘাত ও অবমাননা। যে বেদনা তিনি কোনদিন ভুলতে পারেননি। তিনি নার্গিসের পত্রের জবাবে বলেছিলেন, ‘মনে হয় কালকার কথা । মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারবেন না। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারা দিনরাত চোখে ঘুম ছিল না।’
কুমিল্লা ছেড়ে চলে এলেও কুমিল্লা কবিকে ছাড়েনি। কুমিল্লা তাঁকে আবার টেনে নিয়েছে। নার্গিসের জন্য যে কুমিল্লা রাতের অন্ধকারে ছেড়ে চলে এসেছিলেন, সেই কুমিল্লা আবার তাঁকে টেনে নিল প্রমীলাকে তাঁর করে দিয়ে। কিন্তু প্রমীলাকে পেতেও তাঁকে অনেক প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে হয়েছে। বিশেষ করে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের বিয়ে কেউ গ্রহণ করতে চায়নি। আরো সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো নজরুল কোনো মূল্যেই নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে চাননি, করেনওনি। আবার তিনি এও চেয়েছেন, প্রমীলাও যেন তাঁর ধর্ম ত্যাগ না করেন। যদিও মুসলমানি রীতি অনুযায়ী তাঁদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান কেউই এ বিয়ে সহ্য করেননি। প্রমীলা কবির জীবনে সারাজীবন থাকলেও, অভাব-অনটন থেকে মুক্তজীবন তিনি পাননি। প্রমীলা ১৯৩৯ সালে চিরতরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান। ১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা মৃত্যুবরণ করেন। তখন নজরুলও চিরতরের অসুস্থ। এরপর ১৪ বছর নজরুল প্রমীলাহীন হয়ে বেঁচেছিলেন।
ফজিলাতুন্নেসাকে নজরুল ভালোবেসে ব্যর্থ হন। ফজিলাতুন্নেসা সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের মেধাবী ছাত্রী। মুসলমান বাঙালি মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রথম এমএ পাশ করেন। নজরুলের অপ্রতিরোধ্য মোহ ও আবেগ ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল শিক্ষিতা এই নারীর জন্যে। কিন্তু সেখানে তিনি নিদারুণ বেদনা ছাড়া আর কিছুই পাননি। প্রতিভা বসুর সঙ্গেও তার একটা নীরব সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ের আগে তার নাম প্রতিভা সোম। তিনি অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন। ভালো নজরুল গীতি গাইতেন। মূলত তিনিই এ বাংলায় নজরুলের গান গেয়ে তাঁকে পরিচিত করে তুলেছিলেন। নজরুল ঢাকায় এসে প্রতিভা বসুর বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রতিভা বসুর বাড়ির আশেপাশের হিন্দু তরুণেরা এ ব্যাপারটিকে সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। সেকারণে ঢাকার ওয়ারিতে স্থানীয় হিন্দু ছেলেদের কাছে নজরুল শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছিল নানা রঙে, নিজেও প্রেমে পড়েছিলেন, কিন্তু তৃপ্ততার সুশীতল সুধা তিনি কোথাও পাননি। অতৃপ্ততার অগ্নিতে তিনি বলেছেন, ‘আচ্ছা, আমার রক্তে রক্তে শেলী কীটসকে এত করে অনুভব করছি কেন? বলতে পার? কীটসের প্রিয়া ফ্যানিকে লেখা তাঁর কবিতা পড়ে মনে হচ্ছে এ কবিতা আমিই লিখে গেছি’।২২ নজরুলের কবিতা-গান-গল্প-উপন্যাসে এ বেদনা পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। প্রেমে ব্যর্থ নজরুল অন্তরে-হৃদয়ে ভয়াবহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতেন, নারীদের প্রতি তাঁর যে নীরব অভিমান ও ক্ষোভ ছিল, সে কথা ‘পূজারিণী’ কবিতাতেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্ব্বজন-প্রীতি!
ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্পণ,
পূজা হেরি ইহাদের ভীরু বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি?
