জাপান—পুরো দেশটাই দেখার মতো। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপভোগ করার মধ্যে কী এক অদ্ভুত আনন্দ তা প্রত্যক্ষদর্শী ব্যতিরেকে অনুভব করা সত্যিই কঠিন। এই দেশে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান ও স্থাপত্য। বহু ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রী এবং খাবারদাবার। ধর্মীয় উপাসনালয় তথা মন্দিরের দেশও জাপান। এত ছোট-বড় মন্দির এই দেশের আনাচেকানাচে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত হচ্ছে, যা একুশ শতকেও মানুষকে ভাবায়! জাপান কি তা হলে ধর্মভিত্তিক দেশ? এই প্রশ্নটি মনে জেগে ওঠাই স্বাভাবিক। উপাসনালয়, মন্দির বা প্যাগোডা; যা-ই বলি না কেন, সেসব অবশ্যই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবের আধার কিন্তু দেখারও বস্তু। অর্থাৎ পর্যটন শিল্পেরও প্রধান উপাদান, এটা এই দেশে না এলে আমার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না। আস্তিক-নাস্তিক, ধর্মী-বিধর্মীসহ নানাবিধ পেশাজীবী মানুষেরও ভালো লাগবে জাপানের শিন্তোও ধর্মীয় মন্দির যাকে বলে ‘জিনজা’ ইংরেজিতে হলো ‘শ্রাইন’ এবং বৌদ্ধধর্মীয় মন্দির ‘তেরা’ বা ‘জি’ ইংরেজিতে ‘প্যাগোডা’ চলতি ভাষায় ‘ওতেরা’গুলো। যেমন নির্মাণ-সৌন্দের্য-সৌকর্যের দিক দিয়ে, তেমনি এসব ঘিরে সৃজিত মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। যা চক্ষুদ্বয়কেই শুধু আরাম দেয় না, শরীরের ক্লান্তিকেও প্রশমিত করে। নানা রকম ভাবনারও উদ্রেক করে। ভারত বা বাংলাদেশের ধর্মীয় বা প্রত্ননিদর্শনগুলোর পরিবেশ যেমন ধুলোময়লায় একাকার এবং রুষ্ট পরিবেশদ্বারা আবদ্ধ, জাপানে তার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই! এই ব্যাপারটা সহজেই যে কারও চোখেপড়ার মতো একটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। আর যারা সাহিত্যমনা, শিল্প-সংস্কৃতিমুখী তারা যে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে এইসব প্রাচীন স্থাপত্যকর্মের আঙ্গিক, রূপরেখা আর শৈল্পিক কলাকৌশল প্রত্যক্ষ করবেন, তা বলাই বাহুল্য।
সারা জাপানে প্রায় ৮৫ হাজার জিনজা ও প্রায় ৭৬ হাজার জি বা ওতেরা বিদ্যমান বলে সাধারণ একটি জরিপ থেকে জানা যায়। এর মধ্যে শিন্তোও ধর্মীয় ‘জিনগুউ’, ‘তাইশা’ তথা ‘মহাজিনজা’ একাধিক। সুবিখ্যাত হচ্ছে ইসে জিনগুউ, কাশিমা জিনগুউ, কাতোরি জিনগুউ, আৎসুতা জিনগুউ, হেইআন জিনগুউ, কিরিশিমা জিনগুউ, মেইজি জিনগুউ প্রভৃতি। তাইশা হচ্ছে, যথাক্রমে ইজুমো তাইশা, কুমানো তাইশা, কাসুগা তাইশা, সুমিয়োশি তাইশা, সুওয়া তাইশা, মিশিমা তাইশা, ফুজিসান হোনগুউ আজুমা তাইশা ইত্যাদি। এছাড়া তেনমানগুউ, সুইতেনগুউ, হাচিমানগুউ, তোওশোওগুউ, হাচিমানগুউ, ইনারি ইত্যাদি ঘরানার জিনজাও বেশকিছু বিদ্যমান, বিশেষ করে তোচিগি-প্রিফেকচারে অবস্থিত তোওশোওগুউ জিনজা যা মধ্যযুগে সামুরাই শোওগুন (জেনারেল) তোকুগাওয়া ইয়েয়াসু (১৫৪৩-১৬১৬ খ্রি.) নির্মাণ করেছেন যা মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। তবে এই সব জিনজার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো তারতম্য রয়েছে কি না, জানা নেই। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা, প্রাচীন ও মধ্যযুগে স্থানীয় শাসককুলের ইচ্ছেধীন রুচিবোধ ও অজ্ঞাত রীতিরীতির কারণে নানাবিধ নামকরণ হয়ে থাকবে। উপাসনার ক্ষেত্রে দেবদেবীরও তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। শিন্তোও মূলত জাপানের নিজস্ব প্রাচীনতম ধর্ম, যা আদতেই প্রাকৃতিক শক্তি ও উপাদানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মূলত মাটি অর্থাৎ কৃষি, প্রকৃতি তথা নদনদী-পাহাড় অর্থাৎ জলের উৎস ও পূর্বপুরুষ যারা এই দ্বীপবলির দেশটিকে হাজার-হাজার বছর ধরে রক্ষা করে চলেছেন তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণকরাই শিন্তোও ধর্মের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বা মনোস্কাম। শিন্তোও ধর্মের নানা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তার মধ্যে সর্বপ্রাণবাদ তত্ত্ব অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যানিমিজম’ উল্লেখযোগ্য—এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী শিন্তোও অনুসারীরা অনুগত। তারা সবকিছু এমনকী, প্রস্তরেও ঈশ্বর অস্তিত্বমান বলে বিশ্বাস করেন। তাই জিনজাগুলোর তোরণ এবং প্রাঙ্গণে তাই শেয়াল (উর্ব্বতার ‘কামি’ বা ঈশ্বর), গরু, ঘোড়া, পাখি ইত্যাদির কাঠনির্মিত এবং প্রস্তরখোদিত মূর্তি বা ভাস্কর্য বিদ্যমান। সেইসঙ্গে রয়েছে দণ্ডায়মান প্রস্তরখণ্ড এবং প্রস্তর ফলক। উল্লেখ্য, জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন জিনজা হচ্ছে ইজুমো তাইশা (যা নিয়ে দু-তিন বছর আগে সাপ্তাহিক এখনই সময় এর ঈদসংখ্যায় একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম)।
জাপানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয় আসুকা যুগে (৫৩৮-৭১০ খ্রি.)। সেই সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন রূপে বদলে গিয়ে ‘জুউ সান শুউ.গো জুউ রোকু হা’ অর্থাৎ ‘৩০টি দল (সম্প্রদায়) এবং ৫৬টি উপদলে বিভক্ত হয়েছে। জাপানের ধর্ম প্রাচীনকাল থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই সেদিনও তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্ভাব রেখে তাদের আশীর্বাদের বদৌলতে সমাজে প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। ধর্ম মানেই ব্যয়বহুল সামাজিক অনুষঙ্গ। যার প্রতিষ্ঠা ও বিস্তৃতির জন্য রাজকীয় ক্ষমতা ও অর্থবলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না, যেমনটি আমরা ভারত-সভ্যতায়ও দেখতে পাই। শাসকরাও তাদের মনোগত স্বর্গলাভের স্বার্থে অথবা প্রজার ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণের স্বার্থে ধর্মকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয় কিংবা রাজকীয় ইতিহাস নির্মাণেও ধর্ম ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এইসব কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে উপাসনাবেদি বা মন্দির নির্মাণের সংস্কৃতির সূচনা সুপ্রাচীনকালেই। জাপানও তার ব্যতিক্রম নয়। যিনি যত বড় ক্ষমতাবান শাসক ছিলেন, তিনি তত বড় মন্দির বা জিনজা নির্মাণ করেছেন, নিজের ইচ্ছেমাফিক। মন্দিরকে কেন্দ্র করে বিপুল স্থানব্যাপী প্রকল্প গড়েছেন বংশানুক্রমে। বৃহৎ বৌদ্ধমন্দিরগুলো প্রধানত বৌদ্ধধর্মের চারটি প্রধান যুগ যথাক্রমে আসুকা যুগ, নারা যুগ (৭১০-৯৪ খ্রি.), হেইয়ান যুগ (৭১০-১১৮৫ খ্রি.) ও কামাকুরা যুগে (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রি.) নির্মিত হয়েছে। প্রথম দিকে চোওছেন বা কোরিয়া উপত্যকা থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে চীনা প্রভাবে জাপানে এই ধর্মের বিকাশ ঘটে ব্যাপকারে। তিন দেশ যথাক্রমে বৌদ্ধধর্মের মূল ভূমি ভারত, কোরিয়া এবং চীনের প্রভাব গ্রহণ করে বৌদ্ধধর্ম জাপানে কালক্রমে স্থানীয় ধারার জীবনপ্রবাহের সঙ্গে মিলেমিশে জাপানি রূপ ধারণ করে।
