লেখালেখির শুরুতে আচমকাই কেন জানি—ছোটকাগজের মিছিলে নেমে পড়েছিলাম। সেই শবযাত্রায় নিজের কাঁধেও তুলে নিয়েছিলাম ‘জীবনানন্দ’নামক এক দগ্ধচিতায়—অনল সাজানো লিটলম্যাগ পোড়ানোর কিছু বেদনা ও দায়। কিন্তু আমার সেইসব দিনের বেদনার রঙে ছাই-জর্জরিত ছোটকাগজ কনসেপ্টের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অজ্ঞানতার ধুলো ঝেড়ে ফেলা, কিছু পাগলামি চিন্তার খসড়া ছাড়া আবাক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছুই লিখতে চাইছি না।
যদিও এই লেখাটিতে লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস ঐতিহ্যের বিষয় বলার তেমন কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। কারণ, একটি লিটল ম্যাগাজিন আমাদের ইতিহাসের অংশ হলেও ইতিহাস গড়ার ক্ষমতাও ছোটকাগজের আছে। তাই, আমিও তপোধীর ভট্টাচার্যের মতো করে বলতে চাই যে,‘…কখনো কখনো, নিজেরই সযত্ন রচিত পদ্ধতি প্রকরণ ও অন্তর্বস্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বভাব অর্জন করে নেয়, তখন নির্মোহভাবে নিজেকে আঘাত করে জঞ্জাল থেকে প্রাণের গল্পকে মুক্ত করতে হয়।’
তবুও…লিটল ম্যাগাজিনরে প্রচার ও প্রসারের কাল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে হলেও, বোস্টন থেকে ১৮৪০ সালে প্রকাশিত Ralph Waldo Emerson ও Margaret Fuller সম্পাদিতThe Dail পত্রিকাটিকেই এ অঙ্গনের গবেষকেরা প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কেননা, এই ডায়ালেই এলিয়টের অনন্য অসাধারণ কাব্য ওয়েস্টল্যান্ড কবিতাটি এতেই সর্বপ্রথম ছাপা হয়েছিল। যদিও এরও আগেই ১৭৩১ সালে এডওয়ার্ড কেভ সম্পাদিত Gentlemans Magazine প্রকাশের পরপরই ম্যাগাজিন শব্দটি প্রচলিত হতে থাকে। তবে লিটল শব্দটি জুড়ে উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে লিটল ম্যাগাজিন শব্দটির ব্যবহার আরম্ভ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ডাইস সর্বস্ব পণ্য-সাহিত্যের বিপরীতে আঙ্গিক ও কাঠামোগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্লাটফর্ম হিসেবে ভিন্ন চিন্তার বিশেষ ধারার এইসব কাগজই তখন লিটল ম্যাগাজিন অভিধায় পরিচয় লাভ করে। তখন মার্গারেট এন্ডারসন সম্পাদিত The Little Review জবারবি সে সময়ের চেতনাপ্রবাহী অন্যতম লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল। এমনিভাবে বাংলাসাহিত্যেও বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনকে প্রথম ছোটকাগজ বলা হলেও, সার্বিকভাবে প্রথাবিরোধী মননশীলতার ধারায় প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রকেই বাংলার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলা যেতে পারে। এরপর, ১৯২৩ সালের কল্লোল, ১৯২৪ সালের শনিবারের চিঠি, ১৯২৬ সালের সওগাত, ১৯২৭ সালের শিখা, ১৯২৭ সালের কলি কলম, ১৯২৭ সালের প্রগতি, ১৯৩১ সালের পরিচয়, ১৯৩২ সালের পূর্বাশা পত্রিকাগুলো ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগে পর্যন্ত সমস্তই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, বুদ্ধদেব বসু ও অজিত কুমার দত্ত সম্পাদিত প্রগতি পত্রিকাটি ঢাকা থেকে এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা কাগজটি কুমিল্লা শহর থেকে প্রকাশিত হতো। এরপর সাতচল্লিশ পরবর্তীকালে পঞ্চাশের দশকে বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের একটি ক্ষীণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তখন ফজল শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত কবিকণ্ঠ, সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল, ফজলে লোহানীর অগত্যা (১৯৪৯), মাহবুব-উল আলম চৌধুরী ও সুচরিতা চৌধুরীর সীমান্ত (১৯৪৭), এনামুল হক সম্পাদিত উত্তরণ (১৯৫৮) কাগজগুলো এ সময়ের সৃষ্টিশীল ধারায় সমৃদ্ধ ছিল। তবে ষাটের দশক হচ্ছে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সবচাইতে উর্বর সময়। তাই এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু পত্রিকার নাম না করলেই নয়, কণ্ঠস্বর (১৯৬৫), বক্তব্য (১৯৬২), সপ্তক (১৯৬২), স্বাক্ষর (১৯৬৩), সাম্প্রতিক (১৯৬৪), নাগরিক (১৯৬৪), স্যাড জেনারেশন (১৯৬৩), প্রতিধ্বনি (১৯৬৪), না (১৯৬৭), পূর্বমেঘ ( ? ), সুন্দরম (১৯৬), পলিমাটি, বহুব্রীহি, কালস্রোতসহ অনেক ছোটকাগজ স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যকে নানাভাবে উর্বর করেছে।
