বাংলাদেশে জহির রায়হান এক বহুমুখী বিরলতম প্রতিভা। কথাসাহিত্য এবং চলচ্চিত্র-বিশ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী দুটি গণমাধ্যম-এর তিনি ধারক ও বাহক। তিনি বাংলাদেশের এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে সংগ্রামের চেতনতর সত্তা হিসেবে ছোটগল্প, উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রে সদর্থকভাবে ব্যবহার করেছেন।
‘আরেক ফাল্গুন’ শীর্ষক এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’ শিরোনামে চলচ্চিত্র কিংবা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং লেট দেয়ার বি লাইট’ ইত্যকার ডক্যু সিনেমার চিত্রনাট্য-প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সংগ্রামে একুশের সাযুজ্য-সন্ধান তাঁর ভাষাপ্রীতি, স্বদেশচেতনা, জাতীয়তাবোধ, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সংগ্রামী-মনন এবং শিল্পীর দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভাষা আন্দোলনকে তিনি মনে করতেন সাংস্কৃতিক আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্তশাসনের উৎসার, যার ওপর দাঁড়িয়েই পরবর্তীকালে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন এবং ন’মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশ। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশের যাবতীয় সংগ্রামী-ঐতিহ্য, প্রতিবাদীচেতনা এবং মানবিক শর্তহীন মূল্যবোধের জন্ম হয়েছে ভাষার খুন থেকে।
এই মহতীবোধই সারাজীবন জহির রায়হানের অন্তর্বৃত্তের চেতনাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। ফলে ব্যক্তিগত জীবনে যেমন তিনি যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিটি গণআন্দোলনের সঙ্গে, তেমনি পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের একজন দায়বদ্ধ শিল্পী এবং কর্মী হিসেবে তার শিল্পমাধ্যম, কথাসাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছেন অস্ত্র হিসেবে, যাকে একদা লেনিন বলেছিলেন, বিপ্লবের খাঁজ। জহির রায়হান রাজনীতি ও শিল্পকে কখনো বিচ্ছিন্নভাবে ভাবতে পারেননি বলেই, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তার বিশেষ ভূমিকাকে বাংলাদেশ-বিরোধী গোষ্ঠী গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছেন বলেই যুদ্ধোত্তর পর্বে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে জল্লাদ-রাজাকারদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁকে। শত্রুরা শেষ কামড় দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, শত্রুর শেষ রাখতে নেই। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকার এর চেতনা একদিন শাখা-প্রশাখার মতো পল্লবিত হয়ে উঠবে। এরা অনুভব করেছিল ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ যে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল একুশের বীজে। এ কারণেই তাঁকে শহীদ হতে হরো। ফলত তাঁর শিল্পের মতো আজো তিনি অমর হয়ে আছেন বাংলাদেশের জনমানসে, চৈতন্যে।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, জহির রায়হানের মতো ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এত গল্প আর কোনো কথাসাহিত্যিক রচনা করেননি। উপন্যাস, ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্রের কাহিনী বিন্যাসে একুশের চেতনায় তিনি আবৃত থেকেছেন বরাবরই, যেমন ঋত্বিক ঘটক নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন দেশভাগের যন্ত্রণায়। বাংলাদেশের ভাষা-আন্দোলনের চেতনার ইতিহাসে জহির রায়হান সে কারণে এক শ্রদ্ধেয় শিরোনাম।
জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বেশকিছু গল্প রচনা করেছেন, একথা গোড়াতেই বলেছি। এ-সব গল্পে তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের তথ্যকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি ফুটিয়ে তুলেছেন একুশের সম্ভাবনা এবং আবেগকে, পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে একুশের আলোতে ব্যবচ্ছেদ ব্যক্তি বিশ্লেষণ। তবে গল্পের প্যাটার্নে, মিথে, স্বরূপে, বিষয় ভাবনায় রোমান্টিকতা এবং কল্পনার আশ্রয় রয়েছে। কিন্তু তাই বলে কল্পনা সেই শরীর উদ্ভটত্ব বা রুগ্ণ রোমান্টিকতায় গড়ে ওঠেনি, এখানেই তাঁর ব্যতিক্রমী অন্বেষা।
দলবদ্ধ ঐক্য চেতনা পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা- যুদ্ধ পর্যন্ত কিভাবে কাজ করেছে, তার সূচনা জহির রায়হান তাঁর গল্পের শরীরে ক্রমশ প্রসারিত করেছেন।
একজন জীবনবাদী তথা জাতীয়তাবাদী শিল্পীর কাছ থেকে এই ধরনের বস্তু-আশ্রয়ী গল্পের পরমপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহে কাম্য। প্রাসঙ্গিক গোড়াতেই আরেকটি কথা বলা প্রয়োজন যে, জহির রায়হান ছিলেন চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ, সে কারণে তাঁর গল্পগুলোর ভাষা এবং চলচ্চিত্রের ভাষা প্রায়শই মাখামাখি হয়ে গিয়েছে। সিনেমার মতোই গল্পের প্যাটার্নে তাই এসেছে চিত্রাভাব, সংলাপধর্মিতা, আত্মকথন, দৃশ্যপম্পরা, কোলাজ এবং মন্তাজ ইত্যাদি। বিশেষত বক্তব্যের সারল্য, ভাষার পরিমিতিবোধ, ইঙ্গিতধর্মিতা, ব্যঞ্জনা, সর্বোপরি একটি কাব্যিক গীতিময়তা তাঁর গল্পগুলোর অবয়ব তৈরি করে দিয়েছে।
একুশেকে নিয়ে তিনি যে সাতটি গল্প লিখেছেন, প্রসঙ্গক্রমে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক:
ক. সূর্যগ্রহণ
খ.মহামৃত্যু
গ. অতিপরিচিত
ঘ. একুশের গল্প
ঙ. একুশে ফেব্রুয়ারি
চ. কয়েকটি সংলাপ, এবং
ছ. হাড়
বিশ্লেষণ ক. ১. ‘সূর্যগ্রহণ’
জহির রায়হানের ‘সূর্যগ্রহণ’ গল্পটি রচিত হয়েছে ১৩৬২ বঙ্গাব্দে এবং জহির রায়হান রচনাবলীতে কালানুক্রমিক বিন্যাস হিসেবে এই গল্পটিকে একুশে ফেব্রুয়ারি-নির্ভর তাঁর প্রথম গল্প হিসেবে বিবেচনা করা চলে। গল্পটি বর্ণনামূলক, ফলত বিবৃতির ফরমুলায় বর্ণিত। সমগ্র গল্পটি রচিত হয়েছে গল্পের কথক চরিত্র আনোয়ার সাহেবের দৃষ্টিকোণ থেকে। গল্পটির অন্তর্বয়ন গল্পের নায়ক তসলীমকে ঘিরে আবর্তিত।
আনোয়ার এবং তসলীম থাকতেন একই মেসে। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হযে মারা যান তসলীম। এই গল্পের কাহিনী একটুকুই, কিন্তু ঘটনার পরম্পরা ঘটতে থাকে কাহিনী-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, অন্তর্দাহ, বিবেকী তাড়না এবং মানবিক মূল্যবোধের ভেতরের টানে। তসলীমের শহীদানের ঘটনাটি আনোয়ার সাহেব জানাতে পারেননি তাঁর পরিবারকে এবং বিবেক, মানবতা, মূল্যবোধ সবমিলিয়ে একটি শুভচেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে আনোয়ার সাহেব ভাষা-আন্দোলনের বিবেকে রূপান্তরিত