These imposible women! How they do get around us! The poet was right: can’t live with them or without them.
—Aristophanes, Lysistrata
নারী—প্রকৃতির ফুল ও ভুল, বিধাতার দ্বিতীয় ভ্রান্তি। সৃষ্টিকর্তা আপন অন্তরের সমস্ত সৌন্দর্য দিয়ে গড়েছেন নারী প্রতিমূর্তি। নারী-রহস্যময়ী, দুর্বোধ্য, তার চরণে পুরুষ নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই আনন্দ পায়, শান্তি ও মুক্তি খোঁজে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মাতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর আধিপত্য ছিল, পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর নারীর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পুরুষের হাতে-নারীর ভূমিকাও পাল্টে যায়। এক্ষেত্রে শাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থ নারীকে নিয়ন্ত্রণে বিশেষ শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। সংসারধর্ম ও সন্তান পালন নিয়ে নারী গৃহকোণে বন্দি হয়ে পড়ে। রক্ষিতা হয়েছে, পতিতা বৃত্তিও মেনে নিয়েছে নারী। কিন্তু সমাজ বিকাশের ধারায় আজ নারী ও পুরুষ উভয় উপলব্ধি করেছে—গৃহকোণই নারীর একমাত্র স্থান নয়, তখনই মাথা উঁচু করে নারী দাঁড়াতে চেয়েছে,সে দাবি করেছে নিজের অধিকার, মর্যাদা, সম্মান, পুরুষের সমকক্ষতা, জীবিকা গ্রহণ করেছে পুরুষের মতোই। দ্বন্দ্ব কিংবা ক্লেশের জায়গা এখানেই। পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়া নিজেদের দখল করা জায়গা এতটুকুও ছাড়তে রাজি নয় পুরুষতন্ত্র। জেন্ডার বা লিঙ্গগত পার্থক্য এবং শাস্ত্র ও ধর্মবিধি দিয়ে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টা করেছে পুরুষ। নারী ও পুরুষের মূল পরিচয় লিঙ্গগত নয়, তাদের মূল পরিচয় মানুষ।
ৎনারীরাও মানুষ—এটি কোনো নতুন ধারণা নয়। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বাস্তব সত্য। কিন্তু তাদের দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করা হয়েছে যুগের পর যুগ প্রথাগত পুরুষতন্ত্র। এই অবদমনের আড়াল থেকে নারী বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছে, নানামুখী পথে সক্রিয় হয়েছে যুগে যুগে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অনেক মহীয়সী নারী। গড়ে উঠেছে নারীবাদী তত্ত্ব, ফ্যামিনিজম।
নারী ও পুরুষ উভয় সমান-এটাই নারীবাদের মূল আর্গুমেন্ট। পুরুষতন্ত্রের গ্রান্ট ন্যারোটিভস্ যুগ যুগ ধরে নারীকে রেখে দিয়েছে নিকৃষ্ট অবস্থানে। এটা অন্যায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য নারী মধ্যে জেগে উঠেছে নিজস্ব বোধ এবং সত্তাগত জাগরণ। এই নারীবাদী ধারণা তত্ত্বটি চারটি দৃষ্টিকোণে প্রতিফলিত—রক্ষণশীল নারীবাদ, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ ও মূলধারার নারীবাদ।
