অর্থবহ কবিতার আঁচল ধরে হেঁটে যেতে যেতে চোখে পড়ে এর অপার সৌন্দর্যের চিত্রকল্প। এই সৌন্দর্যকে লালন করে কবিতার শরীরে প্রয়োজনমাফিক এক-একটি ফুল গুঁজে দিতে পারলেই তা হয়ে উঠবে প্রেয়সীর খোলা চুলের মতো দীঘল, সাবলীল ও প্রাঞ্জল। রূপক, উপমার পাশাপাশি চিত্রকল্পও পাঠকের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়া জরুরি। কেননা, চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবির নিজস্ব ঢং প্রকাশিতহ হয়। কবিতার শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চিত্রকল্প ঢুকে পড়লে কবিতার গঠনশৈলী বিকৃত হয়। কবিতা হয়ে ওঠে জটিল। তখন আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতার দোহাই দিয়ে কবিতাকে তুলে ধরা হয়। এতে প্রকৃতপক্ষে, কবিতাটি কেন অর্থবহ বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হলো না, তা আড়াল করা হয়। আধুনিকতার চাদর জড়িয়ে কবিতার দুর্বলতা আড়াল করা মানেই ওই কবির আগামীর পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, অতি অপরিচিত কবির কবিতাটি বেশ মানোত্তীর্ণ, কিন্তু পরিচিত কবি বা সমালোচকের কাছে সেটি কবিতাই হয়ে ওঠেনি বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। বলে রাখা জরুরি যে, প্রত্যেকটি কবিতা তার নিজস্ব আলোয় আলো ছড়িয়ে থাকে। কোনো কবির দৃষ্টিভঙ্গি বা বোধের কাছাকাছি পৌঁছানো বেশ কঠিন। সুতরাং, কোনো কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়নি বা অনাধুনিকতার দোহাই দিয়ে নাকচ করা আদৌ উচিত নয় বলে মনে করি। কেননা, এ বিষয়ে বিস্তর গঠনমূলক গবেষণা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রসারের প্রয়োজন।
কবিতাকে এমন জটিল বা শব্দবিভ্রাট করে পাঠকের সামনে হাজির করলে কবিতার পাঠকপ্রিয়তা ক্রমেই হারাবে। উদ্ভট-জটিলতায় সংক্রমিত হবে কবিতার শিরা-উপশিরা
আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতা শব্দ দু’টিই সাহিত্যিক-সৃষ্টি। মূলত বিশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যামূলক ভিত্তিতে বোঝানোর জন্যই এমন সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা তথা কবিতাকেও এই সরলরৈখিক উপপাদ্যের প্রমাণচিত্রে অহরহ অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ফলে কবিতার শরীর কাটা-ছেঁড়া করে কবিতার নিজস্ব ঢং বা গতি হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে ছন্দচর্চার অভাবেও হারাচ্ছে কবিতার নিজস্ব রূপ। জোর করে হলেও কবিতার নিজস্ব রূপকে মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর অন্য ছন্দ বা ঢং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা ব্যস্ত।
উল্লেখ্য, শেকড়কে বিসর্জন দিয়ে গাছের মগডালে ফল আশা করা বোকামি। সুতরাং, অতি-আধুনিকতার নামে কবিতাকে দিনে দিনে অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য করছি কি না, তা আরও ভেবে দেখা জরুরি। অ্যান্ড্রিয়াস হুইসেন উত্তর-আধুনিকতাবিষয়ক একটি আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, ‘উত্তর-আধুনিকতার অস্পষ্ট অবয়বহীন ধারণা এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই শব্দটির অপরিবর্তনশীল