ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ যেভাবে ভাবতেন, পোয়েট্রি ইজ দ্য স্পনটেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস;—এ ভাবনা দীর্ঘকবিতার জন্য যথেষ্ট নয়। ভাবনাটি অবশ্যই লিরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দীর্ঘকবিতা এই পাওয়ারফুল ফিলিংসের ভেতর রিয়েলিটি দাবি করে। সেসঙ্গে দাবি করে বিস্তীর্ণ জীবনবাদী ক্যানভাস; যা থাকে উপন্যাসের ভেতর। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দীর্ঘকবিতায় উপন্যাসের প্লট ও আখ্যান থাকবে। উপন্যাস দীর্ঘ আখ্যানের আলোকে যে জীবনজিজ্ঞাসার জন্ম দেয় দীর্ঘকবিতা আখ্যানহীনতার আলোকে সেই জীবনজিজ্ঞাসাকে উন্মোচন করতে সক্ষম। বিষয়টিকে খোলসা করতে উপন্যাস এবং দীর্ঘকবিতার পাঠ নেয়া যেতে পারে।
জাঁ পল সার্ত্র-এর উপন্যাস রোডস্ টু ফ্রিডম-এর ক্যানভাস সুবিস্তৃত। উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড ‘দ্য অ্যাজ অব রিজন’; যেখানে জীবন, মনন এবং ব্যক্তি সব মিলে এক প্রচণ্ড শক্তি। সংক্ষিপ্ত তথা তাৎক্ষণিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে মহাকালের যন্ত্রণা, সব কিছুর মূলে রয়েছে ব্যক্তি মানুষ। এই মানুষ সব কিছুর নিয়ন্তা। তার কোনো পূর্বপরিকল্পনাকারী নেই। অর্থাৎ উপন্যাসপাঠে পাওয়া যাচ্ছে, মানুষ নিজেই নিজেকে তৈরি করে। নিজের সংকটে তার একমাত্র রক্ষাকারী একমাত্র আশ্রয়স্থল মানুষ নিজে। অথচ এর জন্য প্রয়োজন তার সত্তার স্বাধীনতা।
উপন্যাসের নায়ক ম্যাথু দেলারু। দর্শনের অধ্যাপক। পরিচিত জগৎ, বন্ধু-বান্ধব, ব্যক্তিগত সুখণ্ডদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-যন্ত্রণা, নাইট-ক্লাব, আর্ট-গ্যালারি, ছাত্র, ক্যাফে সোসাইটি সব কিছুর যোগফল সে নিজে এবং তার ব্যক্তিগত উদ্বেগ-ভয়। কেননা সে সমাজ কর্তৃক শৃঙ্খলিত। মার্সেলকে সে ভালোবাসে। মার্সেল অন্তঃসত্ত্বা। সুতরাং সে মার্সেলকে বিয়ে করতে বাধ্য। কিন্তু এই বাধ্যবাধকতায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে তার স্বাধীনতা। মার্সেলকে সে ভালোবাসে। সে তাকে প্রতারণা করতে চায় না। তারা একত্রে জীবনযাপন করছে অথচ বিয়ে নামক একটা সামাজিক আচার তাদের এই অবাধ ভালোবাসাকে কলুষিত করছে; করছে তাদের আত্মার স্বাধীনতাকে হরণ। তাহলে স্বাধীনতার অর্থ কী? মাই লাইফ হ্যাজ ড্রেইনড ইট ড্রাইএবং মানুষ প্রকৃত প্রস্তাবে কিছুই নয়। সে যা, সে আসলে তা-ই। ম্যাথুর ব্যক্তিজীবনের এমনি সংকটময় অভিজ্ঞতার অন্তরালে এগিয়ে আসতে থাকে মহাযুদ্ধ। আতঙ্কে গর্ভবতী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।
উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড ‘দ্য রিপ্রাইভ’; সমস্ত ইয়োরোপ অধীর আগ্রহে মিউনিখ কনফারেন্সের ফল জানতে অপেক্ষারত। অসংখ্য ঘটনা ও চরিত্র তথা সামাজিক সংকটকে সঙ্গে নিয়ে উপন্যাস এগিয়ে চলে। ঘটনার পর ঘটনা। ঘটনার ওপরে সুপার-ইম্পোজ ঘটনা। যুদ্ধ চাই। যুদ্ধ চাই না। বসে থাকে না মানুষের কাম। ম্যাথুর বৌদি ম্যাথুকে কামনা করে। অথচ ম্যাথুকে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ব্যক্তিক স্বাধীনতার পাশাপাশি নাগরিক স্বাধীনতা বিপর্যস্ত।
প্রকৃত প্রস্তাবে দেশপ্রেমের জন্যই কি যুদ্ধ? মানুষ কেন যুদ্ধ করে? কেনই বা সে মৃত্যুবরণ করে? যুদ্ধ, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ সবকিছুই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থে বেশ অর্থময় গুরুত্বপূর্ণ নীতিকথা কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হলো, ব্যক্তিক জীবন বিপন্ন। নিজের জীবন বিপন্ন। অতএব শান্তি চাই। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে শান্তি। অথচ ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। যে জার্মানদের ছিল নত শির আজ তারা উচ্চশির। ফ্রান্সের মর্যাদা, সম্ভ্রম; আসলে ওসব কিছু নয়;শুধুই যুদ্ধের করাল ছায়া। আতঙ্ক। পরাজয়ের আতঙ্ক। ইতিহাসে যাই ঘটুক না কেন, কারো কিছু আসে যায় না। কেননা ব্যক্তি বিপন্ন। অর্থাৎ যে মুহূর্তে সংকট এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায় জীবনের ঘাড়ে, তখন একমাত্র মৌলিক জিজ্ঞাসা, অস্তিত্ব বজায় রাখার সংগ্রাম।
তৃতীয় খণ্ড, ‘আয়রন ইন দ্য সোউল’-এ পরাজিত ফ্রান্স। এই পরাজয় ম্যাথুকে শিখিয়েছে কী করে মানুষকে হত্যা করতে হয়। কীভাবে ঘৃণা করতে হয়। বস্তুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে সত্য সমাদৃত তা দেশের ক্ষেত্রেও প্রতিভাত। এমনকি ইতিহাসের ক্ষেত্রেও। শুধু প্রতিভাত নয় অস্তিত্বগত স্বাধীনতার প্রশ্নে; ব্যক্তিক স্বাধীনতার প্রশ্নে।
উপন্যাসে দেখা যায় একজন চিত্রশিল্পী, যে কিনা যুদ্ধকালীন সময়ে কর্ণেল। কিন্তু এখন জীবিকাযুদ্ধে পর্যুদস্ত। তাহলে কি যুদ্ধকালীন সময়ই শ্রেয়? কেউ কাউকে সাহায্য করে না; নেশন অর সিটিজেন, ইটস দ্য সেইম থিঙ্ক; এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ;অথচ যুদ্ধের দায়িত্ব কারো একার নয়। ইতিহাসের দায়ভার ব্যক্তির একার নয়। পরাজয় এবং মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ম্যাথু যুদ্ধ করলো। হত্যা করলো। এবং জীবনের শুরু থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে বলি দিয়ে চলেছে সে।
এই হচ্ছে একটা মানব জীবন; যা আমাদেরকে ভয়ানকভাবে ভাবাতে থাকে। হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা ভাবতে থাকি এবং শিহরিত হই। শিহরিত হই জীবনের প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে। যে বাস্তবতা উঠে এসেছে শিল্পের বাস্তবতা থেকে। অ্যারিস্টটল যাকে বলেছিলেন, পোয়েটিক ট্রুথ; যে সত্যের স্থান ইতিহাস বা বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ The truth of poetry is not a copy of reality, but a higher reality, what ought to be, not what is.