হয়ে যান, এবং নিজের অজান্তেই তসলীমের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে তসলীমের মতো একমাত্র উপার্জনশীল পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে থাকেন নিয়মিত; তসলীমের স্ত্রী হাসিনাসহ গোটা পরিবারের প্রতি তাঁর এই দায়বদ্ধতা ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এভাবে টাকা পাঠানো এবং মৃত্যুর খবর না জানাতে – পারার অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত আনোয়ার সাহেবের চেতনা অন্তর্গত মানসিক যন্ত্রণা, মনস্তত্ত্ব, হৃদয়ের টানাপোড়েনের স্বরূপ খুবই দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন রায়হান সাহেব:
‘সারারাত জেগে শুধু ভেবেছেন, তসলীমের মৃত্যুর খবরটা কি জানাবেন হাসিনাকে? চিঠি লিখে কি জানিয়ে দেবেন ওদের যে তসলীম মারা গেছে। ওদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম লোকটা আর বেঁচে নেই।’
গল্পের পটভূমি এবং দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করলে অংশত মনে হওয়া স্বাভাবিক যে জহির রায়হান রোমান্টিকতা, বিবেকীতাড়নায়, মানবতাবাদী চেতনাশ্রয়ী জীবনবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পের পরিকাঠামোয় অতিনাটকীয়তার প্রশ্রয় দিলেন কেন! কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদের প্রতি ভালোবাসা, ভাষা আন্দোলনের সম্ভবনাকে দৃঢ়মূল এক বিবেকী দায়বদ্ধতা হিসেবে গ্রহণ করা এবং মহান ভাষা -আন্দোলনের চেতনার উষ্ণতা হৃদয়ে ধারণ করার এই মানসে গল্পের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, এই উদ্দেশ্যটি মাথায় বদ্ধমূল হলে গল্পটিকে বাস্তব বলে মেনে নেওয়া সম্ভব। জহির রায়হানও মানবতাবাদী চেতনা থেকে অনুভব করেছিলেন বাস্তব এমনই হওয়া প্রয়োজন, হওয়া সম্ভব। গল্পটির কাহিনিবৃত্ত সহজ, সরল। ভাষাভঙ্গি কাব্যিক, মিতবাক্, বাকভঙ্গী এবং রোমান্টিক মেজাজ গল্পটি কবিতার হাত ধরে হৃদয়ের কাছে নিয়ে যায়। একারনেই এ গলকপ কবিতার মতো হৃদয়বৃত্তের কাছে কম্যুনিকেটিং, সদর্থক, দায়বদ্ধ।
বিশ্লেষণ খ. ২. ‘মহামৃত্যু’
রোমান্টিকতার চাদর গায়ে জড়িত বলে ‘ মহামৃত্যু’ গল্পেও জহির রায়হান কিছু কিছু অতিকথন, নাটকীয়তা ও অবাস্তবতার উপাদান ছড়িয়ে রয়েছে। তবে ‘ সূর্যগ্রহণ’ গল্পের সঙ্গে প্রতিতুলনায় ‘মহামৃত্যু’ অনেকাংশে বাস্তব ও স্বাভাবিক। ‘ মহামৃত্যু’ গল্পটির মধ্য দিয়ে জহির রায়হান দেখতে চেয়েছেন একুশে ফেব্রুয়ারির সার্বজনীন আবেদনের কথা, যা প্রতিটি বাঙালির চেতনায় সঞ্চারিত অন্তর্স্রোতে এক স্বতঃস্ফূর্ত অনুপ্রেরণা। বাঙালি সত্তার সম্মিলিত শক্তিরই প্রকাশ ঘটেছে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ঠিক এই কারণেই গল্পে দেখা যায় যে, গল্পের বিশিষ্ট চরিত্র শিবানী তার আঙুল কেটে রক্ততিলক পরিয়ে দেয় পুলিশের গুলিতে নিহত শহীদের কপালে; আবার দুই সহচারী তাদের চুল দিয়ে মুছে দিচ্ছে যেন শহীদের পা। এই ঘটনা- পারম্পর্য বিশ্লেষণ করলে কাহিনির এই আবরণকে নাটকীয় ও বাস্তব পরিহার বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ভাষা- আন্দোলনকে পবিত্রযুদ্ধের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখলে কিন্তু এই ঘটনাকে অবান্তর না ভেবে বরং পূতপবিত্র সংগ্রামের প্রতীক হিসেবেই গণ্য করতে ইচ্ছে করবে। জহির রায়হান যেভাবে ঘটনা ও কাহিনি বিন্যাসে আবেগকে ধরে রেখেছেন, তা থেকে একে বরং হৃদয়ের উত্তাপে বাস্তব বলেই মনে হয়। শহীদের মধ্য দিয়েও :