এরপর স্বধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের সঙ্গে শিল্পসাহিত্যের মাঠেও খরা-উর্বরার সময় পরিলক্ষিত হয়। ফলে ষাটের উজ্জিবিত সাহিত্য আন্দোলন সত্তরের শুরুতে এসে কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তবু সত্তরের দশকে আমাদের মননশীল সাহিত্যধারাকে অব্যাহত রেখে বেশ কয়েকটি পত্রিকা তখন প্রকাশিত হয়েছে। তখন, গণসাহিত্য পত্রিকাটি ছিল সবার গ্রহণযোগ্য লিটলম্যাগ। এছাড়া কালস্রোত, অলক্ত, কবি, অতলান্তিক, অধুনা, উচ্চারণ, কাক, কাদামাটি ও চিরকুট এবং নাট্যবিষয়ক থিয়েটার পত্রিকা ছাড়াও তখন আনওয়ার আহমদ ও বেবী আনওয়ারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় রূপম ও কিছুধ্বনি। বলা যায় এই পত্রিকা দুটির প্রকাশনা অব্যাহত ছিল বহুবছর। পরবর্তী আশি, নব্বইয়ের দশক এবং পরবর্তী সময়ে প্রচুর ছোটকাগজ নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের শিল্পসাহিত্যের নানাস্তরে রূপান্তর ঘটেছে বিভিন্ন লিটলম্যাগের মাধ্যমে। বহু লেখক আছেন, যারা কেবল ছোটকাগজের লেখক হিসেবেই নিজেদের লেখার যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কেবল কিছু লিটলম্যাগে লিখেই তাদের লেখাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পাশ্চাত্যেও বিভিন্ন সাহিত্যতত্ত্ব-দর্শন ও নানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নিজেদের সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিও পাল্টে নিতে পেরেছে এমন অনেক ছোটকাগজের অবদান কেবল ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। থাকবে বহুকাল। তাই রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের জেলা-উপজেলা এমনকি একটি ছোট্ট গ্রাম থেকেও এমন অনেক লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে; যার সঠিক মূল্যায়ন এখনই সম্ভব নয়। তবু সেইসব ছোটকাগজের মলিন মলাট এবং অলঙ্কারবিহীন কিছু নাম ফিনিক্স পাখির মতো মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবে।
আতএব, মৃত্যুর সময় যার জন্ম, তার মৃত্যু নেই—এটা ভেবেই বরং এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো যাক।
ছোটকাগজের জন্ম মূলত ছোট লেখকের পেইন থেকেই শুরু হয়। কেননা, পাঠ ও পাঠক চিন্তা করে ছোটকাগজের কনসেপ্ট তৈরি হয়নি। হবেও না কখনো। তবে কিছু নিরীক্ষাপ্রবণতায় জারিত নতুন কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থেকেও এর যাত্রা হয়। যদিও সৃজনশীল এই কর্মকাণ্ডের গ্লামারস উদ্দেশ্য খুবইই ক্ষীণ। এর বিপরীতে দেনা-পাওনা যা কিছু, তা অতটা বিলবোর্ডসর্বস্বও নয়। তাই, যে কেউ চাইলেই, ছোটকাগজের উদ্দেশ্য হেডিংবোর্ডে টাঙানো রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিজ্ঞাপনের মতো দেখতে পারবেন না। কারণ, এর ক্ষোভ-বিক্ষোভ, ক্ষত-বিক্ষতের যন্ত্রণাগুলো এনেস্থেসিয়ায় স্থির থাকে ছোটকাগজের ঘুমে। কিংবা এই কাগজের ব্যাকটেরিয়ায় এতটাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষাঘাত থাকে, যা কেবল ব্লাঙ্কচোখে কোনোভাবেই দেখা সম্ভব নয়।
ফলে, সাম্প্রতিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণাত্মক বেশি হলেও, লেখকের নিজস্ব ও নতুন ধরনের চিন্তা প্রকাশের বিভিন্ন মাধ্যমগুলোও আজকাল যতটাই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক না কেন, গ্লোবালি এটি একটি প্রক্রিয়াগত চিন্তার প্রকাশমাত্র। তাই এর সমস্ত পদ্ধতিই আমাদের ছোটকাগজের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে থামিয়ে দিতে পারবে না। সে কারণেই ছোটকাগজ কখনো ক্রান্তিকালে পড়বে না। হয়তো পদ্ধতি পাল্টে যেতে পারে। বরং এই বলা যায়, ছোটকাগজ তার ব্রেক-থ্রো