ঐতিহাসিক অথবা ভৌগোলিক সত্যের ঊর্ধ্বে শিল্পের সত্য যে প্রজ্ঞার জগতে আমাদের পৌঁছে দেয় তা-ই শিল্পের সারাৎসার; যা আমরা উল্লিখিত উপন্যাস পাঠে পেয়েছি। ঠিক এই একই সত্যের মুখোমুখি হই আমরা দীর্ঘকবিতা পাঠে। অথচ সেখানে উপন্যাসের ধারাবাহিক ঘটনাক্রম অনুপস্থিত। অনুপস্থিত থাকে চরিত্রসমূহের সুবিস্তারিত বিকাশ ও পরিণতি। তারপরও উপন্যাস শেষাবধি শিল্পের যে ফলাফল বহন করে, সেই ফলাফলকে ধারণ করতে সক্ষম দীর্ঘকবিতা। কেননা দীর্ঘকবিতার ভেতর থাকে অতিসত্যের জগৎ, যা কিনা লিরিকে অনেকাংশেই সম্ভব নয়। অথবা সম্ভব হলেও তা থাকে আংশিক ও খণ্ডিত অর্থে। কিন্তু দীর্ঘকবিতায় যে অতিসত্যের ছায়াপাত ঘটে তাকে হাডসনের ভাষায় বলা সম্ভব, By poetic truth we mean fidelity to our emotional apprehension of fact…our first test of truth in poetry, therefore, is its accuracy in expressing, not what things are in themselves, but their beauty and mystery, their interest and meaning for us।
উপন্যাসের মতো দীর্ঘকবিতার ভেতর এই অতিসত্যের জগৎ কীভাবে ক্রিয়াশীল তা খতিয়ে দেখতে আমরা কাহ্লিল জিবরান-এর দীর্ঘকবিতা ‘দ্য লোনলি পোয়েট’কে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। কবিতাপাঠে পাওয়া যায়, এই মর্ত্যলোকে কবি একা অচেনা একজন আগন্তুক। যিনি বান্ধবহীন; যিনি মানুষের মাঝে বসবাস করা সত্ত্বেও রয়েছেন নির্বাসনে। এখানে লক্ষযোগ্য একটি চরিত্র, যিনি সমাজের মাঝেই নির্বাসিত। এই রূপকল্প আমাদেরকে একটি চেতনাগত অতিসত্যের জগতে নিয়ে যাবার সিড়ি নির্মাণ করে দেয়। কবিতার নিঃসঙ্গ মানুষটি নিজের সঙ্গে প্রশ্নবানে জর্জরিত। তিনি কেন এই মর্ত্যলোকে? আরও একটি চরিত্রের উদ্দেশ্যে এই নিঃসঙ্গ চরিত্রটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘সে কে এবং কেনই বা এখানে? কী করে জানবো কে সে? আর সখ্যতার কোন সূত্রই বা আমাদের সম্পর্কের বন্ধন?’
একাকি নিঃসঙ্গ চরিত্রের ওপর একে একে ভর করে জীবন জগৎ ইহোকাল পরকালসহ যাবতীয় রহস্যময় কাক্সিক্ষত প্রশ্নমালার পাহাড়। সুতরাং তার জীবন দুর্বিসহ। চরিত্রটি ডুবে থাকে একাকিত্বে। সে একা এই কারণে যে, ট্রাডিশনাল সমাজ তাকে কমিউনিকেট করতে অক্ষম। যেমনটা দেখা যায় আলবেয়ার ক্যামুর মারসো চরিত্রের ক্ষেত্রে অথবা কাফকার গ্রেগোর ক্ষেত্রে; সুতরাং যন্ত্রণা অনিবার্য। অনিবার্য সমাজ বাস্তবতা। অনিবার্য ধ্যান। সুতরাং মগ্নতা। মগ্নতায় মুগ্ধতা। পার্থিব চক্ষুদ্বয় দিয়ে আপাতসত্যের ঊর্ধ্বে যে অতিরিক্ত সত্যের জগৎ রয়েছে তাকে অবলোকন সম্ভব নয়। সুতরাং এই পার্থিব চক্ষুদ্বয়কে অস্বীকার করে কাহলিল জিবরানের ‘দ্য লোনলি পোয়েট’ এর চরিত্রটি অতিসত্যের জগতে পরিভ্রমণ করতে শুরু করলো তার অন্তর্চোখ দিয়ে। পাশাপাশি পাঠকের মধ্যেও উন্মোচিত হতে থাকে সেই অলীক চোখ যার সাহায্যে সে অতিসত্যের মুখোমুখি হবার এক রহস্যময় অনুভূতি লাভ করতে থাকে। সুতরাং পাঠক এই দীর্ঘকবিতার চরিত্রটির সঙ্গে ক্রমশ অমৃতলোকে আত্মগত হন; লীন হন মহামগ্নতায়।
চারিদিকে হাসি এবং কান্না। ক্রমশ সাহসের হট্টগোল। সুতরাং ভয়। মানুষের আত্মা সংকুচিত হয়। হৃদয়ের কাছে ফিরে আসে মানুষ। ফিরে আসে অস্তিত্বের কাছে; স্বকীয় চেতনার কাছে। অথচ তারপরও ব্যক্তি অস্তিত্বের স্বাধীনতার টানাপোড়েনে চরিত্রগুলো নৈঃশব্দ্যে কাঁপতে থাকে। ক্রমশ অচেনা। অচেনা শরীর ও চিন্তা। চিন্তা ও শরীর। এবং আমরা আমাদের এই দুই সত্তার কাছেই আগন্তুক। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অমোঘ আয়নার সম্মুখে। যে আয়না আমাদের দেখিয়ে দেবে আমাদের অন্তর্গত সত্যের জগৎ। যা কেউ খুঁজে পায় না; যা শুধু দেখতে সক্ষম আমাদের আত্মা। অথচ আমার আত্মার মাথা নোয়াবার মতো পৃথিবীতে নেই কোনো নিশ্চিন্ত স্থান। মানুষেরা অনুসন্ধানরত। তন্ন তন্ন করে পৃথিবীকে ছিড়ে খুঁড়ে খুঁজে পেতে চায় তার প্রকৃত আবাসভূমি। অথচ আমার মুখোমুখিতে দাঁড়াবার মতো কোনো মানুষ পাই না আমি। না পাই অন্তত এমন একজন মনোযোগী শ্রোতা, যে পারে খুলতে আমার মননের দ্বার।
প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ মানুষের কাছে শৃঙ্খলিত। তার সত্তার সমস্ত গোপন অনুভূতি আদৌ ভাষা পায় না; অথবা ভাষা পায় না এমন কোনো সত্যভাষ্য যা দিয়ে সে নিজের অহমকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারে; বরং সবকিছুই শৃঙ্খলিত। সুতরাং মানুষেরা অন্ধ। অন্ধ মানুষটি হেঁটে যায় শহরের কোলাহলে। পিছে লাগে বালক-বালিকার দল। চিৎকার। হট্টগোল। নাগরিক মানুষের সন্তানেরা বলতে থাকে, ‘দেখ! এক অন্ধ মানুষ। চলো তার হাতে তুলে দেই একখানা সাদাছড়ি যাতে সে খুঁজে পায় পথ।’ আর শহরের সব সুন্দরী কুমারীদের বলতে শোনা যায়, ‘ইস্! লোকটা পাথরের মতো বধির! এসো আমরা ওর কর্ণকুহরে ঢেলে দেই ভালবাসার গান।’
এ পর্যন্ত পাঠ করে পাঠক পৌঁছে যান এক অতিসত্যের সত্যভাষ্যে। যে সত্যভাষ্য নান্দনিক সৌন্দর্যের আধারে প্রতীকী পবিত্রতার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে। মানুষ পালাতে চায় সমাজ থেকে। অনাকাঙ্ক্ষিত সমাজ, রাষ্ট্র ও ইতিহাসের বলি হতে বাধ্য যে মানুষ সেই সার্তের উপন্যাসের ম্যাথুর মতো এই দীর্ঘকবিতার চরিত্রগুলোও ক্রমাগত অনুসন্ধান করে ফেরে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য। আর এই তাৎপর্য অনুসন্ধান তাদের পৌঁছে দেয় নিদ্রাহীন চোখের দেশে। যেখানে ঝুলে থাকে অসংখ্য প্রতীক। কিলবিলে বিষধর সাপ জ্বীন ভূত আর গিজগিজে কীট। অর্থাৎ আমরা মানুষেরা বাস করি যুগপৎ স্বর্গ এবং নরকের ভেতর।
মানুষ এক নিঃসঙ্গ চরিত্র। সে মরুপ্রায় তৃণভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় দ্রুততম এক ক্ষুদ্র নদী। পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়া থেকে যে নদী নিরন্তর ছুটে চলেছে উপত্যকার গভীরতম প্রদেশে। এই পৃথিবী ভ্রমণরত একাকি নিঃসঙ্গ মানুষগুলো সহসা দেখতে পায় ঊষর বৃক্ষগুলো মুহূর্তে পূর্ণ হয়ে গেল পাতায় পাতায়। অতপর কুঁড়ি ফুটে উঠলো ডালে ডালে। আর মুহূর্তেই কুঁড়ি থেকে ফুল; ফুল থেকে ফলে ফলে ভরে গেল ডাল। অথচ তখনই ডালগুলো ভেঙে গিয়ে রূপান্তর হল চকড়াবকড়া দীর্ঘ দীর্ঘ সাপে। অর্থাৎ উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ যখন উৎপাদনে সফলতা অর্জন করে তখন ওই উৎপাদিত ফসলের সুফল তাদের কাছে মুহূর্তেই বিষধর সাপে পাল্টে গিয়ে তাদেরই স্রষ্টা, মানুষকেই ছোবল হানে।