ব্যবহারে শব্দটির অস্পষ্ট অর্থ আমাদের কাছে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ একইভাবে, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার ‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি’ গ্রন্থে ‘আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতা’ বিষয়ে বলেছেন, ‘সমালোচকরা উত্তর-আধুনিকতার ব্যাখ্যায় কেউই একমত নন। এই উত্তর-আধুনিকতা একধরনের নব্যরীতিবাদ বা তার থেকেও নতুন কিছু।’
আধুনিকতার নামে কবিতাকে অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন বা গন্তব্যহীন করা উচিত নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সমকালীন কবিদের হাত থেকে যেসব কবিতা বেরিয়ে আসছে, সেসব কবিতায় আরও বেশি দর্শন, বোধ ও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসা জরুরি। সঙ্গে প্রাঞ্জলতা ও সহজবোধ্যতাও প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কারণ কবিতা হলো কবির মনন ও মেধার সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণের কোনো কাল নেই। জীবনবোধ ও নাগরিক-দাবির কথা কবিতায় উঠে আসে অবলীলায়, নির্ভয়ে। কবিতা কোনো ব্যক্তি বা দেশের একমাত্র সম্পদ নয়, বরং তা বিশ্বসভার। কবিতার মাধ্যমে বন্ধন তৈরি হয় মানুষ ও মানবতার। কবিতায় আধুনিকতা তুলে ধরতে হলে কবিকে আত্মসচেতন হতে হবে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ‘আধুনিক বাংলা কবিতা: প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বর্তমানে দাঁড়িয়ে তিনি রচনা করেন অতীত ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধ। তিনি প্রগতির স্বপক্ষে, মানুষের স্বপক্ষে। তিনি মূলতঃ স্বাদেশিক কিন্তু ফলতঃ বিশ্বনাগরিক। জগৎ ও জীবন প্রসঙ্গে কবি কথা বলেছেন সব কালেই। আধুনিক কবি সেই সঙ্গে সচেতন হয়ে উঠেছেন নিজের সম্পর্কেও। বস্তুত আধুনিক কবির এক প্রধান বৈশিষ্ট্য তিনি আত্মসচেতন।’ সুতরাং, কবিতায় আধুনিকতা স্থান পেলো কি না, তা পাঠক কিংবা সমালোচকেরা নির্ধারণ করবেন, কবির এ বিষয়ে চিন্তা করা জরুরি নয়। তার কাজ হলো কবিতার নন্দনতত্ত্বকে গুরুত্ব দেওয়া। তাহলে কবিতায় দুর্বোধ্যতা বা জটিলতা প্রসঙ্গটি দূরে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে, নান্দনিকতা কবির স্বকীয় বোধের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই সংযোজনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিখনের প্রয়োজন নেই বললেই চলে। প্রয়োজন, কবিতার প্রেমে কামাতুর হওয়া, ধ্যানমগ্ন হওয়া। কবিতার জন্য অপেক্ষা করা। একটি কবিতার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করা। সময়ের জন্য অপেক্ষা করা। কবিতাকে পেশা নয়, নেশা হিসেবে গ্রহণ করা। কবিতার নেশাকে নবায়নযোগ্য করে তোলা। কেউ কাউকে হাতে ধরে কবিতা শিখিয়ে দিতে পারে না। কবিতার হাতেখড়ি বলে কিছু নেই। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এ বিষয়ে আরও বলেছেন, ‘কবিতা আধুনিক পৃথিবীতে কারো পেশা নয়। উপরন্তু পেশামাত্রই প্রশিক্ষণযোগ্য। প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্ততঃ সাধারণ মানের চিত্রকর, ভাস্কর, স্থপতি, গায়ক, যন্ত্রী, অভিনেতা ও নৃত্যশিল্পী যে তেরী করা যায় তা বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করেছেন আর্ট কলেজ, স্থাপত্য ফ্যাকাল্টি, নাট্য একাডেমী ও নাচ গানের হরেক রকমের স্কুল। কিন্তু কবির জন্য তেমন কোন প্রশিক্ষণের আয়োজন কোন সুফল আনেনি।…বস্তুতঃ কবিতা প্রশিক্ষণযোগ্য পেশা নয়।’
