গ্রামীণ জনপদের জীবনমথিত গল্প-গাথা জাতিত্বের পরিচয়কে সমৃদ্ধ করে এসেছে যুগে যুগে। জনপদের নিসর্গ, যাপিত-জীবন, হাসি-কান্না, মায়া-মমতা, প্রেম-ভালবাসা, পাওয়া-না পাওয়া, শ্রম-সাধনা ও আশা-প্রত্যাশার চিত্রায়ণ সাহিত্যকে অভিনবত্ব দিয়ে থাকে। তাই লোকজীবন প্রাচীন হয়েও নতুন এবং প্রাসঙ্গিক রূপে আবির্ভূত হয়। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের সাহিত্যসমগ্র বিশ্লেষণ করলে বর্ণিত সত্যের উপস্থাপনা পাওয়া যাবে শব্দে শব্দে। কবির রচনায় লোকজীবনের যে জীবনকেচ্ছা পাওয়া যায়, তা কেবল নিছক অবসর যাপনের সুখ পাঠ্য নয়, একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও নিষ্ঠুরতম সত্যের মোড়ক উন্মোচনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের মানচিত্রও বলা যেতে পারে।
সমগ্রজীবনে জসীম উদ্দীন যে মু্ক্তার খনি আমাদের সামনে উন্মোচন করে গেছেন, তার স্তরে স্তরে রয়েছে জীবনমুখী বাস্তবতা—আর প্রজন্মান্তরে কর্তব্য-কর্মের নির্দেশনা। কবির নির্দেশনা বোদ্ধা পাঠক অন্তরে ধারণ করেন। তদানুসারে পথ চলেন। সাহিত্য সাধনার সব চেয়ে সুবিধা হলো—গল্প, কবিতা বা ছড়ার মাধ্যমে নিখুঁত ও ক্ররতম জীবন সংগ্রামের ছবি আঁকা যায়। সাহিত্যিকদের সে ছবি কখনো আন্দোলনের জন্ম দেয়, কখনো বিপ্লব সংঘটিত হয়, কখনো জাতির জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শন পরিশুদ্ধায়নে ভূমিকা রাখে। বর্তমান লেখায় খোঁজার চেষ্টা করবো—তিনি কী বলতে চেয়েছেন, গ্রামীণ পটে বাস্তবতায় জীবনদর্শনের রূপ-ই-বা কেমন এবং কে-ই-বা তার বক্তব্য ধরতে পারলো। আলোচনার সুবিধার্থে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত জসীম উদ্দীনের ‘মাটির কান্না’ কাব্যগ্রন্থের ‘দেশ’ কবিতাটিকে উপজীব্য করে এগিয়ে যাবো।
কবিতাটি তিনটি স্তবকে রচিত। তিনটি স্তবকের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আন্তঃসম্পর্কিত; পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি বিষয়ের চিত্র চিত্রিত করার সঙ্গে সঙ্গে তার অমর সৃষ্টি আসমানীদের দুর্দশা, অধিকারহীনতা ও অসহায়ত্বের গল্প অঙ্কিত চিত্রে বিভিন্ন রঙে ফুটে উঠেছে। প্রথম স্তবকে চিরাচরিত বাংলার সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা দৃশ্যের বিবরণ পাওয়া যায়; দ্বিতীয় স্তবকে বাংলার সবুজ প্রকৃতি বন-বাদাড়ের ছবি তুলে ধরেছেন; তৃতীয় স্তবকে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখা নদীমাতৃকার কথা বলা হয়েছে। তিনটি স্তবকের টুইস্ট (twist) হলো—বাংলার ফসল, নিসর্গ আর নদী মাতৃকার ওপর আসমানীদের কোনো অধিকার নেই।
বাংলার বুকে তারা যেন অনাহুত। কবির এই অনাহুত জনগোষ্ঠীর হাড় জিরজিরে দুর্দশার কাব্যিক মহিমা নিয়ে আলোচনা আমার অভীষ্ট নয়। এই অনাহুত ও হাড় জিরজিরে জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্ব একদিন কাউকে না কাউকে স্পর্শ করবে, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে সহায়তা করবে—কবির অন্তরে এ আশাও হয়তো সুপ্ত অবস্থায় ছিল। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, সবুজ বাংলার অপরূপ প্রকৃতির রূপসুধা পানের অধিকারী করে তোলার জন্য, এ জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে একদিন কেউ না কেউ আসবেন। তারা আসমানীদের দুঃখ-কষ্ট অবলেপনে উদ্যোগী হবেন। তাদের অভাব দূর করবেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করবেন, চর্যাপদের অমর আখ্যান ‘হাড়ীতে ভাত নাহি’র ব্যঞ্জনা ভুলিয়ে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের প্রত্যাশা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন। কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর আসমানীদের সেই ভেন্ন পাতার ছানি দেওয়া পাখির বাসার মত ঘর আর ফল-ফসল, নদ-নদী এবং বন-জঙ্গলের মালিকা নিশ্চিতে কেউ প্রয়াস পেয়েছিলেন কিনা তা খুঁজে দেখার চেষ্টেই এ লেখার অভীষ্ট লক্ষ্য।