ফসল হয়ে যায় পণ্য। পণ্যের সুফল ভোগ করে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকশ্রেণী নয়; বরং ভোগ করে বেনিয়া শ্রেণী; চাঁদ সওদাগর অথবা লখিন্দরের বিলাস। সুতরাং ভ্রমণরত কর্ষণরত বঞ্চিত নিঃসঙ্গ মানবগোষ্ঠী শুনতে পায় বিষণ্ন সঙ্গীতে বিলাপরত পাখিগুলো শূন্যে উড্ডীন। টানটান ডানায় পাখিগুলো উড়ে যায়। অতপর প্রতীকাশ্রয়ী জাদুবাস্তবতা। পাখিরা দীর্ঘকেশী বিবস্ত্রে অপরূপ নারীতে রূপান্তরিত হয়। ওরা সুরমা আঁকা মুগ্ধ গদগদ চোখে তাকায় সেই নিঃসঙ্গ চরিত্রটির দিকে। মধু জড়ানো সকৌতুক ঠোঁটে পরিহাচ্ছলে ওদের সুগন্ধীমাখা হাত নিঃসঙ্গ মানুষটির দিকে প্রসারিত হয়। ওদের তীব্র মোহময় কটাক্ষ আর কৌতুকপ্রদ লাস্যময় পরিহাসের ব্যঞ্জনা আকাশে আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। অতপর ওরা অলীক অশরীরীর মতো মুছে যায় দৃশ্যপট থেকে।
এভাবেই স্বর্গদৃশ্যের মোহে মানুষ ভ্রমণে ভ্রমণে একদিন মুছে ফেলে নিজেদের। মুছে যায় জীবন। অতপর তারপরও এই সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে মানুষ প্রজ্ঞা অনুসন্ধান করে; শান্তি অনুসন্ধান করে। এখানেই মানুষের প্রকৃত যুদ্ধ এবং অতপর আবারো মানুষের জন্ম হয় তার পুত্রের মাঝে। যদিও মানুষ জানে সে জাতিস্মর নয়। তবুওতো তৃপ্তি। যতটুকু জীবন ততটুকু জীবনভর এক মানবীয় তৃপ্তির খোঁজে মানুষ ক্রমাগত হাঁটতেই থাকে। এ পর্যায়ে এসে এই ভাবময় ঐক্যসূত্রের দ্যোতনায় প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে ইন্টারপ্রিটেশান অব লাইফ।
দীর্ঘকবিতায় ছোটগল্পের মতো জীবনের ক্ষণমুহূর্তের পূর্ণরূপ উদ্ভাসনের ফলে পাওয়া যাচ্ছে জীবন বিশ্লেষণ বা জীবনব্যাখ্যা। ফলশ্রুতিতে পাঠক অনিবার্য এক জীবনজিজ্ঞাসার সম্মুখিন হন। এই জীবনসত্য উন্মোচনে পাওয়া সম্ভব কবির ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য। কবির শ্রেণীগত অবস্থান। মতাদর্শগত বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা ও মানসিক গঠন। সর্বোপরি দেশ-কাল ও আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গ কবির দীর্ঘকবিতায় প্রভাব বিস্তার করে। লিরিকে যা সার্বিক অর্থে সীমিত। বলা চলে অনেকটা অসম্ভব। কেননা লিরিক হচ্ছে, কবির একান্ত ব্যক্তিগত বাসনা কামনা ও আনন্দ বেদনার ছন্দায়িত প্রকাশ। প্রকৃত প্রস্তাবে কবির হৃদয়জাত অনুভূতি যখন পাঠকের অনুভূতিলোকে সংবেদনশীলতার আলোকে সিম্ফনী জাগাতে সক্ষম হয়, তখন তা গীতিকবিতার পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধুমাত্র কবির নিজ অন্তরের বোধটুকু পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই এই কবিতার উদ্দেশ্য। শুদ্ধসত্ত্ব বসু যেভাবে বলতে চেয়েছেন, ‘গীতি-কবিতায় কবি তাঁর মানসিক অনুভবের একটা দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটান মাত্র, তাঁর আবেগে যে অনুরণন ধ্বনিত— তাতে পূর্ণতার আস্বাদ যে থাকবে— এমন কথা নেই, একটুখানি ইঙ্গিত, ব্যঞ্জনার একটি অভিভাবের বাঙ্ময় রূপায়নই যথেষ্ট।’ সুতরাং দীর্ঘকবিতা আর গীতিকবিতার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে একটি পরিষ্কার দূরত্ব।
Palgrave তাঁর Golden Treasury of Songs and Lyrics-এর ভূমিকায় লিখেছেন, A lyric poem shall turn on some single thought, feeling or situation; একইভাবে সমালোচক Henley বলেছেন, A lyric is a single emotion temperamentally expressed in terms of poetry; কিন্তু দীর্ঘকবিতার ক্যানভাস সিঙ্গল ইমোশান অথবা সিঙ্গল থট দিয়ে নির্মাণ অসম্ভব। দীর্ঘকবিতা ব্যক্তিগত প্রলাপন মাত্র নয়। দীর্ঘকবিতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে পাঠক, পাঠকের সময় ও সমাজ তথা ব্যাখ্যাতীত রহস্যের ইঙ্গিতভাষ্য; ছায়া-প্রতিচ্ছায়া, অনুভূতি ও অসংখ্য চরিত্রঘেঁষা অনুষঙ্গ তথা তীব্র লক্ষভেদি মেসেজ; যে মেসেজগুলো অনেক সময় কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছে না দিলেও অন্তত দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করবে আপাত সত্যের ওপিঠে কী সেই অতিসত্যের স্বরূপ-তাৎপর্য। যা লিরিকে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় মন্ময় কবিতা, তন্ময় কবিতা অথবা বৈষ্ণব কবিতা, রূপক কবিতা, গাথা কবিতা অথবা প্যাস্টোরাল কবিতা অথবা মহাকাব্য, যাই বলি না কেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি ফর্মের মধ্য দিয়েই আসলে খণ্ড খণ্ড ভাবে আর্টের স্বরূপকে ধারণ করা হয় মাত্র। কিন্তু দীর্ঘকবিতা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের প্রচেষ্টায় লিপ্ত। দীর্ঘকবিতা সার্বিক জীবন জীজ্ঞাসাকে সমন্বিত করার কাজে ক্রিয়াশীল। যা করে থাকে উপন্যাস। কিন্তু মনে রাখতে হবে উপন্যাসের প্রকরণে নয় বরং কবিতার প্রকরণে উপন্যাসের নান্দনিক রেজাল্ট উপস্থাপনের চেষ্টা দীর্ঘকবিতায় লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে ছোটগল্পের সঙ্গে গীতি কবিতা এবং উপন্যাসের সঙ্গে দীর্ঘকবিতাকে তুলনা করা সম্ভব।
দীর্ঘকবিতা গীতিকবিতার বিষয়গত ও পরিমাণগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে ইচ্ছুক। দীর্ঘকবিতা অনুসন্ধান করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমাজ পরিবেশে, সমকালীন পারিপার্শ্বিকতা, নিসর্গপ্রকৃতি তথা মহাবিশ্বলোকের উদার ক্যানভাসে ব্যক্তিচৈতন্যের মুক্তি। এই মুক্তির প্রশ্নে উঠে আসতে পারে অনিবার্য জিজ্ঞাসা। যেমন: শিল্প কি শুধুমাত্র নান্দনিক স্ফূর্তি? নাকি এর রয়েছে কোনো বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য? শিল্প কি শুধুই দর্পণ, যাতে প্রতিফলিত হয় মানবজীবন? নাকি এরও অতিরিক্ত কিছু? শিল্প কি শুধুই Criticism of life? নাকি এর বাইরেও সে কাজ করে থাকে? শিল্প কি একইসঙ্গে শিল্প নির্মিতি ও তত্ত্ব প্রচার, প্রকরণ ও প্রতিপাদ্যের এক সুষ্ঠু ভারসাম্য? নীতি-নৈতিকতা তথা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে শিল্পের সম্পর্কটি কোথায় কীভাবে ক্রিয়াশীল? শিল্পকর্মের মূল্যায়ন কি শুধুমাত্র তার নান্দনিক তথা প্রকরণগত উৎকর্ষের মাপকাঠিতে বিবেচ্য, নাকি এর সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে সমাজ ও মানুষকে? শিল্পের চূড়ান্ত গন্তব্য কি শুধুই সত্য অন্বেষণ নাকি শুধুই আনন্দ আহরণ?
