[কবি-প্রাবন্ধিক-সম্পাদক আবু হাসান শাহরিয়ার। গত দুই বছর প্রিন্ট কিংবা অনলাইন পত্রিকা, কোথাও কবিতা কী প্রবন্ধ কী ননফিকশন কিছুই লেখেননি। আজ ২৫ জুন, আজ তার জন্মদিন। এই উপলক্ষে তাঁর সদ্যরচিত গদ্য ‘কবিতার শব্দকল্পদ্রুম’ চিন্তাসূত্রে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। বলতে গেলে দীর্ঘ দুই বছর পর নীরবতা ভঙ্গ শেষে প্রকাশিত হলো প্রথম সার্বভৌম গদ্য।—সম্পাদক]
অনুচ্ছেদ-১ : ‘সবুজ বাতাস’ অথবা ‘বর্ণহীন সবুজ ধারণাবলি’
এ পর্বের প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে—এই পর্বের কোনও প্রতিপাদ্য বিষয় নেই। আবার আছেও। মানে? শঙ্খ ঘোষের পঙ্ক্তিসূত্রে মানে—’কোনও যে মানে নেই, সেটাই মানে।’ অলংকারশাস্ত্রমতে মানে—’বিরোধাভাস’। আর পোস্টমডার্ন স্বভাববৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অল্পস্বল্প ভাব-ভালোবাসাগত মানে—আদ্যোপান্ত ‘open ended’, আগের তিন পর্বের মতো ‘close ended’ নয়। আরেকটু খোলাসা করি।
আগের পর্বগুলোর মতো এই পর্বের আলোচনা শুধু কবিতা নিয়ে নয়;—বলাবলি-উদ্ধারে সাহিত্যের অন্য একাধিক শাখার কথাও আসবে। তবে কবিতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্বন্ধ সাপেক্ষে। ফলত এই পর্ব একই সঙ্গে একটি সার্বভৌম গদ্য এবং আগের তিন আর পরের এক পর্বের মতো একই গদ্যের অংশবিশেষ।
বর্ণহীন বাতাসকে ত্বকে অনুভব করা ছাড়াও তৃতীয় নয়নে রঙিন দেখেছেন জীবনানন্দ দাশ। অভূতপূর্ব সেই দেখাকে অকৃতপূর্ব শব্দবন্ধে প্রকাশও করেছেন; বলেছেন—’সবুজ বাতাস’। অভূতপূর্ব দেখাদেখির অকৃতপূর্ব শাব্দিক প্রকাশই কবিতার প্রাণকথা, যার উপস্থিতিতে ‘অচ্ছুৎ’ শব্দও ছত্রিশ ব্যঞ্জনে ঝংকৃত হয়; অনুপস্থিতিতে ‘অভিজাত’ শব্দও ছেঁদোভাষ।
জীবনানন্দ দাশ উত্তমরূপে কবি। বাতাসকে তিনি সবুজ দেখবেন এবং সেই দেখাদেখিতে ‘সবুজ বাতাস’ বলবেন—তাতে মুগ্ধ হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু, কবি না হয়েও মার্কিন প্রতিমিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি যখন রসকষহীন ব্যাকরণের আলোচনায় কাব্যরসাত্মক শব্দসমবায়ে ‘বর্ণহীন সবুজ ধারণাবলি ফুঁসে ফুঁসে ঘুমায়’ (The colorless green ideas sleep furiously) বলেন, তখন যুগপৎ মুগ্ধ ও বিস্মিত না-হয়ে পারা যায় না। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত রূপান্তরমূলক উৎপাদনশীল ব্যাকরণের জননীগ্রন্থ ‘Syntactic Structures’-এর কাব্যালংকারে সজ্জিত উল্লিখিত উক্তিটি দিয়েই জগদ্বিখ্যাত ভাষামুনিদের নজর কেড়েছিলেন তরুণ চমস্কি।
বাংলা কবিতার গয়নাগাটি বা অলংকারশাস্ত্র সংস্কৃত কাব্যালংকারশাস্ত্রের অনুবর্তন। ওই ভাষায় কাব্যের প্রথম সার্বভৌম শাস্ত্রগ্রন্থ আচার্য দণ্ডীর ‘কাব্যাদর্শ’। দণ্ডীর আবির্ভাব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে। সংস্কৃত ভাষায় এই শাস্ত্রের প্রথম সূত্রাকারে ব্যাখ্যাতা— ‘কাব্যালংকারসূত্রবৃত্তি’র গ্রন্থকার আচার্য বামন। তার আবির্ভাবকাল ৮ম শতাব্দী। দণ্ডী-বামনকথিত ‘কাব্যশোভাকরণ ধর্মানলংকারন্ প্রচক্ষতে’ (কাব্যের শোভাবিধায়ক ধর্মই অলংকার) ও ‘রীতিরাত্মা কাব্যস্য’ (‘প্রকাশশৈলীই কবিতার আত্মা) আদিভাষ্য বিশ্বনাথ কবিরাজকথিত ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম’ (রসাত্মক বাক্যই কবিতা) ভাষ্যে পৌঁছতে সময় নিয়েছে কয়েক শতাব্দী। দীর্ঘ এই কালখণ্ডে বিবর্তিত কাব্যবীক্ষণের নাতিদীর্ঘ বিকল্প পাঠ আছে রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ শিরোনামের প্রবন্ধে; সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত উদ্ধার—”প্রকাশই কবিত্ব। […] তাহার জন্য নানাপ্রকার আভাস-ইঙ্গিত, নানাপ্রকার ছলাকলার দরকার হয়। তাহাকে কেবল বুঝাইয়া বলিলেই হয় না, তাহাকে সৃষ্ট করিয়া তুলিতে হয়।”
কবি হতে শাস্ত্রবিদ হওয়া আবশ্যক নয়। স্বভাষা-বিভাষার কীর্তিমান কবিদের মহার্ঘ কবিতার সান্নিধ্যে থাকলে বিস্তর শাস্ত্রকথা আপনাআপনি জানা হয়ে যায়। তার পাশে কীর্তিমান কবিদের লেখা কাব্যভাবনামূলক গদ্য-প্রবন্ধসূত্রে অর্জিত অল্প-বিস্তর বিকল্প পাঠ থাকলেই যথেষ্ট। বাংলা কথাসাহিত্যের মহান রূপকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় ‘তৃষ্ণা ও বিষাদ’ শিরোনামের এক গদ্যে শাস্ত্রপাঠ বিষয়ে একটি মূল্যবান কথা বলেছেন—”জ্ঞানলাভের জন্য শাস্ত্র। জ্ঞান হয়ে গেলে শাস্ত্র মরে যায়।”
জীবনানন্দ দাশের মরণোত্তর প্রকাশনা ‘কবিতার কথা’র গদ্যগুলো উপর্যুক্ত বিকল্প পাঠের ঋদ্ধ ভাঁড়ার (যদিও অধ্যাপক-প্রাবন্ধিকদের অনেকে ওই বইয়ের গদ্যগুলিকে এ মান্যতা দিতে নারাজ)।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে দরিদ্র শাখাটির নাম—সমালোচনা। তা যদি কবিতার হয়, নব্বই শতাংশই অপাঠ্য। এ দুর্দশা দূর করতে নিকট অতীতে একাই একশর দায়িত্ব পালন করেছেন শঙ্খ ঘোষ। তার ‘নিঃশব্দের তর্জনী, ‘শব্দ আর সত্য’, কবিতার মুহূর্ত’, ‘কবির বর্ম’, ‘ছন্দময় জীবন, ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’, ‘কবিতা পড়া কবিতা লেখা’ নামের বইগুলো বাংলা সাহিত্যের কোষাগারে হীরকতুল্য সংযোজন। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘পদ্যপাগলের পাণ্ডুলিপি’ ও ‘কবিতার ঘর ও বাহির’ এবং সুজিত সরকারের ‘কবিতা কেন কবিতা’ ও বিশ্বকবিতার সহজপাঠ’ বই চারটি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
‘শব্দকল্পদ্রুম’ নামে ‘ars poetica’ ঘরানার একটি কবিতাপ্রতিম কবিতাভাবনা আছে আমার। সেটাই এ অনুচ্ছেদের উপসংহার—
“আবেগ নিষিদ্ধ হলে
কবিতা হয় না
আবেগের মুষলবর্ষণে
আরও হয় না
আবেগের চুন-সুরকিতে
প্রজ্ঞার প্রকৌশলকৃত
বোধের স্থাপনা
কবিতা
শব্দজনপদে
কবি এক
মহান স্থপতি”
অনুচ্ছেদ-২ : পাঠবিমুখতা, পাঠতৃষ্ণা ও পাঠান্মোচনের বহুরৈখিতা
বাংলা একাডেমির মুখপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এর ডিসেম্বর ২০২১ সংখ্যায় বাংলা ছোটোগল্পের প্রবাদপুরুষ হাসান আজিজুল হকের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। তখন থেকে দশ বছর আগে নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ভাষাচিত্রী স্বকৃত্য নোমান আন্তর্জালকবলিত তরুণদের পাঠবিমুখতা এবং সাহিত্যের কেন্দ্র-প্রান্তিক বিভাজন বিষয়ে দুটি প্রশ্ন করলে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন—
এক.
“শত শত খারাপ দিক সত্ত্বেও প্রযুক্তির সুবিধাও তো আছে। […] ইন্টারনেট খুললে তুমি যা জান, নবাবগঞ্জের লোক তা-ই জানে। […] প্রযুক্তি সবাইকে সমান করে দিচ্ছে।”
দুই.
