শিশুর প্রতি নির্মল নিরাভরণ আকুতি সব জাতির চিরন্তন এক আকুতি। শিশুকে কেন্দ্র করে বড়দের নিযুত কর্ম-পরিকল্পনা আবর্তিত হয়। কিন্তু বড়রা অর্থাৎ অভিভাবকরা নিজেদের মতো করে শিশুদের পৃথিবী কল্পনা করে প্রায়ই ভুল করেছেন বা করেন। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই অবস্থার পরিবর্তন যে ঘটেনি, তা নয়। সে কারণে দেখা যায়, শিশুর পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে এ-কালের অভিভাবরা যতটা সচেতন আগের কোনো কালে বড়রা তেমন ছিলেন না। আবার আমাদের ভূখণ্ডের তুলনায় পশ্চিমের অভিভাবকরা যে এ-ক্ষেত্রে আরও সচেতন, সেটা অস্বীকার করা যায় না। তার পরও সম্প্রতি আমাদের সৃজনশীল ব্যক্তিরা, বিশেষত সাহিত্যিকরা, এই বিষয়ে অনেক বেশি যত্নবান।
আদরের শিশুটির দৈহিক বেড়ে ওঠাকে কেউ আর এখন প্রধান ভাবেন না; সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ দেন মানসিক গঠনেও। কারণ শৈশব-কালপর্বে দৈহিক বৃদ্ধির তালে তালে মানসিক বৃদ্ধি না ঘটলে শিশুর সুষ্ঠু বিকাশ ঘটে না। বর্তমানের বড়রা তাই মানসিক বিকাশে গুরুত্ব দেন। মানবজীবনে সম্ভাবনার যতটা বিকাশসাধন সম্ভব, তার প্রধান অংশ এই শৈশবে ঘটে। জীবনে প্রাণের উন্মেষকাল এটি। আর শিশুর বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার প্রাণচঞ্চল পরিবেশ যথাযথ বিকাশের পূর্বশর্ত।
এই বুড়োরা বয়স, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতার ফারাক ভুলে শিশুর মনোজগতে যে প্রবেশ করবেন—এটা তো যেন-তেন কথা নয়।
বলাই বহুল্য, শিশুদের জন্য যারা লেখেন, তারা এই বিকাশের একজন গর্বিত অংশীদার। শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে তার কল্পনার স্বপ্নীল জগৎকে অস্বীকার না করে এই লেখকরা তাদের কল্পনার জগতের প্রকৃত ভাষ্যকার হন। শিশুর কল্পনায় যে জাদুর কাঠি ছোঁয়ালেই সবকিছু হয়ে ওঠে বর্ণালি, এক নিমিষে পাড়ি দেওয়া যায় রূপকথার ভুবন—শিশুসাহিত্যিকের লেখায় সে বর্ণালি রূপকথার জগৎ হয়ে ওঠে আরও সত্য, বাস্তব ও জীবন্ত।
মানুষ মাত্রেরই স্বপ্নের ভুবন রয়েছে—যেটি বয়সের সঙ্গে সামাঞ্জস্যপুর্ণ এবং ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব। বয়সের কথা যখন এলো, তখন প্রশ্ন জাগে—শিশুসুলভ যে বর্ণালি পৃথিবীর কথা আমরা বলি, বয়সের কোন সীমা পর্যন্ত, সাধারণত, মানব সন্তান সেই পৃথিবীকে আপন জানে? শৈশব ও কৈশোরের প্রবণতাকে খেয়ালে রেখে সমাজ-রাষ্ট্রের নির্ধারণ করে দেওয়া বয়সসীমার কাগজি-কলমি হিসাবকে সাহিত্যিকরা ঠেলে দেন ২০-২১ পর্যন্ত। কারণ, কাগজে-কলমে আইন চলে, সাহিত্যের কাজ তো মনে-মগজে।
দুই.