রাজনৈতিক ইশতিহার কিভাবে একটি জাতির লৌকিক জীবনকে ধারণ করে রাজনৈতিক দর্শনে রূপান্তরিত হয় তার জীবন্ত উদাহরণ আমার গ্রাম-আমার শহর প্রকল্প।
১৯৭২ সাল। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের দীনতা, ভঙ্গুর অর্থনীতি আর যুদ্ধের ছাপ কাটিয়ে ওঠার সংগ্রামের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নোয়াখালী জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে অসহায় মানুষদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ শুরু করেন। তারপর দীর্ঘ বিরতি। অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতির নাগপাশ আসমানীদের ভাগ্য বদলের চেষ্টায় মনসংযোগ করতে দেয়নি। দুর্দশা আরও বেড়েছে। আতঃপর তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে আবার শুরু করেন ছিন্নমূল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। তাঁর সে লড়াই তখনো ছিল বিচ্ছিন্ন ও অসংহত প্রচেষ্টা। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের ভাগ্য-উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। তাঁর এই প্রচেষ্টাকে সুসংহত করার জন্য ২০১৮ সালে নির্বাচনি ইশতেহারে তিনি নিয়ে এলেন ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ ধারণা। প্রতিটি গ্রামে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে গিয়ে তাঁর চোখ থমকে গেল। অর্থনৈতিক উন্নতির যে গল্প তিনি রচনা করছেন তার অনেক স্থানে কাহিনিশূন্য চরিত্রগুলো শুষ্ক হাসি নিয়ে যেন চেয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন ফল-ফসলে পরিপূর্ণ এই দেশের অনেক মানুষের এখনো আবাসস্থলহীন—ছিন্নমূল, অনেকের ঘরবাড়ির চিত্র কবি জসীম উদ্দীনের বর্ণনায় চিত্রিত আসমানীদের মতো:
বাড়িতো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।”
প্রধানমন্ত্রীর বোধি যেন শুনতে পেলো কবি জসীম উদ্দীনের আর্তি। ‘দেশ’ কবিতায় যেমন তিনি বলছেন,
সেই ফসলে আসমানীদের নেইকো অধিকার
জীর্ণ পাঁজর বুকের হাড়ে জ্বলছে হাহাকার।
কবি তাঁর অন্তর অলক্ষ্যে যে প্রত্যাশার বীজ বপন করেছিলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র নায়ক যেন সে বীজের সন্ধান পেলেন অসহায় মানুষের মাঝে। আসমানীদের মত মানুষদের পেছনে ফেলে রেখে যে তাঁর উন্নয়নের সাফল্যগাথা পরিপূর্ণ হবে না, তিনি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন। তারপর শুরু হল তাঁর কর্মযজ্ঞ—আসমানীদের মত দরিদ্র, অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষদের জমির অধিকার, ফসলের অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি হাতে নিলেন, দারিদ্র বিমোচনে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন: ‘শেখ হাসিনা মডেল।’ ২০২১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে যাদের জমি নেই ঘর নেই এমন মানুষদের বাছাই করে তাদের আনতে চেয়েছেন উন্নয়নের মূল স্রোতে। তাদের নামে একটি ঘর ও ২ শতাংশ জমির দলিল প্রদানের মাধ্যমে নিশ্চিত করলেন—বাংলার কোন মানুষ অনাহুত নয়। এই বাংলার মাটি ও জলে, ফল ও ফসলে, বন ও বাদাড়ে রয়েছে তাদের জন্মগত অধিকার। একজন রাষ্ট্র নায়কের দায়িত্ব সে অধিকারকে নিশ্চিত করা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাই করেছেন।
