তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল,
আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।
আমার বেদনা আজি রূপ ধরি শত গীত সুরে
নিখিল বিরহী-কণ্ঠে বিরহিণী তব তরে ঝুরে।
(তোমারে পড়িছে মনে: কাজী নজরুল ইসলাম)
বহুদিনের প্রচলিত বিশ্বাস—কান্না মূলত নারীর নিয়তি-ভূষণ। পুরুষশাসিত পৃথিবীতে নারী নানাভাবে নির্যাতিত, শোষিত, নিষ্পেষিত এবং অধিকাংশ যৌথপরিবারে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই নারী কার্যত বাকস্বাধীনতাহীন। তাই তাকে বহু বেদনা নীরবে কিংবা বিনা প্রতিবাদে হজম করতে হয়। পুরুষরচিত বহু পুরনো প্রবাদবাক্য—নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। কিন্তু চেপে রাখা সত্য হলো—আসলে তাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। সে সত্য কথা বললে পুরুষ শ্বশুর-স্বামী-সমাজ তার জিহ্বা কেটে দেয়; যার ঐতিহাসিক সাক্ষী খনা। শিক্ষার সুযোগ লাভ করায় এবং সমাজব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটায় এখন অবশ্য নারীও কথা বলে। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু তেমন সুযোগ এখনো সীমিত এবং তেমন নারীর সংখ্যা এখনো কম। আর প্রেমের ক্ষেত্রেও সব কান্নার মালিক যেন নারী। কান্না তার অসহায়ত্বের প্রকাশ। আবার কান্নাই তার শক্তি। পুরুষ নারীর চোখে জল দেখে সুখ পায়, সেই জলে নিজের বিজয়চিহ্ন খুঁজে পায়। তাই আঁচলে ফুল এবং চোখে জল—এমন নারীকেই কামনা করে পুরুষ। পুরুষ তার ভালোবাসার নারীর ছবি আঁকে এভাবে—‘নয়নভরা জল গো তোমার, আঁচলভরা ফুল / ফুল নেবো না অশ্রু নেবো ভেবে হই আকুল / ফুল যদি নিই তোমার হাতের, জল রবে না আঁখিপাতে / অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল/ মালা যখন গাঁথো তখন পাওয়ার সাধ যে জাগে/ মোর বিরহে কাঁদো যখন আরও ভালো লাগে।’ আর নারীও কেঁদে কেঁদে তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে চায়—‘ও গো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না / আমার এত সাধের কান্নার দাগ ধুয়ো না / সে যেন এসে দেখে/ পথ চেয়ে তার কেমন করে কেঁদেছি।’ (শিল্পী: হৈমন্তী শুক্লা) অথবা ‘মাঝে মাঝে কিছুই থাকে না কান্নার চেয়ে বেশি প্রিয় / আমাকে কাঁদতে দিও।’ (শিল্পী: রুনা লাইলা)। অবশ্য এসব গান নারীদের হয়ে লেখা হলেও রচয়িতারা কিন্তু পুরুষই। তাই এসব গানে নারীর কান্নার বাসনা যতটা না নারীর নিজের, তারচেয়ে বেশি পুরুষের ইচ্ছার প্রতিফলন।
কিন্তু পুরুষ জেনে এসেছে যে কান্না তার নয়। কান্না তো দুর্বলতার লক্ষণ! আর পুরুষ তো নারীর মতো দুর্বল, অসহায় বা অবলা নয়! পুরুষ জানে—তার আছে অর্থবিত্ত। তার আছে গায়ের জোর। তার আছে সৈন্যসামন্ত । তার আছে সমাজ। তার পক্ষে আছে ধর্ম।তার পক্ষে আছে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রসংঘ। তার মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে আছে মিড়িয়া। তার মুখ বন্ধ করার ক্ষমতা নারীর নেই। তাই পুরুষের মুখে কথা, যত ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে। ফলে বুক ফাটা কান্না তার নয়। যে নারীকে সে ভালোবাসবে, তাকে নিজ অধিকারে নিয়ে আসবে। নারী অবাধ্য হলে পুরুষ জোর খাটাবে; তাতেও কাজ না হলে তাকে হাইজ্যাক করবে; তার মুখে এসিড নিক্ষেপ করবে। অতএব তার কান্নার কিছুই নেই। একজন সংসারী নারী অন্য পুরুষকে ভালোবাসলে সে হবে কলঙ্কিনী। সে হবে অসতী। সে হবে চরিত্রহীনা। তাকে শাস্তি পেতে হবে। তার সংসার ভাঙবে; কপাল পুড়বে। আর বিবাহিত পুরুষ অন্য নারীকে ভালোবাসলে সে হবে প্রেমিক। সে হবে রমণীমোহন। প্রয়োজনে সে নিজ স্ত্রীকে তাড়িয়ে দিয়ে নতুনজনকে ঘরে নিয়ে আসবে। সমাজ তার পক্ষেই দাঁড়াবে। সমাজ তার পাশেই থাকবে। অতএব তার কান্নার কোনো কারণ নেই। প্রেম করে সহস্রাধিক স্ত্রীর মালিক কৃষ্ণ (পুরুষ) মহিমান্বিত; কিন্তু তার বাঁশির ডাকে সাড়া দিয়ে শুধু একজন পুরুষের ঘরকরা রাধা (নারী) কলঙ্কিনী অপবাদে বিদ্ধ কালে-মহাকালে। আর কাঁদতে হয়েছে রাধাকেই। তবে নারী যে কাঁদতে ভালোবাসে অথবা কাঁদতে চায় তা নয়, সে চায় পুরুষ তার কান্নার কারণ জানুক, বুঝুক এবং মূল্যায়ন করুক। নারীর সেই বেদনাভরা আকুলতার কথা কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিখ্যাত ‘তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম’ গানটিতে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। গানটির শেষাংশে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে রাধা যখন বলেন, ‘তুমি যে-কাঁদনে কাঁদায়েছ মোরে/ আমি কাঁদাতাম তেমনি করে / বুঝিতে, কেমন লাগে এই গুরু-গঞ্জনা / এ-প্রাণ-পোড়ানি অবিরাম/ তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম।’ তখন পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে নারী কাঁদতে চায় না, পুরুষশাসিত পৃথিবী তাকে কাঁদতে বাধ্য করে।