রক্ষণশীলদের মতে, নারীর যে অবস্থা, তা প্রকৃতি নির্ধারিত। বিধাতাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন নারী-পুরুষের অসম অবস্থান। পুরুষ কর্তৃত্ব করবে, নারী থাকবে অনুগত। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতে, নারী তার নিজস্ব শরীর ও সত্তার একচ্ছত্র মালিক। চাপিয়ে দেয় কোনো মতবাদ, আইন বা ধর্মবিধিকে সে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বেলায় গ্রহণ করবেনা। মাক্সীয়রা মনে করেন, নারীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শোষিত শ্রেণি। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে পণ্যের মতো ব্যবহার করে। মূলধারার নারীবাদীরা মনে করেন, ধর্ম বা পুরুষ নারীকে সুরক্ষা দেয়নি, দেবে না। নারী-সত্তার আত্মজাগরণের মাধ্যমে নারীর আত্মমুক্তি ঘটবে। এসব ধারণা ও তত্ত্ব কথা নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া যায় না। কারণ, পৃথিবীর এককোণে এই বঙ্গভারতের সাহিত্য ও সমাজে যে ‘গ্রান্ট ন্যারেটিভস্’ ‘মাইন্ড সেট’ দাঁড়িয়ে গেছে, তার ঘেরা টোপ থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষিত, সংস্কৃতবান পুরুষদের পক্ষেও সম্ভব হয় না, পারেনি অনেকেই। হুমায়ুন আজাদ নিজেকে নারীবাদী হিসেবে ঘোষণা করলেও ব্যক্তিগত জীবনাচরণে সামন্ততান্ত্রিক ‘মাইন্ড সেট’ থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে লেখার পরিসর বাড়াতে চাই না। তসলিমা নাসরীন অতিরেক নারীবাদী হতে গিয়ে পুরুষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে অহেতুক ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছেন। টেনে এনেছেন ব্যক্তিগত জীবনের খারাপ অভিজ্ঞতাকে। অন্যদিকে ভারতীয় শাস্ত্রবিধি, সনাতনধর্ম বিশ্বাস ও ইসলাম ধর্ম নারীকে সুরক্ষা নামে একধরনের দমিত, নমিত নীতি আরোপ করেছে। নারীর শরীর আবৃত রাখা, পোশাক-পরিচ্ছেদ, লিখিত অলিখিত বিধি-নিয়ম, সংস্কার আরোপ করে নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে পিতৃতন্ত্র। এক্ষেত্রে মা, দাদি-নানিদের সায় আছে, ফলে পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় এবং আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করার পরও নারী নিজেই সংস্কারমুক্ত, স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পারেনি।
বাংলাদেশের সমকালীন বাস্তবতা হচ্ছে, নারীমুক্তি ও নারীসত্তার জাগরণ বিলম্বিত, বিড়ম্বিত, স্বপ্নময় আকাঙ্ক্ষার স্তরেই রয়ে গেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দায় এক্ষেত্রে কম নয়। সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন, শ্রম ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমকক্ষ ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষ্যমের শিকার হচ্ছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা পলিসি মেকিংয়ের জায়গাগুলোতে নারীর নিয়ন্ত্রণ অধিকার না পেলে বৈষম্য থেকেই যাবে। নারীর দুরাবস্থার প্রধান কারণ জৈবিক। গর্ভধারণ করতে গিয়েই নারী মেনে নিতে বাধ্য হয় পুরুষের অধিনতা। সেখানেও নারী তার জরায়ুর স্বাধীনতা চাইতে গিয়ে প্রযুক্তির কল্যাণে টেস্টটিউব বেবি, সার্গেটিং মাদার ইত্যাদির ফলে নারী জৈবিক আত্মতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে নৈঃসঙ্গ্য, নিঃস্ব, শূন্যতার অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। লৈঙ্গিক রাজনীতির শিকার হয়ে এখন স্লোগান উঠছে ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’। নিপীড়ক চলে যায় নিপীড়িতে স্থানে, নিপীড়িত চলে আসে নিপীড়কের জায়গায়-এভাবেই চলতে থাকে অনন্তকাল, এক নিষ্ঠুর খেলা।
দুই.