“ঢাকা-মফস্বলের এই বিভাজন এক ধরনের ক্রীতদাসুলভ মনোভাব। ঔপনিবেশিক কুপ্রভাব। গভীরতর অর্থে এগুলোই গ্রাম্যতা।”
সেইসময় টুইটার, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, বিশেষ করে ফেসবুক, ‘ভার্চুয়াল’ নামে পরিচিত ছিল। করোনাকালীন গৃহবন্দিকালে আন্তর্জালের ব্যবহার ও ব্যবহারকারীর ব্যাপক সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। আন্তর্জালভিত্তিক নিউজ পোর্টালগুলোর গ্রহণযোগ্যতাবৃদ্ধিও এই কালখণ্ডের ঘটনা। আন্তর্জালের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্যেও ছোটোকাগজধর্মী প্রতিমঞ্চরচনার প্রচেষ্টা বিস্তৃত হয়েছে এই সময়। হাসান আজিজুল হক এটা এক যুগ আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এই এক যুগে ঢাকায় কী রাজশাহীতে তার সঙ্গে যে-কবার দেখা হয়েছে, প্রায় প্রতিবারই আন্তর্জালে আসা কোনও না কোনও প্রসঙ্গ উঠেছে এবং তার কৌতূহলপ্রশমনে আমার টাচফোনের মনিটর বইয়ের ভারপ্রাপ্ত পৃষ্ঠা হিসেবে খণ্ডকালীন নিয়োগ পেয়েছে। তার মানে এই যে—শুধু প্রকৃত কবিই নন, জাতভাষাচিত্রীও একজন দ্রষ্টা। তার মানে এ-ও যে—পূর্বসাধককে দিয়ে বিস্তর মহার্ঘ কথা বলিয়ে নিতে পেরেছেন বলে শুধু উত্তরদাতার নয়, কিছু কৃতিত্ব প্রশ্নকর্তারও।
তৃতীয় পর্বের আলোচনায় কবি-প্রাবন্ধিক কার্তিক নাথের ‘ভালো কবিতার জন্য পাঠের পিপাস থাকা চাই; কবিরও, পাঠকেরও’ ভাষ্যটির সঙ্গে স্বকৃত নোমান উত্থাপিত আন্তর্জাল যুগের তরুণদের পাঠবিমুখতার ঘনিষ্ঠতা আছে। আত্মীয়তা আছে ‘জাতিসত্তার কবিখ্যাত মুহম্মদ নূরুল হুদার ‘বুদ্ধদেব বসুর কাব্যানুবাদ প্রসঙ্গে’ শিরোনামের প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত নিচের বাক্যটির সঙ্গেও—”একটি সর্বাঙ্গসুন্দর ও সর্বগ্রাসী কবিতা পাঠ করার পর পাঠক বা পাঠিকা যে-নান্দনিক ঘোরের মধ্যে বন্দি হয়ে যায়, যেমনটি আমার হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ পাঠ করার পর, ঠিক তেমনটি ঘটল শার্ল বোদলেয়ার : তার কবিতা পড়ে।”
অল্পই অধিক। সাংখ্য দর্শনানুসারে জগৎসৃষ্টির কারণ– স্বতঃ, রজঃ ও তমঃ এই তিনের নিত্যসসম্বন্ধ। এরা সুখাত্মক, দুঃখাত্মক ও মোহাত্মক শক্তি। জগতের তাবৎ ক্রিয়া এই তিন শক্তির নিত্যসম্বন্ধে সংঘটিত হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতা সময়, সংবেদ ও নিসর্গ এই তিন শক্তির শাব্দিক সংঘটন। প্রসঙ্গটি আমার সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কবিতাসমগ্র’ বইয়ের আঁতুড়কথনে বিশদে এসেছে। মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত বাক্যের ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’, ‘সর্বগ্রাসী’ ও ‘নান্দনিক ঘোর’ শব্দবন্ধ তিনটি একইরকম শাব্দিক সংঘটনের নিত্যসম্বন্ধীয় দৃষ্টান্ত। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে বা আমাদের কলেজজীবনে সহপাঠীদের কেউ কেউ লুকিয়ে আদিরসাত্মক চটিবই পড়ত। ওদেরও সর্বগ্রাসী পাঠতৃষ্ণা এবং সেই তৃষ্ণাসঞ্জাত রোমাঞ্চকর ঘোর ছিল। সেই পাঠতৃষ্ণা জীবনানন্দের বা বোদলেয়ারের কবিতা মিটত না। ওদের পাঠতৃষ্ণার সঙ্গে মুহম্মদ নূরুল হুদাকথিত পাঠতৃষ্ণার পার্থক্য নির্দেশ করছে ‘সর্বাঙ্গসুন্দর’ শব্দবন্ধটি এবং ‘ঘোর’ শব্দের আগে ‘নান্দনিক’ বিশেষণের প্রয়োগ।
এবার বুদ্ধদেব বসু বিষয়ে তিন প্রাজ্ঞ—পুষ্কর দাশগুপ্ত, মুহম্মদ নূরুল হুদা ও আজফার হোসেনের প্রবন্ধ থেকে তিনরকম তিনটি পাঠোন্মোচন:
এক. পুষ্কর দাশগুপ্তের প্রবন্ধ থেকে:
“… বুদ্ধদেববাবুর অনুবাদে বোদলের রোমান্টিক কবিতে পরিণত। […] সতেরো বছরের ব়্যাঁবো তাঁর বিখ্যাত দ্রষ্টার চিঠিতে লিখেছিলেন—’বোদলেয়ার হলেন প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, সত্যিকারের এক ঈশ্বর । তা সত্ত্বেও তিনি অতি-শিল্পিত একটা পরিমণ্ডলে জীবন কাটিয়েছেন, আর তাঁর বহু প্রশংসিত প্রকাশ প্রকরণ খুবই সাধারণ—অজানার উদ্ভাবন নতুন প্রকাশ প্রকরণের দাবি করে। রোমান্টিক বুদ্ধদেব প্রথম ফাঁপা রোমান্টিক বাক্যটিই নিয়েছেন, পরের গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাটি বাদ দিয়েছেন।”
দুই. মুহম্মদ নূরল হুদার প্রবন্ধ থেকে:
“…তাহলে কি ‘অচেনা মানুষ’ বুদ্ধদেবের মৌলিক সৃষ্টি? আমার স্পষ্ট মীমাংসা : হ্যাঁ, তা-ই। […] ভিন্ন ভাষার কবিতাটির উপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করার পর কবিতাটিকে তিনি নিজের মতো নিজের উপলব্ধিতে, ও পরে তার ভাষিক অভিব্যক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। ফলে এটি একটি নবসৃষ্টি, কেবল প্রথাগত অনুবাদ নয়।…আর অনুবাদক বুদ্ধদেবও এক মৌলিক স্রষ্টা।”
তিন. আজফার হোসেনের প্রবন্ধ থেকে:
“কবিতায় বুদ্ধদেব বসু যে-লিরিক ব্যক্তিকে হাজির করেন এবং চালু রাখেন, সেই লিরিক-ব্যক্তি নজরুলের যেমন অচেনা, রবীন্দ্রনাথেরও তেমনি। এই ব্যক্তির বিশেষ ব্যক্তিকতার জম্ম আসলে নগরায়িত ইউরোপের ঔরসে।…এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি, যিনি ভূমি থেকে উৎপাটিত করার উপনেশবাদী প্রক্রিয়াকে প্রশ্নহীনভাবে উদযাপন করেন। […] এই ব্যক্তির দেহ ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, এই ব্যক্তির ভাষাও ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।”
অনুচ্ছেদ-৩ : কবিতার নতুনত্ব এবং অনূর্ধ্ব ত্রিশের আখ্যান
সৌমিত বসুর ‘ভাঙামন পথঘাট তুতানখামেন’ কবিতাগ্রন্থের আলোচনায় চমস্কিকথিত ‘বর্ণহীন সবুজ ধারণাবলি’র মতো আপাত অপ্রাসঙ্গিক দুটি যুগপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এই সময়ের প্রতিভাবান কবি কুশল ভৌমিক—
“একজন কবি তার কবিতার জন্য কল্পচিত্র বা শব্দগুচ্ছ কোথা থেকে বয়ে আনবেন? অদৃশ্য দেবলোক থেকে?”—অনতিপরে কুশল নিজেই প্রশ্ন দুটির উত্তরে বলেছেন—”কখনোই না।” আমার ধারণা—এই প্রশ্নোত্তর কবি-গদ্যকার উমাপদ করের ‘চিত্রকল্প নয়, কল্পচিত্র দীর্ঘজীবী হোক’ শিরোনামের একটি গদ্যের বা সমধর্মী বলাবলি-লেখালিখির পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্ত আবির্ভূত। দু-চার বাক্যে তার ব্যাখ্যা থাকলে ভালো হত। ‘কল্পচিত্র’ বিষয়ে উমাপদ কর বা তার সমচিন্তকরা যা বলতে চাইছেন, তার সারকথা—চিত্রকল্পের কল্পনা পার্থিব চিত্রের কাঁধে ভর করে হাঁটে; কল্পচিত্রের সবটাই কবির কল্পনা। চিত্রকল্পের বহুলব্যবহারে বাংলা কবিতার মৃতপ্রায় চলমান সমকালে মৃতসঞ্জীবনীপ্রতিম নতুনত্ব—কল্পচিত্র।
কুশল ভৌমিকের ‘কখনোই না’—সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করলেও কল্পচিত্রে বাংলা কবিতার মুক্তি-প্রত্যাশীদের সাধুবাদ জানাই। কারণ লেগে থাকলে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের দুর্ঘটনাবশত পেনিসিলিন আবিষ্কারের মতো তারা কোনও গ্রহণাযোগ্য নতুনত্বের দেখা পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। তবে এ সম্পর্কিত চিরবর্তমান কথা এই যে—বলাবলি দলাদলিতে নয়, নতুনত্বের প্রমাণ কবিতায় দিতে হয়।