আধুনিক কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—রূপকের ব্যবহার। পরিমিত রূপক শব্দ আধুনিক কবিতার শরীরকে ঋদ্ধ ও মজবুত করে। শব্দচয়নকে নান্দনিক করে তোলে। তবে তার সার্থক ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। রূপক ব্যবহারে যত্নবান ও সতর্ক না হলে কবিতার শরীর মেদবহুল ও অনর্থক হয়ে পড়ে। সমকালীন কিছু কবিতায় লক্ষ রাখলে দেখা যায়, আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতার নামে অপ্রয়োজনীয় ও সার্থকহীন রূপকের ব্যবহার বিরামহীনভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে কবিতা তার নিজস্ব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্য গোচরে, যা কবিতার পাঠকের জন্য হুমকিস্বরূপ। কবিতাকে এমন জটিল বা শব্দবিভ্রাট করে পাঠকের সামনে হাজির করলে কবিতার পাঠকপ্রিয়তা ক্রমেই হারাবে। উদ্ভট-জটিলতায় সংক্রমিত হবে কবিতার শিরা-উপশিরা। কবিতাকে নিজের গতিতে হাঁটতে দিতে হবে। রূপক শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দের ইঙ্গিত ঠিক রেখে কবিতাকে হাঁটাতে হবে। কবির ইঙ্গিতকে একটি দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর করে কবিতার ভেতর পাঠক ডুব দেবে। খুঁজে পাবে আক্ষরিক অর্থের আড়ালে অপার সৌন্দর্য ও বোধের পুকুর। যেখানে পাঠক ডুব দিয়ে তুলে আনবে কবিতার রূপ ও রস। কিন্তু রূপক শব্দের আড়ালে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন শব্দের মনগড়া অর্থ কবিতায় স্বীকৃত নয়। বরং তা কবির প্রতি পাঠকের একটি অস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়। সমকালীন কবিতায় কবিদের এই বিষয়টি খেয়াল রাখা বেশ জরুরি। নইলে আধুনিক কবিতাটি হয়ে উঠবে জটিল থেকে জটিলতর। অপ্রাসঙ্গিক রূপক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি’ গ্রন্থে উজ্জ্বলকুমার মজুমদার ‘রূপক-কাব্য’ বিষয়ে বলেছেন, ‘রূপক কবিতা কাহিনীমূলক। এই জাতীয় কবিতায় সমান্তরালভাবে আক্ষরিক অর্থ ছাড়া অন্য এক গভীর অর্থের ইঙ্গিত থাকে। অর্থটি আপাতপ্রতীয়মান নয়, কবির ইঙ্গিত অনুসরণ করে তাকে খুঁজে নিতে হয়।’ একই বিষয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘যেকোনো রূপক থেকেই একটি মনগড়া অর্থ তৈরি করা যায়। কিন্তু সেই অর্থ যদি কবির স্বীকৃতিতে সমর্থিত না হয় বা সেই অর্থের সমর্থন-সূচক কোনো ইঙ্গিত যদি রচনার মধ্যে সমান্তরালভাবে না থাকে তাহলে মনগড়া অর্থটিকে পরিত্যাগ করাই ভালো। স্বেচ্ছামতো রূপক আবিষ্কারের চেষ্টা মূল অর্থকে বিকৃত করতে পারে।’ সুতরাং, উল্লিখিত বিষয় পর্যালাচনা করলে বোঝা যায় যে, কবিতা অর্থবহ করে তুলতে না পারলে কবিতার পাঠকপ্রিয়তা হারাতেই পারে। এক্ষেত্রে এখানে একটি আন্দাজভিত্তিক জনশ্রুতি তুলে ধরা যেতে পারে। যদিও এই আন্দাজভিত্তিক জনশ্রুতির যৌক্তিকতার বিষয়ে আরও আপেক্ষিক গবেষণা প্রয়োজন। বলা হয়, একজন তরুণ বা নবীন কবি—অন্য তরুণ-নবীন-প্রবীণ সকল কবির কবিতায় আগ্রহ রাখে বেশ। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে, একজন প্রবীণ কবি স্বভাবতই একজন নবীন বা তরুণ কবির কবিতায় সহজে আগ্রহী হতে পারে না। কারণ, ওই তরুণ বা নবীন কবির কবিতায় যথেষ্ট দুর্বোধ্যতা কিংবা জটিলতা বিদ্যমান। কতিপয় এমন কবির কারণে সব তরুণ বা নবীনকে একই মাপকাঠিতে আনা উচিত হবে না। কেননা, তরুণ বা নবীন কবিদের হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং আসছে বেশ নান্দনিক কবিতা, কালোত্তীর্ণ কবিতা; যা প্রশংসার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে প্রবীণদের কবিতাও কম দাবি রাখে না।
দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠকের চেয়ে লেখক-কবির সংখ্যা ঢের বেশি। কবিতা কাগজ-কালির বদলে ভার্চুয়াল দেয়ালে ঠাঁই পাচ্ছে
প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমকালীন কবিতায় খেয়াল করলে দেখা যায় যে, কেউ কেউ কবিতার নিজস্ব ঢঙ রপ্ত করে তা পাঠকের উদ্দেশে ছুড়ে দিচ্ছে। কিছু উদ্ভট শব্দচয়ন বা পঙ্ক্তি একত্রিত করে কবিতা নির্মাণ করছে। কবিতা পাঠক বুঝুক বা না-ই বুঝুক কবি সেসব দেদারছে লিখে যাচ্ছে। আসলে, কবি নিজেকে জ্ঞানী মনে করবে আর পাঠককে কবিতা বোঝে না ভেবে মূর্খ মনে করবে, এমনটা সত্য নয়। কেননা, পাঠকের অত বেশি দায় পড়ে যায়নি যে, কবির কবিতা বুঝে ওঠার জন্য আলাদা করে অভিধান খুলে বসতে হবে। শিক্ষককে যেমন ছাত্রদের পড়া বুঝিয়ে দিতে হয়, তেমনি কবির প্রধান কাজ পাঠকসুলভ কবিতা রচনা করা। যেন কবির কবিতা পড়ে পাঠক পাঠোদ্ধার করতে পারে কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। এক্ষেত্রে, সমালোচক ক্লাইভ বেল শিল্পের রূপকলাকে ‘তাৎপর্যব্যঞ্জক’ হিসেবে রূপায়িত করেছেন। তাই বলে, কবিতায় কবির যে স্বাধীন সত্তা থাকবে না, তা কিন্তু নয়। কবিতায় কবির স্বাধীনতা আকাশ কিংবা সমুদ্রের মতো বিশাল। এই স্বাধীনতার সুযোগে কবি তার কবিতায় যা ইচ্ছে তাই লিখে পাঠকের জন্য উপহার দিতে পারে না। পাঠকের চোখের দিকে তাকিয়ে কবিতাকে হাঁটতে দিতে হবে। কবিতাকে জনচেতনার সামনে দাঁড়িয়ে দিতে হবে। তবেই পাঠক নিজে নিজে কবিতাকে খুঁজে নেবে। ‘বাংলা সাহিত্য: কয়েকটি প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে মাহবুবুল হক ইংরেজ লেখক ই.এম. ফস্টারের একটি অভিমত উল্লেখ করেছেন, ‘অন্তত তিনটি কারণে লেখকের স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন: প্রথমত, স্বাধীনতা ছাড়া লেখক কোনো কিছুর সৃষ্টির প্রেরণা পান না; দ্বিতীয়ত, লেখক যা ভাবেন তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা না থাকলে লেখকের সৃষ্টি সার্থক হয় না; তৃতীয়ত, জনসাধারণের চেতনা ও মানস বিকাশের জন্যও এগুলি দরকার।’
