জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ তিথি আফরোজ কবি। কোনো যান্ত্রিক শ্রম বা চেষ্টাচর্চিত প্রয়াস নয়, তিথির ভেতরে কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত, ফল্গুধারার মতো উৎসারিত। যাপিত জীবনকে তিনি কবিতা করতে পারেন এক অন্তঃজ আলো ও কাব্যিক শক্তিতে। তার কবিতা সম্পর্কে অগ্রজ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘মুহূর্তের বিস্ময়াশ্রিত সংকটকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি তিথি আফরোজ, যে সংকট ব্যক্তি হয়ে সমষ্টি হয়ে সমকালে সম্প্রসারিত।’ যথার্থ এই মূল্যায়ন।
সমকালের কবি তিথি আফরোজ কোনো কাঁচঘরে নিজেকে বন্দি করে রাখেননি বা বিশুদ্ধতার মায়াজালে নিজেকে জড়াননি। চারপাশের ঘটনাস্রোতকে তিনি একটি চাদরের মতো জড়িয়ে নেন গায়ে, তাতে শিল্পের কাঁটা ও ফুল গেঁথে দেন। তরুণ বয়সেই তিনি লাভ করেছেন এক জীবনের অভিজ্ঞতা, সেই অভিজ্ঞতার নির্যাস উঠে আসে তার কবিতায়, কখনো সরল, কখনো গরল হয়ে। নারী হয়েও তার কবিতায় কোনো মেয়েলিপনা নেই, বরং রয়েছে এক গৌরবদীপ্ত নারীর প্রতিচ্ছবি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে নাঙা এক তলোয়ার তিথির কবিতা। জীবনের মধু ও বিষ দুটোই তিনি পান করেছেন, কবিতায় উঠে এসেছে সেই অভিজ্ঞতার আলো।
প্রচলিত সংস্কার যা আসলে অচল তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত তিথি আফরোজ। তিনি এমনকি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করেন; কখনো ঈশ্বরের অসাম্য বিধানের প্রতি তিনি সমালোচনামুখর, কখনো তার কাছেই সাম্যতা বিধানের জোর দাবি জানান। এক আধুনিক মন ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে সব পশ্চাদপদতা থেকে মুক্ত রেখেছে, কবিতায় সেই স্বচ্ছ ও সংস্কারমুক্ত মননের প্রতিফলন ঘটে। তিনি প্রথাবিরোধী, নারী পুরুষের পারষ্পরিক শ্রদ্ধায় নির্মিত একটি মুক্ত সমাজের স্বাপ্নিক। চান দ্বিধাহীন প্রেম, একটি বিশ্বস্ত সম্পর্ক ও স্থিরতাভরা একটি ঘর।
প্রথম দশকের কবিতায় নতুন প্রজন্মের নতুন বোধ ও দৃষ্টির যে প্রতিফলন তার সম্মিলন দেখি তিথি আফরোজের কবিতায়। কবিতার যে ডানা তিনি লাভ করেছেন তার জোরেই শিখেছেন ওড়ার কৌশল। জীবন আকাশে এই পাখিটিকে সংগ্রাম করেই উড়তে হয়েছে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা যাকে বলেছেন ‘উত্তরবঙ্গের হিম-স্নিগ্ধ মাঠ ও আকাশের পর আকাশ পেরিয়ে রাজধানীর দিকে উড্ডয়ন।’ কবিতার জোরেই তার এই অগ্রযাত্রা। তিনি চলেও এসেছেন অনেকখানি পথ।
তিথির কবিতায় একটি নিজস্ব স্বর আছে, যা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের অগ্রযাত্রায় এ কবি নিজেকে স্পষ্টতর করবেন সন্দেহ নেই। তাকে অভিবাদন!
প্রথম গ্রন্থ ‘ছন্দপতনের শব্দ’-যে নতুন এক কবির বোধদীপ্ত উচ্চারণ শোনে পাঠক, দ্বিতীয় কাব্য ‘ওড়ার কৌশল’ মানবিক সম্পর্কের জটিলতা ও গ্রন্থি উন্মোচনে প্রত্যয়ী। তৃতীয় কাব্য ‘তিথির তিরিশ’-এবং চতুর্থ কবিতার বই ‘অন্ধ ঈশ্বর’ এ পাওয়া যায় সভ্যতার ও মানবিক বোধের সংকট ও ভণ্ড সমাজের মুখোশ উন্মোচনে ছন্দোবদ্ধ যাত্রা। আগেই বলেছি তিনি কবি, কবি বলেই সত্যবাদী, এমনকি নিজের জীবনসত্যকে তুলে আনতে দ্বিধাহীন। তার কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবিতাই তার সংগ্রাম ও টিকে থাকার প্রধান মানসিক অবলম্বন। কবিতার জন্যই বাঁচেন তিনি। প্রতারক প্রেমিকের প্রতি একইসঙ্গে ক্ষোভ ও মায়া দেখি তার কবিতায়। নারী হিসেবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন তার বেশিরভাগই তিক্ত হলেও তাতে কিছু মধুরতাও রয়েছে। তিথি জানেন, ‘ফাল্গুনের বন্ধু বলে- প্লে-বয়রা ভালোবাসে না/শুধু রঙ নেয়, রঙ দেয় ভূমিকা পছন্দ করে না।’ পতিত কবিতায় তার উচ্চারণ, ‘কেউ কেউ পতিত নয় সকলেই পতিত।’
‘ওড়ার কৌশল’ কবিতাটি শুরু হয়, ‘একটি বালুর ঘর অথবা কাগজের নৌকা/চারু ও কারু ক্লাসে শেখাতে পারি। শিক্ষক সব শেখাতে পারেন/ কীভাবে পাতার নিচে আঠা দিয়ে ফুল বানানো যায়/আর ছেঁড়া কাগজ দিয়ে স্বপ্নের মেঘ।’ ছেঁড়া কাগজ দিয়ে স্বপ্নের মেঘ বানান কবি তিথি আফরোজ। তার কবিতায় পরিপার্শ্ব উঠে আসে কাব্যিক অভিক্ষেপে, যাপিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে যে কবিতার গুপ্তধন লুকিয়ে আছে তাকে তিনি তুলে আনেন উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, রূপক আর প্রতীকে। ‘দাঁড়কাকের জীবন’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘করতালিতে মুখর হয়ে ভুলে যাইনি দাঁড়কাকের জীবন’। ‘দীর্ঘশ্বাস’ কবিতার প্রারম্ভে পাই, ‘বাঁশপাতা ঝরে গেলে হেঁটে যায় দীর্ঘশ্বাস;/ মেহগনির বনে লুকোনো কুমীরের হাড় দেখে/পুনরায় ফিরে যাওয়ার বাসনা লালন করে বুকে।’ ‘লখিন্দর’ শীর্ষক কবিতায় দেখি, ‘যে সাপের মুখে চন্দ্রমল্লিকার সুবাস দিয়েছি সেই কেটেছে বাসর।’
‘তিথির তিরিশ’ তিথি আফরোজের তৃতীয় কাব্য। তিরিশে পা রেখে তার এই আত্মপ্রত্যয়ী আত্মপ্রকাশ বলে দেয় এ কবি বহুদূর যাবেন। গ্রন্থটিতে কবিতাও রয়েছে তিরিশটি। সময়ের ঘাত প্রতিঘাতে কখনো স্বপ্ন বিচূর্ণ হয়, কখনো ভাঙা কাচজোড়া লাগানোর চেষ্টা চলে। কবিতা তার ভেতর অন্তঃসলিলা নদীর মতো, ক্রোধে বা প্রেমে, বিস্ময়ে বা বিবমিষায় কবিতা লিখতে পারেন সমান দ্যুতিতে। তবে সবকিছুই যে কবিতা নয় তা তিনি বোঝেন, তাই যা কিছু কবিতা নয় তাকে ছুড়ে ফেলে দেন। কেবল কখনো উদ্দেশ্যতাড়িত কোনো কোনো কবিতায় একটি কাব্যিকপতন লক্ষ করি। আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলার দায়িত্ব রয়েছে সকল কবির। এ কথা তিথি আফরোজও জানেন। তিথির কবিতায় একটি নিজস্ব স্বর আছে, যা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের অগ্রযাত্রায় এ কবি নিজেকে স্পষ্টতর করবেন সন্দেহ নেই। তাকে অভিবাদন!