উপর্যুক্ত প্রমাণ শফিউল শাহীনের ‘স্তন্যপায়ী গোলাপ’ বইয়ের কবিতাগুলো। না, শফিউল কাব্যান্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের কেউ নন। ‘স্তন্যপায়ী গোলাপ’ তার তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ। বইটির শেষ কবিতা ‘জঙ্গলে হাসপাতাল’ থেকে শুরু ও শেষের দুটি করে পঙ্ক্তি উদ্ধার করছি—
“একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্য জরুরি রক্তের প্রয়োজন।
রক্তের গ্রুপ—চে— লেনিন—মাও সেতুং
…
একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্য জরুরি রক্তের প্রয়োজন।
রক্তের গ্রুপ—রবীন্দ্র—নজরুল—জীবনানন্দ—লালন”
এককে বা জোট বেঁধে তরুণ কবিদের একাংশ যুগে যুগে কবিতায় নতুন কিছু দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। পাশ্চাত্যের শিল্পকাব্যে সর্বাধিক কাব্যান্দোলনের কালখণ্ড—বিংশ শতাব্দী। বাংলা কবিতায়ও এর একাধিক দৃষ্টান্ত আছে। যদিও সেগুলোর প্রায় সবগুলোই নামে-নামান্তরে পাশ্চাত্যের কাব্যান্দোলনগুলোর ঢেউ। এ অভিযোগ থেকে শতভাগ মুক্ত না হলেও পুষ্কর দাশগুপ্তের নেতৃত্বে শ্রুতির কবিদের লিখন-পঠনভিত্তিক কবিতাচর্চাটি একাধিক কারণে প্রশংসার দাবি রাখে। শ্রুতির কবিরা যে-বিষয়গুলোকে মান্যতা দিতেন, সেগুলোর একটি—
”কবিকে পথনির্দেশ দেয় পূর্বজ কবিদের কাব্যকৃতি। বর্তমানকালের কবিতায় আন্দোলন ও চরিত্র পৃথিবীর কাব্য ঐতিহ্যের মূলধারার সঙ্গে যুক্ত।” অর্থাৎ, নতুনত্বের উত্তেজনায় অতীতের সব অর্জনকে হরেদরে অস্বীকার করেননি শ্রুতির কবিরা। এখানেই বাকিদের থেকে তারা আলাদা।
নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত অধুনালুপ্ত ‘সচিত্র সময়’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রবাদপ্রতিম সাহিত্য-সম্পাদক কবি আহসান হাবীব সমার্থক একটি কথা বলেছিলেন আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে—”সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঐতিহ্যের নবায়নই আধুনিকতা।” পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার আকর্ষণ ছিল হাসান আজিজুল হকের ছোটোগল্প এবং দ্বিতীয় সংখ্যাটিকে ঋদ্ধ করেছিল আহসান হাবীবের ওই সাক্ষাৎকার। নাঈমুল ইসলাম খান ছাড়াও সৈয়দ আল ফারুক, ইসমাইল হোসেন, আলম খোরশেদ, আমীরুল ইসলামসহ আমরা যারা পত্রিকাটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম, আমীরুল ছাড়া বাকি সবাই এখন মেঘে মেঘে বালাই ষাট অতিক্রান্ত। একবছর পর আমীরুলও আমাদের দলে ভিড়বেন। স্বপ্নেমোড়া অনেক মধুর স্মৃতি আছে স্বল্পায়ু ওই পত্রিকা সংশ্লিষ্ট। দুটির কথা বলি।
একদিন হাসান আজিজুল হক আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছিলেন ‘সময়’-এর গ্রিন রোড কার্যালয়ে। দীর্ঘ সেই আড্ডা বিকেলে শুরু হয়ে অস্ত গিয়েছিল সূর্যাস্তের দুই-আড়াই ঘণ্টা পর। মনোযোগ দিয়ে তরুণদের কথা শুনেছিলেন তিনি। নিজেও সমকাল-চিরকাল, জীবন-মহাজীবন নিয়ে কিছু মহার্ঘ কথা বলেছিলেন।
অন্য স্মৃতিটি যুগপৎ ‘সচিত্র সময়’ এবং আহসান হাবীবের সম্পাদনা-সংশ্লিষ্ট। তিনি মনিরা কায়েসের একটি ছোটোগল্প তার সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকীতে ছাপাতে পারেননি। ‘ইঁদুর’ নামের সেই গল্প ‘সচিত্র সময়’-এ ছাপা হলে আহসান হাবীব পাঠপ্রতিক্রিয়ায় যা বলেছিলেন, তা অনেকটা এরকম—”গল্পটা তোমাদের আগে আমাকে দিয়েছিল মনিরা। ছাপাতে পারিনি। না-পারার কারণ গল্পকারের ব্যর্থতা নয়, সম্পাদকের সীমাবদ্ধতা। ‘দৈনিক বাংলা’ সরকারি পত্রিকা হওয়ায় আমি যা পারিনি, নাঈম সেটা পেরেছে। লেখক-সম্পাদক দুজনকেই অভিনন্দন।”
নাঈম-মনিরা দুজনের জন্যই ঢেঁকিছাঁটা প্রাপ্তি। বছর দুয়েকের মধ্যে ‘ইঁদুর’ গল্পের লেখকের আরও বড়ো একটি প্রাপ্তিযোগ ঘটেছিল কবি শঙ্খ ঘোষের প্রিয় মাস্টার মশাই ড. ক্ষুদিরাম দাসের কাছ থেকে—১৯৮৪ সালে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রকল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার’ বইটি তিনি মনিরা কায়েসকে উৎসর্গ করেছিলেন। এ কারণে মনিরা-আমি যে-কবার একসঙ্গে শঙ্খ ঘোষের ঈশ্বরনিবাসে গেছি, আমার মিতভাষী দীক্ষাগুরু যেটুকু বলাবলি করেছেন, তার সিংহভাগই মনিরার সঙ্গে।
পুষ্কর দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ‘শ্রুতি’র কবিরা নতুনত্বের খোঁজে যাত্রা শুরু করেছিলেন অনূর্ধ্ব ত্রিশে। অন্য এক সমকালে নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ‘সচিত্র সময়’-এর সঙ্গে যুক্ত আমরাও। ড. ক্ষুদিরাম দাসের উৎসর্গে মনিরা কায়েসের প্রাপ্তিযোগও অনূর্ধ্ব ত্রিশের আখ্যান৷ উল্লেখ্য, চিত্রকল্পবাদ আন্দোলন শুরু করার সময় (১৯১৪) এজরা পাউন্ড অনূর্ধ্ব ত্রিশ ছিলেন। রোমান্টিক কবিতা-আন্দোলনের সূচনাকালে (১৭৯৮) ওই আন্দোলনের দুই পুরোধা ওয়ার্ডসওয়ার্থ-কোলরিজও অনূর্ধ্ব ত্রিশ। নোয়াম চমস্কিও অনূর্ধ্ব ত্রিশ ছিলেন রূপান্তরমূলক উৎপাদনশীল ব্যাকরণের জননীগ্রন্থ ‘Syntactic Structures’-এর আত্মপ্রকাশকালে। ‘বাংলা কবিতায় গদ্যস্পন্দ প্রবর্তনে যার ভূমিকা সর্বাধিক, সেই সমর সেনের তাবৎ কবিতা ১৯৩৪-১৯৪৬ কালখণ্ডে লেখা, যখন তার বয়স আঠারো থেকে ত্রিশ বছর। ‘কবিতা’র আত্মপ্রকাশকালে বুদ্ধদেব বসুও ছিলেন অনূর্ধ্ব ত্রিশ। একটি শিহরণ-জাগানিয়া অভিজ্ঞতার কথা না বললে অসমাপ্ত থেকে যাবে অনূর্ধ্ব ত্রিশের এই আখ্যান। অভিজ্ঞতাটি অমর মিত্রের, অনূর্ধ্ব ত্রিশে লেখা ‘গাঁওবুড়ো’ নামের (অনীশ গুপ্ত অনূদিত নাম ‘The oldman of kusumpur’) ছোটোগল্পটির জন্য যিনি ২০২২ সালে ‘ও হেনরী পুরস্কার’ পেয়েছেন। ১৯৯৮ সালে ‘সান্ধ্যভাষা’ পত্রিকার শ্যামলগঙ্গোপাধ্যায় সম্মান সংখ্যা :১-এ প্রকাশিত তার ‘শ্যামলবাবুর বিষয় আশয়’ শীর্ষক গদ্য থেকে অংশবিশেষপাঠে সেই শিহরণ-জাগানিয়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক—
“শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে তার ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসটি দিয়েছিলেন আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এক হেমন্তের সন্ধ্যায়। বইটি দিতে তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে খোঁজ করেছিলেন, আমি সেখানে আছি কি না। সূত্র ছিল আমার একটি গল্প “গাঁওবুড়ো”, ‘অমৃত’ পত্রিকার পুজো সংখ্যার জন্য বিজ্ঞাপিত হয়েও কোনো কারণে না ছাপা হয়ে পরে একটি সাধারণ সংখ্যায় ছাপা হয়। […]আমাকে যে-পুরস্কার দিয়েছিলেন তিনি, তা আমি আর কখনো পাব না। […] ওই বয়সে এমনভাবে প্ররোচিত হলে কে দূর গোপীবল্লভপুরে সুবর্ণরেখার তীরে বসে হেরিকেনের আলোয় পাতার পর পাতা লিখে যাবে না?”