প্রকাশের জন্য ব্লগ-অনলাইন অথবা ওয়েব সাইট ব্যবহার করবে। নানা পদ্ধতিতে এর ব্যবহার হয়তো প্রতিনিয়ত বাড়বে—বাড়ছেও। আর সেসব আমরা বহু অন-লাইন পত্রিকার ভার্সনে বুঝে উঠতে পারছি। তবু, সর্বত্র গ্লোবালাইজেশনের মানে এই নয় যে, বর্তমানের সমস্ত আধুনিকতাই ছোটকাগজের চিন্তাকে ক্রান্তিকালের দিকে ঠেলে দেবে। যদি তাই হয়, তবে সমাজ-মানুষ-সভ্যতা-ক্লাসিক কোনো কিছুই থাকবে না। বিকাশ লাভ করবে না তেমন কোনো প্যারাডাইমের প্রান্তর। যদি না অভিশপ্ত হয়ে আবার বর্বরতা থেকে শুরু করে পৌঁছতে হবে এখানে। এই সভ্যতার কাছে। ছোটকাগজ যেকোনো বিশেষ ভঙ্গি ও সাইজের পত্রিকাই নয়; ছোটকাগজ মূলত কাঠামোর বাইরে এসে, বিশেষ কোনো চিন্তা ও অভিনবত্বের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠছে সময়ের গ্রহণযোগ্যতায়।
তাহলে, এই ছোটকাগজের ছোটরা কারা? অবশ্যই সাহিত্যের প্রবল স্রোতে ঝাঁপ দেওয়া সেই অবশ্যম্ভাবী তরুণেরা। তাই, তারা যখন নিজেদের প্রথম লেখাটি প্রকাশের তাগিদে— আত্মনির্ভরতার প্রতিশ্রুতিতে আত্মবিশ্বাসী হন, তখনই একেকটি ছোটকাগজের সম্পাদক হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ অবশ্য প্রথাগত সাহিত্য ও শিল্পবোধের বিপরীতে বিশুদ্ধ নন্দনতত্ত্বের ছোটকাগজ প্রকাশ করেন, কেবল অন্যের শ্রেষ্ঠ লেখাটি প্রকাশের প্রয়োজনে। হয়তো তাদের সম্পাদনা বরাবরই মৌলবাদ এবং প্রতিষ্ঠানের গ্রাস এড়িয়ে প্রতিশ্রুতিশীল নবীন/ প্রবীণ লেখকের লেখায় সমৃদ্ধ হয়। ফলে, এইসব ছোটকাগজ, সে—যে ধারায়ই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, নিষ্ঠা-সততা ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কমিটেড ধারায় এগুলো প্রকাশিত হয়।
তাই, আমাদের ছোটকাগজের চিন্তাগুলো—ছোটরাই করে বটে। তবে,এই চিন্তার ব্যাপ্তি মোটেই ছোট কিছু নয়। অনেক বিশাল এর ঐশ্বর্যময়তা। যার গভীরতা-ঔদার্য উপলব্ধি পাঠকের সবার অন্তরের উজ্জ্বলতা নয়। একটি ‘লিটল বয়’ হিরোসিমা ধ্বংসের জন্যে জরুরি হলে, সাহিত্যের প্রথাগত/তথাকথিত এলিট ঐতিহ্য ভাঙনের জন্যেই একটি সৎ/ শুদ্ধচিন্তার (লিটলম্যাগাজিন) ছোটকাগজ এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে। অবশ্য এজন্যে এই কাগজের বারুদশালা, চিন্তা ও দর্শনগুলোও পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক রাখতে হয়। যার মধ্যে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান-পরনির্ভরতা—ভোগ এবং ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই উসকে উঠবে না। আবার, স্রেফ আঁতলামি, অহংবোধ, গোষ্ঠীতন্ত্রে আক্রান্ত অস্থিরতাও দায়বদ্ধ কোনো ছোটকাগজের বৈশিষ্ট্য নয়। মূলত সৃজনশীল ছোটকাগজের চিন্তার পরিধি ও এর ব্যাপকতার পথ খুবই সরু, দুর্গম ও দুস্তরও বটে। এছাড়া, দীর্ঘস্থায়ী নিষ্ঠা ও ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি প্রকৃত ছোটকাগজের বিশ্বাস নয়। তবে, ছোটরাই শুরু করে যে কাগজের নৌকা বানিয়ে তারুণ্যের প্রবণতায় দুর্গম সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতে পারে। বিশেষ সেই উদ্দেশ্য ও দীক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে যেতে সময়ের কোনো এক স্টেশনে নেমে পুনরায় আর এক তারুণ্যকেই ছেড়ে দিতে হয়—স্পেস করে। এই সরু পথের চিন্তাকে—দুর্গমতাকে আমরা হয়তো কখনো অন্ধকার ছাপাখানার পাইকায় সাজিয়েছি। এখন হয়তো সেই চিন্তার আউটপুট কম্পিউটার ট্রেসিং, ডিমাই-প্লেটের ঝকঝকে অক্ষরগুলো অফসেট মেশিনে মুদ্রিত হচ্ছে। তবু, অতি সম্প্রতি ছোটকাগজ সম্পাদনার কনসেপ্টগুলো ব্লগ-অনলাইনের নানা অভিধায়, প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের প্রবণতায় নিয়তই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে। তো, যেভাবে যে মাধ্যমেই মুদ্রিত ও প্রকাশিত হোক না কেন, একজন ছোটকাগজ সম্পাদক তার পত্রিকার সমস্ত টানাপড়েন সহেও বিভিন্ন কারণে উৎকৃষ্ট/ উল্লেখযোগ্য করে তুলতে পারেন।