শিশু-কিশোরের মনের প্রকৃত ভাষ্যকার যথার্থ মনস্তাত্ত্বিক না হওয়ার বিপদ অনেক। সে বিপদের কথায় না গিয়ে আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি, কারা আসলে শিশুদের জন্য লেখেন? লেখেন মূলত বয়স ও বুদ্ধিতে পরিণত বুড়োরা। এই বুড়োরা বয়স, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতার ফারাক ভুলে শিশুর মনোজগতে যে প্রবেশ করবেন—এটা তো যেন-তেন কথা নয়। তাকে প্রথমে তার জগৎ থেকে বেরিয়ে এমন এক জগতে প্রবেশ করতে হবে যা একেবারেই তার নয়; শিশু কিংবা কিশোরের। আর যা-ই হোক, তার হাতে শিশু বা কিশোরের স্বপ্নলোকের দরজা খোলার চাবিকাঠি থাকতে হবে। সেই জগৎকে মনে মনে নির্মাণ করতে না পারলে কী হবে? ড. হায়াৎ মামুদের ভাষায়, বয়সে বুড়ো এই কবির সঙ্গে শিশু বা কিশোরের ছেলেখেলা জমবে না।
এই কাল-পরিসরের যথাযোগ্য দ্রষ্টা কিশোরকবিতার কবি।কী শব্দ চয়ন,
কী ভাবের বিন্যাস—সব কিছুতে কিশোর কবিতার কবিকে বয়ঃসন্ধিকালের চঞ্চল, উড়ুক্কু মন বিবেচনায় রাখতে হয়।
শিশুকিশোররা বয়স্কজনের মতোই পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাদের কল্পনার পৃথিবী আমাদের বয়ষ্কদের ‘মহাবিশ্বের চেয়েও বিশাল’। মনস্তাত্ত্বিক জিগমুন্ড ফ্রয়েড শিশুমনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে বলেছেন, তাদের ইচ্ছাশক্তি ও বাসনার ব্যাপ্তি এত বেশি যে ‘ইচ্ছাপূরণের শক্তি যদি তাদের থাকতো এই পৃথিবী যে কতবার ধ্বংস ও পুনর্নির্মিত হতো তার ইয়ত্তা নেই।’ সুতরাং, ওদের পৃথিবীকে বড়দের চোখে বিচার করাটা ভুল না বলে অন্যায় বলা ভালো। শুধু হৃদ্বৃত্তিগতভাবে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিগত উপলব্ধিতে অল্পবয়সীদের বড়দের মতো স্বতন্ত্র একক ও সম্পূর্ণ ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য করে তাদের প্রয়োজনীয় যাবতীয় বিষয়ে চিন্তা করা সময়ের দাবি। আর যিনি এমন চিন্তা করেন তিনিই শিশুমনস্ক ব্যক্তি।
তিন.
পৃথিবীর ঘরে শিশু হলো একেবারেই নবীন। এটি মানব শিশুর শুঁয়োপোকার মতো খোলস ছাড়াতে-ছাড়াতে ক্রমান্বয়ে প্রজাপতি হয়ে ওঠার বয়স। প্রতিটি বস্তুকে সে তাকিয়ে দেখে প্রথমবারের মতো। দেখে দেখে বিস্ময়ের শেষ খুঁজে পায় না। আবিষ্কারের খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে সে ভাবে—‘আচার্য জগদীশ বসু/ উদ্ভিদকে বলেছেন পশু।’ বিপুলা পৃথিবীর নাজানা-নাচেনা জগৎকে অবাক চোখে দেখে, রহস্যঘন লাগে তার; অনেক কিছু তার কাছে একিবারেই নতুন—সে সবকে সে অনুসন্ধিৎসু মনে অবলোকন করে। শিশুসাহিত্যিক শিশুটিকে এই অজানা রহস্যময় জগৎ ঘুরে দেখান কল্পনা ও বাস্তবতার মিশেলে। শিশু-কিশোর মনকে ধারণ করার জন্য কবির হাতে একমাত্র শব্দ ও কল্পনাবৈভব ছাড়া কোনো মন্ত্র নেই।