অনুচ্ছেদ-৪: বাংলা একাডেমি ও কাঠিলজেন্স
সবাই ড. ক্ষুদিরাম দাস অথবা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় হলে এই অনুচ্ছেদের দরকার হতো না। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার চালু হওয়ার ৬০ বছরপূর্তিতে (সাল—২০১৯) ওই সময়ের মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন,
“বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লেখকদের বয়সের ক্রমকে কোনো মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে না, বরং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাহিত্যকর্মের জন্য এ পুরস্কার যে কোনো বয়সেই একজন লেখক অর্জন করতে পারেন।…কোনো লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যার বিপুলতা এ পুরস্কারকে প্রভাবিত করে না। রচনাকর্মের স্বাতন্ত্র্য এবং অভিনবত্বের কারণে কম বয়সের কোনো লেখকও অনায়াসে এ পুরস্কার পেতে পারেন।”
এঁদোবুদ্ধিপ্রসূত ডাহা ছেঁদোভাষ। কেন ছেঁদোভাষ, তা-ও ডাহা, এ প্রশ্নের উত্তরে ২০১৬ সালের বা পুরস্কারটি পাওয়ার আগে হলে যা বলতাম, এখনও তা-ই বলছি—শুরুর প্রত্যয় শুরুতেই হারিয়েছে বলে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার আর শিশুর হাতের কাঠি-লজেন্সের মধ্যে অর্থমূল্য ছাড়া কোনও পার্থক্য নেই। হাবিবুল্লাহ সিরাজী প্রাতিষ্ঠানিক ভাষ্যকারমাত্র। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে “রচনাকর্মের স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্বের কারণে কম বয়সের কোনও লেখকও অনায়াসে এ পুরস্কার পেতে পারেন।”-এর সমার্থক কিছুই বলতেন। সাহিত্যচর্চা আমৃত্যু সাধনার বিষয়। তার মানদণ্ড যদি অনায়াসলব্ধ হয়, তাহলে ওই পুরস্কার দেওয়া-নেওয়া দুই-ই প্রমাদ। প্রেসভাষ্য থেকে উদ্ধৃত কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে আমপাঠকের মনেও যে-প্রশ্ন উঁকি দেবে—’স্বাতন্ত্র্য’ ও ‘অভিনবত্ব’ থাকলে যদি ‘অনায়াসে’ই পুরস্কারটি পাওয়া যায়, তবে তসলিমা নাসরিন কেন তা পাননি? শিল্পমানে খামতি থাকলেও একটি পশ্চাৎপদ জনপদে দীর্ঘচর্চিত লিঙ্গবৈষম্যগত অবিচার এবং ধর্মসঞ্জাত কুসংস্কারের গালে দুটি সজোরে চপেটাঘাত তসলিমার ‘লজ্জা’ ও ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামের বই দুটি।লেখকের দায়বদ্ধতার বিরল নিদর্শনও। ‘ধর্মীয় স্পর্শকাতর’ কোটায় বঞ্চনার শিকার ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাগ্রন্থের জনক দাউদ হায়দারও। ‘কাঠি লজেন্স’টি না-পেয়েই লোকান্তরিত হয়েছেন ‘আমি খুব একটা লাল গাড়িকে’ নামের মহার্ঘ কবিতাগ্রন্থের জনক আবু কায়সার।
উপেক্ষার দৈর্ঘ্য দু বছর প্রলম্বিত হলে শামসুর রাহমানের প্রিয় শিক্ষক ড. খান সারওয়ার মুরশিদকেও পুরস্কারটি দেওয়ার জন্য জীবদ্দশায় পাওয়া যেতো না (পুরস্কারসাল—২০১০; প্রয়াণসাল—২০১২)।
৬০ পূর্তির বছর (সাল—২০১৯) পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে যোগ্যতায় শীর্ষস্থানীয়দের একজন সাইমন জাকারিয়া। প্রেসভাষ্যে একাধিকবার বয়স প্রসঙ্গটি না এলে ফোকলরে পুরস্কারপ্রাপ্ত সাইমন যে সবচেয়ে কমবয়সি (সম্ভবত), তা মাথায়ই আসত না। ওর বয়স তখন ৫০ ছুঁই-ছুঁই। তো? সৈয়দ শামসুল হক ৩১ বছর বয়সে এবং সেলিনা হোসেন ৩৩ বছর বয়সে পুরস্কারটি পেয়েছেন।
আর, ২০২২ সালে সাহিত্যের কোনও শাখায় পুরস্কৃত করার মতো কোনও ‘নারী কবি-লেখক’কে খুঁজে পায়নি বাংলা একাডেমি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দু-চারদিন বলাবলি হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি পদে সে-বছরই প্রথম কোনও নারী অভিষিক্ত হন— ভাষাচিত্রী সেলিনা হোসেন। তিনিও গুণী ও সজ্জন। কোনও নির্বাহী দায়িত্ব নেই বলে তালিকার নারীশূন্যতায় তার প্রত্যক্ষ দায় নেই কোনও। তারপরও নৈতিকতার দায় থেকেই যায় আড়ালে। শব্দের নৈঃশব্দ্যে সেই দায়সঞ্জাত একটি জিজ্ঞাসাও থাকে—পুরস্কারপ্রাপ্তদের নামঘোষণার পূর্বাপরে বাংলা একাডেমির প্রথম নারী-সভাপতি কি এ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তুলেছিলেন নাকি সম্মতির লক্ষণযুক্ত নীরবতাকে শ্রেয় ও নিরাপদ মনে করেছিলেন? তখন যিনি মহাপরিচালকের দায়িত্বে—কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা—তিনিও একজন ভালো মানুষ ও প্রাজ্ঞজন; তার সাংগঠনিক দক্ষতাও প্রশংসনীয়; কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে—প্রান্তিকে কিঞ্চিৎ বিস্তৃত হওয়া ছাড়া কাঠিলজেন্সকেন্দ্রিক মাৎস্যন্যায় প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত সেই প্রজ্ঞার কী সাংগঠনিক দক্ষতার কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন লক্ষ করিনি। উলটো তালিকার নারীশূন্যতায় কাঠিলজেন্স আরও এককাঠি সরেস হয়েছে।
ঢাকা-মফস্বল বিভাজনকে হাসান আজিজুল হক ‘গ্রাম্যতা’ বলেছেন। তার চেয়েও বেশি গ্রাম্যতা শিল্প-সাহিত্যের মূল্যায়নে লিঙ্গবিভাজন। মানছি, সামাজিক মাধ্যমে বলাবলির দায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের নয়; কারণ জানতে চেয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ এ সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন করেননি; স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মহাপরিচালক নিজেও তার ব্যাখ্যা দিতে যাননি। সব দেখেশুনে সম্পর্কনির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক দার্ঢ্যে না-বলে পারছি না—বাংলা একাডেমি ফিবছর সাহিত্যের কোনও না কোনও শাখায় এমন এক বা একাধিক অপ্রস্তুতবীরপুঙ্গবকে পুরস্কারটি দিয়ে থাকে, যোগ্যতায় যারা মনিরা কায়েস ও আকিমুন রহমানের পদনখকণামাত্র নন। পাঠ ও সম্পাদনাসূত্রে এ-ও মনে করি—এখনও বেঁচে আছেন, বাংলা সাহিত্যের এমন দশজন ছোটোগল্পকারের একজন মনিরা কায়েস এবং সেরা দশ ঔপন্যাসিক কী গবেষকের একজন আকিমুন রহমান। হ্যাঁ, দুজনেই আমার স্বজন—একজন ঘরের স্বজন, আরেকজন অন্যঘরের। তো? আবু কায়সার, দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরিনও একইরকম স্বজন, যাদের কথা এ দুজনের আগেই বলেছি। এমন স্বজনকথা পরেও আছ। তার আগে মনিরা কায়েস ও আকিমুন রহমানের সাহিত্যকর্মের সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন পাঠকের জন্য পরভাষ্যে দুটি উদ্ধার।
মনিরা কায়েসের সর্বশেষ ছোটোগল্পগ্রন্থ নিয়ে কবি-প্রাবন্ধিক কুমার দীপ তার কথাশিল্পের আঙিনায়’ বইয়ে গ্রন্থিত ‘মনিরা কায়েসের অন্ধ কুলঙ্গির টীকাভাষ্য : অন্তর্গূঢ় জীবনের প্রতিচ্ছবি’ শিরোনামের গদ্যে বলেছেন—
“[…] সত্যম, জ্ঞানম, অনন্তম, অর্থাৎ—আমি আছি, আমি জানি এবং আমি প্রকাশ করি। উপনিষদ অনুসারে ব্রহ্মস্বরূপের এই যে তিনটি ভাগ, এর মধ্যে ‘আমি প্রকাশ করি’ গুণটি একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। […] প্রকাশের এই ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করেই একজন শিল্পী বা সাহিত্যিক তার শিল্প বা সাহিত্যকে অপরের নিকট উপস্থাপন করেন। তাঁর পছন্দ, প্রবণতা ও দক্ষতা অনুযায়ী উপস্থাপনের পদ্ধতি ও প্রকরণে […] অন্যের থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠেন, সম্ভ্রমনীয় হয়ে ওঠেন। এটাই তার স্বাতন্ত্র্য, এটাই তার পরিচয়। বর্তমান বাংলা ছোটগল্পচর্চায় মনিরা কায়েস একটি স্বতন্ত্র ও সম্ভ্রমযোগ্য নাম। […] মনিরা কায়েস তাঁর এক-একটি ছোটোগল্পের ভেতরেই ঢুকিয়ে দেন অনেক গল্প-অণুগল্প এবং প্রাসঙ্গিক বিবিধ অনুষঙ্গমালা। এটাই জীবনসত্যের প্রকৃত ব্যঞ্জনা। […] ‘অন্ধ কুলঙ্গির টীকাভাষ্য’-তে এই ব্যঞ্জনাই রচনা করেছেন তিনি। হাটের কোলাহল উজিয়ে নিজস্ব মৃত্তিকায় বুঁদ থেকে তুলে ধরেছেন অন্তর্গূঢ় জীবনের অন্তর্ভেদী প্রতিচ্ছবি।”
আকিমুন রহমানের সর্বশেষ উপন্যাসগ্রন্থ ‘নিত্য বহে যে নদী’র পাঠপ্রতিক্রিয়ায় দীক্ষিত পাঠক রফিকুল ইসলামের গুণবিচারী মূল্যায়ণ—
“এ একান্তই বাঙলার দুকূলপ্লাবী নিরন্তর বহমান জলধারা—উপলখণ্ডের বাধায় এর গতি দ্বিধাগ্রস্ত নয়, কিংবা শীর্ণধারায় শুধু অস্তিত্বই বয়ে চলা নয়। দিগন্তপ্লাবী অমেয় জলের স্নিগ্ধধারায় বহে এ নদী। অন্তহীন দরদে বুকে বয়ে বেড়ায় উর্বরা মানবিক পলি; ইতিহাসের ঐতিহ্যের মানুষের সমাজের স্বপ্নের অশেষ ফসলের প্রাণশক্তি এই পলি।সাহিত্যের শৈল্পিক বিকাশ এই পলি। […] বহুদিন এমন নতুনের দেখা পাইনি কী ভাষায় কী গভীরতায়! রাশিরাশি নর্দমা আর খালের এই সাহিত্য-জগতে, আকিমুন রহমান একবুক বহমান মেঘনা।”
আজ থেকে (সাল-২০২৩) দুই যুগ আগেই বা গত শতাব্দীতেই প্রাগুক্ত ‘বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সাহিত্যকর্ম’ সুবাদে যারা ‘স্বাতন্ত্র্য’ ও ‘অভিনবত্ব’ দেখিয়েছেন, (কেউ-কেউ এখনও দেখাচ্ছেন), তাদের ‘কমবয়সে’র সাফল্যকালে উদ্ধৃত প্রেসভাষ্যের মানদণ্ডটি কোথায় ছিল? হেলাল হাফিজ কাঠিলজেন্স পেয়েছেন ২০১৩ সালে, যখন তিনি ষাটোর্ধ্ব এবং কবিতা থেকে স্বেছানির্বাসিত। অনূর্ধ্ব ত্রিশে লেখা “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” পঙ্ক্তি দুটির জন্য যখন তার কবিতা স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্বের শীর্ষে, তখন ওই মানদণ্ড মিছিলে না যুদ্ধে নাকি স্যালাইনের প্যাকেট হাতে শৌচাগারে ছিল?
