অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনা, প্রজ্ঞার চেয়ে আবেগের তীব্রতা-ই জীবনানন্দ-কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দাশকাব্যে বাঙালি স্বভাবের মৌল প্রবণতা—আবেগই বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন কল্পনা ও কল্পনার নানামুখী প্রকাশ।অবশ্যই প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও আচরণের সঙ্গে সে কল্পনা ও কল্পনার প্রকাশ কোনো সংঘাত সৃষ্টি করে না। পরন্তু তাঁর কল্পনা ও চিন্তায় যৌক্তিক যোগসূত্র রয়েছে। এ সবের পরও সত্য—যাপিত জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনাকে যতটা কবিতার অনুষঙ্গ করে তুলেছেন, তারও চেয়ে বেশি যোগ করেছেন কল্পনার প্রাচুর্য ও আবেগের ঐশ্বর্য।এর ফলে দাশকাব্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক উপলব্ধি করতে থাকেন—তার সামনে যে জগত, তা বিপুল রহস্যঘেরা। সেখানে রূপকথা-উপকথা-মিথ-ইতিহাস অভিন্ন হয়ে উঠেছে। এ কারণে কাব্যসত্য-বস্তুসত্যের ভেদও সেখানে অর্থহীন হয়ে পড়ে।
জীবনানন্দ দাশের প্রধান কবিতাগুলো মূলত আবেগ-স্বপ্ন আর অচরিতার্থ জীবনের হাহাকারময়। এসব কবিতায় যতটা প্রাপ্তি, তারও চেয়ে হারানোর চিত্র বেশি। তারও চেয়ে বেশি বিরহগাথা; স্মৃতিচারণাও। বাঙালি স্মৃতিচারণপ্রিয়, আবেগপ্রবণ। এই অর্থে জীবনানন্দ দাশ বাঙালির ভাবালুতার সমব্যথী। তাই, তাঁর কবিতা সতীর্থ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণুদের কবিতার চেয়ে বেশি পঠিত, আলোচিত-সমালোচিতও। তবে তাঁর কবিতা সতীর্থ কবিদের চেয়ে বেশি পঠিত হওয়ার পেছনে, আবেগের প্রাবল্য ও কল্পনার প্রাচুর্যের সঙ্গে আরও একটি বিষয় সম্পৃক্ত। যে বিষয়টি তাঁর প্রতি তীব্র আবেগে থরোথরো বাঙালি পাঠককে আগ্রহী করে তোলে—সেটি ট্রাম দুর্ঘটনায় অকালমৃত্যু। ট্র্যাজিকপ্রিয় বাঙালি পাঠকের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনার প্রাবল্য বেশি প্রিয়। এই কারণেও জীবনানন্দ দাশের কবিতা অন্য সমসাময়িক কবিদের চেয়ে বেশি পঠিত হয়ে থাকতে পারে।
________________________________________________________________________________
তিনি অভিজ্ঞতা ও এর সারবত্তার কথা বললেও, নিজে অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনাকে দিয়েছেন বেশি গুরুত্ব। বলা যায়, তাঁর কবিতার বিপুল অংশেই এই কল্পনার প্রাচুর্য রয়েছে। তবে কিছু কিছু কবিতা রয়েছে, নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর না করে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঝরে পড়েছে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ। বাদ যায়নি তীব্র আবেগ ও অনুরাগও
_________________________________
অথচ, জীবনানন্দ নিজেই ‘কবিতার কথা’য় বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি—কেননা, তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ তিনি অভিজ্ঞতা ও এর সারবত্তা কথা বললেও, নিজে অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনাকে দিয়েছেন বেশি গুরুত্ব। বলা যায়, তাঁর কবিতার বিপুল অংশেই এই কল্পনার প্রাচুর্য রয়েছে।
তবে কিছু কিছু কবিতা রয়েছে, নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর না করে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ঝরে পড়েছে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ। বাদ যায়নি তীব্র আবেগ ও অনুরাগও।
ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও অভিজ্ঞতার মিশেলে রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘সমারূঢ়’, ‘ইহাদেরি কানে’, ‘যেই সব শেয়ালেরা’। এ সব কবিতায় জীবনানন্দ দাশ স্বকাল ও স্বসমাজের কদর্যরূপকে দেখেছেন খুব প্রত্যক্ষভাবে। এঁকেছেনও সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছবি। এ সব ছবি আঁকার সময় তাঁর করোটিতে ব্যঞ্জিত হয়েছিল, তাঁর সময় ও সমাজের অন্ধকার দিক। যেখানে মূল্যবোধের অবক্ষয় বিদ্যমান, যেখানে সততা, নিষ্ঠা ও জ্ঞানচর্চা নিতান্তই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল। যদিও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার কদর্যরূপ চিত্রায়িত করেছেন, তবু একথা বলা অসঙ্গত হবে না—স্বকালে অবমূল্যায়িত হওয়ার কারণেই মূলত এমন সব পংক্তি লিখেছেন তিনি।