পৃথিবীর অরণ্যচারী আদিম মানুষদের মতো এই সময়ের শিশু-কিশোররাও এক অবারিত কল্পনা জগতের অধিবাসী। তার ইচ্ছা-রঙিন ‘যা খুশি তাই’-এর পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’র অলীক বাগানে ক্ষিপ্র চটুল কাঠবেড়ালির মতো তার ইতিউতি ছোটাছুটি। শিশু যখন দেখতে পায় তার চোখের সামনে ভারী ভারী ইট-কংক্রিটে গাঁথা দানবীয় বিশাল ঢাকা শহরটা—তার শ্বাসরোধকারী শান-বাঁধানো দাপট হারিয়ে হঠাৎ পাগলের মতো দৌড়াতে শুরু করেছে তখন এক অপার্থিব উল্লাসে তার মনটা ভরে যায়।
নিয়ম আগলভাঙা স্বেচ্ছাচারী জগৎ শিশুর অবিকশিত কচি মনটার খুব কাছাকাছি। পরিণত মানুষের বুদ্ধি বা বিচার-বিবেচনা গড়ে ওঠেনি বলে কেবল হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়া দিয়ে সে জীবনের যাবতীয় দেনা শোধ করতে চায়। তার মনজগৎকে যুক্তিহীন অবাস্তবতার জগৎই বলা যায়। এই জগৎকে যে কবি সুস্বাদু খাবারের মতো স্বাদে গন্ধে মুখরোচক করে তার টেবিলে পরিবেশন করতে পারবেন তিনিই তার কবি। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ শিশুর কবিকে দেখতে চান ‘শিশুমনের এই যুক্তিহীনতার প্রতিভাবান লিপিকর।’ কবি শিশু-কিশোরদের খেয়ালরসকে কবিতায় বাঙ্ময় করে তোলেন।
শিশুকিশোরের জগৎ এক অনিন্দ পুলকের জগৎ। অকারণে অনাবিল এক পুলকের পৃথিবী তাদের। এই পুলকের জগতে অদ্ভুত খেয়ালরসের পাশাপাশি তাদের জীবনের অন্যতম প্রধান রস কৌতুকরস। পরিণত মানুষ এখানেই শিশুকিশোরদের থেকে পৃথক। পরিণতদের জীবনের প্রধান বিষয় বিষাদ, সাহিত্যে বড়োদের মূল রস কৌতুক নয়, করুণ। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বিষয় হালকা চালের ও হাস্যরস বিশিষ্ট হতে পারে।
শৈশব ও কৈশোর এক রোমাঞ্চকর ধাপ। এর মধ্যে কৈশোর হলো জীবনের সবচে উর্বর ও পরিবর্তনশীল সময়। এ সময়-পরিসরে ছেলেমেয়ে উভয়ের শরীরে বয়ঃসন্ধির নানা পরিবর্তন ঘটে। শারীরিক পরিবর্তনের এ-নতুন অভিজ্ঞতা অনিবার্যভাবে তার মনেও প্রভাব ফেলে। কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে; এ রহস্যময় পরিবর্তনের ফলে সে হয়ে ওঠে অস্থির-চঞ্চল, কখনও-বা দুরন্ত-দুর্বার, কখনও আবার উদাসীন, উড়ু-উড়ু। সবকিছুতে তার বিপুল উৎসাহ। সে এই সময় নিজেকে ঠিক ছোট ভাবতে নারাজ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরিণত বয়সও এটি নয়। আার এই কাল-পরিসরের যথাযোগ্য দ্রষ্টা কিশোরকবিতার কবি। কী শব্দ চয়ন, কী ভাবের বিন্যাস—সব কিছুতে কিশোর কবিতার কবিকে বয়ঃসন্ধিকালের চঞ্চল, উড়ুক্কু মন বিবেচনায় রাখতে হয়।
শারীরী এই পরিবর্তন মনের ওপর যেমন চাপ ফেলে তেমনি তার চেনা পৃথিবীর সঙ্গে কিছুটা টানাপড়েন ঘটায়। অকারণে তার মন-মেজাজের ভারসাম্য হারায়। পরিচিতজনের কোন ছোট বিষয়ও তার মধ্যে আকস্মিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটায়, তার মনের সঙ্গে সংযোগস্থাপন কিছুটা দুরূহ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। বয়সের বাড়ন্ত গোঁফ তার লজ্জার কারণ হয়। তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার তৈরি হয়। নির্জনতা বা একাকিত্ব কখনো উপভোগ্য হলে আবার কখনো হয় বিরক্তিকর। এই মিশ্র পরিস্থিতিকে বোঝা খুব সহজ নয়।