শিল্পকে আশ্রয় করে চিরকালীন এই অমীমাংসিত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক দীর্ঘকবিতা। যার বিশাল পটভূমিতে ক্রমাগত চিত্রিত হতে থাকে মানুষের জীবন, প্রবাহমান জীবন ও গতিরেখা তথা জীবনের অনিবার্য প্রশ্নসমূহ। যা কিনা শেষাবধি এক জন্মে অমীমাংসিতই থেকে যায়। অথচ বিশাল মানব প্রজন্মের অসংখ্য জিজ্ঞাসাকে উষ্কে দিতে দীর্ঘকবিতা নিজেকে আর লিরিকে আটকে রাখতে চায় না; প্রবেশ করতে চায় নদী থেকে সমুদ্রে। সমুদ্রের রহস্যঘন বিস্ময়ে ভরপুর অনিবার্য এক সম্ভবনাময়ী ঐশ্বর্যপূর্ণ জগতের কাছে। কেননা প্রসঙ্গত এ কথা বলে রাখা সমীচীন যে, আধুনিক সভ্যতায় জটিল মানব প্রজন্মের জটিল সমাজ ব্যবস্থায় গীতিকবিতা এখন আর কবির সার্বিক প্রজ্ঞার জগৎকে ধারণ করতে বা প্রকাশ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং সময়ের প্রেক্ষাপটে গীতিকবিতার যাত্রা এখন দীর্ঘকবিতার দিকে। যা কিনা শুধুমাত্র আয়তনেই দীর্ঘ নয় বরং বিষয়বৈচিত্র্যে, অর্থব্যঞ্জনায় তথা ভাববক্তব্যেও বিশাল।
সুতরাং দীর্ঘকবিতা স্বাভাবিকভাবেই একইসঙ্গে উপন্যাস ও কবিতার স্বাদ দিয়ে থাকে। যা কিনা লিরিকে অসম্ভব। তবে স্বীকার্য, যে কবিতাকে আমরা লিরিক হিসেবে জানি অথচ তার ভেতর রয়েছে উপন্যাসসুলভ ভাবব্যঞ্জনার বিশালতা তথা কবিতার ঐন্দ্রজাল, তা অবশ্যই দীর্ঘকবিতার দাবিদার। তা আয়তনে ছোট হলেও দীর্ঘকবিতা। তার বিষয়বক্তব্যের গভীরতা ও বিশালতার কারণে তা আর লিরিক নয়। কিন্তু আয়তনে বিশাল হয়েও বিষয় ও ভাববক্তব্যের সীমাবদ্ধতার কারণে এবং কবির একান্ত ‘ব্যক্তি-আমি’র উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণে তা দীর্ঘকবিতা না হয়ে হতে পারে বড় কবিতা। অবশ্যই তা দীর্ঘকবিতা নয়।
দীর্ঘকবিতার চরিত্রকে আরও কিছুটা পরিষ্কার করার লক্ষ্যে ওক্টাভিও পাজ-এর দীর্ঘকবিতাকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে দীর্ঘকবিতার গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু লক্ষণ আবিষ্কার করা সম্ভব। এ কথা স্বীকার্য যে, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে পাজের কবিতা অগভীর জটিলতাকে পরিহার করে ক্রমশ গভীর ঘনত্ব অর্জনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। যা কিনা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকবিতার স্বাক্ষরবাহী। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, দীর্ঘকবিতা শুধুমাত্র বিশাল প্রেক্ষাপটে সমাজ বাস্তবতার বহুবিধ অনুষঙ্গকেই চিত্রিত করে না বরং এই চিত্রণের জন্য প্রয়োজন আরেকটি অপরিহার্য শর্ত, সেটি হলো নান্দনিক পরিশুদ্ধতা।
এড্গার এলেন পো, স্তেফান মালার্মে, র্যাঁবো, অস্কার ওয়াইল্ড প্রমুখ শিল্পী জীবনবাস্তবতার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ককে পৃথক করে, এমনকি শিল্পের ব্যবহারিক উপযোগিতার যাবতীয় প্রত্যাশাকে অস্বীকার করে এমন এক শিল্পের কথা বলতে চেয়েছিলেন যেখানে থাকবে শুধুই বিশুদ্ধ নান্দনিকতা। অথচ বাস্তবে শিল্প শুধুই নান্দনিক কলা কিনা এ জিজ্ঞাসারও সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘকবিতা এ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে না বরং বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে শিল্পের ব্যবহারিক প্রতিক্রিয়াকে যাচাই করে দেখতে ইচ্ছুক। ফলে দীর্ঘকবিতা নিছক কবির আবেগ-সৌন্দর্যমাত্র নয় বরং দীর্ঘকবিতা সমাজ প্রণোদিত সত্যভাষ্যের প্রতিরূপও বটে। যা পাঠককে একইসঙ্গে উপন্যাস এবং কবিতা পাঠের আনন্দ দিতে সক্ষম।
দীর্ঘকবিতার প্রধান ও প্রথম শর্ত হচ্ছে, এর প্রেক্ষাপট ও বিষয়বক্তব্যকে হতে হবে বিশাল। যা কখনোই গুটিকয়েক অনুষঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং বিস্তৃর্ণ ক্যানভাসের মধ্যে চিত্রিত হয়ে থাকে সহস্র চিত্রকল্প, অনুষঙ্গ, ঘটনা ও ঘটনার পুনঃসংস্থাপন। দীর্ঘকবিতার ভেতর এমন একটি বিশাল প্রেক্ষাপট নির্মাণ করতে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় অজস্র চরিত্র, উপচরিত্র। কখনো বা কেন্দ্রীয় চরিত্র, পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ চরিত্রসমূহ। যে চরিত্রগুলোকে আপাতভাবে মনে হতে পারে বিচ্ছিন্ন অথবা ঘটনা পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্রবিহীন; অথচ গভীর পাঠে চরিত্রগুলো ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। প্রকৃত প্রস্তাবে দীর্ঘকবিতাতে প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে প্রতিটি চরিত্রের রয়েছে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র। এরপরও মনে রাখতে হবে ছোটগল্পের মতো অথবা উপন্যাসের মতো চরিত্রগুলো কবিতামধ্যে প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য নয় বরং পরোক্ষভাবে চরিত্রগুলো পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র; অনেকটা ছায়া-উপচ্ছায়ার মত। এক্ষেত্রে চরিত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ঘটনাক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে দীর্ঘকবিতা বাধ্য নয়। কেননা কবি উপন্যাস বা গল্প লিখছেন না।