বর্তমানে, ফ্রি হোম সার্ভিস ডেলিভারির মত কবিতাকে জোর করে পাঠকের দেরাজে ঢুকিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা, সমকলীন সাহিত্যবাজারে একটি আলাচিত বিষয়। সঙ্গে আধুনিক কবিতার নামে সঙ্গতিহীন ডামাডোল তো আছেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আদলে সৃষ্টি হচ্ছে ডজন ডজন কবি। ইচ্ছেমতো শব্দ সাজিয়ে কবিতা তৈরির অপচেষ্টা দিন দিন বাড়ছে। দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাঠকের চেয়ে লেখক-কবির সংখ্যা ঢের বেশি। কবিতা কাগজ-কালির বদলে ভার্চুয়াল দেয়ালে ঠাঁই পাচ্ছে। ফলে দিনে দিনে আমরা পড়তে ভুলে যাচ্ছি, আগ্রহী হচ্ছি লেখায়। কারণ, আমরা অনুকরণ বা অনুসরণ করে অন্য কবি বা লেখকের মতো লিখতে আগ্রহী। অথচ, মানোত্তীর্ণ কোনো কবির কবিতা পড়ার চর্চা বা আগ্রহ দিনে হ্রাস পাচ্ছে। একটি বিষয় বলে রাখা জরুরি যে, অনুকরণ বা অনুসরণ কবিতাকে জটিল করে তোলে, অস্পষ্ট করে তোলে। কেননা সেই কবিতায় সংশ্লিষ্ট কবির নিজস্বতা বলে কিছু থাকে না। চাঁদের আলোর মতো সবটুকুই ধার করা। আর আরোপিত কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। কবিতার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি খেয়াল রাখা কবির বুদ্ধিদীপ্ত কাজ বলে মনে করা হয়।
আর একটি বিষয় হলো, আধুনিক কবিতায় শব্দের সংযোজনা এমনভাবে রক্ষা করতে হবে, যা কবিতার তাৎপর্যকে ইঙ্গিত দিতে পারে। শব্দের সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে কবির কল্পনার আশ্রয় নিতে হতে পারে। কিন্তু কবির কল্পনা যেন পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সরলরৈখিক সংযোগ স্থাপন করে। অহেতুক জটিল অধ্যায়ের অবতারণা থেকে নিজেকে দূরে রাখা শ্রেয়। কবির সঙ্গে পাঠকের মানসিক দূরত্ব তৈরি হলে কবিতাকে পাঠক গ্রহণ না-ও করতে পারে। ‘সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি’ গ্রন্থে উজ্জ্বলকুমার মজুমদার ‘কল্পনাশক্তি’ বিষয়ে বলেছেন, ‘কবিতার মধ্যে এই রকম বিচিত্র ও কখনো কখনো বিপরীত ভাবের মিলন যে ঘটে তা কবির কল্পনাশক্তির বলেই ঘটে থাকে। কাজেই কল্পনা কথাটির অর্থ সৃষ্টি-ক্ষমতা। এই কল্পনাশক্তির বলেই অপ্রত্যক্ষ বস্তু প্রত্যক্ষ সত্যে পরিণত হয়, যা মানসিক ব্যাপার তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্য হয়ে ওঠে।’ সুতরাং, কবিতা পাঠকের অনুকূলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়া জরুরি। বাস্তবচিত্রের পাশাপাশি কল্পনাকে কবিতায় স্থান দিতে হলে ভাবপ্রকাশে, শব্দচয়নে আধুনিক ও চৌকষ হতে হবে। ভাবপ্রকাশে কবির ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। পাঠক কবিতাকে আধুনিকতার মানদণ্ডে নিরীক্ষণপূর্বক আলাদা কাব্যিকপ্রীতি তৈরি করে। কবিতায় কখনো কবির আত্মতুষ্টি থাকতে নেই। থাকতে নেই মানসিক প্রশান্তি। তাহলে কবির মৃত্যু হয়। কবিতার ক্ষেত্রে কবিকে আরও বেশি ক্ষুধার্ত, তুষ্টিহীন, প্রশান্তিহীন হতে হয়। নইলে নতুনত্বের সৃষ্টি হবে কী করে? কবিতার খিদে ফুরিয়ে গেলে কবিতায় নান্দনিকতা আসে না। খিদেকে জাগিয়ে রাখতে হবে। তবে এ কথাও সত্য যে, কবিতায় আপেক্ষিক মানসিক প্রশান্তির প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ নিজে কবিতা থেকে প্রশান্তি না পেলে, পাঠকও পাবে না। কবিতার রূপ ও তার উপাদেয় উপাদান কবিতার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। কেবল দেহগত বা রূপগত সৌন্দর্যই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ভেতরকার সৌন্দর্যকে বাইরে প্রস্ফূটিত করা, তবেই পাঠক কবিতার রূপ-রসে সিক্ত হবে। কবিতার ঘ্রাণে বিমোহিত হবে, আন্দোলিত হবে।