সমাজ থেকে যখন ন্যায়বোধ, সততা, নিষ্ঠা ও প্রতিভার মূল্য উঠে যায়, তখন প্রতিভাবানেরা স্বভাবতই ক্ষেপে ওঠেন। কিন্তু সে ক্ষোভ প্রকাশেও একেক শ্রেণীর মানুষের একেক কৌশল থাকে। কিন্তু যিনি কবি, তিনি কেবল শব্দে-বাক্যে-চিত্রকল্পে-উপমায়ই তা প্রকাশ করেন। কখনো তীব্র শ্লেষে, কখনো স্লোগানে কখনো বা প্রবাদপ্রতিম পংক্তিতে। জীবনানন্দ শেষ ধারায়। তাই তাঁর কবিতায় তীব্র ব্যঙ্গ, শ্লেষোক্তি রয়েছে। কিন্তু তা প্রকাশে পরিমিত, সংযমী। ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় যখন উচ্চারণ করেন ‘মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়’ তখন তাঁর স্বকালের রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের একটি চিত্র মেলে। আবার তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ক্রোধ প্রকাশিত হয়। কিন্তু যতই তাঁর ব্যক্তিগত সংক্ষোভের ভেতরই এ সব কবিতার বীজ রোপিত থাকুক, শেষপর্যন্ত তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। একই চিত্র রয়েছে ‘সমারূঢ়’ কবিতার এই পংক্তিগুলোয়—‘বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতা/ পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের পর/ ব’সে আছে সিংহাসনে-কবি নয়- অজরঅক্ষর/ অধ্যাপক,..’। কিংবা ‘ইহাদেরি’ কবিতার এই পংক্তিগুলো—‘পৃথিবীর পথে-পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে/ শুনিল আধেক কথা–এই সব বধির নিশ্চল/ সোনার পিত্তল মূর্তি:..’ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সমাজ-রাষ্ট্রের অসুন্দর একটি দিক পরিষ্কার হয়ে
ওঠে।
______________________________________________________________________________________________________________________________________
আসলে এই দ্বিতীয় বা মধ্যপর্যায়ে জীবনানন্দ ব্যঙ্গময়, আত্মকরুণাশীল, গভীর যাতনাবিদ্ধ, বস্তুবিদ্ধ, নিরশ্রু রোদনশীল। পণ্ডিত ও রূপসী দুই-ই তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য, কেননা দুজনই কবি ও কবিতাকে বুঝতে পারে না। একজন ‘অজর অক্ষর’, আর—একজন ‘সোনার পিত্তল মূর্তি;। বহিঃপৃথিবীর কাছে মার খেয়ে কবি তাঁর দেনা শুধেছেন ঠাট্টা করে, কিংবা রেগে গিয়ে।’’ অর্থাৎ জীবনানন্দ ব্যক্তিগত ক্রোধ-আবেগকে ঠাট্টার ছলে, শ্লেষের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন
_________________________________
এ সব কবিতা পাঠে সহজেই উপলব্ধি হয়—জীবনানন্দ তাঁর সমাজ-রাষ্ট্র ও পারিবারিক জীবন নিয়ে অতৃপ্ত ছিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে তাঁর হৃদয়-মন ভরে উঠেছিল। তীব্র অপমানের হলাহল পান করেও নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর ছিল। নারীর নিষ্ঠুর আচরণ, আর তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতদের হৃদয়হীন তীব্র সমালোচনায় তাঁর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত ছিল। এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে মোক্ষম যুক্তি আবদুল মান্নান সৈয়দ দিয়েছেন ‘‘জীবনানন্দ দাশের ‘কবি’ কবিতায়-পর্যায়’’ প্রবন্ধে। বলেছেন—‘‘মন ভেঙে গেছে, তার সঙ্গে স্বপ্নও ভেঙে গেছে কবির। আসলে এই দ্বিতীয় বা মধ্যপর্যায়ে জীবনানন্দ ব্যঙ্গময়, আত্মকরুণাশীল, গভীর যাতনাবিদ্ধ, বস্তুবিদ্ধ, নিরশ্রু রোদনশীল। পণ্ডিত ও রূপসী দুই-ই তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য, কেননা দুজনই কবি ও কবিতাকে বুঝতে পারে না। একজন ‘অজর অক্ষর’, আর—একজন ‘সোনার পিত্তল মূর্তি;। বহিঃপৃথিবীর কাছে মার খেয়ে কবি তাঁর দেনা শুধেছেন ঠাট্টা করে, কিংবা রেগে গিয়ে।’’ অর্থাৎ জীবনানন্দ ব্যক্তিগত ক্রোধ-আবেগকে ঠাট্টার ছলে, শ্লেষের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