একইভাবে অজস্র চরিত্রের আশ্রয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয় অসংখ্য আপাত বিচ্ছিন্ন গল্প, গল্পের অনুষঙ্গ, কূটাভাষ, ঘটনার অনুষঙ্গ, অনুষঙ্গাশ্রয়ী চিত্রকল্প। যাকে কিনা পৃথক পৃথক উপস্থাপনা বলে হোঁচট খাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘকবিতা পাঠে পাঠক শেষাবধি বুঝতে পারেন, প্রতিটি চিত্রকল্প, ঘটনা বা গল্পইঙ্গিতের মধ্যে রয়েছে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র; যা শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকবিতার বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে উপনীত করে। ফলে অনিবার্যতই সৃষ্টি হয় অতিবাস্তব প্রজ্ঞার জগৎ। ঠিক একই ফলাফল ট্রাজেডি অথবা মহাকাব্যের ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে দীর্ঘকবিতার সঙ্গে মহাকাব্যের অথবা ট্রাজেডির মৌলিক পার্থক্য, মহাকাব্য অথবা ট্রাজেডির জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হয় একটি নির্দিষ্ট আখ্যানের কিন্তু দীর্ঘকবিতার ক্ষেত্রে তার দরকার হয় না। দীর্ঘকবিতা সচেতনভাবে ছোটগল্প-উপন্যাস-মহাকাব্য-আখ্যানকাব্য-গাথাকবিতা অথবা নাটকের মতো একটি সুনির্ধারিত কাহিনিকে পরিত্যাগ করে অগ্রসর হয়। অথচ তারপরও আখ্যানধর্মী সাহিত্যের ভেতর যে শিল্পরস বা যে ফলাফল পাওয়া সম্ভব তা সৃষ্টি করতে দীর্ঘকবিতা সক্ষম। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য ওক্টাভিও পাজ-এর দীর্ঘকবিতা ‘সৌরপ্রস্তর’-এর সুবিশাল ক্যানভাসে আমরা আমাদের প্রজ্ঞানির্ভর বোধকে কার্যকর করতে পারি।
পরিবেশ নির্মাণ তথা চিত্রকল্পের আশ্রয়ে ঘটনার ইঙ্গিত প্রদান এবং গুটিকয়েক চরিত্রের আনাগোনা, সেসঙ্গে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেসেজ পাওয়া যাচ্ছে কবিতার শুরুতেই। যেমন, স্ফটিক উইলো, জলের পপলার, উঁচু ঝরনার ওপর বাতাসের ধনুক আর এদিকে বৃক্ষদের শেকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। অর্থাৎ আমাদের শেষাবধি শেকড়ের নিকটই প্রত্যাবর্তন করতে হচ্ছে। যদিও নদী এগুতে থাকে। অগ্রসর হয় নক্ষত্রের নির্বিকার গতিপথ অথবা যদিও শোনা যায় উপচে পড়া জলের তরঙ্গে দৈববাণী। সারারাত। অথবা প্রতিটি দিন। সবকিছুকে নিয়ে অক্ষয় সবুজের দুর্নিবার আধিপত্য আর বিশাল উদার আকাশে পাখনার পর পাখনা সতেজ আলোর মতো ঝলমলে দৃশ্য। অতপর এমন ইঙ্গিতময় ছবির ভেতর প্রবেশ করে গুটিকয়েক পরোক্ষ চরিত্র। যারা বনের ভেতর অনাগত দিনের পথ নির্মাণে বিভোর। তাদেরকে ঘিরে থাকে বিষণœ দুঃখের সমারোহ।
অতপর জ্বলন্ত অট্টালিকার ছবি ভেসে উঠতে দেখা গেল। দেখা গেল পৃথিবীর বুকে ভাসমান সমুদ্র আর বাতাসে ভাসমান পর্বত। আলোর বিভাজন। আলোর জঙ্ঘা। আলোর তলপেট। উপসাগর। সৌরপ্রস্তর। আলোর মেঘবরণ শরীর। প্রাণবন্ত আলো। লাফ দিয়ে ওঠে দিনের রঙ। ঝকমক করে ওঠে প্রহরের পর প্রহর। দৃশ্যমান জগৎ যেন তোমার স্বচ্ছতায় স্বচ্ছ। অর্থাৎ কবিতাতে আরও একটি পজেটিভ চরিত্রের আগমন ঘটতে দেখা গেল। অতপর পৃথিবীর প্রতিটি শব্দ কবির নিকট এক একটি স্বয়ম্ভূ চরিত্র। অর্থাৎ প্রতিটি শব্দ যা কিনা শেষাবধি একটি স্বয়ম্ভূ কবিতা। পাজ-এর উক্তি অনুসারে এই কবিতা হচ্ছে হারানো মানুষের অনুসন্ধান। পরাবাস্তববাদের প্রঘোষক আন্দ্রে ব্রেতোঁর মতো পাজও মনে করেন, (যদিও পাজকে পরাবাস্তববাদী কবি বলা যৌক্তিক নয়) কবিতা হচ্ছে অহম্ এর আত্মরক্ষার নিয়ামক। এক্ষেত্রে কোনো ধর্ম নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষ নভোচারিতা। ধর্মের ভেতর থাকবে না কোনো ঈশ্বরবোধ।
অথচ রহস্যময় ধর্মীয় চেতনায় যে অসীমের প্রতি আকুলতা লক্ষ করা যায়, সেই আকুলতা পাজ-এর দীর্ঘকবিতার একটি ঐক্যসূত্রও বটে। যদিও এক্ষেত্রে ইপ্সিত গন্তব্য স্বর্গপ্রাপ্তি নয় অথবা নয় কোনো নির্বাণ লাভ তথাপি ইন্দ্রিয়গোচর জগতের ভেতরে ও বাইরে যে অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জগৎ আছে, সেই জগতের অস্তিত্বকে অবয়ব দিতে পারার কারণেই পাজ-এর দীর্ঘকবিতার অভিব্যক্তি এত বিশাল; যে বিশালতার ভেতর রয়েছে মানব সভ্যতার রূঢ় বাস্তবতার আকুলতা; আর এই ধরনের আকুলতাকে পাঠক উপভোগ করেন দীর্ঘকবিতাপাঠে। এবং এই অনুভূতির উৎস হচ্ছে জগৎ ও জীবন। সুতরাং পাজ নিশ্চিত বিশ্বাসে উচ্চারণ করেন, কবিতা এবং জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শ্রেষ্ঠ কবিতার জীবন্ত চিত্রকল্প ব্যবহারিক জীবন ও কর্ম অভিব্যক্তিরই ফসল। সুতরাং,
তুমি সমুদ্র আক্রান্ত এক নগরী
আলোয় বিধ্বস্ত এক গড় কেল্লার,
টসটসে পীচ ফলের রঙ দু’ভাগ হয়ে যায়,
লবণ পাথর আর পাখির এলাকায়
উদাসীন দুপুরের রাজত্বে,
(হায়দার আলী খান অনূদিত)