এ জন্যই আমরা এ-ও মনে করি, ছোটকাগজের ক্যানভাস মোটেই ছোট কিছু নয়। ছোটকাগজই পাঠক তৈরি করছে। তরুণ লেখক উঠে দাঁড়াচ্ছে। সেইসব প্রকৃত পাঠক ও লেখকের প্লাটফর্ম এটি। ফলে, একেকটি ছোটকাগজই এইসব পাঠক ও লেখকসত্তায় প্রতিনিয়ত যাওয়া-আসার সেতু তৈরি করছে। যা মূলত ছোটকাগজের পক্ষেই সম্ভব হয়। যদিও বা, এ-রকম ভাবি, যারা পাঠক, তারাই লেখক। তবে কিন্তু গ্রাফটা অন্যরকম হয়ে যায়। ছোটকাগজ যদি অসংখ্য লেখক তৈরি করে থাকে, তাহলে পাঠকও তৈরি করেছে সমপরিমাণ। পেছনে ফিরে দেখলেই এর সত্যতা মিলবে। যেহেতু আমাদের দৃষ্টিতে কিছু বড়কাগজের ঔদ্ধত্য আছে এবং এদের অসংখ্য পাঠকও আছে। তাই ওদের সবটাই কিন্তু তৈরি হচ্ছে মূলত এইসব ছোটকাগজের অবদানেই। আমরা যদি, এই প্রক্রিয়াকে একটি পাইপ লাইন মনে করি, তবে দেখা যাবে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন লেখক/ পাঠক আসছে। আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম, নতুন লেখক, নতুন সম্পাদকের চাপেই। হয়তো পাঠকের মান কিংবা লেখকের মান—স্তরের পরিমাপ—এটা রাষ্ট্র-সমাজ ও তার স্বাস্থ্য। যেমন, রাষ্ট্রীয় অনেক উপাদানের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে ছোটকাগজের করার কিছু নেই। এই চলার উপমায়, চলমান প্রত্যেকেই মহাপান্থের মানুষ। তাই, যে লিখবে, যে পড়বে, সবটাই তার কমিটমেন্টের ওপর নির্ভর করবে। হারিয়ে ফেলা কোনো হতাশা বা নিয়ম নয়। বরং আর্থ-সামাজিক কাঠামো, রাষ্ট্রের আচরণ, শাসন-শোষণের মাত্রা, সামগ্রিক আকাঙ্ক্ষা, সাময়িক সুস্থতা ও অসুস্থতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে অথবা কমে। লেখক— পাঠকের গ্রাফ লাইনটাও এ রকমই।
তাহলে কি ছোটকাগজের প্রয়োজনীয়তা— উপযোগিতা নেই? যুগের মেরুকরণে ব্যর্থতাই কি এর নিয়তি ? এই প্রশ্ন হাস্যকর। যে কাগজের মাধ্যমে সে দেশের সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, তারুণ্যের বোঝাপাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্ভীকতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবু, আজও আমাদের এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে কেন? যদিও বা আমাদের চিন্তায়, নিয়তি—এই শব্দের বিশ্লেষণ একেবারেই বেমানান। প্রয়োজন ও উপযোগিতা দিয়ে তো ছোটকাগজকে বিশ্লেষণ করা আরও মূর্খতা। তবে হ্যাঁ, যতটুকু বুঝি, ছোটকাগজের উপযোগিতা কিংবা প্রয়োজন কখনো ফুরায় না। কারণ, আর কিছু নয়, সে নিজেই নিজের ঈশ্বর এবং স্বয়ম্ভু। ফলে, ছোটকাগজের ব্যর্থতা বলেও কিছু নেই। যুগের মেরুকরণ যে ভাবেই হোক না কেন, ছোটকাগজ টিকে থাকবে তার চিন্তা-পদ্ধতি-অঙ্গীকার-অহং ও এর দর্শনের কারণেই। বুঝতে হবে, কাঠামো ছোটকাগজের একটি মুখোশ মাত্র। যদিও অবস্থানে বিশাল—প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেও অনন্য। প্রশ্ন হলো, মানুষ কি যন্ত্র হয়ে বর্বর হবে—হচ্ছে? ছোটকাগজ তখন আরও বেশি সফল হয়ে উঠবে। ব্যর্থতা ফুটে উঠবে। এই যুগ-যুগান্তের মেরুকরণের নির্দিষ্টতায়—বিদ্ধ মানুষের আত্মায়। ব্যর্থতার নিয়তি থেকে বরং ছোটকাগজই পারে তাকে বড় করে আনতে। আবার সব রকম আপস— আত্মসমর্পণ এবং নির্ঘণ্টকে অপ্রয়োজনীয় করেও তুলতে পারে যেকোনো জাতির সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন প্রভৃতিকে। ফলে, ছোটকাগজের সবুজ প্রান্তর গড়ে উঠবে—চিরকাল। এর বিপরীত যেকোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক আলুমার্কা চিন্তা, ছোটকাগজের সম্মানের জন্য একেবারেই অর্থহীন। তবে যদি, কখনো ছোটকাগজের সম্মানের জন্য সে রকম প্রান্তর তৈরি হয়ে ওঠে, তখন ছোটকাগজ আর ছোটকাগজ থাকবে না। তা মূলত মূর্খ— হতাশাবাদীদের মুখপত্র হয়ে উঠবে। অর্থসংকট ও সংগ্রামের মধ্যেই ছোটকাগজ প্রাণ ফিরে পায়। পথ দেখায়—তথাকথিত বড়কাগজ, বড়লেখক ও সৃজনশীল পাঠককেও। তাহলে, একবার ভেবে দেখুন তো! ঐশ্বরিক কোনো উদ্যানের সবুজ প্রান্তরের, ও রকম একটি ল্যান্ডস্কেপে ছোটকাগজ দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছু মূর্খ স্যালুট দিচ্ছে। তোপধ্বনি—সামরিক কায়দায় অভিবাদন মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, ছোটকাগজের জন্য উন্মুক্ত লালগালিচা সংবর্ধনায়!