আজকে বৌদ্ধধর্মের যে জয়জয়কার এবং ক্রমাগত সমৃদ্ধি তার প্রধান তীর্থস্থানই হচ্ছে প্রাচ্যের শান্তিবাদী দেশ জাপান। ভারত থেকে বিতাড়িত ভগবান বুদ্ধের শেষ আশ্রয়স্থল এই জাপানেই নির্ধারিত হয়েছে ৬ষ্ঠ শতকে। জাপানের প্রথম মহাবৌদ্ধমন্দির যা প্রথম রাজধানী নারা নগরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সম্রাট শোওমুর (৭০১-৫৬ খ্রি.) আমলে। তিনি রাজত্ব করেন ৭২৪-৪৯ খ্রি. পর্যন্ত। তার আমলে তারই উদ্যোগে নির্মিত হয় বিশাল প্রকল্প তোওদাইজি বা মহাপূর্বাঞ্চলীয় বৌদ্ধ মন্দির। এটাই জাপানের এই পর্যন্ত সবচে বৃহৎ প্রকল্প। এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৈরোচন বুদ্ধের মহামূর্তি—জাপানি ভাষায় যাকে বলে ‘দাইবুৎসু’, যার উচ্চতা ১৪.৯৮ মিটার। শির ৫.৩ মিটার। চোখের আয়তন ১.০২ মিটার। কানের আকৃতি ২.৫৪ মিটার। যে পদ্মফুলপাত্রের ওপরে তিনি আসনরত সেই পাত্রের উচ্চতা ৩.০৫ মিটার। পদ্মপাত্রের গায়ে রয়েছে সরু রেখায় চিত্রিত নানা মন্ত্র এবং তথ্যাদি। ধুপধুনোর সৌগন্ধে মহাবুদ্ধ সমাহিত। এক হাত সামান্য উঁচিয়ে ধরে ‘অভয়’ মুদ্রায় আশ্বস্ত করছেন অগনিত ভক্তকে। ‘দাইবুৎসু’র ওজন ৫০০ মেট্রিক টন! মহাবুদ্ধের দুপাশে স্বর্ণরঙা তার দুজন প্রহরী বা সহযোগী পদ্মাসন করে বসে আছেন। তারা হলেন কোকুউজোও বোসাৎসু তথা অক্ষগর্ভ বোধিসত্ত্ব এবং নিওরাই বোসাৎসু তথা তথাগত। এই দুজনও বিপুল আয়তনের অধিকারী।
তোওদাইজি পুরো প্রকল্পটাই আজকে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্পদ একইসঙ্গে ইউনেসকো’র বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদও বটে। এই মন্দিরেই সম্রাট শোওমুর অনুরোধে দক্ষিণ ভারতীয় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম বৌদ্ধ মহাপুরোহিত বোধিসেনা (৭০৪-৬০ খ্রি.) ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে বৈরোচন মহাবুদ্ধ ভাস্কর্যের ‘তোওদাইজি দাইবুৎসু কাইগেন কুয়োওএ’ তথা ‘মহাবুদ্ধের চক্ষু উন্মীলন শুভানুষ্ঠান’ অথবা ‘বুদ্ধাভিষেকে’র উদ্বোধন করেছিলেন। অর্থাৎ মহাবুদ্ধের দুচোখের ওপর উন্মীলনের রেখা চিত্রাঙ্কন করেছিলেন জীবনদানের প্রতীক হিসেবে। তিনি চীন দেশ থেকে জাপানে তার দলবল নিয়ে জাপানে আগমন করেছিলেন ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনিই এই দেশে প্রথম সংস্কৃত ভাষার পূর্বরূপ সিদ্ধাম ভাষা চালু করেন। যা আজও চর্চিত হচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দ ৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম সম্মেলনে যোগদানের পথে জাপানে কয়েকদিনের জন্য অবস্থান করেছিলেন, তখন তিনি বৌদ্ধমন্দিরে এই ভাষা শিক্ষার দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন বলে তার স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। উক্ত তোওদাইজি মন্দির দিয়ে জাপানে বৌদ্ধধর্মের আন্তর্জাতিক সূচনা এবং বিস্তার লাভ করেছিল অতিদ্রুত। তাই এর তাৎপর্য হাজার বছরের ব্যবধানে আজও উজ্জ্বল। সেইসময় জাপানের এমন কোনো প্রদেশ ছিল না প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগের এদো যুগ (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রি.) পর্যন্ত যেখানে বৌদ্ধ মন্দির গড়ে তোলা হয়নি। যেখানেই শিন্তোও ধর্মের জিনজা বা মন্দির গড়ে উঠেছে তার কাছাকাছি বা একই প্রাঙ্গণে বৌদ্ধ মন্দিরও স্থাপিত হয়েছে।