এরপর কামনার রঙে সেজে ওঠে একটি চরিত্র। যে কিনা কবির চিন্তার মতো নগ্ন হয়ে উঠতে ইচ্ছুক; ইচ্ছুক, চোখজোড়াকে সমুদ্র বানিয়ে ফেলতে। এবং যে চোখজোড়ায় বাঘেরা স্বপ্নের সুধা পান করে; আর ঐ চোখের জ্যোতিতে পৃথিবীর তাবৎ গানের পাখিগুলো পুড়ে পুড়ে আত্মাহুতি দেয়। অতপর দৃশ্যপটে একটি চাঁদ প্রবেশ করে। কাহিনি দানা বেঁধে ওঠে। ইঙ্গিত তীব্রতা লাভ করে। ক্রমশ কবিতার ক্যানভাস ছড়াতে থাকে। অতএব অবশ্যই কবি তার কাক্সিক্ষত নারীর চিন্তার ভেতরে প্রবেশ করেন এবং কবি স্বপ্নের মতো নারীর তলপেটের খুব কাছাকাছি ঘন হয়ে আসেন।
আর এদিকে সারাদেশময় শস্য বোনা শ্যামল ঘাঘরার ঢেউ। সঙ্গীত গীত হয় এবং প্রিয় রমণীর ওষ্ঠাধার, ঘন কালোচুল আর চোখের দৃষ্টি সরারাত… রাতভর… দিনভর…; জলেরও শেকড় আছে আর কবির বুক উন্মুক্ত হয়, উলঙ্গ হয়। অতএব প্রিয় মেয়ে বৃষ্টি হয়ে কবির ত্বকের ওপর ঝরে পড়তে থাকে। সুতরাং কবির বুকের গভীরে তরল এক গাছের জলীয় শেকড় গজাতে শুরু করলো। এবং কবির নিঃসঙ্গ একাকি শরীরী প্রতীকের মাধ্যমে ক্রমাগত উন্মোচিত হতে থাকে দেশ-কাল-পাত্র আর কূটাভাষ দ্বন্দ্ব। সুতরাং ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের সত্তা। সুতরাং মানুষগুলো অশরীরী পথ হাতরায়।
চরিত্রগুলো নস্টালজিয়ায় হাবুডুবু খায়। পচা গ্রীষ্ম, অতীত পিপাসা, ছায়ার মতো একটি মুখ মনে পড়তেই আবার হারায়। একটি হাত, আঁকড়ে ধরতেই চুরচুর হয়ে যায়। অপরিচিত হাসি যেন মাকড়সার জাল। তারপরও বছর পার হয়। আয়নার প্রতিবিম্বে ভেসে ওঠা মুখায়ব ভেঙে টুকরো টুকরো; রাস্তায় পড়ে থাকে। বিকেলের সূর্য লুকিয়ে যায় কোথাও। ফেটে পড়া আঙুর ফলের ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েরা বেরিয়ে আসে। স্কুলের আঙিনায় মেয়েগুলো ছড়িয়ে পড়ে। আর ওদের মধ্যে একজন, যে কিনা দীর্ঘাঙ্গী সে আলোর শিশমহল ধরে হেঁটে গেলে শূন্য প্রান্তর ওকে জড়িয়ে ধরে টেনে নিল আত্মার গভীরে।
রবীন্দ্রনাথের মতো অথবা র্যাঁবোর মতো ওক্টাভিও পাজও মনে করেন, ইন্দ্রিয়কে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করে তোলার প্রচেষ্টাতেই কবিতার উদ্ভব। এই উদ্ভাবনা দীর্ঘকবিতার ক্ষেত্রে বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শময় জগৎ নিয়ে নতুনভাবে ধরা দেয়। অর্থাৎ বাস্তব জগতের বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ কবির শরীর ও মন থেকে কবিতার শরীরে সংক্রামিত হয়। কবির চোখ যেন কলমেরই চোখ। জন্ম হয় আরও নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির। সুতরাং এ কথা বলা সম্ভব, চিরন্তন এবং ধ্রুব আমাদের ইন্দ্রিয়ের বাইরে নয় বরং তা ইন্দ্রিয় দ্বারা স্পর্শযোগ্য এবং যাকে অবশ্যই কবিতাতে স্থানান্তর করা সম্ভব। যেমনটি ঘটতে দেখা যায় পাজ-এর দীর্ঘকবিতায়।
কুয়াশার স্তম্ভ। পাহাড়ি ঝর্ণা। চাঁদের চকোরী। ঈগল পাখির বাসা। সাগরের নিচের উপত্যকায় রাখালি বালিকা এবং প্রেতলোকের দ্বার রক্ষিণী। অসংখ্য ছবি মিলে জন্ম নেয় জীবন্ত কিছু চরিত্র। চরিত্রদের ঘিরে তৈরি হয় উপগল্প। উপগল্পে দেখা যায় খাড়া পাহাড়ের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে একটি চিতা। সেখানে দ্রাক্ষালতার পাশাপাশি বেড়ে উঠছে বিষাক্ত উদ্ভিদ আর স্বর্গীয় ফুলের অন্তরালে রসে টইটম্বুর আঙুর। দৃশ্যপটে ভেসে উঠতে দেখা যায় বিদ্যুতে তৈরি রমণীদের। জেসমিনের বাগান ভরে যায় আলোতে। গুলি খেয়ে আছড়ে পড়া যুবকের ক্ষত থেকে নুন ঝরছে। গোলাপের ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে আর আগস্ট মাসের তুষার পাতের ভেতর দেখা গেল ফাঁসিকাষ্ঠে লটকানো একখানা বিবর্ণ চাঁদ।
অতপর সমস্ত নগরময় যন্ত্রণা। মরুভূমি থেকে এক বুক ভাষা নিয়ে বাতাসেরা ভেসে আসতে থাকে। বাতাসে ভেসে ওঠে সভ্যতার শেষ সৌরলিপি; যা কিনা বেদনা অথবা গম অথবা যবের আগুনের সমান্তরালে নিঃশেষ। লোভী মানুষের ভয়ার্ত মুখণ্ডগহ্বর। পাশাপাশি অশরীরী সময়ের ওপর ভেসে উঠলো একজন কিশোরীর মুখ। মুহূর্তে ভেঙে যায় শহরের সজীবতা। এবং চারিদিকে মৃত্যুর হাতছানি। এক একটি রাত্রি দীর্ঘ ভয়ঙ্কর আয়েশি হাই তুলে ক্রমাগত এগিয়ে আসতে থাকে মানুষগুলোর দিকে; নগরবাসীর দিকে। জীবন্ত মৃত্যুর অবয়ব ভয় দেখায় ওদের। তারপর আরও হাজারো সংঘাত অতপর ঘটনাক্রম।
অতপর ওরা মানুষগুলো বাস্তুহারা হয়। ওদের চিন্তাগুলো বাস্তুহারা হয়। গাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলো বাস্তুহারা হয়। চিন্তার পারদ ছড়াতে থাকে শিরায় শিরায়। অথচ মানুষগুলো জানতো বাঁচার মতো বাঁচতে পারার নাম জীবন। অথচ সেই জীবন এখন অতীত। সমুদ্রের উচ্ছ্বাস এখন অতীত। এমনকি অতীতও অতীত নয়; এখনও সে বয়ে চলে নিঃশব্দ অনুবর্তী অদৃশ্য মুহূর্তের দিকে। এ পর্যায়ে এসে দীর্ঘকবিতা পুরোমাত্রায় জমে ওঠে। জমে ওঠে ক্লাইমেক্স। ঘটনার উত্থান ও গতি। শিহরণ জাগাবার মতো ভয়ানক অনুভূতি নিয়ে পাঠক আরও অগ্রসর হন।
একে একে উন্মোচিত হতে থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্য। অনুভূতি। বিস্ময়। ভয়। আর প্রজ্ঞালব্ধ জগতের ধ্যানমগ্ন বাসস্থান। ধ্যানের মধ্যে জন্ম নেয় ভাষা। যা কিনা চাঁদের জমজ সহোদরার মতো মানুষের বুকে গর্ত করে করে অগ্রসর হয়। ভাষারা জন্ম দেয় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। এবং মহাকালের পথে প্রবাহিত হয় মানবগোষ্ঠী। অথচ তবুও আমার বন্ধুরা শুকরের পালের সঙ্গে কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করে অথবা পাহাড়ি খাদে রোদে পচতে থাকে। মানুষটা ভুলে যায় ওর নাম। ওর স্মৃতি। সভ্যতা এতটাই ভয়ানক যে ওরা অবশ্যই ফিরে আসতে বাধ্য প্রকৃতির কাছে। কেননা এতদিনে এই পাঁচশ কোটি বছরের বিবর্তনে ওর ভেতরে এক বিশাল ক্ষত ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
গবাক্ষবিহীন বর্তমান। তারপরও জেগে থাকে মিথ। মানুষের ঐতিহ্য আর আত্মবিশ্বাস। সুতরাং আবারো ফিরে আসে মৎসকন্যা মেলুসিনা। পাখির মতো চিৎকার করে জেগে ওঠে এক নারী। অতপর ভগ্ন ফ্যাকাশে আর্তনাদ, সময়ের শেষ প্রান্তে রুগ্ন চোখে ছানি বুকে শ্লেষ্মা মাখানো বৃদ্ধা। কুৎসিত সেই নারী। এরই নাম জীবন। হায় আপসোস! কেনই বা মানুষের জন্ম হয় আর কেনই বা তরতাজা যুবতীরা বৃদ্ধা হয়ে যায়! আমরা কেউ নই। ভষ্মিভুত ছাইয়ের গাদা। অথবা পরিত্যক্ত ঝাঁটা ছাড়া অন্য কিছুই নই। তারপরও আমি খুঁজতে থাকি হাজার বছর আগে ডুবে যাওয়া এক মেয়ের দুটি চোখ। গভীর কূপে ডুবে থাকা চাহনিগুলোর অনন্ত ভাষা।
অতপর কবিতায় দেখা যায়, একজন মা তাকিয়ে আছে তার ছেলের দিকে। ছেলে এখন তরুণ পিতা। অথচ এই তরুণ পিতার চোখের দৃষ্টিতে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। হোটেল ভের্নের একটি কক্ষে একটি মেয়ে কেশচর্চায় ব্যাস্ত। অনেক শহরের অনেক নাম। স্থান। রাস্তা আর রাস্তা। প্লাজা। আরও রাস্তা। পার্ক। স্টেশন। সিঙ্গল রুম। দেয়ালের দাগ। কেউ চুল বাঁধছে। কেউ আমার পাশে গাইছে গান। কেউবা পোশাক পরছে। কামরা। স্থান। রাস্তা। নাম। কামরা। ১৯৩৭ সালের মাদ্রিদ। প্লাজা দেল আনজেলে। মেয়েরা সেলাই করছে। ওদের বাচ্চাদের সঙ্গে গান গাইছে। হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ। অতপর হট্টগোল। চিৎকার। চোখের সামনে বড় বড় দালান হাঁটু মুড়ে প্রথমে বসে পড়লো রাস্তায়। অতপর সকলে শুয়ে পড়লো এবং সৃষ্টি হলো একটা ধ্বংসস্তুপ। উঁচু উঁচু মিনারে ফাটল। অতপর পতন। দরজাগুলো ধ্বসে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঝড়ের মতো শব্দ। এবং এমনই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের মাঝে ফিল্মের মন্তাজ টেকনিকে পর্দায় ভেসে উঠলো মৈথুনরত ওরা দুজন; উলঙ্গ। অর্থাৎ সভ্যতাকে ওরা বুড়ো আঙুল দেখালো।
এরপর দীর্ঘকবিতার চারণভূমিতে আরও একটি নতুন চরিত্রের অনুপ্রবেশ। যে কিনা একটি স্বাভাবিক শহরের ছবি উপহার দেয়। চরিত্রটি লাল গেঞ্জি গায়ে একজন পুরুষ। পুরুষটি দৈনিক কাগজ পাঠরত। আর একজন রমণী নিজেদের পোশাক ইস্ত্রি করতে থাকে। সূর্যকরোজ্জ্বল কক্ষ। মানুষের নগর সভ্যতা। অথচ ওরা নিঃসঙ্গ। ওদের একমাত্র অতিথি একখানা পীচ গাছের ডাল। আর এদিকে বারান্দায় তিনটি ছেলে ক্রন্দনরত। ওরা মরচে ধরে সবুজ হয়ে গেছে। ওদের কক্ষগুলো জাহাজের মতো দোল খায়। সাবমেরিনের মতো ঘর। নিঃশব্দতা গলে যায় সবুজ ঢেউয়ের মাঝে। গালিচার জীর্ণ সুতো খসে পড়ে। পাখির খাঁচাগুলো পাল্টে যায়। উড়ে যায় পাখিগুলো স্বাধীন আকাশে। আর মানুষগুলো ফিরে আসে অনিবার্য এক পল্লীর দিকে। প্রত্যেক টেবিলেই ভোজসভা। ওরা শঙ্খের মতো অভেদ্য। সময়ের অবরোধ বৃথা। এখন সময় বলে কিছু নেই। দেয়াল নেই। অবারিত মহাশূন্য। জীবনের উৎসবে তুমি মাতো। এই বৃক্ষের নিচে শুয়ে তুমি এই মদিরা পান করো। সবই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
সবকিছুই পবিত্র। প্রতিটি কক্ষ এখন পৃথিবীর কেন্দ্র। এখনও সৃষ্টির প্রথম রাত্রি প্রথম দিন। পৃথিবীর জন্ম হয় তখনই, যখন একজন পুরুষ আর একজন নারী চুম্বনে বিবশ। পরিত্যাগ কর ইঁদুরে খাওয়া আইন। ব্যাংক অথবা কারাগারের লৌহ দরজা। পরিত্যাগ কর তারকাঁটার বেড়া। রাবার স্ট্যাম্প অথবা যুদ্ধসঙ্গীত; টপহ্যাট পড়া ভদ্রলোক অথবা রেডক্রস বোর্ড। কোনো কিছুরই এখন ওদের প্রয়োজন নেই। ওরা প্রত্যাবর্তন করেছে শুধুই একটা নির্ভেজাল নিরেট পৃথিবীর কাছে। প্রয়োজন নেই নিরামিষভোজী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অথবা স্কুলের গাধা মাস্টার; রক্ষকের ছদ্মবেশধারী কুমির, জাতি, পিতা, মুনাফালোভী মালিক, হাঙ্গররূপী শাসক, ভবিষ্যৎ নির্মাতা, ইউনিফর্মধারী শুয়োর, ধর্মযাজক অথবা গণতন্ত্র অথবা ইংরেজি শেখার ক্লাস অথবা পচনধরা মুখোশ যা মানুষকে অন্যের থেকে পৃথক করে; মানুষকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আমরা প্রত্যাবর্তিত মানবগোষ্ঠী; আমরা সূর্য আর মৃত্যুকে ভাগাভাগি করে নেই। বেঁচে থাকার আশ্চর্য বিস্মরিত বিস্ময়। ভালবাসার অর্থ সংগ্রাম, দুজনের চুম্বন। ভালবাসা মানে মিথ্যা নাম যশের বসন খুলে উলঙ্গ হওয়া।
এই যে পজেটিভ অনুভূতি, এই নান্দনিক ইন্দ্রিয়ানুভূতির ভেতর দিয়েই একজন দীর্ঘকবিতার কবি বিশ্বের সুপ্ত শক্তির সন্ধান লাভ করেন। সুতরাং প্রকৃতি, নারী এবং জগতের সঙ্গে এক বৈদ্যুতিক কামাবেগতাড়িত ভালবাসার সম্পর্কের অনিবার্য প্রকাশই দীর্ঘকবিতা। দীর্ঘকবিতার শব্দ হচ্ছে এক জাদুর বাক্স। যার ভেতর ভাষা সম্ভাব্য প্রসব উন্মুখ ও উত্তপ্ত। যা কিনা চিত্রভাষ্যের মাধ্যমে বয়ান করে আবহমান মানবগোষ্ঠীর অনুন্মোচিত সত্যভাষ্যসমূহ। যার কোনো নির্দিষ্ট কাল নেই, পরিমাপ নেই বরং দীর্ঘকবিতার শব্দরাজির রয়েছে এক নিজস্ব জীবন, ওজন এবং তুল্যমূল্য। যা কিনা মুহূর্তে আমাদের মগজে দৃশ্যের জন্ম দেবার সঙ্গে সঙ্গে বোধ ও অভিব্যক্তি, অভিব্যক্তি ও প্রজ্ঞার উন্মেষ ঘটায়। যা পাঠককে পৌঁছে দেয় এক বিস্তৃর্ণ ক্যানভাসে মোড়ানো গতিশীল সেলুলয়েডের নিকট।
আলোচ্য দীর্ঘকবিতায় আমরা অজস্র গতিশীল ছায়াছবির মুখোমুখি হই। পাজের এই কবিতার একটি অংশে ভেসে ওঠে প্রেমিকের লিঙ্গচ্ছেদের দৃশ্য। বারবণিতা। প্রেমিকা। সমাজ ও বেআইনি অপরাধ। সহোদর-সহোদরার রমণ; যেন বিষাক্ত রুটি, ভষ্মের শয্যায় ব্যভিচার। হিংসা, রিরংসা, উন্মাদ প্রলাপের বিষাক্ত লতা। সমকামীর থুথু। জনতার নিক্ষিপ্ত পাথরে ক্ষত বিক্ষত শরীর। জীবনের সমস্ত রস নিংড়ে নিয়ে ঘানি টানা বলদ। সবই তাম্রমুদ্রার ফলশ্রুতি। সুতরাং,
এর চেয়ে ভালো বরঞ্চ সতীত্ব, যে অদৃশ্য ফুল
নীরবতার ডালে অবলীলাক্রমে দোল খায়,
সাধু-সন্তদের সেই সুকঠিন হীরক খণ্ড
যা কামনাকে শোধন করে, সময়কে তৃপ্ত করে,
(হায়দার আলী খান অনূদিত)
তুলনাযোগ্য টলস্টয়ের ফাদার সিওর্গির জীবন আচারকে। কিন্তু টলস্টয়ের ফাদার সিওর্গি যা পারেনি তা সম্ভব করেছে পাজের এই দীর্ঘকবিতার নায়ক। যে কিনা বয়সহীন এক সূর্যের নিচে হেঁটে বেড়ায়। তার পাশেই সবুজ বৃক্ষের মতো পা ফেলে চলে তার প্রেমিকা। নদীর মতো প্রেমিকা তার সঙ্গে কথা বলে। আর গমের শিষের মতো সেই নারী বেড়ে ওঠে। হাজার পাখির মতো উড়ে যায় সেই নারী। কমলালেবু খেতে খেতে সেই মেয়ে হেসে ওঠে। সুতরাং পৃথিবী আবার সবুজ হয়। আকাশ নেমে আসে ভূমিতে আর গাছেরা উঠে যায় আকাশে। মহাকালের সাক্ষ্য যেন প্রতিটি দৃশ্য এবং ঘটনা। ঘটনা ও মানুষের জীবন। এবং শুধুই আলো আর নীরবতা।
সাদা মেঘের দলগুলো একে একে চলে যায়। শরীর নোঙর তোলে। আত্মা পাল তুলে দেয়। ওরা ওদের নাম ভুলে যায়। ওরা ভেসে বেড়ায়। অতপর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। পর্দায় ভেসে ওঠে হোমারের ইলিয়ড ওডেসির যুদ্ধযাত্রা। প্রাচীন ব্যাবিলন। প্রাচীন গ্রীক। সক্রেটিস। অতপর সেক্সপিয়ার। আগামেমননের বিকট হুঙ্কার। সমুদ্রের অবিশ্রান্ত গর্জনের চেয়েও ভয়ঙ্কর কাসান্ড্রার চিৎকার। শৃঙ্খলিত সক্রেটিস। ক্রিটো। এস্কুলাপিয়াসের মোরগ। ধ্বংসস্তূপে ভেসে ওঠে শৃগালের সুভাষিত বচন এবং যুদ্ধের আগমুহূর্তে ব্রুটাসের প্রেতদর্শন। মকটেজুমা ইনসম্নিয়ার কণ্টকশয্যা। ভগ্নচোয়াল দুই হাতের মাঝে গুঁজে রোবসপিয়রের মুহূর্ত গণনা। চুররুকার কফিন। অথবা থিয়েটার শেষে লিনকনের সন্তর্পণ পদক্ষেপ। মুমূর্ষু ট্রটস্কীর অস্থির ঠকাঠক আওয়াজ। দীর্ঘশ্বাস। নীরবতা। বাক্যবাগীশ কুকুর আর বিজয়ের হর্ষধ্বনি। ঘাতকের চিৎকার। অগ্নিশিখা এবং একজন চিন্তাশীল মানুষ যেন একটি অগ্নিশিখা। প্রজ্বলিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এখন জল্লাদ নেই। দণ্ডিতও নেই।
মৃতেরা সব সময়েই মৃত। ওরা অস্পৃশ্য। এলোয়াজ, পার্সিফোনে, মারিয়া, মুখ তোল, আমাকে দেখাও। যাতে সবশেষে আমার আপন মুখ আমি দেখতে পারি। আমার মুখ সর্বকালের জন্য সকলের মুখ। যারা রুটি বানায় তাদের মুখ। গাড়ির চালকের, মেঘের, নাবিকের মুখ। সূর্যের, নির্ঝরিনীর, পেদ্রোর এবং পাবলো পিকাসোর মুখ। নিঃসঙ্গ জনতার মুখ। আমাকে জাগাও। আমি তো ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছি। জীবন ও মরণ। এইমাত্র আমি স্বপ্নবিহীন পাথরের স্বপ্ন দেখলাম। শুনলাম আমার রক্ত কারাগারে গান গাইছে। সমুদ্র আলোর মর্মরে গান গাইছে। একে একে সব দেয়াল ধ্বসে গেল। সব দরজার কবাট গেল ভেঙে। আমার কপালের ভেতর দিয়ে সূর্য ফুটে উঠল। সত্তাকে মোড়ক কেটে বের করে আনল। আমার হাজার বছরের জৈবনিদ্রা ভেঙে গেল। নদী বয়ে চলে বঙ্কিম ভঙ্গিমাতে। এগোয়। পিছু ফেরে। বৃত্তের পরিধি ঘুরে ফিরে আসে। বিশাল পর্দা জুড়ে দিগন্তে ভেসে উঠলো একটা মস্ত বড় নীলাকাশ। যেখানে একটিও পাখি নেই। শুধু বৃত্ত আর বৃত্ত।
শেষ হলো পাজের দীর্ঘকবিতার এক সংক্ষিপ্ততম ছায়াছবি। সত্যিকার অর্থে একটি দীর্ঘকবিতাকে মোটামুটিভাবে সরল গদ্যে আঁকতে হলে কয়েকশ পাতার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর যদি টীকা ভাষ্য বিশ্লেষণসহ অগ্রসর হওয়া যায় তা হলে একটি দীর্ঘকবিতা একটি মানব সভ্যতার ইতিহাস হয়ে কেবলি বিবর্তিত হতে থাকে। যা পাঠককে অনিবার্যভাবে পৌঁছে দেয় তার পূর্বপুরুষের কাছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতের রূপরেখা বরাবর। সেখানে অজস্র চিত্রকল্প কেবলি ঘুরে ফিরে গান করে। সেই সঙ্গীতে সত্তার অব্যক্ত আকাক্সক্ষা ভাষা পায়। বোধ খেলা করে। যেন অবিনশ্বর এক চিরন্তন রহস্য। এবং এমতাবস্থায় জীবনানন্দ দাশ দীর্ঘকবিতার বিস্ময়কর জগৎ পরিভ্রমণকালে উচ্চারণ করতে বাধ্য হলেন,
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
লাশ কাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।