কবিতায় আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়ার জন্য জীবনবোধের নিরেট কথামালা তুলে ধরা প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিক শব্দচয়ন-রূপক-উপমা ইত্যাদি ব্যবহার করে কবিতার শরীরকে জটিল করা কতটুকু যৌক্তিক, তা পুনর্বার ভেবে দেখা উচিত
আধুনিকতা নিয়ে খুরশীদ আলম বাবু তার ‘আধুনিকতা ও সাম্প্রতিকতার সমন্বয়’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১০.০৮.২০১৮) প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আধুনিকতার সংজ্ঞা নির্মাণ করা একটি দুঃসাহসিক কাজ। মনে রাখা প্রয়োজন আধুনিকতাকে সংজ্ঞায় নির্ণীত করার প্রয়োজনে পূর্বের কবিদের রচনাবলী বাতিল করা যায় না, তেমনভাবে কোনো মতবাদের অভিধায় একে চিহ্নিত করা ভুল প্রচেষ্টা বলে গণ্য হবে।’ আধুনিকতার আরও গভীরে হাঁটতে হাঁটতে উজ্জ্বল সিংহ তার ‘প্রসঙ্গ আধুনিকতা, আধুনিক কাব্য’ (কালি ও কলম) প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘যুক্তিবাদকেই যে আধুনিকতাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য বলা যায়, সেটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন ম্যাক্স ভেবের, কারণ উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকেই আধুনিকতাবাদ হিসেবে মনে করা হতো। আর আধুনিকতার সাধারণ লক্ষণ হলো নতুন-নতুন ভাবনা-চিন্তা, দর্শন, শৈলী, মনোভঙ্গি, দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র আগ্রহ, কৌতূহল এবং তার যথাযথ উপস্থাপনা।’
উল্লেখ্য, একদল তরুণ কবির আত্ম-সচেতন বিদ্রোহের ফলে কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটে থাকে। কবিতার সনাতন পথের বিপরীত দিকে হেঁটে কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আধুনিক মননে। এই কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন—বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। মূলত এ সকল কবির মতামত প্রকাশের উল্লেখযোগ্য আশ্রয়স্থল ছিল তৎকালীন ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি সাহিত্যপত্রিকা। অনেকের মতে, ‘কল্লোল’ পত্রিকাটির মাধ্যমেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূচনা ঘটেছিল। এছাড়া, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যসূচনায় বেশ আলোচিত। অন্যদিকে, তত্ত্বগত দিক থেকে বিচার করলে বাংলা সাহিত্যে কবিতার ভুবনে প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিরিশ দশকের পর থেকে কবিতায় আধুনিকতার বিষয়ে একটি দিক খুব জোরালোভাবে উঠে আসে, সেটি হলো রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত কবিতাই আধুনিক কবিতা। রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত রবীন্দ্রোত্তর কবিতা যদি আধুনিক হয় তবে রবীন্দ্রনাথ কি অনাধুনিক? মোটেও সেটি নয়। বরং রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীনসহ তৎকালীন কবিদলও আধুনিকতার চূড়ান্ত জ্যামিতিক-বৃত্ত।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিরিশের যুগে যে আধুনিকতার সূত্রপাত ধরা হচ্ছে, মূলত তার গোড়াপত্তন প্রাচীন যুগ থেকেই। চর্যাপদ কি এখন অনাধুনিক? চর্যাপদ ‘তৎকালীন- আধুনিক’ না হলে আধুনিক যুগে এসেও পাঠ্যবইয়ে চর্যাপদ পড়ানো হতো না। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, প্রাক-মধুসূদন যুগ, প্রাক-রবীন্দ্র যুগ কিংবা রবীন্দ্র-নজরুল-ফররুখ-জসীমউদ্দীনসহ অন্যরা আধুনিক সমাজের অধ্যয়নের মূল পাথেয় হতো না। সেসব যুগেও ‘তৎকালীন- আধুনিক’ কাব্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগের রচনাবলিতে আধুনিকতার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিকতার ধারণাটি একমাত্রিক নয় বরং বহুমাত্রিক। যেটি এসব কবির রচনাবলিতে। উজ্জ্বল সিংহ তার ‘প্রসঙ্গ আধুনিকতা, আধুনিক কাব্য’ (কালি ও কলম) প্রবন্ধে বলেছেন, ‘সমকালে সকলই আধুনিক, বর্তমানে যা আধুনিকতা হিসেবে গণ্য, পঁচিশ-পঞ্চাশ-একশ বছর পর তা-ই হয়ে ওঠে অনাধুনিকতা। অতএব, সময়ের বিচারে আধুনিকতার বিচার করা উচিত নয়। সময়ের মতোই আধুনিকতা একটি কল্পিত বা পরাবাস্তব ধারণা, দুটোই সতত প্রবহমান।’
এদিকে, ‘হাজার বছরের বাংলা কবিতা’ গবেষণাগ্রন্থে মাসুদুল হক, উল্লেখ করেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার সূত্রপাত ১৯২০ সালের পর থেকেই শুরু হয়ে যায়। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আধুনিক কবিতার সূত্রপাত ঘটেছিল তৎকালীন সময়ের ইংরেজি কবিতার নতুন আন্দোলনের প্রভাবে। ১৯১৮ সালে হপকিন্সের প্রথম কাব্যগ্রন্থ The Poems of Gerard Manley Hopkins প্রকাশের পর থেকে ইংরেজি কাব্য রসিকেরা আধুনিক কবিতার বিচিত্র স্বাদ পেলেন।…দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় আধুনিক কবিতার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঠিক এ সময়েই বাংলা কবিতাতেও বিবর্তনের হাওয়া লেগে যায়।’ সুতরাং, একদল তরুণ কবির সফল প্রয়াসে যে সূচনা ঘটেছে, তার যথার্থতা বজায় রাখা জরুরি। কবিতায় প্রবর্তন ও পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে মাত্রারিক্ত কাম্য নয়। কবিতায় আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়ার জন্য জীবনবোধের নিরেট কথামালা তুলে ধরা প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিক শব্দচয়ন-রূপক-উপমা ইত্যাদি ব্যবহার করে কবিতার শরীরকে জটিল করা কতটুকু যৌক্তিক, তা পুনর্বার ভেবে দেখা উচিত। তাই, জটিলতাহীন কবিতার খিদেয় বেড়ে উঠুক—সমকালীন কবিতার পরিবার।
তথ্যঋণ:
১. আধুনিক বাংলা কবিতা: প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত; মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম প্রকাশ-১৯৮৫, পৃ-০১, ০৩।
২. সাহিত্য ও সমালোচনার রূপ-রীতি; উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পঞ্চম সংস্করণ-এপ্রিল, ২০১৬, পৃ-২৪, ৫০, ২৪৫ ।
৩. বাংলা সাহিত্য: কয়েকটি প্রসঙ্গ; মাহবুবুল হক, গতিধারা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি-২০০৯, পৃ-৬১।
৪. হাজার বছরের বাংলা কবিতা; মাসুদুল হক, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি-২০০৮, পৃ-৪৭।
৫. আধুনিকতা ও সাম্প্রতিকতার সমন্বয়; খুরশীদ আলম বাবু, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১০.০৮.২০১৮।
৬. প্রসঙ্গ আধুনিকতা, আধুনিক কাব্য; উজ্জ্বল সিংহ, মাসিক কালি ও কলম।