স্বাধীনতা বা মুক্তি—নারীর ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, তা শুধু আধুনিক কালে নয়, সুদূর প্রাচীনকালে থেকেই কিন্তু পুরুষতন্ত্রের গ্রান্ডন্যারেটিভস্ সে অর্গুমেন্টকে আমলে নেননি। মিশেল ফুকো তার, হিস্টোরি অব সেকচ্যুয়ালিটি (১৯৮১) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন— ‘আমাদের এমনটাই বিশ্বাস করানো হয়েছে যে আধুনিককালের ক্ষমতাবান প্রক্রিয়া বিশেষভাবে এককেন্দ্রিক একক কোনো বৃত্তে এই প্রক্রিয়াটি আবর্তিত হয় কিংবা এক ধরনের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করে অন্যদের ওপর চালানো হয় অবদমন, তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।’ ক্ষমতা এখানে সমধর্মী নয়, একচেটিয়া। যৌনতাকে সবসময় অবদমিত রাখা হয়েছে। অবদমিত রূপটাকে প্রধান করে তুলে ধরা হয়েছে। আসলে যৌনতা সম্পর্কে আমাদের অনিঃশেষ জিজ্ঞাসা থাকা উচিত, চুলচেরা বিশ্লেষণ ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেয়া উচিত। নারীর চাপা পড়া কণ্ঠস্বরকে তুলে আনা দরকার। নারীর সেই বেগানা, অশ্রুত, অনাঘ্রাতা কণ্ঠের স্বতন্ত্র আওয়াজ, কম্পিত স্বও, সাহিত্যে, কবিতায় আমরা কান পেতে শুনতে চাই কিন্তু কোথায় সেই কণ্ঠস্বর? এখানে নারী লেখিকারাও যেন পুরুষ কণ্ঠে কথা বলে, পুরুষ ন্যারেটিভ্সের ভেতরে ঢুকে যায়, মিলিয়ে যায়। স্বতন্ত্র ভয়েজ নিয়ে উপস্থিত হতে পারে না নারী।
নারী-কণ্ঠস্বরের বহুবঙ্কিম উপস্থাপনা আমরা লক্ষ করি কবি দিলারা হাফিজের কবিতায়। ‘নারী-সংহিতা’ (২০১৯) গ্রন্থের ‘উৎসর্গ’পত্রে তিনি লিখেছেন—‘পৃথিবীর নিপীড়িত ও নির্যাতিত নারীর করকমলে যাঁরা কথা ও কলমে কখনোই কোনো প্রতিবাদ করেননি।’ নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত হয়েও নারীরা নির্বাক থেকেছে, থাকতে বাধ্য হয়েছে হাজার বছর। তার নারী জন্ম থেকে কিশোরী হয়ে ওঠা এবং কিশোরী থেকে মেয়ে হয়ে ওঠা—আসলে খাটো হাফপ্যান্ট থেকে সালোয়ার, ফ্রক ছেড়ে সেমিজ-কামিজ পরার বিশাল বদলে যাওয়ার গল্প আছে। বয়সঃসন্ধি তাকে জানিয়ে দেয়, সে আগের মতো নেই:
আম-বাগানের নির্জনতার মূলে
একাকিনী কিশোরী আজ ভুলে
বুকের ওপর হাত রেখেছে যেই
ধূপছায়া বুক আগের মতো নেই
এ কি! পাথর সোনা-দানা!
লজ্জা-ভয়ে বাড়লো বিভাবনা
বিপুল বিজন ওড়না-আড়াল বুকে
শস্য-আঁকা দীর্ঘ দুটি চোখে
দীপ্র শরীর চমকে উঠে রাতে
কিশোরী আজ জেগে উঠে নারীর নহবতে।
(কিশোরী আজ: নারী-সংহিতা)
কিশোরীর ধূপছায়া বুক আগের মতো নেই। বুকে জেগে ওঠছে ‘পাথর সোনা-দানা’ নির্জনে একবার দেখেই চমকে ওঠে। লজ্জা হয়, ভয় হয়, ওড়না ঢাকতে হয় বুক। শরীরের ভেতরে জেগে ওঠে এক নতুন শরীর। নারীত্বের ‘নহবত’ শুরু হয় তখন থেকে। এই কণ্ঠস্বর এতদিন আমরা কবিতায় পাইনি। মেয়ে বড় হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার অন্তর্জগত, বাহ্যিক পরিবেশ-তখনো বুঝে উঠতে পারে না, কোন কথাটি বলা যায় না উচ্চস্বরে, কী কথা বলতে হয় কানে কানে। পুতুল, হাড়ি-পাতিলের খেলনা ছেড়ে তাকে বুঝতে হয় মায়ের চোখের ইশারা, চোখ রাঙানি, মৃদু বকুনি শুনতে হয়। মায়ের শাসন-বারণের তাড়নায় শরীর ঢাকতে হয় পোষাকে, পায়ের গতি থামাতে হয়।