—এঁদোবুদ্ধিজাত ছেঁদোভাষের শ্রেষ্ঠ নমুনা ৬০ পূর্তির ওই প্রেস-ব্রিফিং। আগেই বলেছি; আবারও বলছি—এর দায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর নয়; তখন তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ভাষ্যকারমাত্র। ভাষাচিত্রী সেলিনা হোসেন ও কবি মুহম্মদ নূরল হুদার নীরবতার দায়ও তাদের ব্যক্তিগত নয়। তিনজনের সঙ্গেই আমার অনেক মধুর স্মৃতি আছে। আমার প্রথম লেখকসম্মানীপ্রাপ্তি ‘ধানশালিকের দেশ’ পত্রিকায় ছড়া লিখে। সেলিনা হোসেন তখন পত্রিকাটির সম্পাদক। প্রথম টুঙ্গিপাড়া দর্শন মুহম্মদ নূরুল হুদার অভিভাবত্বে। হাবীবুল্লাহ সিরাজী, সেলিনা হোসেন ও মুহম্মদ নূরুল হুদা—তিনজনের সঙ্গেই বৃক্ষরোপণের স্মৃতি আছে সংস্কৃতি-শিক্ষানুরাগী সজ্জনপ্রতিনিধি র. আ. ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও শিক্ষাবিদ ফাহিমা খাতুনের পৈতৃক জনপদ ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার চিনাইর শিক্ষাগ্রামে।
ধর্মান্ধদের কারণে দাউদ হায়দার স্বদেশত্যাগে বাধ্য হন ১৯৭৪ সালে। তখন থেকে শুরু করে বিশ শতাব্দীর শেষ এক চতুর্থাংশ কালখণ্ডে (১৯৭৪-২০০০) যারা ‘স্বাতন্ত্র্য’ ও ‘অভিনবত্ব’ দেখানো সত্ত্বেও বায়ান্নোর ভাষাশহিদদের স্মৃতি-স্বপ্ন বিজড়িত বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কারবঞ্চিত, তাদের একটি দালিলিক তালিকা—
(১) দাউদ হায়দার, (কবিতা)
(২) ময়ুখ চৌধুরী, (কবিতা)
(৩) আবুল কাইয়ুম, (প্রবন্ধ-গবেষণা/ অনুবাদ/সামগ্রিক)
(৪)জাফর তালুকদার, (কথাসাহিত্য)
(৫) জাহিদ হায়দার, (কবিতা)
(৬) ফারুক নওয়াজ, (শিশুসাহিত্য)
(৭) মঈনুদ্দিন খালেদ, (প্রবন্ধ/শিল্প-সমালোচনা)
(৮) ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, (প্রবন্ধ/গবেষণা)
(৯) মনিরা কায়েস, (কথাসাহিত্য)
(১০) আকিমুন রহমান, (কথাসাহিত্য/প্রবন্ধ/গবেষণা)
(১১) সৈয়দ ইকবাল, (কথাসাহিত্য)
(১২) আতা সরকার, (কথাসাহিত্য)
(১৩) শেখর ইমতিয়াজ, (কথাসাহিত্য)
(১৪) হাফিজ রশীদ খান, (কবিতা)
(১৫) রিফাত নিগার শাপলা, (শিশুসাহিত্য)
(১৬) আতাউল করিম, (শিশু সাহিত্য/সামগ্রিক)
(১৭) তসলিমা নাসরিন, (সামগ্রিক)
(১৮) প্রবীর বিকাশ সরকার, (প্রবন্ধ-গবেষণা/শিশুসাহিত্য/সামগ্রিক)
(১৯) সৈয়দ আল ফারুক, (কবিতা/শিশুসাহিত্য)
(২০) ইসমাইল হোসেন, (কথাসাহিত্য)
(২১) সৈয়দ কামরুল হাসান, (কথাসাহিত্য)
(২২) ফরিদ কবির, (কবিতা)
(২৩) জয়দুল হোসেন, (সামগ্রিক)
(২৪) সিরাজুল ইসলাম মুনীর, (কথাসাহিত্য)
(২৫) নুরুন্নাহার শিরীন, (কবিতা)
(২৬) ওমর কায়সার, (কবিতা)
(২৭) উত্তম সেন, (শিশুসাহিত্য)
(২৮) অঞ্জনা সাহা, (কবিতা)
(২৯) শরিফ নাফে আস সাবের, (শিশুসাহিত্য)
(৩০) ফারুক হোসেন, (শিশুসাহিত্য)
(৩১) খালেদ হোসাইন, (কবিতা)
(৩২) আনিস রহমান, (কথাসাহিত্য)
(৩৩) সাজ্জাদ শরিফ, (কবিতা)
(৩৪) সেলিম মোরশেদ, (ছোটোগল্প)
(৩৫) শহীদ ইকবাল, (প্রবন্ধ-গবেষণা)
(৩৬) আজফার হোসেন, (অনুবাদ, প্রবন্ধ-গবেষণা)
(৩৭) আহমাদ মাযহার, (প্রবন্ধ-গবেষণা)
(৩৮) রাজু আলাউদ্দিন, (অনুবাদ)
(৩৯) জুয়েল মাজহার, (কবিতা)
(৪০) সেলিনা শেলী, (কবিতা/প্রবন্ধ-গবেষণা)
(৪১) মহিবুল আজিজ, (কথা সাহিত্য)
(৪২) মোসাদ্দেক আহমেদ, (কথাসাহিত্য)
(৪৩) প্রমিত হোসেন, (অনুবাদ)
(৪৪) রাজা হাসান, (কবিতা)
(৪৫) শামশেত তাবরেজী, (কবিতা)
(৪৬) খালেদ হামিদী, (কবিতা)
(৪৭) মানবর্ধন পাল, (প্রবন্ধ-গবেষণা)
(৪৮) আকমল হোসেম নিপু, (কথাসাহিত্য)
(৪৯) তারিক উল ইসলাম, (কবিতা)
(৫০) পাবলো শাহী, কবিতা)
(৫১) সিরাজুদ্দৌলা বাহার (কবিতা)
(৫২) জাহাঙ্গীর আলম জাহান (শিশুসাহিত্য)
আরেকটু দীর্ঘ করা যেত তালিকাটি। তারপরও মনে হতো, আর কেউ বাদ পড়লেন না তো? কোথাও না কোথাও থামতে হয়। সেই থামাথামি ‘৫২’য় হলে তার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। কেননা বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রাণের মেলা যেমন ‘একুশের বইমেলা’ প্রাণের সংখ্যা তেমনি ৫২ ও ৭১।
ড. ক্ষুদিরাম দাস ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে মনিরা কায়েস ও অমর মিত্রের দুটি অন্যরকম পুরস্কারপ্রাপ্তির আখ্যান সুবাদে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের কথা এলেও তার সঙ্গে এই তালিকার সম্পর্ক গৌণ। এটি তৈরি করেছি নিজের সমকালের গুণীদের এবং অনাগতকালের প্রাবন্ধিক-গবেষকদের প্রতি দায়বোধ থেকে। বলাবাহুল্য, একজনের পাঠসূত্রে এ জাতীয় তালিকার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা অনূর্ধ্ব আট আনা। নিজের সমকাল হওয়ায় এবং ওই কালখণ্ডে এপার-ওপার দুপার বাংলায় পাঠকনন্দিত সাহিত্য সাময়িকী ‘খোলা জানালা’ সম্পাদনাকালীন অনুসন্ধিৎসু জানাজানির কারণে তালিকাটির গ্রহণযোগ্যতা যদি কিঞ্চিৎ বেশিও দাবি করি, তা-ও অনূর্ধ্ব দশ আনা। দশ আনাই হোক কিংবা আট আনা, এ প্রসঙ্গে জোরগলায় শুধু এতটুকুই বলতে পারি—সরকারনৈতিক, আমলানৈতিক, সম্পর্কনৈতিক ইত্যাদি অনৈতিক বাহুল্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের তালিকায় ফিবছর যেমন এক বা একাধিক ভুঁইফোড় কবি-লেখকের নাম থাকে, এ তালিকায় তেমন একজনেরও নাম নেই।
ইতোমধ্যে একুশ শতাব্দীর দুই যুগ অতিক্রান্ত হতে চলেছে। এই কালখণ্ডে কৃত্যগুণে ওইরকম একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি রাখেন, এমন অনেকে চলে এসেছেন। প্রজন্মগত দূরত্ব, কোনও অনুসন্ধিৎসু সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত না-থাকা ইত্যাদি কারণে তাদের নিয়ে ওইরকম একটি তালিকা তৈরি করলে তার গ্রহণযোগ্যতা বড়জোর অনূর্ধ্ব পাঁচ আনা হবে বলে তা থেকে বিরত থাকছি। তার মানে এই নয়, তাদের কারও নাম নিতেও অন্য অনেকের মতো কার্পণ্য করব। এই দুই যুগে যাদের লেখা পড়ে একাধিকবার মুগ্ধ হয়েছি, তাৎক্ষণিক স্মৃতিচারণে তাদের কয়েকজনের নাম নিয়ে গদ্যটিকে একপশলা প্রেমে সিক্ত করি—
কবিতা: রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, ব্রাত্য রাইসু, মিজান খন্দকার, সরকার আমিন, খোকন মাহমুদ, জফির সেতু, কামরুজ্জামান কামু, মতিন রায়হান, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, হাদিউল ইসলাম, মাহবুব কবির, তপন বাগচী, মুজিব মেহদী, হেনরি স্বপন, রনজু রাইম, তুষার কবির, কাজল কানন, নয়ন আহমেদ, শাহেদ কায়েস, বীরেন মুখার্জী, আলফ্রেড খোকন, সাকিরা পারভীন, আহমেদ শিপলু, অনার্য মামুন, মোহাম্মদ হোসাইন, কাজী নাসির মামুন, মিলু শামস, এহসান হাবিব, কুমার দীপ, সাঈফ ইবনে রফিক, শামীম আহমেদ, রিঙকু অনিমিখ, হেনরি লুইস, আল মাকসুদ, পিয়াস মজিদ, সারাফ নাওয়ার, ফারহানা আনন্দময়ী, আখতার জামান, কুশল ভৌমিক, কাজী শোয়েব শাবাব; নজরুল মোহাম্মদ; কথাসাহিত্য : প্রশান্ত মৃধা, আহমেদ মোস্তফা কামাল, মুস্তাফিজ কারিগর, স্বকৃত নোমান, সৈকত আরেফিন, রঞ্জনা ব্যানার্জী, মাজহার সরকার; প্রবন্ধ : হামীম কামরুল হক, কাজী মহম্মদ আশরাফ, আর রাজী, মোহাম্মদ নূরুল হক; শাবিহ মাহমুদ, মাওলা প্রিন্স; শিশুসাহিত্য : মাহবুবা হক কুমকুম, হাসনাত আমজাদ, আশরাফুল আলম পিনটু, সৈয়দ সায়েম, সোহেল মল্লিক; অনুবাদ : মুম রহমান, রাজিয়া সুলতানা; সামগ্রিক: হাসানআল আব্দুল্লাহ, আবিদ ফায়সাল; ভ্রমণকাহিনি : আশফাকুজ্জামান উজ্জ্বল; নাটক : সুফি সুফিয়ান।