অন্যদিকে, একসময়কার বৌদ্ধপ্রধান দেশ দক্ষিণ কোরিয়া এখন খ্রিস্টানপ্রধান দেশ, কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়ায় ধর্ম নিষিদ্ধ। চীন ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে বৌদ্ধধর্মকে নিষিদ্ধ করে—চীনা সমরতান্ত্রিক শাসকদের ভাষায় ধর্ম হচ্ছে আফিম। কিন্তু জাপান শতশত বছর ধরে ধর্মীয় উদ্দীপনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের যে উজ্জ্বল উদাহরণ স্থাপন করেছে তা চীন-কোরিয়া করতে পারেনি, পারেনি ভারতও। মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) শিন্তোওধর্মী সম্রাট মেইজির আদেশে শাসন ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয় রাষ্ট্রীয় এক ঘোষণাদ্বারা। এই ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত জাপানে প্রাচীনকাল থেকেই শিন্তোও, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে নানা বাদবিবাদবিরোধ যেমন বজায় ছিল আবার সুসহাবস্থানেরও নজির আছে। প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বৌদ্ধমন্দিরগুলোতে ‘সোওহেই’ নামে ভিক্ষুসেনা মোতায়েন রাখা হতো।
জাপানি বৌদ্ধধর্মের একটি চমৎকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভারতীয় হিন্দু দেবদেবী এই দেশে বৌদ্ধমতে পূজিত হওয়া। যেমন তাইশাকুতেন (ইন্দ্র), কিচিজোওতেন (লক্ষ্মী), বিশামোনতেন (কুবের), দাইকোকুতেন (শিব), বেনতেন/বেনযাইতেন (সরস্বতী)সহ আরও। জাপানে খুবই বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় কল্যাণকামী ‘শিচিফুকুশিন’ ‘বা ‘সপ্তদেবদেবী’—এই দেববৃত্ত গঠিত হয়েছে ভারতীয় তিনজন, চীনা তিনজন এবং জাপানি একজন দেবদেবীকে নিয়ে। উক্ত ভারতীয় হিন্দু দেবদেবী যথাক্রমে দাইকোকুতেন, বেনযাইতেন এবং বিশামোনতেন এই দেববৃত্তের অন্তর্ভুক্ত।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, ভারত থেকে যেসকল দেবদেবীর আগমন জাপানে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে এবং যাদের নামের সঙ্গে ‘তেন’ যার অর্থ ‘ব্রহ্মা-’ বা ‘স্বর্গত’ সে সব দেবদেবীর মন্দির হচ্ছে ‘তেরা>ওতেরা’, আর এদের বাইরে যারা তাদের মন্দির হচ্ছে ‘জি’ বা ‘জিইন’, এগুলোতে স্বয়ং ভগবান গৌতম বুদ্ধ নতুবা তার একাধিক অন্যরূপ হিসেবে অভিতাভ, তথাগত, বোধিস্বত্ত্ব, বৈরোচন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত। আবার অন্যান্য বৌদ্ধ দেবদেবীর মন্দিরও বিদ্যমান। যেমন তোওদাইজি, হোওরিউজি, কিনকাকুজি, গিনকাকুজি, এনরিয়াকুজি, তোওজি, হোনকানজি, জেনকোওজি, কোওফুকুজি, শিনশোওজি, এরকম বিখ্যাত অনেক রয়েছে। আবার ‘তেরা’ও আছে যেমন কিয়োওমিজুদেরা খুবই বিখ্যাত প্রাচীন একটি বৌদ্ধমন্দির। আছে ‘ইন’ বা ‘জিইন’ও যেমন, বিয়োওদোওইন, চিওনইন, হোওকিয়োওইন, কোওতোওইন ইত্যাদি। রয়েছে মোৎসুজিইন, মানশুজিইন ইত্যাদি।
সাধারণত ‘জিইন’গুলোতে ধর্মবিষয়ে গবেষণা করা হয়, অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। তেমনি জেন্ বৌদ্ধমন্দিরগুলোয় গবেষণা ছাড়াও চিত্রকলা ‘সুইবোকুগা’, ইকেবানা (ফুলসজ্জা), কেনদোও ক্রীড়া, জুওদোও (জুজুৎসু), শোদোও (লিপিকলা), চাদোও (চা অনুষ্ঠান), বোনসাই, হাইকু ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তির চর্চা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। জেন্ সংস্কৃতি জাপানের অনন্যসাধারণ একটি জীবনধারা যা তাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে বিশ্বসংস্কৃতির জগতে। বড় বড় বৌদ্ধমন্দিরগুলোতে নিয়মিত প্রত্নসম্পদ, প্রতিমাশিল্প, ভাস্কর্য, নিহোনগা (ঐতিহ্যবাহী চিত্রাঙ্কন) প্রদর্র্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সম্ভবত জাপানের মতো এত অনন্য বর্ণিল ধর্মীয় বৈচিত্র্য অন্যকোনো দেশে দেখা যায় না।
অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে, হাজার বছরের ধারায় বিশ্বের সব ধর্মই জাপানে এসে এই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত করেছে শিন্তোও ধর্মকে, বৌদ্ধধর্মের একাধিক শাখা যেমন জেন্ যা এসেছে চীন থেকে, চীনে এর নাম চ্যান্ যা আসলে ভারতীয় ধ্যান—বৌদ্ধধর্ম মূলত ধ্যানজাত জাপানে এসে হয়েছে জেন্। জেন্ মন্দিরগুলোতে নিয়মিত ‘জাজেন্’ বা ‘ধ্যান’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এসেছে তিব্বত থেকে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম যার উদ্ভব আসলে বাংলা অঞ্চলে—নিরলসভাবে চর্চিত হচ্ছে জাপানে। নারিতা শহরে অবস্থিত বৃহৎ শিনশোওজি মন্দির তার উজ্জ্বল প্রমাণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানবিক গুণাবলী এবং আধ্যাত্মিক শান্তির বিপুল আধার হচ্ছে জাপানের শিন্তোও এবং বৌদ্ধমন্দিরগুলো। কাজেই জাপানে এসে জাদুঘরগুলোতে গেলেই জাপানকে দেখা, জানা ও বোঝা সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এর অনন্যসাধারণ মন্দিরগুলো পরিদর্শন করা না হবে। অন্যান্য দেশে জাদুঘরগুলোতে গেলেই যেমন সেদেশের সামগ্রিক চিত্রটা ধরা পড়ে জাপানের ক্ষেত্রে তা নয়। অন্ততপক্ষে জাপানে এসে শিমানে-প্রিফেকচারের ইজুমো তাইশা যা জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন শিন্তোও জিনজা; নারা-প্রিফেকচারের তোওদাইজি, হোউরিউজি, কাসুগা তাইশা; কিয়োতোর তোওজি, হিয়েএইযান, কিনকাকুজি, গিনকাকুজি, কিয়োওমিজুদেরা, ইয়াসাকা জিনজা; মিয়ে-প্রিফেকচারের ইসে জিনগুউ; হিরোশিমার ইৎসুকুশিমা জিনজা; চিবা-প্রিফেকচারের শিনশোওজি; তোচিগি-প্রিফেকচারের তোওশোওগুউ; টোকিওর ছেনসোওজি এবং ইয়াসুকুনি জিনজা পরিদর্শন অবশ্য কর্তব্য। জাপানের ২০টি মন্দির ও স্থাপত্যকে ইউনেসকো’র বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ (ওয়ার্ড হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানই প্রমাণ করে যে এই মন্দিরগুলো কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।
জাপানের বৌদ্ধ মন্দির এবং শিন্তোও জিনজা-মন্দিরগুলো যেমন আধুনিক চিন্তা, শৈল্পিক গুণাগুণ এবং বাস্তবধ্যানজ্ঞানদ্বারা পরিচালিত হচ্ছে তা এককথায় বিরল। কেউ কারো ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে মাথা ঘামান না, বাগড়াও দেন না। বড় সত্য এই যে, যত ধর্মীয় মতবাদেরই এই দেশে আগমন ঘটুক না কেন, যতই জাপানিরা প্রভাবিত হোক না কেন, মূল যে ‘জাপানিজম’ বা ‘জাপানিত্ব’ সেটার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, ভবিষ্যতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। শত বছরের ব্যবধানে যে আধুনিক সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে তারও বিকল্প নেই। ধর্মীয় মতবাদের ওপর জাপান নির্ভর নয়, ধর্মের মূল যে মানবতা যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র এক সংস্কৃতি সেটাই তার আধ্যাত্মিক উন্নতির আরাধ্য সদিচ্ছা; আদৌ বিপথু, বিপদগামী, স্বপ্রচারিত ভিত্তিহীন ধর্মযুদ্ধ, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ কিংবা অদৃষ্টবাদ জাপানি সংস্কৃতিবিরোধী। তাই সাধারণ উপাসনালয় থেকে শুরু করে বৃহৎ মন্দিরগুলোর পরিবেশ যেমন প্রকৃতিসমৃদ্ধ তেমনি সম্প্রীতির জন্য সদাসর্বদা উন্মুক্ত।