এখনো বোঝে না সে যে
ভাইটি কেন হিসি করে রোজ
উঠানে দাঁড়িয়ে
মা তাকে কেন বাধ্য করেন
আড়ালে গিয়ে শিশিরের মতো নিঃশব্দ ত্যাগে
মাকে কেন খেতে হয় শুধু
গলার হাড্ডি মুরগির মাথা কলিজা ও গিলা
এখনো বোঝে না সে যে।
(মেয়ে তুমি বড় হচ্ছো: নারী-সংহিতা)
মা-মেয়ের অন্তর্জগতের এই কথাগুলো কারোই অজানা ছিল না। কিন্তু কেউ কি এমন করুণভাবে বলেছে? দিলারা হাফিজের কবিতার স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের, বিশেষত মুসলিম পরিবারগুলোর অন্তঃপুরের অব্যক্ত কণ্ঠস্বরকে কাব্যে রূপায়িত করেছেন। নারীত্বের চোখে দেখেছেন বেদনার বিবর্ণ রূপকে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক প্যাটার্ন বা কাঠামোর ভেতরে অলিখিত বিধানের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এখানে।
কিশোরী থেকে মেয়ে হয়ে ওঠা তারপর বয়স যখন ষোলোতে, তখন পিপাসার্ত হয়ে ওঠে তার ঠোঁট, চোখে গাঢ় সে আঁকে কাজল, কপালে নীল টিপ পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখে নিজেকে। লজ্জায় নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়ে ধরে। শিহরণ জাগে বুকে, আনমনা হয়ে স্বপ্নে বিভোর হয়। উত্তাল ঢেউ বুকে নিয়ে সাহসী পুরুষের প্রার্থনা করে।
আমি একজন সাহসী পুরুষ চাই
যে পুরুষ নিদ্রাহীন, জাগে জাগায় রাত্রি দিন
যে পুরুষ কণ্ঠে সমূহ আবেগে উচ্চারিত হয়
বিপ্লবের ধ্বনি, জীবনের উদ্দাম অভয়বাণী
সেরকম একজন সাহসী পুরুষ চাই
যার এক হাতে ওড়ে জাতির পতাকা
অন্য হাতে প্রেমের প্রত্যয়।
(সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা: নারী-সংহিতা)
নারীত্বে পৌঁছার পর প্রত্যেকটি নারী মনোদৈহিকভাবে কামনা করে পুরুষসঙ্গী। তার কামনার সঙ্গে আসে কল্পনা, স্বপ্ন-রঞ্জিত কল্পনা। সেই পুরুষকে চায় নারী, যার বুকে আছে দুঃখ জয়ের সাহস, নির্ভরতার স্থায়ী আসন, আশ্রয়, দৃঢ় বিশ্বাস, এগিয়ে যাওযার প্রত্যয়। সে চায় দিতে এবং নিতে পুরোপুরি, বিশ্বাসের জায়গায় সে কোনো আপস করতে রাজি নয়। নারীর নির্ভরতার জায়গাটা এখানে—‘সেরকম একজন সাহসী পুরুষ চাই আমি’। কিন্তু নারীর এই চাওয়ার কথা বাংলা কাব্যে বিরল ছিল। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো নারীকে ভোগ্য পণ্য করে তুলেছে। সেখানে নারী তার পছন্দের পুরুষকে নির্বাচন করার অধিকার ছিল না। পুরুষরাই পাত্রী পছন্দ করার একচেটিয়া অধিকার প্রাপ্ত ছিল। এটাই পিতৃতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক কাঠামো। অধুনা এই কাঠামো ভেঙে অনেকে নিজের পছন্দের নারী বা পুরুষ সঙ্গী বেছে নিলেও পরিবার তা মেনে নিতে চায় না সহজে। আবহমান বাংলা কবিতার দিকে তাকালে দেখা যায়, কবিরা নারীর কাছে প্রেম ভিক্ষা করেছেন, নারীর প্রেমে হয়েছেন আকুল-ব্যাকুল, আত্মহারা।
পরিণত বয়সে এসে নিজের জীবনের ভিক্ষালব্ধ জ্ঞানকে, অভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞানে রূপ দিয়েছেন কবিতায়। এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য-শৈল্পিক সার্থকতা।