নারী নাহি হ’তে চায় শুধু একা কারো,
এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো
ইহাদের অতিলোভী মন,
একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়,
যাচে বহু জন!…
যে-পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে!
কোনো বাঙালি কবি নারীকে নিয়ে এভাবে ক্ষোভের আগুন কবিতায় ছড়িয়ে দেননি, যা নজরুল করতে পেরেছিলেন। তাই বলে নারীদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা যে কম ছিল তাও নয়। বিশেষ কোন নারীকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো তাঁর এই ক্ষোভের অগ্নিপ্রকাশ।
ঝড়ের রাতে যার জন্ম, ঝড়ের মতো যার জীবন, বাংলা সাহিত্যে তার বার্তা ঝড়ের মতোই ছিল। ভারতে যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উন্মাদনা চলছে। ১৯২০ সালে করাচি থেকে ফিরেই নজরুল ইসলাম সম্ভাব্য সাব-রেজিস্ট্রার-এর চাকরি না-নিয়ে পুরোপুরি সাহিত্যে আত্মনিয়োগ করলেন। লিখতে থাকলেন অবিরল ধারায়। এর দু বছরের মধ্যেই লিখলেন আবহমান বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যা ছিল বাংলা সাহিত্যে রীতিমতো এক ঝড়ের আগমন- যা একেবারে অচেনা কিন্তু খুব প্রয়োজন—ভারতবাসীর জন্য এক নতুন বাণী।
এর পরেও যেটি সত্য সমকালে নজরুল একশ্রেণির মানুষের কাছে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার ছিলেন। অনেকেই তাঁকে কবি হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। তা যে মূলত ঈর্ষা সে বিষযে কোনো সন্দেহ থাকে না। অবশ্য এটি মধুসূদনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। তাঁর কবিতাকে অনেকে কবিতা হিসেবেই গ্রহণ করতে চাননি। অনেক বিরূপ সমালোচনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথও এর থেকে মুক্ত ছিলেন না। তাঁর কবিতাকে ভাব আর কল্পনার বলে অনেকে গ্রাহ্যে নিতে চাননি। যে কোন বড় প্রতিভাকেই সমকালে সহজেই ধারণ করা কঠিন। গ্রহণ করার জন্য যে পরিমাণ মেধা ও শক্তি লাগে, গতানুগতিকতায় বন্দিদের তা কমই থাকে। ফলে গতানুগতিকতা ভেঙে নতুনের গান যাঁরা গেয়েছেন, তাঁদের বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজয়মাল্য উঠেছে তাঁদের গলাতেই। নজরুলের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ তা স্পষ্ট অনুভব করেছিলেন এই প্রতিভাকে অনেকেই না বুঝে না জেনে, তাঁর কবিতার রূপ রস অনুধাবন না করে তাঁকে অবজ্ঞা ও অবহেলার তীর নিক্ষেপ করেছে। সেকারণে তিনি তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করে একটি জবাবই দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য স্মরণযোগ্য: ‘নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে তোমাদের মনে কিছু সন্দেহ রয়েছে। নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করেছি এবং উৎসগপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছ। আর পড়ে থাকলেও রুপ ও রসের সন্ধান করোনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র।..জনপ্রিয়তা কাব্য বিচারের স্থায়ী নিরীখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’
নজরুলের প্রতিকূলতার শেষ ছিল না। সাহিত্য তাঁর শখের বিষয় ছিল না। তিনি যে হাতে প্রেমের কবিতা লিখেছেন, সে-হাতেই লিখেছেন অগ্নি-বারুদের মতো বিদ্রোহের কবিতা। যে কবিতা ব্রিটিশরা সহ্য করতে না পেরে, যে কবিতায় তাদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল, সারা ভারতবাসীকে ভারতমুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিল, এর পরিণামে তাঁকে কারাগারের জীবন বেছে নিতে হয়েছিল। বাঙালি আর কোনো কবি নেই যিনি দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তিনি জেলে বসেও আন্দোলন করেছেন, অগ্নিঝরানো কবিতা লিখে বিপ্লবী মন্ত্রে গণজাগরণ তৈরি