এই যে তাঁর আত্মকরুণাশীলতা, এই যে নিরশ্রু রোদনশীলতা—এই বিষয়গুলো আবেগপ্রবণ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। কাঁদায়, ক্ষোভ জাগায়, ঘৃণা করার জন্য প্ররোচিতও করে। এই কবিতাগুলো পাঠের সময়, কবিকে অসহায়, প্রতারিত, উপেক্ষিত হিসেবে আবিষ্কার করে পাঠক।
এ সব অভিজ্ঞতালগ্ন ক্ষোভপূর্ণ কবিতার পাশাপাশি স্মৃতিচারণ ও ইতিহাস-আশ্রিত কবিতায়ও জীবনানন্দকে দেখা যায় তীব্র আবেগে থরোথরো অবস্থায়। ইতিহাস আশ্রিত, স্মৃতিচারণ কিংবা প্রেম-বিরহ বিষয়ক কবিতায় সামষ্টিক অনুভূতির চেয়ে ব্যক্তিক অভিজ্ঞানই বেশি সক্রিয়। এখানে তাঁকে সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা যায় না, দেখা যায় বিশাল জলরাশির মাঝখানে দূর থেকে দেখা একবিন্দু দ্বীপের মতো। যা ক্রমাগত ঢেউয়ের তালেতালে ডুবু-ডুবু। কিন্তু কখনো জলের অতলে ডুবে যায় না, বারবারই ভেসে ওঠে; হাতছানি দেয়—তীরবর্তী মানুষকে সাঁতার দিয়ে সমুদ্র পার হতে।
তার মানে—জীবনানন্দ দাশের কবিতা মাদকতাপূর্ণ। তাঁর কবিতা মগজে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না, কিন্তু হৃদয়কে আলোড়িত করে। মনকে করে দেয় ইতস্তত, বিক্ষিপ্ত। ব্যক্তি তার চারপাশে কেবল শূন্যতা, হাহাকার আর জীবনের অনর্থ খুঁজে পায়। কখনো মনে জীবন বিরহের ভাঁড়ার, কখনো মনে হয়, অচরিতার্থতা-ই জীবনের চরম সত্য, কখনো বা মনে হয়, অসীম ক্লান্তিময়। ‘বনলতা সেন’, ‘বোধ’, ‘মৃত্যুর আগে’, ‘হায় চিল’, ‘আট বছর আগের একদিন’, ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’-এর মতো কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে, ব্যক্তিহৃদয়ের হাহাকার, গোপন ক্ষরণ, আধ্যাত্মসংকট, গাঢ় প্রেম ও বিরহ।
ইতিহাসচেতনার সঙ্গে কালচেতনা এবং প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সম্পর্কের যুগলচিত্র ‘বনলতা সেন’। একইসঙ্গে ‘বনলতা সেন’কে তুলে ধরা হয়েছে ক্লান্তিনাশা আশ্রয় হিসেবে। নিঃসঙ্গ, অনেকানেক পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকের শেষ আশ্রয়স্থল ‘বনলতা সেন’। একারণেই তার মনে হয়—‘সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন; /থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ আবার ‘অন্ধকার’ও এর আভিধানিক অর্থ ছাড়িয়ে ভিন্ন অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়। এখানে অন্ধকার হয়ে ওঠে পরম বিশ্বস্ত অবসর।
কিংবা যদি ধরি ‘বোধ’ কবিতার কথা। সেখানেও হৃদয়-মনকে ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। যেন এক প্রবল মরুঝড়ে সব কিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে। মানুষকে করে গেছে নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ ও বেদনার্ত। এমনই তার অনুভব—‘যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে/নষ্ট শসা—পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,/ যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে/— সেই সব।’ এই অনুভব মানুষকে চিন্তিত করে না, উৎকণ্ঠিত করে। কোনো সমাধানের পথে নিয়ে যায় না, কিন্তু একজন বিপণ্ন মানুষের জন্য নিভৃতে মন কেঁদে ওঠে। ধরা যাক ‘মৃত্যুর আগে’। গ্রামীণ জীবনের আবহমান চিত্র এখানে দেখা দেয় রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি নিয়ে। ‘খড়ের চালের’ পরে ‘মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার’ শোনার পাশাপাশি ‘পুরানোর পেঁচারে ঘ্রাণ’ও পান কবি। অর্থাৎ তাঁর সঙ্গে পাঠকও। কিন্তু এই মুগ্ধরাতের সঙ্গে পেঁচার ঘ্রাণ কিংবা ডানার সঞ্চারের ভেতর ব্যক্তি আসলে কী পেতে চান? জীবনকে ভালোবেসে শেষমুহূর্তে বেঁচে উঠতে চান? না কি পৃথিবীর জীবন তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে বলে অন্য কোনো গ্রহলোকে পাড়ি দিতে চান। প্রচুর প্রশ্ন আছে, আছে বিস্ময়-কৌতূহলও। কিন্তু সহজ কোনো উত্তর নেই।