মধ্যযুগের কবি আলাওল পদ্মাবতীর রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন এক’শ ত্রিশ পঙ্ক্তি। অথচ এমন নারী-কবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না, যে নারী প্রেমর কাব্যে পুরুষকে যাচনা করেছে, পুরুষের কাছে প্রেম প্রার্থনা করে হয়েছে উম্মাদিনী। দিলারা হাফিজের কবিতায় সেই ব্যাকুল, বিবশ, অনুভূতির প্রকাশ দেখতে পাই:
তোমাকে জড়িয়ে ধরে অকস্মাৎ বিস্মিত
‘ভালোবাসা’ শব্দের যথার্থ মানে আজ
পেয়ে গেছি তোমার কল্যাণে
তাই আজ ‘ভালোবাসা’ এই শব্দটির প্রতি বড় বেশি ঝুঁকে আছি।
বিয়ে, দেনমোহর, ধর্মের শরণ—এগুলো সাংস্কৃতিক কাঠামোর যে ইঙ্গিত করে, তাতে নারীর নিরাপত্তা, সুরক্ষার কবচ হয়? সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত যৌনপার্থক্যের সমস্তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নারী শোষিত হয় দু’ভাবে—পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ও পুরুতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। যেমন শ্রমবাজার লিঙ্গগত বা জেন্ডার পার্থক্যের ভিত্তিতে বিভক্ত করে রেখেছে পুরুষই। পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে বেশি সক্রিয়, সে নারীর ভেতরে নিজেকে প্রবেশ করিয়েই মানবশিশু জন্ম দেয়। অন্যদিকে নারী পুরুষের তুলনায় নিষ্ক্রিয়, যে নিজের মধ্যে পুরুষকে প্রবেশ করায়, কারণ জৈবিকভাবে সে শ্রেষ্ঠ, সন্তান জন্মদান করে সে পরম মানসিক তৃপ্তি অর্জন করে। এভাবে যৌনাঙ্গের দিকে ইঙ্গিত করে নারীকে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, নারীকে নারী করে রেখেছে অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। দিলারা হাফিজ সেই ইতিহাসকে কবিতায় তুলে আনেন এভাবে:
আমি এক অখ্যাত কন্যা-সন্তান
আমার শারীরিক মূল্য
দস্তা ও তামার দরের চেয়ে বেশি নয়
আমি ভুলে যাইনি
আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগে জন্মমাত্রই
আমাকে হত্যা করা হতো গলাটিপে
আমার জন্য গর্বিত হয়না কখনো আমার পিতৃকুলের কেউ
আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি একা
আমি জানি আমাকে ছাড়া
পৃথিবী এগোবে না এক পা—
(আমি: নারী-সংহিতা)
পিতৃতন্ত্রের গ্রান্ডন্যারেটিভ্সের তিনি জানেন। কন্যা সন্তান জন্মালে এখনো পিতৃকুলের কেউ খুশি হয় না। গর্ববোধ করে না কেউ, তার দাম দস্তা বা তামার মতো সস্তা, সোনার মতো দামি নয়, তবু সে দৃঢ় কণ্ঠে বলছে:
আমি জানি আমাকে ছাড়া
পৃথিবী এগোবেনা এক পা
মানব সভ্যতা জন্মধাত্রী নারী। তাকে ছাড়া কী পৃথিবী এক পা-ও এগোতে পারে? এটাই নারীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর। যে কণ্ঠস্বরের ধ্বনি সমস্ত দেয়াল ভেঙে প্রবিষ্ট হয় দুর্ভেদ্য পুরুষের বুকে। ভেঙে চুরে তছনছ করে দেয় পৌরষত্বের সকল অহঙ্কার। এখানেই নারীত্ব শক্তির জয়। পিতৃতন্ত্রের সেই দীর্ঘ ছায়ার উদ্দেশে দিলারা হাফিজ লিখেছেন:
পিতা, আমার জন্মের পর বহুদিন
আপনি আমাকে দেখতে যাননি—
মায়ের আতৃপ্ত বুকে মুখ ঘষে ঘষে
আমি তবু বেড়ে, উঠেছি বহু বিপাকে
একথা ঠিক, পিতা, আপনার শখের বাগানে
আমি বড়ই বিমুখ ফুল,
এক নিরাকার অভিমান বুকের ভেতরে অকারণ বেদনা জায়গায়
তবু পারি না নিজে সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে নিতে
রোজ মধ্যরাতে আপনি কি এরই জন্যে জেগে থাকেন, পিতা?
