এ সময়ের কবিতার চারিত্র্য কী?
বিশ্বাস করি, সাম্প্রতিক কবিতা দর্শনঋদ্ধ শিল্পপাঠ। আবেগের স্তর পেরিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য পরিমিতিবোধ রূপায়িত হচ্ছে এ সময়ের কবিতায়। দার্শনিকতা মুখ্য নয়, তা জীবন সন্বিষ্ট। এঁদের কবিতায়, অন্তত কারও কারও, অল্প কয়েক জনের ভাব-ভাষায় একরৈখিকতার বদলে বহুরৈখিকতার রশ্মি দেখতে পাই। আত্মমগ্নতার স্তর থেকে সমাজকাঠামোর দিকে মুখিয়ে আছে তাদের পথ পরিক্রমা; ক্রমশ চলিষ্ণু জগতের পরিবর্তনের বাঁক পর্যবেক্ষণের দিকে দৃকপাত করা এবং তাকে আত্মস্থ করা। এর মধ্যে তারা নিজেদের গেঁথে দিয়েছেন ঘটনা প্রবাহের বড়শীতে; গাঁথছেন অশ্রুবিন্দু সদৃশ শিল্পমালা। সময়কে ধারণ করে সময়কে অতিক্রমণের সাধনা আছে তাঁদের। ঋজু অথচ কোমল স্বভাবে উচ্চারিত ভাষাবিন্যাস তাঁদের কাব্যরীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেশ তাদের কাছে বিশ্ববোধের একটা খণ্ড কেবল; মানুষ তাঁদের কাছে বহু বর্ণিল আনন্দ-বেদনার পাঠমাত্র। এক অন্তর্দাহ-জর্জর বিশ্বব্যবস্থার কাঠামো তাঁদের কবিতার বিষয়বস্তু হতে শুরু করেছে। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা শঙ্খচুড় ইমাম, শামস আরেফিন, গিরীশ গৈরিক, সানাউল্লাহ সাগর, চাঁদনী মহরুবা ও মহিম সন্ন্যাসীর কবিতাপাঠের মধ্যে দিয়ে এই-ছয় কবির ভাবজগতের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রয়াস পাবো।
শঙ্খচুড় ইমাম
শঙ্খচুড় ইমামের কবিতার ভুবনে একটু ঘুরে আসতে পারি আমারা। তাঁর কবিতার স্থাপত্যরীতিটা সংহত, কারুকার্যময়—নানা বর্ণে সজ্জিত, দীপ্তিময়। শৈথিল্য চোখে পড়ে না। বর্ণনামূলক আখ্যানের মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে যান অভীষ্ঠ লক্ষ্যে। বর্ণনার ভেতরে পরিবেশ, প্রতিবেশ প্রতীকময় করে তোলেন। সমাপ্তিতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক ভাষা ব্যবহার করেন। ফলে, তাঁর কবিতা সান্ত্বনার আশ্রয়ে জীবননিষ্ঠ হয়ে ওঠে। উদাহরণ দেই:
চীনা হাঁসের মতো মেয়েটির গ্রীবা ঘিরে
গেঁথে আছে লাল টোস্ট বিস্কুট । (বিশ্বাস)মানুষ মূলত ঝড়ের তলে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটি গাছ। ( মানুষ মূলত)
পৃথিবীর হাতে তুলে দেও তোমার ফুটন্ত সন্তান। (গার্হস্থ্য জীবন শেষে)
শঙ্খচুড় রূপক ও প্রতীকে সিদ্ধহস্ত। এই সক্ষমতা তাঁকে কুশলী করে তুলেছে। আরও উদাহরণ লক্ষ করি:
টোস্ট কিস্কুট মানে-কাম হারানো বৃদ্ধের সকাল বেলা (বিশ্বাস)
কাম একটি ইসকুল ( বিশ্বাস)
বস্তু, নির্বস্তুর দ্বন্দ্ব পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মানবিক আখ্যান নির্মাণই কবির আরাধ্য হয়ে ওঠে, সম্ভাবনায় পূর্ণ হয়ে ওঠে জীবন। রূপকের অন্তর্জাল পেরিয়ে একটি কলিংবেল মূর্ত হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের ঔজ্জ্বল্যে। কবির উচ্চারণ:
একটা কলিংবেল—
যেখানে ঘুমন্ত প্রজাপতির
উচ্চতা মেপে
রেখে দেওয়া হয়
সমূহ সম্ভাবনা (কলিংবেল)
মনে হয় অন্তহীন সৌন্দর্যের মোড়কে কবি জীবন্ত করে তুলতে চান পার্থিবতা।
শামস আরেফিন
প্রকৃতির নরম-কোমল আধারে আশ্রয় খোঁজেন শামস আরেফিন। নাগরিক মনন প্রশান্তির আবরণে তৃপ্তি লাভ করে চির সবুজ নিবিড়তা কামনা করে। বিক্ষুব্ধ ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট হৃদয় উপশম লাভ করে। আমরা দেখি, আরেফিনের কবিতা মমত্বের সুতায় বোনা একধরনের শান্ত নিবেদন, যা তাঁকে বাস্তবতার চৌমাথায় দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর ‘মন’, ‘জীবিকার চাবুক’,‘খরা’, ‘প্রকৃতির কান্না’ ইত্যাদি কবিতায় প্রকৃতি ও ঐতিহ্য-নিষ্ঠ শব্দের ঝংকার সহজেই চোখে পড়ে। উদাহরণগুলোর দিকে চোখ বোলাই:
তোমাকে খুঁজে জোছনার শীতল পাটি হারায় হতাশার বনে… ( মন)
তোমার তালপাতায় তৃপ্ত হতে চায়… (মন)
তোমায় দেখে মজনু-ভালোবাসা ম্যাচের কাঠির মতো ছড়াক প্রেম… (মন)
কষ্ট হজমের জন্য আবেগের পুদিনা পাতা যার নেই …(জীবিকার চাবুক)
ভালোবাসার তুলতুলে পাটিসাপটা পিঠা হতে পারো… ( প্রকৃতির কান্না)
আরেফিনের প্রতীকীবোধ জনজীবন ও লোকালয়ের অনুষঙ্গে প্রতিস্থাপিত। প্রতিদিনের দৃশ্যপট তাঁর কবিতায় নতুন রূপ ধারণ করে। কিছু দশ্যপট এমন:
অর্ধফোটা শাপলার মুচকি হাসি… (মা)
প্রেমকানা কাঠঠোকরা…(মন)
স্মৃতি হাতুড়িতে চূর্ণ বিচূর্ণ স্বপ্ন… (জীবিকার চাবুক)
শহুরে বকুল গাছ…(মন)
হতাশায় বোনা ভোরগুলো…(প্রকৃতির কান্না)
নাগরিক নির্মমতা কবিকে থামিয়ে দিতে পারে না – বরং , আশায় জেগে ওঠে তার মনন। তাঁর কণ্ঠে শেষ পর্যন্ত ধ্বনিত হয় ‘আত্মাকে চিবিয়ে তৃপ্তি পায় বলেই প্রেমের জাবর কাটে জীবন’ (স্মৃতির ব্ল্যাকবোর্ড)। এই জীবনই তাঁর কবিতার প্রসাদ।
গিরীশ গৈরিক
কোনো কোনো কবিতা জীবনের মর্মমূলে প্রবেশ করতে চায়, পাঠ করতে চায় জন্ম-মৃত্যুর আখ্যান, মনুষ্যত্বের স্বরূপ, রহস্যনিবিড়তা ইত্যাকার বিষয় ভাবনার অবয়বে উন্মোচন করব গিরীশ গৈরিকের কবিতা। তাঁর কবিতায় পাবো দর্শনজাত ভাষা,আঙ্গিক-শৈলীতে পাবো নতুনত্বের ছোঁয়া। মনে হচ্ছে, গৈরিক একটা স্ব-ভাষার সূচনা করতে সক্ষম হয়েছেন, যা তাঁকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। নমুনা দেই:
সকল রং এক সরল রেখায় এসে সাদা হয়ে যায়
এসব কথা লাশের কাফনে, বাতাসের রঙে লেখা আছে।
বাতাস রঙের লেখা পাঠ করতে পারে এক ডোম। (ডোম-১)তাই আমার এই হাঁস জনমের বেদনা ফাঁস করে গেলাম কবিতায়
যে কবিতা পাঠ করলেই শুনতে পাবেন চৈ চৈ-চৈ চৈ। (ডোম-২)