আমার কবিতা বিষয়ক গদ্যে-প্রবন্ধে উল্লিখিত অনুজদের অনেকের কথা ব্যাখ্যা-দৃষ্টান্তসহ এসেছে। রহমান হেনরীর কবিতাবিশদে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রবন্ধও আছে ‘প্রজ্ঞার প্রতিস্বর : রহমান হেনরির কবিতা’ শিরোনামে । তপন বাগচীর পঞ্চাশ পূর্তিতেও এরকম একটি গদ্য লিখেছি।
‘কবিতার বাঁক অথবা বাংলা কবিতার ৫০ বছর’ শিরোনামের প্রবন্ধটি পড়ে পাঠে কুবের প্রাবন্ধিক-চিন্তক-সম্পাদক কাজী মহম্মদ আশরাফ এক চিঠিতে লিখেছিলেন—‘‘আপনার এই বিশাল প্রবন্ধের ব্যাপারে একটা লক্ষণীয় বিষয় এই যে, বিনয়বশত, নিজের কথা অনুল্লেখ করেছেন। অন্তত নির্মোহ ভাবে কিছু কথা বলা উচিত ছিল আপনার কবিতা সম্পর্কে।” প্রত্যুত্তরে কাজী মহম্মদ আশরাফকে কী লিখেছিলাম, মনে নেই। অনুমান—আমার কবিতার ‘লাগে না পদক-খ্যাতি যদি থাকে লেখার শ্রাবণ’ বা ‘লোকসানে যার প্রাপ্তি তাকে মেলাবে কোন হালখাতাতে’ পঙ্ক্তির সমার্থক কিছু বলেছিলাম।
চিরকালের দীক্ষিত পাঠক কবিতার মতো কবির জীবনাচারেও স্বাতন্ত্র্য আশা করেন। বাংলা কবিতার চলমান সমকালে দুরকম স্বাতন্ত্র্যেরই দুর্ভিক্ষ চলছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি দুটোকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তাই যে-ধরনের প্রাপ্তিতে আমি অনূর্ধ্ব ত্রিশে উদ্দীপ্ত হতাম, ষাটোর্ধ্ব বয়সেও হই। তাকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ তাবৎ পদক-পুরস্কারের চেয়ে বড়ো মনে করি। তেমন তিনটি প্রাপ্তির নমুনা।
প্রথম নমুনাটি বাংলা সংবাদপত্রে নতুন বাঁকের রচয়িতা নাঈমুল ইসলাম খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা প্রণম্য বাচিকশিল্পী আশরাফুল আলমের একটি মন্তব্যসূত্রে প্রাপ্ত—”একজন মানুষ গতানুগতিক স্রোতকে অমান্য করে তার নিজের গড়া পথে হাঁটতে ভালবাসে। সেই একজনের নাম আবু হাসান শাহরিয়ার । তাকে নিয়ে লেখার জন্য অভিনন্দন ।”
*দ্বিতীয় নমুনাটি বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক লোকসংস্কৃতিবিদ শামসুজ্জামান খানের অনুরোধে ঢেঁকি গেলার কারণে লজ্জাজনক পরিস্থিতির শিকার হলে পুষ্কর দাশগুপ্তের ক্ষুদেবার্তাসূত্রে প্রাপ্ত—”আমি সবই জানি, সবই বুঝি। সাধারণভাবে আমাদের অবস্থা সব দিক থেকেই দরিদ্র। আর সরকারি দাক্ষিণ্য বা ওপরওয়ালাদের বদান্যতার জন্য কত প্যাঁচ কষা, কত দলাদলি! মাংসের টুকরো কম, তাই কুকুরদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। মাথা উঁচু করে যেভাবে রয়েছ, সেভাবেই সম্মান পাবে ভালোবাসা পাবে।”
তৃতীয় নমুনাটি পাঠে-কণ্ঠে কুবের অনুজপ্রতিম বাচিকশিল্পী মজুমদার বিপ্লবকৃত জন্মদিনের খোলাচিঠিসূত্রে প্রাপ্ত—”আবু হাসান শাহরিয়ারকে পছন্দ করি তাঁর স্পষ্টভাষিতার জন্য। সমীহ করে চলি ‘দুর্বাশা মুনি’র মতো তাঁর মেজাজ-মর্জি, সংবেদনশীলতাকে। একজন লেখক, সম্পাদক ও নন্দিত মানুষ হিসেবে সমকালীন সমাজ-পরিবেশ-প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা আমাদের বোধের মর্মমূলে আঘাত হানে প্রতিনিয়ত—তাঁর মেধাদীপ্ত, ক্ষুরধারসম্পন্ন লেখায় আমরা তাড়িত হই। একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে অন্য সবার মতো আমিও উপলব্ধি করি নিজের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে। কবির ঐতিহ্যসচেতন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে আমি খুঁজে পাই নিজস্ব শিল্পরুচির প্রতিফলন। বাংলা কবিতার চিরায়ত ধারাকে তিনি বহন করে চলেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। নিরন্তর সাধনায় নিজেকেও বিনির্মাণ করে চলেছেন উত্তোরত্তর আধুনিক হিসেবে।”
অনুচ্ছেদ-৫ : ব্যক্তিক নিজের কবিতার নিরিখে এক পশলা নৈর্ব্যক্তিক বলাবলি
“সামনে কুয়াশা
পেছনে কুয়াশা
মাঝখানে স্পষ্ট এই আমি।
তবুও
সামনে যে আছে
—তার কাছে
পেছনে যে আছে
—তার কাছে
আমিও কুয়াশা”
‘কুয়াশা’ নামের এই কবিতা মানুষের সব জানাজানির চিরবর্তমান চরিত্র। কবিতাটি ‘অজানায় শুরু না-জানায় শেষ’ কবিতাগ্রন্থের জনক সুজিত সরকারের, যিনি “দেয়াল তুললেই ঘর/ভেঙ্গে ফেললেই পৃথিবী’র মতো অসংখ্য মহার্ঘ পঙ্ক্তি ও পঙ্ক্তিগুচ্ছে ঋদ্ধ করেছেন বাংলা কবিতাকে এবং এখনও করে চলেছেন। প্রথম অনুচ্ছেদের আলোচনায় তার দুটি গদ্যগ্রন্থের কথা এসেছে। হ্যাঁ, শঙ্খ ঘোষের পর যে-দুজন কবি-সমালোচকের কবিতা বিষয়ক গদ্যকে আমি সর্বাধিক মান্যতা দিই, সুজিত সরকার তাদের একজন। চতুর্থ পর্বের প্রচ্ছন্ন প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ব্যক্তিক নিজের কবিতার নিরিখে কবিতা প্রাসঙ্গিক কিছু নৈর্ব্যক্তিক বলাবলি’। স্বভাষ্যে নয়; পরভাষ্যে। সুজিত সরকারভাষ্যে। কবিতার সমলোচনা কী কবিতা বিষয়ক গদ্য-প্রবন্ধ-সমালোচন কত কী অনুষঙ্গে লেখকের পূর্বপ্রস্তুতি দাবি করে, সুজিত সরকারের লেখা “কবি আবু হাসান শাহরিয়ার আমার ‘মনের মানুষ'” শিরোনামের দীর্ঘ প্রবন্ধটি তার উৎকৃষ্ট নমুনা। সেখান থেকে উদ্ধারকৃত নিচের অংশবিশেষই চতুর্থ পর্বের শেষ অনুচ্ছেদের বলাবলি—
“… আমি তখন কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের গদ্যগ্রন্থ ‘কবিতার প্রান্তকথা’ সবে শেষ করেছি। কবিতা বিষয়ক গদ্য কীভাবে লেখা উচিত, সে বিষয়ে আমার নিজস্ব একটি ধারণা আছে। শাহরিয়ারের গদ্যগ্রন্থটিতে আমার সেই ব্যক্তিগত ধারণার সমর্থন খুঁজে পাওয়ার বইটির কথা সকলকে জানানোর এক প্রবল তাগিদ আমি নিজের ভেতরে অনুভব করতে থাকি। […] আমার আলোচনায় আমি দেখিয়েছিলাম গ্রন্থটি দশটি গদ্যের সংকলন হলেও পড়তে পড়তে মনে হয় যেন একটিই গদ্য পড়ছি যেখানে হাজার বছরের বাংলা কবিতাকে কোথাও কোথাও ছুঁয়ে যায় বিশ্বকবিতা, কলকাতা আর ঢাকার মাঝখানে থাকে না কোনো সীমারেখা, কোনো কাঁটাতার, যেখানে কবেকার রূপসী গ্রিক কবি সাফোর কথা বলতে শুরু করে…কবেকার চর্যাপদ আর এখনকার ফুকোর দর্শন প্রায় পাশাপাশি জায়গা করে নেয় […] কোনো অকবি অধ্যাপকের গুরুভার আলোচনা নয়, যেন ঢাকার শাহবাগ আজিজ মার্কেটে দাঁড়িয়ে তরুণ কবিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছেন আবু হাসান শাহরিয়ার। […] শাহরিয়ারের কবিতা নিয়ে দু’-চার কথা লিখতে চাই, অথচ তাঁর গদ্যের কথাই বলছি। তাঁর গদ্যের সঙ্গে পরিচয়া ঘটার অনেক আগেই তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। আমি প্রথম থেকেই তাঁর কবিতার এক মনোযোগী ও মুগ্ধ পাঠক। […] তিনি আমার ভাষারই কবি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নন, বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সব কবির কবিতা আমি পড়িনি, তবে প্রধান কবিদের কবিতা অবশ্যই পড়েছি। আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা পড়ে তাকে আমার ‘আপনজন’ মনে হয়েছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের পরে তিনিই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি। একজন ভালো কবির যা যা গুণ থাকা দরকার সব ক’টি গুণই আমি আবু হাসান শাহরিয়ারের মধ্যে লক্ষ করেছি। তাঁর কবিতা মেধা ও আবেগের এক সার্থক সমন্বয়:
“বাংলাদেশ বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। ওকে
অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে
ভূত সেজে ভয় দেখিও না
ওর বুক ধড়ফড় করে।
তোমাদের একটুও কাণ্ডজ্ঞান নেই
অকস্মাৎ একেকটা ঘটনা ঘটিয়ে বসো, আর
মেয়েটার চোখ, মুখ, সমস্ত শরীর
প্রস্ফুটিত লাবণ্য হারায়।
ও বড়ো আহ্লাদী মেয়ে
সবুজ ফিতেয় চুল বেঁধে প্রতিদিন
পা দোলায় বঙ্গোপসাগরে।
জল, পলিমাটি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে।
কারও সঙ্গে বিরোধ করে না।
তোমরাও বিরক্ত কোরো না ওকে। ওর
খেলার সংসার
তছনছ করে দিয়ে উধাও হয়ো না।
ফের সব সিজিল-মিছিল ক’রে ওঠা
একরত্তি মেয়েটার পক্ষে খুব কষ্টকর কাজ।
বাংলাদেশ বড়ো শান্ত মেয়ে
কারও সঙ্গে খুনসুটি করে না কখনও
নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসে।
কেউ ওকে চুল টেনে ঢিল ছুড়ে বিরক্ত কোরো না।
অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে
ভূত সেজে ভয় দেখিও না।”
কবিতাটির নাম ‘বাংলাদেশ’। শাহরিয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্তহীন মায়াবী ভ্রমণ’-এর অন্তগর্ত। বলা যেতে পারে, সূচনা পর্বের এই কবিতাটির মাধ্যমেই বাংলাদেশের কবি সমাজে শাহরিয়ারের আবির্ভাব ঘটেছিল, এই কবিতাটিই স্বদেশে তাঁর বিপুল কবিখ্যাতির প্রথম সোপান। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে, প্রথম কবিতা প্রকাশের নয় বছর পরে। এর আগে প্রকাশিত হয়ে গেছে একটি ছোটগল্পের বই, একটি ছড়ার বই। তাহলে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরে কাব্যগ্রন্থ-প্রকাশে এত বিলম্বের কারণ কী? এর উত্তর পেলাম শাহরিয়ারের একটি সাক্ষাৎকার থেকে: ‘আমি আত্মপ্রকাশের চেয়ে আত্মপ্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছিলাম বেশি।’ এই প্রস্তুতিতে সত্যিই যে কোনো ফাঁকি ছিল না, আত্মপ্রতারণা ছিল না তা আজ শুধু বাংলাদেশের কবিতাপাঠকের কাছেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের কবিতাপাঠকের কাছেও সুবিদিত। […] উল্লিখিত কবিতাটি আরো একবার মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করুন। ভাষা কি স্বচ্ছ, সাবলীল। একটি পঙ্ক্তিও মনে হয় না চেষ্টা করে ভেবে ভেবে লিখতে হয়েছে। কবিতার সংজ্ঞা হিসেবে ওয়র্ডস্ওয়র্থের যে কথাটি অধ্যাপক ও সমালোচকেরা প্রায়শই ব্যবহার করে থাকেন ‘Spontaneous overflow of powerful feelings’ সেটি আমার বেশ পছন্দ। কিন্তু ওয়র্ডস্ওয়র্থ যেটি বলেননি, অথচ যে কোনো ভালো কবিতার ক্ষেত্রেই যেটি অত্যন্ত জরুরি, সেটি হল কবির নির্মাণদক্ষতা। নির্মাণদক্ষ কবি বলতে আমি সেই কবিকে বুঝি যিনি ভাষার সাবলীলতার আড়ালে কলাকৌশলকে গোপন করতে জানেন। ‘বাংলাদেশ’ কবিতাটি অক্ষরবৃত্তে লেখা। কিন্তু সেই অক্ষরবৃত্তে ছন্দের ব্যবহারে এমন এক সাবলীলতা আছে যে পড়ার সময়ে খেয়ালই থাকে না কবিতাটি ছন্দে লেখা হয়েছে। দীর্ঘদিন কবিতা লেখার পরে ভাষার এই মসৃণতা আনা যায়। অথচ শাহরিয়ার তাঁর এই সহজাত দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন প্রথম কাব্যগ্রন্থেই। তাছাড়া বড় কবির আরো একটি লক্ষণ হল যে কোনো জটিল বিষয়কেই সহজভাবে প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা। [… ]‘বাংলাদেশ বড় মেয়ে/-কারও সঙ্গে খুনসুটি করে না কখনো/নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে ভালোবাসে/কেউ ওকে চুল টেনে ঢিল ছুড়ে বিরক্ত কোরো না।/অন্ধকার জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে/ভূত সেজে ভয় দেখিও না।’ মনে কি হয় না স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নানাবিধ সমস্যা শাহরিয়ার কেমন সহজে বলে দিয়েছেন? তাছাড়া, বাংলাদেশকে ছোট একরত্তি মেয়ে হিসেবে কল্পনা করার মধ্যেও যথেষ্ট অভিনবত্ব আছে, যে মেয়ে সবুজ ফিতে দিয়ে চুল বেঁধে ‘পা দোলায় বঙ্গোপসাগরে।’ ভাবা যায়, প্রথম কাব্যগ্রন্থেই একজন কবি এতটা পরিণত। ‘কবিতার প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে আমি আত্মপ্রকাশের চেয়ে আত্মপ্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছিলাম বেশি।’ এই কথার ভেতরে সত্যিই যে কোনো অতিশয়োক্তি নেই, আত্মাভিমান নেই তা এতক্ষণে অনেকের কাছেই পরিষ্কার। হ্যাঁ, কবি হিসেবে শাহরিয়ার বড় বেশি সৎ।
‘সমাত্মজীবনী’ নামে আবু হাসান শাহরিয়ারের একটি বই আছে। [… ] লেখালেখিকে শাহরিয়ার বলেন ‘সমাত্মজীবনী’, কবিতাকে বলেন ‘একার সন্ন্যাস’ এবং কোনো গ্রন্থের ভূমিকা অংশটিকে বলেন ‘আঁতুড়কথন’।…শাহরিয়ারের বাবা ছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও সরকারি কলেজের অধ্যাপক। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে জমিতে মই দিয়েছেন, পাট চাষ করেছেন, আলু-টমেটোর ক্ষেত পরিচর্যা ছাড়াও লাউ-কুমড়োর ফুলে পরাগায়নেরও হাতেকলমে পাঠ নিয়েছেন। শেক্সপিয়রের সনেট সম্পর্কে ওয়র্ডস্ওয়র্থের সেই বিখ্যাত উক্তিকে অনুকরণ করেই বলতে ইচ্ছে করছে, ‘সমাত্মজীবনী’ সেই চাবি যার সাহায্যে শাহরিয়ার তাঁর হৃদয়-দুয়ার উন্মুক্ত করেছেন: ‘গ্রামে গেলে আমি মানুষ থাকি না; গাছ হয়ে যাই! ঘাটের হিজল আর হাওরের ম্যাড়াকে মনে হয় আমার মাটি-সহোদরা।… এবার আমরা পড়ে নিতে পারি ‘একলব্যের পুনরুত্থান’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘মাটি-বংশধর’ কবিতাটি:
“আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা
আমার বাপের নাম কে না জানে চাষা-মালকোঁচা
আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত নি¤œজনা
ধুতি-গোয়ালারা জ্ঞাতি, আরো জ্ঞাতি খড়ম-তাঁতিরা
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা।
বারোভাজা তেরোভাজা তোমাদের তেলেভাজা বুদ্ধি-বিবেচনা
আমাকে ছোঁবে না আমি কাঁচা মাছে, পোড়া মাংসে বাঁচি
আমার বউয়ের নাম কাঁচাসোনা, তোমাদের মতো বুকে কাঁচুলি পরে না
স্তনে মুখ ঘষে দিয়ে চলে আসি, ঝাঁপিখোলা-ঝাঁপিবন্ধ নেই।
মাটি ভাষাভাষী শস্য, লতাগুল্ম, বৃক্ষ, বনরাজি
আমাকে শেখায় বীজমন্ত্র আমি শরীরের মাটিভাষা জানি
মাটি মাতৃভাষা আমি সে ভাষায় সোঁদাগন্ধ পুথি পাঠ করি
যা পড়ি শেকড়ে পড়ি, বাকলে লিখি না নাম তর্জমাবশত।
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, জন্ম মাটি-বংশধরে
মুখে খিস্তি-খেউড়ের দোচোয়ানি, ব্যাকরণে ঢেঁকুর তুলি না।”
‘মাটি-বংশধর’ যিনি লেখেন তিনি যে একদিন ‘কাগজবৃত্তান্ত’ লিখবেন তা যেন গাছপালা বেড়ে ওঠার মতোই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। কবিতাটি ‘এ বছর পাখি বন্যা হবে’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত:
এক সময় আমরা ভূর্জপত্রে পুথি লিখেছি
তারপর প্যাপিরাসের বাকল থেকে এল কাগজ
একখণ্ড শাদা কাগজের জন্য এখনো আমরা বাঁশঝাড় উজাড় করি
মানুষ কাগজে কী লেখে, যা গাছের পাতা ও বাকলে নেই?”