জিজ্ঞাসা চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলারা হাফিজ পিতার কাছে জানতে চান—‘আপনার শখের বাগানে আমি বড়ই বিমুখ ফুল?’ জন্মের পর বহুদিন আপনি আমাকে দেখতে যাননি। সেই অভিমান বুকে নিয়েও মেয়ে পিতাকে ভুলতে পারেননি। মধ্যরাত পর্যন্ত মেয়ের দুশ্চিন্তায় পিতা ঘুমাতে পারেন না, সেই বেদনা মেয়েকেও কাঁদায়। পিতার অবহেলার কথা মেয়ের মনে থাকেনা। উৎকণ্ঠিত পিতার মুখ করুণ হয়ে তার বুকে বাজে। কন্যা-জায়া-জননী—এই তিন পরিচয়ে নারীর গন্তব্য এবং ঠিকানা আসলে কোথায়? নার্সারির টবে জন্ম নেওয়া ফুলের চারাগাছ যেন নারী। অন্যের ঘরের বারান্দায় গিয়ে ফোটাবে ফুল। তার নিজের কোনো স্থায়ী আবাস নেই:
একটা আমার বাবার বাড়ি
একটা আছে স্বামীর
দু’টো বাড়ির কেউ নই আমি
আশ্রিত এই শরীর।
(বাড়ি: নারী-সংহিতা)
‘নারী-জীবন’ নামের লতানো গাছটির এই হচ্ছে পরিণতি। তার নিজ গৃহ বলে কিছু থাকতে নেই, কেবল ‘আশ্রিত এই শরীর’। এই উন্মূল পরিস্থিতিকে নারীবাদীরা তিনদিক থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘চলমান’-‘পরিবর্তমান’ এবং ‘রাচনিক’। অর্থ্যাৎ নারীর জীবন চলমান (পিতৃগৃহে বড় হয় স্বামীর গৃহে যাওয়ার জন্য). পরিবর্তমান (মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠা) রাচনিক (স্বামীর গৃহে গিয়ে সন্তান জন্মদান) ভূমিকাই তাকে উন্মূল, গৃহহীন করেছে। রাচনিক (স্বামীর গৃহে গিয়ে সন্তান জন্মদান) ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সে নিজেকে আত্মবিসর্জন দেয়:
শত বাসনা বিসর্জন দিয়ে তবেইে তো মা
এখনো ভাবি, আজো বুঝি স্বয়ংসম্পূর্ণ মা হয়ে উঠিনি
প্রতিদিন তাই মা হতে শিখি
সন্তানের মনে মায়ের যে ছবি আঁকা আছে
সেই ছবিটির মতো আমি মায়ের নিখুঁত
পোট্রেট হতে চাই
রক্ত মাংসের মা ততটা নয় সর্বংসহা ধরিত্রী
যতটা সহিষ্ণু এই পৃথিবী
জননী জন্মধাত্রী মা আমি ২৮০ দিন ক্লান্ত শ্রান্ত
প্রসব বেদনাতুব, তবু লক্ষ কোটি চুমুতে
অধরা আলিঙ্গনে ধরে রাখি
সন্তানের কলরব।
(বিজর্সন: নারী-সংহিতা)
নারীত্বের সার্থকতা মাতৃত্বে। কিন্তু মা হতে গিয়ে নারী যে সর্বংসহা ধরিত্রীর হতে হয়। ২৮০ দিনের বিশাল একজার্নি তারপর প্রসববেদনার মতো রক্তাক্ত যন্ত্রণা, মৃত্যুময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নাড়িছেড়া ধন কোলে আসে। স্তন্যদানরত সন্তান কোলে মা—এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। শিশুর কলরবে ভরে ওঠে মায়ের আঙিনা। এই অভিজ্ঞতাকে কবিতা করে তুলেছেন দিলারা হাফিজ—‘জননী জন্মদাত্রী মা আমি ২৮০ দিন ক্লান্ত শ্রান্ত প্রসববেদনাতুর’ এই বেদনার যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা পুরুষের নেই।
সংসার, দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতাকেও দিলারা হাফিজ কবিতায় রূপায়িত করেন এভাবে:
প্রেমের বয়স জোর বড়ো জোর এক দু’দশক
বাকী সময় ফোটে না ফুল জবা কিংবা রক্ত অশোক
নিন্দা-মন্দ গায়ের কাঁটা পায়ে কাঁটা
বাদ-অপবাদ সিন্ধুলোকে
লুকিয়ে তার অন্ধকারে
বাকী জীবন মায়ার বাঁধন মাতৃবোধন
ফেলে আসা দশকগুলোর স্নিগ্ধ এক অনুরণন
প্রেমের বয়স জোর বড়ো জোর এক দু’দশক
বাকী সময় ফোটানো ফুল জবা কিংবা রক্ত অশোক
মানো কিংবা নাই বা মানো।
(দাম্পত্য প্রেমের সংজ্ঞা: নারী-সংহিতা)
পুরোবাসী নারীর এই কণ্ঠস্বর অভিনব, অকৃত্রিম। প্রেম করে, পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করলেও ‘বড়ো জোর এক দু’দশক’ পর্যন্তই প্রেমের পরশ থাকে। তারপর করপুরের মতো প্রেমের সমস্ত সুরভী উড়ে যায়। ‘বাকি জীবন মায়ার বাঁধন মাতৃবোধন’ এই উপলব্ধি নির্মমভাবে সত্য। কেউ হয়ত এসত্য মানবে অথবা মানবে না, তাতে কী আসে-যায়? নারীকণ্ঠের এই অভিজ্ঞতা আমাদের কবিতা ছিল না। দিলারা হাফিজ সেই অভিজ্ঞতাকে শৈল্পিকভাবে রূপায়িত করেছেন তার কবিতায়। ‘রাজা রামমোহন রায় ও সতীদাহ প্রথা’ কবিতায় দিলারা হাফিজ এক আমোঘ প্রশ্ন তুলে ধরেন:
স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় যেতে হলে
কী করতে তুমি?