গৈরিক স্বভাবে আত্মমগ্ন, প্রকাশেও তাই— ধ্যানী-তপস্বীর মতোন। বিষাদ-বেদনায় দোকানপাট খুলে যে আখ্যান তিনি বর্ণনা করেন, তাতে ধরা পড়ে তীব্রতা -জীবনের, যাপনের। তাঁর ‘মা-৩’, ‘শ্লোক’, কিংবা ‘ডোম-১’ ও ‘ডোম-২, কবিতা এরই সাক্ষ্য বহন করে। গৈরিকের কবিতায় চিত্রকল্প একটি নিত্য অনুষঙ্গ বিষয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি মনুষ্যত্বের মহিমা দান করেছেন নতুন রূপে।
আমার স্মৃতির ভেতর নদীর স্রোতরাতে তোমার ভেসে যাওয়া
এ যেন আমি ডোম বংশের বেহুলা, তুমি লখিন্দর।
আমার কামের ভেলায় তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছি
যেখানে কবিতার অনুরাগে মৃতদেহ প্রাণ ফিরে পায়। (ডোম-৫)
এ প্রত্যাশাই তাঁকে জীবনশিল্পী করে তুলছে
সানাউল্লাহ সাগর
ক্লেদাক্ত সময়কে ধারণ করে আছে সানাউল্লাহ সাগরের কবিতা। নির্মোহ, নির্লিপ্ত থেকে, অতল বেদনা বোধের ধারাভাষ্য নির্মাণ করেন তিনি। ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধে ব্যথিত তিনি। এ থেকে চান উজ্জ্বল পরিত্রাণ। ইতোমধ্যেই তাঁর একটি আলাদা ভাষা গড়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি স্বকীয়তার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন।
তাঁর ‘মানুষ’ কবিতায় দেখি স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা কিভাবে আশাহত করে তোলে মানুষের ভেতর-বাহির; হৃৎ-জগৎ অর্থাৎ মনোজগতের ওপর প্রভাব ফেলে। মানসিক আঘাতে করে জর্জরিত। এমনই প্রক্ষাপটে তাঁর কবিতা বিনির্মিত হয়েছে। একটি বিড়ালের প্রতীকে উপলব্ধ হয়েছে এই বোধ; তাঁর চিন্তন-মগ্নতা।
আগামি স্বপ্নে একটা বিড়াল কিনবো;
হলুদ মেখে—নাম রাখবো মানুষ!
নিকটবর্তী কোন ডোবায় নাচতে দিয়ে—দেখতে থাকবো ভেতরের
নাচগুলো কতো মুহূর্ত বাঁচতে পারে। (মানুষ)
সাগরের কবিতা রূপক ও প্রতীকঋদ্ধ। ক্লীবত্ব ও নৈরাশ্যবোধের জগৎ উন্মোচনে তাঁর ব্যবহৃত শব্দদ্যোতনা সাম্প্রতিক ক্ষতচিহ্নের স্মারক হয়ে দেখা দেয় । উদাহরণ দেই;
আমার মুখডগায় তেলাপোকা
আমি আর ঘুমাবো না। (কোরাস)এতিম উঠোনে সন্ধ্যা
আমি ঘোর কিনে ঋনী তখনো;
. চুপকন্যার সিথিতে গাঁথিনি লাল। (ভাঙারি)এতেকাফ বাদে -জ্বলে ওঠে পড়শিচুমু। (সেকেন্ড হ্যান্ড)
ছায়াগুলো খান-বিল আঁকতে আঁকতে নিয়ন্ত্রণ হারানো কোন বাসে উঠে যায়। (গিরিপথ)
নিরীক্ষ প্রবণতা, সাম্প্রতিকতা এবং বিষয় ভাবনার বৈচিত্র্যই সাগরকে আলাদা রূপে চিহ্নিত করেছে।
চাঁদনী মাহরুবা
চাঁদনী মাহরুবার কবিতায় একটা সরল স্থাপত্য লক্ষ করা যায়। তিনি প্রতীকবাদী কবি। কোনো বিষয়কে উপস্থাপন করতে প্রতীকের আশ্রয় নেন, স্পষ্ট করেন তাঁর ভাবজগৎ। তাঁর ‘যেভাবে পা টেনে চলো’ কবিতায় এই বোধের জগৎটি সুস্পষ্ট। এ কবিতায় নারীমানস ও মনস্তত্ত্ব মূর্ত হয়ে ওঠে। ‘চোখের বালি ২য় পত্র’ কবিতায় সে জগৎটি বৃহত্তর পরিমণ্ডলে রূপায়িত হয়েছে। সেখানে ব্যবহৃত রূপকগুলো ব্যঞ্জনা পেয়েছে অন্য একমাত্রায়। ভেলভেট থান, পানপাতা হ্রদ, জেসাস, ডাহুকের ইতিহাস—ইত্যাদি শব্দ সংহত ভাব প্রকাশ করেছে। অন্যান্য কবিতায় মর্মযাতনার ছাপ লক্ষ করা যায়।
প্রতীক ব্যবহারে কারণে তাঁর ভাষা রহস্য-নিবিড়, যা শিল্প সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। যেমন:
আমরা কামরাঙা গাছে পা ঝুলিয়ে সাবলিকা হবার গল্প করেছিলাম। (যে ভাবে পা টেনে চলো)
আমাদের আঙ্গুর ক্ষেত পুড়ে গিয়েছিল ( চোখের বালি ২য় পত্র)
মাছরাঙার ঠোঁট খসে পড়ে এই জ্বরে। (এভাবে জল বাড়লে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে যাব)
চাঁদনী মাহরুবা এভাবে গড়ে তুলেছেন তাঁর সহজ অথচ ঋজু বাক প্রতিমা।
মহিম সন্ন্যাসী
ঈষৎ জীবনানন্দীয় ভাব ও ভাষায় মহিম সন্ন্যাসী কাব্যর্চ্চায় সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। প্রতি-তুলনা, তুলনার মধ্য দিয়ে স্থিত সত্যে উপনীত হতে চান তাঁর কাব্যসত্যে। তাঁর ‘তরমুজ’ কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। ‘তুমি তরমুজ দেখে কাঁদো/ চোখ দুটো টকটকে লাল/ চোখ দুটো বীজে ভরে ওঠে’— এই বক্তব্য, ভাষ্যে এক অনির্বচনীয় জগৎ মূর্ত হয়ে ওঠে। কবিতাটিতে তিনি জীবন ও প্রেম চেতনার স্বরূপ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ‘কফিন’ কবিতাটি গ্লানিকর সভ্যতার রূপ-স্বরূপের সম্মিলন, যেখানে ফাঁসদেয়া মৃত/মৃতার জটিল ভাব-উদ্দীপক মর্মচেতনায় রূপায়িত হয়েছে, জীবনলিপি চিত্রিত হয়েছে।
যে শরীর দোল খেতে চায়
তাকেও নির্দ্বিধায় সটান শুইয়ে রাখো কাঠের কফিনে! (কফিন)
অন্য কবিতাগুলোর মধ্যে ‘দোহন’একটি বিশিষ্ট কবিতা । গাই দোহনের প্রতীকে মানব জীবনের সমগ্রতা যাপন ও বেঁচে থাকাকে চিত্তাকর্ষক করে প্রকাশ করেছেন কবি। জীবন যেন এ অমৃত মধু।
শুধুই আঙুল দিয়ে ভরে নেয় টিনের কলস?
তুমি কি ওলান চেনো? ওলানের কয়টি ঘর, কয়টি, জানালা । (দোহন)
তাঁর ‘জলাশায়’ কিংবা ‘বস্তাবতা, রূঢ় জীবনের প্রতীকে চিত্রিত হয়েছে।
আমরা প্রায় শেষ প্রান্তে এসেছি ছয় কবির কবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে। আমরা দেখেছি, এই সময়ের কবিতায় প্রতীক চেতনা, শিল্পবোধ ও রহস্যময়তা একটি মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণদের কবিতায় তাঁদের আত্মদর্শন ফুটে উঠেছে। এঁদের একেকটি কবিতায় মূর্ত হয়েছে নিজস্ব ভাবনা জগৎ, নিজস্ব বোধ। এঁদের কবিতায় আছে নানা বাঁক, জীবনের নানান অলিগলির রূপ, স্বরূপ; জটিল এক শহরের চেনা-অচেনা পথের অসংখ্য মোড় । এঁদের কবিতা যাবে বিচিত্র পথে। বিচিত্র দিকে। উজ্জ্বল নক্ষত্রলোকে পৌঁছবে এঁদের নিবিড় নির্মাণ। সেই প্রত্যাশায় থাকবো আমরা।