আরো পরে, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’ কাব্যগ্রন্থেও এই কবিকে আমরা তাই বলতে দেখব ‘আমার সকল পাঠ গাছের হরিৎ থেকে নেয়া’ কিংবা ‘আমার সকল ভাষা গাছের শিকড়ে লেখা আছে।’ যে কবি গ্রামে গেলেই আর মানুষ থাকেন না, গাছ হয়ে যান তিনি তো এমন কথা বলবেনই।
অসামান্য সব প্রেমের কবিতা লিখেছেন আবু হাসান শাহরিয়ার। একজন অভিজ্ঞ কবিতা পাঠক হিসেবে এটুকু বুঝেছি যে অধিকাংশ প্রেমের কবিতায় থাকে অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের প্রাধান্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নীরাকে বাসস্টপে তিন মিনিট দেখে কবিতায় লেখেন ‘এক বছর ঘুমোব না’, আর সুধীন্দ্রনাথের এই লাইনদুটি তো অনিয়মিত কবিতা পাঠকেরও অজানা নেই আর: ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে/ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী।’ আবু হাসান শাহরিয়ারের পুরো একটি কবিতাই অতিশয়োক্তি অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে গণ্য হতে পারে। কবিতাটির নাম ‘তুলাদণ্ড’, শাহরিয়ারের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অব্যর্থ আঙুল’-এর অন্তর্গত:
“তোমার চোখের চেয়ে বেশি নীল অন্য কোনও আকাশ ছিল না
যেখানে উড়াল দিতে পারি
তোমার স্পর্শের চেয়ে সুগভীর অন্য কোনও সমুদ্র ছিল না
যেখানে তলিয়ে যেতে পারি
তোমাকে দেখার চেয়ে নির্মিমেষ অন্য কোনও দ্রষ্টব্য ছিল না
যেখানে নিমগ্ন হতে পারি।
তোমাকে খোঁজার চেয়ে বেশি দূর অন্য কোনও গন্তব্য ছিল না
যেখানে হারিয়ে যেতে পারি।
কেবল তোমার চেয়ে বেশি দীর্ঘ তুমিহীন একাকী জীবন।”
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান বলেছেন: ‘আবু হাসান শাহরিয়ার, সত্তর দশকে যার আবির্ভাব, আমার অত্যন্ত প্রিয়জনই শুধু নন, আমি তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠকও। তাকে আমাদের দেশের একজন অগ্রগণ্য কবি বলে মনে করি। তিনি পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান এবং সর্বোপরি মেধাবী। বিভিন্ন কবিতায় তিনি তাঁর কবিত্বশক্তির নির্ভুল স্বাক্ষর রেখেছেন। সবচেয়ে প্রশংসনীয় বিষয় হচ্ছে, এই কবি ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে চলেছেন কি বিষয়নির্বাচনে, কি প্রকাশভঙ্গিতে।’ ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে চলার এই পরিচয় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় দু’ হাজার দুই থেকে দু’ হাজার চারের মধ্যে প্রকাশিত তিনটি কাব্যগ্রন্থে ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’, ‘হাটে গেছে জড়বস্তুবাদ’ এবং ‘সে থাকে বিস্তর মনে বিশদ পরানে।’[…] বিষয়ের দিক থেকে যেমন এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনই এই তিনটি কাব্যগ্রন্থে শাহরিয়ার নিজস্ব একটি আঙ্গিক প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছেন। অতীত ও বর্তমানের বিভাজনের-রেখা মুছে গিয়ে মহাকাল ও সমকাল মিলেমিশে হয়ে উঠেছে চিরবর্তমান। আবার, আঙ্গিকেও রয়েছে অভিনবত্ব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কবিতাগুলি টানা গদ্যে লেখা, কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় প্রতিটি গদ্যই অক্ষরবৃত্তে রচিত, উপরন্তু শেষ দুটি বাক্যে রয়েছে অন্ত্যমিল:
বিষয় নির্বাচনে প্রকাশভঙ্গিতে শাহরিয়ারের ‘ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করা’র কথা বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রাহমান। ‘ফিরে আসে হরপ্পার চাঁদ’ পড়তে পড়তে বিস্মিত পাঠক লক্ষ করেন চারু মজুমদার, টোডাকন্যা, জাতিসংঘ, সক্রেটিস, প্লেটো, সাফো, গোপবালিকা, ব্রজের রাখাল, বড়ু চণ্ডীদাস, বাৎস্যায়ন, মাল্টিন্যাশনাল চাঁদ, ফেমিনিস্ট রাধা, এয়ার হোস্টেস মেঘ, শিব, দ্রৌপদী, উপনিষদ, হরপ্পার শিলালিপি, ফুকো, হার্ডডিস্ক-মন, কালিদাস, মিডিয়ার ম্যানিপুলেশন সব যেন মিলেমিশে এক পোস্টমডার্ন পৃথিবী গড়ে তুলেছে, যেখানে পুরান-দর্শন-ইতিহাস যেন আলাদা আলাদা কিছু নয়, সব নিয়ে এক, আর তাই ‘হাওড়ের চন্দ্রাবতী ঢাকার ফ্যাশন-শোয়ে নাচে।’ […]
‘সমাত্মজীবনী’র সঙ্গে সঙ্গে ‘বালিকা আশ্রম’ কাব্যগ্রন্থটিও রচিত হচ্ছিল সমান্তরালভাবে। শাহরিয়ার বলেছেন, ‘গদ্যে-পদ্যে বই দুটি আসলে যমজ ভাইবোন।’… আমার বিবেচনায় ‘বালিকা আশ্রম’ শাহরিয়ারের শ্রেষ্ঠ বই।… ‘সমাত্মজীবনী’তে যখন লিখেছেন ‘পানীয় জলও যে কিনে খাওয়ার বস্তু হবে কোনও একদিন, অর্ধশতাব্দীকাল আগেও পৃথিবীর মানুষ তা কল্পনা করতে পারেনি।… ভয় হচ্ছে, জোছনার ওপরও না প্রমোদকর বসিয়ে দেয় মুক্তবাজারিরা। মানুষের গান টিকিট কেটে শুনতে হয়। কিন্তু পাখিরা সুরের মজুরি চায় না। নদীও কখনও ঢেউবিল ধরিয়ে দেয় না হাতে৷… তখন পাশাপাশি ‘বালিকা আশ্রম’-এ লিখেছেন:
“আবারও কে কড়া নাড়ে? কে দাঁড়ায় স্বার্থপর পায়ে?
বিল-হাতে হকার ছেলেটা? তার মানে
মাস ঘুরে গেছে। ছেলেটাকে
ক্যালেন্ডারও বলা যেতে পারে।
এভাবে জ্যোৎস্নাও যদি বিল হাতে
দরজায় দাঁড়ায়? রৌদ্রবিল আসে যদি
বিদ্যুতের বিলের বদলে?
গাছ যদি ছায়াবিল, নদী যদি ঢেউবিল,
পাখি যদি সুরের মজুরি চেয়ে বসে?
অনেক বকেয়া বিল পড়ে আছে মতিহার সবুজের মাঠে।
শ্রমের মজুরি ছাড়া খোলাচুলে বয়ে গেছে অনেক বাতাস।
এখনও পদ্মার বাঁধে নাজাতের খালিবাড়ি ছুঁয়ে
অনেক দুপুর একা লালনের মঠে চলে যায়।
অনেক রিকশার চেন পড়ে যায় মন্নুজান হল যদি ডাকে।
তখন চিঠির ভাঁজে অনেক নদীর ঢেউ গুঁজে
বিজন স্টেশনে একা থেমে থাকে বেণীবাঁধা বালিকা এক্সপ্রেস।”
আবারো বলি, শাহরিয়ারের কবিজীবনের শ্রেষ্ঠ ফসল এই কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ভারি সুন্দর একটি আলোচনা করেছেন বাংলাদেশের এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এক কবি রহমান হেনরী। অন্তত একটি বাক্য উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না: ‘বালিকা আশ্রম হয়ে ওঠে আমাদের সময়ের এমন এক সোনালি দলিল, যার চেতনাবীজ ইতিহাসে প্রোথিত। যন্ত্রণাস্নাত স্মৃতি যার প্রকাশ্য ও আপাত অবলম্বন, ব্রাত্যজীবনের অনুদ্ঘাটিত রূপ-রস-সৌন্দর্য, এমনকি, শব্দাবলি যার নির্মাণ-উপাদান এবং চূড়ান্তে মহাজীবন ও মহাপৃথিবীর দিকে ধাবমান যার গতিমুখ।’
শাহরিয়ারের কবিতার জাদুতে দীর্ঘদিন মুগ্ধ হয়ে আছি। তার প্রতিটি নতুন কাব্যগ্রন্থ হাতে এসে পৌঁছয়। আর আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, তাঁর কবিতায় যে-তারুণ্য আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল একদিন, সেই তারুণ্য এখনো একই রকম, যেন ফুরোচ্ছেই না! এর কারণ কী? ভেবে দেখেছি, বিপুল অধ্যয়ন, নিরন্তর ভ্রমণ, বিরামহীন লিখে যাওয়া কবিতা, আর শামসুর রাহমানের সেই ‘ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়া’র কথা। দু’ হাজার আটে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘তোমাদের কাচের শহরে।’ শাহরিয়ারের পর আরো অনেক অনেক তরুণ কবি এসে গেছেন তাঁদের যৌবনদীপ্ত তেজ আর স্পর্ধা নিয়ে, তাঁদের অনেককেই আমি চিনি, কিন্তু বয়সে বড় হলেও শাহরিয়ার তাঁদের সকলের চেয়ে কবি হিসেবে অনেক বেশি তরুণ:
“আমি একটা অপ্রকাশিত কবিতার পিছু নিয়েছি, একটু আগেও যে আমার সঙ্গে ছিল
ঘড়িতে এখন চর্যাপদ বেজে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
এটা একটা দুপুরের পাণ্ডুলিপি, ছাপাখানায় যাওয়ার আগেই যার মৃত্যু হয়েছিল
ঘড়িতে এখন রবীন্দ্রনাথ বেজে তিরিশি কবিরা
যে দশকগুলো যুদ্ধে নিহত হয়েছে, তাদের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা যাক
ঘড়িতে এখন শাহবাগ বেজে আজিজ মার্কেট
এটা একটা সদ্য প্রকাশিত বিচ্ছেদ, এইমাত্র যে বাঁধাইখানা থেকে এসেছে
ঘড়িতে এখন অমাবস্যা বেজে কয়েকটা চিঠি”
লালন, রবীন্দ্রনাথ ও শঙ্খ ঘোষ শাহরিয়ারের ‘দীক্ষাগুরু’। তাঁর সঙ্গে খুব বেশি দেখা হয়নি আমার। […] শুধু একটা কথা অকপটে স্বীকার করে আমি এই লেখায় ইতি টানতে চাই। কবি আবু হাসান শাহরিয়ারকে আমি আমার পরমাত্মীয় হিসেবে বিবেচনা করি। তিনি আমার লালন-কথিত ‘মনের মানুষ’।