আরও মনে করা হয় যে, পুরুষ হবে মনের দিক থেকে শক্ত এবং অটল। যে পুরুষের চোখে বেদনায় জল আসে, অধরে উচ্চারিত হয় সশব্দ কান্না, তাঁকে তাকে নরম প্রকৃতির, তাকে প্রচলিতভাবে মেয়েলিস্বভাবের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু প্রেম এমন একটা জিনিস যে মিলনের আনন্দে এবং বিচ্ছেদের বেদনায় প্রেমিকপুরুষও কান্নায় ভেঙে পড়ে। অতি তেজস্বী পুরুষ যাদের বলা হয়—সিংহপুরুষ বা পুরুষসিংহ অথবা যারা কঠিনহৃদয় পুরুষ অথবা যারা সন্ন্যাসী-মনের আত্মসংযমী পুরুষ, তারাও প্রেমে পড়লে নরম হয়ে যান। প্রেমের ছোঁয়ায় তাদের পাষাণহৃদয় গলে আনন্দবেদনার ঝর্ণাধারায় পরিণত হয়। তাদের কঠোরতার প্রাচীর এবং আত্মসংযমের বাধ ভেঙে পড়ে। যুদ্ধের ময়দানে রক্তদৃশ্য দেখেও যার কান্না আসে না, প্রেমিকার সঙ্গে মিলনে অথবা বিচ্ছেদে তার চোখ ভরে ওঠে আনন্দ অথবা বেদনার জলে। হয়তো সে অশ্রু সরব কান্না হয়ে উদ্বেল করে তোলে না পাড়াপড়শী বন্ধুজনদের। এই নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম রচেছেন এক অভূতপূর্ব অনন্যসুন্দর গান।
পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁয়ায়
গলিয়া সুরের তুষার গীত-নির্ঝর বয়ে যায়।
উদাসী বিবাগী মন
যাচে আজ বাহুর বাঁধন
কত জনমের কাঁদন ও পায়ে লুটাতে চায়।ওগো তোমার চরণ-ছন্দে মোর মুঞ্জরিল গানের মুকুল
তোমার বেণীর বন্ধে গো মরিতে চায় সুরের বকুল।
চমকে ওঠে মোর গগন ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়।
বিষয়কে কেন্দ্র করে সুর ও বাণীর সহযোগে রচিত অপূর্বসুন্দর সঙ্গীতের অন্যতম নমুনা এই গান। এ গানের কথক একজন পুরুষ, তবে সাধারণ পুরুষ নয়, মহাকর্মযজ্ঞে ব্যস্ত মহাপুরুষ। চারপাশের উপভোগের উপাচার আর সৌন্দর্যের উপকরণের দিকে লক্ষ করার তার সময় ছিল না। কত ফুলের সুবাস মুগ্ধ করতে চেয়েছে তার উদাসীন মনকে, কত নদীর কলতান তাকে আসন ছেড়ে আনন্দ ভ্রমণের সঙ্গী হতে ডেকেছে, কত পাখির কুজন তাকে ঘরছাড়া ডাক দিয়েছে, কত সুন্দরী নারী অনুরাগের আঁচল উড়িয়ে তাকে প্রেমের নিরুদ্দেশ-যাত্রায় মধুর আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু এতসব মধুর হাতছানি ও সুন্দরের ডাক উপেক্ষা করে সে রয়ে গেছে কর্মযোগী, আপন দায়িত্বের সিংহাসনের পাষাণসম্রাট। অথচ কোনো এক শুভক্ষণে এক অসাধারণ গুণবতী নারীর ক্ষণিক চুম্বকস্পর্শে তার কর্মধ্যান টুটেছে, ধ্যানরত বিশ্বামিত্রের মতো চোখ মেলে চাইতেই উড়ে গেছে তার কর্মযোগ-সাধনা আর পাষাণ ঔদাসীন্য। তার অন্তরে পাষাণচাপা ঝর্ণার মতো অবরুদ্ধ প্রেমের ধারা গলিত তুষারের ন্যায় প্রবলবেগে বের হয়ে ঝর্ণার রূপান্তিত হয়েছে । সে ঝর্ণা সুরের ঝর্ণা। এ যেন পাষাণের মতো শক্ত কঠিন অগ্নিবীণার বিদ্রোহী কবি নজরুলের বুলবুলের প্রেমের কবিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রতীকী উপস্থাপন। বিদ্রোহী কবি গানের কবিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর আর অসির ঝনঝনানি শুনাননি। তিনি প্রেমের বীণাই বাজিয়ে গেছেন।আর প্রেমিকার উদ্দেশে বলেছেন:
তুমি আমায় ভালোবাসো তাই তো আমি কবি
আমার এ রূপ সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি
শুধু বক্তব্যের জন্যই নয়, উপমা, চিত্রকল্প, ছন্দ, অনুপ্রাস সবকিছুর সমন্বয়ে কবিতা হিসেবে গানটির যে শৈল্পিক সৌন্দর্য ও মনোহারিত্ব তাও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘গলিয়া সুরের তুষার গীতি-নির্ঝর রয়ে যা’—চিত্রকল্পটির সৌন্দর্য ও অর্থব্যঞ্জনা সুগভীর ও সুমধুর। তেমনি চমৎকারিত্বে ভরা—‘চমকে ওঠে মোর গগন ঐ হরিণ চোখের চাওয়ায়’ চরণটি। ‘উদাসী বিবাগী মন/ যাঁচে আজ বাহুর বাঁধন/ কত জনমের কাঁদন/ ও পায়ে লুটাত চায়’—এই অন্তরা যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে—মানবীয় প্রেমের বিজয় পতাকা ওড়ার গভীর মনোহর দৃশ্য—যার সামনে বিপুল শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে যাবতীয় সৃষ্টি। এই দুটি চরণে পুরুষের কান্নার গভীর রূপ ফুটে উঠেছে । নারীর মতো পুরুষেরও কান্না পায়; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষ তা চেপে রাখে। কিন্ত একসময় বাধভাঙা জোয়ারের মতো তা আছড়ে পড়ে। সেজন্য এই কান্নাকে বলা হয়েছে—‘কত জনমের কাঁদন।’