তবু, একটি ছোটকাগজ—সত্যিকারের ছোটকাগজ কি না, তা নির্ভর করে ওই কাগজটির সহ্যক্ষমতা এবং সম্পাদকের মেধা ও মননমিশ্রিত দূরদর্শিতার ওপর। কাগজটিকে হরেক রকম বানানো তর্কের সাঁচে ফেলে ‘প্রতিষ্ঠান/অপ্রতিষ্ঠানবিরোধী’, ‘ছোটকাগজের লেখক/ বড়কাগজের লেখক’, এইসব প্রলাপে প্রবাহিত হয়ে ছোটকাগজ করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। মেধা ও বোধ কোনো সম্পাদকের নিজস্ব হতে পারে। কিন্তু এর সহ্য ক্ষমতা বলতে, আরও অনেক কিছুকে বোঝায়। আর তা বোঝাতে, ওই কাগজটি শিল্পমান সম্পন্ন হয়ে ওঠার নতুনত্বে এবং অভিনবত্বে যেকোনো রকমের প্রাণস্পর্শী লেখা প্রকাশের জন্য তার দরজা কতটা খোলা রাখে। কত বেশি লেখককে নয়, লেখাকে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে, এ রকম একটি প্লাটফর্ম থেকেই তৈরি হয়, এই সময়ের সঙ্গে সম্মুখ সময়ের সংযোগ এবং এর থেকেই একটি ছোটকাগজের কালস্রোদে ভেসে বপু খুলে দাঁড়ানোর এক চিলতে মাটি পেয়ে যান—প্রকৃত লেখকের পরিচয়। তাই একজন স্র্রষ্টা নিয়তই একা। আজকে কেউ কেউ নিজেকে লেখক/ কবি/ কবিতাকর্মী মনে করে এক ধরনের গুরুমুখী মৌমাছির চাক তৈরি করে—স্থুলতায় নিঃশেষ করে দেয় প্রতিভাকে। সত্যিকার কবি/ লেখককে কেউ ব্যবহার করতে পারে না। না দর্শন, না ঈশ্বর। কেননা, লেখা ছাড়া যে লেখকের আর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে নেই।
অনেক ছোটকাগজের সম্পাদককে দেখেছি, লেখক/ কবিকে মুখ্য করে, লেখাকে নয়। দীর্ঘদিন যাবৎ ‘জীবনানন্দ’ সম্পাদনা করেছি। তখন ‘জীবনানন্দ কবিতাপত্র’ পুরোপুরি কবিতার কাগজ করেই এর চরিত্র গড়ে নিতে চেষ্টা করেছি। ‘জীবনানন্দ’: ছোটকাগজ/ বড়কাগজ এই খেলায় মেতে ওঠেনি। যে সকল কবি/ লেখক প্রবল বড়কাগজবিরোধী, তাদেরই তো আবার বড়কাগজে হজম হতে দেখি। প্রতিষ্ঠান/ অপ্রতিষ্ঠান এই তকমায় বিরোধী হতে হতে সেই কাগজই— মানসিকতায়— প্রতিষ্ঠান হয়ে, সীমিত কেন্দ্র, গোষ্ঠীবদ্ধতায় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়। এই যে নক্ষত্রপতন চলছে, এর মূলে কোনো ছোটকাগজ কাউকে নক্ষত্র হতে উসকে দিতে আসে নি। ‘জীবনানন্দ কবিতাপত্র’ সেই নক্ষত্র নির্দিষ্ট করতে পেরেছে কি, পারেনি, আমাদের জানা নেই। তবে, কবিতা হয়ে ওঠার বাইরে কোনো রকম খণ্ডিত দর্শনে শক্তিক্ষয় করতে চায়নি। ‘জীবনানন্দ কবিতাপত্র’ সব কবিকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বয়স-ব্যক্তি কোন কিছুই মুখ্য ছিল না কেউ। তাই, ‘জীবনানন্দ’ যে রকম বহু প্রতিষ্ঠিত কবির লেখা যেমন মনে রাখেনি, ছাপেওনি। আবার, বহু তরুণের কবিতা ছেপে ‘জীবনানন্দ কবিতাপত্র’ নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করেছে। আমাদের ডাস্টবিন ছিল অনেক বড়। অনেক লেখক, অনেক কবির ভুল লেখা হয়তো আমরা ছাপাইনি। কিন্তু, তরুণদের বেলায় কিছু কিছু ভুল থেকে গিয়েছিল।
তাই, প্রকৃত ছোটকাগজের কনসেপ্ট মানেই: সে লেখকের ভালো লেখাটি ছাপতে চায়— নিজেদের সঙ্গে প্রথম সংযোগের আনন্দ খুঁজে নিতে। যার কোনো রুদ্ধতা নেই। মেনিফেস্টোও নেই। তার মানে ছোটকাগজের ভালোবাসা কেবল বহুগামী নয়; সমৃদ্ধ— বহুগামী! ছোটকাগজ সম্পাদনার প্রবণতা প্রথমত ছাপার স্পেস জনিত সমস্যার ফল। তাহলে, আবার প্রশ্ন হতে পারে, কারা ছোটকাগজ সম্পাদনা করে? এক অংশ বড়কাগজে জায়গা পায় না বলে। অন্য অংশ তথাকথিত কাগজে জায়গা নেয় না। যারা জায়গা পায় না, তারা শো-বিজ আক্রান্ত বিশেষণ লোভী। (ড্যাসের কবি…ড্যাসের সম্পাদক হতে চান) সাহিত্য নির্মাণ তাদের কাছে মুখ্য নয়। অন্য অংশ নতুন ধরনের ক্লাসিক তৈরি করার চিন্তায়; অভিনব উচ্চারণ নিয়ে ছোটকাগজ সঙ্গী করে এগোয়। কারণ আর কিছু নয়। ওই সব কাগজ যেমন আপসহীন এই লেখকদের চেনে না। নিরাপসকারীরাও