কিশোর বেলায় দৈহিক পরিবর্তনের সুর প্রকৃতির ঢেউয়ে ধাক্কা খায়। প্রকৃতি বদলে যাওয়ার গান ধরলে নিজেকে একান্তভাবে উদাস মনে বিলিয়ে দেওয়ার ধ্যানে মগ্ন হয়ে পড়ে। তখন নতুন কিছু খোঁজা এবং নিজেকে উপস্থাপনের নেশায় এখানে-ওখানে-সেখানে ছুটে যায় তার উদাসী মন। এই বয়সীদের মন স্বভাবতই স্বপ্নকল্পনা-বিলাসী। স্বপ্নপ্রবণ কিশোর মনের চিরায়ত বিস্ময় ও অভিব্যক্তির নিরন্তর পরিবর্তনশীলতা, পরিবেশ-প্রকৃতি ও সামাজিক শৃঙ্খলার সঙ্গে নিত্যকার দ্বন্দ্ব-বাধ্যবাধকতা এবং তা থেকে মুক্ত হওয়ার বিদ্রোহী ইচ্ছাভ্রমণ, তার সবই অক্ষর-বুননে মূর্ত করে তোলা জটিল কাজ। কাব্যের তত্ত্ব-তালাশ আয়ত্ত্বে এলেও কিশোর মনস্তত্ত্ব, মনোজগতের দ্বন্দ্ব-বিকাশ এবং সহজাত গতি প্রকৃতিকে যথাযথ আত্মস্থ করতে না পারলে একে কবিতার মোড়কে প্রকাশ করা দুরূহ।
শিশু-কিশোরদের ভেতর রয়েছে এক দুর্দান্ত ও আদিম শক্তিমত্তা। তার চারপাশের সম্পর্কগুলো নিয়ে তার রয়েছে নিজস্ব ভাবনার উঠান। তার শারীরিক যোগ্যতা অফুরন্ত ও নৈসর্গিক। সাত ভাইয়ের সাতটি চাঁপা ফুল হয়ে গাছের ডালে ফুটে থাকা পারুল বোনের সঙ্গে কথোপকথন, রাক্ষসের তাড়া খাওয়া নিরাশ্রয় রাজপুত্রকে ‘সত্য গাছে’র দু’ভাগ হয়ে নিজের ভেতর নিয়ে নেওয়া— সবকিছু তার কাছে সত্য এবং বিশ্বাসযোগ্য।
দুরন্তপনা কিশোরজীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম। সে এ-গাছের ও-গাছের ডালে চড়বে, পাখির পেছনে পেছনে ছুটবে, বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, গভীর জঙ্গলে পাখির কুজন-কাকলী তাকে মুগ্ধ মনোহর করে বারবার টানবে, সে ছুটে যাবে নদীর উত্তাল ঢেউ দেখতে, ক্ষেতের আলে এঁকেবেঁকে ছুটবে নিরুদ্দেশ, স্কুল পালিয়ে বন্ধুরা মিলে দস্যিপনায় মেতে সারাদিন মনের আনন্দে খেলে বেড়াবে—এই তো বাংলার প্রকৃত কিশোরের রূপ। এই দুরন্তপনা, দস্যিপানার মাধ্যমে খুঁজে নিবে সে সবুজ, শ্যামল স্বাধীন সোনার বাংলাকে। এই যার কিশোরবেলা, সে তো বড় হয়ে অন্য কোনো সংস্কৃতিকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারে না; দেশের বুকে ভিন্ন সংস্কৃতিকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে সে যত দূর-দুরান্তেই যাক না কেন, বুক পকেটে ভরে নিয়ে যাবে বাংলাকে, বাংলাদেশকে, বাংলার শাশ্বত রূপকে, রূপসীবাংলার অবহমান সংস্কৃতিকে। অন্যথায় যার জীবন শুরু হবে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে, বাবা মা যাকে অঢেল অর্থ, বাড়ি, গাড়ির স্বপ্ন দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাস্তব কণ্টকাকীর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে সে কী করে বুঝবে নিজ-সংস্কৃতির দরদ?