‘মৃত্যুর খাটটা কাঁধে তোলা নিয়ে কাড়াকাড়ি হলো কিছুক্ষণ; ছেলেরা বললো আমরা নেবো।
বুড়োরা বললো, ‘আমরা’।
শেষে রফা হলো। ঠিক হলো মিনিট দশেকের বেশী কেউ রাখতে পারবে না। শ’ খানেক লোক পাড়ার, সবাইকে সুযোগ দিতে হবে তো। খাটে শোয়ান শহীদকে নিয়ে যখন রাস্তায় নামলো ওরা, সূর্য তখন বেশ খানিকটা উঠে গেছে উপরে। সবার সামনে, বাঁশের ডগায় ঝোলানো রক্তাক্ত জামা হাতে সুরেশ উকিলের ছোট মেয়ে শিবানী। তার দু’ পাশে হোসেন ডাক্তারের দুই নাতনী।
সব মিছিলের সবারই কথা ছিল একটি- তাদের ভাষাকে বাঁচাবার জন্যে তাদের জন্যে প্রাণ দিয়েছে শহীদ ছেলেটি।’
এ আসলে চেতনার গন্ধ, চেতনা সঞ্চারিত করে আবেগ ও উত্তাপ তৈরির কাহিনি। যারা ঢাকার কাঁচের ঘেরা প্রদর্শনীতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত সার্ট দেখেছেন, তাদের কাছে এ গল্প বিন্যাস এবং ঘটনার শাখা-প্রশাখাকে নাটকীয় বলে মনে হবে না। চেতনতর সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়ে হাজার বছর ধরে রক্তের গভীরে আলোড়ন তোলাই এই গল্পের মহিমা। ‘ সূর্যগ্রহণ’-এর আনোয়ার সাহেব একা যে দায়বদ্ধতা পালন করার সূত্রপাত করেছিলেন শহীদের শুভানুগমণ হয়ে জনতা ‘মহামৃত্যু’-তে এসে মিছিলে পরিণত হয়ে ব্যাষ্টি থেকে সমষ্টিতে রূপান্তরিত হন। দলবদ্ধ ঐক্য চেতনা পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা- যুদ্ধ পর্যন্ত কিভাবে কাজ করেছে, তার সূচনা জহির রায়হান তাঁর গল্পের শরীরে ক্রমশ প্রসারিত করেছেন।
বিশ্লেষণ গ. ৩. ‘ অতিপরিচিত’
‘অতিপরিচিত’ গল্পটির মূল বিষয় প্রেম চেতনা। কিন্তু সেই প্রেমের অনুষঙ্গে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা, স্মৃতি রোমন্থন ইত্যাদি। গল্পের নায়ক দেশপ্রেমিক কিন্তু তরুণ। নায়িকা কোনো ধনী কন্যা। গল্পটির কাঠামো একটু ভিন্নরীতির। নায়িকার বাবা পাকিস্তানের জন্মের দশ বছর বাদে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন। তিনি পাড়ার রেশন দোকানী থেকে ধাপে ধাপে পৌঁছেছেন শিল্পপতির সোপানে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তার নেই স্যমক জ্ঞান। তার ধারণা : বাংলা ভাষার নিজস্ব কোনো ঐতিহ্য নেই। ইসলামী দেশে ইসলামী ভাষাই হবে রাষ্ট্র ভাষা। ভাষার প্রশ্নে নায়ক-নায়িকার মিলন হলো না। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ব্যবধানেই নায়ক-নায়িকার মিলন সম্ভব ছিল না। জহির রায়হান এই গল্পের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন মনোভাবের পরিচয় ফুটিয়ে তুলেছেন। পাকিস্তান তৈরি হয়েছে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে।
জহির রায়হানের একুশ সংক্রান্ত এই সাতটি গল্পের থীম এককেন্দ্রিক এবং বক্তব্য অভিন্ন। কিন্তু উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় রূপ-রীতিতে গল্পগুলো আলাদ আলাদা হয়ে গেছে।
পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকশ্রেণী মনে করতো বাংলা ভাষার ঐতিহ্য নেই। এর মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলাকে ভাষাহীন এক ক্রীতদাসে রূপান্তরের চিন্তা যে মনে-প্রাণে তারা পোষণ করতো তার ঈঙ্গিত মেলে এবং শুধু তাই নয়, নায়িকার পিতার ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী ভাষা প্রবর্তনার স্বপ্নের মধ্য দিয়ে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার ইতিহাসকেই জহির রায়হান এই গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি প্রেমের হলেও বিভিন্ন মোটিভের মধ্য দিয়ে উক্তি, ভাবনা এবং সংলাপের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের চেতনা এবং শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই গল্পের নায়ক পূর্ব বাংলার তরুন দামাল ছেলে, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু ; নায়িকা ধনীর দুলালী, অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে প্রাচুর্যের প্রতীক সর্বস্ব। নায়ক ও নায়িকার স্থলে যদি ‘ পূর্ব বাংলা’ ও ‘পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বসিয়ে দেওয়া যায় তবে তৎকালীন দুই মেরুর অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শুধু ভাষাই নয়, অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এই গল্পের নায়ক- নায়িকার মিল সম্ভব ছিল না। এটাই বাস্তব, যেমন সম্ভব ছিল না পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মেল-বন্ধন। বাংলা ও উর্দু ভাষার মিলহীন বিচ্ছিন্নতা দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়েই এই নায়ক- নায়িকা রূপাশ্রিত দুই প্রতীক চরিত্রে রূপ নিয়েছে, যা দুটি অসমান্তরাল সমাজের বৈষম্যের চালচিত্র বহন করছে।
বিশ্লেষণ ঘ. ৪. ‘ একুশের গল্প’
জহির রায়হানের ‘ একুশের গল্প’৷ একটি প্রতীকাশ্রিত গল্প। তীব্র আবেগ গল্পের গতিকে দ্রুত লয়ের দিকে নিয়ে গেলেও সংহত বক্তব্য একে স্পষ্ট পরিণতির দিকে পৌঁছে দেয়। গল্পের বিন্যাসে পরিলক্ষিত হয় : চার বছর আগে হাইকোর্টের মোড়ে মাথায় গুলি অবস্থায় পুলিশ যে তপুকে নিয়ে গিয়েছিল চার বছর পরে একটি মাথার কঙ্কালের খুলিতে ছিদ্র দেখে তপুর বন্ধু রাহাত চিনতে পারে তপুকে। কঙ্কালের মধ্যে তপুকে নতুন করে পাওয়ার কামনা, অনুভব করার আনন্দবোধ এবং তারই পাশাপাশি হৃদয়ের যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ অনন্যতা পেয়েছে। গল্পে তপুকে আবিষ্কারের বর্ণনা ব্যঞ্জনাধর্মী :
‘সেদিন সকালে বিছানায় বসে এনাটমীর পাতা উল্টাছিল সে। তার চৌকির নিচে একটা ঝুড়িতে রাখা ‘স্কেলিটনের স্কালটা’ বের করে দেখছিল আর বইয়ের সাথে মিলিয়ে পড়ছিল সে। তারপর এক সময় রাহাতের হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রাহাত সাহেব, একটু দেখুন তো ‘ স্কালের’ কপালের মাঝখানটায় এতোটা গর্ত কেন? ‘
গল্পটিতে লেখকের মানসিকতার দ্রুতচারিতা এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব অনুভব করা গেলেও এই গল্প জহির রায়হানের বহুল প্রচারিত গদ্য কর্মের একটি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুদ্ধের পর কলকাতার এক সভায় তপুকে আবিষ্কারে প্রভাবিত হয়ে কবিতা পর্যন্ত লিখে ফেলেছিলেন। এ গল্প মর্মস্পর্শী এবং চেতনাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখে। এখানেই জহির রায়হানের কৃতিত্ব।
বিশ্লেষণ ঙ. ৫. ‘ একুশে ফেব্রুয়ারি ‘
জহির রায়হানের সবচেয়ে সেরা গল্প ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। এর মূল কাহিনীবৃত্ত একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র আবর্তিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ সংঘাত এবং প্রতিরোধ সংগ্রাম এই গল্পের মূল থীম। গল্পের ফ্রেমে তিনি গোটা সমাজ, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলছেন। কাহিনীর সরল গ্রামীণ চাষী গফুর থেকে ছাত্রনেতা তসলীম ( ‘ তসলীম’ চরিত্রটি ‘সূর্যগ্রহণ’ গল্পেও পরিদৃশ্যমান) ও রিকশাচালক সেলিম পর্যন্ত সার্থক সৃজন। এই গল্পে জহির রায়হান চলচিত্রের চিত্রনাট্য – এর রীতিকে অনুসরণ করেছেন। এই বিচারে একে চিত্রনাট্য- এর প্রতিচ্ছায়া বলাই শ্রেয়। কেননা গল্পের শরীরে তিনি অসাধারণ সংক্ষিপ্ত চিত্রল দৃশ্য ও সিকুয়েশন ফুটিয়ে তুলেছেন এইভাবে :
কতগুলো মুখ
মিছিলের মুখ
রোদে পোড়া
ঘামে ভেজা
সমানের কঠিন উজ্জ্বল দীপ্তিতে ভাস্বর।
এগিয়ে আসছে সামনে।
এ যেন লংস্পট থেকে ক্লোজ আপ – এর ফ্রেমে বন্দী দৃশ্য। ক্যামেরা প্যান ও টিল্ট করে যেন ছবির পর ছবি ধরে রেখেছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক। এ-সব খণ্ডচিত্র বাদ দিলেও গল্পের কোথাও কোথাও আবেগতাড়িত কাব্যরীতিও ধরা পড়েছে। কোথাওবা মন্তাজরীতি বা বাস্তবের সঙ্গে প্রকৃতির চিত্র। জনৈক সমালোচক বলেছেন : ‘ একুশে ফেব্রুয়ারি জহির রায়হানের সুস্থির শিল্পিত সৃষ্টি; বাংলা সাহিত্যে একুশে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক সমগ্র প্রেক্ষিত স্পষ্ট এমন গল্প দুর্লভ।’
এই উক্তিকে মোটেও অতিকথন বলে মনে হয় না।
বিশ্লেষণ চ. ও ছ.৬. ‘কয়েকটি সংলাপ’ এবং ‘হাড়’
‘কয়েকটি সংলাপ’ গল্পটিতে একুশে ফেব্রুয়ারির পূর্বেকার বাংলার মানুষের প্রত্যাশা ও পরবর্তীকালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে তারই মূল্যায়ন করা হয়েছে, তারই কথকতা বর্ণিত হয়েছে। কিভাবে মধ্যবিত্তশ্রেণী তাদের শ্রেণী চরিত্র বদলে দিয়ে ক্রমান্বয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে, জহির রায়হান তা নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন এই গল্পে। গল্পে তিনটি ডাইমেনসন দেখিয়েছেন :
ক. অতীত : জাগরণ – উম্মাতাল এবং মুক্তি প্রয়াসী
খ. বর্তমান : আত্মসমর্পণ, প্রতিক্রিয়া বিকৃতি ও আক্রান্ত
গ. ভবিষ্যৎ : চিরন্তন মুক্তি চেতনায় উজ্জ্বল
এ গল্পটিতেও প্রচণ্ড আবেগের সঙ্গে রূপ পরিগ্রহ করেছে চিত্রনাট্যের ব্যঞ্জনা। জহির রায়হানের ‘হাড়’ গল্পটিও একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী জীবনচেতনাকে নির্ভর করে লেখা হয়েছে। কাহিনি বয়ানে তিনি অবলম্বন করেছেন স্মৃতিচারণার ভঙ্গি। গল্পকারের সাতটি গল্পের বিশ্লেষণ ও দেহ-ব্যবচ্ছেদ থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, জহির রায়হানের মানসিকতার মধ্যে দ্বিবিধ সত্তা ঐক্যসূত্রে কাজ করেছে।
১. একুশ সংক্রান্ত গল্প সম্বন্ধে তাঁর সংশয় এবং
২. তাঁর বক্তব্যের অভিন্নতা
একথা ঠিক যে জহির রায়হানের একুশ সংক্রান্ত এই সাতটি গল্পের থীম এককেন্দ্রিক এবং বক্তব্য অভিন্ন। কিন্তু উপস্থাপনার মুন্সিয়ানায় রূপ-রীতিতে গল্পগুলো আলাদ আলাদা হয়ে গেছে। তবু মহান ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী চেতনা একজন বড় মাপের স্রষ্টাকে যে এভাবে নাড়া দিতে পেরেছে, বাংলা সাহিত্যের কুশীলবদের কাছে সেটা নিঃসন্দেহে পরমপ্রাপ্তি।