চিন্তাবিশ্বের বহুমাত্রিকতার কারণে তাদের বর্জন করে। মৌলিক লেখক সর্বত্রই দ্বিতীয় পক্ষের সম্পাদকদের দলে। কেননা, সম্পাদনা মোটেই গৌণ আনন্দ নয়। অবান্তর হস্তমৈথুনের আনন্দের মতোও নয়। ছোটকাগজ প্রক্রিয়ায় শিল্পের বেসাতিটা— আত্মসমীক্ষণের। সেইসব সৎ গোষ্ঠীতন্ত্রহীন উৎকৃষ্ট লেখকের শ্রেষ্ঠ লেখাটি পাঠ করা এবং সেইসব উৎকৃষ্ট পাঠককে ছোটকাগজের সঙ্গে ইনভলভ করাই হচ্ছে ছোটকাগজ সম্পাদনা চিন্তার— প্যারালাল। নিরীক্ষানির্ভর— একগুঁয়ে কিন্তু নয়— মৌলিক বরং বাণিজ্যিকও নয়— বরং পুরোপুরি কনট্রিবিউশন-ই হচ্ছে প্রতিটি সম্পাদনার দায়িত্ব। অবশ্য ছোটকাগজের ক্ষেত্রে সেই বিপ্রতীপ সৌন্দর্য ও আনন্দ খুঁজে পেতে অনেক দুস্তর পথ চলতে হয়। কিন্তু ছোটকাগজের সমস্যা মূলত সেই প্রথম পক্ষের গ-মূর্খরা। শো-বিজ আক্রান্ত যারা দলবাজি—প্রোপাগান্ডা করে, পাঠককে ছোটকাগজ সম্পর্কে ভুল ধারণা সরবরাহের মাধ্যমে সমস্যা তৈরি করে। আরও সমস্যা হচ্ছে কনসেপ্ট। সম্পাদকীয় লেভেল পৃষ্ঠপোষকতায় কতটা কন্ট্রোল ক্ষমতা আছে কিংবা নেই। মুশকিলটা হলো যারা তরুণ তাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ আশা করা যায় অথবা এখনকার তরুণরা ও পরিমাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত কি না। আমাদের সময় তরুণরাই ছোটকাগজ করতেন এবং ওই সময় বহু পত্রিকা প্রথম প্রকাশেই অনেককে চমকে দিয়েছিল। এখন তরুণদের অনুভবের স্তরেই গোলমেলে অবস্থা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন কারণে, গ্লোবালাইজেশনের খারাপ চর্চা করে। যা ব্যাখ্যা করে না বললেও চলে। আজকাল এগুলো এত বেশি দৃশ্যমান যে, অন্ধরাও দেখতে পাচ্ছে। ছোটকাগজ করা, না করা একজন লেখকের অথবা সম্পাদকের স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হতে হয়। যা কখনো কখনো উত্তেজনা এবং প্রতিবাদের দায় হওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, আরও অনেক কিছু— লেখক এবং পাঠকের ভিতর মিশ্রিত হতে হয়। এছাড়া, পাঠকও বেড়েছে অনেক। হয়তো তারা সিরিয়াস বই এবং ছোটকাগজ পড়ে নিজের সঙ্গে ক্রিয়া— প্রতিক্রিয়া সাজিয়ে ভেতরে ভেতরে উৎকৃষ্ট হয়। অবার, ছোটকাগজের ভুল ব্যাখ্যায় আমাদের ফ্যাক্টরগুলো কাজ করছে না। এখনকার কোনো কোনো তরুণ ছোটকাগজকে নিজের লেখক সত্তা তৈরির কাজে পরিণত করছে বলেই মানসম্মত ছোটকাগজের এই দশা। ফলে, শিল্পমান হারাচ্ছে অধিকাংশ সাহিত্যের ছোটকাগজ।
প্রকৃত লেখকের কাছে দৈনিক অথবা ছোটকাগজের ক্ষেত্রে প্রধান বলে কিছু নেই। কখনো কবির কাছে দৈনিক/ ছোটকাগজ উভয়ই গৌণ হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, লেখক লিখতে বসে কোথায় তা ছাপবেন, সেটা মনে রেখে লিখছেন কি না?/ যদিও ছাপার ক্ষেত্রে লেখকের পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে ঘিরে কোনো তত্ত্ব, আন্দোলন, বিরোধিতা লেখকের লেখায় কোনো গুরুত্বের মাত্রা যুক্ত হয় না। লিখতে এসে লেখার জায়গা দখল করবে না—বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরনের দখলদারিত্বের কাছে আটকা পড়বে (কখনো কখনো) কেন? এমন তো হতে পারে, অনেক দৈনিকের সাহস-ই নেই আপনার সেই লেখাটি ছাপানোর। এই সাহসের ক্ষেত্রে যদিও ছোটকাগজ সবসময়ই অগ্রগামী। দৈনিকের সাহস থাকা বা না থাকার পেছনে অবশ্য উদ্দেশ্য থাকা স্বাভাবিক। এ কারণেই তরুণদের নতুন লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে, সবসময়ই ছোটকাগজ দৈনিকের পাতা পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়। বুঝতে হবে, দৈনিক কারা প্রকাশ করে? কারা ছোটকাগজ করে? এর মধ্যেই এই দুই মিডিয়ার ঐতিহ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে আছে। তরুণদের তা