কিশোর কবিতার কবিকে জীবনের কোনো একটি আবেগাশ্রিত বিষয়কে
ধ্বনিময় চিত্রলোকের বিস্মিত বাসিন্দা করে তুলতে হয় কল্পনা
ঐশ্বর্যের সমান সচ্ছলতা দিয়ে—কবিত্বের শক্তি দিয়ে।
কৈশোরের স্মৃতি-বিস্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় না এমন কোনো মানুষ পাওয়া যায় না। কারণ, মেঘের পাল্কিতে চড়ে বিজলি ছোঁয়ার দুঃসাহস তৈরি, সে তো এই কৈশোরে হয়েছে। তাই সৃজনশীল মানুষমাত্রই জীবন অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে হাত বাড়ায় দুরন্ত কৈশোরের প্রতি। কৈশোরের দুরন্তপনায় হাত বাড়াননি কোন কবি? অস্থিমজ্জায় দস্যিপনা এমন এক ও একাকার হয়ে যায় যে, এটিকে সত্তা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এড়াতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীন, আহসান হাবীবও। তাদের মতো আল মাহমুদও কর্ণফুলীর কূল ভুলতে পারেননি; তিনি নদীর কূলে, বকুল ডালে পাখির মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকাডাকি করতে পছন্দ করেন—‘আমার কেবল ইচ্ছা জাগে নদীর কাছে থাকতে,/ বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে/ পাখির মতো ডাকতে।’
কেবল কৈশোর স্মৃতিমন্থনকে কিশোর কবিতা বলার দিন অতীত। যথাকিঞ্চৎ স্মৃতিমন্থন কবিতার শর্তে উৎরালে দোষের কিছু থাকার কথা নয়। খেয়াল রাখতে হবে, নবীন কিশোর যেন সেখানে কবির অভিজ্ঞতা পাওয়ার পরিবর্তে নিজেকে খুঁজে পায়—কবি তেমন পরিবেশই গড়ে তুলবেন। যদি কিশোর কবিতার ক্ষেত্রে কৈশোরিক ভাবালুতাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তবু এটিকে কিশোর কবিতার প্রধান উপজৈব্য ভাবা নিতান্তই একগুঁয়েমি।
চার.