__________________________________________________________________________________________________________________________________________
জীবনানন্দ দাশকে চিন্তার জটিল অরণ্যের পরিব্রাজক বলা যাবে না কোনো মতেই। তবু এই তিনটি পংক্তির পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে তাকে যথেষ্ট জটিল-অসরল বলেই মনে হয়। কিংবা সেই বিখ্যাত ‘আট বছর আগের একদিন’। সংসার, স্ত্রী, সন্তান, সম্মান—সমাজস্বীকৃত সবই আছে ব্যক্তির।কিন্তু যা নেই, তা তার মনের স্থিরতা। চিত্তের সুখ। প্রগাঢ় বিশ্বাস। তাই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তাই সে ‘লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার’।
____________________________________________________________________________________________________________________________________
‘গোধূলি সন্ধির নৃ্ত্য’ও এইক নেতিবাচক ও মনোযাতনার কবিতা। কবি দেখেন, ‘ক্রুর পথ নিয়ে যায় হরীতকী বনে–জ্যোৎস্নায়।’ অর্থাৎ সেই নৈরাশ্য সেই শূন্যতা। অথচ জীবনানন্দ দাশের সমগ্র কাব্যপাঠেও এমন প্রমাণ মেলে না—তিনি নিখিল নাস্তির পক্ষে। তাহলে এই কবিতায় এমন নৈরাশ্য-শূন্যতা আর নেতির আধিক্য কেন—এমনটা ভাবিয়ে তোলে। ‘কয়েকটি লাইন’ বেদনাহত ও ‘নিরাশ্রু রোদনের’ চিহ্ন হয়ে উঠেছে। এখানে কিঞ্চিৎ আশার কথা বলা হলেও কবি শেষ পযন্ত সেই হতাশা-নৈরাশ্যেই নিমজ্জিত। আশা-নিরাশার পংক্তিগুলো—‘তারা-ভরা আকাশের তলে/ চাঁদ তার আকাঙ্ক্ষার স্থল খুঁজে লয় ,—/আমার নিকট থেকে তোমারে নিয়েছে কেটে যদিও সময়।’ জীবনানন্দ দাশকে চিন্তার জটিল অরণ্যের পরিব্রাজক বলা যাবে না কোনো মতেই। তবু এই তিনটি পংক্তির পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে তাকে যথেষ্ট জটিল-অসরল বলেই মনে হয়। কিংবা সেই বিখ্যাত ‘আট বছর আগের একদিন’। সংসার, স্ত্রী, সন্তান, সম্মান—সমাজস্বীকৃত সবই আছে ব্যক্তির।কিন্তু যা নেই, তা তার মনের স্থিরতা। চিত্তের সুখ। প্রগাঢ় বিশ্বাস। তাই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তাই সে ‘লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার’।
জীবনানন্দের কবিতায় ব্যক্তি তার নিজের আবেগ-অনুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশ দেখতে পায়। কখনো কখনো ব্যক্তির মনে হয়, এই অভিজ্ঞতা জীবনানন্দের নয়, তার নিজেরই। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে জীবনানন্দ তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হয়তো একারণেই তিনি ধীরে ধীরে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। ‘কালের পুতুল’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, চলতিকালের কাব্যরচনার ধারাকে তিনি (জীবনানন্দ দাশ) গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন, সমকালীন ও পরবর্তী কবিদের উপর তার প্রভাব কোথাও-কোথাও এমন সূক্ষ্মভাবে সফল হয়ে উঠেছে যে বাইরে থেকে হঠাৎ দেখে চেনা যায় না।’ বুদ্ধদেব বসুর এই মূল্যায়ন যথার্থ। তার প্রমাণ জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতার ইতিহাস-প্রবণতা পর্যালোচনা করলেই মিলবে। জীবনানন্দ-উত্তর বাংলাকাব্যে এমন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি প্রথমে এই কবির প্রভাবে কবিতা রচনা করেননি। কারও কারও সমগ্র কাব্যপ্রচেষ্টা-ই জীবনানন্দীয়। এ কথা বলা অসঙ্গ হবে না—উত্তররৈবিক বাংলাকাব্যে জীবনানন্দের প্রভাব দিগন্তবিস্তারী, অতল স্পর্শী ও সর্বগ্রাসী। তাঁর প্রভাব এড়িয়ে কবিতা রচনা শুধু কঠিনই নয়, অনেকক্ষেত্রেই অকল্পনীয়। বিশেষত আবেগ, কল্পনা, প্রকৃতির সঙ্গে নারীর অভিন্ন রূপ চিত্রায়ণ ও ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সমকাল চেতনার মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রে।