করেছেন। ভারতমুক্তির জন্য যে বীর সন্তানেরা জীবন দিয়ে রক্তআখরে মুক্তির সোপান রচনা গেছেন, তাঁদের বন্দনা করে তিনি কবিতা লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন। এমন কি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। পত্রিকা বের করে সেখানে আন্দোলনের বাণী— বিপ্লবের বাণী—অধিকারের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরাধীন ভারত স্বাধীন হবার পরেও নজরুলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অভাব-অনটন দারিদ্র তাকে অক্টোপাসের মতোই বন্দি করে রেখেছিল। যে মানুষ সারাজীবন মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন, সেই তিনি নিজের কল্যাণের কথা কোনোদিন ভাবেননি। তবে এ কথা বলা অনস্বীকার্য মনে করি, মধুসূদনের পাশে যেমন ছিলেন বিদ্যাসাগর, নজরুলের ছিলেন মোজাফ্ফর আহমেদ। বিদ্যাসাগর মধুসূদনকে যেভাবে স্নেহ-মমতা-অর্থ-সাহায্যে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন বিপদের সময়, মোজাফ্ফর আহমেদও ছিলেন নজরুলের জীবনে বড় রকমের মানসিক শক্তি, বড় রকমের আশ্রয়। কঠিন পাহাড় অন্ধকারের জীবনে এ ছিল মধুসূদন ও নজরুলের সবচেয়ে বড় আলো। কিন্তু অভাবের যে অন্ধকার, সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি ঘটেনি এই দুই মহান কবির।
নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়ার শরপুকুরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত প্রমীলার কবরের পাশে নজরুলের কবরের জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিল। নজরুলের আর ফেরা হয়নি প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। আর প্রমীলা জীবনে যে নজরুলকে পেয়েও পাননি, মরণেও পাওয়া হলো না তাঁকে।
নজরুল ইসলাম হুগলি ছেড়ে অন্য কোনখানে চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আর্থিক অভাব-অনটনের কারণেই। হেমন্তকুমার সরকার তাঁকে কৃষ্ণনগরে যাবার কথা বললে তিনি রাজি হয়ে যান। ১৯২৬ সালের ৩ জুন নজরুল হুগলি-পর্ব শেষ করে কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের গ্রেট কটেজ-এ বাসা নেন। এ বাড়িতেই তাঁর প্রিয় পুত্র বুলবুলের জন্ম হয়েছিল। বুলবুলকে তিনি অসম্ভবরকম ভালোবাসতেন। মাত্র চার বছর বয়সেই অর্থাৎ ১৯৩০ সালের ৭/৮ মে বসন্ত রোগে বুলবুলের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুতে নজরুল মানসিকভাবে চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তাঁর অসংখ্য কবিতা-গানে এই বেদনা ছড়িয়ে আছে। বুলবুলের রোগযশ্যায় বসে তিনি অনুবাদ করেছিলেন কবি হাফিজের ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ। পরে এটি ‘রূবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ নামে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি তিনি বুলবুলকে উৎসর্গ করেছিলেন।
নজরুল সপরিবারে কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা চলে এলেন। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিকভাবে যদি স্বচ্ছলতার কোনো পথ তৈরি করা যায়। কৃষ্ণনগরে বুলবুলের কবরের জায়গাটি তিনি কিনে রেখেছিলেন। ভবিষ্যতে বাধাই করবেন বলে। কিন্তু অর্থের অভাবে তা আর কোনোদিনই সম্ভব হয়নি। নজরুল নিজেও জানতেন তাঁর অনেক সম্ভাবনা আছে, তাঁর অনেক কিছু দেবার ছিল। কিন্তু অর্থের অভাবে তার সেসব সম্ভাবনা অধরাই থেকে গেছে। তাঁর দারিদ্রের সুযোগ নিয়েছিলেন বিখ্যাত অনেক ব্যক্তি। আবার নজরুল নিজেও অর্থের কারণে নিরুপায় হয়ে নিজেকে বিকিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এসবের কোনোটি থেকেই তিনি পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারেননি। এমনকি দারিদ্রের বৃত্ত থেকেই তিনি বেরিয়ে আসতে পারেননি। নজরুল ‘দৈনিক নবযুগ’-র