বুঝতে হবে এবং এটাও মনে রাখা উচিত, দৈনিকে প্রকাশ যেমন কোনো লেখক বা লেখার মাপকাঠি নয়, তেমনি ছোটকাগজও। হয়তো দৈনিকে প্রকাশ হওয়ামাত্র কোনো তরুণ কবি অহং-এ আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। যা তার লেখকসত্তার বিশালতাকে থামিয়ে দিয়ে স্থূলতায় আটকে দেয়। আবার ছোটকাগজে প্রকাশিত হয়ে তামসিক গোষ্ঠী অহং-এ আটকা পড়েও চোরাবালিতে ডুবে যান অনেকেই। মূলকথা: কোথায় ছাপা হবে, না হবে—এটাকে ভুলে নিয়ত লেখা অন্যকে পড়া ও লেখার দিকে সতর্ক চোখ রাখাই একজন তরুণের দায় থাকা সুবিধাজনক। সত্যিকারের লেখা হয়ে উঠলে, ছাপা-ছাপির ক্ষেত্রে কেউ কারোর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং এই ভালো লেখাটি ছেপে উভয় কাগজই প্রধান হয়ে উঠবে। তবু, পছন্দ তো অসীম সূত্র—যা নিয়ে তর্ক চলে না।
কে, কিভাবে প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা দেয়—জানি না। সাহিত্যকর্মী ও সম্পাদক হিসেবে বরাবরই মনে হয়েছে—একটি ছোটকাগজ যদি চিন্তার পথগুলো আটকে দেয়, নার্সিসিজম ও দলবাজিতে আক্রান্ত হয়, সাহিত্য নির্মাণে মনোযোগ না দিয়ে, লেখক বিরোধ সরবরাহ করে এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট তত্ত্বে দ্রবীভূত হয়ে সাহিত্য বিচারে আমলাতন্ত্র আরোপ করে, তাহলে ওই ছোটকাগজ একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার রূপ ভয়াবহ! প্রথম প্রশ্নের ছোটকাগজের অবদানের চেয়েও ভয়াবহ। বিশ্বাসযোগ্য ছোটকাগজের দুর্দিন এখন। চারদিকে কনডম বিজ্ঞাপনের মতোই আলোআঁধারির ধূম্রজাল। সম্পাদক-কবি-লেখক সবাই আজকাল জর্জরিত একই জালে। সচেতন লেখক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চাইবে না। তাহলে বিরোধিতার কথাও সে বলবে না। আবার ছোটকাগজের আন্দোলন-ফান্দোলনের তোয়াক্কাও করবে না। তবে, ছোটকাগজের যে একটি ট্র্যাজেডির জগৎ আছে, এর ভেতরের দুঃখভোগ-ব্যথা-বেদনা আরও যেসব ক্ষত আছে, যার খবর কেবল কয়েকজন ছোটকাগজের মরমি-সৎ লেখকেরাই রাখে। কিন্তু আজকাল ছোটকাগজের নামে অধিকাংশই হচ্ছে করে খাওয়ার ধান্দাবাজি। কেউ এর থেকে লিফট নিচ্ছে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে। মোটা কাগজে রদ্দি ছাপিয়ে পৃষ্ঠাভরে পায়ের তলায় রেখে ওপরে ওঠার দেয়াল টপকাচ্ছে। এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট আওড়াতে আওড়াতে এরাই আবার সেই এস্টাবলিশমেন্টের সুবিধাদি ভেঙে খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানের— দপ্তরে দপ্তরে। যে অর্থে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, তা তো সেই কাগজের নির্মাণ এবং সম্পাদনার মধ্যে থাকেই। দখল এবং বর্জন কোনোটাই শুভ নয়। বরং সবপথ খোলা রাখাই ভালো। বিজ্ঞাপন ও প্রতিষ্ঠানের (তথাকথিত) লেখক যদি আমার চিন্তা এবং কাগজকে শোষণ করে পিছন দিকে নিয়ে যায়, তবে ওই বিজ্ঞাপন অবশ্যই বিজ্ঞাপন। ঐ লেখক অবশ্যই প্রতিষ্ঠান। যেখানে সে কৃত্রিম বিরোধিতায় নিজেই বিজ্ঞাপিত হয় নিজের বেশ্যালয়ে। আজকের ভয়াবহ-ভয়ঙ্কর অসুখের নাম এইডস। এই দুরারোগ্য ব্যাধিতে নিজে তো নিঃশেষ হচ্ছেই। সব ছোটকাগজের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত ঘটে না। এক্ষেত্রে ঢালাও দুর্নাম চাপানো উচিত নয়। কোনো কোনো ছোটকাগজ এর বাইরে আছে। এই স্পর্শকাতর কথাগুলো বললাম। কারণ, ছোটকাগজ সম্পাদনা এখন তো অনেকটাই ফ্যাশনে আটকে গেছে। কিংবা পাঠক যোগাযোগের বদলে, লেখক যোগাযোগের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যা অনেক লেখকের ক্লাসিক নির্মাণের নীরবতাকে ভেঙে দেয়। নৈঃশব্দ্যের ধাঁধায় ফেলে।