শিশুর প্রতি আকুতি প্রাচীন হলেও তার জন্য রচিত সাহিত্যে শিশুমনস্কতা যেমন অর্বাচীন তেমনি কিশোরের মন জগতের খবর অনুসন্ধান করে তাকে তার-ই মতো ভাবতে দেওয়ার ইতিহাস খুব বেশিকাল পুরাতন নয়। ডাণ্ডা মেরে শিশুকিশোরকে ঠাণ্ডা করা শুধু আমাদের এই উপমহাদেশে নয়, পৃথিবীর সব প্রান্তেই দেখা যায়।
আমাদের দেশে শিশুকিশোর মনস্কতার কথা কখন থেকে ভাব হয়? এমন প্রশ্নে প্রথমে যার নাম আসে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরে যা স্পষ্ট তা হলো, তিনিও শিশুকিশোরদের শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন, আনন্দদান তার উদ্দেশ্য ছিল না। শিশুকিশোরদের ইচ্ছাকে সম্মান, তার আনন্দকে আবাহন, তাকে নিজের মতো করেই বিকশিত হতে দেওয়া— এসব তো তখনই সম্ভব ‘যখন য়োজ্যেষ্ঠেরা নিজের ইচ্ছাশক্তির মারে তাকে বিপন্ন ও পার্যদুস্ত না-করছে।’ শিশুকিশোরদের নিয়ে ভাবনা-চিন্তা যারা করেছেন, তাদের মধ্যে এই চিন্তাটি যিনি প্রথম করেছেন তিনি যে উপেন্দ্রকিশোর রায়; এতে সন্দেহ নেই। প্রাক-উপেন্দ্রকিশোর শিশুসাহিত্যে শিক্ষা দেওয়ার দিকটায় গুরুত্ব দেওয়া হতো, এমনকি রবীন্দ্রনাথেও কমবেশি, বুদ্ধদেবের ভাষায়—‘গুরুগিরি’র হাওয়া আছে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোরেই সে ধরনের লেখার সূত্রপাত করেছেন, যেখানে ‘গুরুগিরি’র স্থান নেই, এমনকি গুরুরও স্থান নেই। তার হাতে বাংলা সাহিত্য শিশুকিশোর মনস্কতার বিষয়ে অধিকতর সচেতন হয়েছে।
যেকোনো দেশের, যেকোনো কালের শিশুকিশোররা সবচে বেশি অপছন্দ করে উপদেশ। শিশুকিশোর মাত্রই পছন্দ করে সেইসব কাহিনী, যেখানে তার নিজের নায়ক হওয়ার সুযোগ পূর্ণমাত্রায়। অর্থাৎ অদ্ভুত-রস, ফ্যান্টাসি ও রোমাঞ্চকর অভিযান তাদের আচ্ছন্ন করে। হায়াৎ মামুদ বলেছেন, ‘তার ইহজাগতিক পরিমণ্ডলকে সে অস্বীকার ক’রে যেমন নিজস্ব কল্পনা জগৎ গড়ে নেয়, যিনি তাকে গল্প শোনাতে চাইছেন তাঁকে প্রথমে সেই জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতে হয়।’
শব্দে, ছন্দে, ছবিতে, গানে, স্বপ্ন কল্পনায় ও বিরল সৌকর্যে শিশুকিশোর পৃথিবীকে তাদের সমান রঙদার করে তুলে ধরতে হয়। কল্পনাই তার সম্পূর্ণ বক্তব্যকে ছবি আর গানের বর্ণোজ্জ্বল জগতে—ধ্বনিময় চিত্রলোকে—স্মরণীয় জায়গা দেবে। কল্পনা যাকে স্পর্শ করে, তার নামই শিল্প—অনুপম, অশ্রুতপূর্ব ও অপার্থিব। কিশোর কবিতার কবিকে জীবনের কোনো একটি আবেগাশ্রিত বিষয়কে ধ্বনিময় চিত্রলোকের বিস্মিত বাসিন্দা করে তুলতে হয় কল্পনা ঐশ্বর্যের সমান সচ্ছলতা দিয়ে—কবিত্বের শক্তি দিয়ে। যার কবিত্বের শক্তি যত বেশি, তিনি এই কল্পনার জগতের তত সফল কবি হতে পারেন, হতে পারেন শিশুর মনোজগতের প্রকৃত রূপকারও। কল্পনার দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে কারুকার্যময় কবিতার নকশীকাঁথা বুনন করবেন কবি, শিশু বা কিশোর সেই কবিতা পড়তে পড়তে হারিয়ে যাবে তার সেই স্বপ্নের রাজ্যে—যে স্বপ্নের কল্পনায় বিভোর হয়ে উড়নচণ্ডী হয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা।