কচি লেবু-পাতার মতো নরম সবুজ আলোয়
. পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;
কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস—তেমনই সুঘ্রাণ—
. হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!
আমারও ইচ্ছে করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো
. গেলাসে-গেলাসে পান করি,
এই ঘাসের শরীর ছানি—চোখে চোখ ঘষি,
. ঘাসের পাখনায় আমার পালক,
ঘাসের ভেতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনও এক নিবিড় ঘাস-মাতার
. শরীরের সুস্বাদ আন্ধকার থেকে নেমে।
(ঘাস)
কবিতা ব্যাপারটাই হচ্ছে, রহস্যের গালিচায় কল্পনার বিস্তার। আবার, এর চেয়েও বেশি কিছু। তাই, এর নন্দনতত্ত্বের সূত্র খুঁজতে আমি যা ভাবি, তা হচ্ছে—প্রথমে পাঠককে সে আচ্ছন্ন করবে। না হয় তাকে ভাবিত করবে। দ্বিতীয়ত, যদি পাঠককে প্রথমেই আচ্ছন্ন করে তো। ক্রমান্বয়ে ভাবিতও করবে। কিংবা প্রথমেই যদি ভাবিত করে, তাহলে ক্রমান্বয়ে আচ্ছন্নও করবে। বলতে দ্বিধা নেই, কেবল যার মধ্যে এমন দূরবর্তী দেখার রহস্য আছে। যে দেখার সর্বোচ্চ উপলব্ধিতে, সেই ভাষার রূপ ও স্বরূপ উন্মোচিত হয় কিংবা যে কবিতা আমাকে আচ্ছন্ন করে না—এমনকি ভাবিতও করে না, সেটি আমার কাছে কোনো কবিতাই নয়।
আবার আমি সেসব কবিতায় ডুবে যেতে চাই, যে কবিতার এলোমেলো চিন্তার ঢেউগুলো পাড়ভাঙা তীরে এসে, আছড়ে পড়ছে নিজের ও অন্যের আত্মায়। এক্ষেত্রে জীবনানন্দই অখণ্ড এবং প্রফিসি। তার একেক পঙ্ক্তি থেকে অন্য পঙ্ক্তিতে যাওয়ার ঘূর্ণি, কাল-মহাকাল, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, মিথ, নৃতত্ত্ব, ব্যক্তি ও সমষ্টি, সংঘর্ষসমগ্র প্রকাশে জীবনানন্দকেই এক অসীম ট্রাভেলার মনে হয়। ফলে আজও জীবনানন্দের কাব্য ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েই আমি যেন বারংবার কবিতা পাঠের মুগ্ধতা খুঁজি।
জীবনানন্দের কবিতা আমাকে অস্থির করে। গুঢ় চেতনাকে আলোড়িত করে। আচ্ছন্নও করে ফেলে। স্বভাবতই আলাদা উপলব্ধিতে তৃষ্ণার্তও করে। ফলে তার কাব্যের প্রগাঢ়তায় আমি প্রতিনিয়ত রোমাঞ্চিত হই। কখনো কখনো উত্তেজনাও তৈরি হয় সমগ্র সত্তায় দ্রৌপদীর নাচ। আর এর থেকেই মনে হয়, আমি জেগে জেগে ঘুমোচ্ছি অথবা কল্পনার জাদুতে হাঁটছি অন্যমনস্ক-গভীর ঘুমের ভেতর একা। এই যে, বিষণ্ন হচ্ছি। জারিত হচ্ছি। রোমাঞ্চিত হচ্ছি। এখানেই শেষ নয়। জীবনানন্দের কবিতা আমাকে দুর্গম রহস্যের ফাঁদে ফেলে ভয়ার্তও করে। আমার স্ত্রী-কন্যা যখন মধ্যারাতে আমার পাশে ঘুমিয়ে থাকে, তখন আকাশের গাঢ় অন্ধকার রহস্যময় চুলের মধ্যে ধবল জ্যোৎস্নার অপরূপ রূপ, সবুজ আলোয় ভরে ওঠে। খোলা প্রান্তরের বাতাসে ঘাসের ঘ্রাণ ব্যথিত গন্ধের নীরবতায়—মনে হয়, ‘এই ঘাসের শরীর ছানি—চোখে চোখ ঘষি,/ ঘাসের পাখনায় আমার পালক।’ এভাবেই বুঝতে পারি, কবিতার অদ্ভুত প্রহেলিকায় কতটা সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
দেখা নিয়ে আইনস্টাইনের বিরোধ ছিল সর্বজনবিধিত, কিন্তু যে দূরবর্তী কল্পনায় বিজ্ঞানের সূত্রকে দৃশ্যমান দেখতেন আইনস্টাইন, সেই একই চরিত্র ধারণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বলা যায়, বাংলা কবিতার তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী—আরেক আইনেস্টাইন। পাঠক কখনোই আইনেস্টাইন পান করতে পারে না ঠিকই, কিন্তু বহুকাল পরে এখন জীবনানন্দের কবিতা পান করছে যে যার মতো। পার্থক্যটা এখানেই। কারণ, কবিতার নন্দনতত্ত্ব প্রয়োগে এমন সাহস আর কারও কবিতায় এমনটি দেখা যায়নি। দেখা যায়নি এত প্রবল ইন্দ্রিয়ানুভূতি, স্বপ্নের মতো ঘোর, অভিনব অর্থের সংযুক্তি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বন্দ্ব নির্মাণে বহুদূর কণাঘুম খুলে দেখা। যদিও তিরিশের সময়ের কবিতার পাঠক তার কবিতা সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন, কবির ভাষার ব্যবহারের গভীরতা ও ভিন্নতাকে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি অনেকেই। তখন বাঙালি হৃদয়ের আতিশয্য ও আলোকতার প্রতি নিলর্জ্জ লোভ ও প্রগলভতা এতই উচ্চকিত ছিল যে, তখন তার কবিতার অন্ধকারের শক্তি উপলব্ধি করার মতো পাঠক কয়েকজনই ছিল কেবল। কিন্তু এখনকার অগণন পাঠকের মতো আমিও কি ধরে নেব, ‘কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস—তেমনি সুঘ্রাণ/ হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।’
‘ঘাস’—এই কবিতাটির সর্বাঙ্গে জীবনানন্দীয় নিসর্গ—দর্শনের এত সর্বজনীন কাব্যধারা—ক্রীড়াসূত্র রয়েছে। কিংবা কাব্য বিমানবায়নের মধ্যে মানবায়নের যে বীজপত্র আছে, তাতেও তো অস্পষ্টতা থেকে স্পষ্ট হতে হতে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে ভেসে উঠছে কিছু হতাশাগ্রস্ত ছবির ইম্প্রেশন এবং পুনর্জন্মের আকঙ্ক্ষা। কিন্তু, আমি যতবারই কবিতাটি পাঠ করি, ‘ঘাসের ভেতর ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার/ শরীরের সুস্বাদ আন্ধকার থেকে নেমে।’ এমন পরাবাস্তবকে বাস্তব নিসর্গে নামিয়ে আনা ঘোর, অথবা যে বোধের আকাঙ্ক্ষায় কবি ঘাস-মাতার গর্ভে ঘাস হয়ে জন্মানোর সুস্বাদ, বাস্তবকে বিমূর্ত, বিমূর্তকে ইন্দ্রিয় জর্জরিত করা এমন ইমেজকে, আমিও কেবল দূরবিস্তারী এক ধরনের গুঢ় মুগ্ধতার ভেতর থেকে টের পাই। যদিও এ কবিতাটির সরল পঙ্ক্তিগুলো আবার খুব সরলও নয়। তবু, কবিতাটির মেটাফর বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিম্বলের গভীরে গেলে বুঝি, সুদূরে আশ্চর্য কোনো এক গভীর মায়ালোক আছে।