যদি বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলো মনে করতো যে, ছোটকাগজ তাদের শত্রু, তাতে তাদের দেউলিয়া অবস্থা প্রমাণিত হতো। একটি ছোটকাগজ অন্য একটি ছোটকাগজকে বিভিন্নভাবে অতিক্রম করে যেতে পারে? আমাদের মধ্যে এই অতিক্রম করার প্রবণতা তো দূরের কথা, উল্টো একটি ছোটকাগজ অন্য একটি ছোটকাগজকে সহ্য করার ক্ষমতাই অর্জন করেনি। বরং নিজের চরিত্র হারিয়ে অন্যের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। একে অন্যকে তাচ্ছিল্য করছে। যে জন্য এখন হামেশাই মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আমাদের মন্ত্রময় ছোটকাগজের সাহিত্য নির্মাণ।
ছোটকাগজে নতুনদের খুব বেশি আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবা উচিত। সঙ্গে পুরনোরা যদি নতুন কিছু করে, তাকে সামনে আনা। সম্মান করা। যদিও কিছু সাহিত্যমূর্খ বামনের পাল্লায় পড়ে পিছু হটছে নতুন চিন্তা। নতুন সাহিত্য সৃষ্টির উন্মাদনা হারাচ্ছে অজস্র সাময়িকীর ভিড়ে। অন্যদিকে ছোটকাগজ হারিয়ে ফেলছে তার চরিত্র। বামনরা ভোগ করছে নতুনদের। এরা পাতায় পাতায় বীজ-নষ্টের নাশকতা ছড়াচ্ছে। কিংবা দেউলিয়া হওয়ার ভয়ে নিজেকে মুখ্য করে তুলছে। যে চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত করে বামনরা তার একমাত্রিক চিন্তায় আটকে ফেলে—সে তো যতটা না মূর্খ, তারচেয়ে বড় শোষণকারী বহুরূপী প্রতিষ্ঠানের হয়েই এসব করছে। তাই, ছোটকাগজের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্রোধমিশ্রিত নতুন পথের সন্ধানকারী তরুণ লেখকেরা কেন যে এদের পোষ্য হয়! কেনই বা এদের বৃত্তের দুয়ারে ঘুরপাক খাচ্ছে? কেন তারুণ্যের এই আপসকামিতা!
যদিও দুই বাংলার অনেক কাগজই ছোটকাগজের চরিত্র হারিয়ে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। যদিও এর কারণ ভিন্ন ভিন্ন। ওপার বাংলার ছোটকাগজের বিষয় বৈচিত্র্য আছে সত্য। কিন্তু, বিষয়ের সঙ্গে যেসব লেখককুল জড়িত তাদের চিন্তাকাঠামো অনেকাংশেই গতানুগতিক, যা নতুন পথের অসম্ভবকে সমর্থন করে না। যেখান থেকে শুরু হবে নতুন পথের সন্ধান। ওদের চিন্তা এখনো অতীত-ক্লাসিক-অপভ্রংশ। ফলে, ওদের নতুন ক্লাসিক তৈরির ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধান নেই। নেই ক্রোধের বিস্তার। ওদের ছোটকাগজের বিষয়গুলোর মধ্যে বি-মানবায়ন খুব বেশি নেই। এক ধরনের একমাত্রিক জীবনমুখী ধারা ওখানকার লেখকদের চালিত করে। ফলে, মিডলক্লাসের গার্হস্থ্য নিয়ন্ত্রিত বিষয়গুলোর মধ্যে ওখানকার ছোটকাগজের লেখকরা ঘুরপাক খায়। এছাড়া, মুড নিয়ন্ত্রিত সাহিত্যের চেয়ে প্রতিবেদন এবং ন্যারেট করার প্রবণতা অনেক বেশি। তাইতো, পশ্চিম বাংলার ছোটকাগজ মারা যাচ্ছে—লেখক আধিক্যে। যারা সবাই চিন্তাবিশ্বে শারদীয় একমাত্রিক, যাতে ক্রিয়েটিভ কোনো অভিনব মন্ত্রময় পথের সন্ধান অন্তত খুঁজে পাওয়া যায় না।
আর, এখানকার (বাংলাদেশের) ছোটকাগজের সমস্যা অনেক। প্রতিশ্রুতিশীল বহু লেখক—যারা তাদের চরিত্র হারিয়ে নিজেদের অসম্ভব করে তুলছেন। অথবা এই যে তারা আর ক্লাসিক চর্চার আকাঙক্ষা পোষণ করছে না। এ সবই একগুঁয়ে চর্চার ফল। বিভিন্ন রকমের ম্যানুফেস্টো, স্লোগান, গোষ্ঠীবদ্ধ আকাঙ্ক্ষা এখানকার লেখকদের ক্ষয় করে গেছে। এ-ও বলা যায়, লেখক হওয়ার কমিটমেন্ট ছিল না বলেই উত্তেজনা এবং সাময়িকপ্রাপ্তি তাদের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের লিটলম্যাগাজিন সেই ভূমিকা রাখতে পারছে না। লেখক হওয়ার অসীমযাত্রায় ছোটকাগজ অনেক ভালো পাঠক তৈরি করছে, কিন্তু মৌলিক লেখক তেমন সৃষ্টি করতে পারছে কি?
মূলত, বাংলাদেশের ছোটকাগজ মরে যাচ্ছে—লেখক শূন্যতায়। এজন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়া বহু ছোটকাগজ যতটা দায়ী, ততোটাই দায়ী লেখক এবং সম্পাদকীয় মূর্খতা!