_________________________________________________________________________________________________
পুরুষের কান্না সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সে-কান্নায় বাড়তি চাপ পড়লে তার জ্বালামুখ খুলে যেতে বসে। তাই ভালোবাসার বিনিময়ে যে-নারীর কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া যাবে না, সে নারীকেও সে ভালোবাসতে চায়
_________________________________________________________________________________________________
কিন্তু শুধু অসাধারণ পুরুষরাই নয়, সাধারণ পুরুষ মানুষও প্রেমে পড়ে, দুঃখে নিপতিত হয়ে অথবা প্রিয়জনের বিচ্ছেদে কাঁদতে পারে, কেঁদে থাকে যদিও তার কান্না নারীর কান্নার মতো সবসময় হাউমাউ উচ্চারণে ভেঙে পড়ে না। ভালোবাসার উপস্থিতি এবং প্রস্থান পুরুষকে কাঁদাতে পারে। ভালোবাসা আসার আগে যে-পুরুষের জানা ছিল না ভালোবাসার আনন্দ কি, বেদনাইবা কি, ভালোবাসা এসে তাকে কাঁদিয়ে দিতে পারে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কেন আসিলে ভালোবাসিলে দিলে না ধরা জীবনে যদি’ গানটিতে পুরুষের সেই কান্নার ছবি দেখা যায়। গানটির শেষ তিনটি চরণ সেই কান্নাকে ধারণ করেছে গভীর ব্যঞ্জনায়—‘ওগো কত জনমের কত সে কাঁদন করে হাহাকার বুকেরি তলায় / ওগো কত নিরাশায় কত অভিমান ফেনায়ে ওঠে গভীর ব্যথায়/ মিলন হবে কোথায় সে কবে কাঁদিছে সাগর স্মরিয়া নদী।’ একজন সাধারণ গেরস্থ প্রকৃতির মানুষও প্রিয়জনের বিচ্ছেদবেদনায় কাঁদে। কবি জসীমউদদীনের বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা একজন পুরুষের গভীর-নিবিড় সবব্যাপী কান্নাকে ধারণ করে আছে অশ্রুর সমুদ্রের ব্যাপকতায় ও ব্যঞ্জনায়। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত একটি আধুনিক গান ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়, তুমি ফিরিলে না ঘরে।’ এই গানে একজন সাধারণ গেরস্ত প্রকৃতির মানুষের প্রিয়তম জীবনসঙ্গিনী হারানোর কান্না উপস্থাপন করা হয়েছে। গৃহস্থ মানুষটির জীবন ছিল সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরা। প্রকৃতির উদার উঠানে গাছের ছায়ায় বাতাসের উদার্যে, বৃষ্টির আশীর্বাদে এবং সুখের মহানুবতায় দুটি নরনারীর সংসার ছিল পরিতৃপ্তির প্রাসাদে সুখশান্ত। চুলের খোঁপায় প্রকৃতি হতে তুলে নেওয়া ফুল এবং ফুল রঙের কমদামি শাড়িতেই গৃহস্থ নারীর সাজগোজ হয়ে যেত। তার জন্য প্রকৃতিই ছিল বিউটিপার্লার। কিভাবে, কখন তার মৃত্যু হয়েছে অথবা সে নারী গৃহস্থ পুরুষের জীবন থেকে কিভাবে চিরতরে হারিয়ে গেছে তার বর্ণনা বা ইঙ্গিৎ গানে নেই। সে আর নেই—শুধু এই তথ্যই শোকের হাহাকার হয়ে বেজে উঠতে চেয়েছে। তাকে হারিয়ে আলোশূন্য আনন্দশূন্য, উৎসাহহীন প্রেরণাহীন হয়ে পড়েছে গৃহস্থ-নায়কের সমগ্র জীবন। বর্ষার দিন। চারপাশে বৃষ্টির বিরহসঙ্গীত। জীবনসঙ্গিনীর খুঁটিনাটি স্মৃতির চিহ্ন পড়ে আছে এখানে ওখানে। বাসন্তীরাঙা শাড়ি। খোঁপায় কাঁটা। খোঁপায় গাদাফুল। শূন্য কলস। শিখাহীন গৃহদীপ। এসবই গৃহস্থ নারীর সকরুণ অনুপস্থিতিকে সহৃদয় অন্তরঙ্গতায় ব্যঞ্জিত করে তুলেছে। গৃহস্থ মানুষ শহরের শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মতো কোনো শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেনি; পত্রিকায় শোকবার্তা প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়নি। শোক ভোলার অছিলায় মদের নেশায় চুর হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেনি। বর্ষাকালে গৃহস্থের বহুবিধ কাজ। তার মন চায়নি কাজে যোগ দিতে। তাই তিনি সারাদিন ঘরেই কাটিয়েছেন। ‘যাইনি বাহিরে আজ সারাদিন/ ঝরিছে বাদল শ্রান্তিবিহীন/ পিয়া পিয়া বলে ডাকিছে পাপিয়া এ বুকের পিঞ্জরে!’ এই কথাগুলোর মধ্যে তার বুকের মাঝে জমায়েত শোকের মাত্রা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। কেউ আসেনি কাছে। তার দুঃখের ভাগ নেওয়ারও কেউ নেই। এ শোক একান্তভাবে তার আপনার। বুকের পিঞ্জরে পাপিয়া পাখি ‘পিয়া পিয়া’—ডাক তার শোক ও দুঃখকে খুঁড়ে তুলে উদ্বেল করে দিতে চেয়েছে অশ্রুভেজা অনুভবের সমস্ত উৎস। গানটির শুরুর চরণটি অপূর্বসুন্দর। আমরা জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতায় পড়েছি ‘সব পাখি ঘরে আসে সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন।’ কিন্তু নজরুলের এ গান ‘ বনলতা সেন’এর কবিতার বহু আগে রচিত। এ গানেও জড়িয়ে আছে বিরাট রহস্য। গৃহস্থ নারী একা কোথায় গিয়েছিল? তখন তো নারীরা ঘরের বাইরের কাজে নিয়োজিত হতো না। যদি নদীতে স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরতো বা স্রোতে ভেসে যেত, তবে তো গৃহস্থ নায়ক সে খবর কোনো না কোনো ভাবে পেয়ে যেত। সে সারাদিন ঘরে বসে না থেকে হারানো প্রিয়ার খোঁজে কিংবা অন্তত তার মৃত দেহের সন্ধানে বের হতো। আর এ বাড়িতে সে একা কেন? তখন তো যৌথ পরিবার প্রথা ছিল। তাদের কোনো সন্তান ছিল না? নাকি তারা নতুন দম্পত্তি ছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আমাদের শুধু জীবন সঙ্গিনীর ফিরে না আসা এবং নিখোঁজ থাকার প্রেক্ষাপটে শোকের উঠোনে বেদনাহত একজন গৃহস্থ মানুষের ব্যথিত করুণ হাহাকার ভরা অভিব্যক্তি দেখে সমব্যথী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। আমরাও তার ব্যথার সমব্যথী হয়ে উঠি। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, পুরুষ মানুষও প্রিয়ার বিচ্ছেদে কাঁদে অন্তরে বাহিরে এবং এই কান্না খুবই গভীর। এই কান্না সমুদ্রের কান্না, যা শুনতে পায় নিশুতিরাতের তটভূমি আর জোছনা ধোয়া আকাশ। এই কান্না শোনার যোগ্যতা নেই গড়পরতা নারী-পুরুষের কারুরই।
সংবেদনশীল পুরুষের আরেক ধরনের কান্না আছে। সেটা প্রিয়জনের অনিরাময়যোগ্য অসুখ কিংবা অকালে ফুরিয়ে-যাওয়া অবস্থা প্রেমিকপুরুষ বা জীবনসঙ্গী-পুরুষকে বেদনার সাগরে নিক্ষেপ করে। সে-পুরুষ প্রিয়নারীকে সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলতেও পারে না; তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে না তার সবুজ জীবনের স্বাভাবিক উচ্ছলতায়। কিন্তু তার প্রিয়নারীর তীরবিদ্ধ পাখির মতো যন্ত্রণাকাতর জীবন দেখে মনটা বেদনায় মুষড়ে ওঠে। পুরুষের এই কান্না একজন সজ্জন মানুষের অসহায় কান্না।
…তুমি আমার সকাল বেলার সুর
হৃদয়-অলস-উদাস করা অশ্রু ভারাতুর।।
ভোরের তারার মত তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়,
…
অরুণ তুমি, তরুণ তুমি, করুণ তারো চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্রসভার মৌন বীণা নীরব নূপুর।
এ গানের নারী স্বাভাবিক সুস্থ সচ্ছল জীবন থেকে বঞ্চিত। তার প্রাণশক্তি স্তিমিত; সে আনন্দে উচ্ছ্বল হওয়ার ক্ষমতা অকালে হারিয়ে ফেলেছে। আনন্দ দানের শক্তিও ছেড়ে গেছে তাকে সময়ের বহু আগেই। যতদিন সুযোগ-সামর্থ্য ছিল, ততদিন যাবৎ নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এই নারীর প্রতি পুরুষকবির আকর্ষণ কমেনি, বরং তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসির দেশের উচ্ছ্বল নারী নিয়তির নিষ্ঠুর খেয়ালে বিষাদলোকের মেয়ে হয়ে গেলেও ভালোবাসার কেন্দ্রচ্যুত হয়নি, জীবনের উঠোনে আবর্জনা হয়ে ওঠেনি। তার অবদানের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা রয়েছে প্রেমিক-পুরুষের মনে। এ নারী আয়ুর শেষপ্রান্তের বয়স্ক নারী নয়। সে তরুণ ও অরুণ । কিন্তু একইসঙ্গে করুণও। কিন্তু কেন? কেন তার অকাল নীরব হয়ে যাওয়া? কেন অসময়োচিত করুণ বিষণ্নতা? তাহলে কি সে নারী কোনো অসুখে কিংবা অপঘাতে পঙ্গু হয়ে গেছে? ‘তুমি ইন্দ্রসভার মৌনবীণা, নীরব নূপুর’—এই কল্পচিত্রটি দেশ ও জাতিকে কবিতা-গানে মাতিয়ে অকালে নীরব হয়ে যাওয়া নজরুলের নিজের জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধসূত্র রচনা করে। আবার নজরুলের সুস্থ অবস্থাতেই তাঁর স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে অচল হয়ে পড়েছিলেন। তখন দুজনের কারও বয়সই বেশি হয়নি। আর নজরুল প্রমীলাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং তাকে সারিয়ে তোলার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রেমময় সঙ্গ দিয়ে গেছিলেন সর্বোতভাবে। একবার মনে হয় এই গানটির নায়িকা যেন সেই রোগগ্রস্ত শয্যাশায়ী প্রমীলা। ‘অরুণ তুমি, তরুণ তুমি, করুণ তারও চেয়ে/ হাসি দেশের তুমি যেন বিষাদলোকে মেয়ে’—চরণদুটি ঝংকৃত অনুপ্রাসের রণন ও বিপরীতার্থক চিত্রকল্পের সমাবেশ গানটিকে অসাধারণ শিল্পগুণে ভরে তুলেছে। বেদনার ইজেলে দুঃখ প্রতিমার মমতামাখা মাধুর্য অপরূপ সৌন্দর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। এ সৌন্দর্য উপভোগের নয়, এ সৌন্দর্য হৃদয়কে দুঃখের মাধুরীতে অভিভূত করে দেওয়ার। এই গানে একজন নারীর করুণ ছবি স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে চোখের সামনে; তবে আড়ালের গভীর-নিবিড় কান্নাটি কিন্তু প্রেমিক পুরুষের যা সাধারণ মানের শ্রোতা-পাঠকের বোধে ধরা নাও পড়তে পারে।