জীবিকার প্রয়োজনে নিত্য হাজার হাজার মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। ফলে নগর জীবনে খাদ্যাভাব হতে শুরু করে সব ধরনের নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। শহরমুখী মানুষের গন্তব্য পাল্টে গ্রামমুখী করার জন্য শহরের সুযোগ-সুবিধা, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহ, ইন্টারনেট সেবা ও উপার্জন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তিনি ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুষঙ্গ হিসেবে ইতমধ্যে ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩ টি পরিবার দুই শতাংশ জমিসহ একটি সেমিপাকা ঘর পেয়েছেন। শুধু ঘর বা জমি নয়, এর সাথে আছে বিদ্যুৎ সংযোগ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং ঘরের আঙ্গিনায় সবজি জাতীয় ফসল চাষের সুযোগ—যা আয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। প্রায় দুই লক্ষ পরিবারের সেই ‘পাখির বাসার মতো ঘর যার ভেন্না পাতার ছানি’র চিরচেনা চিত্র—তার স্থলে স্থান পেয়েছে দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ঘর, যার ভেতর রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট এবং রান্নাঘর। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে আসমানীদের মত ভাগ্যহত মানুষের এই পরিবর্তন অবিশ্বাস্য হলেও এটি বাস্তব এবং দৃশ্যমান। সমগ্র কর্মযজ্ঞের প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে দেখব বাস্তবতার সঙ্গে অবিশ্বাসের রঙ-তুলি দিয়ে আঁকা একটি ভিন্ন ধরনের ছবি জাতির সামনে উপস্থাপনে প্রধানমন্ত্রী’র সরকার ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ সচেষ্ট ছিলেন। তাদের এই প্রচেষ্টা বাস্তবতার সাথে যেন কল্পনার মিশ্রণ. Oxford Dictionary সাহায্য নিয়ে বলতে হয়, সমগ্র প্রচেষ্টা ছিল ‘a style of writing that mixes realistic events with fantasy.’ অর্থাৎ বাস্তবতার সঙ্গে জাদুবাস্তবতার অদ্ভুত সংশ্লেষ।
সাহিত্যের সার্থকতা বোধ হয় এখানেই। কবি-সাহিত্যিকরা জগতের অমসৃণ বাস্তবতাকে তুলে ধরেন বাছাইকৃত শব্দের গাঁথুনির মাধ্যমে। তাদের তুলে ধরা সৌন্দর্যের মধ্যে বোদ্ধা পাঠক খুঁজে নেয়—দায়-দায়িত্বের বোঝা। পল্লীকবি জসীম উদদীন তাঁর সমগ্রজীবনে অধ্যয়ন করেছেন লৌকিক জীবন। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালবাসা, আশা-প্রত্যাশার চিত্র গ্রামীণ শব্দের বুননে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘দেশ’ কবিতায় বাংলার সৌন্দর্যের বিবরণ আছে, বিবরণ আছে হৃদয়ে হা-হাকার তোলা দরিদ্রশ্রেণির অপ্রাপ্তির কথা। তাঁর সে উপস্থাপনা ছয় দশক পরে বাংলার রাষ্ট্রনায়কের পথ চলার পাথেয় হিসেবে কাজ করছে। ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিশাল বাংলার বুক চিরে লাল-সবুজ টিনের গল্পে প্রায় দুই লক্ষ পরিবার বেঁচে আছে। তাদের এই বাঁচিয়ে তোলার প্রচেষ্টা অবিশ্বাস্য হলেও এখন তা জ্বলন্ত বাস্তব ঘটনা। ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত তত্ত্ব জাদু বাস্তবতার (magic reality) সফল মঞ্চায়ন—এই আশ্রয়ণ প্রকল্প। রাজনৈতিক ইশতিহার কিভাবে একটি জাতির লৌকিক জীবনকে ধারণ করে রাজনৈতিক দর্শনে রূপান্তরিত হয় তার জীবন্ত উদাহরণ আমার গ্রাম-আমার শহর প্রকল্প।