ভাগ্যিস উনবিংশে জন্মছিলেন রাজা রামমোহন রায়
অন্যথা কে সরাতো সতীদাহ প্রথার জঞ্জাল
কে নেভাতো চিতার চিহ্ন
বাংলার রেনেসাঁসের সন্তান রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়। না হলে সনাতন ধর্মে বিশ্বাস মতে এজনপদের অর্ধেক নারী স্বামীর চিতার আরোহন করে সহমরণে যেতে হতো। পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের দিকে যাওয়ার মতো কোনো নারীই পাওয়া যেতো না। উনিশ শতকের এই মানবতাবাদী সমাজ সংস্কারককে স্মরণ করে পুরোবাসী নারীকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন—‘স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় যেতে হলে কী করতে তুমি?’ না, কিছুই করার নেই। প্রথা সব নারীর জন্যই রচিত। এটাই পুরুষতন্ত্রের অস্ত্র। তার কবিতায় উঠে আসে বাংলার মিথ-পুরাণে অঙ্কিত নারীগণ—পঞ্চবটিবনের সীতা, বেহুলার রোদন, খনার কর্তিত জিহ্বা, আদম-হাওয়ার মিলন:
সাহসী প্রেমিক সমর্পিত
দু’বাহু বাড়িয়ে দিয়ে যদি বলে ‘ভালোবাসি’
তোমাকেই চাই অনন্ত আঁধারে
যেভাবে আদম চেয়েছিল হাওয়ার হৃদয়।
হৃদয় ভেঙে ভালোবাসা এক সময় আড়ালে চলে যায়। স্বার্থান্ধ পুরুষ সমাজ অনেক সাধনায় পাওয়া সোনার মেহের নিতান্ত মাটি মতো ছুড়ে ফেলে দেয়। সেই নিষ্করুণ বেদনাবোধকে দিলারা হাফিজ কবিতায় শিল্পায়িত করেছেন এভাবে:
ভালোবাসার আড়ালেও দেখেছি আমি
নিদারুণ স্বার্থপরতা
বাবার
মায়ের ভাই-বোনের
বন্ধুদের
এমন কি স্বামীর
আমি এক নিঃসঙ্গ মানুষ
অতপর
সন্তানের স্বার্থপরতা
দেখবো বলে আজও বেঁচে আছি একা।
হয়ত এটা জীবনের নিমর্ম পরিহাস। নারীর বাস্তবিক জীবন এরকমই। কিন্তু বাস্তবতার চেহারা নারীর চোখ দিয়ে দেখা, নারীকণ্ঠে বলার ধ্বনিটি দীর্ঘদিন বাংলা কবিতায় অনুপস্থিত ছিল। আশার কথা হচ্ছে, সমকালীন বাঙালি নারী লেখিকাগণ সে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন। কবি দিলারা হাফিজ সেই কবিদের অন্যতম। যিনি নারী-জীবনের জন্ম থেকে শেষ পরিণতি পর্যন্ত জীবনের ধারাবাহিক স্তরকে কাব্যশিল্পে রূপায়িত করেছেন নিজস্ব জীবন-অভিজ্ঞতা দিয়ে। পরিণত বয়সে এসে নিজের জীবনের ভিক্ষালব্ধ জ্ঞানকে, অভিজ্ঞতাকে অভিজ্ঞানে রূপ দিয়েছেন কবিতায়। এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য-শৈল্পিক সার্থকতা।