আর প্রকাশ্য অথবা গোপন বিরহ পরুষকে কাঁদায় অন্তরে অন্তরে যদিও সেকাঁদন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাধারণের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে রায়। কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটিতে বিরহী পুরুষের বোবাকান্নার করুণ ছবি। অনেক প্রেমিক পুরুষ আছে বা থাকে যারা তাদের বিচ্ছেদবেদনা কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারে না। বন্ধুবান্ধব বা অন্য কোনো মানুষকে আপনবেদনার কথা শোনাতে গেলে নিজেকেই অন্যদের কাছে করুণা বা উপহাসের পাত্র করে তোলা হতে পারে। তাই জানালার পাশে জেগে থাকা প্রাণদায়ী গুবাক তরুর সঙ্গে অশ্রুভেজা কথা ভাগাভাগি করে নেওয়া। বিরহের আলাপচারিতা বেদনার বর্ণমালায় হয়ে ওঠে পুরুষের অন্তরঙ্গ কান্নার অশ্রুস্নাত নান্দনিক সৃষ্টি। অন্য মানুষের সঙ্গে সে তার অশ্রু ভাগাভাগি করে নিতে পারে না, বলেই তাকে বরণ করে নিতে হয় গোপন-অনলে একাকী পুড়ে যেতে থাকার দহন-ভাগ্য: ‘নিশ্চল নিশ্চুপ / আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’ আর আগুনের বর্ণমালায় এবং দহনের ব্যঞ্জনায় সে রচে অন্তরঙ্গবেদনার অদৃশ্য-চিতায় নিজেরই জ্বলতে থাকার দহন-সঙ্গীত: ‘গঙ্গায় তারি চিতা নিভেছে কবে / মোর বুকে সেই চিতা আজো জ্বলে নীরবে/ স্মৃতির চিতা তার নিভিবে না বুঝি আর / কোন সে জনমে কোন সে লোকে।’ (কেন মেঘের ছায়া আজি চাঁদের চোখে / কাজী নজরুল ইসলাম)। আবার এমনও হয়—ভালোবাসা চেয়ে তা না পেয়ে সংক্ষুব্ধ পুরুষ ভালোবাসার নারীর ওপর একধরনের প্রতিশোধ নেয়। সে নিজে কাঁদে; ভালোবাসার নারীকেও কাঁদায়। আর সে-নারীর উদ্দেশে অশ্রুমাখা উচ্চারণ ছড়িয়ে দেয় বাতাসে: ‘তুমি বুঝিবে না বালা / যে আঘাত দেয় বুকের প্রিয়ারে, তার বুকে কত জ্বালা!’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। ভালোবাসার আঘাতে জর্জরিত অথবা বিরহ-বিচ্ছেদ-বেদনায় দহিত পুরুষটি যদি কোনো সৃজনশীল মানুষ (কবি-কথাশিল্পী-ভাস্কর-নাট্যকার-কণ্ঠশিল্পী-চিত্রকর) হন, তবে তিনি শুধু গোপন আগুনে পুড়ে পুড়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দেন না; তিনি আপন অন্তরঙ্গ বেদনার উপকরণ দিয়ে সৃষ্টি করেন অশ্রুর নদী, প্রণয়ের স্মৃতিসৌধ, বিরহের কাব্য, বিচ্ছেদবেদনার গান; মৃত্যুর মৃত্তিকার ওপর গড়ে তোলেন অমরত্বের অট্টালিকা। এটি কয়েকটি কারণে এবং কয়েকভাবে ঘটে থাকে। এক-যে নারীর প্রেমে পুরুষ খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন পিপাসার জল, সে নারী তা দিতে অক্ষম; কারণ সে নারীর অন্তরে ভালোবাসার নদী নেই। তিনি শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যসর্বস্ব। এটি জানার পর সে পুরুষের আত্মোপলব্ধির নিরাশউচ্চারণের স্বগত-সংলাপ শোনার ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়। ‘রে পাগল! এ কি দুরাশা! / জলে তুই বাঁধবি রে বাসা / মেটে না হেথায় পিপাসা / হেথা নাই তৃষ্ণা-দরিয়া। (মুসাফির মোছ রে আঁখিজল:কাজী নজরুল ইসলাম)। তারপরও সৃজনশীল পুরুষ ভালোবাসে নারীকে। যে নারী তাকে ভালোবাসে না কিংবা ভালোবাসবে না, তাকেও বেহিসাবের মন নিয়ে ভালোবাসে সৃজনশীল মানুষ। ভালোবাসার হৃদয়-মন নিয়ে তার জন্ম। ভালোবাসা তার অভ্যাস বা বদ-অভ্যাস। ভালোবেসে যন্ত্রণা পাওয়া তার নিয়তি। ভালোবাসা ছাড়া তার চলে না। ‘মন দেয়া নেয়া অনেক করেছি মরেছি হাজার মরণে / নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে!’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। তার ভেতরে অনেক অশ্রু, অনেক বেদনা, দেওয়ার মতো অনেক সঞ্চয়। এসব ভাগাভাগি করতে না পারলে কিংবা এসবের অংশ কাউকে দিতে না পারলে অথবা নিদেনপক্ষে কাউকে তার ভালোবাসার কথা জানাতে না পারলে তার বুকের ভেতরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠতে চায়। পুরুষের কান্না মানে সমুদ্রের কান্না। সে-কান্না প্রকাশের ইতিবাচক মাধ্যম না পেলে তা সাইক্লোন হয়ে উঠতে চায়। পুরুষের কান্না সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সে-কান্নায় বাড়তি চাপ পড়লে তার জ্বালামুখ খুলে যেতে বসে। তাই ভালোবাসার বিনিময়ে যে-নারীর কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া যাবে না, সে নারীকেও সে ভালোবাসতে চায়। ‘বুকে তোর সাত-সাগরের জল, পিপাসা মিটলো না কবি / ফটিকজল জল খুঁজিস্ যেথায় কেবলি তড়িৎ ঝলকে!’ (এত জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বলো কে:কাজী নজরুল ইসলাম)। সৃজনশীল পুরুষের কান্নার প্রকাশের নিজস্ব মাধ্যম আছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা সাধারণের চোখে পড়ে না। তার কান্নার নিবিড় ধ্বনি সাধারণ কান শুনতে পায় না। এ ধরনের অ-সাধারণ পুরুষ তার কান্নাকে ছড়িয়ে দেন সিন্ধুতরঙ্গে । তিনি তার অশ্রুকে মিশিয়ে দেন শ্রাবণের বর্ষণে। তিনি তার হাহাকারকে ছড়িয়ে দেন নির্জন রাতের জোছনাপ্রান্তরে। তিনি তার চাপাকান্নার ভার তুলে দেন রোদনভরা বসন্তের বাতাসের কাঁধে। তার কান্না অন্যের কান্না হয়ে বাজে দশজনের কানে—কথায় ও সুরে, ছন্দে ও তালে। আর আপন সৃষ্টির সৌন্দর্যের নিচে সৃজনশীল-পুরুষের কান্না চাপা পড়ে যায়। সৃজনশীল পুরুষের এই চাপা-পড়া কান্নার ছবি সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটে নজরুলের উঠেছে ‘কবি, সবার কথা কইলে এবার নিজের কথা কহ’ গানটিতে। গানটি পাঠ করা যায়:
কবি, সবার কথা কইলে, এবার নিজের কথা কহ।
(কেন) নিখিল ভুবন অভিমানের আগুন দিয়ে দহ।
কে তোমারে হানলো হেলা কবি!
(হায়) সুরে সুরে আঁক কি গো সেই বেদনার ছবি?
কার বিরহ রক্ত ঝরায় বক্ষে অহরহ।।
কোন্ ছন্দময়ীর ছন্দ দোলে তোমার গানে গানে
তোমার সুরের স্রোতে বয়ে যায় কাহার প্রেমের টানে গো…
কাহার চরণ পানে?
কাহার গলায় ঠাঁই পেল না বলে
(তব) কথার মালা ব্যথার মত প্রতি হিয়ায় দোলে,
(তোমার) হাসিতে যে বাঁশিতে বাজে, সে তো তুমি নহ।।
আসলে প্রিয়জনের বিরহই সেই পুরুষের বুকে রক্ত ঝরায়; লোকচক্ষুর আড়ালে তাকে গোপনে ভাসায় অশ্রুর সাগরে। আরেকটি গানে কবি বিষয়টি সরাসরি বলেছেন, ‘যেদিন তোমারে পাই না কাছে গো পরশন নাহি পায় / মনে হয় যেন বিশ্বভুবনে কেহ নাই, কিছু নাই/ অভিমানে কাঁদে বক্ষে সেদিন বীণ / আকাশ সেদিন হয়ে যায় বাণীহীন/ যেন রাধা নাই আর বৃন্দাবনে গো সব সাধ গেছে মরে।’ (তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের পরে:কাজী নজরুল ইসলাম)।
অজেয় বীরপুরুষের প্রতীক স্রষ্টার সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে ওঠা চির-উন্নতশির মানুষের শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত, চিরযৌবনের প্রতীক, বিশ্বমানবতার-বিশ্বমানবিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, অনন্ত প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের তিন পর্বের ‘সিন্ধু’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটি সৃজনশীল মহাপুরুষের কান্নাপ্রকাশ এবং অশ্রু-নিবেদনের স্বকীয় পন্থার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হয়ে আছে। নজরুল নিজেই ছিলেন সমুদ্রের মতো দুরন্ত, অনিয়ন্ত্রণযোগ্য, দুঃসাহসী। নজরুলের হৃদয় ছিল সমুদ্রের মতো বিশাল। তিনি সমুদ্রের মতোই জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে এবং সমাজে। তাঁর বিদ্রোহমূলক সৃষ্টিকর্মে এবং আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল তৎকালীন ব্রিটিশরাজ এবং সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদীর গোষ্ঠীর আসন। নজরুল সমুদ্রের মতো অবারিতভাবে দিয়ে গেছেন সমাজকে, মানবসমাজকে। বিনিময়ে সম্মান পেয়েছেন; আবার ব্যথাও পেয়েছেন প্রচুর। নজরুলের হৃদয় ছিল প্রেমে ভরা; সে প্রেম যুগপৎভাবে বৃহত্তর অঙ্গনে মানবজাতির জন্য এবং ব্যক্তিসীমায় অন্তরঙ্গ নারীর জন্য। কিন্তু তার সেই প্রেমের পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেটা তাঁর ব্যক্তিজীবনেও হয়নি, সমাজজীবনেও হয়নি। এই নিয়ে নজরুলের মনেবেদনা ছিল অপরিসীম ও অগাধ। নজরুল তাঁর নিজের সেই বেদনাকে সমুদ্রের পিপাসার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি এক গানে বলেছেন, ‘সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে / কি তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে/বেদনার মহাসাগরের কাছে করো করো সন্ধান।’ সমুদ্রের মতো বিশালহৃদয় নজরুল সমুদ্রকেই তাঁর বেদনার সহচর হিসেবে দেখেছেন। নজরুল তাঁর কান্নার সহচর হিসেবে সমুদ্রকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ নজরুলের কান্না সমুদ্রের কান্নার মতোই সুগভীর এবং অনন্য সাধারণ।
কত কথা আছে—কত গান আছে শোনাবার,
কত ব্যথা জানাবার আছে—সিন্ধু, বন্ধু গো আমার!
এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি!
অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া, দুহু পশি
ঢেউ নাই যেথা—শুধু নিতল সুনীল!
তিমিরে কহিয়া দাও—সে যেন খোলে না খিল
থাকে দ্বারে বসি।
সেইখানে কব কথা, যেন রবি-শশী
নাহি পশে সেথা।
তুমি রবে, আমি রব—আর রবে ব্যথা।
সেথা শুধু ডুবে রব কথা নাহি কহি..
যদি কই,
নাই সেথা দুটি কথা বই,
আমিও বিরহী, বন্ধু, তুমিও বিরহী!
(সিন্ধু : কাজী নজরুল ইসলাম)
এই সিন্ধু বাহ্যিকভাবে জলের অথই আমাদের বঙ্গোপসাগর হলেও এই কবিতার প্রকৃত ব্যঞ্জনা এই যে পুরুষকবির আপন অন্তরেই আপন ব্যথার সমুদ্র। সেই আপন-সমুদ্রে ডুব দিয়ে দিন যায় রাত যায় তাঁর। কারণ, সেই-ব্যথা, সেই-কান্না অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। গোপনে হজম করতে হয় সকল মহাবেদনা, সবার চোখের আড়ালে নিজ হৃদয়-সমুদ্রে ডুব দিয়ে জুড়াতে হয় হৃদয়ের জ্বালা। নিজের চোখের জল পান করে মিটাতে হয় মহানপ্রাণের অদ্ভুত পিপাসা। পুরুষের অন্তর ফেটে কান্না এলে তাকে তা চেপে রাখতে হয়; সেটা খুবই কঠিন কাজ। কারণ পুরুষপ্রেমিকের অশ্রুর নালিশ জানানোর জন্য জগতে কোনো আদালত নেই। এটি একটা খুবই অসহায় অবস্থা।
একজন সৃজনশীল পুরুষ গড়পড়তা মানুষ নন বলে প্রেমের এত বাহ্যিক ব্যর্থতা, এত উপেক্ষা, এত অপ্রাপ্তি, হৃদয়ের এত একতরফা দান তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে না। অপ্রাপ্তির আগুনে পুড়ে তিনি ছাই না হয়ে উল্টো খাঁটি সোনা হয়। তিনি তার অশ্রু দিয়ে অশ্রুর তাজমহল নির্মাণ করেন। সেই তাজমহল কখনো কবিতা, কখনো গান, কখনো উপন্যাস, কখনো নাটক, কখনো ভাস্কর্য, কখনোবা রঙতুলির চিত্রকর্ম। সৃজনশীল মানুষ কোথাও কোথাও বাহ্যিকভাবে ব্যর্থ হলেও জীবনের গভীর অঙ্গনে বিজয়ী হন। সেজন্য কবি আল মাহমুদ তাঁর সুবিখ্যাত ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় বলেছেন, ‘পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা / দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’ ভালোবাসার নারীকে বাহ্যিকভাবে কাছে না পেলেও তাকে নিজ অন্তরে ধারণ করতে পারেন পুরুষ কবি-শিল্পী। পুরুষ কবি-শিল্পীরা সাধারণ মানুষের মতই রক্তামংসের মানুষ হলেও তারা সাধারণ মানুষ নন। মনের অ-সাধারণত্ব নিয়ে তারা অ-সাধারণ মানুষ। এই পৃথিবী যে এতটা সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা তার পেছনে রয়েছে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের শ্রম ও ঘাম। তবে তাজমহল এর মতো অসাধারণ সৃষ্টিগুলোর পেছনে স্থাপত্যশিল্পী এবং শ্রমিকদের অবদান তো আছেই, তার চেয়ে বেশি অবদান শাহজাহানের মতো পাগলহৃদয় প্রেমিকজনের। পৃথিবীতে যেসব গান যুগের পর আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে শ্রোতাদের, যেসব কবিতা-উপন্যাস-নাটক বছরের পর বছর হৃদয়মনের খোরাক যুগিয়ে যাচ্ছে পাঠককে, যেসব স্থাপত্য চোখের পিপাসা মিটিয়ে চলেছে পর্যটকদের—সেসবের পেছনে মূলত কিছু মহান মানুষের ভাবনা-চিন্তা-উদ্যোগ- সৃজনশীলতা কাজ করে আসছে। যা দেখে ভালো লাগে—তা-ই তারা ভালোবাসেন; যাকে মনের মতো মনে হয়— তাকে মনের মিতা হিসাবে গ্রহণ করেন; যা দেখে চোখ জুড়ায়— তার প্রশস্তি রচনা করে দশজনকে শোনান। আপন সৃষ্টির গায়ে আনন্দের রঙধনু এঁকে তারা তাকে নয়নাভিরাম চেহারা দান করেন। তা দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভরে ওঠে। তাঁরা মূলত একতরফা সিদ্ধান্তে এসব করে থাকেন। ফলে বিনিময়ে কী পাবেন, কী পাবেন না, তার অগ্রিম হিসাব করেন না। আর প্রেমের তো কোনো প্রাক্কলন হয় না! তো যদি নগদানগদি কিছু পেয়ে যান ভালো। আর যদি কিছুই না জোটে, তাতেও সবখানি ক্ষতি নেই। তাঁরা নিজের সৃষ্টির গায়ে বেদনার রঙ, হৃদয়ের ক্ষরণের রস এবং মনের মায়ার প্রলেপ দিয়ে সৃষ্টিকে করে তোলেন আরও বেশি মাধুর্যমণ্ডিত—আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী— আরও বেশি রসোত্তীর্ণ।
নাইবা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার।
তোমায় আমি করব সৃজন এ মোর অহংকার।
রচব সুরধুনী তীরে
আমার সুরের উর্বশীরে
নিখিল কণ্ঠে দুলবে তুমি গানের কণ্ঠহার
কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার।।
যে নারী আনুষ্ঠানিকভাবে কবির গলায় প্রেমের মালা পরিয়ে দিতে পারেননি, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটলেও কবি তার ওপর কোনো রাগ পোষণ করেন না। কারণ, কবি তাকে ভালোবাসেন। কবিকে সেই নারী ভালোবাসেন কি না—সেটা কবির কাছে সবটুকু বিবেচ্য নয়। যে নারী কবির কাছে আসতে পারেননি—তার হয়তোবা কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল। কবি তাই তাকে আবিষ্কার করতে চান; তিনি প্রেয়সীকে গানে গানে সুরে সুরে বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত করে দিতে চান। আকাশের নীলে তার নীল চোখ, বাতাসের মর্মরে তার মধুর গুঞ্জন, সাগরের গর্জনে তার হৃদয়ের রোদনধ্বনি এবং পাখির কণ্ঠে তার কণ্ঠের সুর ব্যপ্ত হয়ে গেলে কবিরও লাভ। লাভ পাঠকেরও। আসলে মহান শিল্পী-কবিরা হৃদয়-মনে ব্যথা পেলে তারা তাদের সেই বেদনার ভূমিতে ফলিয়ে তোলেন অমূল্য শস্যের শিল্প। নজরুলের সেই গানে ফিরে এসে বলা যায় কবির প্রেম নৈর্গসিক; কিন্তু তার আবেদন যুগপৎভাবে স্বর্গমর্ত্যব্যাপী পরিব্যাপ্ত। তাই কবি তাকে স্বর্গের উর্বশী রূপে কল্পনা করেছেন; আর তাকে রচতে চেয়েছেন স্বর্গের নদী—সুরধুনী বা অলকানন্দার পাড়ে। কবি তার প্রিয়াকে এমনভাবে রচতে চান—যেন তিনি সর্বজনীন প্রেয়সী হয়ে ওঠেন। এজন্য কবি তাকে সুরের ঊর্বশী করে স্বর্গের নদী— সুরধুনীর তীরে রচনা করতে চেয়েছেন। এতে প্রেয়সী সুরে সুরে উচ্চারিত হবেন শত কণ্ঠে, লক্ষ কণ্ঠে, কোটি কণ্ঠে। আবার সে-সুরে না-পাওয়াজনিত গভীরবেদনা জড়িয়ে থাকবে বলে তা ছুঁয়ে যাবে সব মানুষের হৃদয়-মন। কারণ, সুখ সর্বজনীন নয়, কিন্তু বেদনা সর্বজনীন। এমন কোনো মানুষ নেই যিনি জীবনে কোনো না কোনো সময় বেদনার পেয়ালায় চুমু দেননি। আর গভীর বেদনার তুলির স্পর্শ ছাড়া কোনো সৃষ্টিই সর্বজনীনতার রঙে রেঙে ওঠে না। তার আবেদনও স্থায়িত্ব লাভ করে না। তাজমহল মূলত শাহজাহান এবং মমতাজ, এই দুটি মানুষের। কিন্তু তাজমহল বিশ্বের সকল মানুষের; এর পেছনেও অনেক অশ্রু, অনেক বেদনা। সৃষ্টি হিসেবে তাজমহলও অশ্রুমতী, তাজমহলও গভীর বেদনার। এবং নিখিলের সকলের সমান অংশ সেই অশ্রুতে, সেই বেদনায়। তবে এই কান্না মূলত পুরুষের। রবীন্দ্রনাথের কথায় তাজমহল হচ্ছে, ‘একবিন্দু নয়নের জল/ কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল।’ (শা-জাহান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। আর রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাজমহলের স্রষ্টা শাহজাহানকে ‘সম্রাট কবি’ এবং তাজমহলকে ‘নব মেঘদূত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন:—‘হে সম্রাট কবি / এই তব হৃদয়ের ছবি, / এই তব নব মেঘদূত, / অপূর্ব অদ্ভুত /ছন্দে গানে/ উঠিয়াছে অলক্ষ্যের পানে…/যেথা তব বিরহিণী প্রিয়া / রয়েছে মিশিয়া/ প্রভাতের অরুণ-আভাসে, / ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিশ্বাসে, / পূর্ণিমায় দেহহীন চামেলির লাবণ্যবিলাসে, /ভাষার অতীত তীরে / কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে । / তোমার সৌন্দর্যদূত যুগ যুগ ধরি /এড়াইয়া কালের প্রহরী / চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া—ভুলি নাই , ভুলি নাই, ভুলি নাই প্রিয়া!’ (শা-জাহান :রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। তো তাজমহল মূলত পুরুষের কান্নার স্মৃতিসৌধ। তাই রবীন্দ্রনাথ একই কবিতায় সম্রাট-কবি শাহজাহানকে তাঁর সৃষ্টি তাজমহলের চেয়েও মহৎ বলে আখ্যায়িত করেছেন: ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ, /তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার / বারম্বার।’
নজরুল তাঁর উপর্যুক্ত গানে বলেছেন , ‘নিখিল কণ্ঠে দুলবে তুমি গানের কণ্ঠহার/ কবির প্রিয়া অশ্রুমতী গভীর বেদনার।’ পুরুষের বেদনা তো গভীর এবং সৃজনশীল পুরুষ তাঁর সেই গভীর বেদনাকে সবার বেদনার মহান সৃষ্টিতে উন্নীত করে নিজের বেদনার ভার কিছুটা লাঘব করেন, এবং একইসঙ্গে নজরুলের এই গান হচ্ছে শব্দে ও সুরে রচিত পুরুষেরই অশ্রুর তাজমহল। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই কান্না সেই পুরুষের যিনি একাধারে প্রেমিক এবং সৃজনশীল। এ ধরনের গভীরভাবে সৃজনশীল প্রেমিক-পুরুষের সংখ্যা যেমন কম, তেমনি তাঁদের ভালোবাসার মূল্য দেয়ার মতো নারীর সংখ্যাও বিরলপ্রায়। আর তাই এধরনের পুরুষের কান্না শোনার মানুষ নেই। তাঁর কান্না শোনে সর্বসহা প্রকৃতি—আকাশ-বাতাস-সাগর-নদী: ‘তুমি শূন্য, আমি শূন্য, শূন্য চারিধার / মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার!’ (সিন্ধু: কাজী নজরুল ইসলাম)।