প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ পত্রিকার মালিক ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনিও নজরুলকে প্রাপ্য টাকা না দিয়ে বরং উল্টো আঘাত করেছিলেন। হাবীবুল্লাহ বাহারও নজরুলের ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নজরুল হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহারকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তাঁদের বাড়িতে গিয়েছেন, থেকেছেন। তাঁদের চমৎকার সম্পর্ক ছিল। অথচ চরম দুর্দিনে হাবীবুল্লাহ বাহার তাঁর পাশে তো দাঁড়ানইনি, বরং বিপদকে আরো গভীরতর করে তুলেছিলেন। হাবীবুল্লাহ বাহার ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, আর নজরুল ছিলেন তখন চরম অসুস্থ। তিনি ইচ্ছে করলে নজরুলকে বড় ধরনের সাহায্য করতে পারতেন। তা না করে বরং মিথ্যে অভিযোগ তুলে তাঁর মাসিক ভাতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
নজরুল দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে দুহাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন, মাসিক দুশো টাকা সুদে। এই সুদের টাকা তিনি নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেননি। সেকারণে কাবুলিওয়ালা তাঁর বাড়ির দরোজায় এসে লাঠি ঠুকিয়ে অপমান করতেন। মধুসূদন দত্ত নজরুলের মতোই পাওনাদারদের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীরে নজরুল রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলেন চাকরির জন্যে পরীক্ষা দিতে। সেখানে তাঁকে যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি। যে-দেশের মুক্তির জন্য সারাজীবন অগ্নিঝরা লেখনি লিখলেন, জেল খাটলেন, পথে-পথে আন্দোলন করলেন, সে-দেশে বাঁচার জন্য ন্যূনতম একটি চাকরির জন্য তিনি যোগ্য বিবেচিত হননি!
১৯৪২ সালে ৯ জুলাই কলকাতা বেতারে শিশুদের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের সময় বাকরুদ্ধ হয়ে যান তিনি। এর পর আর কোনোদিনই তিনি কথা বলতে পারেননি। এর পর কবিকে দেশে, দেশের বাইরে লন্ডন ও ভিয়েনায় চিকিৎসা করানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো সুফল হয়নি। নজরুল এরকম অসুস্থতার ভেতরেই চিরদিনের জন্য প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলাকে হারান ১৯৬২ সালের ৩০ জুন । কাজী অনিরুদ্ধ মারা যান মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে, ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বাকরুদ্ধ বোধহীন যেন এক মাংসপিণ্ড নজরুল পাথর-চোখে অসহায়ের মতো শুধুই দেখেছেন প্রিয়জনদের চলে যাওয়া।
১৯৭২ সালের ২৪ মে নজরুলকে ঢাকায় আনা হয়। ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এ বছরেই ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর ভেতর দিয়েও আর এক ট্রাজেডি তৈরি হয়। পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে পুত্র কাজী সব্যসাচী যখন ঢাকার পথে, তিনি ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে নজরুল চির নিদ্রায় শায়িত হন। নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়ার শরপুকুরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত প্রমীলার কবরের পাশে নজরুলের কবরের জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিল। নজরুলের আর ফেরা হয়নি প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। আর প্রমীলা জীবনে যে নজরুলকে পেয়েও পাননি, মরণেও পাওয়া হলো না তাঁকে।
কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র তেইশ বছরে যে অসাধ্য কর্মযজ্ঞ সাধন করে গেছেন, স্বাভাবিক পন্থায় তা কখনো সম্ভবপর নয়। আবার ৩৪ বছর অর্ধমৃত হয়ে বাকরুদ্ধ মাংসপিণ্ড হয়ে যে জীবন তিনি পার করেছেন, তাও কল্পনায় আনা সম্ভব নয়।